মৃত্তিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী সৃষ্টির পর উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে কঠিন শিলার সৃষ্টি হয়। এ সব কঠিন শিলা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাপ, চাপ, শৈত্য, বায়ু প্রবাহ ইত্যাদি শক্তির প্রভাবে ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থের সৃষ্টি করে। এরাই মৃত্তিকা গঠনের উৎস বস্তু (Parent material)। এদের সাথে বিভিন্ন জীবজন্তু ও উদ্ভিদের দেহাবশেষের সংমিশ্রণে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী উৎস বস্তুর ধর্ম এবং জলাবায়ুর উপাদানসমূহের প্রভাবের ওপর মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে নির্ভরশীল।
মৃত্তিকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য উৎপাদনের প্রাকৃতিক মাধ্যম। খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ও ধরন মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেজন্য বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফসল উদ্ভিদের প্রাধান্য দেখা যায়। খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম হিসাবে মৃত্তিকার কোন উপযুক্ত বিকল্প নেই। তাই উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে মৃত্তিকা ব্যবহারের পূর্বে একে ভালোভাবে জানা আবশ্যক। এ ইউনিটে মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা, মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদান, শিলা ও শিলাক্ষয়, মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া এবং মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
মৃত্তিকা পার্শচিত্র নিয়ে আজকের আলোজনা। আমরা জানি, পঙ্গুলিকরণ, ল্যাটেরাইজিকরণ ও চুনীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। পুকুর খনন, খাল খনন কিংবা নির্মাণ কাজের জন্য ভূমি খনন আপনারা নিশ্চয় দেখে থাকবেন। এসব খন কাজের সময় লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, ভূপৃষ্ঠে উপর থেকে যতই গভীরে যাওয়া যায় মাটির বর্ণ ততই পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ উপরের স্তরের মাটির বর্ণ নিচের স্তরের মতো নয়। গভীরতার সাথে সাথে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বর্ণের মাটি দেখা যায়। সূতরাং মাটিকে লম্বচ্ছেদ করলে উপর থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নানা বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পন্ন বিভিন্ন গভীরতা বিশিষ্ট অনেকগুলো স্তর দেখা যায়। এ স্তরগুলোকে একত্রে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Soil Profile) বলে।
মৃত্তিকা পার্শচিত্র
একটি মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রে সাধরণতঃ ২-৩ টি স্তর দেখা যায়। এরা ভূ-পৃষ্ঠের সমান্তরালে একটির পর একটি বিন্যস্ত থাকে। স্তরগুলো একটি হতে অপরটি এক বা একাধিক ধর্ম যেমনঃ বুনট, সংযুক্তি, বৰ্ণ, স্তরের পুরুত্ব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পৃথকীকৃত। বুনট হলো কোন মৃত্তিকায় অবস্থিত বালি, পলি ও কর্দম কণার আপেক্ষিক অনুপাত। আর মৃত্তিকার দলা গঠনের ক্ষমতাকে সংযুক্তি বলে। মৃত্তিকার বুনট ও সংযুক্তি নিয়ে পরবর্তী ইউনিটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্রে বিভিন্ন স্তরের বুনট, গভীরতা, বর্ণ ও রাসায়নিক প্রকৃতি প্রভৃতি মৃত্তিকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ করে। এসব বৈশিষ্ট্যাবলীর ওপর ভিত্তি করে কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মৃত্তিকার গুরুত্ব নির্ধারিত হয়। মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে মৃত্তিকা সম্পদের সুষ্টু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
হরাইজন কী (What is Horizon):
মৃত্তিকাকে লম্বচ্ছেদ করলে নানা বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পন্ন এবং বিভিন্ন গভীরতাবিশিষ্ট কতগুলো স্তর দেখা যায় যারা ভূ-পৃষ্ঠের সমান্তরালে একটির পর একটি বিন্যস্ত থাকে, এ সকল স্তরের প্রত্যেকটিকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে হরাইজন (Horizon) বলে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে হরইজনগুলো একটি অন্যটি থেকে পৃথক থাকে।
ক) স্তরের বুনট
খ) সংযুক্তি
গ) বর্ণ
ঘ) স্তরের পুরুত্ব
একটি আদর্শ মৃত্তিকা প্রোফাইলের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনা :
আলোচনা ও বর্ণনার সুবিধার্থে মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন স্তরগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথাঃ O, A, B ও C স্তর। নিম্নে এদের বর্ণনা করা হলো :
(১) o স্তর বা জৈব স্তর :
এটি খনিজ স্তরের উপরের স্তর। কোন কোন প্রোফাইলে এ স্তর দেখা যায়, আবার কোন কোন প্রোফাইলে দেখা যায় না। উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহের অবশেষ জমা হয়ে স্তর সৃষ্টি হয়। সাধারণতঃ বন অঞ্চলে এই স্তর দেখা যায়। কিন্তু তৃণ ভূমিতে তা দেখা যায় না। এ স্তরের আবার দু’টি উপস্তর আছে। উপস্তর গুলো নিম্নরূপ ঃ
(ক) 0, উপস্তর : একে Aoo স্তরও বলা হয়। এ জৈব স্তরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষের প্রকৃত গঠন খালি চোখে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
(খ) O2 উপস্তর : একে Ao স্তরও বলা হয়। O স্তরের সংলগ্ন এবং কিছুটা নিচে অবস্থিত। এখানে প্রাণী ও উদ্ভিদ দেহবাশেষের প্রকৃত গঠন ততটা আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায় না।
(২) A স্তর :
একে ‘এলুভিয়েল স্তর’ ও (Eluvial layer) বলা হয়। একটি খনিজ স্তর যাহা ভূপৃষ্ঠে অথবা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি। অবস্থান করে। এ স্তর হতে বিভিন্ন প্রকার খনিজের চুয়ানী বা এলুভিয়েশন’ ঘটে। খনিজ স্তরের উপরের দিক হতে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে স্তরকে যথাক্রমে A1, A2, A3 ইত্যাদি উপস্তরএ বিভক্ত করা যায়। যেমনঃ
(ক) A উপস্তর :
খনিজ স্তরের সবচেয়ে উপরের স্তর। ইহা প্রচুর হিউমাস মিশ্রিত জৈব পদার্থ ধারণ করে। ফলে এই উপস্তর নিচের স্তরগুলো অপেক্ষা গাঢ় বর্ণ ধারণ করে।
(খ) A, উপস্তর ঃ
এই উপস্তর হতে কদম, লৌহ,, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি সবচেয়ে বেশি। পরিমাণে চুয়ানী বা এলুভিয়েশন ঘটে। A2 উপস্তর সাধারণত Ar অপেক্ষা হালকা বর্ণের হয়।
(গ) A3 উপস্তর :
এটি A ও B স্তরের সংযোগকারী একটি স্তর। তথাপি ইহা B স্তর অপেক্ষা A ও A2 উপস্তরের ধর্মাবলী বেশি প্রদর্শন করে। কোন কোন প্রোফাইলে এই উপস্তরটি অনুপস্থিত থাকে।
(৩) B স্তর :
একে ইলুভিয়েল স্তর (Illuvial layer) ও বলা হয়। স্তরের Fe, A1 এর যৌগ কাদা ও হিউমাসের সাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। যৌগগুলো সাধারণত A স্তর হতে চুয়ানীর মাধ্যমে আসে। অনেক সময় শুকনো ও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে CaCO3, CaSO ও অন্যান্য লবণ এ স্তরের নিচের দিকে জমতে দেখা যায়। স্তর আবার B1, B2 ও B3 উপস্তরে বিভক্ত।
(ক) B, উপস্তর :
এটি A ও B স্তরের সংযোগকারী স্তর এবং ধর্মাবলী A স্তরের এর তুলনায় B স্তরের সাথে বেশি সাদৃশ্য বহন করে। কোন কোন প্রোফাইলে এই স্তরটি অনুপস্থিত থাকে।
(খ) B2 উপস্তর :
A2 ও তার নিচের স্তর হতে নেমে আসা কর্দম কণা, লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের অধিকাংশই এ স্তরে জমা হয়। জৈব বস্তু ধারণ ক্ষমতা A2 স্তরের তুলনায় অধিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের সংযুক্তি ব্লকী অথবা প্রিজমেটিক অথবা উভয়ই হয়ে থাকে।
(গ) B3 উপ স্তর : এ স্তর B এবং C স্তরের মাঝামাঝি। এর ধর্ম C স্তর অপেক্ষা অনেকটা B ও B2 স্তরের কাছাকাছি।
(8) C স্তর :
এটি বিকৃত শিলা দ্বারা গঠিত সোলামের (Solum) [ A ও B স্তর] নিচের স্তর। এটি উৎস বস্তুর অনুরূপ হতে অথবা নাও হতে পারে। এ স্তরে অণুজৈবিক কার্যাবলী অনুপস্থিত এবং আয়তনী ঘনত্ব বেশি। ইহার উপরের স্তর শিলাক্ষয় প্রক্রিয়ায় কালক্রমে সোলামের (প্রকৃত মাটি) অংশ তৈরি করে।
(৫) D স্তর / R স্তর :
একে ভূগর্ভস্থ শিলা স্তরও বলা হয়। এই স্তরের উৎস বস্তুর (Parent material) যেমন : বেলে পাথর, চুনা পাথর, গ্র্যানাইট প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত। সব মৃত্তিকা প্রোফাইলে সব স্তর নাও থাকতে পারে। কারণ ভূমিক্ষয়ের দরুন উপর হতে দু’একটি স্তর বা উপস্তর ক্ষয় হয়ে যেতে পারে।
সোলাম কী? (What is Solum):
উৎস দ্রব্যের (Parent material) উপরে অবস্থিত মৃত্তিকা প্রোফাইলের উপরের অংশ যেখানে মৃত্তিকা গঠনের প্রক্রিয়া গুলো সংঘটিত হয় তাকে সোলাম (Solum) বলে। উন্নত মাটিতে এটি A ও B স্তর নিয়ে গঠিত। একে প্রকৃত মাটিও বলা হয়। শিলাক্ষয় প্রক্রিয়ায় উৎস বস্তুর বা C স্তরের উপরের অংশ কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে এ সোলামের অংশ তৈরি হয়।
রিগোলিথ কী (What is regolith):
মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রে A, B ও C স্তর মিলে যে গঠন প্রাপ্ত হয় তাকে রিগোলিথ বলে। C স্তর সামান্য বিকৃত শিলা দ্বারা গঠিত বলে রিগোলিথে বিকৃত শিলা দেখা যায়। সেজন্য একে উৎসদ্রব্য বা আদি উপাদানের স্তরও বলা হয়৷
সোলাম ও রিগোলিথের মধ্যে পার্থক্য (Differences between solum and regolith) সোলাম ও রিগোলিথের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হয়।
সূচি:
মৃত্তিকা পার্শচিত্র ,পাঠ ১.৬, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
শিলা ও খনিজ নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি উন্মক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান ১২০৪ বই এর ১ নং ইউনিটের ১.৩ নম্বর পাঠ।
শিলা ও খনিজ
সিলিকন (খনিজ)
শিলা কী (What is Rocks) ?:
সিলেটের জাফলং বা শ্রীপুর থেকে আগত পাথর ভর্তি ট্রাক কিংবা আমাদের সড়ক ও রেলপথ তৈরির পাথর সবাই দেখে থাকবেন। বনভোজন কিংবা ভ্রমণের জন্য যারা জাফলং কিংবা শ্রীপুরে গিয়েছেন তারা পাহাড়ী ঝরণায় পাথরের আগমন দৃশ্য নিশ্চয় অবলোকন করেছেন। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, পাহাড়ী ঝরণা ধারায় নেমে আসা এ সব পাথরকে শিলা বলে। তাপ, চাপ ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে এরা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে উঁচু পাহাড়ী এলাকা থেকে পানির স্রোতে গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে আসে।
