মৌসুমী পুকুরে মাছ চাষ

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-মৌসুমী পুকুরে মাছ চাষ। বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য দিঘি, পুকুর, ডোবা ও জলাশয়। কোন কোন জলাশয় বছরের অধিকাংশ সময় পতিত থাকে। একটু চেষ্টা করলেই এসব জলাশয়ে সহজে মাছ চাষ করা যায়। আমাদের দেশে মাছ চাষ বলতে পুকুরে মাছ চাষকেই বুঝায়। দেশে অধিকাংশ পুকুরেই নিয়ম অনুযায়ী মাছ চাষ করা হয় না। আবার সব পুকুরে সব রকম মাছ চাষ করা যায় না। বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২৭৫ টি স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যায়। প্রজাতির সব মাছ পুকুরে চাষ করা যায় না। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেছে। পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

এ ইউনিট শেষে আপনিঃ

  • মৌসুমী পুকুরে এবং
  • স্থায়ী পুকুরে মাছ চাষ করার পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারবেন।

মৌসুমী পুকুরে মাছ চাষ

 

 

অনেক পুকুর আছে যেখানে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না, সেগুলোকে মৌসুমী পুকুর বলে। অর্থাৎ বছরে ৩-৮ মাস পানি থাকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এ জাতীয় অসংখ্য পুকুর আছে। উপযুক্ত ব্যবহারের অভাবে এসব পুকুর পড়ে থাকে। অনেক ছোট জাতের মাছ এসব জলাশয়ে বা পুকুরে খুব সহজে চাষ করা যায়। যেমন- রাজপুঁটি নাইলোটিকা, দেশী শিং,
মাগুর ইত্যাদি।

মৌসুমী পুকুরে মাছ চাষের সুবিধা

  • পারিবারের বাড়তি আয় হয়।
  • আমিষের চাহিদা পূরন হয়।
  • গ্রামীন মহিলারাও সহজে অংশগ্রহণ করতে পারে।
  • অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে মাছ চাষ করা যায়।
  • পতিত জলাশয় চাষাবাদের আওতায় এনে পরিবেশ ভালো রাখে
  • রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট অংশ খাবার হিসেবে পুকুরে দেয়া যায়।

চাষ পদ্ধতি

পুকুরে মাছ চাষ আরম্ভ করার পূর্বে পুকুর প্রস্তুত করতে হয়। পূর্বের ইউনিটে পুকুর প্রস্তুতির নিয়মাবলি বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপ ধাপগুলি বর্ণনা করা হলো-

ক. আগাছা পরিষ্কার।

খ. রাক্ষুসে মাছ ও আগাছা অপসারণ।

গ. পাড় ও তলা মেরামত।

ঘ. চুন ও সার প্রয়োগ।

ঙ. পানি সরবরাহ।

চ. প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা।

এ ধাপগুলোকে পোনা মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনাও বলা যায়।

 

 

ক. আগাছা পরিষ্কার

আগাছা পুকুরে ব্যবহৃত সার থেকে পুষ্টি শোষণ করে। মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও রাক্ষুসে মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নিচের যে কোন একটি পদ্ধতির মাধ্যমে আগাছা পরিষ্কার করা যায়-

১. কায়িক শ্রম দ্বারা

দেশের বেকার শ্রমজীবী মানুষকে সহজেই এ কাজে লাগানো যায়। কচুরিপানা, হেলঞ্চা, কলমিলতা ইত্যাদি সহজেই পরিষ্কার করা যায়।

২. জৈব পদ্ধতিতে

গ্রাসকার্প ও রাজপুঁটি উদ্ভিদভোজী মাছ। এসব মাছ পুকুরে মজুদ করলে আগাছা খেয়ে সহজেই পুকুর পরিষ্কার করে ফেলে।

৩. রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে

মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য সবুজ শেওলা পুকুরে অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে মাছ চাষে বিঘ্ন ঘটে। শতাংশ প্রতি ১ মিটার গভীরতার পানির জন্য ৩৫ গ্রাম কপার সালফেট (তুঁতে) প্রয়োগ করে অতিরিক্ত সবুজ শেওলা দূর করা যায়।

খ. রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ অপসারণ

এসব মাছ পুকুরে চাষকৃত মাছের পোনা ও খাবার খেয়ে ফেলে। তাই মাছ চাষের শুরুতে এসব মাছ সরিয়ে ফেলতে হয়। নিচের যে কোন একটি পদ্ধতির দ্বারা রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করা যায়।

১. পুকুর শুকনো

রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ অপসারণের জন্য পুকুর শুকনো প্রয়োজন। পাম্প মেশিনের সাহায্যে পুকুর সেচে ফেলতে হয়। তারপর পুকুরের তলায় চাষ দেয়া ভালো। এতে ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস হয়, উৎপাদনশীলতা বাড়ে।

