বীজতলা তৈরি

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় বীজতলা তৈরি। বিশুদ্ধ, পুষ্ট, রোগ-পোকামাকড় মুক্ত সঠিক জাতের ধান-বীজ উৎপাদন অত্যন্ত শ্রম-সাধ্য ও ব্যায়-সাপেক্ষ হলেও, এ ধরণের বীজ ব্যবহারে ধানের ফলন ১০-২০% বৃদ্ধি হতে পারে। ধান গাছের কাংখিত বাড়বাড়তি ও ফসলের অধিক ফলনের জন্যও যথাযথভাবে বীজ গজিয়ে আদর্শ বীজতলায় ধানের সুস্থ্য-সবল চারা উৎপাদন এবং সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ ও যথাযথ অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা করা একান্ত প্রয়োজন।

বীজতলা তৈরি

 

 

বীজতলা তৈরি

প্রাসঙ্গিক আলোচনা:

ধান বাংলাদেশের একটি প্রধান খাদ্য ফসল। সাধারনত বীজতলায় চারা উৎপাদন করে সেই চারা জমিতে রোপণ করে এ ফসল চাষ করা হয়। বাংলাদেশে বছরের বিভিন্ন সময়ের আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে বীজতলা তৈরি করা হয়। সাধারণত বোরো মৌসুমে ভিজা কাদাময় বীজতলা, আউশ ও আমন মৌসুমে শুকনা ও ভিজা উভয় প্রকার বীজতলাই তৈরি করা হয়।

যেসব এলাকার জমি উঁচু – এবং মাটি দো-আঁশ প্রকৃতির সেখানে সাধারণত শুকনো বীজতলা তৈরি করা হয়। এঁটেল মাটিতে প্রধানত ভিজা বীজতলা তৈরি করা হয়। শুকনো ও ভিজা বীজতলা ছাড়া ডাপোগ ও পরিবর্তিত ডাপোগ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা যায়। আবার বিরূপ প্রাকৃতিক অবস্থায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়।

সংজ্ঞা: যে মাটিকে বীজের সুষ্ঠু অঙ্কুরোদগম ও চারা গজানোর জন্য তৈরি করা হয় তাকে বীজতলা বলে। ধান চাষের েেত্র এক বিঘা জমিতে চারা রোপণের জন্য সাধারনত এক কাঠা জমিতে চারা উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ এক কাঠার উৎপাদিত চারা দিয়ে ২০ কাঠা বা এক বিঘা জমিতে চারা রোপণ করা যায়। এদেশে জমির পরিমাণ কৃষক পর্যায়ে বিঘাতেই সুপরিচিত।

বীজতলাকে সুষ্ঠুভাবে যত্ন ও পরিচর্যার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাপে তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট পরিমাপে শুকনো বা ভিজা জমিতে তৈরি এক কাঠার এই বীজতলাকে একটি আদর্শ বীজতলা বলা হয়ে থাকে ।

 

আদর্শ বীজতলা তৈরির কাজের ধারা:

একটি আদর্শ বীজতলা তৈরির জন্য ১০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৭ মিটার প্রস্থ জায়গা মেপে নিন। দৈর্ঘ্যের এক পাশ থেকে ২৫ সে.মি. জায়গা বাদ দিয়ে বৃষ্টির পানির নিষ্কাশন ও চারা গাছের পরবর্তী পরিচর্যার জন্য ১২৫ সে.মি. চওড়া চারটি পৃথক পৃথক বীজতলা চিত্র অনুসারে ভাগ করে নিন। প্রতি দুই খন্ড বীজতলার মাঝে ৫০ সে.মি. জায়গা নালা তৈরির জন্য রাখুন।

 

চিত্র ৩ : এক কাঠার একটি বীজতলা।

বীজতলার মাটি পরিপাটি করে তৈরি করে শুকনো বীজ সমানভাবে বীজতলার উপর ছিটিয়ে বুনে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিন। বীজগুলো নাড়াচাড়া করে ২.৫-৪.০ সে.মি. মাটির গভীরে স্থাপন করুন। প্রয়োজন বোধে হালকা মাটির আস্তরণ দিয়েও বীজগুলো ঢেকে দিতে পারেন। উল্লেখ যে, এক কাঠার বীজতলার জন্য উপরোক্ত মাপ নেয়া হয়। প্রয়োজন বোধে দৈর্ঘ্য ১০ মিটারের বেশি বাড়িয়ে নেয়া যাবে।

 