গড়িয়ে গড়িয়ে নিচের দিকে আসার ফলে ঘর্ষণের কারণে এরা মসৃন ও সুন্দর আকার প্রাপ্ত হয়। সুতরাং ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, শিলা হলো দুই বা ততোধিক খনিজের সংমিশ্রণ বা দলা যা ভূত্বকের অপরিহার্য অংশসমূহ গঠন করেছে এবং যাদের ধর্ম ধারণকৃত খনিজের ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল। যেমনঃ গ্র্যানাইট, চুনাপাথর ইত্যাদি। (According to the Geologists rock is a mixture or aggregate part of the earth’s crust, the properties of which will vary on the basis of minerals they contain. Such as granite, limestone etc.)।
শিলা
শিলার প্রকারভেদ (Classification of rocks):
গঠন ও উৎস অনুসারে শিলাকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় :
আগ্নেয় শিলা ( Igneous rocks)
পাললিক শিলা (Sedimentary rocks)
রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic rocks)
আগ্নেয় শিলা (Igneous rocks):
পৃথিবীর আদিম অবস্থার উত্তপ্ত ও গলিত লাভা কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় উত্থিত উত্তপ্ত গলিত লাভা ঠান্ডা হয়ে যে শিলার সৃষ্টি হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে।
পাললিক শিলা (Sedimentary Rock)
আগ্নেয় শিলার বৈশিষ্ট্য:
উত্তপ্ত গলিত অবস্থা হতে ঠান্ডা হয়ে এ জাতীয় শিলার উৎপত্তি হয় বলে আগ্নেয় শিলায় কোন স্তর থাকে না।
উত্তপ্ত গলিত পদার্থের মধ্যে জীব-জন্তুর অস্তিত্ব অসম্ভব। বৃক্ষলতাও তাতে জন্মে না। এ কারণে আগ্নেয়শিলার ভিতর জীবাশা দেখতে পাওয়া যায় না।
গলিত অবস্থা হতে তাপ বিকিরণ করে ক্ষেত্র বিশেষে এ জাতীয় শিলা কেলাসিত হয় বা নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে।
উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূ-পৃষ্ঠে ঠান্ডা হলে তাকে বহিঃজ আগ্নেয় শিলা (Extrusive igneous rocks) বলে। অপর পক্ষে উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূ-পৃষ্ঠে আসতে না পেরে পৃথিবীর অভ্যন্তরেই ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। এ রূপে গঠিত আগ্নেয় শিলাকে অন্তঃজ (Intrusive) আগ্নেয় শিলা বলে।
ব্যাসল্ট, পিউমিকস্টোন, লাপিলি ইত্যাদি হলো বহিঃজ আগ্নেয় শিলা। অন্যদিকে গ্র্যানাইট, গ্যারো, সায়েনাইট, পরিফাইরি ইত্যাদি অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা।
পাললিক শিলা (Sedimentary rocks):
তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, সাগরতরঙ্গ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে আগ্নেয় শিলা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছোট ছোট নুড়ি, কাকর ও বালিতে পরিণত হয়। অতঃপর অংশসমূহ উল্লিখিত প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা বাহিত হয়ে সমুদ্র, হ্রদ বা উপমহাদেশের তলদেশে পলল বা তলানীরূপে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। পরে তা বায়ুর চাপে জমে শক্ত ও দৃঢ় আকার প্রাপ্ত হয়। এ ধরনের শিলাকে পাললিক শিলা বলে। পলল বা তলানী হতে এ শিলা গঠিত হয় বলে একে পাললিক শিলা বলে। আবার স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয় বলে এ শিলাকে স্তরীভূত (Stratified) শিলা বলে। ইহা অকেলাসিত ।
পাললিক শিলা (Sedimentary Rock)
পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য:
এ শিলা মূল শিলার (Older rocks) ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ হতে সৃষ্টি হয়।
পাললিক শিলা স্তরে স্তরে সৃষ্টি হয় বলে এর মধ্যে স্তর থাকে।
এ শিলার মধ্যে জীবাশা দেখা যায়। ইহা উত্তপ্ত অবস্থা হতে সৃষ্ট নয় বলে অকেলাসিত ।
ইহা গৌণ বা মাধ্যমিক (Secondary) শিলা নামে পরিচিত।
ইহা ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় উন্নত (Developed ) হতে পারে। বালিপাথর (Sand stone), শেল (Shale), ডলোমাইট (Dolomite), সিল্ট স্টোন (Silt stone), চুনাপাথর (Lime. stone) ইত্যাদি পাললিক শিলার উদাহরণ।
রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic rocks):
প্রচন্ড তাপ ও চাপের যৌথ প্রভাবে মূল আগ্নেয় ও পাললিক শিলা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে অধিকতর কঠিন ও স্ফটিকাকার যে নতুন শিলার সৃষ্টি হয় তাকে রূপান্তরিত শিলা বলে। এ ভাবে চুনাপাথর (পাললিক শিলা) রূপান্তরিত হয়ে মার্বেলে, বেলেপাথর (পাললিক শিলা) পরিবর্তিত হয়ে কোয়ার্টজাইট, কাদা পরিবর্তিত হয়ে স্লেটে (Slate), গ্র্যানাইট (আগ্নেয় শিলা) পরিবর্তিত হয়ে নীসে ( Gneisses) পরিণত হয়।
আগ্নেয়শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় রূপান্তরিত হলে তাকে আগ্নেয় রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমন : গ্র্যানাইট নীসে ( Gneisses ), পরিণত হওয়া। অনুরূপভাবে পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হলে তাকে পাললিক রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমনঃ বেলে পাথর পরিবর্তিত হয়ে কোয়ার্টজাইট পরিণত হওয়া।
কোয়ার্টজাইট, এক ধরনের রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rock)
রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য:
আগ্নেয় ও পাললিক শিলা উভয় শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ইহা আগ্নেয় ও পাললিক শিলার জাতক। প্রচন্ড তাপ ও চাপের যৌথ প্রভাবে এ নতুন প্রকৃতির শিলার সৃষ্টি হয়। ইহা কেলাসিত হয় বলে ইহাকে পাললিক শিলা থেকে পৃথক করা যায়। এ জাতীয় শিলার খনিজ উপাদানগুলি সমান্তরাল থাকে বলে আগ্নেয় শিলা থেকে সহজে পৃথক করা যায়।
খনিজ (Minerals) কী?
প্রাকৃতিক অজৈব প্রক্রিয়ায় তৈরি সমসত্ব স্ফটিকাকার বস্তু যার সুনির্দিষ্ট আণবিক গঠন ও রাসায়নিক সংযুক্তি রয়েছে তাকে খনিজ বলে। দুই বা ততোধিক খনিজ একত্রিত হয়ে শিলা গঠন করে। সুতরাং খনিজ হলো শিলা গঠনের উপাদান।
খনিজ প্ৰধানত দু’প্রকার :
প্রাইমারী খনিজ (Primary minerals) : উত্তপ্ত গলিত ম্যাগমা শীতল ও কঠিন হওয়ার ফলে সৃষ্ট খনিজকে প্রাইমারী খনিজ বলে। যেমনঃ কোয়ার্টজ (SiO2) অর্থোক্লেজ ( KAISiO3) মাস্কোভাইট [KAl Si O 10 (OH)2], বায়োটাইট ( KAI (Mg-Fe), Si, O 10 (OH)2], ইত্যাদি প্রাইমারী খনিজ।
সেকেন্ডারী খনিজ (Secondary minerals) : তাপ, চাপ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে প্রাথমিক খনিজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যে খনিজ সৃষ্টি হয় তাকে সেকেন্ডারী খনিজ বলে। যেমনঃ ক্যালসাইট (CaCO3), জিপসাম (CaSO4, 2H2O), লিমোনাইট, (Fe2O3, 3H2O), ডলোমাইট [(CaMg (CO3)2] শিলা ও খনিজের মধ্যে পার্থক্য ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মে শিলা ও খনিজ পদার্থে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিচে শিলা ও খনিজের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
সালফার (খনিজ)
সূত্র:
শিলা ও খনিজ, পাঠ ১.৩, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
মৃত্তিকা গঠনের উপাদান নিয়ে আজকের আলোচনা। কঠিন শিলা থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। শিলা থেকে প্রথমে খনিজের সৃষ্টি হয়। শিলা ও খনিজ থেকে মাটি সৃষ্টি হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ সময় ব্যাপিয়া শিলা ও খনিজের উপর বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবর্তন সাধিত হয়ে মৃত্তিকায় পরিণত হয়। বিশেষ করে তাপমাত্রা, বারিপাত (Precipitation), বিভিন্ন রকমের উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর চলমান ক্রিয়ায় শিলা ও খনিজ নির্দিষ্ট সময় পর মৃত্তিকায় পরিণত হয়।
মৃত্তিকা গঠনের উপাদান
সুতরাং যেসব উপাদান নতুন মৃত্তিকা গঠনের জন্য দায়ী তাদেরকে মৃত্তিকা গঠনের উপাদান বলে। ঐসব উপাদানের যৌথ ক্রিয়ার ফলে মৃত্তিকা প্রোফাইল গঠিত হয়। ভূত্বকের কোন স্থানের মৃত্তিকা প্রধানত পাঁচটি উপাদানের যুগপৎ ক্রিয়ার ফলে গঠিত হয়। এ পাঁচটি উপাদান হলো ঃ
১। মৃত্তিকার উৎস বস্তু (Parent material)
২। জলবায়ু (Climate )
৩। জীবসত্ত্বা (Biosphere)
৪। ভূমির বন্ধুরতা (Topography)
৫। সময় (Time)
জেনীর সমীকরণ (Jenny’s equation):
মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদানগুলোর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন উপায় ও তীব্রতায় সংঘটিত হয়। সবগুলো উপাদানই আবশ্যকভাবে পরস্পর নির্ভরশীল। তবে নির্দিষ্টস্থানে বিশেষ কোন উপাদান মৃত্তিকা গঠনের কাজে অধিক সক্রিয় হতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য উপাদানগুলো অবশ্যই সক্রিয় থাকবে তবে তা তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় হতে পারে। মৃত্তিকা গঠনকালে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের সক্রিয়তার তারতম্যের উপর মৃত্তিকার ধর্ম নির্ভরশীল। বিজ্ঞানী Jenny মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদানসমূহ এবং মৃত্তিকার ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক দেখিয়ে একটি সাধারণ সমীকরণ প্রকাশ করেছেন। ইহা জেনীর সমীকরণ নামে পরিচিত। সমীকরণটি নিম্নরূপ ঃ
S=f (p, cl, b, r, t…………)।
এখানে ঃ
S =মৃত্তিকার ধর্ম (Any soil property)
f= ক্রিয়া (Function of )
P= উৎস বস্তু (Parent material)
cl =জলবায়ু (Climate)
b = জীবসত্ত্বা (Biosphere)
r= বন্ধুরতা (Relief)
t= সময় (Time)
মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদানসমূহের শ্রেণিবিভাগ:
মৃত্তিকা বিজ্ঞানী Joffe মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদানগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :
সক্রিয় উপাদান (Active factor)
অক্রিয় উপাদান (Passive factor)
উৎস বস্তু শিলা (Parent material) এবং ভূনিম্নস্থ শিলার (Bed rock) উপর কাজ করে মৃত্তিকা গঠন করিবার জন্য যে সমস্ত উপাদান শক্তি সরবরাহ করে থাকে তাদেরকে সক্রিয় উপাদান (Active factor) বলে। মৃত্তিকা গঠনের পাঁচটি উপাদানের মধ্যে জলবায়ু (Climate) ও জীবসত্ত্বা (Biosphere) হলো সক্রিয় উপাদান। অপরপক্ষে, উৎস বস্তু, ভূমির বন্ধুরতা (Topography/relief) এবং সময় এরা মৃত্তিকা গঠনে সরাসরি কোন শক্তি সরবরাহ করে না বলে তাদেরকে অক্রিয় উপাদান বলে।
মৃত্তিকা গঠনে উৎস দ্রব্য (Parent material):
মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অঘনীভূত ও রাসায়নিকভাবে কম বেশি ক্ষয় প্রাপ্ত যে সকল খনিজ ও শিলা দ্রব্য থেকে মৃত্তিকা প্রোফাইল উৎপন্ন হয় তাকে মাটির উৎস দ্রব্য বলে।
মৃত্তিকা বিজ্ঞানী Jenny’র মতে, S = f(p) { cl, b, c, ….. }