২. জাল টেনে

পুকুরে পানি কম থাকলে বার বার জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ দূর করা যায়। জালের নিচের অংশে ইট বা ভারী কিছু বেঁধে আস্তে আস্তে জাল টানতে হয়।

 

 

৩. রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ

অনেক সময় পুকুর শুকানো সম্ভব হয় না। আবার জাল টেনেও সব রাক্ষুসে মাছ অপসারণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রোটেনন, ফসটক্সিন, ব্লিচিং পাউডার নির্দিষ্ট মাত্রায় পুকুরে দিতে হয়। পরবর্তী পৃষ্ঠায় কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার মাত্রা দেয়া হলো:

দ্রব্যের নাম                              ব্যবহার মাত্রা/শতাংশ

রোটেনন                                  ৩০-৩৫ গ্রাম

ফসটক্সিন                             ৩ গ্রাম (১টি টেবলেট)

ব্লিচিং পাউডার                            ১০০ গ্রাম

রোটেনন বা ব্লিচিং পাউডার পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিলে ১ ঘণ্টা পর মাছ পানির উপর ভাসতে শুরু করে। তখন বার বার জাল টেনে মাছ তুলে ফেলতে হয়। রোটেননের বিষাক্ততার মেয়াদ ৭ দিন। রোটেনন দিয়ে মারা মাছ যাওয়া যায় ব্লিচিং পাউডার দিলে পুকুরে চুন দিতে হয় না। ফসটক্সিন টেবলেট সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হয়।

গ. পাড় ও তলা মেরামত

পাড় ভাঙা থাকলে বর্ষাকালে পুকুরের মাছ বাইরে চলে যেতে পারে আবার রাক্ষুসে মাছ পুকুরে ঢুকতে পারে। তাই শুকনো মৌসুমে ভাঙা পাড় মেরামত করে তাতে ঘাস লাগালে পাড় শক্ত হয়। তলা অসমান থাকলে জাল টানতে অসুবিধা হয়। সেজন্য কোদাল বা লাগুল দিয়ে তলদেশ সমান করতে হয়। তলায় অতিরিক্ত কাদা থাকলে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। পুকুরের পরিবেশ যথাযথ রাখার জন্য ১৫-২০ সে.মি. কাদা রেখে অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হয়।

ঘ. চুন ও সার প্রয়োগ

পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট চুন ও সার দিতে হয়। চুন মাটির অম্ল ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। মাটি ও পানির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। পানিতে উদ্ভিদকণা ও আধিক্যের উপর পুকুরের উৎপাদনশীলতা নির্ভর করে। উদ্ভিদকণার আধিক্যের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়াম প্রয়োজন। অজৈব সার (ইউরিয়া, টি.এস.পি) ও জৈব সার (গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, সবুজ সার, কম্পোস্ট) ব্যবহারে পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মো ।

ঙ. পানি সরবরাহ

পুকুরে যদি প্রাকৃতিকভাবে পানি না জমে তবে মেশিনের সাহায্যে পানি ঢুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

চ. প্রাকৃতিক খাদ্য

পরীক্ষা পুকুরে চুন, সার ও পানি সরবরাহের সাতদিনের মধ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য জন্ম নেয়। পর্যাপ্ত খাদ্যসমৃদ্ধ পানির রং হাল্কা সবুজ বা বাদামি হয়। দুটি পরীক্ষার দ্বারা প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি বোঝা যায়-

১. গ্রাস পরীক্ষা

সার ব্যবহারের ৫-৭ দিন পর স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে পুকুরে পানি নিতে হবে। সূর্যের আলোতে যদি গ্লাসের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা ও প্রাণিকণা দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে।

২. হাত পরীক্ষা

নিজের হাত কনুই পর্যন্ত পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে হাতের তালু দেখুন। হাতের তালু দেখা না গেলে বুঝতে হবে প্রাকৃতিক খাদ্য আছে। হাতের তালু দেখা গেলে পুনরায় সার দিতে হবে।

সরপুঁটির চাষ

সরপুটি মাছ খুব শক্ত প্রাকৃতির, সুস্বাদু, সহজে রোগাক্রান্ত হয় না। মাত্র ৩ মাসে খাওয়ার এবং বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়।

পোনা মাছ মজুদ

পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষার পর যখন পানির রং সবুজ হবে, তখনই পুকুরে সরপুঁটি মাছের পোনা অবমুক্ত করতে হবে। শতাংশ প্রতি ৮-১০ সে.মি. আকারের ৬০-৮০ টি সরপুঁটির পোনা অবমুক্ত করতে হবে। পোনা অবমুক্ত করার আগে পোনার ব্যাগটি আধ ঘণ্টা পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।

