করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল , করলা দেশের অন্যতম প্রধান সবজি। স্বাদে তিক্ত হলেও এটি প্রিয় সবজি হিসেবেই পরিচিত। আর সঠিক পদ্ধতিতে করলা চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। করলা চাষে অধিক ফলন পেতে সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি।

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

করলা চাষে মাটি:

যে জমিতে পানি জমে থাকে না, এ ধরনের প্রায় সব রকম মাটিতেই করলার চাষ সম্ভব। আর জৈব পদার্থযুক্ত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিত করলা চাষে অধিক উপযোগী।

করলা চাষের জন্য জলবায়ু:

করলা চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ সবজি ভালো জন্মে। তবে ফুল আসার সময় অধিক বৃষ্টিপাত ফল ধরাতে সমস্যার করে।

করলার জাত:

দেশে করলার বেশ কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল জাত রয়েছে। এর মধ্যে বারি করলা-১ এবং বিএডিসির গজ করলা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরও কয়েক রকমের হাইব্রিড জাত রয়েছে। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কৃর্তক উদ্ভাবিত বারি করলা-১ উচ্চফলনশীল জাত। এ জাতের একটি গাছে ২০-৩০টি করলা ধরে। হেক্টরপ্রতি ফলন ৩০ টনের কাছাকাছি।

আরেকটি উচ্চ ফলনশীল করলার জাত হলো বিএডিসির গজ করলা। এ জাতের একটি গাছে ১৫-২০টি ফল ধরে। হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫ টনের কিছুটা কম।

করলার আরও যে কয়টি হাইব্রিড জাত আছে, তার মধ্যে বুলবুলি, টিয়া, প্যারট, কাকলি, তাজ-৮৮, গ্রিনস্টার, গৌরব, প্রাইড-১, প্রাইড-২, গ্রিন রকেট, হীরক, মানিক, জয়, রাজা, প্রাচী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

করলার জীবনকাল:

করলার মোট জীবনকাল প্রায় ৪ থেকে সাড়ে চার মাস। তবে জাত-আবহাওয়া ভেদে সময় কম বেশি হতে পারে।

করলার উৎপাদন মৌসুম:

ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের যে কোনও সময় করলার বীজ বোনা যেতে পারে। অনেকে জানুয়ারি মাসেও বপন করে থাকেন। কিন্তু এসময় তাপমাত্রা কম থাকায় গাছ দ্রুত বাড়তে পারে না। এ কারণে আগাম ফসল উৎপাদনে তেমন সুবিধা হয় না।

করলা চাষের জন্য জমি তৈরি ও বপন:

হেক্টরপ্রতি করলা ও উচ্ছের জন্য যথাক্রমে ৬-৭.৫ ও ৩-৩.৫ কেজি বীজ লাগবে। উচ্ছে ও করলার বীজ সরাসরি মাদায় (৪০x৪০x৪০ সে.মি) বোনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাদায় কমপক্ষে ২টি বীজ বপন অথবা পলিব্যাগে উৎপাদিত ১৫-২০ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। উচ্ছের ক্ষেত্রে সারিতে ১.০ মিটার এবং করলার জন্য ১.৫ মিটার দূরত্বের মাদা তৈরি করতে হবে। মাদা বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতে হলে অন্তত ১০ দিন আগে নির্ধারিত সার প্রয়োগ করে তৈরি করে নিতে হবে।

 

করলা চাষ ৫ করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

 

করলা চাষের জন্য সেচ ও নিষ্কাশন:

ক্ষেতে খরা হলে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। পানির অভাবে গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন ধাপে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন প্রাথমিক অবস্থায় চারার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া। পরবর্তীতে ফল ঝরে যাওয়া। জুন-জুলাই মাস থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আর সেচের প্রয়োজন হয় না। জমির পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড ও নিকাশ নালা সর্বদা পরিষ্কার করে রাখতে হবে। করলার বীজ উৎপাদনের সময় ফল পরিপক্ব হওয়া শুরু হলে সেচ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। বাউনির ব্যবস্থা করা করলার প্রধান পরিচর্যা। চারা ২০-২৫ সেমি উঁচু হতেই ১.০-১.৫ মি. উঁচু মাচা তৈরি করতে হবে।

