আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ ডিমপাড়া মুরগির খামার পরিকল্পনা ও স্থাপন ।এটি কৃত্রিম প্রজনন ও খামার স্থাপন এর মুরগির খামার স্থাপন ইউনিটের অন্তর্গত।
Table of Contents
ডিমপাড়া মুরগির খামার পরিকল্পনা ও স্থাপন
পরিকল্পনা
যে কোনো খামার পরিকল্পনা অর্থনৈতিক লাভের জন্য করা হয়। তাই ডিমপাড়া মুরগির খামার পরিকল্পনার বেলায়ও নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহ চিন্তা করে খামার স্থাপন করতে হবে । যথা-
১. মূলধনের উৎস কী ? নিজের টাকা না ব্যাংক ঋণের টাকা?
২. আপনার খামার হতে বার্ষিক কত টাকা লাভ করতে চান তা স্থির করতে হবে ।
৩. আপনার স্থিরিকৃত পরিমাণ টাকা মুনাফা করতে হলে খামারজাত দ্রব্য হতে শতকরা ১০-১২ টাকা লাভের হারে মোট কত টাকা আয় করতে হবে তা হিসেব করতে হবে ।
৪. বর্তমান বাজার দরে কতগুলো ডিম বিক্রি করলে আপনি এ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করতে পারবেন তা হিসেব করতে হবে । একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে । যেমন- বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে খাবার ডিম বা অনিষিক্ত ডিম উৎপাদন এবং ৬০-৬৫% হারে বাচ্চা ফুটানো বা নিষিক্ত ডিম উৎপাদন ধরে, প্রতিটি ডিম গড়ে ২.৫০ ৩.০০ টাকা হিসেবে বিক্রি ধরে – বছর শেষে ৮৮% মুরগি সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকবে; আর বাকি পুরানো মুরগি বিক্রি করে ও উৎপাদন খরচ বাদে ১০-১২% লাভ থাকবে এ হিসেব করে পরিকল্পনা করতে পারেন ।
৫. ডিমের ব্যবহার অনুযায়ী ডিমপাড়া মুরগির খামার দুপ্রকার । যথা-
- নিষিক্ত বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন খামার
- অনিষিক্ত বা খাবার ডিম উৎপাদন খামার
আপনি কোন্ ধরনের খামার তৈরি করবেন তা ঠিক করুন। যদি বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন করেন তাহলে আপনি দুরকম বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদন করতে পারেন । যথা-
- বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদনের খামার
- খাবার ডিম উৎপাদনের খামার
আবার খোসার রঙ অনুযায়ী উপরের দুরকম উদ্দেশ্যের জন্যই আপনি
- সাদা খোসার ডিম উৎপাদনকারী বা বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী মুরগির খামার করতে পারেন ।
৬. সাদা বা বাদামি খোসার খাবার ডিম বা বাচ্চা ফুটানোর ডিম উৎপাদনকারী মুরগি বা বাচ্চা কোথায় পাবেন, আপনি সেগুলো আনতে পারবেন কি-না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে ।
উপরোক্ত বিষয়সমূহে চিন্তাভাবনা করে খামার স্থাপনের কাজে হাত দিতে হবে ।
খামার স্থাপন ও পরিচালনার খরচ
খামার স্থাপন ও পরিচালনার খরচ দুই খাতে বিভক্ত । যথা-
ক) স্থায়ী খরচ
খ) আবর্তক বা চলমান বা চলতি খরচ
ক) স্থায়ী খরচ
স্থায়ী খরচের খাতওয়ারী হিসেব নিম্নরূপ-
- খামার এলাকাভুক্ত জমির মূল্য ।
- মুরগির গৃহায়ণ ব্যবস্থাবাবদ খরচ ।
- ম্যানেজারের অফিস, ডিম সংরক্ষণাগার, খাদ্য গুদাম, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসপত্র রাখার স্থান, শ্রমিকদের বিশ্রাম ঘর, অসুস্থ ও মৃত মুরগি রাখার জায়গা নির্মাণবাবদ খরচ ।
- আসবাবপত্র ও যানবাহন ক্রয়বাবদ খরচ ।
খ) আবর্তক খরচ
আবর্তক খরচে নিম্নবর্ণিত খাতসমূহ অন্তর্ভুক্ত । যথা-
