আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-আলু চাষ। আলু হল Solanum tuberosum উদ্ভিদের একটি শ্বেতসারসমৃদ্ধ কন্দ। আলু প্রায় ৭,০০০-১০,০০০ বছর আগে, Solanum brevicaule মিশ্রণের একটি প্রজাতি থেকে গৃহপালিত হয়েছিল। আলু গাছপালা গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী যা প্রায় ৬০ সেমি (২৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত উচ্চতায় বৃদ্ধি পায়, বিভিন্নতার উপর নির্ভর করে, ফুল, ফল এবং কন্দ গঠনের পরে পাতাগুলি বিপরীতক্রমে মারা যায় । এগুলো হলুদ পুংকেশর সহ সাদা, গোলাপী, লাল, নীল, বা বেগুনি ফুল বহন করে।
Table of Contents
আলু চাষ
এবাংলাদেশে বিভিন্ন সবজির মধ্যে আলুই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এদেশের প্রায় সব আলু চাষ হয়। জমির পরিমাণ ও উৎপাদনের দিক থেকে এদেশে ধান ও গমের পরেই আলুর স্থান। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মত আর ফলন ধান চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পর্তুগিজরা আমাদের দেশে আলু নিয়ে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়।
আলুর বংশগতি:
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫,০০০ আলুর জাত রয়েছে। তাদের মধ্যে তিন হাজার শুধুমাত্র আন্দিজ অঞ্চলে পাওয়া যায়, প্রধানত পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, চিলি এবং কলম্বিয়াতে। শ্রেণিবিন্যাসগত গোষ্ঠীর উপর নির্ভর করে তারা আট বা নয়টি প্রজাতির অন্তর্গত। ৫,০০০টি চাষ করা জাত ছাড়াও, প্রায় ২০০টি বন্য প্রজাতি এবং উপ-প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলিই চাষ করা জাতের সাথে আন্তঃ-প্রজনন করানো যেতে পারে। বন্য প্রজাতির জিন পুল থেকে চাষকৃত আলু প্রজাতির জিন পুলে নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গ এবং রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা স্থানান্তর করার জন্য বারবার আন্তঃ-প্রজনন করা হয়েছে।
আলু চাষের জলবায়ু:
কি আনা আৰু চাদের জন্য উত্তম তাপমাত্রা ১০ সে. থেকে ২০ সে. এর ভিতরে থাকলে আলুর ফলন ভালো হয়। এর নিচে বা উপরে গেলে ফলন কমে যায়। তবে ১৫-২০ সে. তাপমাত্রায় ফলন সবচেয়ে বেশি হয়।
আলু চাষের জমি নির্বাচন:
বৃষ্টির পানি জমে থাকে না বা পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে এমন ধরনের দো-আঁশ বা বেলে-দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য উপযোগী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) আঙ্গুর অনেকগুলো উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এই জাতগুলো হলো- কৃষ্ণরা, সিন্দুরী, কার্ডিনাল, মোরিন, মাল্টা, ইত্যাদি।
এছাড়াও কিছু দেশী জাত যেমন- শীলাবিলাতী দোহাজারী, চল্লিশা, লালশাক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীগণ আলুর প্রকৃত বীজ (IPS) উৎপাদন করাতে সফল হয়েছেন। এতে উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে এবং আলুচাষীরা লাভবান হতে পারবেন।
আলু রোপণের সময়:
বেশি বৃষ্টি না হলে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসেই আলুর কন্দ রোপণ করা যায়। তবে নভেম্বর মাসেই সাধারণত রোপন করা হয়ে থাকে। নভেম্বর মাসের পর রোপণ করতে যত দেরি হবে।
আলু চাষের জমি তৈরি:
গভীরভাবে ৬-৭ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হয়।
আলুর রোপণ পদ্ধতি:
কন্দের ক্ষেত্রে দুই পদ্ধতিতে আলুর চাষ করা যায়।
১। পদ্ধি
২। তেী পদ্ধতি।
এখন দেখা যাক পদ্ধতি দুটো কী?
