লেয়ার মুরগির পালন ও ব্যবস্থাপনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-লেয়ার মুরগির পালন ও ব্যবস্থাপনা। ডিম পাড়া মুরগিকে ইংরেজিতে লেয়ার (Layer) বলে। লেয়ার মুরগি পালন সাধারনত ৭৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত সীমিত থাকে। লেয়ার মুরগির খামার দুই ধরনের হতে পারে। যেমন

১। খাওয়ার ডিম উৎপাদনের খামার।

২। বাচ্চা ফোটানোর ডিম উৎপাদনের খামার।

বাণিজ্যিক বাচ্চা ফোটানোর ডিম উৎপাদনের খামার তুলনামূলকভাবে বেশ ব্যয়বহুল। খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য খামারে মোরগ রাখার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাচ্চা ফোটানোর ডিম উৎপাদনের খামারে আনুপাতিক হারে অর্থাৎ প্রতি ৮-১০ টি মুরগির জন্য একটি করে মোরণ রাখতে হয়। লেয়ার খামার ১ দিনের বাচ্চা দিয়ে অথবা ৮ সপ্তাহ বা তদুর্ধ বয়সের বাড়ন্ত মুরগি দিয়ে শুরু করা যায়। ১ দিন বয়সের বাচ্চা দিয়ে খামার স্থাপন করতে হলে বাচ্চাদের ৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ব্রয়লার বাচ্চার অনুরূপ পরিচর্যা করতে হয়।

লেয়ার মুরগির পালন ও ব্যবস্থাপনা

বাড়ন্ত মুরগি পালন

আট থেকে বিশ সপ্তাহ পর্যন্ত বয়সের মুরগিকে বাড়ন্ত মুরগি বলে। মুরগির এই সময়ের লালন-পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রাপ্ত বয়সে ডিম উৎপাদন নির্ভর করে বাড়ন্ত বয়সে সঠিকভাবে লালন-পালনের ওপর বাড়ন্ত বয়সে যে মুরগির দেহের বৃদ্ধি ভালো ও স্বাস্থ্য সুন্দর সেগুলো থেকে প্রাপ্ত বয়সে বেশি ডিম পাওয়া যায়। অধিক উৎপাদনশীল লেয়ার বা ডিম পাড়া জনপ্রিয় বাণিজ্যিক জাতের কয়েকটি মুরগির নাম নিয়ে দেওয়া হলো-

১। লোহম্যান ব্রাউন

২। নিক চিক

৩। স্টার ক্রস

৪। হাইসেক্স

৫। হাইলাইন:

৬। ব্যাবকক:

৭। আই এস এ ব্রাউন:

৮। রস ব্রাউন:

৯। হারবার্ড:

বাণিজ্যিক লেয়ার উন্নত ব্যবস্থাপনায় এবং বছরে গড়ে ২৭০-২৮০টি ডিম দেয়। প্রতিটি ডিমের গড় ওজন হয় ৬০-৬৫ গ্রাম।

বাড়ন্ত মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা

১। রোগমুক্ত খ্যাতনামা কোন খামার হতে বাড়ন্ত মুরগির বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।

২। খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য মোরগ বাচ্চা সংগ্রহের প্রয়োজন হয় না।

৩। বাচ্চা ফোটানোর ডিম উৎপাদনের জন্য খামার করতে হলে প্রতি ৫টি মুরগির জন্য একটি মোরগ বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। পরিণত বয়সে বাছাই করার পর প্রতি ৮-১০ টি মুরগির জন্য ১টি মোরগ রাখতে হবে।

৪। মোরগ এবং মুরগি বাচ্চা আলাদাভাবে পালন করতে হবে।

৫। ঘরের পুরাতন লিটার ও আসবাবপত্র বের করে নিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।

৬। জীবাণুনাশক ওষুধ যেমন- ফিনাইল, স্যাভলন, লাইজল, আইওমান দিয়ে ঘর ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

৭। ঘর শুকিয়ে নিয়ে লিটার বা বিছানা হিসাবে ধানের তুষ বা শুকনা কাঠের গুঁড়া ১৫-২৩ সে. মি. পুরু করে ঘরের মেঝেতে দিতে হবে।

৮। খাদ্য ও পানির পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর সারিবদ্ধভাবে দিতে হবে। বিশুদ্ধ পানি ও সুষম খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

৯। ঘরের মেঝেতে আয়তন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক বাড়ন্ত মুরগি পালন করতে হবে। প্রতিটি মুরগিকে ঘরের মেঝেতে ০.১৮ বর্গমিটার জায়গা দিতে হবে।

১০। একই সাথে বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা রাখা যাবে না।

১১। ২০ সপ্তাহ বয়সে মুরগির ডিম পাড়া শুরু করার প্রকৃত সময়। এর আগে বা পরে ডিম পাড়া শুরু করলে সেসব মুরগি থেকে সাধারণত বেশি ডিম পাওয়া যায় না।

১২। মুরগির ডিম পাড়াকালে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন যাতে কম হয় তাই এ সময়ের মধ্যে সকল সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে।

