আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় জমিতে সার প্রয়োগ: সারের মাত্রা, প্রয়োগ সময় ও প্রয়োগ পদ্ধতি
Table of Contents
জমিতে সার প্রয়োগ: সারের মাত্রা, প্রয়োগ সময় ও প্রয়োগ পদ্ধতি
জমিতে সার প্রয়োগ : সারের মাত্রা, প্রয়োগ সময় ও প্রয়োগ পদ্ধতি
জীব মাত্রই বেঁচে থাকার জন্য অর্থাৎ তাদের বৃদ্ধি, বিকাশ, বংশ বৃদ্ধি ও অন্যান্য কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয় এবং সে শক্তির উৎস হলো পুষ্টি বা খাদ্য। যেহেতু ফসল জীব জগতের অন্তর্ভুক্ত তাই তাদেরও খাদ্যের প্রয়োজন হয়। মানুষের খাদ্য তালিকায় যেমন রয়েছে আমিষ, শর্করা, স্নেহ, খনিজপদার্থ, পানি ও ভিটামিন, তেমনি উদ্ভিদের বেলায়ও রয়েছে বেশ কয়েকটি রাসায়নিক পুষ্টি মৌল বা পুষ্টি উপাদান।
উদ্ভিদদেহ বিশ্লেষণ করে এ পর্যন্ত ৩০টির মতো মৌল উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বিজ্ঞানীদের মতে ১৬টি উপাদান উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য। অবশ্য কোনো কোনো বৈজ্ঞানিকের মতে অপরিহার্য মৌল উপাদানের সংখ্যা ২০ বা তারও বেশি। উদ্ভিদের অপরিহার্য খাদ্যোপাদান বলতে সেসব পুষ্টি মৌলকে বোঝায় যার যে কোনো একটির অনুপস্থিতি বা অভাব উদ্ভিদের স্বাভাবিক কার্যকলাপ ব্যাহত করে, এমনকি উদ্ভিদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
এদের যে কোনো একটির অভাব বা অনুপস্থিতি অন্য কোনোটির স্বল্প বা অধিক মাত্রায় ব্যবহার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয় ।
এসব পুষ্টি উপাদান যে আকারে গাছ গ্রহণ করে সে আকারে গাছে বা মাটিতে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না, কোনো না কোনো যৌগিক দ্রব্য (সার) হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়।
এসব দ্রব্য মৃত্তিকাস্থ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে ক্যাটায়ন (+) ও অ্যানায়ন (-) হিসেবে প্রধানত উদ্ভিদের মূলরোমের সাহায্যে দেহে প্রবেশ করে গাছের বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। কিছু কিছু পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদ তার পাতা ও কান্ডের মাধ্যমে আয়ন রূপে গ্রহণ করতে পারে। এদের মধ্যে রয়েছে নাইট্রোজেন, আয়রন (লৌহ), কপার (তামা), জিঙ্ক (দস্তা) প্রভৃতি।
উদ্ভিদের অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানগুলোর নাম, এদের উৎস ও পরিশোষণযোগ্য আকারসহ নিচের তালিকায় দেখানো হল :
স্বীকৃত ১৬টি পুষ্টি উপাদানের মধ্যে প্রথম ৯ টিকে (N, P, K, C, H, O, Ca Mg, S) উদ্ভিদ বেশি পরিমাণে পরিশোষণ করে বলে এদেরকে বলা হয় মুখ্য উপাদান (Major element)। আর বাকি ৭ টিকে (Zn, Cu, Mo, B, Fe, Mn, Cl) বলা হয় গৌণ উপাদান (Minor element), কারণ এদেরকে উদ্ভিদ খুব অল্প পরিমাণে শোষণ করে।
শোষণের পরিমাণগত দিক থেকে মুখ্য ও গৌণ হিসেবে গণ্য হলেও গুরুত্বের দিক থেকে এদের মধ্যে কোন তারতম্য নেই; সবগুলোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মুখ্য পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে N, P, এবং K উদ্ভিদের সবচাইতে বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং এদেরকে প্রাইমারী বা প্রাথমিক পুষ্টি উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে এবং জমিতে প্রতিনিয়ত এদের অভাব পরিলতি হয়ে থাকে।
