বায়ু দূষণ

বায়ু দূষণ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের “পরিবেশ” বিভাগের ২ নং ইউনিটের ২.২ নং পাঠ।

 

বায়ু দূষণ

বায়ু দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ , ইউনিট ২ , পাঠ-২.২

 

আমরা যে বায়ুসমুদ্রে ডুবে আছি তার বিস্তৃতি ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে প্রায় ১৬২ কিলোমিটার এবং এতে প্রায় ৫১০১৮ ঘনমিটার বায়ু বর্তমান। উপাদান হিসেবে এই বায়ুতে রয়েছে বিভিন্ন গ্যাসের সংমিশ্রণ। এর মধ্যে শতকরা ২১ ভাগ অক্সিজেন, ৭৮ ভাগ নাইট্রোজেন। অবশিষ্টাংশে রয়েছে ০.০৩৫ বায়ুতে কেবলমাত্র অক্সিজেন ছাড়া অন্য যে কোনো গ্যাসের আধিক্য ঘটলে অথবা বায়ুতে ধুলি, বালু কণার বৃদ্ধি ঘটলে তাকেই বায়ুর দূষণ বলে। ভাগ কার্বন—ডাই—অক্সাইড, কিছু হাইড্রোজেন, সালফার, আর্গন, ওজোন ইত্যাদি গ্যাসের সমাবেশ। বায়ুতে কেবলমাত্র অক্সিজেন ছাড়া অন্য যে কোনো গ্যাসের আধিক্য ঘটলে অথবা বায়ুতে ধূলি, বালু কণার বৃদ্ধি ঘটলে তাকেই বায়ুর দূষণ বলে।

বায়ু দূষণের উৎস বায়ুর দূষণ প্রধানত মানবসৃষ্ট। বায়ুতে দূষণ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে কার্বন—ডাই—অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার—ডাই—অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন এবং কণাযুক্ত পদার্থসমূহ। বায়ুমন্ডলে বর্ধিত CO2—এর মুল কারণ ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন। এছাড়া আগ্নেয়গিরির অগন্যুৎপাত, জীবদেহের পচন, অগ্নিকান্ড, বৃক্ষনিধন ও জ্বালানি, প্রাণীর শ্বাস—প্রশ্বাস প্রভৃতি উৎস থেকে বায়ুতে প্রচুর CO2 জমা হচ্ছে।

 

১। কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) :

বায়ু দূষণের প্রধান উৎসই হচ্ছে কার্বন—ডাই—অক্সাইড (CO2)। লক্ষ লক্ষ বর্ষব্যাপি বায়ুমন্ডলে CO2—এর পরিমাণ শতকরা ০.০৩ ভাগ বা ৩০০ পি.পি.এম.—এ স্থিতাবস্থায় ছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩৫০ পি.পি.এম. ছাড়িয়ে গেছে। বায়ুমন্ডলে বর্ধিত CO2—এর মূল কারণ ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন। এছাড়া আগ্নেয়গিরির অগন্যুৎপাত, জীবদেহের পচন, অগ্নিকান্ড, বৃক্ষনিধন ও জ্বালানি, প্রাণীর শ্বাস—প্রশ্বাস প্রভৃতি উৎস থেকে বায়ুতে প্রচুর CO2 জমা হচ্ছে।

বায়ু দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ

 

২। কার্বন মনোক্সাইড (CO) :

বায়ু দষণের প্রায় ১০ূ —১৫% সৃষ্টি হয়ে থাকে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস দিয়ে। কয়লা ও খনিজ তেলজাতীয় জ্বালানীসমূহের পূর্ণ বা অপূর্ণ দহনের ফলে অথবা শিল্প—কারখানা ও মোটরযান হতে নির্গত ধেঁায়া থেকে CO নির্গত হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে, কেবল আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বছরে ৬৫ মিলিয়ন টন CO গ্যাস উৎপন্ন হয়।

 

৩। সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) :

সালফার ডাই—অক্স্রাইড (SO2) বায়ু দূষণের অন্যতম বৃহত্তম এই গ্যাসের সাথে সীসা, তামা, ি জঙ্ক, ক্যালসিয়াম, লৌহ, প্রভৃতি ভারি ধাতু ও CO, ঐ২ঝ, ঐঈষ, ঘঙ, হাইড্রোকার্বন, ৩, ৪ বেনজোপাইরিন প্রভৃতি গ্যাসীয় পদার্থ মিশ্রিত থেকে ধেঁায়ার সৃষ্টি করে। উপাদান। এর প্রধান উৎস শিল্প—কারখানা ও শক্তি উৎপাদক কেন্দ্রে ব্যবহৃত সালফার সংযুক্ত কয়লা ও পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের দহন। এই গ্যাসের সাথে সীসা, তামা, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, লৌহ, প্রভৃতি ভারি ধাতু ও CO, ঐ২ঝ, ঐঈষ, ঘঙ, হাইড্রোকার্বন, ৩, ৪ বেনজোপাইরিন প্রভৃতি গ্যাসীয় পদার্থ মিশ্রিত থেকে ধেঁায়ার সৃষ্টি করে। কল—কারখানার আধিক্যহেতু গ্রামাঞ্চল অপেক্ষা শহরাঞ্চলের বায়ুতে এ ধরনের দুষণের মাত্রা অধিক।

