মৃত্তিকা ক্ষয় ও সংরক্ষণ

মৃত্তিকা ক্ষয় ও সংরক্ষণ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান – ১২০৪ কোর্সের ইউনিট ৫ এর,  পাঠ ৫.৩ নম্বর পাঠ।

মৃত্তিকা ক্ষয় ও সংরক্ষণ

 

মৃত্তিকা ক্ষয় বা ভূমি ক্ষয় (Soil erosion):

বৃষ্টির জোরালো আঘাত, পানির স্রোত, সূর্যের উত্তাপ, প্রবল বায়ু প্রবাহ, বিশাল নদীর ঢেউ, তুষারপাত, কালবৈশাখী ঝড়, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, পোকা-মাকড়, জীবাণু এবং মানুষের দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের মাটি এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তর হওয়াকে মৃত্তিকা ক্ষয় বা ভূমিক্ষয় বলে। পৃথিবী সৃষ্টির পর যখন থেকে জল প্রবাহ ও বায়ু প্রবাহ শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এ প্রক্রিয়াটি অবিরত চলছে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে মাটি গড়ে উঠে, তা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ভূমিক্ষয় বিশেষ করে পানি চলাচল ও বায়ু প্রবাহ প্রক্রিয়ায় আলগা হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়। পানির স্রোত দ্বিগুণ বাড়লে ৬৪ গুণ বড় কণা বহন করতে পারে, অর্থাৎ ৩২ গুণ বেশি পরিমাণ মাটি পানির সংগে ভেসে যেতে পারে এবং ভূমিক্ষয় ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।

ভূমিক্ষয় উপাদান সূত্র:

ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ও তীব্রতা মূলতঃ ৫টি উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। এ সকল উপাদান একটি সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়, যথা ভূমিক্ষয়, e = f(cl, vs, th

এখানে,

f = function of or dependent on ( উপাদান)

cl = climate (জলবায়ু – বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ও তাপমাত্রা)

v = vegetation (উদ্ভিজ – বৃক্ষ ও লতা গুল্মের পাতা, গাছপালা, ঘাস, গাছের শিকড় প্রভৃতি)।

t = topography (ভূমির বন্ধুরতা – ঢাল, ঢালের দৈর্ঘ্য ও দিক, জমির দৈর্ঘ্য)।

s = nature of soils (মৃত্তিকার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য – কণার আকার, বুনট, সংযুক্তি, জৈব পদার্থ, ভূমিধস প্রভৃতি)।

h = human activities (মানুষের কাজকর্ম)।

ভূমি ক্ষয়ের প্রকারভেদ:

ভূমি ক্ষয়কে প্রধানতঃ দু’টি ভাগে ভাগ করা যায় যথা,

ক) পানি ভূমি ক্ষয় (Water erosion)

খ) বায়ু ভূমি ক্ষয় (Wind erosion)

ক) পানি ভূমিক্ষয় আবার ৮ প্রকার যথা :

১। ছিটকে পড়া বা বৃষ্টির ফোঁটা জনিত (Splash or raindrop erosion)

২। পাত ভূমিক্ষয় (Sheet erosion)

৩। পলি ক্ষয় বা প্রারম্ভিক ভূমিখাত (Rill erosion)

8। গালি ভূমিক্ষয় (Gully erosion)

৫ । ধ্বস ভূমিক্ষয় (Slip erosion)

৬। নদী তীর ভূমিক্ষয় (Stream bank erosion)

৭। সমুদ্র উপকূল ভূমিক্ষয় বা বেলাভূমির ভূমি ক্ষয় (Sea shore erosion)

৮। পার্বত্য জলধারা বা ঝোরা ক্ষয় (Torrent erosion)

খ) বায়ু ভূমি ক্ষয় আবার দুপ্রকার, যথা

১। সল্টেশন (Saltation)
২। বায়ু বাহিত ধূলিকণা (Suspension)

 

মৃত্তিকা ক্ষয়ের কারণ:

১।বনভূমির ধ্বংস বা উচ্ছেদ সাধন ।

২। বনের মধ্যে গাছপালা পরে গিয়ে বনভূমি ক্ষতি কিংবা পতিত গাছপালায় নিয়ন্ত্রণ বিহীন আকস্মিক আগুন ধরে যাওয়া।

৩। গভীর অরণ্যে বুশ ফায়ারে বনভূমির ক্ষতি কিংবা বিলুপ্তি।

৪। চারণ ভূমির ঘাস বার বার কেটে ফেলা।

৫ ৷ চারণভূমিতে ব্যাপক হারে গরু কিংবা অন্যান্য জীবজন্তু চড়ানো।

৬। আগুন দিয়ে বনভূমির লতাপাতা, আগাছা, বুশ ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলা।