আলুর আচ্ছাদন পদ্ধতি :
এই পদ্ধতিতে আলুর কন্দ লাগানোর পর গড়-কুটা, কচুরীপানা ইত্যাদি দিয়ে জমি ঢেকে দেয়া হয় এবং কোন প্রকার পানি সেচ দেওয়া হয় না।
আলু চাষের তেলী পদ্ধতি :
এই পদ্ধতিতে আলুর কন্দ জমিতে সারি করে লাগানো হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব সাধারণত ৫০-৬০ সে.মি. এবং সারিতে কন্দ থেকে কন্দের দূরত্ব ২০-২৫ সে.মি. রাখা হয়। পরে কন্দ থেকে চারা মাটির উপর ৩-৪ সে.মি. বের হবার পর সারিয় দুপাশের মাটি তুলে নিয়ে চারার গোড়ায় স্থাপন করতে হয়।
এতে প্রতিটি সারি দুপাশের ফাকা জায়গা থেকে বেশ উঁচু হয় এবং দুসারির মাঝখানে নালা সৃষ্টি হওয়াতে প্রয়োজনে সেচ দেওয়া যায় বা প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করা যায়।
প্রকৃত বীজের ক্ষেত্রে- এখানেও দু’ভাবে আলু চাষ করা যায়।
১। বীজতলায় আলুর প্রকৃত বীজ বুনে চারা তৈরি করে সেই চারা মূল জমিতে লাগানো হয়।
২। জমিতে বীজ বুনে প্রথম বছরে ছোট ছোট কন্দ উৎপাদন করে তা হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। পরের বছর এই কন্দ লাগিয়ে আলুর চাষ করা হয়।
আলুর বীজের পরিমাণ:
প্রতি হেক্টর আলুর কন্দ প্রয়োজন ১.৭ ২.৪ টন এবং প্রকৃত বীজ লাগবে ৩০০-৩৫০ গ্রাম। উল্লেখ্য আলু চাষে যে মোট ব্যয় হয় আর ৩০-৪০% না হয় আলুর কন্দ কিনতে।
আলুর সার প্রয়োগ:
প্রতি হেক্টর জমিতে আলু চাষ করলে নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
জৈব সার / গোবর
১০ জন
ইউরিয়া
টি এস পি
৩২৫ কেজি
২০০ কেজি
এমপি
২৭৫ কেজি
উপরোক্ত সারগুলো ছাড়াও যে সব জমিতে সার অভাব ধরা পড়ে সেখানে ৪০- ৪৫ কেজি জিপসাম এবং ৮-১০ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আচ্ছাদন পদ্ধতিতে আলু চাষ করলে সব সার চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
আবার ভেলা পদ্ধতিতে চাষ করলে সম্পূর্ণ ान সার / গোবর, টি এস পি, জিপসাম ও জিংক সালফেট চাষের সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এম পি সারের অর্ধেকটা জমি তৈরির সময় ও বাকি অর্ধেকটা ডেলীতে প্রয়োগ করাতে হয়। আবা ইউরিয়া সারের ১, অংশ চাষের সময় ১/৩ অংশ চারা বের হওয়ার ১৫-২০ দিন পর এবং
বাকি ১/৩ অংশ চারা বের হওয়ার ৪০-৪৫ দিন পর গাছের গোড়ায় তেলী বরাবর প্রয়োগ করতে হবে। তবে এসময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে রোপণকৃত কন্দ বা চারার গায়ে কোন আঘাত না লাগে না ।
আলু চাষের পরিচর্যা:
আচ্ছাদন পদ্ধতির বেলায় জমির কিছু কিছু জায়গায় নতুন করে খড়-কুটা বা কচুরিপানা বিছায়ে নিতে হয়। আবার ভেলী পদ্ধতির ক্ষেত্রে তেলীতে মাটি তুলে দিতে হয়। সেচ ও নিকাশ শুভ মৌসুমে আলু চাষ করা হয় বিধায় ২-৩ বার সেচ দেওয়া . প্রয়োজন। বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে জমিতে পানি জমে গেলে তা নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
