Tag Archives: সমূহকৃষি উন্নয়ন

সমূহকৃষি উন্নয়ন

রাইজোবিয়াম, এ্যাজোলা ও ট্রাইকোডার্মা সার

রাইজোবিয়াম, এ্যাজোলা ও ট্রাইকোডার্মা সার – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি প্রযুক্তি” বিষয়ের ৮ নং ইউনিটের ৮.১ নং পাঠ।

রাইজোবিয়াম, এ্যাজোলা ও ট্রাইকোডার্মা সার

রাইজোবিয়াম:

১. রাইজোবিয়াম কি ?

রাইজোবিয়াম এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া শিম ও ডাল জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ের কাছে অবস্থান নিয়ে বায়ু থেকে নাইট্রোজেন গ্রহন করে শিকড়ে গুটি তৈরি করে। এ ব্যাকটেরিয়া বায়ুমন্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংযোজন করে নিজের প্রয়োজন মিটায় এবং উদ্ভিদে সরবরাহ করে।

শিম জাতীয় উদ্ভিদ যেমন— মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, সয়াবিন, চিনাবাদাম, ধইঞ্চা ইত্যাদি ফসলে ব্যাকটেরিয়া সার ব্যবহার করে উত্তম ফসল পাওয়া যায়। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী রাইজেবিয়াম অণুজীব সার ইউরিয়া সারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।

 

২. রাইজোবিয়াম অণুজীব সার তৈরীর পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলো:

১। রাইজোবিয়াম প্রজাতি নিবার্চন:

রাইজোরিয়াম প্রজাতি শিম জাতীয় উদ্ভিদের শিকড়ে নডিউল থেকে সরাসরি আলাদা করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করা হয়। সংগৃহীত রাইজোবিয়াম প্রজাতি কতোগুলো পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ করা হয়। এ কাজের জন্য প্রথমে বিভিন্ন মৃত্তিকায় সুপারিশকৃত উদ্ভিদকে কার্যকরী নডিউল তৈরী করতে সক্ষম হতে হবে। এছাড়া উক্ত উদ্ভিদটির অনুপস্থিতিতে প্রজাতির মাটিতে টিকে থেকে বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

 

২। আবাদ মাধ্যম:

রাইজোবিয়ামের বংশবৃদ্ধির জন্য সাধারণত দুই ধরনের আবাদ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। কঠিন মাধ্যম ও তরল মাধ্যম।

 

কঠিন মাধ্যম :

কঠিন আবাদ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে— পিটমাটি, কাঠের গুড়া ও ছাই। জীবাণু যাতে জীবাণুসারে দীর্ঘদিন টিকে থাকে, কার্যকর থাকে এবং ব্যবহারের সুবিধা বিবেচনায় আবাদ মাধ্যমের যাথেষ্ট পানি ধারণক্ষমতা ও প্রচুর কার্বন থাকতে হবে।

 

তরল মাধ্যম :

প্রথমে তরল আবাদ মাধ্যম প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োগোপযোগী অণুজীবের চাষ করতে হবে। এরপর তরল মাধ্যমটি ১৫ পাউন্ড চাপে (১২১ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) ৩০ মিনিট ধরে নিবীর্জ করা হয় এবং ঠান্ডা করে তরল মাধ্যমে নিবার্চিত অনুজীব (রাইজোবিয়াম) জন্মানো হয়।

তরল কালচারকে ২৮ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রেখে অনবরত কিছুক্ষণ ঝাঁকুনি দিলে ভিতরের তরল মাধ্যমে অক্সিজেন প্রবেশ করে প্রচুর অণুজীব উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়। অত:পর এ অণুজীব তরল অব¯ায় বাহ’ কের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যথেষ্ট সংখ্যক অণুজীব (১০৬ ১০৯/মিলিলিটার) জন্মানোর পর পরিমাণমত তরল কালচার নিবীর্জ করা পিট মাটির সাথে মেশানো হয়।

 

৩। পীট মাটি তৈরী :

পিট মাটি সংগ্রহের পর রোদে শুকানো হয়। কোন আবর্জনা বা পাথর থাকলে তা ভালভা ব পরিস্কার করে প্রথমে হাতুড়ি দিয়ে ও পরে মেশিনের সাহায্যে গুড়া করা হয়। রাইজোবিয়াম জন্মানোর জন্য ৭৫ মাইক্রোমিটার বিশিষ্ট চালুনি দিয়ে পিটের গুঁড়া চালা হয় এবং এতে শতকরা ২—৩ ভাগ ক্যালশিয়াম কার্বনেট মেশাতে হয় যাতে অম্লমান ৬.৫—৭.৩ হয়।