৭।  মাঠে আগুন দিয়ে ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলা।

৮। পাহাড় বা টিলার ঢালুতে চাষাবাদ করা।

৯।ঘরবাড়ী তৈরি, আবাদ ভূমি সৃষ্টি, ও জ্বালানীর প্রয়োজনে বনভূমির পরিধি কমিয়ে আনা।

১০।বেলে মাটি দীর্ঘ সময় পতিত রাখা কিংবা চাষাবাদ না দিয়ে বায়ু ক্ষয়কে উৎসাহিত করা।

১১। বন্যার ফলে ভূপৃষ্টের ক্ষয় প্রবল বেড়ে যাওয়া।

১২। বৃষ্টির আঘাতে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের মাটিস্তর ভীষণ ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া।

১৩। দিনরাত মানুষের বিচরণ বা চলাফেরা।

১৪। মাঠে ঘাটে নানান খেলাধ লার প্রভাব যথা, দৌড়, লাফ, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়া বাধা, হাডুডু, ফুটবল, হকি, প্রভৃতি।

১৫। মাঠ চাষ দিয়ে কিংবা ফসল কেটে দীর্ঘ সময় পতিত ফেলা রাখা।

১৬। সময় অসময় শিলা বৃষ্টির প্রকোপতা।

১৭। পুকুর রাস্তাঘাট, কিংবা মাঠে এলো মেলো অসংখ্য গর্ত করে ফেলে রাখা অথবা গর্ত করে গাছপালা না লাগানো। ১৮। যুগ যুগ ধরে একই এলাকায় একই রকম খাদ্যশস্য উৎপন্ন করা।

 

 

মৃত্তিকা ক্ষয়ের উদাহরণ:

১।নদীর পাড় বা কিনারার ভাঙ্গন।।

২। পুকুর পাড় ভাঙ্গন ।

৩। খালের পাশের ভাঙ্গন।

৪। নর্দমার ভাঙ্গন ।

৫ । রাস্তাঘাট ধ্বসে পড়া কিংবা রাস্তার পাশের ভাঙ্গন ।

৬। নদীর বুকে চর জাগা।
৭। বন্যার ফলে মাটিতে কাঁদা, পলি কিংবা বালির স্তর জমা।

৮। পুকুর, খাল, বিল, লেক কিংবা নদীর বুকে তলানী পড়া অর্থাৎ ৯। এখানে সেখানে মাটির স্তুপ জমে থাকা।

১০। গাছপালার শিকড় বের হয়ে যাওয়া।

১১। গোড়া অথবা শিকড়সহ গাছপালা ধ্বসে পড়া।

১২। হাঁটার রাস্তায় উঁচু নিচু কিংবা গর্ত থাকা।

১৩। পাহাড়ের পাদদেশের মাটির স্তুপে রাস্তাঘাটে চলাচল বন্ধ থাকা।

১৪। ক্ষেতের পানি বের করার মুখ প্রান্ত ।

১৫। গরুর গাড়ী কিংবা রিক্সা চলাচলে রাস্তায় গর্ত থাকা।

১৬। ছাদের পানি পড়ে গর্ত হওয়া।

১৭। নলকূপের পানি পড়ায় সামনের গর্ত।

১৮। গভীরতা কমে আসা।

 

মৃত্তিকা ক্ষয়ের প্রতিক্রিয়া/প্রভাব:

১। সরাসরি বৃষ্টিপাতের ফলে পানি মাটির জমাট বাধা পদার্থগুলোকে ধৌত করে নিয়ে যায় ফলে

২।মাটির কণাগুলো বিভাজিত হয়। মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলী সুস্পষ্ট ধরা পরে। 2।

৩।ফলন কমে যায়।

৪।কোথাও মাটি চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।

৫ । মৃত্তিকায় প্রোফাইলের স্তর সঠিক রূপ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না।

৬। মৃত্তিকায় উর্বরতা লোপ পায়।

৭। মাটির জৈব পদার্থ কমে যায়।

৮।মাটি মরুভূমিতে রূপ নিতে পারে।

৯।মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়।

১০। মাটিতে অণুজীবের সংখ্যা কমে আসে।

১১। মাটিতে গাছপালা জন্মানো অসম্ভব হয়ে যায়।

১২। এলাকায় সুস্থ পরিবেশ রক্ষা করা যায় না কিংবা সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেয়া যায় না।

১৩। গাছপালা দ্রুত মরে যেতে পারে।

১৪। আকস্মিক ব্যতিক্রমধর্মী মৃত্তিকার জন্ম নিতে পারে।

১৫। মাটিতে ফুল ফল কিংবা শাকসবজির চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না।

