দেশী লাঙ্গল ও মইয়ের সাহায্যে ভূমিকর্ষণ

বাংলাদেশের কৃষিপ্রধান সমাজে ভূমি প্রস্তুতিই সফল ফসলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভূমিকর্ষণ বা জমি চাষের প্রাথমিক কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে পরবর্তী কৃষিকাজ অনেকাংশে সহজ ও ফলপ্রসূ হয়। ঐতিহ্যবাহী দেশী লাঙ্গল ও মই ব্যবহার করে ভূমি চাষ করার পদ্ধতি দেশের গ্রামীণ কৃষক সমাজে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। এই পদ্ধতি শুধুমাত্র জমির গভীরভাবে চাষ করে মাটির গঠন উন্নত করে না, বরং মাটির বায়ু সঞ্চালন, জলাধারণ ও পুষ্টি উপাদানের সঠিক বিতরণে সাহায্য করে।

দেশী লাঙ্গল ও মইয়ের ব্যবহার কৃষি কার্যক্রমে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক যান্ত্রিক কৃষি উপকরণের পরেও এই প্রাচীন পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষ করে আমাদের ছোট ও মধ্যম কৃষি খাতে। এই নিবন্ধে আমরা দেশী লাঙ্গল ও মইয়ের সাহায্যে ভূমিকর্ষণের প্রক্রিয়া, তার উপকারিতা, এবং আজকের আধুনিক কৃষিতে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করব।

দেশী লাঙ্গল ও মইয়ের সাহায্যে ভূমিকর্ষণ

 

 

দেশী লাঙল ও মইয়ের সাহায্যে ভূমি কর্ষণ

সাধারণ ভূমি কর্ষণে লাঙল ও মই দ্বারা কয়েকবার আড়াআড়িভাবে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। লাঙল চাষের পর মই দিয়ে মাটি ভেঙ্গে সমান করা হয়। জমির উপর অবস্থিত আগাছা ও পূর্বের ফসলের আবর্জনা পরিষ্কার অথবা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে উত্তম ভৌত অবস্থার একটি জমি তৈরি করা হয়। লাঙল ও চাষ মই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নিম্নে দেয়া হলো:

কী জন্য লাঙল দিয়ে জমি চাষ করা হয় ?
  • লাঙল দিয়ে জমি চাষের ফলে শক্ত মাটি ভেঙ্গে যায়।
  • আগাছা নিয়ন্ত্রিত হয়।
  • জৈব পদার্থ ও রাসায়নিক সার মাটিতে মিশে যায় ।
  • চারা রোপণের উপযোগী কাদাযুক্ত নরম জমি তৈরি হয়।
  • জমিতে একটি শক্ত লাঙল স্তরের সৃষ্টি হয় যা পানি ও খাদ্যাপাদান ধরে রাখতে সাহায্য করে ।
  • শুকনো জমিতে বায়ু চলাচল সহজতর হয়।

আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে দেশী লাঙল দিয়ে জমি তৈরি করা হচ্ছে। এ যন্ত্রটির গঠন ও নির্মাণ অতি সাধারণ । এতে একটি ত্রিকোণাকার কাঠের শরীর (Body) আছে। শরীরের পিছন দিকে থাকে একটি হাতল (Grip)। এই হাতল ধরে কৃষক জমি চাষ করে। শরীরের অগ্রভাগে লোহার ধারালো ও স চালো ফাল (Share) লাগানো থাকে। এই ফালের সাহায্যে জমি চাষ করা হয়।

শরীরের মাঝখানে ছিদ্র করে কীলক দিয়ে কাঠের একটি ঈষ (Beam) লাগানো থাকে। ঈষের অগ্রভাগে জোয়াল বেঁধে এক জোড়া গরু বা মহিষ দিয়ে লাঙল টানা হয়। এই দেশী লাঙলের সাহায্যে ৮-১০ সে.মি. গভীর করে জমি চাষ দেয়া যায়। প্রতিদিন এ যন্ত্র দিয়ে প্রায় এক বিঘা জমি চাষ করা যায়।

 