পলিথিনের ব্যাগে ভরে (সাধারণত ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম, ২০০ গ্রাম) তা অটোক্লেভে দিয়ে নির্দিষ্ট সময় ও তাপে নিবীর্জ করা হয়। এরপর গামা রেডিয়েশন দিয়ে পিট মাটি জীবাণুমুক্ত করা হয়। এভাবে তৈরি পিট মাটির প্যাকেটে পরিমাণ মতো তরল মাধ্যমে জন্মানো অণুজীব সতর্কতার সাথে সিরিঞ্জের সাহায্যে প্রবেশ করানো হয় যাতে নতুনভাবে অনাকাক্সিক্ষত অণুজীব ব্যাগে ঢুকতে না পারে। তরল অণুজীব কালচার ও পিট মাটি ভালভাবে মিশিয়ে কয়েকদিন রাখা হয় যা পরবতীর্তে বীজের সাথে মিশিয়ে ব্যবহারের জন্য বাজারজাত করা হয়।

অণুজীব সার জমিতে ব্যবহার পদ্ধতি :

নিচে অণুজীব সারের প্রয়োগ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো :

১। অণুজীব সার বীজের সাথে মেশানোর সময় আঠালো বস্তু হিসাবে চিটাগুড়, ভাতের ঠান্ডা মাড় অথবা পানি ব্যবহার করতে হয়, তবে পানি ব্যবহার না করাই ভালো।

২। ব্যবহৃত বীজে যদি কোনরূপ কীটনাশক ব্যাবহার করা হয়ে থাকে তবে সেই বীজ পানিতে ভালভাবে ধুয়ে অণুজীব সার মেশাতে হবে।

৩। উত্তম ও সুস্থ সবল বীজ পরিমাণমতো একটি পলিথিন ব্যাগ বা পাত্রে নিয়ে তাতে চিটাগুড় বা ভাতের মাড় মিশিয়ে এমনভাবে নাড়তে হবে যাতে প্রতিটি বীজের গায়ে প্রলেপ পড়ে।

৪। এ প্রলেপযুক্ত বীজের সাথে অণুজীব সার এমনভাবে মেশাতে হবে যাতে প্রতিটি বীজে কালো বর্ণের প্রলেপ পড়ে।

৫। অণুজীব সার মিশ্রিত বীজ সকাল ৯ টার মধ্যে বা বিকাল ৪ টার পর বপন করে যত দ্রুত সম্ভব মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

৬। কোন নির্দিষ্ট ফসলের বীজ আধা ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানি ফেলে দিতে হবে। অত:পর রাইজোবিয়াম অণুজীব ঐ বীজের উপর ঢেলে দিয়ে তা ভালোভাবে ছিটিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

৭। বীজের গায়ে যাতে সূর্যের আলো না লাগে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। সূর্যের আলো লাগলে অণুজীব মারা যাবে
এবং অণুজীব সার প্রয়োগ ব্যর্থ হবে।

এ্যাজোলা:

এ্যাজোলা হচ্ছে ভাসমান জলজ পানা। যা পুকুর, ডোবা, নালা, ধানের জমিতে ভাসমান অবস্থায় থাকে। এ্যাজোলার দৈহিক ওজন প্রতি ৫ দিনে দ্বিগুন হতে পারে। এ্যাজেলা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি হেক্টর জমিতে ২০০—৫০০ কেজি নাইট্রোজেন যোগ করা যেতে পারে। বোরো ধানের জমিতে অতি সহজ ও সফলভাবে এ্যাজোলা চাষ করা যায়। এ্যাজোলা মাটির উর্বরতা ও গুনাগুনের উন্নয়ন ঘটায়।

এ্যাজোলা ব্যবহার করলে সালফার ও জিংকের ঘাটতিও দূর হয়। এ্যাজোলার পাতার গহ্বরে অ্যানাবিনা এ্যাজোলি নামক নীলাভ সবুজ শেওলার একটি প্রজাতি মিথোজীবীরূপে বাস করে যা বায়ুমন্ডল থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন সংযোজন করে এ্যাজোলার পাতার গহ্বরে জমা করে। এ এ্যাজোলা মাটিতে চাষ দিয়ে মেশালে মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ হয়।

চাষ পদ্ধতি :

অতি ঠাণ্ডা কিংবা অতি গরম আবহাওয়ায় অ্যজোলা জন্মাতে পারে না। বাংলাদেশে বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত এর চাষ করার উপযুক্ত সময়। যে জমিতে ধান চাষ করা হবে এমন জমি এ্যাজোলা চাষের জন্য নির্বাচন করা প্রয়োজন। অ্যাজোলার চাষ পদ্ধতি নিম্নরূপ—

১। প্রথমে ৫ বা ৬ সেন্টিমিটার পানি দাঁড়ানো একখন্ড জমি নির্বাচন করে ভালভাবে চাষ বা মই দিয়ে সমান ৮টি প্লটে ভাগ করে নিতে হয়।

২। উক্ত জমির দুইকোণার দুইটি প্লটে প্রতি বর্গমিটার জমিতে ৫০০—৮০০ গ্রাম হিসেবে তাজা এ্যাজোলা ছেড়ে দিতে হয়।

৩। অ্যাজোলা ছাড়ার আগে প্রতি বর্গমিটার জমিতে ২.০ গ্রাম কার্বোফোরান—৫ জি প্রয়োগ করতে হয়।

