আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-কাঠ ও বাঁশ সিজনিং এবং সংরক্ষণ। কাঠ ও বাঁশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত দুটি প্রাকৃতিক উপাদান। ঘরবাড়ি নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে এদের বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। তবে, এই উপকরণগুলো কাটার পর সরাসরি ব্যবহার করলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না; বরং ঘুন, ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই সমস্যার সমাধানে কাঠ ও বাঁশের সিজনিং এবং সংরক্ষণ একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া।
সিজনিংয়ের পাশাপাশি সংরক্ষণ প্রক্রিয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সিজনিংকৃত কাঠ ও বাঁশ রাসায়নিক দ্রবণ, যেমন সিসিবি (ক্রোমিক এসিড, কপার সালফেট ও বোরিক এসিডের মিশ্রণ) দ্বারা পরিশোধন করে আরও টেকসই করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় উপকরণগুলোর আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায় এবং তা ঘুন, ছত্রাক ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকে।
এই প্রবন্ধে আমরা কাঠ ও বাঁশের সিজনিং ও সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি, যেমন বায়ু পদ্ধতি, কিলন পদ্ধতি এবং রাসায়নিক সংরক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। এছাড়াও, আমরা এই প্রক্রিয়াগুলোর উপকারিতা, প্রয়োগ পদ্ধতি এবং ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোকপাত করব, যা কাঠ ও বাঁশের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
কাঠ ও বাঁশ সিজনিং এবং সংরক্ষণ
ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরি করতে কাঠ ও বাঁশের বহুবিধ ব্যবহার হয়ে থাকে। গাছ লাগানোর পর পরিণত বয়সে কেটে নিয়ে কাঠ চেরাই বা ফালি করে আসবাবপত্র ও ঘরবাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। তদ্রূপ পরিপক্ব বাঁশ কাটার পর ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কিন্তু এই কাঠ ও বাঁশ কাটার পর পরই ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ যে কোনো জীবের দেহের ওজনের বেশির ভাগই হলো পানি। এ পানি জীবন্ত অবস্থায় গাছ বা বাঁশের জন্য অপরিহার্য হলেও কাটার পর গাছ বা বাঁশে যত কম পানি থাকবে সেই বাঁশ বা কাঠ তত বেশিদিন টিকবে।
কর্তনকৃত গাছ বা বাঁশ থেকে সমস্ত পানি বা আর্দ্রতা বের করে নেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কাঠ বা বাঁশের ওজন যদি ১২% এ নামিয়ে আনা যায় তবে ধরে নেয়া হয় যে সেই কাঠ বা বাঁশ ব্যবহারের জন্য সর্বোত্তম। কাঠ বা বাঁশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি থাকলে তা ঘুন উইপোকা, কাঠ ছিদ্রকারী বিটল, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।
তাই সিজনিং করলে কাঠ ও বাঁশকে এসব ক্ষতিকর পোকা ও ছত্রাকের হাত থেকে রক্ষা কর যায় এবং এদের স্থায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়। নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে কাঠ ও বাঁশ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অতিরিক্ত পানি বের করে নেয়ার পদ্ধিতিকেই সিজনিং বলা হয়।
অনেক সময় দেখা যায় যে, গ্রাম-গঞ্জের মানুষ কর্তনকৃত গাছের টুকরো অর্থাৎ লগ ও বাঁশ কেটে পুকুর বা ডোবার পানিতে ফেলে রাখে এবং দীর্ঘদিন পর তা তুলে কাঙ্ক্ষিত কাজে ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিকেও অনেকে সিজনিং বলে থাকে। মূলত এতে কাঠ বা বাঁশের আয়ুষ্কাল বাড়লেও এটা সিজনিং নয়।
কারণ এই পদ্ধতিতে কাঠ বা বাঁশের মধ্যে যে সমস্ত শর্করা জাতীয় পদার্থ আছে তা পোকামাকড় ও ছত্রাকের প্রিয় খাবার, এগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে কাঠ বা বাঁশ থেকে বের হয়ে যায় বলেই কাঠ বা বাঁশের আয়ুষ্কাল কিছুটা বেড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এ পদ্ধতিতে কাঠ বা বাঁশ থেকে পানি বের হয় না বলে এটাকে সিজনিং বলা যাবে না। সিজনিং করার পদ্ধতি
দুই পদ্ধতিতে, সিজনিং করা যায়-
১। বায়ু পদ্ধতি,
২। কিলন পদ্ধতি।
বায়ু পদ্ধতি
বাঁশ কাটার পর বা গাছ কেটে চেরাই করার পর তা যদি অনেকদিন রোদে শুকানো হয়, তবে সে বাঁশ বা কাঠ থেকে আস্তে আস্তে পানি বের হয়ে যায়। চেরাই কাঠ বা তক্তাকে প্রতিদিন মৃদু সূর্যালোকে এপিঠ ওপিঠ করে দীর্ঘদিন শুকালে তক্তা থেকে পানি বের হয়ে যাবে।
কিন্তু এ পদ্ধতিতে পানির পরিমাণ ১২% এ নেমে আসবে না। তবে তা ২০% এর কাছাকাছি থাকবে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তক্তাকে প্রখর রোদে শুকালে তা ফেটে কিংবা বেঁকে যেতে পারে। সেজন্য চেরাই কাঠকে কখনোই প্রখর সূর্যালোকে শুকাতে হয় না।