এ সমীকরণে মাটির গুণের সহিত মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদান উৎস দ্রব্য (Parent material) বা P এর কাজের ফাংশন বুঝানো হয়েছে যখন cl. b. . . ……. স্থির থাকে। ভূতাত্বিক প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্টের বিভিন্ন উৎস দ্রব্য হতে মৃত্তিকার উৎপত্তি হয়। উৎস দ্রব্যের প্রকৃতির ওপর উদ্ভূত মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ মাটির বুনট উৎস দ্রব্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যা মৃত্তিকায় পানির নিম্নমূখী প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলশ্রুতিতে সূক্ষ্ম মৃত্তিকা কলা ও উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের সঞ্চায়ন (illuviation) এবং চুয়ীসরন (eluviation) প্রভাবিত হয়। শিলাক্ষয় (Weathering) প্রক্রিয়া ও এর গতি প্রকৃতি উৎস বস্তুর (Parent material) রাসায়নিক ও খনিজ উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, যা উৎপন্ন উদ্ভিদরাজির প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, লাইম স্টোন সমৃদ্ধ উৎস বস্তু হতে সৃষ্ট মৃত্তিকার প্রোফাইল সৃষ্টি হতে দীর্ঘ সময় লাগে, যা আর্দ্র আবহাওয়া দ্বারা ত্বরান্বিত হয়। শক্ত বিশুদ্ধ চুনাপাথর হতে গভীর বালি প্রধান মাটি তৈরি হয়। অপরদিকে মিশ্রিত নরম চুনাপাথর হতে গভীর ও সূক্ষ্ম বুনট সম্পন্ন মাটি তৈরি হয়। উষ্ণ এশিয়ার অধিকাংশ মাটি গ্রানাইট, নীস, বেসন্ট, বালিপাথর, চুনাপাথর, শেইল ও পলিজ অধঃক্ষেপ হতে উৎপন্ন হয়েছে।
ক্লে কর্দমের গুণগত বৈশিষ্ট্যাবলী ও মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র সমভাবে উৎস বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয়। আগ্নেয় শিলা, স্থুল কোয়ার্টজ নুড়ি, বালিপাথর ইত্যাদি ধীর গতিতে ক্ষয় প্রাপ্ত হয় এবং সাধারণ অনুর্বর মাটি গঠন করে। ইহাতে কেওলিনাইট জাতীয় কর্দম কণা উপস্থিত থাকে এবং ক্ষারীয় দ্রবা কম থাকে। অধিকাংশ ক্ষারীয় আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে সূক্ষ্ণ বুনট সম্পন্ন এবং ক্ষারক সম্পন্ন উর্বর মাটি গঠন করে। এতে মন্টমরিলোনাইট জাতীয় কর্দম কণা বেশি থাকে।
জলবায়ু (Climate ):
Jenny’ র মতে, S = f (cl) {p, b, r, ……) এ সমীকরণে মাটির গুণের সাথে মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদান জলবায়ু বা এর কাজের ফাংশানকে বুঝানো হয়েছে, যখন অন্যান্য উপাদান অপরিবর্তিত থাকে। জলবায়ু হলো মৃত্তিকা গঠনের প্রত্যক্ষ এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি মৃত্তিকা প্রোফাইল শত শত বছর ধরে মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদানসমূহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্রিয়ার ফল। জলবায়ু সাধারণত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠনে প্রভাব বিস্তার করে।
বৃষ্টিপাত:
বৃষ্টিপাত নানাভাবে মাটি গঠনে অংশ গ্রহণ করে। বৃষ্টিপাত বেশি হলে পানি চুয়ানোর মাত্রা বৃদ্ধি পায় ফলে ক্ষারীয় পদার্থ ক্রমেই চুইয়ে নিচে চলে যায়। তখন মাটি অয় হয় এবং সেখানে Fe এবং Al এর প্রাধান্য দেখা যায়। অল্প বৃষ্টি হলে উপরের স্তর হতে CaCO3 ও MgCO3 নিচে নেমে মধ্য স্তরে জমা হয়। ফলে চুন সমৃদ্ধ একটা হরাইজন (Horizon) এর সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বৃষ্টিপাত কম হলে বাষ্পীভবন বেশি হয় ফলে নিচের ক্ষারীয় উপাদান বাষ্পীভবনজনিত টানে পানির সাথে উপরে উঠে। আর পানি বাষ্প হয়ে উড়ে গেলে সে পদার্থগুলো মাটির উপরের স্তরে জমা হয় এবং তখন মাটি ক্ষারীয় বিক্রিয়া প্রদর্শন করে।
বৃষ্টিপাত উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে বাড়ায়, ক্ষুদ্র জীবাণুর বংশবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং তাদের কর্মতৎপরতাকে উৎসাহিত করে। ফলে মাটিতে বেশি পরিমাণে জৈবপদার্থের বিয়োজন হয়ে মৃত্তিকা গঠনের কাজ তরান্বিত করে।
বৃষ্টিপাত ঢালু জমিতে প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের মাধ্যমে মাটির প্রোফাইলকে আক্রান্ত করে, ফলে মৃত্তিকা ধাপ (Steep) এ পাতলা মাটির স্তর এবং পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা পদার্থের পুরু স্তর জমা হয়।
বৃষ্টির পরিশ্রুত পানি মৃত্তিকার উৎস বস্তু গঠনকারী পদার্থগুলোকে দ্রবীভূত করে এবং অন্যত্র নিয়ে জমা করে মাটি গঠনে সহায়তা করে। বাংলাদেশে নদীজনিত ভূমিক্ষয় ও পানি জমাটের মাধ্যমে সামুদ্রিক উপকূল অঞ্চলে নতুন মৃত্তিকা গঠিত হয়।
তাপমাত্রা:
মৃত্তিকা গঠনের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ১০° সে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মৃত্তিকার রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বিগুণ হয়। মেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা হচ্ছে মৃত্তিকা গঠনের বিরোধিতাকারী একটি শক্তি। নিচু তাপমাত্রার কারণে সেখানে কোন পরিস্কার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না। শুষ্ক অঞ্চলেও পরিস্রবনের পরিমাণ কম। যার কারণ হচ্ছে অধিক বাস্পীভবন। উঁচু পর্বত অঞ্চলে শীতকাল দীর্ঘ হওয়ায় মৃত্তিকা প্রোফাইল এর ভিতর দিয়ে পরিস্রবনের পরিমাণ কম হয়। ফলে হ্রদ জলভূমি পাট গঠিত হয়।
নিচু তাপমাত্রায় অণুজীবের কার্যকলাপ সীমিত হওয়ায় জৈব পদার্থ সঞ্চিত হতে থাকে। ফলে এসব অঞ্চলে জৈব পদার্থের স্তর বেশ বিস্তৃত হয় এবং পিটের নিচে কোন মৃত্তিকা স্তর গঠিত হয় না। অপরপক্ষে, আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডল ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডল অঞ্চলে উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে জন্মে এবং অবশেষে বিগলিত হওয়ার ফলে Ao স্তরে জৈবপদার্থ খুব কম হয়।
যে সব এলাকায় উত্তাপ ও আর্দ্রতা বেশি সেখানে মাটিতে কর্দম কণা বেশি দেখা যায় কারণ অবক্ষয় প্রক্রিয়া বেশি মাত্রায় হয়। কিন্তু হীম ও শুষ্ক বা হীম ও আর্দ্র এলাকায় ইহা কম হয়। তাপমাত্রা বেশি ও বৃষ্টিপাত কম হলে মৃত্তিকার ধনাত্মক আয়ন বেশি ধরে রাখতে পারে এবং চুয়ানী পানির পরিমাণ কম হয়।
জীব সত্ত্বা (Biosphere):
Jenny’ র মতে, S=f (b) (cl, p, r, t…..} । এই সমীকরণে b দ্বারা জীব সত্ত্বা (Biosphere) বুঝানো হয়েছে যা সবুজ আণুবীক্ষনিক বা অপেক্ষাকৃত বড় জীবসমূহ এবং মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এটি মৃত্তিকা গঠন পদ্ধতিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। উদ্ভিদ কী প্রকৃতির এবং কী পরিমাণ জৈব পদার্থ প্রদান করিবে তাহার ওপর মৃত্তিকার গঠন নির্ভরশীল। মৃত্তিকার রং, বর্ণ, সংযুক্তি ইত্যাদি ভৌত অবস্থা উদ্ভিদ জাতীয় জৈব পদার্থ দ্বারা পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে উপরের স্তরের ঘাসী জমির মাটিতে জৈব পদার্থ (Organic matter) তুলনামূলকভাবে বনাঞ্চলের মাটি হতে বেশি থাকে।
উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি গাঢ় বর্ণের যার পানি ও ক্যাটায়ন ধারণ ক্ষমতা বনাঞ্চলের মাটি হতে বেশি। মৃত্তিকা গঠনও ঘাসী উদ্ভিদরাজি দ্বারা প্রভাবিত হয়। এছাড়া মৃত্তিকার অম্লত্ব ও ক্ষারকত্বও উদ্ভিদরাজি দ্বারা প্রভাবিত হয় পার্বত্য এলাকার মাটির চাইতে নিম্নভূমির মাটিতে গাছের বৃদ্ধি এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হয়।
ভূমির বন্ধুরতা (Topography):
Jenny’র মতে, S = f (r) { cl, b, p. …… | এ সমীকরণে মাটির গুণের সাথে মৃত্তিকার বন্ধুরতার বা এর কাজের ফাংশানকে বুঝানো হয়েছে যখন অন্যান্য উপাদান অপরিবর্তিত থাকে। কোন স্থানের ভূমির বন্ধুরতা বলতে সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে উক্ত স্থানের উচ্চতাকে বুঝায়। মৃত্তিকা গঠনে ভূমির বন্ধুরতা সাধারণত নিম্নরূপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে :
ভুমির বন্ধুরতা জলবায়ুর প্রভাবকে ত্বরান্বিত করে বা বিলম্বিত করে। অসমতল জমি অপেক্ষা সমতল জমি থেকে অতিরিক্ত পানি কণা বেশি অপসারিত হয়। কোন স্থানে সারা বছর বা বছরের অধিকাংশ সময় পানি জমা থাকলে উহাতে জলবায়ূর প্রভাব ততটা কার্যকর হয় না।
পাড়ের তীক্ষ্ণঢালে সহজে ভূমিক্ষয় হয় এবং পানি মাটির প্রোফাইলে খুবই কম পরিমাণে প্রবেশ করে। এজন্য কম দৈর্ঘ্যের প্রোফাইল গঠিত হয়। ভূমির বন্ধুরতা নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও মাটির পানির স্তরের উচ্চতা নির্ধারণ করে। বন্ধুরতা বা ঢাল মৃদু হলে অধিক পরিমাণ পানি মৃত্তিকা প্রোফাইলে প্রবেশ করে ফলে অধিক দৈর্ঘ্যের প্রোফাইল প্রতিষ্ঠিত হয়।
কম ঢালবিশিষ্ট প্রোফাইলটিতে অধিক জৈব পদার্থ থাকে। ভূ-পৃষ্টের অসমতলতা সমুদ্রপৃষ্ট হতে উচ্চতা বৃদ্ধি করে জলবায়ু অধিকতর শীতল হয়। মাঝে মাঝে অধিক আর্দ্রতাসম্পন্ন হয় যা মৃত্তিকা গঠনে প্রভাব ফেলে। বন্ধুরতা ফসলী জমির ব্যবহার বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে জমির ব্যবহারের উপর প্রভাব ফেলে যা মাটি গঠনের সহায়ক।
সময় (Time):
Jenny’র মতে S = f (t) { cl, b, p, r} | এ সমীকরণে মাটির গুণের সাথে মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদান সময় বা এর কাজের ফাংশানকে বুঝানো হয়েছে, যখন অন্যান্য উপাদান যেমন : cl,b, pr… স্থির থাকে। শিলা হতে মাটি সৃষ্টি হওয়ার জন্য একটা ন্যূনতম সময়ের দরকার। শিলা ও খনিজ পদার্থের ক্ষয় হতে কী পরিমাণ সময় ব্যয়িত হয়েছে তার ওপর মাটির প্রকৃতি নির্ভর করে।
উৎস বস্তু সৃষ্টির পর সময়ের ব্যবধানে সৃষ্ট মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীর পরিবর্তন ঘটে। যদিও সময়ের এ প্রয়োজনীয়তা জলবায়ু, Parent material এর প্রকার, প্রাণী ও উদ্ভিদের কার্যাবলী ও নিষ্কাশন (Drainage) এর উপর ঘনিষ্টভাবে নির্ভরশীল। সাধারণত একটি পরিণত বা সম্পূর্ণ মাটি (Mature soil) তৈরি হতে দুইশত থেকে কয়েক হাজার বছর লাগতে পারে।
নিম্নলিখিত কারণে মাটি তৈরির কাজ বিলম্বিত হয়।
(ক) কম বৃষ্টিপাত
(খ) কম আপেক্ষিক আর্দ্রতা
(গ) অধিক চুন সম্পন্ন উৎস বস্তু
(ঘ) অধিক বালি
(ঙ) অধিক কর্দম কণা
(চ) ক্ষয়রোধী উৎস বস্তু
(ছ) তীব্র ঢাল
(জ) উচ্চ পানি স্তর
(ঝ) সতত মৃত্তিকা দ্রব্যের অপসারণ
(ঞ) তীব্র বায়ু ও পানি ভূমি ক্ষয়
(ট) অধিক গর্ত খননকারী প্রাণী, ইত্যাদি
সূত্র:
মৃত্তিকা গঠনের উপাদান ,পাঠ ১.২, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
বীজের বিশুদ্ধতা কৃষি উৎপাদনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি মানসম্পন্ন ও বিশুদ্ধ বীজ সরবরাহ কৃষকের উৎপাদনশীলতা, ফলনের পরিমাণ এবং ফসলের গুণগত মানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশুদ্ধ বীজ বলতে বোঝায়—বীজের মধ্যে কেবলমাত্র কাঙ্ক্ষিত (desired) জাতের বীজ থাকবে, যেখানে অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা ভিন্ন জাতের বীজের উপস্থিতি থাকবে না। এর ফলে কৃষক নির্ভরযোগ্য ফলনের নিশ্চয়তা পায় এবং উপযুক্ত জাতের গুণাগুণ বজায় থাকে।
বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়
এই পাঠটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএজি-এড ডিসিপ্লিনের “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি (Course Code: ১১০২)” বিষয়ের চতুর্থ ইউনিটের ‘মৃত্তিকার জৈবিক বৈশিষ্ট্য’ অংশের অন্তর্ভুক্ত।
বীজেরবিশুদ্ধতারগুরুত্ব
বীজ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা না হলে—
ফসলের জাতের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে,
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে,
রোগবালাই প্রতিরোধে সমস্যা দেখা দিতে পারে,
বাজারে ফসলের মান ও গ্রহণযোগ্যতা কমে যেতে পারে।
বীজেরবিশুদ্ধতারহারনির্ণয়
বীজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য তার বিশুদ্ধতার হার নির্ধারণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বীজে কাঙ্ক্ষিত জাতের বীজ কত শতাংশ রয়েছে এবং কতটা ভেজাল বা অনুপযুক্ত জাত মিশ্রিত হয়েছে। বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়ের মাধ্যমে কৃষক—
সঠিক বীজ নির্বাচন করতে পারেন,
ফলন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নির্ভরযোগ্যভাবে করতে পারেন,
উচ্চমানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে সক্ষম হন।
এই পাঠে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে বীজের বিশুদ্ধতার হার কীভাবে নির্ণয় করা হয়, তার ধাপ ও ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা:
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়—কোনো বীজ নমুনায় ওজনের ভিত্তিতে শতকরা কত ভাগ মূল শস্য বীজ বিদ্যমান। এই পরীক্ষা কৃষিতে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং ফলনের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করে।
একটি বীজ নমুনায় প্রধানত চারটি উপাদান থাকে:
উপাদানের ধরন
বর্ণনা
উদাহরণ
(১) বিশুদ্ধপ্রজাতিরবীজ
এটি কাঙ্ক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য জাতের বীজ যা উচ্চ ফলনশীল ও কৃষির জন্য উপযোগী।
যেমন: উন্নত জাতের ধান, গম, টমেটো, পালং ইত্যাদি
(২) অন্যান্যপ্রজাতিরবীজ
ভিন্ন জাত বা অবাঞ্ছিত শস্যের বীজ যা উদ্দেশ্য ফসলের সাথে অপ্রাসঙ্গিক।
যেমন: প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ভিন্ন শস্য বীজ
(৩) আগাছারবীজ
এ ধরনের বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ ফসলের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং জমির উর্বরতা নষ্ট করে।
যেমন: পুঁইশাক, গাঁদা, নালিশ, মঞ্জরি ইত্যাদি
(৪) জড়পদার্থ
মাটি, পাতা, পাথর বা অন্য কোনো অনাবশ্যক বস্তু যা বীজের সঙ্গে মিশে থাকে।
যেমন: পাথর, শুকনো পাতা, ধুলাবালি ইত্যাদি
এই চারটি উপাদানকে আলাদা করে ওজন করে দেখা হয় কত শতাংশ বিশুদ্ধ প্রজাতির বীজ রয়েছে। এই শতকরা হারই বীজের বিশুদ্ধতার হার হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশুদ্ধতার হার যত বেশি, বীজ তত বেশি মানসম্পন্ন ও ফলপ্রসূ।
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি:
বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ একটি সূক্ষ্ম ও মনোযোগসাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যার জন্য নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রপাতি অপরিহার্য। নিচে এই যন্ত্রপাতিগুলোর নাম ও ব্যবহার সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:
(১) পিউরিটি বোর্ড (বা বীজ বোর্ড): এটি একটি সাদা, মসৃণ ও সমতল পৃষ্ঠবিশিষ্ট বোর্ড, যা বীজ বিশুদ্ধতা পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। বীজ ছড়িয়ে পরীক্ষার সময় বিভিন্ন উপাদান যেমন — বিশুদ্ধ বীজ, ভেজাল বীজ, ময়লা, খোসা, মৃত বীজ ইত্যাদি সহজে শনাক্ত করা যায়। রঙিন বা অমসৃণ পৃষ্ঠ বিশ্লেষণকে ব্যাহত করে, তাই সাদা পৃষ্ঠ ব্যবহার করা হয়।
(২) মাপক নিক্তি (দশমিক গ্রাম স্কেল, যথা: ±০.০০১ গ্রাম): বীজের ওজন সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্য এই সূক্ষ্ম মাপযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। বিশেষত বিশুদ্ধতা পরীক্ষার সময় মোট ওজন ও বিশুদ্ধ অংশের ওজন নিরূপণ করতে এটি অপরিহার্য।
(৩) সাদা কাগজ: বিকল্প পৃষ্ঠ হিসেবে, বিশেষ করে পোর্টেবল পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সাদা কাগজ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পরীক্ষার সময় পিউরিটি বোর্ডের কাজ করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান আলাদা করতে সুবিধা দেয়।
(৪) পেট্রি ডিস (মাঝারি ও বড় আকার): বীজ বিশ্লেষণের সময়, বিশেষ করে অঙ্কুরোদগম বা জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে, পেট্রি ডিস ব্যবহার করা হয়। এতে বীজ সহজে পর্যবেক্ষণযোগ্য অবস্থায় রাখা যায়।
(৫) চিমটা (টুইজার): ছোট ও সূক্ষ্ম বীজ বাছাই বা পৃথক করার সময় চিমটা ব্যবহার করা হয়। এটি বীজকে আঘাত না করে আলাদা করতে সহায়তা করে।
(৬) স্ট্যান্ডযুক্ত ম্যাগনিফাইং গ্লাস (আয়তন বাড়ানো কাচ): ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম গঠনের বীজ বা ভেজাল উপাদান বিশ্লেষণের জন্য এই যন্ত্রটি অত্যন্ত কার্যকর। স্থির স্ট্যান্ডের মাধ্যমে দুই হাত মুক্ত রেখে কাজ করা যায়, যা দীর্ঘ সময় ধরে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সহায়ক।
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার ধাপ:
বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ একটি সঠিক কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়, যাতে বীজের মধ্যে অন্য কোনো প্রজাতির বীজ, আগাছা, বা জড় পদার্থ মিশে না থাকে। নিচে বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার বিস্তারিত ধাপ উপস্থাপন করা হলো:
১। ওজন মাপুন
প্রথমে, মাপক নিক্তি ব্যবহার করে কার্য সম্পাদন নমুনার সঠিক ওজন নিন। এটি নিশ্চিত করবে যে, আপনার কাছে সঠিক পরিমাণ বীজ রয়েছে যা পরীক্ষা করতে হবে।
২। বীজ ছড়িয়ে দেয়া
ওজন নেওয়ার পর, সমস্ত বীজ পিউরিটি বোর্ডে ছড়িয়ে দিন। তারপর, বীজগুলোকে নিম্নলিখিত উপকরণের ভিত্তিতে পৃথক করুন:
(ক) বিশুদ্ধ বীজ: সঠিক জাতের বীজ যা ফসল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত।
(খ) অন্য প্রজাতির বীজ: যেগুলো অন্য কোনো জাত বা প্রজাতির, যা সাধারণত উপযুক্ত নয়।
(গ) আগাছা বীজ: যেগুলো কৃষিকাজের জন্য অবাঞ্ছিত এবং ফসলের ক্ষতি করতে পারে।
(ঘ) জড় পদার্থ: মাটি, পাথর বা অন্য কোনো অবাঞ্ছিত উপাদান, যা বীজের সঙ্গে মিশে থাকে।
এই উপাদানগুলো সঠিকভাবে আলাদা করার জন্য, বিস্তারিতভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য জানুন এবং সঠিকভাবে শনাক্ত করুন।
৩। বীজ পৃথক করা
বাছাই করা প্রতিটি অংশ পৃথক পৃথক পেট্রি-ডিসে রাখুন। এই সময়ে, বীজ শনাক্তকরণের জন্য যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তবে স্ট্যান্ডযুক্ত ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করুন। এটি আপনাকে বীজের বিস্তারিত গঠন এবং তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।
৪। ওজন নির্ধারণ ও হিসাব করা
এরপর, প্রতিটি অংশের সঠিকভাবে (প্রয়োজনীয় সংখ্যক দশটি ঘর পর্যন্ত) পৃথক ওজন নির্ধারণ করুন এবং নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহার করে হিসেব করুন:
কার্য সম্পাদনের নমুনার ওজন (G গ্রাম)
নির্ধারিত অংশের মোট ওজন (W গ্রাম)
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পরীক্ষার পর যদি G ও W এর মধ্যে ৫% এর বেশি পার্থক্য থাকে, তাহলে আবার পরীক্ষা করুন।
৫। বিশুদ্ধতা গণনা
প্রস্তুত করার পর, আপনি বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করতে পারবেন। বিশুদ্ধতা হিসাব করার জন্য, নিম্নলিখিত সূত্র অনুসরণ করুন:
এটি নিশ্চিত করবে যে, আপনার নমুনার মধ্যে কত শতাংশ বীজ বিশুদ্ধ। মনে করি, সম্পাদনের নমুনার ওজন এ গ্রাম, তখন অন্যান্য ওজন ও বীজের বিশুদ্ধতার সূত্র নিম্নরূপ হবে:
কার্য সম্পাদনের নমুনার ওজন G গ্রাম কার্য সম্পাদনের নমুনা বিভিন্ন অংশে পৃথক করার পর মোট ওজন W গ্রাম এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হিসেব শেষ করার পর যদি কার্য সম্পাদন নমুনা G ও W এর মধ্যে ৫% এর বেশি পাথক্য থাকে তাহলে পূনরায় পরীক্ষা করুন।
এখন আমরা বিশুদ্ধ বীজ, অন্য প্রজাতির বীজ, আগাছা বীজ ও জড় পদার্থ সম্পর্কে আলোচনা করব।
বিশুদ্ধ বীজ অংশ:
বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণে বিভিন্ন উপাদান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রজাতির বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মানের উপর। নিচে বিশুদ্ধ বীজ, অন্য প্রজাতির বীজ, আগাছার বীজ ও জড় পদার্থ চিহ্নিত করার বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হলো:
১. সম্পূর্ণ অক্ষত ও সুস্থ বীজ: একটি বিশুদ্ধ বীজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি সম্পূর্ণ অক্ষত, দাগহীন ও সুস্থ হতে হবে। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন এই বীজগুলোই পরবর্তীতে সুস্থ ও উৎপাদনক্ষম গাছের জন্ম দেয়।
২. ভ্রণসমৃদ্ধ ভাঙা বীজ: যেসব ভাঙা বীজে অন্তত ৫০% অংশ, বিশেষত ভ্রণ অংশ অক্ষত থাকে, সেগুলোকে অনেক সময় বিশুদ্ধ বীজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এসব বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে পরীক্ষা করা আবশ্যক।
৩. চিটা বা আংশিক বিকৃত বীজ অন্তর্ভুক্ত নয়: চিটা, অপরিপূর্ণ বা অর্ধ-গঠিত বীজকে বিশুদ্ধ বীজ হিসেবে গণ্য করা যায় না। এদের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নেই এবং এগুলো উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
❌ অবিশুদ্ধ উপাদানসমূহ
১. অন্য প্রজাতির বীজ: মূল ফসল ছাড়া অন্য যেকোনো প্রজাতির বীজ এই অংশে পড়ে। এদের উপস্থিতি চাষের কাঙ্ক্ষিত ফলন ব্যাহত করতে পারে, কারণ তারা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বহন করে।
২. আগাছার বীজ: পরিচিত বা অজানা সব ধরনের আগাছার বীজ—যা সম্পূর্ণ, ভাঙা বা চিটা হতে পারে—বিশুদ্ধতার বাইরে বিবেচিত। এগুলো ফসলের পুষ্টি গ্রহণে প্রতিযোগিতা তৈরি করে এবং ক্ষেত্রকে আগাছা আচ্ছাদিত করে ফেলে।
৩. জড় পদার্থ: যেসব উপাদান বীজ নয়—যেমন মাটি, ধুলো, পাথর, শুকনো শিকড়, খোসা, খড়কুটা ইত্যাদি—তারা জড় পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এসব পদার্থ বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
