হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

পরিকল্পিতভাবে ও বিজ্ঞাসম্মত উপায়ে পুকুরে একই সাথে হাঁস ও মাছের চাষ করাকে সমন্বিত হাঁস ও মাছের চাষ বলে।আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু হাঁস-মুরগি পালনের পক্ষে অনুকুলে অসংখ্য নদী, নালা, খাল-বিল, পুকুর দিঘী ডোবা ও হাওড়ে মাছ চাষের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।

আবহমান কাল হতে এদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই হাঁস-মুরগি পালন করে আসছে। এদের বিষ্ঠা তেমন কোন উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয় না। সমন্বিত হাঁস ও মাছ চাষ পদ্ধতিতে হাঁসের বিষ্ঠা পুকুরে সঠিকভাবে প্রয়োগ করে দেশে মাছ উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।

সংগে সংগে মাংস ও ডিমের উৎপাদনও বৃদ্ধি সম্ভব। হাঁস ও মাছ একত্রে চাষ পদ্ধতিতে হাঁসকে যে খাদ্য দেওয়া হয় তার উচ্ছিষ্ট এবং হাঁসের বিষ্ঠা মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়। এ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত কোন খাদ্য বা সার প্রয়োগ ছাড়াই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বাড়তি আয় করা যায়।

একই জায়গা দুটি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। অধিকন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের সীমিত জমিতে অধিক উৎপাদন করে খাদ্য এবং পুষ্টির চাহিদা মিটাবার পথ সুগম হয়। এ পদ্ধতিতে মাছের সাথে হাঁসের পরিবর্তে মুরগি অথবা হাঁস ও মুরগি মাছ একত্রে পালন করে বেশ লাভবান হওয়া যায়।

পুকুরে হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষের সুবিধাসমূহ

১। একই ব্যবস্থাপনায় একই জমিতে লাভজনকভাবে মাংস, ডিম এবং মাছ উৎপাদন করা যায়।

২। হাঁসের বিষ্ঠা একটি উৎকৃষ্ট জৈবসার এবং মাছের সুষম খাদ্য। পুকুরে হাঁস ও মাছ একত্রে চাষ করলে মাছের জন্য কোন বাড়তি বা আলাদা খাদ্য দিতে হয় না।

৩। অব্যবহৃত ও পানিতে পড়ে যাওয়া হাঁসের খাদ্য মাছের সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

৪। মাছ হাঁসের বিষ্ঠা সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।

৫। হাঁস পুকুরের শামুক-ঝিনুক ইত্যাদি খেয়ে ফেলে। ফলে মাছকে আক্রান্ত করে এমন কিছু পরজীবীর জীবনচক্র নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া হাঁস মশা ও অন্যান্য জলজ পোকা খেয়ে পুকুরের পরিবেশ ভালো রাখে।

৬। হাঁস পুকুরে সাঁতার কাটার সময় বাতাস থেকে অক্সিজেন পানিতে মিশে যায়। এই অক্সিজেন মাছের জন্য খুবই প্রয়োজন।

৭। খাদ্যের অন্বেষণে হাঁস পানিতে ডুব দিয়ে পুকুরের তলায় মাটি নাড়াচাড়া করে মাটির সারবস্তু পানিতে মিশিয়ে দেয়। ফলে পানির উৎপাদিকা শক্তি বেড়ে যায়। মাটিতে জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসও বের হয়ে আসে।

৮। পুকুরের পাড়ে বা পানির উপর হাঁসের ঘর তৈরি করা যায়। ফলে হাঁস পালনের জন্য আলাদা জায়গার প্রয়োজন হয় না।

৯। হাঁস ও মাছ একত্রে চাষ করলে উভয়ের দেখাশুনার জন্য আলাদা লোকের প্রয়োজন হয় না, ফলে শ্রমিক খরচ কম হয়।

১০। পুকুরের জলজ আগাছা দমনে হাঁস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১১। গোবর, খইল, ইউরিয়া ইত্যাদি যে সব সার মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হত সেগুলো শস্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করে কৃষকের আয় বাড়ানো যায়।

হাঁসের ঘর

পুকুরে হাঁসের ঘর তৈরি করা যেতে পারে। বাঁশ, শুকানো খড় গোল পাতা অথবা টিন হাঁসের ঘর তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণত প্রতিটি হাঁসের জন্য ০.২৭ বর্গমিটার জায়গার দরকার হয়। ঘরের উচ্চতা ১.৫ থেকে ১.৮ মিটার হলে চলে।

