পিঁয়াজ চাষ

পিঁয়াজ চাষ – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “উদ্যান ফসল” বিষয়ের ৮ নং ইউনিটের, পাঠ নং ৮.৭। পিঁয়াজ একটি গুরত্বপূর্ণ এবং সব চেয়ে বেশী ব্যবহৃত মসলা জাতীয় ফসল। সবজি ও সালাদ হিসেবে এবং মসলা জাতীয় ফসল, দ্বিবর্ষজীবী, শঙ্ককন্দ, বারি পিঁয়াজ, ক্যাপসুল আচার, কেচাপ ও সস তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এর অনেক ওষধি গুণ রয়েছে। ক্ষত প্রতিষেধক হিসেবে এবং সর্দি-কাশি, আমাশয়, উচ্চ রক্তচাপ, পেটফাঁপা ইত্যাদি নিরাময়ে পিঁয়াজ ব্যবহৃত হয়।

পিঁয়াজ চাষ

 

উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচিতি পিঁয়াজ একটি দ্বিবর্ষজীবী উদ্ভিদ। তবে আমাদের দেশে এর একবর্ষজীবী জাতও দেখা যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Allium cepa. পিঁয়াজের রূপান্তরিত কান্ড সংলগ্ন পাতার গোড়ায় খাদ্য জমাটের ফলে স্ফীত হয় এবং কান্ডের সাথে একটির পর একটি সংযোজিত হয়ে শঙ্ককন্দ উৎপাদন করে। এ শঙ্ককন্দ পিঁয়াজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ থেকে নতুন গাছ জন্মে থাকে । পিঁয়াজের ফুল উভলিঙ্গী, ফল ক্যাপসুল জাতীয় এবং বীজের রং কালো।

 

 

পেঁয়াজের জাত:

জাত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতের পিঁয়াজ দেখা যায়। পিঁয়াজ আকার, আকৃতি, রং, ঝাঁঝ, বাণিজ্যিক ব্যবহার ও পরিকপক্কতার সময় অনুসারে বিভিন্ন রকম হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি পিঁয়াজ—১, ২ এবং ৩ নামে পিঁয়াজের তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এদের মধ্যে বারি পিঁয়াজ—১ শীতকালে এবং বারি পিঁয়াজ—২ ও ৩ গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী। পিঁয়াজের স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুর ভাটি, কৈলাশনগর অন্যতম। বংশবিস্তা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে জমিতে রোপণ, সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন বা ছোট ছোট কন্দ রোপণ সাধারণত এ তিনটি পদ্ধতিতে পিঁয়াজের চাষ করা হয়। এদের মধ্যে চারা রোপণ পদ্ধতিতে পিঁয়াজের ফলন বেশী হয়।

 

পেঁয়াজ ফুল

 

পেঁয়াজ চাষের জন্য জলবায়ু ও মাটি:

জলবায়ু ও মাটি সহনশীল তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত দিনের আলো ও মাটিতে রস থাকলে পিঁয়াজের ভাল ফলন পাওয়া যায়। এঁটেল মাটি ছাড়া অন্য যে কোন মাটিতে পিঁয়াজের চাষ করা যায়। তবে দেঁাআশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পিঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। পিঁয়াজের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। মাটির অম্লত্ব বা ঢ়ঐ ৫.৮—৬.৫ পিঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উত্তম, অধিক ক্ষার বা অম্ল মাটিতে পিঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে।

উৎপাদন মৌসুম বাংলাদেশে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে অর্থাৎ সারা বছরই পিঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। শীতকালীন পিঁয়াজ অক্টোবর থেকে জানুয়ারী, গ্রীষ্মকালীন পিঁয়াজ ফেব্রুয়ারী থেকে জুলাই এবং বর্ষাকালীন পিঁয়াজ জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে চাষ করা যায়।

 

 

পেঁয়াজের জীবনকাল :