কাঠের পরিমাণ বেশি হলে ও কম জায়গায় সুষ্ঠুভাবে কাঠ সিজনিং করতে চাইলে তক্তা বা ফালিকে স্তরে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে একটি তক্তা বা ফালি অন্য তক্তা বা ফালির গায়ে না লাগে এবং দুটো তক্তা বা ফালির মাঝখানের স্থান দিয়ে বায়ু চলাচল করতে পারে।
এজন্য চেরাই কাঠকে মাটি থেকে ৩৫-৪৫ সে.মি. উঁচুতে ছায়াযুক্ত স্থানে স্তরে স্তরে সাজিয়ে। রেখে দিলে আস্তে আনে চেরাই কাঠ শুকিয়ে যায়। দুটো তক্তা বা ফালির মাঝখানে ৩-৪ সে.মি. পুরু দুটো কাঠের টুকরো দুপাশে বসাতে হবে যাতে দুটো তক্তা বা ফালির মাঝখান দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে।
খোলা জায়গায় এ কাজটি করতে হয় যাতে প্রতিটি তা বা ফালিতে চারদিক থেকে ভালোভাবে বাতাস লাগে। খোলা বাতাস রেখে এ পদ্ধতিতে কাঠ সিজনিং করাকে বায়ু শুকানো পদ্ধতি বলা হয়। চেরাই কাঠ কখনও এলোমেলোভাবে রাখা ঠিক নয়। কারণ এতে, চেরাই কাঠ বেঁকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বায়ু শুকানো পদ্ধতিটি অত্যড় সহজ ও ব্যয় কম, তবে এ পদ্ধতিতে কাঠ সিজনিং করতে কমপক্ষে একটি শু মৌসুমের প্রয়োজন হয়।
কিলন পদ্ধতি
কাঠের পরিমাণ অনেক বেশি হলে এ পদ্ধতির দ্বারা সিজনিং করা হয়। প্রশ্ন আসে কিলন কী? কিলন হলো একটা বড় পাকা বায়ু নিরোধক কক্ষ যেখানে চেরাই কাঠকে পূর্বের মতো স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্রথম জলীয় বাষ্প প্রবেশ করিয়ে কাঠের মধ্যে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়।
পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি কাঠ বা তেল পুড়িয়ে উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করে তা সে কক্ষে প্রয়োগ করে কাঠ থেকে পানি বের করে নেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে কাঠ সিজনিং করে ২১ দিনের মধ্যে কাঠে পানির পরিমাণ ১২% এ নামিয়ে আনা হয়। তবে কাঠভেদে এ সময় কম-বেশি হতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, তাপই যদি দেয়া হয় তবে প্রথমে জলীয়বাষ্প ঢুকিয়ে কাঠে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয় কেন? উল্লেখ্য কাঠে যে পানি থাকে তা কাঠের সব জায়গায় সমান পরিমাণ থাকে না। যেমন- কাঠের ওপরের অংশে ভিতরের চেয়ে বেশি পানি থাকে।
এই অবস্থায় তাপ দিলে ওপরের অংশের পানি বেশি বের হয়ে যাবে। কিন্তু কাঠের ভিতরের অংশে বেশি পানি থেকে যাবে। এই ধরনের তারতম্যের ফলে কাঠে অনেক ত্রুটি দেখা দেয়। এজন্য ত্রুটিমুক্ত কাঠ পাওয়ার জন্য প্রথমে জলীয়বাষ্প ঢুকিয়ে কাঠের সব জায়গায় পানির পরিমাণ সমান করা হয় এবং পরে তাপ প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রিতভাবে কাঠ থেকে পানি বের করে নেয়া হয়।
উল্লেখ্য বাঁশ সিজনিং করার জন্য কিলান দেয়ার প্রয়োজন নেই। বায়ু পদ্ধতিতে সিজনিং এর চেয়ে কিলন পদ্ধতিতে কাঠ সিজনিং করতে সময় কম লাগে, সিজনিং ভালো হয় এবং কাঠ থেকে ইচ্ছা মাফিক পানি বের করে আনা যায়। তবে এ পদ্ধতি বায়ু পদ্ধতিতে সিজনিং এর চেয়ে খরচ বেশি পড়ে।
কাঠ ও বাঁশ সংরক্ষণ
কাঠ ও বাঁশ সিজনিং করার পরও রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা পরিশোধন করতে হয়। নচেত এগুলো মাটি কিংবা পানির সংস্পর্শে আসলে এদের স্থায়িত্ব অনেক কমে যায়। রাসায়নিক পদ্ধতি দ্বারা কাঠ বা বাঁশ সংরক্ষণ করার মূলনীতি হলো নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের দ্রবণ বাঁশ বা কাঠের মধ্যে নির্দিষ্ট চাপ পদ্ধতিতে প্রবেশ করানো হয়।
নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থের দ্রবণটিকে সংক্ষেপে সিসিবি বলা হয়। এ সিসিবি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
সি সি বি’র উপাদান
উপাদান
শতকরা পরিমাণ
ক্রোমিক এসিড।
89.0
কপার সালফাইড
১৮,৫
বোরিক এসিড
08.0
উপরিউক্ত উপাদানগুলো বাজার থেকে পৃথকভাবে কিনেও সিসিবি তৈরি করা যায়। উল্লেখ্য সিসিবি দ্বারা কাঠ বা বাঁশ পরিশোধন করার পর তা ভালোভাবে বায়ুতে শুকিয়ে নিতে হয়।
সারমর্ম
সিজনিং হলো কাঠ বা বাঁশ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়া। কাঠ বা বাঁশে পানির পরিমাণ শতকরা প্রায় ১২ ভাগে নামিয়ে আনতে পারলে এদের স্থায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়।
কারণ এতে কীটপতঙ্গ বা ছত্রাক আক্রমণ করতে পারে না। সিজনিং করার পরেও কাঠ বা বাঁশ সংরক্ষণের জন্য সিসিবি দ্বারা পরিশোধন করে নিয়ে বায়ুতে ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। এতে কাঠ বা বাঁশের আয়ুষ্কাল অনেক অনেকগুণ বেড়ে