পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল

পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট – ৪, পাঠ-৪.২।

পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল

পিঁয়াজের বীজ উৎপাদন পিঁয়াজ একদিকে একটি মসলা এবং অপরদিকে একটি সবজিও বটে। পিঁয়াজের পাতা ও ডাঁটা ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। সাধারণত রবি মৌসুমে পিঁয়াজ চাষ করা হয়। এর জন্য উপযুর্ক্ত তাপমাত্রা হলো ১৫—২০০ সে.। গাছ বৃদ্ধির প্রথম দিকে তাপমাত্রা কম থাকা ভালো। কন্দের বৃদ্ধি ও পরিপক্কতা পর্যায়ে তাপমাত্রা কিছু বেশি এবং শুষ্ক বাতাস বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পিঁয়াজের ফুল ধারনের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা প্রয়োজন। পিঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য কন্দ বা বাল্ব উৎপাদন করা হয়। সাধারণত কন্দ থেকে উৎপাদিত পিঁয়াজ পরবর্তী বছর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালেও পিঁয়াজের আবাদ শুরু হয়েছে।

 

পিঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হল:

১। মাটি ও আবহাওয়া:

দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি পিঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। ১৫—২০০ সে. তাপমাত্রা পিঁয়াজ চাষের জন্য উপযোগী। মাটির অম্লমান ৬.৫—৭.৫ পিঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম।

২। জমি তৈরি:

গভীর চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। বড় ঢেলা ভেঙ্গে সমতল ও আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে যাতে পিঁয়াজের শিকড় ও কন্দের বৃদ্ধি ভাল হয়।

৩। বপন/রোপন পদ্ধতি ও সময়:

সরাসরি জমিতে বীজ বুনে, কন্দ ও চারা রোপন করে পিঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। বৃষ্টিপাতজনিত সমস্যা না থাকলে আগাম ফসলের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে কন্দ রোপন করা যায়।

 

৪। বীজের পরিমাণ:

কন্দের আকারভেদে হেক্টর প্রতি প্রায় ১.২—১.৫ টন কন্দের প্রয়োজন।

 

৫। সার প্রয়োগ:

বীজ পিঁয়াজের জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

 

ইউরিয়া ও এমওপি সারের অর্ধেকসহ অন্যান্য সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি সার কন্দ রোপনের ২৫—৫০ দিন পর দিতে হবে।

 

৬। কন্দ নির্বাচন ও রোপন:

প্রতি কেজিতে ৭০ থেকে ১০০ পেঁয়াজ ধরে এরূপ আকারের কন্দ বীজ পিঁয়াজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কন্দ থেকে কন্দের রোপন দূরত্ব হবে ১৫ সে.মি. এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সে.মি.।

 

৭। অন্তর্বতীকালীন পরিচর্যা:

পিঁয়াজের জমিতে মাটির প্রয়োজনীয় রস না থাকলে প্রতি ১০—১৫ দিন অন্তর পানি সেচ প্রয়োজন, পিঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং পিঁয়াজের জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখা বাঞ্চনীয়, এমনভাবে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে যাতে পিঁয়াজের শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

 

৮। পোকমাকড় দমন:

থ্রিপস ও জাব পোকা পিঁয়াজের পাতা ও কচি ডগার রস শুষে গাছের ক্ষতি করে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করে পোকা দমন করা যায়।

৯। রোগবালাই দমন:

পিঁয়াজের রোগের মধ্যে গোড়াপঁচা ও অলটারনারিয়া লিফ ব্লাইট (পার্পল ব্লচ) প্রধান। গোড়াপঁচা রোগে গাছের গোড়া পচে যায়। এক্ষেত্রে ডাইথেন এম—৪৫ ২০ গ্রাম/১০লিটার প্রতি হেক্টরে স্প্রে করে ভাল ফল পাওয়া যায়। অলটারনারিয়া লিফ ব্লাইট হলে পাতায় লালচে রং এর ঠোসা দেখা যায়। পরে পাতা কালো হয়ে পুড়ে যায়। এ রোগ দমনের জন্য রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি (২০ গ্রাম/ ১০ লিটার, প্রতি হেক্টরে) স্প্রে করতে হবে।

 

১০। রোগিং:

বীজ ক্ষেত থেকে রোগাক্রান্ত সন্দেহযুক্ত ও অন্য জাতের গাছ তুলে ফেলাকে রোগিং বলে। পিঁয়াজ বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুল আসার আগে, ফুল আসার সময় এবং ফল পরিপক্ক পর্যায়ে রোগিং করতে হয়।

 

১১। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

কন্দ রোপনের দুই থেকে আড়াই মাস পর পিঁয়াজ গাছে ফুল আসে এবং এর ৬—৭ সপ্তাহ পর ফল পাকতে শুরু করে। ফল পেকে শুকিয়ে গেলে এবং কালো রং ধারণ করলে তখন সেগুলোকে সংগ্রহ করতে হবে। একবারে সকল ফল পাকে না বিধায় ২—৩ বারে সংগ্রহ করতে হবে। ডাঁটার খানিক অংশ সহ ফলগুলো তুলে ভালো করে শুকিয়ে মাড়াই ও ঝাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এরপর বীজগুলো ভালভাবে শুকিয়ে বায়ুবন্ধ টিনে বা পলিথিন ব্যাগে ভরে শুকনা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।

 

১২। ফলন :

হেক্টরপ্রতি ফলন ৭০০—৮০০ কেজি হতে পারে।

সরিষা বীজ উৎপাদন সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তৈলবীজ ফসল। সরিষা বীজে ৪০—৪৪% তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০% আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। খৈল একটি উৎকৃষ্ট জৈব সার। বাংলাদেশে সাধারনত রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়।