- নিষিক্ত ডিম বা ডিমের জন্য প্রজননক্ষম পুলেট ও ককরেলের মূল্য, অনিষিক্ত বা খাওয়ার ডিম উৎপাদনের জন্য উন্নতমানের পুলেটের মূল্য (হাইব্রিড)।
- সুষম খাদ্যের মূল্য ।
- টিকা এবং প্রতিষেধক ওষুধপত্রের মূল্য ।
- খামার পরিচালনায় জনবলের বেতনভাতা খরচ ।
- পরিবহণ ও যাতায়াত খরচ ।
- মূলধনের সুদ ।
- ডিপ্রেসিয়েসন বা অপচয় খরচ ।
- মেরামত খরচ ।
- বিদ্যুৎ ও পানির বিলবাবদ খরচ ।
- এডভারটাইজিং বা বিজ্ঞাপন ব্যয় ।
- নষ্ট বা বাদ যাওয়া ডিমের মূল্য ।
- অসুস্থ বা মৃত মুরগির মূল্য ।
খামারের আয়
অন্যদিকে ডিমপাড়া মুরগি হতে আয়ের খাতওয়ারী হিসেব নিম্নরূপ-
- ডিম বিক্রিবাবদ আয় ।
- উৎপাদন শেষে জীবিত মুরগির বিক্রিত মূল্য ।
- বিষ্ঠা বা সারের মূল্য ।
- পুরনো বা অকেজো জিনিসপত্র বিক্রিবাবদ আয় ।
খামার স্থাপন
স্থায়ী খরচ
১. নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির মূল্য, খামারে যতগুলো মুরগি রাখা হবে তাদের জন্য ঘরের জায়গাসহ গুদাম, অফিস, ডিম রাখার জায়গা রেখে যে পরিমাণ জমি লাগবে তার মূল্য । এলাকা অনুযায়ী প্রতি বিঘা জমির মূল্য কমবেশি হবে ।
২. প্রজাতি বা স্ট্রেইন অনুযায়ী যতগুলো মুরগি রাখা হবে তাদের মোট জায়গার পরিমাণ হিসেব করে ঘর তৈরি করতে হবে । সাদা খোসার ডিম উৎপাদনকারী প্রতিটি মুরগির জন্য ০.২৮ বর্গমিটার (৩ বর্গফুট) জায়গা এবং বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য ০.৩৭ বর্গমিটার (৪ বর্গফুট) জায়গা হিসেব করে থাকার ঘর তৈরি করতে হবে। এসব মুরগি লিটার বা খাঁচায় যে কোনো পদ্ধতিতে পালন করা যায় ।
খাঁচাতে প্রতিটি মুরগির জন্য ৪৩ বর্গ সে.মি. জায়গার প্রয়োজন হবে । কাজেই এ হিসেবে খাঁচা তৈরি করা হয় । খাঁচার সারি লম্বালম্বিভাবে এক সারি বা একটার উপর আরেকটা রেখে ৩/৪ সারি করা যায় । আবার সিড়ির মতো করে সাজিয়ে উভয় পার্শ্বেও সারি করা যায় ।
ঘরের চালা ঃ
ঘরের চালা পূর্বের পাঠে (পাঠ ৩.২) আলোচিত ব্রয়লারের ঘরের অনুরূপ হবে । বাংলাদেশের পরিবেশে দোচালা বা গেবল টাইপ চালই মুরগির জন্য বেশি আরামদায়ক ।
বেড়ার নমুনা :
ব্রয়লার ঘরের বেড়ার মতো লেয়ারের ঘরের বেড়ার উচ্চতার ১/৩ অংশ শক্ত দেয়াল, কাঠ বা বাঁশের চাটাই দিয়ে পূর্ণ করে বাতাস চলাচলের জন্য তারজালি বা বাঁশের চটি দিয়ে আড়াআড়িভাবে তৈরি করতে হবে। বেশি বাতাস বা বেশি শীত হতে মুরগিকে রক্ষার জন্য বেড়ার ফাঁকা অংশ প্রয়োজনে ঢেকে দেয়ার জন্য পলিথিন বা চটের পর্দার ব্যবস্থা করতে হবে ।
মেঝের প্রকৃতি ঃ
লিটার পদ্ধতিতে পালন করলে মুরগির ঘরের মেঝে পাকা হলে ভালো হয় । কাঁচা মেঝের ক্ষেত্রে শক্ত এঁটেল মাটির মেঝে হলেও চলবে । তবে এ ধরনের মেঝে বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যেতে পারে । শুকনো বালির মেঝের ক্ষেত্রে বর্ষাকালে সমস্যা হতে পারে ।
- এছাড়াও ম্যানেজারের অফিস ঘর তৈরির খরচ প্রতি বর্গফুট (০.০৯৩ বর্গমিটার) হিসেবে মোট মূল্য ।
- ডিম সংরক্ষণের ঘর তৈরি খরচ প্রতি বর্গফুট (০.০৯৩ বর্গমিটার) হিসেবে মোট মূল্য ।
- খাদ্য গুদাম তৈরির খরচ- মুরগির সংখ্যা অনুসারে প্রতিটি মুরগির জন্য দৈনিক ১১০-১২০ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হিসেবে কমপক্ষে ২ মাসের খাদ্য সংরক্ষণাগার তৈরির খরচ ।
- বিষ্ঠা বা সার রাখার স্থান নির্মাণের খরচ ।