১৬। কোন বৃক্ষ কিংবা ফলের গাছ থাকলে তা কালক্রমে মরে যায়।

১৭। বায়ু মৃত্তিকা ডাষ্টকে শত মাইলের বেশি দূরেও স্থানান্তর করতে পারে, ফলে মাটিতে প্রবল ডাস্টের উৎপত্তি ঘটলে এলাকার গাছপালার দূষণ ঘটায় এবং স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফুল উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।

 

মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ/সংরক্ষণ:

শত শত বৎসর ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় যে মৃত্তিকা গঠিত হয়, একে যথাস্থানে যথাযথভাবে ধরে রেখে গুণগত মান রক্ষা করার নামই মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ বা মৃত্তিকা সংরক্ষণ কিংবা মৃত্তিকা কনজারভেশন। সুস্থ পরিবেশ ও মানুষের জীবন যাত্রার উন্নয়নের জন্য মৃত্তিকা সংরক্ষণ অপরিহার্য। যতদিন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে ততদিনই মৃত্তিকা সংরক্ষণ চলতে থাকবে।

 

মৃত্তিকা ক্ষয় ও মৃত্তিকা ক্ষয়রোধের মধ্যে পার্থক্য:


মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ বা সংরক্ষণ পদ্ধতি:

১।  মাটি জৈব পদার্থ কিংবা খড়, অন্য লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া বা মালচিং করা।

২। বৃক্ষ রোপণ ।
ক) রাস্তার পাশে বৃক্ষ রোপণ ।
খ) নদীর পাড়ে বৃক্ষ রোপণ ।

৩। মাটি উঠানোর পর ঘাস লাগানো।

৪। ক্রপ রোটেশন বা ফসল চক্র অবলম্বন করা।

৫। গোবর, কম্পোস্ট কিংবা জৈব সার প্রয়োগ করা।

৬ । একই মাঠে বিভিন্ন ফসল বা মিক্সড ক্রপিং অনুশীলন করা।

৭।  নদীর চরে শন, ধনচে কিংবা হালকা বৃক্ষ লাগানো।

৮। বাড়ীর আশ পাশে আম, কাঠাল, জাম, বাঁশ, লিচু, কলাগাছ প্রভৃতি রোপণ ।

৯ । নদীর ধারে বাঁধ দেয়া কিংবা পাথর ফেলে নদীর পাড় রক্ষা করা।

১০। প্রতিটি প্লটে জমির আইল বেঁধে পানি মওজুদ রাখা।

১১। জমিতে ফসলের অবশিষ্টাংশ রেখে আসা।

১২। ঢালু জমি পর্যায়ক্রমে আইল বেঁধে চাষাবাদ করা।

১৩। মাঠে জমির আইলে ডোল কলমি, বাবলা কিংবা মাঝারী আ3কৃতির গাছ লাগানো।

১৪। সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ের টিলায় চা বাগান করা।

১৫। উত্তরবঙ্গে বরেন্দ্রভূমির ক্ষয়রোধ ও মরুকরণ প্রতিরোধে বিভিন্ন রাস্তার পাশে চারাগাছ লাগানো।

১৬। দেশে এনজিওদের তৎপরতায় বৃক্ষ রোপণ কার্যের পরিধি বৃদ্ধি করা।

১৭। পুকুর পাড় ভেঙ্গে পরলে কিংবা পাড়ে লাগানো গাছের শিকড় বেরিয়ে আসলে পুণরায় মাটি দিয়ে কিংবা বেড়া দিয়ে মাটি বসায়ে কিনারার অতিরিক্ত ভাঙ্গন রোধ করা।

১৮। পুল তৈরি কৃত এলাকায় চার পাশের মাটি বার বার কেটে নেয়ার ফলে মারাত্বক ভূমিক্ষয় আরম্ভ হয় ফলে ঐ সকল এলাকায় ব্যাপক হারে গাছ লাগানো।

১৯। কৃষিক্ষেত্রে ধনচে, সয়াবিন, ভূট্টা ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে গ্রীনম্যানুরিং (Green Manuring) করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া।

২০। গ্রামের হাট বাজার ও শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মানুষ ও যানবাহন চলাচলের ফলে মাটি শীত ও গ্রীষ্মকালে ব্যাপক ক্ষয় হতে থাকে, ফলে ঐ সকল এলাকার রাস্তাঘাটে সকাল বিকেলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ কিংবা গাড়ীর সাহায্যে পানি ছিটানো।

২১। ঢালু জমিতে বিশেষ পদ্ধতিতে ফসলের চাষ।

 

 

সূত্র:

  • মৃত্তিকা ক্ষয় ও সংরক্ষণ ,পাঠ ৫.৩, ইউনিট ৫ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version