১৩। ১৮ সপ্তাহ বয়সে মুরগিকে কৃমির ওষুধ খাওয়াতে হবে। মুরগির গায়ে উকুন দেখা দিলে গ্যামাটবক্স বা বলকো জাতীয় উকুননাশক ওষুধ গায়ে মাখিয়ে উকুন মেরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।

লেয়ার মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা

বাড়ন্ত মুরগি ২১ সপ্তাহ বয়সে ডিম পাড়া মুরগিতে পরিণত হয়। ডিম পাড়া মুরগি সাধারণত ২১-৭২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়ে থাকে। তবে ডিম উৎপাদন আশানুরূপ হলে ৭৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা যেতে পারে।

এ সমনের পর ডিম উৎপাদন কমে যায় বিধায় এসব মুরগি খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে দেওয়া হয়। পরিষ্কার ঘর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশে মুরগি পালনের ওপর ডিম উৎপাদন নির্ভর করে। এ অবস্থায় মুরগিকে সুষম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করলে এবং রোগমুক্ত পরিবেশে রাখলে অধিক সংখ্যক ডিম পাওয়া যায়।

লেয়ার মুরগি পালনে করণীয়

১। ঘরের সব আসবাবপত্র ও লিটার বা বিছানা বের করে ঘর প্রয়োজনে জীবাণুনাশক দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ঘরের কোন মেরামতের প্রয়োজন হলে তা করতে হবে।

২। খাবার ও পানির পাত্র এবং ডিম পাড়ার বাক্স ভালো করে পরিষ্কার করে জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে শোধন করে সারিবদ্ধভাবে রাখতে হবে। প্রতি ৫টি মুরগির জন্য একটি করে ডিম পাড়ার বাক্স দিতে হবে।

৩। ১৮ সপ্তাহ বয়সে বাড়ন্ত মুরগির ঘর থেকে ডিম পাড়া মুরগির ঘরে এদের স্থানান্তর করতে হবে। ডিম পাড়া শুরু করার ২ সপ্তাহ আগেই মুরগি ডিম পাড়ার ঘরে স্থানাস্তর করতে হয়। যাতে মুরগিগুলো ঐ পরিবেশের সংগে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রতিটি মুরগির জন্য ঘরের মেঝেতে ০.২৭ বর্গমিটার জায়গার প্রয়োজন। ঘরে লিটার বা বিছানা হিসাবে ধানের তুষ বা কাঠের গুঁড়া ১৫-২৩ সে.মি. পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে।

৪। ২০ সপ্তাহ বয়সে যে দিন প্রথম ডিম দিবে সেদিন থেকে লেয়ার বা ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এ সময় ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণের জন্য আলাদা পাত্রে চুনাপাথর বা ঝিনুকের গুঁড়া সরবরাহ করতে হবে। মুরগি মেঝেতে ডিম পাড়লে দেখামাত্রই তা ডিম পাড়ার বাক্সে তুলে রাখতে হবে।

৫। রাতে কৃত্রিম আলোর জন্য মুরগির মেঝে থেকে ২.৪ মিটার উঁচুতে প্রতি ৩ মিটার দুরত্বে ১ টি ৪০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালিয়ে রাখতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকলে হারিকেন জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৬। ডিমপাড়া শুরু করলেই কৃত্রিম আলো প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে বাড়িয়ে ২১ সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা করতে হবে। তারপর প্রতি সপ্তাহে ৩০ মিনিট বাড়িয়ে ২৯ সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টায় নিতে হবে। দিনের আলো এবং কৃত্রিম আলো মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টা মোট ১৬ ঘণ্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।

৭। নিয়মিত এবং পরিমিত খাবার ও পরিষ্কার পানি দিতে হবে। খাবার ও পানির পাত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

৮। ডিম দিনে ৩ বার সংগ্রহ করা ভালো। অপরিষ্কার ডিম শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কা করে নিতে হয়।

৯। শীতকালে প্রচন্ড শীতে ঘরের চারদিকে পর্দার ব্যবস্থা করে ঘর গরম রাখতে হয়।

১০। গ্রীষ্মকালে ঘর যাতে ঠান্ডা থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

১১। লিটার পদ্ধতিতে মুরগি পালন করলে ২ মাস পর পর মুরগিকে খাবার বা পানির সংগে মিশিয়ে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো দরকার।

১২। লিটার বা বিছানা যাতে জমাট বেঁধে না যায় এবং শুকনা থাকে সে জন্য শীতকালে ৩-৪ সপ্তাহ পর পর এবং বর্ষাকালে ২ সপ্তাহ পর পর লিটার ওলট-পালট করে দিতে হয়। লিটার মাঝে মধ্যে চুন ছিটিয়ে দিলে রোগ-জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়।

১৩। সাধারণত ৭২ সপ্তাহ বয়স হলে মুরগি খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে দিতে হয়। তবে ডিম পাড়া যদি ৭০ ভাগের উপর থাকে তাহলে ৭৬ সপ্তাহ পর্যন্ত পালন করা যেতে পারে। খাবার ডিম উৎপাদনের জন্য খাঁচাতে মুরগি পালন করা যায়। এ পদ্ধতিতে মুরগিকে খাবার ও পানি দেওয়া এবং ডিম সংগ্রহ করা সহজ।

