বাংলাদেশের কৃষি-নির্ভর সমাজে মাঠ ফসল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ ফসলগুলোকে বৈজ্ঞানিক ও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে ফসলের বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হয়।
Table of Contents
🧪 মাঠ ফসলের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Field Crops)
কৃষিতাত্ত্বিক ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ:
মাঠ ফসলকে কৃষিতাত্ত্বিক ভিত্তিতে সাধারণত নিম্নলিখিত শ্রেণিগুলোর মধ্যে ভাগ করা হয়:
১. তণ্ডুলজাতীয় শস্য (Cereal Crops)
এই শস্যগুলো ঘাস (Gramineae) পরিবারের অন্তর্গত এবং প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে পরিচিত। এদের দানাগুলো আহারোপযোগী এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ।
উদাহরণ:
- ধান (Rice)
- গম (Wheat)
- যব (Barley)
- ভুট্টা (Maize)
- বাজরা (Pearl millet)
- জোয়ার (Sorghum)
- চীনা, কাওন, রাই ইত্যাদি।
২. ডাল ফসল (Pulses or Grain Legumes)
এই শ্রেণির ফসলগুলো Leguminosae পরিবারের Papilionaceae উপপরিবারভুক্ত এবং প্রধানত আমিষ (Protein) সরবরাহের উৎস। এগুলো মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক।
উদাহরণ:
- মসুর (Lentil)
- ছোলা (Chickpea)
- খেসারি (Grass pea)
- মটর (Pea)
- মাষ (Black gram)
- মুগ (Green gram)
- অড়হর (Pigeon pea)
- বরবটি (Cowpea)
৩. তৈলবীজ ফসল (Oilseed Crops)
এই ফসলের বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয় যা স্নেহ জাতীয় উপাদান সরবরাহ করে এবং খাদ্য, শিল্প ও জ্বালানি কাজে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- সরিষা (Mustard)
- চীনাবাদাম (Groundnut)
- সয়াবিন (Soybean)
- সূর্যমুখী (Sunflower)
- তিল (Sesame)
- তিসি (Linseed)
- কুসুম (Safflower)
- রেড়ি (Castor)
- গর্জন তিল (Niger)
৪. চিনি ফসল (Sugar Crops)
এই ফসলগুলোর রস থেকে চিনি, গুড় ও মিছরি উৎপাদিত হয়। এগুলোতে উচ্চমাত্রার শর্করা থাকে।
উদাহরণ:
- আখ (Sugarcane)
- চিনি বীট (Sugar beet)
অতিরিক্ত: খেজুর ও তাল থেকেও গুড় তৈরি হয়; যদিও এগুলো মাঠ ফসলের অন্তর্ভুক্ত নয়, তবুও চিনি ফসল হিসেবে বিবেচিত।
৫. আঁশ ফসল (Fibre Crops)
এই ফসলগুলো থেকে আঁশ সংগ্রহ করে কাপড়, দড়ি ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা হয়।
উদাহরণ:
- পাট (Jute)
- তুলা (Cotton)
- শনপাট (Sunnhemp)
- কেনাফ (Kenaf)
- রামী (Ramie)
৬. নেশাজাতীয় ফসল (Narcotic Crops)
এই শ্রেণির ফসল থেকে বিভিন্ন উত্তেজক বা প্রশমক পদার্থ তৈরি হয়, যেগুলো ঔষধি ব্যবহার থাকলেও অতিরিক্ত সেবনে নেশা সৃষ্টি করে।
উদাহরণ:
- তামাক (Tobacco)
- আফিম (Opium poppy)
- গাঁজা (Hemp)
- হেনবেন (Henbane)
- কুম্ভি (Kumbhi)
৭. পানীয় ফসল (Beverage Crops)
এই ফসলগুলো থেকে উদ্দীপক পানীয় তৈরি হয়। এগুলো পুষ্টি না দিলেও চেতনা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
উদাহরণ:
- চা (Tea)
- কফি (Coffee)
- কোকো (Cocoa)
- কোলা (Cola)
৮. পশুখাদ্য ফসল (Forage & Pasture Crops)
এই ফসলগুলো গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে চাষ করা হয়। চারণভূমিতে এসব ফসল পশুকে সরাসরি খাওয়ানো হয়।
উদাহরণ (Fodder crops):
- খেসারী
- ঘাস কালাই
- ভুট্টা
- জোয়ার
চারণভূমির ঘাস: - দূর্বা ঘাস (Bermuda grass)
- কার্পেট ঘাস
- ক্লোভার (Clovers)
৯. সবুজ সার ফসল (Green Manuring Crops)
