কৃষি ঋণ ও সমবায়

এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ইউনিট ১৮, পাঠ ১৮.১-এর অন্তর্ভুক্ত। কৃষি ঋণ বলতে কৃষকরা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন অধিক উৎপাদনশীল বীজ, সার, বালাইনাশক ইত্যাদি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উৎস থেকে শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য গ্রহণ করা অর্থকে বোঝানো হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, কৃষি ঋণ হলো কৃষক কর্তৃক কৃষি সম্পর্কিত উপাদান ও প্রযুক্তি ক্রয়ের জন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে নেওয়া ঋণ।

কৃষি ঋণ ও সমবায়

কৃষি ঋণের প্রয়োজন কেবলমাত্র বীজ-সার কেনার জন্য সীমাবদ্ধ নয়; এটি কৃষি ভূমির উন্নয়ন, ফসলের সঠিক সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণসহ কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ, কৃষকরা উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সমর্থ হতে এই ঋণের উপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের কৃষকরা অধিকাংশই আর্থিকভাবে দুর্বল। ফলে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ থেকে উৎপাদনের প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে পারেন না। এজন্য তারা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। তবে দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের উৎসগুলো সাধারণত অসংগঠিত, অনিশ্চিত এবং অত্যন্ত শোষণমূলক হওয়ায় কৃষকদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে। এজন্য কৃষকরা বাধ্য হয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ উৎসের দিকে আকৃষ্ট হন, যেখানে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা হয়।

 

কৃষি ঋণের প্রাতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ

উৎসের ধরন উদাহরণ ভূমিকা বৈশিষ্ট্য
দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক উৎস সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক, সমবায় সমিতি, অনুমোদিত এনজিও কৃষকদেরকে সাশ্রয়ী শর্তে ঋণ প্রদান, আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়া।
বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক উৎস বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কৃষি উন্নয়নে প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান, দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের জন্য ঋণ ও অনুদান দেয়।

প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকরা সুষ্ঠু ও সময়মত অর্থসাহায্য পেয়ে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। এছাড়া, এসব প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রবর্তনেও ভূমিকা রাখে, যা কৃষি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এইভাবে, কৃষি ঋণ কৃষকের জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর এক অপরিহার্য হাতিয়ার। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে কৃষি ঋণের সঠিক ব্যবহার এবং বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষকদের আধুনিক ও কার্যকর কৃষি পদ্ধতি অনুসরণে সহায়তা করা এবং ঋণের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের কৃষি খাতকে শক্তিশালী করার অন্যতম পথ।

 

কৃষি ঋণের ধরণ:

কৃষি উৎপাদন একটি ধারাবাহিক এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। জমি চাষের শুরু থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ, ফসলের সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কৃষকের অর্থের প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসল নষ্ট হলে জীবন ধারনের জন্যও কৃষককে ঋণ নিতে হতে পারে। যাইহোক, কৃষক যেকোনো উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করুক না কেন, সময়ের ভিত্তিতে কৃষি ঋণ প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত হয়—

  • ক) স্বল্পমেয়াদি
  • খ) মধ্যমেয়াদি
  • গ) দীর্ঘমেয়াদি

নিচে এই তিন ধরণের ঋণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদান করা হলো—

ক) স্বল্পমেয়াদি কৃষি ঋণ

স্বল্পমেয়াদি ঋণ বলতে সাধারণত এক বছরের বা বারোমাস পর্যন্ত সময়সীমার ঋণ বোঝায়। এ ধরনের ঋণ কৃষকের দৈনন্দিন উৎপাদন কর্মকাণ্ড ও ছোটখাটো খরচের জন্য প্রয়োজন হয়। প্রধানত নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যে এই ঋণ গ্রহণ করা হয়:

১. সাময়িক ঋণ: প্রধানত ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অথবা ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ যেমন বীজ, সার, কীটনাশক, বালাইনাশক ক্রয়ের জন্য এ ঋণ প্রদান করা হয়।

২. উপকরণ সংগ্রহের ঋণ: কৃষি কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহে যেমন সার, বীজ, কীটনাশক, আগাছানাশক ইত্যাদি কেনার জন্য স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়া হয়।

৩. অন্যান্য কৃষিকাজের ঋণ: চাষাবাদ ছাড়াও মৎস্যচাষ, হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন ইত্যাদি কৃষি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমের জন্যও স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করা হয়।