জড় পদার্থ নিম্নরূপ হবে:
বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে জড় পদার্থের উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। জড় পদার্থ বলতে বোঝায়—বীজ ছাড়াও অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত ও অজৈব বস্তু যা বীজের গুণগত মান ও অঙ্কুরোদগমে বাধা সৃষ্টি করে। এইসব উপাদান বীজের ভৌত গঠনকে নষ্ট করে এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
জড় পদার্থের ধরন ও তাদের প্রভাব
১. মূল শস্য বা অন্যান্য শস্য বীজের ৫০% এর কম উপস্থিতি: যখন বীজের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জাতের উপস্থিতি ৫০% এর কম হয়, তখন তা অদক্ষ বা নিম্নমানের বীজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ব্যবহার কৃষকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
২. ছাতাগুটি বা কৃত্রিম গুলের উপস্থিতি: ছত্রাকজনিত ছাতাগুটি বা রোগাক্রান্ত অংশ কিংবা কৃত্রিমভাবে গঠিত গুল বীজের গুণগত মান নষ্ট করে দেয়। এটি বীজের সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্ষেত্রেও রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে।
৩. চিটা বীজের উপস্থিতি: চিটা বা অপুষ্ট বীজ বীজতলার বা ক্ষেতে অঙ্কুরিত হয় না, ফলে এটি উৎপাদন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. খড়কুটা, পাতা ও কান্ড: এসব জৈব অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণের সময় পচে যেতে পারে, যার ফলে বীজের আর্দ্রতা বাড়ে ও ছত্রাক জন্মায়, যা বীজের সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করে।
৫. মাটি কণা, নুড়ি, ইটের টুকরা, ধুলাবালি ও মৃত/জীবিত কীটপতঙ্গ: এ ধরনের অনুজৈব বস্তু বীজের ওজন বাড়িয়ে দেয়, পরীক্ষায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষত মৃত বা জীবিত কীটপতঙ্গ শস্যের ক্ষতি করে ও গুদামে সংরক্ষণের সময় ঝুঁকি বাড়ায়।
সূত্র:
বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয় , বীজ উৎপাদন , ইউনিট-৪ , পাঠ-৪.৪
মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি বিএই ১২০৪ – মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ের ইউনিট -২ এর পাঠ – ২.৫। আকারে যোগান দেয়ার সামর্থকে মাটির উর্বরতা বলে। যে মাটি খুব বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান যোগান দিতে পারে সে মাটি তত বেশি পরিমাণ উর্বর। পুষ্টি উপাদানের পরিমাণের উপর মাটির উর্বরতা কম বা বেশি হতে পারে।
মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা
উর্বরতা অনুযায়ী মাটি ২ প্রকারের হয়ে থাকে—
উর্বর মাটি:
শস্য উৎপদানের জন্য উর্বর মাটি উত্তম। যে মাটি উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে ও উৎপাদনের সুষম আকারে যোগান দিতে সক্ষম তাকে উর্বর মাটি বলে।
অনুর্বর মাটি :
যে মাটি উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে ও সুষম আকারে যোগান দিতে অক্ষম তাকে অনুর্বর মাটি বলে। এ মাটি শস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী নয়।
মাটির উর্বরতা হ্রাসের কারণ নিম্নে মাটির উর্বরতা হ্রাসের কারণসমূহ তুলে ধরা হল:
১. জৈব সারের ব্যবহার কম করা
২. রাসায়নিক সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা।
৩. শস্য পর্যায় নীতি মেনে না চলা।
৪. উচ্চফলনশীল জাতের ফসল চাষ করা।
৫. ভূমিক্ষয় ও মাটি দূষণ।
৬. জ্বালানী হিসাবে গোবর সার ব্যবহার করে ফেলা।
৭. নিবিড়ভাবে ফসল চাষ করা।
৮. গৃহপালিত পশুর সংখ্যা ও গোবর কমে যাওয়া।
৯. ফসলের বাকী অংশ জ্বালানী কাজে ব্যবহার করা।
১০. অধিক ভূমি কর্ষণ করা।
উর্বর মাটির বৈশিষ্ট্য :
মাটির পিএইচ মান ৬.০—৭.৫।
মাটি গাঢ় বর্ণের।
মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ওজন ভিত্তিতে ২—৩%।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়া ফসল ও ফসলবিন্যাস।
দোঅঁাশ থেকে পলিদোঅঁাশ সম্পন্ন মৃত্তিকা বুনট।
মাটির উৎপাদন ক্ষমতা:
নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট শস্য বা শস্য বিন্যাসের ফলন দেয়ার ক্ষমতাকে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বলা হয়।
মাটি ও ফসলের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী মাটি দু’প্রকারের হয়ে থাকে যথা:
১. উৎপাদক মাটি : যে মাটি ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত তাকে উৎপাদক মাটি বলে।
২. অনুৎপাদক মাটি : যে মাটি ফসল ফলানোর জন্য অপেক্ষাকৃত অনুপযুক্ত তাকে অনুৎপাদক মাটি বলে।
উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মাটির বৈশিষ্ট্য :
১. মাটি উর্বর হয়ে থাকে।
২. মাটি উত্তম নিস্কাশন সম্পন্ন হয়ে থাকে।
৩. আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুকুলে থাকে।
৪. ফসলের শত্রু কম থাকে।
উর্বর মাটির উপাদান প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপাদান দ্বারা মাটির উর্বরতা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিম্নে উপাদানমূহ উল্লেখ করা হল:
প্রাকৃতিক উপাদান
১. গাছপালা ও জলবায়ু: গাছপালা ও জলবায়ু মাটির উর্বরতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অধিক গাছপালা সম্পন্ন এলাকার মাটিতে অধিক জৈব পদার্থ যোগ হয় যার ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। অধিক বৃষ্টিপাত সম্পন্ন এলাকার মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাওয়ায় উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান কমে যায়। আবার যে সব এলাকায় তাপমাত্রা বেশি ও আর্দ্র আবহাওয়া সেসব এলাকার মাটি তাড়াতাড়ি ক্ষয়িত হয়, ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায়।
২. উৎস শিলা : উদ্ভিদ যে খনিজ উপাদানসমূহ গ্রহণ করে তা উৎস শিলা হতে পেয়ে থাকে। যে শিলায় পুষ্টি উপাদান অধিক সে শিলা সম্পন্ন মাটি অধিক উর্বর হয়ে থাকে।
কৃত্রিম উপাদান , কৃত্রিম উপাদানসমূহ নিম্নরূপ:
১. প্রয়োগকৃত জৈব পদার্থ : জৈব পদার্থ মাটির ভৌত অবস্থার উন্নতি করে এবং মাটিতে বিদ্যমান অনুজীব কার্যক্ষমতা ত্বরান্বিত করে ফলে মাটির উর্বরতা বেড়ে যায়।
২. ভূমি কর্ষণ : পরিমিত ভূমি কর্ষণের ফলে ভূমির উপরের স্তর দূর্বল হয় যার ফলে উদ্ভিদের শেকড় সহজেই বিস্তার লাভ করে পুষ্টি উপাদান নিতে পারে।
৩. মাটির পিএইচ : মাটিতে এর মান খুব বেশি বা কম হলে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে না। পিএইচ (ঢ়ঐ) মান ৬—৮ হলে উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
মাটির উৎপাদনক্ষমতার উপাদান:
আমরা সহজে বলতে পারি যে, যে মাটি যত বেশি উর্বর তার তত বেশি উৎপাদনক্ষমতা থাকে। মাটির উৎপাদনক্ষমতা কিছু উপাদানের উপর নির্ভর করে থাকে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:
১. মাটির উর্বরতা: মাটির উর্বরতা হচ্ছে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণ ও সুষম হারে যোগান দেওয়া। মাটি উর্বর হলে তা অবশ্যই উৎপাদনশীল হবে।
২. শস্য পর্যায় : শস্য পর্যায় যথাযথভবে অনুসরণ করে মটির উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়।
৩. জলবায়ু : ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত জলবায়ুর প্রয়োজন। উপযুক্ত জলবায়ু মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৪. জমি কর্ষণ : জমি কর্ষণের উপর মাটির উৎপাদান ক্ষমতা নির্ভর করে। জমি ভালোভাবে কর্ষণ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৫. ফসল ব্যবস্থাপনা : ফসল ব্যবস্থাপনার উপর মাটির উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভরশীল্ ফসল ব্যবস্থাপনা যেমন সার প্রয়োগ, আন্ত:কালীন পরিচর্যা, রোগ ও পোকামাকড় দমন, গাছের গোড়া আলগা করে দেয়া প্রভৃতির মাধ্যমে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মাটির উর্বরতা সংরক্ষণের উপায় :
১। সঠিক পদ্ধতিতে জমির ব্যবহার : ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে জমিতে যে ফসল উপযোগী সে জমিতে সে ফসল চাষ করতে হবে। যেমন সমতল ভূমিতে সে সকল ফসল চাষ করা হয় পাহাড়ি অঞ্চলে সেসকল ফসল চাষ করা যায় না। সমতল ও পাহাড়ি জমির চাষ পদ্ধতিও ভিন্ন হবে।
২। ভূমি কর্ষণ : পরিকল্পিতভাবে ভূমি কর্ষণ মাটির উর্বরতা সংরক্ষণে সহায়ক। অনিয়মিত ও যথেচ্ছ ভূমি কর্ষণ মাটির ভৌত ধর্ম নষ্ট করে এবং উর্বরতা কমায়। সে ফসলের জন্য যতটুকু কর্ষণ করা দরকার ততটুকুই কর্ষণ করতে হবে।
৩। জৈব পদার্থ প্রয়োগ : জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। জৈব পদার্থ মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মের উন্নয়ন সাধন করে এবং গাছের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। বিভিন্ন জৈব সার যেমন খামার জাত সার, কম্পোস্ট, সবুজ সার, গোবর, পঁচা আবর্জনা ইত্যাদি মাটিতে প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ানো যায়।
৪। পরিমিত রাসায়নিক সার ব্যবহার : জমিতে বিভিন্ন সারের প্রয়োজনীয়তা জেনে পরিমিত রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
৫। পানি সেচ ও নিকাশ : জমিতে পানি সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থা ভাল হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় পানি সেচ দিতে হবে আবার অতিরিক্ত পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।
৬। সবুজ সার ও আচ্ছাদন ফসলের চাষ : বিভিন্ন সবুজসার ফসল যেমন ধৈঞ্চা ফুল আসার পূর্বে নরম অবস্থায় চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও মাটির উপর আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী ফসল যেমন ডাল, মিষ্টি আলু ইত্যাদি চাষ করে মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ করা যায়।
৭। ফসল পর্যায় ও ফসল বিন্যাস অবলম্বন : একই জমিতে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফসল চাষ করতে হবে যাতে মাটির বিভিন্ন অঞ্চলের পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদ দ্বারা সমভাবে পরিশোধিত হয়।
৮। আগাছা দমন ও মালচিং : আগাছা জমির পুষ্টি উপাদান শোষন করে জমির উর্বরতা কমায়। এজন্য আগাছা দমন করে এবং উদ্ভিদ অবশিষ্টাংশ ও অন্যান্য খড়কুটা দিয়ে মালচিং করে জমির উর্বরতা সংরক্ষণ করা যায়।
সারাংশ
ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির উর্বরতা বজায় রাখা অতীব প্রয়োজন। শুধু মাটির উর্বরতা বজায় রাখলে চলবে না, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কারণ রাসায়নিক বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে ও হাজার বছরের চাষাবাদের ফল মাটি হারাচ্ছে তার অকৃত্রিম উর্বরতা। তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমাদের দেশের জমির উর্বরতা রক্ষা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে হবে।
ভূমিক্ষয় ও সংরক্ষণ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” এর, ২ নং ইউনিটের ২.৪ পাঠ।
ভূমিক্ষয় ও সংরক্ষণ
ভূমির নির্বিচার:
অবিরাম ও অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে ভূমিক্ষয়ের বিষয়টি এখন সারাবিশ্বে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, তুষারপাত, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, সূর্যের উত্তাপ, কালবৈশাখী ঝড় ইত্যাদি নিয়ামকের প্রভাবে ভূপৃষ্টের মাটি সরে যাওয়াকে ভূমিক্ষয় বা মৃত্তিকাক্ষয় বলে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক শক্তির প্রভাবে ভূমির উপরের অংশ ক্ষয় হওয়াকে ভূমি ক্ষয় বলে।
দীর্ঘদিন ধরে যে মাটি গড়ে উঠে তা জল প্রবাহ ও বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে অল্প সময়ের ব্যবধানে স্থানান্তরিত বা আলগা হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ রাস্তাঘাট ধ্বসে পড়া, নদীর কিনারার ভাঙ্গন পুকুরপাড় ভাঙ্গন,পানি গড়ে গর্ত হওয়া, গাছপালার শিকড় বের হয়ে যাওয়া প্রভৃতি। ভূমি সংরক্ষণ মাটির কোন খাদ্যোপাদানের ঘাটতি না করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণ করাই হচ্ছে মাটির সংরক্ষণ বা মৃত্তিকা সংরক্ষণ। অর্থাৎ মাটিতে যে ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়, একে যথাস্থানে ধরে রেখে এর স্বাস্থ্য রক্ষা করার নামই মাটি সংরক্ষণ। মাটির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা মাটি সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য, পরিবেশ রক্ষার জন্য এবং কৃষি জমির সৃষ্ঠ প্রয়োগের জন্য মাটি সংরক্ষণ অতীব জরুরী বিষয়।
ভূমিক্ষয় ও সংরক্ষনের মধ্যে পার্থক্য :
ভূমিক্ষয়ের কারণ:
ভূমিক্ষয়ের কারণ বিভিন্ন কারণে ভূমিক্ষয় হয়। নিচে ভূমিক্ষয়ের কারণগুলো উল্লেখ করা হলো:
বন উজাড়করণ।
মাটির প্রকৃতি।
বায়ু প্রবাহ।
বৃষ্টির আঘাতে ভূ—ত্বকের মাটির স্তর ভীষণ ক্ষয় হওয়া
পাহাড় বা টিলাতে চাষাবাদে করা।
মানুষের অবাধ বিচরণ এবং মাঠে ঘাটে দৌড়, লাফ এবং খেলাধুলার প্রভাব।
অবাধ খনন কাজ ও অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন।
আগুনের মাধ্যমে ফসলের অবশিষ্টাংশ ও বনভূমির আগাছা লতাপাতা পুড়ে ফেলা।
কৃষিকাজে যন্ত্রের প্রয়োগ।
শস্য পর্যায় অবলম্বন না করা
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার।
মিলকারখানা ও নগরায়নের কার্যক্রম।
ভূমিক্ষয়ের শ্রেণীবিভাগ:
ভূমিক্ষয়ের কার্যকারিতা অনুসারে ২ প্রকার যেমন—
ক) স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয়
খ) ত্বরান্বিত ভূমিক্ষয় বা মানুষ কতৃর্ক ভূমিক্ষয়
ক) স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয় :
প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয়ের প্রভাব ব্যাপক। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ভূমির ক্ষয় শুরু হয়েছে। নদীর মোহনায় বা সমুদ্রে চর সৃষ্টি বা দ্বীপ গড়ে ওঠা এই সবই দীর্ঘকালের ভূমিক্ষয়ের ফলাফল। এই ভূমিক্ষয়ের ফলে পৃথিবীর কোন অঞ্চল উর্বর হচ্ছে আবার অন্য কোন অঞ্চল অনুর্বর হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ভূমিক্ষয় একটি অনবরত চলমান প্রক্রিয়া।
প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে বায়ুপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত অন্যতম। এগুলো প্রবাহিত হওয়ার সময় ভূ—পৃষ্ঠের মাটির কণা বহন করে নিয়ে যায়। তবে এতে যে পরিমাণ মাটির ক্ষয় হয় তা খুবই নগণ্য। প্রাকৃতিক ভূমিক্ষয় মাটি গঠন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ বলে ধরা হয়। ভূমিক্ষয় ও মাটির গঠনের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকাল অনাবরত ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে
কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে।
খ) ত্বরান্বিত ভূমিক্ষয় বা মানুষ কতৃর্ক ভূমিক্ষয় :
মানুষ কর্তৃক ভূমিক্ষয়ের প্রভাব ব্যাপক। মানুষ নিজের প্রয়োজনে বিভিন্নভাবে ভূমিক্ষয় করছে। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। খাদ্য উৎপাদনের জন্য মানুষ মাটিতে কৃষিকাজ করে আসছে কৃষি সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে। কৃষি কাজের জন্য ভূমিকর্ষণ, পানি সেচ ইত্যাদি করা হচ্ছে এবং এ কাজগুলো দ্বারা মাটির বুনট ও সংযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে ভূমিগুলো প্রাকৃতিক শক্তি তথা বৃষ্টি ও বাতাসের নিকট উন্মোচিত হচ্ছে এবং ক্ষয় হচ্ছে।
পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয়:
আবার পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ বা ধাপ করে চাষ করা ভূমিক্ষয়ের আরেকটি কারণ।
অতিবৃষ্টির হলে সেখানকার মাটিতে পাহাড়ি ধস নামে, এতে বিপর্যয় আকারে ভূমিধস হয়।
কার্যশীল শক্তির প্রকার অনুযায়ী ভূমিক্ষয় প্রধানত ২ প্রকার যথা—
ক) বৃষ্টিজনিত ভূমিক্ষয় বা পানি ভূমিক্ষয়
খ) বায়ু ভূমিক্ষয়।
ক) বৃষ্টিজনিত ভূমিক্ষয় বা পানি ভূমিক্ষয়:
ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ হল বৃষ্টিপাত। অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক ভূমিক্ষয় হয়। এই ভূমিক্ষয়কে নিচের চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়;
(১) আস্তরণ ভূমিক্ষয়
(২) রিল ভূমিক্ষয়
(৩) নালা বা গালি ভূমিক্ষয়
(৪) নদী ভাঙন।
নিচে এই ভুমিক্ষয়গুলোর আলোচনা করা হলো:
১। আস্তরণ ভুমিক্ষয়:
যখন বৃষ্টির পানি বা সেচের পানি উঁচু স্থান থেকে ঢাল বেয়ে জমির উপর দিয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হয় তখন জমির উপরিস্তরের নরম ও উর্বর মাটির কণা কেটে পাতলা আবরণের বা আস্তরণের মতো চলে যায়। একেই আস্তরণ ভুমিক্ষয় বলে। বৃষ্টির ফলে যে ভুমিক্ষয় হয় তা সহজে উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু কয়েক বছর পর বোঝা যায় যে জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে। আর এর কারণ হলো আস্তরণ ভূমিক্ষয়।
২। রিল ভূমিক্ষয়:
আস্তরণ ভূমিক্ষয়ের দ্বিতীয় ধাপ হল রিল ভূমিক্ষয়। অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে বেশি পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে জমির ঢাল বরাবর লম্বাকৃতির রেখা সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই ছোট ছোট রেখা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বড় হতে থাকে। এর ফলে উর্বর মাটি জমি থেকে হারিয়ে যায় এবং জমি উর্বরতা হারায়। রিল ভূমিক্ষয়ের কারণে কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারেও অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
৩। নালা বা গালি ভূমিক্ষয়:
আস্তরণ ভূমিক্ষয়ের তৃতীয় ধাপ হল নালা বা গালি ভূমিক্ষয়। অর্থাৎ রিল ভূমিক্ষয় থেকেই নালা বা গালি ভূমিক্ষয়ের সৃষ্টি। অনবরত রিল ভূমিক্ষয়ের ফলে এর ছোট ছোট নালাগুলো দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর উপরিস্তরের ফসলের মাটি আরও বেশি ক্ষয় হতে থাকে। কালের পরিক্রমায় এগুলো নর্দমা বা ছোট নদীর মতো দেখায়। যত বেশি বৃষ্টিপাত হবে, তত বেশি নালা বা গালি ভূমিক্ষয় হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে গালি ভূমিক্ষয় এরূপ ভূমিক্ষয় দেখা যায়।
৪। নদীভাঙন:
বাংলাদেশের ভূমিক্ষয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ নদী ভাঙন। নদী বিধিত অঞ্চলে যেমন লক্ষীপুর, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, গোয়ালন্দ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রতি বৎসরই নদীভাঙনে শত শত হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। বর্ষার শুরুতে কিংবা বর্ষার শেষে নদীতে প্রবল ে¯্রাত সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে নদীতীরের কৃষিজমি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়।
খ) বায়ু ভূমিক্ষয়:
গতিশীল বায়ু প্রবাহের ফলে এক স্থানের মাটি অন্য স্থানের বয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াকে বাত্যজনিত বা বায়ু ভূমিক্ষয় বলে। সমতল ভূমিতে তুলনামূলকভাবে গাছপালা কম আছে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম হয় এমন অঞ্চলে বাত্যাজনিত কারণে ভূমিক্ষয়ের প্রকোপ দেখা যায়। প্রবল বেগে বায়ুবাহিত হলে বেলে ও বেলে দোঅঁাশ মাটি সহজেই উড়ে যায়।
আর যে স্থানে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ একেবারেই কম সে স্থানের বাত্যজানিত ভূমিক্ষয় আরও বেশি। মরুভূমিতে বায়ু ভূমিক্ষয়ের প্রভাব লক্ষণীয়। বায়ুপ্রবাহ উর্বর অঞ্চলে বালি নিক্ষেপ করে অনুর্বর করে তোলে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাসমুহ যেমন, দিনাজপুর, রাজশাহী অঞ্চলে চৈত্র—বৈশাখ মাসে কিছুটা বায়ুজনিত ভুমিক্ষয়ের প্রকোপ দেখা যায়। এর ফলে কৃষি জমির উর্বরতা কমে যায়। ভূমিক্ষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব:
১. মাটিতে জৈব পদার্থ ও অণুজীবের সংখ্যা কমে যায়।
২. ভূমির উর্বরতা বিনষ্ট হয়ে যায়।
৩. উদ্ভিদের আশ্রয়জনিত শক্তি কমে যায়।
৪. মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।
৫. মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলির নেতিবাচক পরিবর্তিত হয়ে যায়।
৬. ভূমিক্ষয়ের ফলে মাটি ধ্বসে নদীতে বাহিত হয়ে নদ—নদী ভরাট করে ফেলে।
৭. মাটি চাষাবাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
৮. মাটি তার সম্পূর্ণ প্রোফাইল ধরে রাখতে পারে না।
৯. মাটিতে ফুল ফল কিংবা শাকসবজি চাষাবাদ করা যায় না।
১০. স্রোতের প্রভাবে নদীর ভাংগন এলাকার কৃষি জমি বিনষ্ট করে।
১১. ভূমিক্ষয় ধুলি ঝড় সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ দূষিত করে এবং জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট করে।
ভূমিসংক্ষণের প্রয়োজনীয়তা:
১। মাটির উর্বরতা ধরে রাখা এবং জমি অবক্ষয় হতে বাঁচানো।
২। মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা।
৩। মাটিকে ফসল উৎপাদনের উপযোগী রাখা।
৪। নদী ভাঙন কিছুটা রোধ করে চাষযোগ্য জমি রক্ষা করা।
৫। নদ—নদী ও খাল—বিল ভরাট হতে না দেয়া।
ভূমি সংরক্ষণের কার্যকরী উপায়:
১। শস্য পর্যায় অবলম্বন :