শোকানন আৰু গাছে কাটুই পোকা, জাব পোকা প্রিয় আক্রমণ দেখা যায়। ফাটাই পোকা রাতের বেলা গাছের গোড়া কেটে নিয়ে মাত্মক ক্ষতি সাধন করে। এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে প্রতিদিন ভোরবেলা কাটা গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ে পোকা ধরে মেরে ফেলতে হবে।
এছাড়া ১ লিটার পানির সঙ্গে ১.৫-২.০ মিলিলিটার জবান মিশিয়ে সারির মাঝখানে স্প্রে করে নিয়ে হালকা সেচ দিলে এ পোকা দমন হয়। ন পোকা আলু গাছের পাতা ও কচি ডগার রস চুদে যায়। এতে গাছের বৃদ্ধি কমে যাওয়াতে কান কম হয়। এ পোকা দমনের জন্য ভাতা / সুমিথিয়ন /নগন পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো পাওয়া যায়।
রোগ দমন আলুর অনেক রোগ আছে তবে সবচেয়ে মাঝক রোগ হলো টেরাইট বা নাবি ধসা। এই রোগ এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে। ঠান্ডা, আর্দ্র ও মেঘলা আবাহাওয়াতে দেখা দেয়ার সাথে সাথেই ডাইথেন এম-৪৫ বা রিডোমিল পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আলু ফসল উত্তোলন:
উন্নত জাতসমূহ পরিপক্ক হতে সাধারণত ৯০-১১০ দিন সময় নেয়। কিন্তু দেশী জাতের আলু পরিপক্ক হতে এর চেয়ে বেশি সময় লাগে। পরিণত বয়সে আলু গাছ হেলে পড়ে ও পাতা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে। আলু জমি থেকে তোলার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যাতে আলু কেটে বা থেতলে না যায় এবং কোন প্রকার ক্ষত সৃষ্টি না হয়।
আলু তোলার পর প্রচুর বাতাসযুক্ত জায়গায় ও ছায়াময় স্থানে কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা রাখতে হয়। এরপর পড়া, কাটা, থেতলানো ছোট, মাঝারি, বড় প্রভৃতিভাবে আলু বাছাই করে নিতে হয়। অবশ্যই মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনে আলু উত্তোলন করা উচিত।
আলু বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে হিমাগারে রাখা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তবে সাধারণভাবে সংরক্ষণ করতে চাইলে প্রচুর আলো বাতাস চলাচল করে এম ঘরে রাখতে জান। ঘরে মাচা তৈরি করে তার উপর চাটাই বিছাতে হয়।
এই চাটাই এর উপর ৩.৫-৫.৩ সে.মি. পরিমাণ পরিষ্কার ও শুকনো বালি বিছিলো এর উপর ১৬-২০ সে.মি. পুর করে আলু রাখতে হয়। এই প্রতিনার মাননো চালাতে হয়। উল্লেখ্য ১৫-২০ দিন পর পর গুদামের আলু পরীক্ষা করে দেখতে হয় এবং পচা আলু পাওয়া গেলে তা সরিয়ে ফেলতে
ফলন
উন্নত জাত
১৪৩৫ টন/হেক্ট
দেশী জা ৮- ১৫ টন/হেক্টর
আলু চাষের সারমর্ম:
শুভ ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া আলু চাষের উপযোগী। ১৫-২০ সে. তাপমাত্রায় আলুর নান সবচেয়ে বেশি হয়। উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য উত্তম। আলুর উফশী জাত হলো কার্ডিনাল, কুফরী, সিন্দুরী, মাল্টা, মেরিন, যাঁরা প্রভৃতি দেশীজাত হলো- লালপাকরী, শিলবিলাতী দোহাজারী ইত্যাদি।
নভেম্বরের পর আলু লাগাতে যত বিলম্ব হবে ঘদান তত কম হবে। প্রকৃত বীজ বা কন্দ থেকে আলু দুভাবে উৎপাদন করা হয়। অনুর সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো কাটুই পোকা এবং রোগ হলো লেউরাইট। প্রতি হেক্টরে আলুর ৮-৩৫ টন পর্যন্ত হতে পারে।