খ) মধ্যমেয়াদি কৃষি ঋণ

মধ্যমেয়াদি ঋণ সাধারণত এক বছর থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিশোধের জন্য হয়। এ ধরনের ঋণ কৃষকের উন্নত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় ও ব্যবহারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর কিছু ব্যবহারের ক্ষেত্র হলো:

১. কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়: লাঙ্গল, ট্রাক্টর, পাওয়ারট্রিলার, গরু-মহিষ ইত্যাদি কেনার জন্য এই ঋণ গ্রহণ করা হয়।

২. কৃষি যান্ত্রিকীকরণ: ভূমি কর্ষণ যন্ত্র ছাড়াও শস্য মাড়াই যন্ত্র, গভীর নলকূপ ইত্যাদি ক্রয় ও স্থাপনের জন্য মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবহার করা হয়।

৩. পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন: কৃষি উপকরণ এবং উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্য ছোট ট্রাক, অটোরিক্সা, ভ্যানগাড়ি ইত্যাদি যানবাহন ক্রয়ের জন্য এ ঋণ প্রদান করা হয়।

গ) দীর্ঘমেয়াদি কৃষি ঋণ

দীর্ঘমেয়াদি ঋণ হলো পাঁচ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে পরিশোধযোগ্য ঋণ, যা কৃষকের বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে:

  • জমির সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন
  • পানি নিষ্কাশনের সমস্যা সমাধান
  • ভূমি উন্নয়ন
  • কৃষি খামারের অবকাঠামো নির্মাণ
  • অন্যান্য স্থায়ী উন্নয়নমূলক কাজ

দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং জমির স্থায়ী উন্নয়ন সাধিত হয়।

 

কৃষি ঋণের ধরণের তুলনামূলক সারাংশ
ঋণের ধরণ মেয়াদ প্রধান ব্যবহার ক্ষেত্র উদাহরণ
স্বল্পমেয়াদি ১ বছর বা তার কম ফসল উৎপাদন, সার-বীজ-কীটনাশক ক্রয়, ছোটখাটো কৃষিকাজ বীজ ক্রয়, সার সংগ্রহ, হাঁস-মুরগি পালন
মধ্যমেয়াদি ১ থেকে ৫ বছর কৃষি যন্ত্রপাতি, যান্ত্রিকীকরণ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ট্রাক্টর ক্রয়, নলকূপ স্থাপন
দীর্ঘমেয়াদি ৫ বছর বা তার বেশি সেচ ব্যবস্থা, অবকাঠামো নির্মাণ, ভূমি উন্নয়ন সেচ পাম্প, খামারের স্থায়ী কাঠামো নির্মাণ

 

এই ধরণের ঋণগুলো কৃষকের বিভিন্ন সময়ের ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা করা হয়, যা কৃষি খাতের সুস্থ ও স্থায়ী উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ও কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

কৃষি ঋণের উৎসসমূহ:

বাংলাদেশের কৃষকেরা সাধারণত দুটি প্রধান উৎস থেকে কৃষি ঋণ গ্রহণ করেন— প্রতিষ্ঠানিক এবং অপ্রতিষ্ঠানিক। নিচে এই উৎসগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করা হলো।

ক) প্রতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ

কৃষি ঋণ সরবরাহে প্রতিষ্ঠানিক উৎসগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি কৃষকদের ঋণ প্রদান না করলেও, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণ প্রদানকারী সংস্থাকে অল্প সুদে ঋণ প্রদান করে কৃষি ঋণ বিতরণের সহায়তা করে থাকে। বাংলাদেশের ‘কৃষি ঋণ বিভাগ’ এবং ‘কৃষি ঋণ স্থিতিশীলকরণ বিভাগ’ এ কাজে নিয়োজিত।

২. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
দেশব্যাপী ছয়শোরও অধিক শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সরাসরি কৃষকদের বিভিন্ন মেয়াদের কৃষি ঋণ প্রদান করে থাকে।

৩. গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামীণ ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হলেও বিশেষভাবে পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঋণ প্রদান করে থাকে।

৪. কর্মসংস্থান ব্যাংক
দেশব্যাপী কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

৫. সমবায় ব্যাংক
বিভিন্ন ধরণের সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষি ঋণ সরবরাহ করে থাকে।