জমি তৈরির প্রকার

সাধারণত দেশী লাঙল দিয়ে দু’প্রকার জমি তৈরি করা হয়:

১. শুকনো জমি তৈরি করা হয় আউশ, গভীর পানির আমন ধান বা বোনা আমন ধান, পাট, সরিষা ইত্যাদি চাষের জন্য ।

২. ভিজা কাদাযুক্ত জমি রোপা আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষের জন্য। উল্লেখ্য যে, এখানে লাঙল ও মইয়ের সাহায্যে শুকনো জমি তৈরির পদ্ধতি আলোচনা করা হচ্ছে।

 

 

কীভাবে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করবেন?

১. জোয়ালের সাহায্যে একজোড়া বলদের সাথে লাঙল জুড়ে দিন ।

২. মাঠের এক প্রান্ত হতে লাঙ্গল চাষ আরম্ভ করুন। সমান্তরাল দূরত্বে আসা-যাওয়া করে চাষ দিতে থাকুন যতণ না সম্পূর্ণ জমি চাষ হয়।

৩. তারপর আড়াআড়িভাবে অপর প্রান্ত থেকে চাষ আরম্ভ করুন।

৪. উপরের মাটির স্তর ভা গার জন্য যতবার প্রয়োজন পূন: পূন: চাষ দিতে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত একটা সমান সংগতিপূর্ণ দৃঢ়তা না আসে।

 

কীভাবে শুকনো জমি তৈরি করবেন?

১. বোরো অথবা রোপা আমন বা মৌসুমের প্রারম্ভে প্রথম বৃষ্টির অব্যবহিত পরেই জমি চাষের জন্য উন্মুক্ত করুন।

২. জমিতে মাঠ মতা (‘জো’ অবস্থা) থাকা অবস্থায় লাঙল দিয়ে চাষ দিন। এক মুষ্ঠি মাটি হাতের তালুতে নিয়ে পরী া করুন। হাতে একটি মাটির বল তৈরি করে সাধারণ শক্ত মাটির উপর ছেড়ে দিন। যদি তৈরি মাটির বলটি পতনের পর ভেঙ্গে ছড়িয়ে যায় তাহলে বুঝবেন জমি ‘জো’ অবস্থায় এসেছে এবং লাঙল চাষের জন্য উপযুক্ত হয়েছে।

৩. লাঙল ও মই দিয়ে ৫-৬ বার চাষ দিন। এতে জমি আগাছামুক্ত হবে অথবা আগাছাগুলো মাটির সাথে মিশে যাবে এবং সমান সংগতিপূর্ণ দৃঢ়তায় জমি তৈরি হবে। লাঙল চাষ ও মইয়ের পরিমাণ জমির অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

৪. যতদুর সম্ভব গভীর করে জমি চাষ করুন।

৫. আগাগোড়া জমি চাষ করে মই দিয়ে ভালোভাবে সমান করুন।

 

কেন মই চাষ দেয়া হয়?

১. মাটির ঢেলা ভাঙ্গার জন্য।

২. জমি সমান করার জন্য ।

৩. অঙ্কুরিত আগাছাগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্য।

এদেশে আদিকাল থেকেই বাঁশের তৈরি মই দিয়ে মই চাষ দেয়া হয়। এই মই-এর আকার, আকৃতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম। কোনটি বড় আবার কোনটি ছোট। কোনটি দুটি বার (Bar) আবার কোনটি তিনটি বার সংযুক্ত। প্রধান বারগুলো ছোট ছোট ক্রসবার (Cross bar) দিয়ে আঁটসাট করে লাগানো থাকে।

 

জোয়ালের সাথে মই বেঁধে এক জোড়া অথবা দুই জোড়া বলদ বা মহিষ দিয়ে মই চাষ দেয়া হয় । মই চাষ দেবার সময় কোদাল ও ঝুড়ি সঙ্গে রাখা উচিত। কোদাল অকর্ষিত জমি ও আগাছা উত্তোলনে ব্যবহার করা হয় যা লাগুলের সাহায্যে করা যায়নি। আর ঝুড়ি দিয়ে সংগৃহীত আগাছা ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version