আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পারিবারিক কৃষি খামার – যা কৃষি সমবায় ও পারিবারিক খামার এর অন্তর্ভুক্ত। জনবহুল কৃষি প্রধান বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৯ লাখ হেক্টরের সামান্য বেশি হলেও বিভিন্ন কারণে বছর বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অধিকন্ত, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য ঘরবাড়ি নির্মান এবং কর্মসংস্থানের জন্য নতুন শিল্প স্থাপনায় কৃষি জমির ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৭০% এর বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে এবং মোট আবাদি জমির প্রায় ৫% বসতবাড়ীর আওতায় রয়েছে । এসকল বসতবাড়ীর আঙ্গিনা সুষ্ঠু ব্যবহার করে পারিবারিক খামারের এক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরী করা যেতে পারে।
বসতবাড়ীতে সবজী ও ফল চাষের মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যকে উৎপাদনে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। একই সাথে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাড়তি সবজী বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আরের সংস্থানও নিশ্চিত করা যায়। নিয়ে কয়েকটি পারিবারিক খামারের কথা উল্লেখ করা হলো:
Table of Contents
পারিবারিক কৃষি খামার
পারিবারিক মৎস্য খামার :
বাংলাদেশের কৃষকের অনেকের বাড়ীতেই ছোট বড় পুকুর আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসকল পুকুর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব পুকুরে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু মাছ জন্মে আবার ক্ষেত্র বিশেষ কিছু মাছের চাষও করা হয়।
এ চাষের ফলে উৎপাদিত মাছ পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রি করা যায়। কিন্তু সনাতন পদ্ধতির এ মাছ চাষ খাদ্য হিসেবে যেহেতু বাড়ীর উদ্ধৃত্ত ভাত কিংবা অন্যান্য খাবারের অংশ বিশেষ দেওয়া হয়। তাই মাছের উৎপাদন খুবই কম হয়।
এসব পুকুরে পরিকল্পনামাফিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষের আওতায় আনতে পারলে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব। সেইসাথে পারিবারিক মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেকার সদস্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে ।
পারিবারিক কৃষি খামারঃ
এদেশের বেশীরভাগ কৃষকের বসতভিটার আশে পাশে কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে। আপাত দৃষ্টিতে যা বাণিজ্যিক চাষের অনুপোযোগী । ফলে প্রায়শই অনাবাদী থাকে। বাড়ীর আশে পাশের এ ধরনের খালি জায়গা যা উঁচু, নীচু, মাঝারি বা উভয় হতে পারে- চাষের আওতায় এনে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পরিকল্পণা করা হয় তাকে পারিবারিক কৃষি খামার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
এই খামারের জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ঋতুভিত্তিক ফসল নির্ধারন করতে পারলে সারা বছরই পারিবারিক চাহিদা পুরণ করতে সমর্থ হবে সেই সাথে বাড়তি উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া এ পারিবারিক কৃষি খামারে উৎপাদিত পণ্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মুক্ত হওয়ায় বাজারে চাহিদাও বেশী থাকে এবং উচ্চমূল্যও পাওয়া যায়।
পারিবারিক পোল্ট্রি খামারঃ
পোল্ট্রি বলতে গৃহপালিত পাখি যেমন, হাস, মুরগী, কবুতর ইত্যাদিকে বুঝায়। আবহমানকাল থেকে এদের গ্রামীন কৃষক পারিবারিক খামারে হাঁস, মুরগী, কবুতর ও অন্যান্য সৌখিন পাখি যেমন কোয়েল পালন করে আসছে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ এ দেশের কৃষির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে এশ্রেণীর খামার থেকে পরিবারের ডিম ও মাংশের চাহিদা মিটিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে উদ্ধৃত অংশ বাজারজাত করে কৃষক কিছু বাড়তি আয়েরও পথ তৈরী করতে পারে।
তবে বর্তমান সময়ে প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎপড়তার কারণে পারিবারিক খামারে কৃষকরা উন্নত জাতের হাঁস ও মুরগী পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। অধিক ডিম উৎপাদনে সক্ষম এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে পারিবারিক খামারে অধিক মাংশ উৎপাদনশীল ব্রয়লার মুরগী পালন করে আসছে।
পারিবারিক দুগ্ধ খামার :
দুগ্ধ খামার বর্তমানে একটি লাভজনক শিল্প। পারিবারিক দুগ্ধ খামার বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র বিমোচন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশে দুধের চাহিদা পূরনে বিশাল ভূমিকা রাখছে। গত পাঁচ বছরে গ্রামের অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে পারিবারিক দুগ্ধ খামার। প্রধানত গ্রামের নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি উন্নত জাতের গাভী পালনে হাসি যুগিয়েছেন পরিবারের মুখে।
বিশেষ একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে দু-একটি গাভী দিয়ে শুরু করে এখন ছোট বড় খামার গড়ে তুলেছে ৫২ হাজার পরিবার। তারা এ খামারের মাধ্যমে যেমন হয়েছেন স্বাবলম্বী তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন বিশাল অবদান। ব্র্যাক আড়ং, প্রাণ, আকিজের মতো বড় ব্র্যান্ডের প্যাকজজাত দুধের বড় যোগান আসছে এসব পারিবারিক পুগ্ধ খামার থেকে।
পারিবারিক খামারের গুরুত্ব :
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টতই বুঝা যায় পারিবারিক খামার পরিবারের চাহিদা পূরণ করে, পরিবারের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও সহায়তা করে । নিম্নে পারিবারিক খামারের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করা হলোঃ
১) পরিবারের সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা এবং ক্ষেত্র বিশেষ অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে ।
২) বেকার সদস্যদের কর্মসংস্থান তৈরীতে সহায়তা করে।
৩) পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের অবসর সময় আনন্দে কাটানোর কর্মক্ষেত্র তৈরী করে ।
৪) কীটনাশক ও বিষমুক্ত শাকসবজী, ফলমূল যোগানের উৎকৃষ্ট সুযোগ তৈরী করে ।
৫) ঋতু বর্হিভূত (অফ সিজন) ফল/সবজী ফলানোর মাধ্যমে অতিথি আপ্যায়নে বৈচিত্র্য আনয়ন করে।
৬) গৃহপালিত গবাগি পশু পালন করে প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পুরন পূর্বক পশু উপজাত (যেমন, গোবর, পোল্ট্রি লিটার) উত্তম জৈবসার এবং মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৭) গবাদি পশুর মলমূত্র থেকে বায়োগ্যাস উৎপন্ন করে জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি করে গৃহিনীদের কষ্ট লাঘব করা যায়।
৮) সর্বোপরি কৃষক পরিবারের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে ।
সারসংক্ষেপ
দেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। অধিক জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় বাসস্থান তৈরীর নিমিত্তে কৃষি জমি ব্যবহৃত হয়ে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অপরদিকে বর্ধিত ঐ জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন অধিক উৎপাদন।
পারিবারিক খামারকে কিছু ক্ষেত্রে ঐ বর্ধিত খাদ্য উৎপাদনের জন্য এক চমৎকার অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পারিবারিক খামারে উৎপাদিত পণ্য একদিকে যেমন পরিবারের সকল পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে, অনুরূপ বর্ধিত খাদ্যশস্য বিক্রি করে কৃষক অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে পারে।