চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৩ , পাঠ -৩.৪।

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

 

পুকুরে খাদ্য সরবরাহ :

পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকলে অধিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ করতে হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি পরিমাণ থাকলে কম পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। পুকুরের পানির গুণাগুণের সাথে সাথে খাবারের পরিমাণের সম্পর্ক রয়েছে।

পুকুরে যেসব খাদ্য সরবরাহ করা হয় তার সবটুকু মাছ সরাসরি খাদ্য হিসেব গ্রহণ করতে পারে না। খাদ্যের কিছু অংশ পানিতে মিশে পানির গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। এতে করে অনেক সময় পানির গুণাগুণ খারাপ হতে পারে, ফলে মাছের মৃত্যুও হতে পারে। পুকুরের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার কোন সুব্যবস্থা না থাকলে প্রতি একরে ১৫ কেজির বেশি খাবার দেয়া ঠিক না। সেক্কি ডিস্কের পাট ১০ সে.মি. এর কম হলে পুকুরে খাবার সরবরাহ বন্ধ রাখতে হবে। সেক্কি ডিস্কের পাট পুনরায় ২০ সে. মি.বা তার অধিক হলে আবার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।

চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ , কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র , ইউনিট-৩ , পাঠ -৩.৪

 

ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি : পুকুরে গলদা চিংড়ির পোনাকে তাদের ওজনের শতকরা ৩—৫ ভাগ দৈনিক ২ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় খাবার দেয়া ভাল। খাদ্য পিলেটগুলোকে পুকুরের পাড়ের চারপাশে ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। সন্ধ্যায় সমস্ত চিংড়ি পুকুর পাড়ের নিকট দিয়ে খাদ্যের সন্ধানে ঘোরাফেরা করে।

ছোট ছোট ভাসমান খাঁচা বা নাইলন জাল পাতলা পুরাতন কাপড় দিয়ে তৈরি করা যায়। ৩  ২  ১ বাঁশের খাঁচা তৈরি করে নিচে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল বা কাপড় দিতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি খাদ্য খেয়েছে কি না জানা যায়। সরবরাহকৃত খাদ্য যদি চিংড়ি গ্রহণ না করে তাহলে পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়। চিংড়ির খাদ্য তৈরির পর এদের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন। সাধারণত খাবার ও চিংড়ির দেহের বৃদ্ধির অনুপাত ২ ঃ ১ হলেই চিংড়ির ভাল ও উপযোগী খাবার বলে গণ্য করা হয়।

 

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি :

১. চিংড়ি সাধারনত: রাতে খাবার গ্রহন করে। তাই চিংড়ির খাবারকে সন্ধ্যা বা রাত্রিতে প্রয়োগ করতে হবে।

২. চিংড়ির দেহ ওজনের অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাবার দিতে হবে।

৩. পিলেট জাতীয় খাবার পুকুরের চারিদিকে পাড়ের কাছাকাছি ছিটিয়ে দিতে হবে।

৪. বাঁশের খাঁচায় খাদ্য সরবরাহ করা হলে ৩২১ মিটার আকৃতির বাঁশের খাঁচা তৈরী করে তাতে সম্পূরক খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

৫. মাঝে মাঝে ঘের/পুকুরে জাল টেনে চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে খাবার প্রয়োগের অনুপাত কম—বেশী করতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি মাছ চাষের ক্ষেত্রে খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। খাদ্য প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হলো মাছের অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা। মাছের খাদ্যভাস ও মাছ চাষ পদ্ধতির ওপর খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ভরশীল। মাছ চাষ নিবিড় না আধা নিবিড় তার ওপর নির্ভর করে খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা। প্রয়োগকৃত খাবারের সবটুকু মাছ গ্রহণ করলেই কেবল অধিক লাভ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। মাছের খাদ্য গ্রহণ মাছের আকারের ওপর নির্ভরশীল। মাছের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে খাবার গ্রহণের পরিমান ও মাত্রা কমতে থাকে। পানির তাপমাত্রা ও দ্রবীভূত অক্সিজেনের ওপরও মাছের খাদ্য গ্রহণের মাত্রা নির্ভরশীল। পানির তাপমাত্রা বাড়লে খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়ে। তবে মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রায় খাবার প্রয়োগের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে।

 

মাছ ও চিংড়ির খাদ্য 1 চাষের পুকুর/ঘেরে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ

নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের গড় ওজন ঠিক করে মাছের খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয় করতে হয়। সাধারণত মাছের দেহের ওজনের ৩—৫% খাবার প্রয়োগ করা হয়। ছোট আকারের মাছের জন্য খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা বড় মাছের তুলনায় ঘন ঘন হতে হবে। মাছকে প্রধানত: তিন ভাবে খাদ্য প্রয়োগ করা যায় যথা—

১। হাত দিয়ে খাওয়ানো

২। চাহিদা অনুযায়ী খাওয়ানো এবং

৩। স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

আমাদের দেশে এখনো হাত দিয়ে খাওয়ানো পদ্ধতিই বহুল প্রচলিত। অন্য ২টি পদ্ধতি বানিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়।

হাত দিয়ে খাবার প্রয়োগ শ্রম সাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। তথাপি এ পদ্ধতির কতগুলো সুবিধা রয়েছে। এ পদ্ধতিতে খাবারের প্রতি মাছ কিরূপ সাড়া দেয় তা খাদ্য প্রয়োগকারী স্বচক্ষে দেখতে পারে যা মাছ চাষে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভিজা খাবার প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাত ছাড়া অন্য পদ্ধতি কষ্টসাধ্য। একই ব্যক্তি হাত দিয়ে প্রতিদিন খাবার প্রয়োগ করলে মাছগুলো ঐ ব্যক্তির উপস্থিতিতে পরিচিত ও অভ্যস্ত হয়ে উঠে। সাধারণত পুকুরের কোন নির্দিষ্ট স্থানে মাছকে খাবার দিতে হয়। এর ফলে মাছ অল্প দিনের মধ্যে জেনে যায় পুকুরের কোন জায়গায় গেলে সহজে খাবার পাওয়া যাবে।

