আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় চারার ঘনত্ব নির্ধারণ ও সম্ভাব্য ফলন
Table of Contents
চারার ঘনত্ব নির্ধারণ ও সম্ভাব্য ফলন
চারার ঘনত্ব নির্ধারণ ও সম্ভাব্য ফলন
একটি নির্দিষ্ট একক পরিমাণ জমিতে সার্থকভাবে একটি ফসল ফলাতে যে পরিমাণ বীজ বপন করতে হয় তাকেই ঐ ফসলের বীজহার বুঝায়। একটি নির্দিষ্ট আয়তনের জমিতে যে পরিমাণ চারা গাছ থাকলে একটি ফসলের উচ্চ ফলন হয়, সে পরিমাণ চারার উপস্থিতিকে ঐ ফসলের চারার ঘনত্ব বলে। চারার ঘনত্বের উপর ফসলের ফলন অনেকখানি নির্ভরশীল।
অতএব জমিতে কাঙ্খিত চারার ঘনত্বের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমান বীজ জমিতে বপন করা হয়। নির্দিষ্ট একক জমিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ সুষম দূরত্বে অবস্থান করে ভালভাবে জন্মালেই সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া সম্ভব। বীজের হার কমবেশি হলে গাছের ঘনত্ব সংখ্যা কম বা বেশি হয়। ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে তারতম্য হয় যা ফলনের উপর প্রভাব ফেলে।
বীজহার বীজের বিভিন্ন গুণাগুণের উপর নির্ভর করে। এ সমস্ত গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে বীজের বিশুদ্ধতা, অঙ্কুরোদগম মতা, ওজন, আকার, আকৃতি, সমাবয়বতা, পরিপক্কতা ইত্যাদি। বীজ যত বিশুদ্ধ হয় বীজহার তত কম হয় এবং বীজে ভেজালের পরিমাণ যত বেশি হবে বীজহার সে হারে বাড়বে।
আবার বীজের অঙ্কুরোদগমের হার যত বেশি হবে বীজহার সেই অনুপাতে কমবে। বীজের আকার আকৃতির তারতম্যের জন্য বীজহার কম বা বেশি হবে। বীজের ওজনের তারতম্যের জন্য গোলআলু বীজহার হেক্টরে ২০ থেকে ৭৫ মণ পর্যন্ত ওঠানামা করতে পারে। এ ছাড়াও বীজের সমাবয়বতা ও পরিপক্কতার জন্য বীজহার কম বা বেশি হতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে, ফসলের তে চারার ঘনত্ব ও ফলন নিবিড়ভাবে জড়িত। কাঙ্খিত ফলনের জন্য চারার ঘনত্ব নির্ধারণে প্রভাব বিস্তারকারী কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:
কাজি ত উদ্ভিদ সংখ্যা (Desired plant population )
একটি নির্দিষ্ট একক পরিমাণ জমিতে নির্দিষ্ট সংখ্যার গাছ সংকুলান হবার পর ফলন সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। এই নির্দিষ্ট সংখ্যার গাছ ঐ একক জমিতে পরিবেশের ভারসাম্য রা করে। জমিতে কাঙ্খিত গাছের সংখ্যা বাড়লে অথবা কমলে ফসলের তে গাছের খাদ্য উপাদান প্রাপ্তির তারতম্য দেখা দিতে পারে, েেতর আর্দ্রতা, বায়ু চলাচল, সূর্যের আলো কম বা বেশি হতে পারে।
গাছের সংখ্যা অধিক হলে ফলন কমতে থাকবে। অতএব, একক জমিতে সর্বাধিক যতটা গাছ থাকলে ফসলের ফলন সর্বাধিক হয়, সেই গাছের সংখ্যাকেই ঐ জমিতে কাঙ্খিত উদ্ভিদ সংখ্যা বলে। বিভিন্ন ফসলের জন্য এই সংখ্যা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে, আবার একই ফসলে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন হতে পারে।
প্রবর্তন মাত্রা (Establishment allowance) বা নিরাপত্তা / সংর ণী মাত্রা (Percent safety allowance)
অনেক বীজের গবেষণাগারে অঙ্কুরোদগম হয় কিন্তু মাঠে প্রতিকূল অবস্থায় অঙ্কুরোদগম হয় না । কারণস্বরূপ বলা যায় মাঠের সর্বত্র সমান রস থাকেনা। আবার অনেক বীজ মাটির বেশ গভীরে অথবা একেবারেই উপরে থাকে। শক্ত বীজ (Hard seed) সাধারনত গবেষণাগারে অঙ্কুরিত হয় না কিন্তু মাঠের প্রতিকূল অবস্থায় শক্ত বীজের অঙ্কুরোদগম হতে পারে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার জীব যেমন কীট পতঙ্গ বা পাখি বীজ খেয়ে ফেলতে পারে। ফলে ফসলের েেত চারার ঘনত্ব কমে যেতে পারে। এরকম কিছু চারার তিকে প্রবর্তন তি (Establishment loss) বলা হয়। এ ধরণের প্রতিকূল অবস্থাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য বীজ বপনের সময় অথবা চারা রোপণের সময় প্রবর্তন মাত্রা অনুযায়ী বেশি বীজ বপন করা হয়।
সাধারণত মাঠ ফসলে চারা রোপণের েেত্র ৫-১৫% হারে এবং বীজ বপনের েত্রে ১০-১৫% হারে প্রবর্তন মাত্রা যোগ করা হয়, যাতে প্রতিকূল অবস্থার পরও কাঙ্খিত চারার সংখ্যা ঠিক থাকে।
জমির উর্বরতা ও উৎপাদন মতা (Soil fertility and Productivity)