তাই এদেরকে যথাক্রমে ইউরিয়া, ট্রিপল সুপারফসফেট (টিএসপি) এবং মিউরেট অব পটাশ (এমপি) সারের মাধ্যমে প্রত্যেক মৌসুমেই ফসল ে তে প্রয়োগ করতে হয়। প ান্তরে গৌণ উপাদানগুলো ফসলের স্বাভাবিক চাহিদার তুলনায় মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান থাকে বলে অধিকাংশ েত্রে এদের অভাব পরিল িত হয় না। অভাব দেখা দিলে অবশ্যই এদেরকে সার হিসেবে প্রয়োগ করতে হয়।
যেমন ইদানিং বাংলাদেশে সেচের সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়াতে ধান চাষাবাদের জন্য বৎসরের অধিকাংশ সময় মাটি ভেজা থাকায় সালফার (গন্ধক) ও জিঙ্ক (দস্তা) এর অভাব পরিলতি হচ্ছে এবং এদেরকে যথাক্রমে জিপসাম ও জিঙ্ক অক্সাইড বা জিঙ্ক সালফেট নামক সারের মাধ্যমে জমিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ফসলের চাহিদা
একক জমির (যেমন- একর বা হেক্টর) একটি ফসল বিভিন্ন খাদ্যোপাদান কী পরিমাণে ও অনুপাতে পরিশোষণ করে, উদ্ভিদের দেহ বিশেষণ করে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফসলের খাদ্যোপাদানের চাহিদা এদের ধরন, জাত, উৎপাদন কলাকৌশল ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। চাহিদার একটি অংশ আসে মাটিতে সঞ্চিত খাদ্যোপাদান থেকে, আর বাকিটা সারের মাধ্যমে জমিতে সরবরাহ করতে হয়।
সারের মাত্রা
মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া, উৎপাদন মৌসুম, ফসলের ধরন ও জাত, ফসল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে সারের মাত্রা নির্ধারিত হয়। উল্লেখ্য, যে দুটো জিনিসের নিরূপণ ছাড়া সারের মাত্রা ঠিক করা যায় না তার একটি হলো ফসলের চাহিদা এবং দ্বিতীয়টি হলো একক জমিতে বিদ্যমান পরিশোষণযোগ্য অবস্থায় গাছের খাদ্যোপাদানের পরিমাণ।
যদি একক জমিতে সঞ্চিত খাদ্যোপাদানের পরিমাণ একক জমির জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছের চাহিদার সমান বা বেশি হয় তা হলে সে জমিতে সার প্রয়োগ করার কোন প্রয়োজন হয় না। আর যদি কম থাকে তবে সে জমিতে অবশ্যই সার প্রয়োগ করতে হবে। তখন সারের পরিমাণ হবে গাছের চাহিদা এবং মাটিতে সঞ্চিত খাদ্যোপাদানের পরিমাণের ব্যবধানের সমান।
অর্থাৎ গাছের চাহিদা যদি হয় ৩০ কেজি নাইট্রোজেনের আর জমিতে থাকে ২২ কেজি, তাহলে সার হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে ৩০-২২ = ৮ কেজি নাইট্রোজেন, যা ইউরিয়ার মাধ্যমে প্রয়োগ করলে প্রয়োজন হবে ১৭.৩৯১ কেজির এবং এমোনিয়াম সালফেটের মাধ্যমে দিলে লাগবে ৩৯.০২৪ কেজি। অনুরূপভাবে অন্যান্য সারের মাত্রাও নিরূপণ করা যাবে।