চারা রোপণের ৯০ থেকে ১০৫ দিন পর পিঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়। বীজতলা বীজতলা ৩ মি. দ্ধ ১ মি. মাপের এবং ১৫—২০ সেমি. উঁচু হতে হবে। প্রতি হেক্টর জমিতে চারা রোপণের জন্য ৩ মি. দ্ধ ১ মি. আকারের ১২০—১৩০ টি বীজতলার প্রয়োজন হয়। প্রখর সূর্যের তাপ এবং ভারী বৃষ্টিপাতের হাত থেকে বীজতলার বীজ ও চারা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শেডের ব্যবস্থা করতে হয়। সেচ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য বীজতলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নালার ব্যবস্থা রাখতে হয়। বীজ বপন শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন পিঁয়াজ চাষের জন্য যথাক্রমে অক্টোবর থেকে নভেম্বর, ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ এবং জুন থেকে জুলাই মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয।

৩ মি. দ্ধ ১ মি. মাপের একটি বীজতলায় ২৫—৩০ গ্রাম বীজ লাগে। বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম ভিটাভেক্স দ্বারা শোধন করে বীজবাহিত রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। বীজের হার প্রতি হেক্টর জমিতে চাষের জন্য চারা রোপণ পদ্ধতিতে ৩—৪ কেজি বীজ, সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন পদ্ধতিতে ৬—৭ কেজি বীজ এবং শল্ককন্দ (পিঁয়াজ) রোপণ পদ্ধতিতে কন্দের আকার অনুযায়ী প্রায় ১.২—১.৫ টন শল্ককন্দের (পিঁয়াজের) প্রয়োজন হয়।

 

 

পেঁয়াজ চাষের জন্য জমি তৈরি :

দোআঁশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রচুর দিনের আলো, সহনশীল তাপমাত্রা ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে পেঁয়াজের ফলন খুব ভাল হয়। রবি পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ১৫-২৫ সে. তাপমাত্রা পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উপযোগী। ছোট অবস্থায় যখন শেকড় ও পাতা বাড়তে থাকে তখন ১৫ সে. তাপমাত্রায় ৯-১০ ঘন্টা দিনের আলো থাকলে পেঁয়াজের বাল্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে ১০-১২ ঘন্টা দিনের আলা ও ২১ সে. তাপমাত্রা এবং গড় আর্দ্রতা দ৭০ শতাংশ থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ভালভাবে বাড়ে, বীজ গঠিত হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। মাটির পিএইচ ৫.৮ তেকে ৬.৫ হলে পেঁয়াজের ফলন ভাল হয়। সমুদ্র তীর থেকে ২১০০ মিটার উচ্চ পাবর্ত্য উপত্যকাতেও পেঁয়াজের চাষ করা যায়। হালকা মাটিতে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে পেঁয়াজের ফলণ ভাল হয়। অধিক ক্ষার বা অম্ল মাটিতে পেঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে।

৪-৫ টি গভীর চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে, মাটির ঢেলা ভেঙ্গে ও সমতল করে জমি তৈরি করতে হয়। সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার্থে জমিতে মাঝে মাঝে ৫০ সেমি. প্রশস্ত নালা রাখতে হয়। পেঁয়াজের জমি চাষের জন্য ডিস্কহ্যারো ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এতে মাটি পুনরায় শক্ত হয়ে যায়। আগাছামুক্ত ঝুরঝুরা সমতল মাটি পেঁয়াজের জন্য উত্তম। সারি থেকে সারি দূরত্ব ৩০ সেমি এবং পেঁয়াজ থেকে পেঁয়াজের দূরত্ব ১৩-১৫ সেমি রাখতে হবে।

 

 

পেঁয়াজের চারা/কন্দ রোপণ :

৪৫—৫০ দিন বয়সের পিঁয়াজের চারা ১৫দ্ধ১০ সেমি দুরত্বে রোপণ করা হয়। উচ্চ ফলন পাওয়ার জন্য সুস্থ ও সবল চারা রোপণ করা উচিত। চারা রোপণের গভীরতা ৩—৪ সেমি এবং একটি করে চারা লাগাতে হবে। কন্দ রোপণ পদ্ধতিতে সমতল জমিতে অগভীর নালা করে ২০—২৫ সেমি দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ১০—১৫ সেমি অন্তর কন্দ লাগানো হয়। চারা বা কন্দ রোপনের পরই সেচ দেওয়া আবশ্যক। রোগবালাই ও পোকামাকড় পেঁয়াজের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে পার্পল ব্লেচ, লিফ ব্লাইট, অ্যানথ্রাকনোজ, বালব রট প্রধান। পার্পল ব্লেচ রোগ বীজবাহিত। সুতরাং বীজ বপনের পূর্বে শোধন করে নিতে হবে। পেঁয়াজের ক্ষতিকর পোকামাকড় হচ্ছে থ্রিপস, মাছি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ডায়াজিনন স্প্রে করতে হবে।