একই জমিতে বিভিন্ন ঋতুতে একই ফসল চাষ না করে ভিন্ন ভিন্ন ফসল উৎপাদনকে শস্য পর্যায় বলে। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল যেমন গভীর, মধ্যম গভীর ও কম গভীর মূল বিস্তারকারী ফসল, সবুজ সার ফসল, লিগিউম ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করার ফলে মাটির বিভিন্ন অঞ্চলের খাদ্যোপাদান উদ্ভিদ কর্তৃক সমভাবে গৃহিত হয় এবং জৈব সার ও মাটিতে যুক্ত হয়। এতে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা ঠিক থাকে।
২। ফসল ব্যবস্থাপনা :
ভূমির ধরণ অনুযায়ী ফসল নির্বাচন, প্রয়োজনীয় পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা ফসলের আন্তঃপরিচর্যা, সঠিক সময়ে ফসল রোপন ও কর্তন ইত্যাদি ফসল ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত যা মাটি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩। মাটি ব্যবস্থাপনা :
মাটি ব্যবস্থাপনা বলতে সঠিক উপায়ে ও প্রয়োজনমত মাটি কর্ষণ, চাষ পদ্ধতি, মাটিতে সার ও চুন প্রয়োগ, জৈব সার প্রয়োগ, পানি সেচ ও নিকাশ ইত্যাদিকে বোঝায়।
৪। মালচিং :
লতাপাতা, খড়, কচুরিপানা বা ফসলের অবশিষ্টাংশ দিয়ে মাটি ঢেকে রাখাকে মালচিং বলে। মালচিং প্রয়োগ করে মাটির রস ধরে রাখা যায় এবং বৃষ্টির পানি ও বায়ু প্রবাহ থেকে মাটিকে সংরক্ষণ করা যায়।
৫। বনায়ন :
পরিত্যক্ত জমি, উপকূলীয় অঞ্চল ও অন্যান্য পতিত জমিতে বৃক্ষরোপন এবং বনায়ন সৃষ্টি করে ভূমিকে সংরক্ষণ করা যায়।
সারাংশ
মাটি হচ্ছে প্রকৃতির অবারিত দান। প্রকৃতির সেই দানকে আমাদের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতার কারণে নষ্ট করে ফেলছি। পরিবেশের অন্যতম উপাদান ভূমিক্ষয় রোধ করতে হলে আমাদের চাষের ধরণ পরিবর্তন করতে হবে, বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে এবং সর্বোপরি জমিকে বিশ্রাম দিতে হবে।
মাটির ক্ষারত্ব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়” এর “স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট” এর “বিএজেড” স্তরের “বাউবি বিএই ১২০৪ – মৃত্তিকা বিজ্ঞান” এর পাঠ – ২.২। মৃত্তিকাক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা আমরা পূর্বের পাঠ থেকে জানতে পেরেছি কোন মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের (H+) পরিমাণ বেশি হলে তাকে অম্লীয় মৃত্তিকা বলে। কোন মৃত্তিকা দ্রবণে যদি হাইড্রোক্সিল আয়নের (OH-) গাঢ়ত্ব বেশি হয় তাকে ক্ষারীয় মৃত্তিকা বলে।
মাটির ক্ষারত্ব
ক্ষারীয় মৃত্তিকার পিএইচ (pH) মান সবসময় ৭ এর চেয়ে বেশি। ক্ষার জাতীয় লবণ যেমন সোডিয়াম কার্বনেট, ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট ও পটাসিয়াম কার্বনের হাইড্রোক্সিল আয়নের সাথে একত্রিত হয়ে ক্ষারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। মৃত্তিকা লবণাক্ততা হচ্ছে যখন মত্তিকা দ্রবূ ণে দ্রবণীয় লবণের পরিমাণ বিশেষ করে সোডিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যায় তাকে লৰণাক্ত মত্তিকা বুঝায় ।
অর্থাৎ যে মৃত্তিকা সোডিয়াম লবণের তড়িৎ বিশ্লেষণের ফলে উৎপন্ন হয় তাকে লবণাক্ত মৃত্তিকা বলে।
ক্ষারীয় মাটি সংশোধন নিম্নলিখিত উপায়ে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা যেতে পারে:
১। জিপসাম প্রয়োগ করে :
জিপসাম হল ক্যালসিয়াম ও সালফার সমৃদ্ধ রাসায়নিক সার। এটি প্রয়োগ করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা যায়। মাটির ক্ষারত্বের প্রধান কারণ হল সোডিয়াম (Nat) আয়নের আধিক্য। জিপসামের ক্যালসিয়াম আয়ন (Cat) মাটির কলয়েড থেকে সোডিয়াম আয়নকে অপসারিত করে এবং সোডিয়াম আয়ন দ্রবণে চলে এসে সোডিয়াম সালফেট (Na2SO4) নামক যৌগ উৎপন্ন করে। এ যৌগটি পানিতে দ্রবীভূত হয়ে লিচিং এর মাধ্যমে জমির ক্ষারত্ব কমায়। Na+ + CaSO4 Ca+ + Na2SO4
২। সালফার বা গন্ধক ব্যবহার করে :
জমিতে সালফার (S) ব্যবহার করলে তা মাটিস্থ বায়ু দ্বারা জারিত হয়ে এবং পানির সাথে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক এসিড (H2SO4) তৈরি করে। সালফিউরিক এসিড সোডিয়াম যৌগের সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম সালফেট (Na2SO4) তৈরি করে এবং মাটি থেকে লিচিং হয়ে ক্ষারত্ব কমায়।
S+O2 [ SO2 | SO2 + H 2 O + H 2 SO 4
H2SO4 +Na2CO3 Na2SO4 + H2O+ CO2
৩। জৈব সার ব্যবহার করে :
জমিতে পরিমাণমত জৈব সার যেমন- বায়োফার্টিলাইজার অনুজীব সার, ট্রাইকোডার্মা, বায়োপেস্টিসাইড, সবুজ সার, কম্পোস্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে মাটির ক্ষারত্ব কমানো যায়। বিভিন্ন অনুজীবসার যেমন রাইজোবিয়াম, মাইকোরোইজা, ট্রাইকোডার্মা, ফসফেট ব্যকটেরিয়া ইত্যাদি প্রয়োগ করলে জৈব পদার্থের বিয়োজনে জৈব এসিড উৎপন্ন হয় যা মাটির সোডিয়াম আয়নকে অপসারিত করে দ্রবণে নিয়ে আসে। ফলে মাটির ক্ষারত্ব দূর হয়।
৪। সেচ ও নিকাশ :
মাটির ক্ষারত্ব কমানোর জন্য মাটি থেকে লবণ সরিয়ে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন লবণমুক্ত পানি সেচ এবং নিষ্কাশন। এ পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণ পানি দিয়ে জমিকে প্লাবিত করা হয়। এতে জমির ক্ষারীয় লবণ পানির সাথে দ্রবীভূত হয়। পরে পানি নিষ্কাশন করলে মাটির ক্ষারত্ব কমে।
৫। সহনশীল ফসলের চাষ :
যেসব জমিকে ক্ষারমুক্ত করা যায় না, সেখানে ক্ষার সহনশীল ফসলের চাষ করেও মাটির ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্ষার সহনশীল উদ্ভিদ হলো-সুগার বীট, খেজুর, নারিকেল, গাজর, বার্লি, টমেটো, তুলা, ধান, গম, ভুট্টা, ইত্যাদি।
ক্ষারীয় মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য :
১. পিএইচ (pH) মান ৮.৫-১০।
২. বিনিময়যোগ্য সোডিয়ামের পরিমাণ ১৫% এর বেশি থাকে।
৩. জৈব পদার্থ পরিমাণে কম থাকে।
৪. শুকনো মৌসুমে মাটির উপরের আবরনে কালো চাপ বাঁধা স্তর দেখা যায়। এজন্য একে কালো ক্ষার বলে ।
৫. বার্লি, খেজুর-বাবলা বিশেষ করে যে সকল ফসল লবণ সহ্য করতে পারে সেসব ফসল ভালো জন্মে।
৬. সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, কিন্তু দ্রবণীয় লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ কম থাকে।
লবণাক্ত মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য:
১. পিএইচ (pH) মান ৭-৮.৫।
২. শুকনো মৌসুমে মৃত্তিকার উপরের আবরনে সাদা চাপা বাধা স্তর দেখা যায়। এজন্য একে সাদা ক্ষার বলে।
মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততার কারণ মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তবে ক্ষারত্বের ও লবণাক্ততা প্রায় একটি কারণে হয়ে থাকে। কেননা মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি হলে মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণসমূহ নিম্নরূপ:
১. লোনা পানিতে লবণের পরিমাণ এবং সোডিয়াম কার্বনেটের পরিমাণ খুব বেশি থাকে। সমুদ্রের লোনা পানি দিয়ে জমি নিয়মিত প্লাবিত হলে সে জমির লবণাক্ততা বেড়ে যায় যার ফলে মাটি ক্ষারীয় হয়।
২. ক্ষারীয় শিলার চূর্ণবিচুর্নের ফলে মৃত্তিকা ক্ষারীয় হয়। ক্ষারীয় শিলা হতে গঠিত মৃত্তিকা ক্ষারীয় বিক্রিয়া প্রদর্শন করে। উদহারণস্বরূপ ডলোমাইট চুন, চুনাপাথর কুইকলাইম হতে গঠিত মৃত্তিকায় চুনের আধিক্য বেশি থাকে।
৩. অধিক লবণযুক্ত পানি দিয়ে ক্রমাগত জমিতে সেচ দিলে সে মাটির লবণাক্ততা ও ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
৪. অবিরাম ঘেরে চিংড়ি মাছ চাষের ফলে সে জমির মাটিতে ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
৫. জলবায়ুর প্রভাবে শুস্ক ও অবশুস্ক এলাকায় বৃষ্টিপাত খুব কম হয় বলে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আয়নের চুয়ানি অনেকাংশে কমে যায় যার ফলে মৃত্তিকার উপরের স্তরে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে এবং ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
ক্ষারীয় ও লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদনে বাধাসমূহ :
শুকনো মৌসুমে মানসম্পন্ন পানির অভাব দেখা দেয়।
লবণের গাঢ়তা বা ক্ষারের আধিপত্য বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বিনষ্ট করে দেয়।
গাছপালার সুষম বৃদ্ধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি দেয়।
লবণের বা ক্ষারের তীব্রতায় শিকড়ের বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয় এমনকি চারাগাছ মরে যায়।
সোডিয়ামের প্রাচুর্যে মাটিতে বিষাক্ততা দেখা যায়।
ক্ষারের তীব্রতা সহ্য করতে না পারায় গাছের পাতা পুড়ে যায়।
পানি নিস্কাশনের অভাবে সারা বছর জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।
নিষ্কাশন বিলম্বিত হওয়ায় রবি শস্য চাষাবাদ ব্যাহত হয়।
ক্ষার মাটি পুনরুদ্ধার পদ্ধতি :
ক্ষার মাটিতে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার সম্ভব যথাঃ
জল নিস্কাশন
লোনা পানির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাধ ও সুইচ গেট নির্মাণ করা ।
সোডিয়ামের পরিমাণ কমানোর জন্য ক্যালসিয়াম সালফেট বা জিপসাম প্রয়োগ করা।
সেচ দিয়ে প্লাবিত করা
উপরে মাটি চাচিয়া পরিস্কার করা
বাস্পায়ন কমাবার ব্যবস্থা করা, যেমন ঃ মালচিং প্রয়োগ করা।
সেচ খাল ও নালা পাকা করা
পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব ও সবুজ সার প্রয়োগ
অন্য স্থান থেকে উবর্র মাটি আনয়ন করে তা ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
গভীর সেচ ও স্বাদু পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে
লবণ ও ক্ষার সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করতে হবে।
উপযুক্ত চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
মৃত্তিকা অম্লত্ব ও মৃত্তিকা ক্ষারত্বের মধ্যে পার্থক্য :
সারাংশ :
মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম। মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনা ও শস্য বিন্যাসে। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিলুপ্তের পথে রয়েছে কয়েক’শ প্রজাতির শস্য। কৃষি অলাভজনক হওয়ায় কৃষকরা লবণাক্ত মাটিতে আবাদ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা দূর করতে হবে।
মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আজকের আলোচনা। মৃত্তিকা একটি প্রাকৃতিক বস্তু। এটি মানুষ ও জীবজগতের খাদ্য উৎপাদনের উৎস এবং বিচরণ ক্ষেত্র৷ বিরাট মহীরুহ থেকে শুরু করে আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদ এই মৃত্তিকায় লালিত ও পালিত হয়। সকল জীবের অস্তিত্বের জন্য মৃত্তিকা অপরিহার্য হলেও মৃত্যুর পর সকল জীবই মৃত্তিকায় মিশে যায়।
মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা
মৃত্তিকা কী?