এই শ্রেণির ফসল জৈব সার তৈরির উদ্দেশ্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এতে মাটির জৈব উপাদান ও উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ:
- ধইঞ্চা (Dhaincha)
- শনপাট (Sunnhemp)
গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ:
ফসল চাষের বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন ভিত্তিতে ফসলকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এই শ্রেণিবিন্যাস কৃষকদের পরিকল্পিত চাষ, মাটির ব্যবহার, সেচের ব্যবস্থা, সময়নির্ধারণ ও বীজ নির্বাচন সহজ করে তোলে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিতে ফসলের শ্রেণিবিভাগ উপস্থাপন করা হলো:
🌾 ১. উৎপাদনের মৌসুম অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ
বাংলাদেশে ফসল সাধারণত তিনটি মৌসুমে উৎপাদিত হয়—রবি, খরিপ-১, খরিপ-২। এই শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে ফসলগুলো নিচের মতোভাবে ভাগ করা যায়:
ক. রবি শস্য (শীতকালীন ফসল):
রবি মৌসুমে বপন করা হয় এবং সাধারণত শুষ্ক ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠে।
উদাহরণ:
- বোরো ধান
- গম
- যব
- সরিষা
- ডাল শস্য (মসুর, ছোলা)
খ. খরিপ শস্য (গ্রীষ্মকালীন ও বর্ষাকালীন ফসল):
(১) খরিপ-১ শস্য:
প্রথম খরিপ মৌসুমে (এপ্রিল-জুন) বপন করা হয়।
উদাহরণ:
- আউশ ধান
- পাট
- ভুট্টা
(২) খরিপ-২ শস্য:
দ্বিতীয় খরিপ মৌসুমে (জুলাই-অক্টোবর) বপন করা হয়।
উদাহরণ:
- আমন ধান
- সূর্যমুখী
- সয়াবীন
গ. উভয় মৌসুম শস্য:
কিছু ফসল উভয় মৌসুমেই উৎপাদনযোগ্য।
উদাহরণ:
- তিল
- কাওন
- ভুট্টা
- চীনা বাদাম
🌼 ২. পরাগায়নের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (Pollination)
ফসলের পরাগায়ন প্রক্রিয়া প্রজনন এবং ফলন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক. স্ব-পরাগী (Self-pollinated) ফসল:
নিজের ফুলের পরাগেই নিষেক সম্পন্ন হয়।
উদাহরণ:
- ধান
- গম
- তামাক
- ডাল ফসল
খ. পর-পরাগী (Cross-pollinated) ফসল:
ভিন্ন ফুল থেকে পরাগ গ্রহণ করে নিষেক ঘটে।
উদাহরণ:
- সরিষা
- ভুট্টা
- ফুলকপি
- বাঁধাকপি
- গাজর
গ. স্ব ও পর-পরাগী (Often cross-pollinated) ফসল:
স্ব-পরাগায়ন বেশি হলেও পর-পরাগায়নও ঘটে।
উদাহরণ:
- তুলা
- সূর্যমুখী
🌱 ৩. জীবনকাল অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ (Life Cycle Based)
ক. একবর্ষী (Annual) ফসল:
একটি মৌসুমে জীবচক্র সম্পন্ন করে।
উদাহরণ:
- ধান
- পাট
- তামাক
খ. দ্বি-বর্ষী (Biennial) ফসল:
প্রথম বর্ষে পাতা ও শিকড়, দ্বিতীয় বর্ষে ফুল ও ফল উৎপাদন করে।
উদাহরণ:
- সুগার বীট
- গাজর
গ. বহু বর্ষী (Perennial) ফসল:
দীর্ঘ সময়জুড়ে উৎপাদনক্ষম থাকে।
উদাহরণ:
- চা
- কফি
- আম
- জাম
- কাঁঠাল
🌾 ৪. বীজপত্রের সংখ্যার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (Based on Cotyledons)
ক. একবীজপত্রী (Monocot) ফসল:
বীজে একটি বীজপত্র থাকে।
উদাহরণ:
- ধান
- গম
- ভুট্টা
- চীনা
- কাওন
খ. দ্বিবীজপত্রী (Dicot) ফসল:
বীজে দুটি বীজপত্র থাকে।
উদাহরণ:
- পাট
- সরিষা
- তামাক
- ডাল ফসল
🌞 ৫. ফুল উৎপাদনে দিনের দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (Photoperiodism Based)
ক. খাটো দিবস ফসল (Short Day Crops):
অল্প দিনের আলো পেলে ফুল ফোটে।
উদাহরণ:
- পাট
- আখ
- মিষ্টি আলু
- আমন ধান
খ. দীর্ঘ দিবস ফসল (Long Day Crops):
দীর্ঘ সময় আলোর সংস্পর্শে থাকলে ফুল ফোটে।
উদাহরণ:
- সুগার বীট
- বাঁধাকপি
- পালং শাক
গ. দিন নিরপেক্ষ ফসল (Day Neutral Crops):
দিনের দৈর্ঘ্য ভেদে তাদের ফুল ফোটার উপর প্রভাব পড়ে না।
উদাহরণ:
- সয়াবীন
- ভুট্টা