এরপর পোনার ব্যাগটি কাত করে আস্তে আস্তে পুকুরের পানি ব্যাগে এবং ব্যাগের পানি পুকুরে দিতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে যখন পোনার ব্যাগের পানির তাপমাত্রা এবং পুকুরের পানির তাপমাত্রা প্রায় সমান হবে। তখন পোনার ব্যাগটি পুকুরে কাত করে ধরলে সমস্ত পোনা পুকুরে চলে যাবে। পুকুরে পোনা ছাড়ার পর তার পরিচর্যা প্রয়োজন।

পোনার পরিচর্যা

পোনা ছাড়ার পরদিন থেকেই প্রতিদিন পুকুরে যে পরিমাণ মাছ আছে তার শারীরিক ওজনের শতকরা ৩-৪ ভাগ হারে চালের কুঁড়ো দিতে হবে। তার কয়েকদিন পর অর্থাৎ ৮-১০ দিন থেকে সব ধরনের খাবার পুকুরে সরবরাহ করা যায়।

অন্যান্য পরিচর্যা

মাছ খাবার ঠিকমত খাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি দেখা যায় সকালে মাছ পানির উপরের দিকে মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে তখন বুঝতে হবে পানিতে অক্সিজেনের অভাব
হয়েছে।

স্বাস্থ্য পরীক্ষা

মাসে দুবার জাল বা পাতলা কাপড় টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হয়। মাছের পোনায় রোগ-বালাই হলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে। অক্সিজেনের তীব্র অভাব হলে পুকুরে খাবার ও সার দেয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া বাঁশ বা লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করে, ঘনঘন জাল টেনে বা পুকুরে সাঁতার কাটলে অক্সিজেনের অভাব দূর হবে।

মাছ আহরণ

পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে সরপুঁটি মাছ ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের হয়ে যায়। তখন টানা বেড় জাল দিয়ে মাছ আহরণ করতে হবে। সম্পূর্ণ মাছ আহরণ করার জন্য পুকুর সেচে ফেলতে হবে। মাছ আহরণের কাজ ভোররাত থেকে সকাল ৮-৯টা পর্যন্ত করা যায়। এ সময় মাছগুলো বিক্রি করলে মূলাও ভালো পাওয়া যাবে।

নিচে ২০ শতাংশের একটি পুকুরে ৫-৬ মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখান হলোঃ

 

দেশী মাছ চাষ মাগুর, শিং, কৈ, মাছকে আমাদের দেশী মাছ বলা হয়। এ মাছগুলো খুব সুস্বাদু। এসব মাছের পুষ্টিমান বেশি। রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিকভাবে খাল, বিল, ডোবায় এ জাতীয় মাছ প্রজনন করে। বাজারে এসব মাছের প্রচুর চাহিদা আছে।

চাষ প্রাণালী :

ছোট বড় সবধরনের পুকুরেই শিং-মাগুর মাছ চাষ করা যায়। তবে অগভীর ছোট পুকুরেই এসব মাছ চাষের জন্য ভালো। পুকুরের পাড় খাড়া হওয়া ভালো। পুকুর পাড়ে ৩০ সে.মি. ইটের খাড়া দেয়াল বা বাঁশের বেড়া দিলে ভালো। অন্যান্য মাছ চাষের মতই পুকুর প্রস্তুত করতে হয়। শতাংশ প্রতি ১০০-১২৫ টি পোনা ছাড়া যায়। সাত দিন পর পর শতাংশ প্রতি ১ কেজি গোবর দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

এসব মাছ আমিষ জাতীয় খাদ্য পছন্দ করে। তাই চালের কুঁড়ো, সরিষার খৈল, ফিশমিল, গবাদিপশুর রক্ত নাড়িভূড়ি, শামুক, ঝিনুক ও গমের ভূষি সম্পূরক খাদ্য হিসাবে দেওয়া যায়। মাছের দেহের মোট ওজনের ৩-৫% হারে প্রতিদিন খাবার দিতে হয়। তবে ২ মাস পর থেকে গরু-ছাগলের নাড়িভুড়ি কেটে দেয়া যায়।

ঘরের উচ্ছিষ্ট খাবার জমিয়ে রেখে পুকুরে দেয়া যায়। নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ ও পরিচর্যা করলে ৫-৬ মাসে একটি মাঙর ১৫০-২০০ গ্রাম এবং শিং মাছ ১০০-১২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মৌসুমী পুকুরে শিং ও মাগুরের চাষ করলে বছরে দুবারে মাছ চাষ করা যায়। প্রতি ফসলে হেক্টর প্রতি ৪-৫ টন মাছ পাওয়া যায়।

সারমর্ম

পুঁটি, নাইলোটিকা, শিশু ও মাতর অল্প সময়ে অল্প খরচে চাষ করা যায়।
পানির রং বাদামি সবুজ বা হাল্কা সবুজ হলে বুঝতে হবে পানিতে প্রাকৃতিক খাবার আছে।
সকাল ও সন্ধ্যায় পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে মাছকে খাবার দিতে হয়।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version