মৃত্তিকা একটি প্রকৃতিজাত বস্তু (Natural body)। আজ আমরা মৃত্তিকাকে যেভাবে দেখতে পাচ্ছি তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। লক্ষ লক্ষ বৎসরের আবর্তে পৃথিবীর উপরিভাগের কঠিন শিলা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বিভিন্ন জীবজন্তু ও উদ্ভিদের দেহাবশেষের সাথে মিশে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্তিকা একটি মিশ্র পদার্থ। ইহা মৌলিক বা যৌগিক পদার্থ নয় কারণ এর কোন সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন নেই। মৃত্তিকা সৃষ্টির পর থেকে সর্বদাই এটি পরিবর্তিত হচ্ছে।
মানুষের কার্যক্রম, বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির ক্রিয়া এবং বিভিন্ন জীবজন্তুর দেহাবশেষের মিশ্রণের ফলে মৃত্তিকা দিন দিন তার বৈশিষ্ট্য বদলাচ্ছে। মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী উৎস শিলার বৈশিষ্ট্য, জলাবায়ু, মানুষের কার্যক্রম, জীব বৈচিত্র্য ইত্যাদি মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী উপাদান। এসকল উপাদানের তারতম্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যও বিভিন্ন হয়ে থাকে।
বৈশিষ্ট্যগত তারতম্য যাই থাকুক না কেন, সকল এলাকার মৃত্তিকা চারটি উপাদানে গঠিত। এ চারটি উপাদান হলো খনিজ দ্রব্য, পানি, বায়ু ও জৈব পদার্থ। খনিজ দ্রব্য মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী কঠিন শিলা থেকে, জৈব পদার্থ জীবের মৃতদেহের মিশ্রণ থেকে আর পানি বারিপাত (Precipitation) থেকে এবং বায়ু প্রাকৃতিক বায়ুমন্ডল থেকে এসেছে। এ চারটি উপাদান কোন নির্দিষ্ট অনুপাতে মাটিতে থাকে না। বিভিন্ন স্থানের মৃত্তিকায় এদের অনুপাতে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। সেজন্য মাটিকে মিশ্র পদার্থ বলা হয়।
মৃত্তিকার সংজ্ঞা (Definition of Soil):
বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার দ্রুত উন্নতির সাথে সাথে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের উন্নতিও এগিয়ে চলছে। গবেষণার ফলে মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের ধ্যান ধারণা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন রহস্য। ফলে মৃত্তিকার সংজ্ঞাও দিন দিন পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হচ্ছে। নিচে বিভিন্ন মৃত্তিকা বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্তিকার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো।
১। মৃত্তিকা হলো একটি রাসায়নিক গবেষণাগার যেখানে বিভিন্ন রাসায়নিক বিয়োজন (Chemical Decomposition) এবং সংশ্লেষণ বিক্রিয়া সংগোপনে (Hidden manner) ঘটে থাকে (Berzilius JJ, Sweden ) |
২। মাটি হলো খাদ্য তৈরির কারখানা (Davy, UK )
৩। মৃত্তিকা হলো পৃথিবীর উপরের স্তর যা শিলা ক্ষয়ের ( Weathering) মাধ্যমে গঠিত এবং উদ্ভিদের অবলম্বন (Support) ও পুষ্টির উৎস হিসেবে কাজ করে (Schubler, Germany)।
8। মৃত্তিকা হলো বিচূর্ণ কঠিন কণা, বায়ু এবং পানির মিশ্রণ যা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য সহজলভ্য খাদ্যোপাদানের বাহক হিসেবে কাজ করে (Mitscherlich A, Germany)।
৫। মৃত্তিকা খনিজ ও জৈবিক উপাদানে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক বস্তু যা বিভিন্ন গভীরতাবিশিষ্ট স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং আঙ্গিক (Morphology), ভৌত গঠন, রাসায়নিক ধর্ম ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র (Joffe, USA)। সংজ্ঞাটি ইংরেজি পরিভাষায় এরূপ – The soil is a natural body of mineral and organic constituent differentiated into horizons of variable depths, which differs from the material below in morphology, physical make-up, chemical properties and biological characteristics এ সংজ্ঞাটি যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত।
৬। কৃষিতাত্ত্বিক (Agronomic) বিবেচনায় বিজ্ঞানী হিলগার্ডের সংজ্ঞাটি গুরুত্বপূর্ণ। সংজ্ঞাটি হলো মৃত্তিকা হলো কম বেশি আলাদা এবং ঝুর ঝুরে পদার্থ যেখানে উদ্ভিদ শিকড় প্রবেশ করিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এবং পুষ্টিসহ বৃদ্ধির অন্যানা শর্তসমূহ পেয়ে থাকে। ইংরেজি পরিভাষায় সংজ্ঞাটি এরূপ- Soil may be defined as the more or less loose and friable material in which by means of their roots, plants may or do find a foot-hold and nurishment, as well as other conditions of growth.
৭। আমেরিকান মৃত্তিকা বিজ্ঞান সমিতি মৃত্তিকার একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। সংজ্ঞাটি হলোঃ মৃত্তিকা হলো কতকগুলি প্রাকৃতিক বস্তুর সমষ্টি যা পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে উদ্ভিদের বিভিন্ন রকম সহায়তা প্রদান করে এবং সময়ের পরিবর্তনে উৎস দ্রব্যের উপর সজীব বস্তু ও জলবায়ুর ক্রিয়ায় বন্ধুরতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু ধর্মাবলী প্রাপ্ত হয়। এটি ইংরেজি পরিভাষায় এরূপ- Soil is a collection of natural bodies occupying portion of earth surface that support plants and have definite properties due to the integrated affect of climate and living matter acting upon parent material as conditioned by relief over period of time.
৮। খনিজ মৃত্তিকার সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে বিজ্ঞানী Nyle C. Brady’র সংজ্ঞাটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ক্ষয়ীভূত খনিজ এবং পচনরত জৈব দ্রব্যের চল মিশ্রণ থেকে পার্শ্বচিত্রের আকারে সংশ্লেষিত নানা প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ, যা ভূ-পৃষ্ঠকে একটি পাতলা আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত করেছে এবং উদ্ভিদকে দৈহিকভাবে ধারণ ও উপস্থিতিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি, বায়ু এবং পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে তাকে মৃত্তিকা বলে।
উল্লিখিত সংজ্ঞাগুলো থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে মৃত্তিকাকে নির্ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করা বেশ দূরহ। প্রকৃতপক্ষে আধুনিককালে মৃত্তিকার উৎপত্তি, গঠন, প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন ধ্যান ধারণার আবিষ্কারের ফলে মৃত্তিকার সংজ্ঞাতেও পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। যাহোক, উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
মৃত্তিকা সৃষ্টি হলো যেভাবে:
পৃথিবীর বুকে মৃত্তিকা সৃষ্টি এক অনন্য রহস্য। বিজ্ঞানীদের মতে, সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী উত্তপ্ত গলিত পদার্থে পূর্ণ ছিল। ক্রমান্বয়ে তা ঠান্ডা হয়ে কঠিন শিলা বা প্রস্তর খন্ড সৃষ্টি হয়। লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে তাপমাত্রা, শৈত্য, বায়ুপ্রবাহ, অন্যান্য ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ঐ সমস্ত শিলাখন্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।। এসব চূর্ণ-বিচূর্ণ পদার্থই মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রথম ও প্রধান উপাদান। মৃত্তিকা সৃষ্টিকারী এসব পদার্থকে উৎস বস্তু (Parent material) বা উৎস শিলা (Parent rock) বলা হয়। এভাবে উৎস শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বিভিন্ন নতুন নতুন খনিজ পদার্থের সৃষ্টি হয়।
শিলাচূর্ণ থেকে খনিজ পদার্থ সৃষ্টি চলতে চলতে এক পর্যায়ে তাতে প্রাণের সঞ্চার হয়। আর তখন থেকেই মৃত্তিকা সৃষ্টির দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। তাতে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধি ও উন্নয়ন চলতে থাকে। চূর্ণ বিচূর্ণ শিলা ও খনিজের উপর তাদের কার্যকলাপের ফলে শিলা ও খনিজের ক্ষয় দ্রুত চলতে থাকে। অপরপক্ষে, উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহাবশেষের মিশ্রণের ফলে শিলা ও খনিজ পদার্থ থেকে উন্নত মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকা সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে দিন দিন এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন চলতে থাকে।
সে জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্যে এত বৈচিত্র্য! মৃত্তিকা সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়ায় প্রভাবকারী বিভিন্ন উপাদান এবং এদের প্রভাব সম্পর্কে পরবর্তি পাঠে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্তিকা গঠনকারী এসব উপাদানের প্রভাব সম্পর্কে জানলে মৃত্তিকা সৃষ্টির রহস্য আরও সহজভাবে বোধগমা হবে।
সূত্র:
মৃত্তিকা সম্পর্কে ধারণা , পাঠ ১.১, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
২০। গভীর ধূসর সোপান মাটি (Deep Grey Terrace Soils)৬
মানচিত্র, নির্দেশিত শ্রেণিসমূহ, প্রয়োজনীয় উপকরণ, কাজের ধাপ বা অংকন এবং সাবধানতা আপনার ব্যবহারিক খাতায় তুলে নিন। সময়মত তা টিউটরকে দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিন।
সূত্র:
মানচিত্রে বাংলাদেশের মৃত্তিকা শ্রেণি প্রদর্শন ব্যবহারিক, পাঠ ৫.৬, ইউনিট ৫ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি
কৃষি, কৃষি শিক্ষা, কৃষি প্রশিক্ষণ, কৃষি শিল্প, কৃষি গবেষণা