রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৩ নং পাঠ। আজ রাজ রাজপুটির চাসের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে।

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

 

রাজপুটি মাছ পরিচিতি:

রাজপুটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল মিঠাপানির চাষোপযোগী মাছ। দক্ষিণ—পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (যেমনথাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি) এ মাছ চাষ করা হয়। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Barbonymus gonionotus. মাছটির আগের নাম ছিল Punitius Gonionotus যা এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

১৯৭৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে মাছটিকে প্রথম আমাদের দেশে আনা হয়। মাছটি দেখতে অনেকটা দেশী সরপঁুটি মাছের মত। তবে দেশী সড়পুটির তুলনায় এদের দেহ বেশ চেপ্টা ও পাতলা। মাছটিকে অনেকে থাই সরপঁুটিও বলে থাকে। মাছটির পিঠের উপরের দিক হালকা মেটে, শরীরের বর্ণ উজ্জ্বল রূপালি, লেজ খাঁজ কাটা, পেটের পাখনার রং হালকা হলুদাভ। পোনা অবস্থায় এরা ফাইটোপ্ল্যাংকটন ও জুপ্ল্যাংকটন খায়। পরিণত বয়সে এরা বিভিন্ন ধরণের জলজ উদ্ভিদ/আগাছা, ক্ষুদিপানা এবং ছোট ছোট অমেরুদন্ডী প্রাণিও খেয়ে থাকে। চাষের অবস্থায় এরা চালের কঁুড়া, সরিষার খৈল ইত্যাদি খেয়ে থাকে। রাজপুটি প্রায় এক বছরেই প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। এরা নদী বা খালের ে¯্রাতশীল পানিতে প্রজনন করে থাকে।

Capture 117 রাজপুটির চাষ পদ্ধতি
চিত্র ১.৩.১: রাজপুটি মাছ

 

রাজপুটি মাছের বৈশিষ্ট্য/চাষের সুবিধা:

(১) উচ্চ ফলনশীল এবং সুস্বাদু মাছ।

(২) প্রায় সব ধরনের খাদ্যই খায়। তবে ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ এদের প্রিয় খাদ্য।

(৩) যে কোনো প্রকার পুকুর, ডোবা বা পতিত জলাশয়ে চাষযোগ্য।

(৪) রুইজাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ সম্ভব।

(৫) অল্প সময়ে এবং স্বল্প ব্যয়ে সহজেই মাছটি চাষ করা সম্ভব।

(৬) দ্রুত বর্ধনশীল এ মাছ ৪—৬ মাসের মধ্যে আহরণযোগ্য।

(৭) খাদ্যের জন্য বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয় না।

(৮) সহজ চাষ ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে ঘোলা পানিতে ও ধান ক্ষেতে সমন্বিতভাবে চাষ করা সম্ভব।

 

রাজপুটি মাছের একক চাষ পদ্ধতি:

রাজপুটি মাছের একক চাষ পদ্ধতি রাজপুটি চাষ করতে হলে নিম্নোক্ত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে করা প্রয়োজন।

 

১। মজুদ পকুর ব্যবস্থাপনা:

পুকুর প্রস্তুতি:

পুকুর প্রস্তুতির উপর মাছ চাষের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। সে কারণে পোনা মজুদের পূর্বে অবশ্যই পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। সাধারণত: ১০—৩০ শতাংশ আয়তনের যে কোনো মৌসুমী পুকুর যেখানে পানির গভীরতা ১.০—১.৫ মিটার থাকে এমন পুকুর রাজপুটি চাষের জন্য উপযোগী। পুকুর প্রস্তুতির ধাপগুলো হলো:

রাজপুটি 1 রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

(ক) পাড় ও তলা ঠিক করা:

পুকুরের পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে যাতে বন্যার পানি বা বৃষ্টির পানি পুকুরে ঢুকতে না পারে। জাল টানার সুবিধার্থে পুকুরের তলা সমান করতে হবে। তলায় জমা অতিরিক্ত পচা কাদা অপসরণ করতে হবে নতুবা পানিতে বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হবে। পুকুর পাড়ে বড় গাছপালা থাকলে ডালপালা ছেটে দিতে হবে নতুবা গাছের পাতা পানিতে পড়ে পচে পুকুরের পরিবেশ নষ্ট করবে।

(খ) ক্ষতিকর আগাছা দমন:

জলজ আগাছা হিসেবে পুকুরে কচুরীপানা, টোপাপানা ও তন্তুজাতীয় শেওলা দেখা যায়। মাছের পোনা মজুদের পূর্বে এই সমস্ত জলজ আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। শিকড়যুক্ত আগাছা থাকলে শিকড়সহ তুলে ফেলতে হবে। পুকুরে আগাছা থাকলে মাছ চাষে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি করে। যেমন—