ঘরে যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। পুকুরের পাড় থেকে ১.৮ থেকে ২.০ মিটার ভিতরে পানিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘর তৈরি করা যায়। বাঁশ দ্বারা মেঝে তৈরি করা যায়। মেঝের বাতাগুলোর একটি থেকে অন্যটিকে দূরত্ব ১ সেন্টিমিটার দেওয়া উচিত।

এতে হাঁসের বিষ্ঠা ও পাত্র হতে পড়ে যাওয়া খাদ্য সরাসরি পানিতে পড়ে যাবে। ঘরের মেঝে প্রতিদিন ১ বার পানি দ্বারা ধুয়ে দিলে আটকে থাকা খাদ্য ও বিষ্ঠা পুকুরে পড়ে যাবে। পুকুরের পানি হতে ঘরের মেঝে এমন উঁচু করতে হবে যাতে বর্ষাকালে পুকুরের পানির সর্বোচ্চ স্তরের ০.৬ থেকে ১ মিটার উপরে হয়।

পুকুরের পাড় হতে হাঁসের ঘরে যাওয়া আসার জন্য বাঁশের সিড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। সন্ধ্যায় সিঁড়ি ভুলে রাখলে বন্য প্রাণী বা চোরের উপদ্রব হতে রেহাই পাওয়া যাবে। হাঁসগুলো পুকুরে নেমে সাঁতার কাটা ও চারার জন্য। ঘরের এক পার্শ্বে একটি দরজা ও হেলানো বাঁশের তৈরি সিঁড়ি দিতে হয়। হাঁসের ঘরে প্রয়োজন মত খাবার ও পানির পাত্র এবং ডিম পাড়ার বাক্স দিতে হবে।

হাঁসের জাত নির্বাচন

সমন্বিত পদ্ধতিতে পুকুরে থাকি ক্যাম্পাশে, ইন্ডিয়ান রানার ও জিনডিং জাতের হাঁস পালন করার জন্য নির্বাচন করা হয়। উন্নত জাতের খাকি ক্যাম্পালে ও জিনডিং হাঁস বছরে ২০০- ২৫০ টি ডিম দেয়। এরা আমাদের পরিবেশেও ভালোভাবে টিকে থাকে। সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ মাস বয়সে এরা ডিম নিতে আরম্ভ করে।

প্রতি শতাংশ পুকুরে ২টি করে বা ৩৩ শতাংশের একটি পুকুরে ৬০-৭০টি হাঁস পালন করা যেতে পারে। এ সংখ্যক হাঁস পালন করলে পুকুরে কোন প্রকার সার বা মাছের জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহের প্রয়োজন হয় না। দুই হতে আড়াই বছর বয়স হয়ে গেলে হাঁসগুলো বিক্রি করে দিনের সমान সংগ্রহ করতে হবে। কেননা বয়স্ক হাঁসের ডিম উৎপাদন কমে যায়।

পুকুর প্রস্তুতকরণ

পুকুরে মাছ ছাড়া

পুকুর প্রস্তুতকরণ

মাছ ছাড়ার পূর্বে পুকুর থেকে শোল, বোয়াল, টাকি, গজার ইত্যাদি রাহুসে মাছ ধরে ফেলতে হবে। পানি নিষ্কাশন করে অথবা রোটেনন জাতীয় ওষুধ ৩৫ গ্রাম প্রতি শতাংশে ব্যবহার করে এ মাছ ধরা যায়। পুকুরের জলজ আগাছা শিকড়সহ তুলে ফেলতে হয়।

পুকুরের তলদেশ থেকে কানা, পচাপাতা, আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়। পুকুরের তলদেশ অসমান থাকলে সমান করতে হয়। পুকুরের পাড় উঁচু করে দিতে হয় এবং পাড়ে জঙ্গল থাকলে তা পরিষ্কার
করে আলো-বাতানের ব্যবস্থা করতে হবে। পুকুরের পানি নিষ্কাশনের পর প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ছিটিয়ে নিতে হয়। চুন দেওয়ার দিন পর পুকুরে মাছ ছাড়া যায়।