জমির উর্বরতা ও উৎপাদন মতা বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন জমির উর্বরতা ও উৎপাদন মতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কম উর্বরতা সম্পন্ন মাটিতে গাছের বৃদ্ধি কম হবে এবং সে অনুযায়ী বেশি সংখ্যক গাছের সংকুলান হবে। আবার যেখানে মাটির উৎপাদন মতা বেশি সেখানে গাছের বৃদ্ধির হার বেশি বলে কম সংখ্যক চারার সংকুলান হবে। কাজেই চারার ঘনত্ব নির্ধারণে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন মতার প্রভাব রয়েছে।
ফসলের ব্যবহার (Use of crop )
ফসলের ব্যবহার চারার ঘনত্ব নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে। উদাহরণস্বরূপ গো-খাদ্য ও দানা ফসল হিসাবে ভুট্টা চাষের কথা বলা যায়। দানা ফসল হিসাবে চাষ করলে চারার যে ঘনত্ব দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি চারার ঘনত্ব প্রয়োজন গো-খাদ্য হিসাবে চাষ করলে। এ রকম ধইঞ্চা, শণপাট, ইত্যাদি ফসল সবুজ সার হিসাবে অথবা বীজ উৎপাদন বা আঁশ ফসল হিসাবে চাষ করলে চারার ঘনত্বে অনেক পার্থক্য রাখা হয়।
ফসল জন্মানোর ঋতু (Growing season )
যদি কোন ফসল রবি এবং খরিপ উভয় মৌসুমে চাষ করা হয় তবে চারার ঘনত্বের তারতম্য হতে পারে। তুলা ফসল রবি মৌসুমে চাষ করা হলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি কম হয়। তাই এ ঋতুতে চারার ঘনত্ব বাড়িয়ে দিতে হয়। অপর দিকে খরিপ মৌসুমে একই জাতের তুলা ফসলে দৈহিক বৃদ্ধি বেশি হওয়ার জন্য চারার ঘনত্ব কমিয়ে দেয়া হয়।
ফসল লাগানোর পদ্ধতি (Planting method )
ে তে চারার ঘনত্ব ফসল লাগানোর পদ্ধতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। যেমন, আখ ফসল চাষে চলমান সারিতে আখের কান্ড রোপণ করলে হেক্টরপ্রতি প্রায় ১০০ মণ আখ বীজ খন্ডের প্রয়োজন। অথচ আঁকাবাঁকা পদ্ধতিতে রোপণ করলে এর দ্বিগুণ আখ বীজ খন্ডের প্রয়োজন হয়। পাট চাষের েত্রে যদি পাট বীজ ছিটিয়ে বোনা হয় তবে হেক্টর প্রতি ১০-১২ কেজি বীজ এবং লাইনে বপন করলে ৫-৮ কেজি বীজ দরকার হয়।
চারা লাগানোর সময় (Planting time )
বীজ বপন বা রোপনের সময় অনুসারে চারার ঘনত্ব কম বেশি হতে পারে। ফসল যখন মৌসুমের প্রথম দিকে লাগানো হয় তখন চারাগুলো বৃদ্ধির জন্য প্রচুর সময় পায় বলে চারার ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হয় । কিন্তু মৌসুমের শেষের দিকে লাগালে গাছ দৈহিক বৃদ্ধির জন্য সময় কম পায়। ফলে চারার ঘনত্ব বাড়িয়ে দিতে হয়। রোপা আমন ধানের েেত্র মৌসুমের প্রথম দিকে প্রতি গোছায় ২-৩টি চারা এবং মৌসুমের শেষ দিকে ৩-৪টি চারা রোপণ করা হয় ।
কুশি উৎপাদন প্রকৃতি (Tillering habit)
গ্রামিনী (Gramineae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত শস্য জাতের কুশি উৎপাদন মতা চারার ঘনত্ব নির্ধারণে প্রভাব বিস্তৃর করে। যে জাতের কুশি উৎপাদন মতা বেশি সে জাতে চারার ঘনত্ব কমিয়ে দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গমের ইউনিকলম (Uniculm) জাতে শুধুমাত্র একটি কুশিই থাকে কিন্তু অন্যান্য জাতে একাধিক কুশি উৎপন্ন হয়।
ধান, আখ, গম, যব, চীনা, কাওন ইত্যাদি তণ্ডুল জাতীয় ফসলের (Cereals) চারার ঘনত্ব নির্ণয়ের জন্য এ সকল ফসলের বিভিন্ন জাতের কুশি উৎপাদন মতা বিবেচনা করতে হয়।
চাষের প্রকার (Type of cultivation )
ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য দু’ধরণের চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এর একটা ব্যাপক চাষ (Extensive cultivation) আর অন্যটি নিবিড় চাষ (Intensive cultivation)। এ দুটিকে আবার যথাক্রমে আনুভূমিক বিস্তার (Horizontal expansion) এবং উলম্ব বিস্তার (Vertical expansion) ও বলা হয়।
ব্যাপক চাষের জন্য একটি দেশের বা খামারের সকল চাষযোগ্য জমি চাষের আওতায় আনা হয়। চাষোপযোগী প্রতি ইঞ্চি জমি চাষ করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। অপর নিবিড় চাষে একই জমিতে সকল প্রকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের সম্ভাবনাময় ফলন (Potential yield) উৎপাদন করা হয়।
নিবিড় চাষে যথাযথভাবে সার, সেচ ও উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যবহার করে ফলন বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে একই জমিতে নিবিড় চাষের জন্য চারার ঘনত্ব ব্যাপক চাষের চেয়ে বেশি নির্ধারণ করা হয়।