* পুকুরে সূর্যালোক পেঁৗছাতে বাঁধা দেয়

* রোগজীবাণু ও পরজীবীর বাসস্থান হিসেবে কাজ করে

* মাছের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়

* রাত্রে এবং মেঘলা দিনে পানিতে অক্সিজেনের অভাব ঘটায় ক্স পানিতে দ্রবীভূত পুষ্টি উপাদানের অভাব ঘটায়।

(গ) রাক্ষুসে মাছ অপসরণ:

পুকুরের রাক্ষুসে মাছ দু’ভাবে অপসারণ করা যায়।
জাল টেনে বা পুকুরে শুকিয়ে মাছের পোনা মজুদ করার পূর্বে ঘন ঘন জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ যেমন— শোল, টাকি, চিতল, বোয়ল ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। যদি জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ অপসারণ করা না যায় তবে পুকুর শুকিয়ে ফেলে কাজটি করা যেতে পারে।

ওষুধ প্রয়োগ করে

রোটেনন –

প্রতি ফুট পানির গভীরতার জন্য ৩০ গ্রাম/শতাংশ হারে রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে রোটেনন প্রয়োগ করে পানি ওলটপালট করে দিলে তাড়াতাড়ি কাজ করে।

ফসটক্সিন ট্যাবলেট –

১ মিটার পানির গভীরতার জন্য ৩টি ট্যাবলেট/শতাংশ হারে ব্যবহার করা যাবে। সমস্ত পুকুরে ট্যাবলেট সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে পানি ওলটপালট করে দিতে হবে। ১—২ ঘন্টা পর মাছ ভাসতে শুরু করলে তুলে ফেলতে হবে। (বি:দ্র: পুকুরে ফসটক্সিন ব্যবহার করা অনেক সময় অনুমোদন করা হয় না। কারণ, ফসটক্সিন থেকে উৎপন্ন গ্যাস মানুষও গবাদি পশুর জন্য খুবই ক্ষতিকর।)

(ঘ) চুন ও সার প্রয়োগ:

পুকুরের ঘোলা ও বিষাক্ত পানি শোধন ও প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য যথাক্রমে চুন ও সার প্রয়োগ করতে হয়। রাক্ষুসে মাছ অপসারনের ১—২ দিন পর ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন পানিতে গুলে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। চুন ক্ষতিকর রোগ জীবাণু ধ্বংস করে, মাটি ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখে, মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। চুন প্রয়োগের ৩—৪ দিন পর ৩—৪ কেজি/শতাংশ হারে গোবর (জৈব সার) অথবা ২ কেজি/শতাংশ হারে হাঁস—মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োগ করতে হবে। এর ৬—৭ দিন পর অজৈব সার হিসেবে ১০০—১৫০ গ্রাম ইউরিয়া/শতাংশ এবং ৫০—৭৫ গ্রাম টি.এস.পি/শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হবে।

অজৈব সার পানিতে গুলে সারা পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। সার প্রয়োগের ৪—৫ দিন পর পানির রং সুবজাভ হলে বুঝতে হবে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। তখন মাছের পোনা ছাড়তে হবে।

 

২। মাছের পোনা মজুদ:

*নিকটবর্তী কোনো সরকারি বা নির্ভরযোগ্য বেসরকারি খামার থেকে প্রয়োজন অনুসারে রাজপুটি মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে ১/৩ ভাগ পানির সাথে ২/৩ ভাগ অক্সিজেন সহকারে পোনা সংগ্রহ করা উত্তম। পোনা পরিবহনের কাজটি সকালে করা শ্রেয়।

রাজপুটির 2 রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

* সংগৃহিত পোনা (৫—৭ সে.মি আকারের) ৭০—৮০টি/শতাংশ হারে মজুদ করা যেতে পারে। সকাল বেলা পোনা মজুদ করার উত্তম সময় কারণ এসময় তাপমাত্রা কম থাকে। ফলে তাপমাত্রাজনিত কারণে পোনা মৃত্যুর হার কম হয়।
ক্স সংগৃহিত পোনা সরাসরি মজুদ করা যাবে না। প্রথমে ব্যাগের পানির তাপমাত্রা মজুদ পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমতায় আনতে হবে। এজন্য পোনা ভর্তি ব্যাগ কিছুক্ষণ পুকুরের পানিতে রাখতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে কাত করলে ব্যাগের পানি পুকুরে এবং পুকুরের পানি ব্যাগে যাবে। এভাবে রাখলে পোনাও আস্তে আস্তে পুকুরে চলে যাবে।

 

৩। সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:

* পোনা মজুদের পরের দিন থেকে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৪—৬ ভাগ হারে চাউলের কঁুড়া (৮০%) ও সরিষার খৈল (২০%) এর মিশ্রণ খাদ্য হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে। নিচের সারণি অনুসরণ করেও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সারণি ১। প্রতি শতাংশে পোনা ছাড়ার পর থেকে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগের পরিমান।

Capture 1 17 রাজপুটির চাষ পদ্ধতি
* সকালে ও বিকালে প্রতিদিন দু’বার নির্দিষ্ট জায়গায় খাবার দিতে হবে।
* সম্পূরক খাদ্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর পুকুরে ৪—৬ কেজি/শতাংশ হারে গোবর ছিটিয়ে দিতে হবে।

 

৪। মাছের স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধি পরীক্ষণ:

প্রতি মাসে অন্তত একবার জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। মাছের নমুনা সংগ্রহ করে ওজন পরীক্ষা করতে হবে। যদি রং উজ্জ্বল হয়, গায়ে পিচ্ছিল স্বচ্ছ পাদার্থ থাকে, কোনো ক্ষত চিহ্ন না থাকে, পাখনাগুলো ভালো থাকে এবং দেখতে বেশ তাজা মনে হয় তবে বুঝতে হবে মাছের স্বাস্থ্য ভালো আছে। রাজপুটি মাছ বেশ শক্ত প্রকৃতির হওয়ায় রোগ বালাই তেমন হয় না। তবে শীতকালে কখনও কখনও ক্ষত রোগ হতে পারে। শীতের শুরুতে ১ কেজি/শতাংশ হারে চুন প্রয়োগ করে পানি শোধন করলে রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়।

 

৫। রাজপুটি আহরণ ও উৎপাদন/আয়:

  •  উল্লেখিত পদ্ধতিতে ৫—৬ মাস চাষ করার পর মাছের ওজন ১৫০—১৭০ গ্রাম হয়ে থাকে। এমন ওজনের মাছ বিক্রির জন্য ধরা যেতে পারে।
  • পুকুর থেকে খুব সকালে মাছ ধরতে হবে, যাতে জীবিত বা তাজা অবস্থায় বাজারে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়।
  • পুকুর না শুকিয়ে বেড় জাল টেনে সমস্ত মাছ আহরণ করা যায়।
  • আধা—নিবিড় পদ্ধতিতে রাজপুটি মাছ চাষ করে ৫—৬ মাসে প্রতি শতাংশে ১০ থেকে ১২ কেজি ফলন পাওয়া সম্ভব। একক চাষ পদ্ধতিতে সমস্ত উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রতি শতাংশ হতে ৬ মাসে ৫০০—৬০০ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।

 

রাজপুটির চাষ পদ্ধতি

 

৬। রাজপুটির রোগ ব্যবস্থাপনা:

সাধারণত: শীতকালে মাছ কম খায় ফলে শারীরিকভাবে কিছুটা দূর্বল থাকে। রাজপুটি মাছও এর ব্যতিক্রম নয়। আর ঐ সময়টাই সুযোগ সন্ধানী রোগ জীবাণুর জন্য আদর্শ। তাই শীতকালে মাছ রোগক্রান্ত হতে পারে। রাজপুটি মাছের ক্ষতরোগ, লেজ ও পাখনা পচা রোগ, আঁইশ খসে পড়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে। রাঁজপঁুটি মাছের রোগ ব্যবস্থাপনার করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

(১) পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ মাছ চাষের উপযোগী রাখতে হবে।

(২) পুকুরে গুণগতমানসম্পন্ন ভাল জাতের পোনা মজুদ করতে হবে।

(৩) পুকুরটি হতে হবে খোলামেলা ও আগাছা মুক্ত।

(৪) পুকুরে যাতে কোনো অবাঞ্ছিত বা ক্ষতিকর প্রাণি ঢুকতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

(৫) পুকুরটি বন্যামুক্ত স্থানে হওয়া বাঞ্চনীয়।

(৬) মাত্রাতিরিক্ত সার ও সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

(৭) পানির গুণাগুণ মাছ চাষের উপযোগী রাখার জন্য নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ করতে হবে।

(৮) শীত মৌসুমের পূর্বেই মাছ আহরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৯) নমুনায়নের সময় আক্রান্ত মাছ পেলে তা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে ফেলতে হবে এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হবে।

(১০) আক্রান্ত পুকুরে ব্যবহৃত উপকরণ (জাল) অন্য পুকুরে ব্যবহার করা যাবে না। কড়া রৌদ্রে শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা যেতে পারে।

(১১) পুকুরে মাছের ক্ষতরোগ দেখা দিলে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হবে।

(১২) মজুদ মাছের সংখ্যা ও পুকুরের ধারণ ক্ষমতার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হবে অর্থাৎ অতিরিক্ত পোনা মজুদ করা যাবে না।

 

আরও দেখুন  :

Leave a Comment