 

ডিম পাড়া মুরগি চেনার উপায়

অধিক ডিম পাড়ার মুর

১। শরীরের গঠন সামান্তরিক। কম ডিম পাড়া মুরগির

২। গঠন ত্রিকোনাকৃতি ।

৩। চোখ উজ্জ্বল, বড় ও কোটরের বাইরে অবস্থিত থাকবে। ২। চোখ ছোট, ঘোলাটে, অনুজ্জ্বল এবং কোটরের ভিতর থাকে।

৪। মাথার ত্রুটি ছোট ও ফ্যাকাশে।

৫। মাথার ঝুটি লাল ও উচ্ছ্বল।

৬। কটির অস্থি পাতলা নরম এবং চর্বি না। ৪। কটির অস্থি মোটা শত্রু এবং চর্বি জমে থা

৭। কটির অস্থির মধ্যে ফাঁক হবে ৩-৪ আঙ্গুল।

৮। কটির অস্থির মধ্যে ফাঁক হবে ৩ আঙ্গুল।

৯। বুকের হাড় থেকে কটির অস্থির ফাঁক হবে ৪-৫ আঙ্গুল।

১০। বুকের হাড় থেকে কটির অস্থির ফাঁক হবে ৩ আঙ্গুলের কম। সারণী হতো এবং ডিম্বাকার।

১১. অবসারণী ছোট, অরুনা ও গোলাকার।

১২। পেটের অংশ শক্ত ও অপ্রশস্ত।

 

 

ডিম উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ

১। হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটলে যেমন- প্রচন্ড গরম অথবা অত্যধিক শীত।

২। কম জায়গায় বেশি মুরগি পালন করলে।

৩। ঘরের আলোর হঠাৎ কোন পরিবর্তন

৪। হঠাৎ করে খাদ্য পরিবর্তন করলে। খাদ্য সুগম না হলে। খাদ্যের কোন উপাদান যেমন- আমিষ, শর্করা, ক্যালসিয়াম ইত্যাদির ঘাটতি হলে।

৫। ডিমপাড়া মুরগি এক ঘর হতে অন্য ঘরে বা একদল হতে অন্যদলে স্থানান্তর করলে।

৬। মুরগি কোন কারণে ভয় পেলে বা বিকট আওয়াজ বা বন্য জীব-জানোয়ার দেখলে। –

৭।পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং পানির অভাব হলে।

মুরগি অসুস্থ হলে। মুরগি খামারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সাধারণত গরমের সমনো খামার ব্যবস্থাপনার জটিলতার সৃষ্টি হয়। এ সময় অত্যধিক গরম এবং আর্দ্রতার কারণে খামারে মুরগির নানা সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দেশে বিশেষ করে, বৈশাখ মাসে অত্যধিক গরমের ফলে অনেক খামারেই যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। মুরগি গরম সহ্য করতে পারে না। অথচ অধিকাংশ খামারেই টিনের চালার ঘরে মুরগি পালন করা হয়ে থাকে।

অত্যধিক গরমে মুরগিতে প্রতিক্রিয়া

১। মুরগির শ্বাস কষ্ট হয় এবং শব্দ করে শ্বাস নিতে থাকে।

২। অধিক তৃষ্ণা পায় এবং অধিক পরিমাণে পানি খায়। দানাদার খাদ্য খাওয়ার পরিমাণ কমে যায়।

৩। ডিমপাড়া মুরগির ডিমের পরিমাণ কমে যায়।

৪। হঠাৎ সুস্থ, ভালো মুরগিও মারা যেতে পারে।

অত্যধিক গরমে করণীয়

১। মুরগির ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা।

২। টিনের নিচে সিলিং বা মাচার ব্যবস্থা করা।

৩। দুপুরের রোদে টিনের চালের উপরে পানি বা ভিজা ছালা বা চটের বস্তা দিয়ে চালা ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করা।

৪। মুরগিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিষ্কার পানি ও সুষম খাদ্য সরবরাহ করা।

৫। বড় ধরনের খামারে বৈদ্যুতিক পাখার সাহায্যে ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করা।

৬। ঘরের মাঝে মাঝে পাত্রে বড় বরফের টুকরা রাখা।

সারমর্ম

• ডিমপাড়া মুরগি সাধারণত ২১-৭২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়।

• প্রতিটি মুরগির জন্য ঘরের মেঝেতে ০.২৭ বর্গমিটার জায়গার প্রয়োজন।
দিনের আলো এবং কৃত্রিম আলো মিলিয়ে ঘরে ২৪ ঘণ্টার মোট ১৬ ঘণ্টা নিয়মিত আলোর ব্যবস্থা করতে হয়।

২০ সপ্তাহ বয়সে মুরগির ডিমপাড়া শুরু করার প্রকৃত সময়।

৮-২০ সপ্তাহ বয়সের মুরগিকে বাড়ন্ত মুরগি বলা হয়।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version