 

৪। বালি ও ধূলিকণা :

কোনো কোনো শিল্প—কারখানা (পাটকল, চাউল—আটার কল, কাগজকল, সুতাকল ইত্যাদি), শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, আবর্জনা মুক্ত করার কেন্দ্র, ইটের ভাটা ইত্যাদি স্থান থেকে বেরিয়ে আসা ধুলো ও বালিকণা বায়ুতে মিশ্রিত হয়ে দূষণ ঘটায়। ৫। ধাতব কণা ঃ টিন, নিকেল, দস্তা, ক্যাডিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি ধাতুর কণা বা
গ্যাস বিভিন্ন শিল্পের রাসায়নিক উপজাত থেকে সৃষ্ট হয়ে বায়ুতে মিশে যায় ও দষণ ঘটায়।ূ

৬। এরোসোলস :

এরোসলসজাতীয় সামগ্রী থেকে সাধারণত কঠিন ও তরল উভয়বিধ উপাদানই বায়ুতে ভাসমান থাকে। এ সকল দ্রব্যে জিঙ্ক, দস্তা, তামা, লোহা, ইত্যাদি গঠিত বিষাক্ত যৌগিক উপাদান বিদ্যমান থাকায় তা বায়ুতে দূষণ ঘটায়। এসব দ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রসাধন সামগ্রী, কীট ও জীবাণুনাশক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ঈঋঈং বা ক্লোরো— ফ্লোরো—কার্বন ইত্যাদি।

৭। জৈবিক দূষণ :

প্রকৃতিতে অনেক জৈবিক উপাদান রয়েছে যাদের উপস্থিতির কারণে বায়ু দূষিত হয়, যেমনঃ ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের রেণু , পরাগরেণু  ইত্যাদি। বায়ু দূষণের পরিধি বা বিস্তৃতি যেহেতু বায়ু প্রায়ই স্থিতাবস্থায় থাকে না সে কারণে বায়ুর দূষণ ও স্থিতাবস্থায় বিরাজ করে না। দূষণের বিস্তৃতি সাধারণভাবে আবহাওয়ার অবস্থা, বায়ুর গতিবেগ, দূষণ উপাদানের রাসায়নিক দৃঢ়তা (স্থিতাবস্থা) এবং তাদের অণুর আকৃতির উপর নির্ভরশীল।

বায়ু দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা সাধারণভাবে দূষণের উৎস এলাকায় দেখা যায় এবং এটি ঘটে সাধারণভাবে রাত্রিকালীন সময়ে যখন ভূমিসংলগ্ন বায়ু ঊর্ধ্বাকাশের বায়ু অপেক্ষা শীতলতর থাকে। কিন্তু নগরীর ধেঁায়া, শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র এবং ইটের ভাটা থেকে উত্থিত সালফার—ডাই—অক্সাইড গ্যাস, হাইড্রোকার্বন থেকে সৃষ্ট ওজোন ও নগরীর ধেঁায়া থেকে নিঃসৃত নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎসস্থল থেকে শত শত কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে বায়ু দূষণের কারণ হতে দেখা যায়।

 

বায়ু দূষণের প্রভাব :

স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বায়ু দূষণীয় পদার্থ সে এলাকার মেঘ, বৃষ্টিপাত, তাপ প্রবাহ ইত্যাদিতে পরিবর্তন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, নগর উৎস থেকে নিঃসৃত অনেক বায়বীয় দূষণবস্তু নগরীর বায়ু কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াম পর্যন্ত উত্তপ্তকরণে সক্ষম এবং নগরকেন্দ্রিক এ ধরনের উত্তাপ পার্শ¦বর্তী বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

মানব দেহের ওপর ধাতব বস্তুর প্রভাব বায়ুমন্ডলে উপস্থিত বিভিন্ন ধাতুসমূহের কণা মানবদেহে রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। ভারি ধাতব কণা এজমা, কাশি, ফুসফূস এবং গলার অন্যান্য রোগের জন্য দায়ী। বায়ুমন্ডলে উপস্থিত বিভিন্ন ধাতুসমূহের কণা মানবদেহে রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। ভারি ধাতব কণা এজমা, কাশি, ফুসফূস এবং গলার অন্যান্য রোগের জন্য দায়ী। সীসা বয়ষ্ক মানুষের স্বাভাবিক কার্যাবলীর ব্যাঘাত ঘটায় এবং মস্তিষ্ক বিকল করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। ক্যাডিয়াম উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