 

 

পেঁয়াজ চাষে আগাছা দমন :

জমি নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এতে কন্দ ভালভাবে গঠিত হয় ও ফলন বাড়ে। সেচ ও নিকাশ মাটির রস স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে পিঁয়াজের ফলন কমতে থাকে। এজন্য পিঁয়াজের জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন। চারা মাটিতে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ৩ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। কন্দ গঠিত হয়ে গেলে সেচ কম লাগে। পিঁয়াজ উত্তোলনের ৩ সপ্তাহ পূর্ব থেকে সেচ বন্ধ রাখতে হয় নতুবা পিঁয়াজের গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সেচ প্রয়োগের ৩০—৬০ মিনিট পর সেচের অতিরিক্ত পানি নালা দিয়ে বের করে দিতে হবে।

পিঁয়াজের সম্পূর্ণ জীবন চক্রে ৮—১০ বার সেচের প্রয়োজন হয়। সেচের পর জমিতে চটা বাঁধলে তাতে গাছের মূলে বাতাস চলাচল ব্যহত হয়। এজন্য চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। পিঁয়াজ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। এজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।

 

 

পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে অন্যান্য পরিচর্যা :

প্রতিবার পিঁয়াজ ক্ষেতে নিড়ানির পর ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। পিঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কলি বের হওয়ার সাথে সাথে ভেঙ্গে দিতে হবে। ফসল সংগ্রহ, গ্রেডিং ও সংরক্ষণ পিঁয়াজ গাছ পরিপক্ক হলে এর পাতা হেলে পড়ে। যখন ৭০—৮০% পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে নেতিয়ে বা ভেঙ্গে পড়ে তখন পিঁয়াজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। উজ্জ্বল রৌদ্রযুক্ত দিনে পিঁয়াজ উত্তোলন করলে সংরক্ষণ ভাল হয়। পিঁয়াজ উত্তোলনের পর এর পাতা ও শিকড় কেটে বায়ু চলালচল সুবিধাযুক্ত শীতল ও ছায়াময় ঘরের মেঝেতে ৮—১০ সেমি উঁচু করে ৮—১০ দিন ছড়িয়ে রেখে দিলে পিঁয়াজ শুকিয়ে যায়।

আকারের উপর ভিত্তি করে পিঁয়াজকে মোটামুটি ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।

ক) ৪—১০ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট বড় আকারের পিঁয়াজ

খ) ৩—৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট মাঝারী আকারের পিঁয়াজ

গ) ৩ সেমি এর কম ব্যাস বিশিষ্ট ছোট আকারের পিঁয়াজ সুস্থ ও সবল পিঁয়াজ বাছাই ও গ্রেডিং করার পর বাঁশের মাচা, ঘরের সিলিং, প্লাস্টিক বা বাঁশের তাক অথবা ঘরের পাকা মেঝেতে শুষ্ক ও বায়ু চলাচলযুক্ত স্থানে পিঁয়াজ ছড়িয়ে সংরক্ষণ করা যায়। মাঝে মাঝে পচা ও অঙ্কুরিত পিঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হয়। কোল্ড স্টোরেজে ৭—৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৬২—৬৭% আর্দ্রতায় পিঁয়াজ দীর্ঘদিন।

 

পেঁয়াজ সংরক্ষণ :

করে রাখা যায়। পচা ও অঙ্কুরিত পিয়াজ সরিয়ে ফেলতে হবে। ফলন আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরন করে পিঁয়াজের হেক্টরপ্রতি ১০—১৩ টন ফলন পাওয়া যায়।

 

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version