 

 

উৎপাদন প্রযুক্তি:

১. জমি ও মাটি নির্বাচন:

উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু জমি যেখানে বৃষ্টি বা সেচের পানি জমে না অথবা বন্যার পানি আগাম সরে যায় সেখানে সরিষার আবাদ করা যায়। দেঁাআশ ও এঁটেল দেঁাআশ এবং বর্ষার পলি পড়ে এমন মাটি সরিষা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

 

২. জমি তৈরি:

জমি ৪—৫ বার ভাল করে চাষ ও মই দিতে হবে। এমনভাবে জমি সমতল করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যায়। মাটি অত্যন্ত মিহি হতে হবে কারণ সরিষা বীজ খুব ছোট।

 

৩. সার প্রয়োগ:

জাত, মাটি ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হবে। ইউরিয়া সার অর্ধেক ও অন্যান্য সমুদয় সার বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি প্রয়োগের জন্য মাটিতে রস থাকা দরকার।

 

৪. বীজ বপন পদ্ধতি:

অক্টোবর—নভেম্বর মাস সরিষার বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য অক্টোবর থেকে শেষ অক্টোবর এই সময়ের মধ্যে সরিষা বীজ বপন করা উত্তম। জাতভেদে বীজের হার ৭—৯ কেজি প্রতি হেক্টরে। সাধারণত সরিষা বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়। জমিতে সমভাবে ছিটানোর জন্য বীজের সাথে ছাই, বালি বা গুঁড়া মাটির যে কোন একটি মিশিয়ে বপন করা ভাল।

 

৫. আন্ত:পরিচর্যা:

জমিতে বীজ বপনের ১৫—২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে। জমিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে সেচ দিতে হবে বিশেষ করে উঁচু জমিতে ১—২ বার সেচ দেয়া প্রয়োজন। একবার সেচ দিলে সাধারণত বীজ বোনার ২৫—৩০ দিন পর (ফুল ফোটার শুরুতে) দিতে হবে। দু’বার সেচের প্রয়োজন হলে বীজ বোনার ২৫—৩০ দিন পর প্রথম এবং এবং ৪০—৬০ দিন পর (শুটি বৃদ্ধির সময়) দ্বিতীয় সেচ দেওয়া দরকার।

 

৬. পৃথকীকরণ দূরত্ব:

সরিষা পরপরাগায়নধর্মী ফসল হওয়ায় এর বীজ ফসলের মাঠ একই পরিবারভুক্ত অন্যান্য জাতের ফসল বা একই জাতের ফসলের মাঠ থেকে ১০০০ মিটার দূরে অবস্থিত হতে হবে। এতে করে জাতের বিশুদ্ধতা বজায় থাকবে।

 

 

৭. রোগবালাই দমন:

অলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট অলটারনারিয়া ব্লাইট বা পাতা ঝলসানো রোগ সরিষার অন্যতম মারাত্মক রোগ। এ রোগ হলে গাছের বয়স্ক পাতায় গাঢ় বাদামি দাগ দেখা যায়, পরে দাগ গাছের কান্ডে শুটি বা বীজে আক্রমণ করে, এ রোগ প্রতিরোধ করতে হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ও রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। আক্রান্ত সরিষা ক্ষেতে ২.৫ গ্রাম ক্যাপটেন বা ভিটাভেক্স—২০০ দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হয়। এ রোগের আক্রমণ বেশি হলে রোভরাল—৫০, ডাইথেন এম—৪৫ বা এ জাতীয় ঔষধ ২ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে ১২ দিন পর পর ৩বার স্প্রে করতে হবে।

 

৮. রোগিং:

সরিষা বীজ ফসলের জমিতে বেশ কয়েকবার রোগিং করতে হয়। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আগে ফুল আসা গাছ, হলুদ ফুলের মধ্যে সাদা ফুলযুক্ত গাছ, বিজাতীয় বা অন্য জাতের গাছ এবং স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা গাছ উঠিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে।

 

৯. পোকামাকড় দমন:

জাব পোকা সরিষা ক্ষেতে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। পূর্নবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই সরিষার পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল হতে রস হতে রস শোষণ করে। এ পোকার আক্রমণ হলে ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা জুলন ৩৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিমিটার হারে মিশেয়ে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক অবশ্যই বিকেলে স্প্রে করতে হবে। সকালের দিকে স্প্রে করলে মৌমাছির ক্ষতি হয়। মৌমাছি পরাগায়নের জন্য উপকারী।

 

১০. ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

বিভিন্ন জাতের সরিষা পাকতে বিভিন্ন সময় লাগে। সাধারণত টরি সরিষা পাকতে ৭০—৮০ দিন এবং অন্যান্য সরিষা পাকতে ৯০—১১০ দিন সময় লাগে। গাছের শতকরা ৭০—৮০ ভাগ শুটি পাকলে সকালের ঠান্ডা পরিবেশে গাছ কেটে মাড়াইয়ের স্থানে নিতে হবে। তারপর ২—৩ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দ্বারা পিটিয়ে মাড়াই করতে হয়। ফল অতিরিক্ত পাকলে মাঠে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মাড়াইয়ের পর বীজ ২/৩ দিন রোদে শুকিয়ে শুকনা বীজ যেকোন পরিষ্কার এবং শুকনো পাত্রে দুবছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

সারাংশ :

সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তৈলবীজ ফসল। রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচর্যার মাধ্যমে সরিষা বীজ উৎপাদন করলে রোগ মুক্ত ও অধিক ফসল পাওয়া যায়।

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version