অন্যান্য বীজতলার পরিচিতি

ভিজা কাদাময় বীজতলা:

ভিজা বীজতলা তৈরির জন্য জমিকে পানি দ্বারা সিক্ত করে ২/৩টি লাঙল চাষ ও ম‍ই চাষ দিয়ে ৭-১০ দিন পর্যন্ত পানি আটকে রাখা হয় এই অবস্থাকে জাবর দেওয়া বলা হয়। জাবর দেবার ফলে জমির আগাছা, পূর্ববর্তী ফসলের অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি পচে মাটির সাথে মিশে জৈব সারের কাজ করে। এরপর জমিকে লাঙল চাষ ও মই দিয়ে থকথকে কাদাময় করতে হবে।

শুকনো বীজতলার মত প্রথমে ২৫ সে.মি. ও চারটি বীজতলার প্রতি দুটির মাঝে ৫০ সে.মি. ফাঁক রেখে বীজতলা তৈরি করতে হবে। ফাঁক রাখা জায়গা থেকে ১০ সে.মি. গভীর মাটি তুলে দুপাশের বীজতলার উপর দিতে হবে। বীজতলার উপরের মাটি হাত, বাঁশ বা কাঠের সাহায্যে সমান করে তৈরি করতে হবে।

বীজতলার কাদা খুব নরম হলে বীজ বোনার সময় কাদায় ডুবে যাবে তাই এ রকম অবস্থায় কয়েক ঘন্টা রেখে দিলে কাদা কিছুটা জমে যাবে এবং এরপর অঙ্কুরিত বীজ বোনা যাবে।

 

ডাপোগ বীজতলা

বিশেষ পরিস্থিতিতে ডাপোগ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করা হয়। সাধারনত বাড়ীর উঠানে বা যে কোন শুকনো জায়গায় এক বর্গ মিটার একটি পলিথিন ব্যাগ বিছিয়ে এই বীজতলা তৈরি করা হয়। মাটি সমতল করে মাঝখানে একটু গভীর করে পলিথিন বিছিয়ে দেয়া হয়। এরপর প্রতি বর্গমিটারে ২.৫- ৩.০ কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছিটিয়ে পুরু করে বুনে দিতে হয়।

বীজ যাতে শুকিয়ে না যায় সেজন্য বীজের উপর অল্প করে পানি ছিটানো হয়। এ রকম বীজতলায় চারাগাছ বীজপত্র থেকে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ করে বলে এই বীজতলার বিশেষ যত্ন নিতে হয়। পানি দেবার সময় পানির সাথে ইউরিয়া মিশ্রিত করে দিলে চারার বৃদ্ধি ভালো হয় । বন্যা কবলিত এলাকার জন্য পরিবর্তিত ডাপোগ বীজতলা তৈরি করা যেতে পারে।

পরিবর্তিত ডাপোগ পদ্ধতিতে কাদাময় সমতল জমিতে কাঠ, কলাপাতা, কলাগাছের বাকল দিয়ে চৌকোণা ঘরের মত করতে হবে। বীজতলার নিচে কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তারমধ্যে অঙ্কুরিত বীজ বুনতে হয়। মাটি থেকে কোন প্রকার খাদ্যাপাদান গ্রহণ করতে পারে না বলে এই বীজতলার বিশেষ যত্ন নিতে হয়, অন্যথায় চারাগাছ খাদ্যের অভাবে মারা যায়।

 

বীজতলার যত্ন

সুস্থ ও সবল চারার জন্য বীজতলার যত্ন নেয়া উচিত। ভিজা বীজতলায় সব সময় পানি রাখা উচিত। ডাপোগ বীজতলায় ঝরণার সাহায্যে পানি দিতে হবে এবং বীজগুলো এক সঙ্গে চেপে রাখতে হবে।

 

সেচ ও পানি নিষ্কাশন

বীজ বপনের পর থেকে চারা গজানো পর্যন্ত পানি দ্বারা নালা ভর্তি রাখতে হবে। বীজতলায় পানি আটকে থাকলে তা নিষ্কাশন করতে হবে।

 

সার প্রয়োগ

সাধারণত উর্বর ও মাঝারি উর্বর জমিতে সার না দিয়েই বীজতলা তৈরি করা হয়। জমির উর্বরতা কম থাকলে প্রতি বর্গ মিটারে দুই কেজি পচা গোবর বা কম্পোস্ট বা খামারজাত সার-প্রয়োগ করা যেতে পারে।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version