- আউশ ধান
- বোরো ধান
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় সফলতা নিশ্চিত করার জন্য ফসলের প্রকৃতি, চাষের পরিবেশ, মাটির ধরণ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং ব্যবহারের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অংশে আলোচনা করা হলো ফসলের আরও কিছু বিশেষ শ্রেণিবিভাগ, যা কৃষি পরিকল্পনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পরিবেশ, মাটির ধরণ, জলবায়ু সহনশীলতা এবং ব্যবহারের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ:
🌍 ১. মাটির অম্লত্বের (pH) ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
মাটির pH মানের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে ফসলের চাষাবাদে সাফল্য ভিন্ন হতে পারে। নিচে তিন ধরনের মাটির উপযোগী ফসলের শ্রেণি দেওয়া হলো:
ক. অম্ল সহনশীল ফসল:
অম্লীয় মাটিতে ভালো জন্মায়।
উদাহরণ:
- চা
- কফি
খ. ক্ষার সহনশীল ফসল:
ক্ষারযুক্ত বা এলকেলাইন মাটিতে ভালো জন্মায়।
উদাহরণ:
- সুগার বীট
- ধান
গ. নিরপেক্ষ মাটির ফসল:
যেসব ফসল নিরপেক্ষ বা মাঝারি pH (প্রায় ৬.৫–৭.৫) সহ্য করে।
উদাহরণ:
- পাট
- গম
- আখ
🌡️ ২. অভিযোজন তাপমাত্রার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
তাপমাত্রা ফসলের বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। নিম্নরূপভাবে ফসলগুলিকে ভাগ করা যায়:
ক. উষ্ণ জলবায়ুর ফসল:
উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী।
উদাহরণ:
- মসুর
- ছোলা
- অড়হর
খ. অবউষ্ণ জলবায়ুর ফসল:
উষ্ণ-আর্দ্র জলবায়ুতে জন্মায়।
উদাহরণ:
- আখ
- পাট
- ধান
গ. শীতল জলবায়ুর ফসল:
ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভালো জন্মায়।
উদাহরণ:
- গম
- যব
- সুগারবীট
🧬 ৩. ফসলের বিশেষ শ্রেণিবিভাগ (Special Classification of Crops)
ক. অন্তর্বর্তী ফসল (Catch Crop):
বছরের প্রধান দুই ফসলের মধ্যবর্তী সময়কে কাজে লাগিয়ে স্বল্প মেয়াদি ফসল চাষ করা হয়।
উদাহরণ:
- বোরো ও আমনের মাঝে চীনা বা কাওন
বিশেষ বিবেচনা:
যখন প্রধান ফসল প্রাকৃতিক কারণে ব্যর্থ হয়, তখন এই ধরণের ফসল বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
খ. অর্থকরী ফসল (Cash Crop):
যে ফসল চাষ করে কৃষক নগদ অর্থ বা অন্যান্য চাষ খরচ মেটাতে পারে।
উদাহরণ:
- তামাক
- পাট
- আখ
গ. আচ্ছাদন ফসল (Cover Crop):
ভূমি ক্ষয় রোধ এবং আগাছা নিয়ন্ত্রণে ভূমি ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- চীনা বাদাম
- ক্লোভার
- দূর্বাঘাস
ঘ. সংরতি গো-খাদ্য ফসল (Silage Crop):
সবুজ অবস্থায় সংগ্রহ করে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে গবাদিপশুকে খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণ:
- ভুট্টা
- জোয়ার
- নেপিয়ার ঘাস
ঙ. মিশ্র ফসল (Mixed Cropping):
একাধিক ফসলের বীজ একসাথে বপন করে একই জমিতে চাষ।
উদাহরণ:
- গম ও মসুর একসাথে বপন
চ. আন্তঃফসল (Inter-Cropping):
প্রধান ফসলের সারির মাঝে অন্য ফসল চাষ।
উদাহরণ:
- গমের সাথে মসুর চাষ
ছ. সাথি ফসল (Relay Crop):
একটি ফসল কাটার আগে, তার জমিতে পরবর্তী ফসল বপন।
উদাহরণ:
- আমন ধানের মাঠে খেসারির চাষ
জ. বহুগুণ ফসল (Multiple Cropping):
একই জমিতে এক বছরে একাধিক ফসল চাষ।
উদাহরণ:
- এক জমিতে আউশ → আমন → বোরো ধান চাষ
এই বিশেষ শ্রেণিবিভাগগুলো আমাদের কৃষিকে আরও বৈচিত্র্যময়, টেকসই ও উৎপাদনক্ষম করতে সাহায্য করে। সময়, জমি ও সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাসকে বিবেচনায় রাখা কৃষকদের জন্য অপরিহার্য।