৬. বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)
বিআরডিবির প্রধান কাজ হলো গ্রামীণ সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা। তারা উপজেলা/থানা পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি গঠন করে কৃষকদের মূলধন গড়ে তোলার জন্য শেয়ার ক্রয় এবং ক্ষুদ্র সঞ্চয় সুবিধা প্রদান করে। পাশাপাশি, সমবায় কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করাও তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ।

 

খ) অপ্রতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ

অপ্রতিষ্ঠানিক উৎসসমূহ কৃষকদের জন্য ঋণের সহজলভ্যতা এবং দ্রুততর সেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এ উৎসগুলোতে ঋণের শর্তকাঠিন্য, উচ্চ সুদহার ও অনিশ্চয়তা বেশি থাকে। প্রধান অপ্রতিষ্ঠানিক উৎসগুলো হলো:

১. আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব
ঋণের সহজলভ্যতা ও সাধারণত সুদবিহীন হওয়ার কারণে কৃষকরা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। যদিও এটি অনেক সময় সীমিত পরিমাণে ও সকলের জন্য সম্ভব হয় না।

২. গ্রাম্য মহাজন ব্যবসায়ী
অতিরিক্ত জরুরি অর্থের প্রয়োজনে কৃষকরা মহাজন ও গ্রাম্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নেন, যারা সাধারণত স্থাবর সম্পত্তি বা গহনা বন্ধক রেখে উচ্চ সুদে ঋণ প্রদান করে। এর ফলে কৃষকরা প্রায়ই শোষণের শিকার হন।

৩. দালাল ব্যাপারী
কৃষি পণ্যের বাজারে দালাল ও ব্যাপারীরা কৃষকদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকেন, তবে অত্যধিক সুদ ধার্য করেন। তারা কৃষকদের কাছ থেকে ফসল আগাম অল্পমূল্যে কিনে নেয়, ফলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

যদিও অপ্রতিষ্ঠানিক উৎসগুলো সহজ ও দ্রুত ঋণ দেয়ার সুবিধা প্রদান করে, তবুও উচ্চ সুদ ও শোষণমূলক শর্তের কারণে কৃষকদের জন্য প্রতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করাই অধিক উপকারী ও টেকসই পথ। সুতরাং, কৃষি উন্নয়নের জন্য ঋণ প্রাপ্তিতে প্রতিষ্ঠানিক উৎসের ভূমিকা বৃদ্ধি করা ও অপ্রতিষ্ঠানিক ঋণ ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক হ্রাস করা জরুরি।

 

কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তা :

বাংলাদেশের কৃষকগণ অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সঠিক সময়ে নিজস্ব উৎস থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হন না। এর ফলে কৃষি কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং ফসল উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ে। সুতরাং কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য। নিচে কৃষি ঋণের প্রধান প্রয়োজনীয়তাগুলো বর্ণনা করা হলো:

ক) কৃষি উপকরণ ক্রয় ও কৃষিকাজের জন্য ঋণ

কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং ফসল সংগ্রহ, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার জন্য ঋণের প্রয়োজন পড়ে। এসব কাজে পর্যাপ্ত তহবিল ছাড়া কার্যক্রম সচল রাখা সম্ভব নয়।

খ) ফসলের সুষ্ঠু বিপণন ও সংরক্ষণ

উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার জন্য ফসল গুদামজাতকরণ, পরিবহণ ও বাজারজাতকরণে যথাযথ বিনিয়োগ করতে হয়। এর জন্য কৃষকদের কৃষি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন প্রয়োজন।

গ) প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলার জন্য ঋণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঝড় ইত্যাদির কারণে ফসল নষ্ট হলে কৃষকদের দ্রুত পুনরুদ্ধার ও উৎপাদন পুনরায় শুরু করার জন্য ঋণ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ঘ) পারিবারিক ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য ঋণ

ফসল উৎপাদনের সময় কৃষকরা পরিবারের অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ঋণের সাহায্য নেন।

ঙ) ঋণ পরিশোধের জন্য সময়োপযোগী ঋণ ব্যবস্থা

কৃষকগণ উৎপাদন থেকে আয় পাওয়ার পর ঋণ পরিশোধ করে থাকেন, এজন্য ঋণের সময়সীমা ও শর্তাবলী কৃষকদের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন।

ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা :

ক্ষুদ্র ঋণ বাংলাদেশে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য একটি টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। কারণ এটি সেই সমস্ত মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যায়, যাদের কাছে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সেবা পৌছানো সম্ভব হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের উৎপাদনশীল খাতগুলোতে বিনিয়োগ এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে সহযোগিতা প্রদান করে থাকে।

প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থার তুলনায় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মূল পার্থক্য হলো এটি দরিদ্র মানুষের উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে সরাসরি সংযুক্তি ঘটিয়ে তৃণমূল অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনে। ক্ষুদ্র ঋণের ফলে গরীব জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয় এবং একটি সহনশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। যদিও এটি দারিদ্র বিমোচনের একমাত্র উপায় নয়, তবুও যথাযথ ব্যবহারে অনেক ঋণগ্রহীতা দারিদ্র চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৮৮ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে গ্রামীণ দারিদ্রতা প্রতি বছর প্রায় ১% হারে কমেছে। অনেকের নেতিবাচক অভিমতকে উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে নারীরা এখন আর্থিক স্বাধীনতা লাভ করছে এবং পরিবারে পুরুষ সদস্যদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতেও ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধাভোগী পরিবারে জন্মনিয়ন্ত্রণ, ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিশুপুষ্টির উন্নতি ঘটেছে। এ ছাড়াও শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০১৫ সালে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) জানিয়েছে, বাংলাদেশে সার্টিফাইড ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থার সংখ্যা ৬৫৯। এসব সংস্থাকে শাখার সংখ্যা ও কার্যক্রমের পরিধি অনুযায়ী ছোট, মাঝারি, বড় ও বৃহৎ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।

এমআরএ কর্তৃক ক্ষুদ্র ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ২৭% নির্ধারণ করলেও, পিকেএসএফ-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহ ২৫% এর বেশি সুদ নেয় না। বর্তমানে পিকেএসএফ-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ২২০, এবং বাকী ৪৩৯ টি সংস্থা সুদহার ২৭% হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে।

 

ক্ষুদ্র ঋণের ধরণ

ক্ষুদ্র ঋণ বলতে গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র শিল্প বা কুটির শিল্প স্থাপনের জন্য প্রদত্ত ঋণ বোঝানো হয়। এছাড়াও কৃষিকাজ, পশুপালন, মৎস্য চাষ, কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঋণ নেওয়া হয়। ক্ষুদ্র ঋণ সাধারণত বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়, যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলি অধিক সুদহার আরোপ করে থাকায় অনেক সময় মানুষের শোষণ ঘটে।

প্রাতিষ্ঠানিক উৎসগুলো এ ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি দেয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে সহায়তা করে। যদিও ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি, তার পেছনে কারণ হলো এ ঋণ কর্মসূচীগুলো স্বাস্থ্য বীমা, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ ইত্যাদি সেবামূলক কার্যক্রমের জন্য অর্থ সঞ্চয় করে রাখে। দেশে এখনও সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু না হওয়া এবং শিক্ষার সর্বস্তরের সুযোগ সবার জন্য না থাকায় ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমকে বিকল্প হিসেবে দেখা হয় না।

সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী zwar দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়ক হলেও ক্ষুদ্র ঋণের বিকল্প নয়। বরং মহাজনীর ঋণই ক্ষুদ্র ঋণের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়, যা সাধারণত উচ্চ সুদে গরীবদের শোষণ করে। মহাজনীরা ঋণ খেলাপির ক্ষেত্রে আগাম শ্রম বা ফসল বিক্রয়ের সুবিধা নিয়ে থাকে, যা ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের নিয়মিত সংস্থাগুলো থেকে আলাদা।

 

ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়ার শর্তসমূহ

ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পালন করতে হয়। সেগুলো হলো—

১. ঋণগ্রহীতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত হওয়া আবশ্যক।

২. ঋণগ্রহীতার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ থাকা চলবে না।

৩. ঋণগ্রহীতা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানিত হতে হবে।

৪. ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা থাকতে হবে।

৫. কোনো অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান করা হয় না।

৬. ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের শর্তাবলী মেনে চলার মানসিকতা রাখতে হবে।

৭. ঋণ গ্রহণযোগ্য প্রকল্পের জন্য আবেদন করতে হবে।

৮. যুব ঋণের ক্ষেত্রে আগ্রহীকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে।

 

ক্ষুদ্র ঋণ বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান অত্যাবশ্যক।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version