 

করলার রোগ বালাই ও দমন:

করলার মাছি পোকা:

স্ত্রী মাছি কচি ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মত তরল পদার্থ বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামী রং ধারণ করে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে। এরপর ফল হলুদ হয়ে পচে ঝরে যায়।

দমন ব্যবস্থা: আক্রান্ত ফল বা ফুল সংগ্রহ করে ধ্বংস করা বা পুড়ে ফেলা। ভালোভাবে জমি চাষ করে পোকার পুত্তলি পাখিদের খাবার সুযোগ করে দেওয়া। ক্ষেতের মাঝে মাঝে কাঁঠালের মোথা দেওয়া। এতে করলার পরিবর্তে স্ত্রী মাছি কাঁঠালের মোথায় ডিম পাড়বে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ কমে আসবে। প্রথম ফুল আসামাত্র ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করা। প্রতি ১০ শতাংশের জন্য ৩টি। আম বা খেজুরের রসে সামান্য বিষ মিশিয়ে তা বোতলে রেখে জানালা কেটে দিয়ে ক্ষেতের মাঝে মাঝে স্থাপন করা।

 

করলা চাষ ২ করলা চাষে অধিক ফলন এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল

 

করলার সাদা মাছি পোকা:

স্ত্রী মাছি কচি ফলে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়াগুলো ফলের শাস খায়। ফল পচে অকালে ঝরে পড়ে।

দমন ব্যবস্থা: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ। আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। সেক্স ফেরোমন ও বিষটোপ ফাঁদের যৌথ ব্যবহার। বিষটোপের জন্য থেঁতলানো ১০০ গ্রাম পাকা মিষ্টি কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম সেভিন ৮৫ পাউডার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হয়। বিষটোপ ৩-৪ দিন পরপর পরিবর্তন করতে হয়।

করলা চাষের জন্য সার ব্যবস্থাপনা

 

সারের নামমোট পরিমাণ
(হেক্টর প্রতি)
মোট পরিমাণ (শতাংশ প্রতি)জমি তৈরির সময় (শতাংশ প্রতি)চারা রোপণের ৭-১০
দিন পূর্বে
চারা রোপণের ১০-১৫
দিন পর
চারা রোপনের ৩০-৩৫
দিন পর
চারা রোপনের ৫০-৫৫ 
দিন পর
চারা রোপনের ৭০-৭৫ 
দিন পর
পচা গোবর২০ টন৮০ কেজি২০ কেজি৫ কেজি
টিএসপি১৭৫ কেজি৭০০ গ্রাম৩৫০ গ্রাম৩০ গ্রাম
ইউরিয়া১৭৫  কেজি৭০০ গ্রাম১৫ গ্রাম১৫ গ্রাম১৫ গ্রাম১৫ গ্রাম
এমপি১৫০ কেজি৬০০ গ্রাম২০০ গ্রাম২০ গ্রাম১৫ গ্রাম
জিপসাম১০০ কেজি৪০০ গ্রাম৪০০ গ্রাম
দস্তা সার১২.৫ কেজি৫০ গ্রাম৫০ গ্রাম
বোরাক্স১০ কেজি৪০ গ্রাম৪০ গ্রাম
ম্যাগনেশিয়াম১২.৫কেজি৫০ গ্রাম৫ গ্রাম

 

করলা ফসল সংগ্রহ:

চারা গজানোর ৪৫-৪৫ দিন পর উচ্ছের গাছ ফল দিতে থাকে। করলার বেলায় লেগে যায় প্রায় ২ মাস। স্ত্রীফুলের পরাগায়নের ১৫-২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়। ফল আহরণ একবার শুরু হলে তা দুমাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে উচ্ছে ও করলার হেক্টর প্রতি ফলন যথাক্রমে ৭-১০ টন (৩০-৪০ কেজি/শতাংশ) এবং ২০-২৫ টন (৮০-১০০ কেজি/শতাংশ) পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন :

Leave a Comment