পুকুরে মাছ ছাড়া

সমন্বিত চাষ পদ্ধতিতে পুকুরে বিভিন্ন জাতের মাছ ছাড়তে হয়। সব জাতের মাছ একই ধরনের দানা খায় না। তাই পুকুরে তলায় পানির মধ্যভাগ এবং উপরিভাগের মানা যায় এমন প্রজাতির মাছ বাছাই করতে হয়। ৩০ শতাংশের একটি পুকুরে ৮-১০ সে.মি. আকারের ১০০০ বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ছাড়া যান। পোনা ছাড়ার হার কাতলা/ সিলভার কার্প মৃগেল / কাল বাউশ 80% গ্লাস কার্প ১০% এই পদ্ধতিতে বর্ণিত আকারের পুকুর থেকে বছরে ৬০০ কেজি মাছ ও ১২-১৫ হাজার ডিম উৎপাদন সম্ভব।

হাঁসের খাদ্য ব্যবস্থাপনা

হাঁসকে নিয়মিত সুষম দানা সরবরাহ করতে হবে। হাসের খাদ্য ও পানি আলাদা পাত্রে ঘরের মধ্যে নিতে হবে। খাদ্য ও প্রস্থ ১০-১২ সে.মি. গভীরতা বিশিষ্ট এলুমিনিয়াম, টিন অথবা প্লাস্টিকের তৈরি হলে ভালো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হাঁসকে দৈনিক ১৪০-১৫০ গ্রাম ধন্য নিতে হয়। পুকুরে যদি পোকামাকড় আগাছা, ঝিনুক ও শামুক থাকে তবে ১১০- ১২০ গ্রাম খানা দিলে চলবে। হাঁসের সুষম খাদ্যের তালিকা দেওয়া হলো :

হাঁসের সুষম খাদ্যের তালিকা

 

হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

হাঁসের ঘর সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খাদ্য ও পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। হাঁস সাধারণত শেষ রাতে বা ভোরে ডিম পাড়ে। কিছু কিছু হাঁস সকাল ৯ টার মধ্যে ডিম দিয়ে থাকে।

হাঁস পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। সারাদিন হাঁসকে মুক্ত অবস্থায় থাকতে দেওয়া উত্তম। সূর্যাস্তের পূর্বে হাঁসগুলোকে ঘরে তুলতে হবে। ডিম পাড়ার বারো কিছু পরিষ্কার পড় বা তুষ দিলে ডিমগুলো পরিষ্কার থাকবে। ডিম দেওয়া শুরু করার নেতৃ মাস পূর্বে ডিম পাড়ার বাক্স দেওয়া ভালো।

হাঁসের রোগ

হাঁসের সাধারণত রোগবালাই কম হয়। তবুও হাঁসকে নিয়মিত প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে। টিকা বীজ পশুসম্পদ অধিদপ্তরের স্থানীয় অফিসে পাওয়া যানা।

 

হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

 

হাঁসের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা

রোগের নাম

টিকা ও ওষুধের নাম

  • ১। ডাক প্লেগ ডাক প্লেগ টিকা

টিকা দেওয়ার সময় ও টিকা দেওয়ার নিয়ম

ক. জনের ১৫-২০ দিন দিন বয়সে ১ম বার। বুকের মাংসে ইনজেকশন হিসাবে

খ. ১ম বারের ১৫ দিন পর ২য় বার।

গ. এরপর প্রতি ৫-৬ মাস অন্তর

  • ২| ডাক কলেরা টিকা

ক. জন্মের দেড় মাস বয়সে ১ম বার বুকের চামড়ার নিচে ইনজেকশন হিসাবে

খ. ১ম মাত্রার ১৫ দিন পর ২য় বার

  • ৩। কৃমি রোগ

ইউভিলন, এভিপার ইত্যাদি ওষুধ

গ. এরপর প্রতি ৪-৫ মাস অন্তর

ক. ৩-৪ মাস বয়সে ১ম বার পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।

খ. এরপর ৬ মাস অন্তর অন্তর

 

হাঁস ও মাছের সমন্বিত চাষ

স্বাস্থ্য বিধি

১। হাঁসের ঘর সব সময় শুকনো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে

২। খাদ্য ও পানি পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।

৩। অসুস্থ হাঁসকে আলাদা করে ফেলতে হবে।

৪। মৃত হাঁস মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।

৫। রোগ দেখা দিলে দ্রুত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সারমর্ম

• পুকুরে প্রতি শতাংশে ২ টি হাঁস পালন করা যায়।
• হাঁসের ঘর পুকুরের পাড়ে বা পানির উপর করা যায়।

Leave a Comment