- মৃত মুরগি পুড়িয়ে ফেলা বা পাকা গর্তে ফেলে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখার স্থান নির্মাণবাবদ খরচ।
- যানবাহন কেনাবাবদ খরচ ।
আবর্তক খরচ
ক. মুরগি সংক্রান্ত খরচ-
- একদিন বয়সের লেয়ারের বাচ্চা বা ডিমপাড়ার সম্ভাবনাময় পুলেট ক্রয়ের খরচ ।
- খাদ্য খরচ- মাথাপিছু ১১০-১২০ গ্রাম ধরে ।
- লিটার কেনাবাবদ খরচ ।
- খাঁচায় মুরগি পালন করলে মেঝে পাকা হলেই ভালো ।
খ. ঘর তৈরির সাজসারঞ্জাম বিভিন্ন রকমের হতে পারে । যথা-
- বাঁশ, টিন বা বিচালী ।
- মাটির ঘর ।
- ইট, সিমেন্ট বা পাকা দালান ঘর ।
গ. ঘর তৈরির সাজসরঞ্জাম অনুযায়ী প্রতি বর্গফুট ঘর তৈরির খরচ, তা যেভাবেই ঘর তৈরি করা হোক না কেন প্রতি বর্গফুট (০.০৯৩ বর্গমিটার) হিসেবে খরচ ধরে ঘরের মোট খরচ বের করতে হবে ।
ঘ. আসবাবপত্র ক্রয় বা তৈরিবাবদ খরচ-
- খাবার পাত্রের দাম ।
- পানির পাত্রের দাম ।
- ডিম পাড়ার বাক্সের দাম ।
- ডিম রাখার ঝুড়ি কেনার জন্য খরচ ।
- ডিম বাছাই ও ছাটাই খরচ- যতগুলো ডিম বিক্রির অনুপযুক্ত হলো তার মূল্য ।
- টিকা ও ওষুধপত্রের খরচ ।
- খাদ্য সংগ্রহ, ডিম বাজারজাতকরণ ও ডিমপাড়া শেষে মুরগি বিক্রির জন্য পরিবহণ খরচ ।
- বিভিন্ন কাজে ম্যানেজারের যাতায়াত খরচ ।
ঙ. খামারের জনশক্তির খরচ
- ম্যানেজারের বার্ষিক বেতনভাতা ।
- অফিস স্টাফের বার্ষিক বেতনভাতা ।
- শ্রমিকদের বার্ষিক বেতনভাতা ।
এছাড়াও মূলধনের উপর বার্ষিক সুদ (ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে), জমিবাদে স্থায়ী খরচের অপচয়ের শতকরা হার ইত্যাদি । এভাবে যত খরচ হয় সব যোগ করে বার্ষিক খরচ/মোট খরচের হিসেব রাখতে হবে ।
বার্ষিক আয় –
- ডিম বিক্রি- বার্ষিক গড়ে ৭০-৭৫% হারে উৎপাদন ধরে বর্তমান বাজার দরে ডিমের মোট মূল্য ।
- শতকরা ৮৮টি মুরগির সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে এ হিসেবে ডিমপাড়া শেষে বর্তমান বাজার দরে মোট মূল্য ।
- প্রতিটি মুরগি থেকে বছরে ৩০ কেজি বিষ্ঠা পাওয়া যাবে এভাবে হিসেব করে বর্তমান বাজার দরে মোট বিষ্ঠা বা সারের মূল্য ।
- অকেজো আসবাবপত্র বিক্রিবাবদ মোট আয় ।
এভাবে মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত লাভলোকসান হিসেব করতে হবে ।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন
১ । সঠিক উত্তরের পাশে টিক চিহ্ন (√) দিন ।
ক. খাঁচা পদ্ধতিতে পালনের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুরগির জন্য কতটুকু জায়গার প্রয়োজন হয় ?
i) ৪৩৭ বর্গ সে.মি.
ii) ৪৪২ বর্গ সে.মি.
iii) ৪৫২ বর্গ সে.মি.
iv) ৪৬২ বর্গ সে.মি.
খ. প্রতিটি মুরগির জন্য দৈনিক কতটুকু খাদ্যের প্রয়োজন ধরা হয়?
i) ১০০-১০৫ গ্রাম
ii) ১০৫-১১০ গ্রাম
iii) ১১০-১২০ গ্রাম
iv) ১১৫-১২০ গ্রাম
২। সত্য হলে ‘স’ এবং মিথ্যা হলে ‘মি’ লিখুন।
ক. মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিয়ে প্রকৃত লাভলোকসান হিসেব করতে হয় ।
খ. বাতাস বা শীত থেকে মুরগিকে রক্ষা করার জন্য পলিথিন বা চটের পর্দার ব্যবস্থা করতে হয় ।
৩। শূন্যস্থান পূরণ করুন ।
ক. ডিমের ব্যবহার অনুযায়ী ডিমপাড়া মুরগির খামার
খ. শুকনো বালির মেঝের ক্ষেত্রে – সমস্যা হতে পারে ।
৪। এক কথায় বা বাক্যে উত্তর দিন ।
ক. খামার স্থাপনের খরচের প্রধান দুটো খাতের নাম কী ?
খ. বাদামি খোসার ডিম উৎপাদনকারী মুরগির জন্য কতটুকু জায়গার প্রয়োজন?