কিছু দিন একস্থানে খাবার প্রয়োগের পর আবার অন্য স্থানে কিছুদিন খাবার দেয়া ভালো। একই স্থানে সবসময় খাবার দিলে অব্যবহৃত খাবার জমে পঁচে বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে। তাই কিছুদিন পর পর পরীক্ষা করে দেখতে হবে মাছ সব খাবার খেয়েছে কিনা। উপরের অংশ খোলা এরূপ বাক্সে বা পাত্রেও খাবার প্রয়োগ করা যায় । এতে মাঝে মাঝে দেখা যায় মাছ সমস্ত খাবার খেয়েছে কি না। একদিনের খাবার একবারে না দিয়ে সকালে ও বিকালে অথবা সকালে, দুপুরে ও বিকালে (৩ বারে) দেওয়া উত্তম।

নার্সারি পুকুরে পোনা মাছের ক্ষেত্রে পাউডার বা দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ১০—১৫% হারে প্রতিদিন ৩—৪ বার পুকুরের চার পাশে ৩—৪টি নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে দিতে হবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে দানাদার খাদ্য মাছের দেহের ওজনের ৩—৫% হারে প্রতিদিন ২—৩ বার পুকুরের চার পাশে ৩—৪টি স্থানে ছিটিয়ে দিতে হবে।

সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি পুকুর বা জলাশয়ে মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী খাবার দিতে হয়। মাছ কী পরিমান খাবার গ্রহণ করেছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্য গোলাকার পিন্ড আকারে এবং মাংসাশী ও রাক্ষুসে মাছের ক্ষেত্রে পিলেট আকারে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। একই সাথে পুকুরের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্য দ্রব্য সরাসরি ছিটিয়ে না দিয়ে ডুবন্ত খাবার ট্রে বা পাটাতনে দিতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য দিতে হবে।

প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য একবারে না প্রয়োগ করে কয়েকবারে ভাগ করে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। প্রতি দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সম্ভব হলে ভাগ করে তিন বারে দিলে ভালো। অল্প পরিমানে ও বেশিবার খাবার প্রয়োগ করলে খাবারের অপচয় হয় না। খাদ্য দিনের আলোতে দিতে হবে। সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে খাদ্য দেওয়া ঠিক নয়।

মাছের খাদ্য স্বভাব বিভিন্ন প্রজাতির মাছের খাদ্য স্বভাব বিভিন্ন ধরনের। বাংলাদেশে চাষযোগ্য প্রজাতির মাছগুলো পুকুরে বা জলাশয়ের প্রধানত: তিনটি স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। উপরের স্তর, মধ্যের স্তর এবং নিচের স্তর। উপরের স্তরে যেসব মাছ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো কাতলা, সিলভার কার্প। রুই মাছ মাঝের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। মৃগেল, মিরর কার্প ও কমন কার্প (কার্পিও) নিচের স্তরের খাবার গ্রহণ করে থাকে। গ্রাস কার্প ও সরপঁুটি বিভিন্ন স্তুরের খাবার গ্রহণ করে থাকে।

কাতলা মাছ কিশোর ও পূর্ণ বয়স্ক উভয় ক্ষেত্রেই প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন খায়। তবে কিছু কিছু শৈবালও খেয়ে থাকে। রুই মাছ পানির মধ্যভাগের খাবার গ্রহণ করে বিধায় একে কলাম ফিডার বলা হয়। রুই মাছ উদ্ভিদভূক্ত মাছ। এরা ছোট অবস্থায় শুধু প্রাণিজ প্ল্যাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় প্ল্যাঙ্কটন ও পঁচনশীল জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। মৃগেল মাছ বয়স্ক অবস্থায় সাধারণত তলদেশের জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। তবে এরা প্লাঙ্কটনও খেয়ে থাকে। সিলভার কার্প ছোট অবস্থায় রোটিফার নামক জুওপ্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় ফাইটোপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে। গ্রাস কার্প ছোট অবস্থায় প্রাণিজ প্লাঙ্কটন এবং বড় অবস্থায় জলজ আগাছা খেয়ে থাকে।

কমন কার্প বা কার্পিও মাছ সর্বভূক। এরা পুকুরের তলদেশের খাবার খেয়ে থাকে। এরা ১০ সে.মি. লম্বা হলেই এক বিশেষ খাদ্যভ্যাস গ্রহণ করে। এরা গব গব করে কাদা মুখে নেয় এবং উহার জৈব অংশ ছেকে নিয়ে বাকীটুকু ফেলে দেয়। ফলে কার্পিও মাছ যে পুকুরে চাষ করা হয় সে পুকুরের পানি সব সময় খোলা থাকে। তেলাপিয়া মাছ কিশোর অবস্থায় সর্বভূক্ত। এরা ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জুপ্লাঙ্কটনকে প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। শোল, গজার, বোয়াল, আফ্রিকান মাগুর এগুলো রাক্ষুসে মাছ বিধায় এদের খাদ্য স্বভাব ভিন্ন হয়।

এরা ছোট অবস্থায় জুপ্লাঙ্কটন খেয়ে থাকে বড় অবস্থায় শামুক, কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট মাছ খেয়ে থাকে। তাছাড়াও ফিশ মিল, সরিষার খৈল, চালের কুড়া, গমের ভূষি প্রভৃতি সম্পূরক খাদ্যও এরা গ্রহণ করে থাকে।

 

Leave a Comment