গ্যাসীয় পদার্থের প্রভাব মানুষ ও প্রাণীর জন্য CO2 একটি শ্বাসরোধী গ্যাস। বায়ুমন্ডলে CO2 এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। ফলে জলবায়ুতে ঘটাবে ব্যাপক পরিবর্তন। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। তলিয়ে যাবে পৃথিবীর বহু নিম্নাঞ্চল। বায়ুতে CO এর আধিক্য এবং নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে মাথাধরা. দৃষ্টিহীনতা, এবং তলপেটে ব্যাথা অনুভূত হয়।

বায়ুতে SO2 এর আধিক্য হাপানী, ব্রংকাইটিস, প্রভৃতি ফুসফুস সংক্রান্ত রোগের জন্ম দেয়। বাতাসে বেনজোপাইরিন হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। বায়ুর জৈবিক উপাদানঘটিত দূষণ, যথাঃ ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরাগরেণু ইত্যাদি এ্যালার্জিজনিত রোগের (যেমনঃ হাপানী, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি) অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।

বায়ু দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ

এসিড বৃষ্টি :

বিভিন্ন অক্সাইড বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও সালফারজাতীয় অক্সাইডের গ্যাস বৃষ্টির পানির সাথে মিলিত হয়ে নাইট্রিক ও সালফিউরিক এসিডে পরিণত হয় যা ‘এসিড বৃষ্টি’ নামে পরিচিত। এসিড বৃষ্টি মাটি ও পানির চঐ হ্রাস করে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এসিড বৃষ্টির ফলে মাছের মড়ক দেখা দেয় এবং প্রজনন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। বর্তমান পৃথিবীতে শিল্পোন্নত দেশে এসিড বৃষ্টি একটি প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভারতের মথুরায় অবস্থিত শিল্প—কারখানা থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন গ্যাস ও এসিড বৃষ্টির কারণে আগ্রার তাজমহল তার উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে।

 

উদ্ভিদের ওপর বায়ু দূষণের প্রভাব :

বায়বীয় দূষণ সবুজ উদ্ভিদ ও শস্য উৎপাদনের জন্যও ক্ষতিকর। নরম পাতাযুক্ত উদ্ভিদ, যেমনঃ মূলা, গাজর, লেটুস এবং বিভিন্ন বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদের উৎপাদনশীলতা দূষিত বায়ুর কারণে ব্যাহত হয়। বাতাসে খনিজ দ্রব্যের ধুলোবালি আধিক্য হলে উদ্ভিদের জৈবিক ক্রিয়া—কর্মে ব্যাঘাত ঘটে। নাইট্রোজেন অক্সাইডের প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভিদের পত্রঝরা, ক্লোরোসিস, ছিট—পড়া পাতার ডগা ও কিনারায় পুড়ে যাওয়া প্রভৃতি উপসর্গ দেখা যায়। দূষিত পদার্থের কণা নিকটবর্তী উদ্ভিদের পাতায় পড়ে পত্ররন্ধ্র বন্ধের কারণ ঘটায়। ফলে গ্যাসীয় আদান—প্রদান (এধং বীপযধহমব), পানি ধারণ ক্ষমতা ও অন্যান্য শারীরবৃত্তিয় কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এ কারণেই শিল্প কারখানার নিকটবর্তী স্থানে গাছের পাতা ঝরা, ডগা শুকিয়ে যাওয়া, পাতা ও ফলের ক্ষত সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি অসুবিধা দেখা যায়।

বাতাসে SO2 এর আধিক্য ঘটলে আঙ্গুরজাতীয় উদ্ভিদ, তুলা ও আতা ফলের পাতা হলুদ হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। স¦ল্প মাত্রার ওজোন (০.০২— ৫০ পিপিএম) তামাক, টমেটো, সীম, পাইন ইত্যাদি গাছের ক্ষতি সাধন করে।

বায়ু দূষণ , কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ , পরিবেশ

 

বায়ু দূষণের প্রতিকার:

ক্ষুদ্র কণাজাতীয় দূষক ও বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাসের প্রভাব থেকে বায়ুমন্ডলকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে —

  • নির্গমনের পূর্বে দূষিত বায়ুকে সিŽছদ্র প্রকোষ্ঠের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করে বিষাক্ত ক্ষুদ্র কণা পৃথককরণ।
  • দষিত বায়ুকে পানির টাওয়ারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে দ্রবণীয় দূ ষিত পদার্থ পৃথককরণ।
  • থলি ছাঁকনার মাধ্যমে বায়ুস্থ ধূলিকণা পরিশোধন করা।
  • ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রোস্টাটিক ঝরণার মাধ্যমে।

ধেঁায়া জাতীয় দূষণের পাতন ঘটানো ইত্যাদি উলে­খযোগ্য। এগুলো ছাড়াও অতিরিক্ত সতর্কতামুলক ব্যবস্থা হিসেবে যতদূর সম্ভব কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে জলবিদ্যুৎ, বায়ুকল (ডরহফ সরষষ),
সৌরশক্তি ইত্যাদির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

 

আরও দেখুন :

Leave a Comment