যেহেতু বিভিন্ন এলাকার মাটির উর্বরতা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। এমনকি একই জমির বিভিন্ন অংশে উর্বরতা ভিন্নতর হতে পারে । সেজন্য যে কোন এলাকার জন্য সারের নিখুঁত মাত্রা সুপারিশ করা সম্ভব হয় না । তবুও অনেক পরীা-নিরীা, এলাকার শস্য বিন্যাস, আবহাওয়া ও সাধারণ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে কোন এলাকার জন্য সারের মাত্রা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো মাটির উর্বরতা বজায় রেখে এবং সারের অপচয় না ঘটিয়ে লাভজনক ও সাফল্যজনকভাবে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করা। নিচে বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি ফসলের সারের মাত্রা উল্লেখ করা হলো। স্থানীয় অবস্থার পরিপ্রে িতে এর কিছু কমবেশি (অতি উর্বর মাটির জন্য কিছুটা কম এবং অনুর্বর মাটির জন্য কিছুটা বেশি) হতে পারে।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সার প্রয়োগের প্রক্রিয়াকে সার প্রয়োগ পদ্ধতি বলে। প্রয়োগ পদ্ধতির উপর সারের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। উপযুক্ত সময়ে ও সঠিক পদ্ধতিতে সার ব্যবহার না করলে পুষ্টি উপাদানের অপচয় ঘটে। যেমন- আয়তনবহুল গোবর, কম্পোস্ট সার ইত্যাদি জমি চাষের শুরুতেই প্রয়োগ করলে মাটিতে ভালভাবে মিশতে পারে এবং পুষ্টি উপাদানগুলো সহজেই উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় চলে আসে।
সবটুকু নাইট্রোজেন সার একবারে প্রয়োগ করলে উদ্ভিদ গ্রহণ করার আগেই তা বিভিন্নভাবে নষ্ট হয়ে যায়। নিচে সার প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
ছিটিয়ে প্রয়োগ
দানাদার এবং শুকনা সার হাত দিয়ে বা যন্ত্রের সাহায্যে জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে দেয়াকে ছিটানো প্রয়োগ পদ্ধতি বলে। এেেত্র অল্প অল্প করে একবার জমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ও পরে আড়াআড়িভাবে ছিটিয়ে দিতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা হয় সে পরিমাণকে ব্যাসাল ডোজ (Basal dose) বা প্রাথমিক মাত্রা বলা হয় ।
টপ ড্রেসিং (Top dressing) বা উপরি প্রয়োগ পদ্ধতি
জমিতে দাঁড়ানো অবস্থায় ফসলের উপর থেকে ছিটিয়ে সার প্রয়োগকে টপ ড্রেসিং বা উপরি প্রয়োগ পদ্ধতি বলা হয়। সাধারণত নাইট্রোজেনজাতীয় সার এভাবে প্রয়োগ করা হয়। প্রয়োজনে পটাশিয়াম সারও এ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে যে সব সার সহজে মাটির মধ্যে চলাচল করতে পারে না, যেমন ট্রিপল সুপার ফসফেট, সেগুলো এ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয় না ।
পার্শ্ব প্রয়োগ পদ্ধতি
ফসল গাছের গোড়ায় সারির এক পাশ বা উভয় পাশ থেকে ছিটিয়ে সার প্রয়োগ করাকে পার্শ্ব প্রয়োগ বলা হয়, যেমন- আলু, চীনাবাদাম, ফুলকপি, বাঁধাকপির বেলায় প্রযোজ্য।
স্থানীয়ভাবে বা অকুস্থলে প্রয়োগ পদ্ধতি
ফসল গাছের শিকড়ের কাছাকাছি স্থানে মাটির নিচে ফালিতে (Furrow) সার প্রয়োগকে স্থানীয়ভাবে বা অকুস্থলে প্রয়োগ পদ্ধতি বলে। সারের অপচয় রোধ করাই এর মূল উদ্দেশ্য। স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে ।
মাদায় প্রয়োগ পদ্ধতি
বীজ বা চারা লাগানোর জন্য তৈরি মাদায় ঝুরঝুরে মাটিতে সার মিশিয়ে দেয়াকে মাদায় প্রয়োগ পদ্ধতি বলে, যেমন- লাউ, কুমড়া, সীম, আম, কাঁঠাল ইত্যাদির বেলায় প্রযোজ্য।
সিঞ্চন পদ্ধতি
তরল সার অথবা শুকনা সারকে পানিতে দ্রবীভূত করে স্প্রে বা সিঞ্চন যন্ত্রের সাহায্যে সার প্রয়োগকে সিঞ্চন পদ্ধতি বলে। ইউরিয়া বা অন্যান্য গৌণ সার এ পদ্ধতিতে পাতায় প্রয়োগ করা হয়।