৪। এ্যাজোলা ছাড়ার পর জমির পানি পরিষ্কার হলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে ০.৮—১.৬ গ্রাম টিএসপি সার পানিতে গুলে এ্যাজোলার উপর সরাসরি প্রয়োগ করতে হয়।

৫। এ্যাজোলা যথেষ্ট ঘন হলে পাশের প্লটে এ্যাজোলা ছেড়ে অনুমোদিত পরিমাণ ও পদ্ধতিতে কার্বোফোরান ও টিএসপি প্রয়োগ করতে হয়।

৬। এভাবে এক মাসের মধ্যে সমস্ত জমিটি এ্যাজোলায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

 

উপকারিতা :

এ্যাজোলা ব্যবহারের উপকারিতাসমূহ নিম্নরূপ। যথা—

১। এ্যাজোলা সার মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে নাইট্রোজেন যোগ করে। বিশেষ করে ধান ক্ষেতে পর্যাপ্ত পরিমাণে নাইট্রোজেন সঞ্চয়ন করে।

২। এ্যাজোলা ধানের সাথে একত্রেই জন্মানো যায়; কিন্তু তা ধানের বৃদ্ধিতে কোন ব্যাঘাত ঘটায় না।

৩। এ্যাজোলা অধিক পানিতে জন্মাতে পারে।

৪। এ্যাজোলা আগাছা দমন করে।

৫। উঁচু জমির ফসলে এ্যাজোলা কম্পোষ্টের উপাদান যোগান দেয়। যে সব ফসল জলবদ্ধ অবস্থায় জন্মাতে পারে না। সে সব জমিতে এ্যাজোলা কম্পোষ্ট হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

৬। প্লাবিত এলাকায়, যেখানে সবুজ সার শস্য জন্মানো যায় না, সেখানে এ্যাজোলা জন্মানো যায়।

৭। এ্যাজোলা মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

৮। এ্যাজোলা ব্যবহার করলে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০—৪০ কেজি নাইট্রোজেন কম লাগে।

৯। এ্যাজোলা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

 

এ্যাজোলা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা :

এ্যাজোলা উৎপাদনের সীমাবদ্ধতাসমূহ নিম্নরূপ—

১। জমিতে অবশ্যই পানি আবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হবে।

২। উচ্চ তাপমাত্রায় এ্যাজোলার বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

৩। এ্যাজোলাতে কীট—পতঙ্গের আক্রমণ অধিক।

৪। বছরের সব মৌসুমে এ্যাজোলা জন্মানো খুব কঠিন।

৫। শামুক এ্যাজোলা খেয়ে ফেলতে পারে।

৬। ফসফরাস প্রয়োগ ব্যতীত এ্যাজোলা উৎপাদন কঠিন।

৭। কম্পোষ্ট সার হিসাবে এ্যাজোলাকে কোন ক্ষেতে প্রয়োগ করতে গেলে পরিবহন করা ঝামেলাপূর্ণ হয়।

 

ট্রাইকোডার্মা :

ট্রাইকোডার্মা এক প্রকার ছত্রাক। এ ছত্রাক বিভিন্ন ময়লা আবর্জনার সাথে ব্যবহার করে যে সার তৈরি করা হয় তাকে ট্রাইকোডার্মা অণুজীব সার বলে। ২৫—৩০ সে তাপমাত্রায় এ ছত্রাক বংশবিস্তার করতে পারে। পচনশীল দ্রব্য বিয়োজনের মাধ্যমে এর জীবন চক্র সম্পন্ন হয়। ট্রাইকো কম্পোষ্ট তৈরিতে ট্রাইকোর্ডামা ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে।

এই ছত্রাকের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যে, এটি অন্যান্য অণুজীবের বা ছত্রাকের চেয়ে কঠিন বস্তু যেমন কাঠের গুড়া গাছের শক্ত অংশ বিয়োজন করতে পারদর্শী। মাটিতে এর কোন নেতিবাচক প্রভাব নেই। তাই এটি পরিবেশ বান্ধব। এ ছত্রাক গাছে রোগ সৃষ্টিকারী অনেক রোগজীবাণু খেয়ে ফেলে এবং গাছের সুরক্ষা দেয়। এজন্য একে ডক্টরস্ ফাংগাস বলা হয়।

 

 

ট্রাইকোর্ডামা সার তৈরীর পদ্ধতি :

১। প্রথমে মাটিতে ১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১ মিটার প্রস্থ করে কয়েকটি গর্ত তৈরী করতে হবে গর্তের গভীরতা হবে ১ হাত বা ০.৫ মিটার।

২। অত:পর বাড়ির ময়লা আবর্জনা, পৌরসভার বর্জ্য ইত্যাদি হতে অপচনশীল দ্রব্য। যেমন— পলিথিন, ইট, পাথর ও লোহার টুকরা ইত্যাদি আলাদা করতে হবে।

৩। বৃষ্টির পানি রোধে গর্তের চারধারে আইল দিতে হয়। রোদের তীব্রতা ও ঝড়বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে গ র্তর উপর ঢাকনা দিতে হয়। আবর্জনা গর্তে ফেলার আগে একটু গোবর মেশালে ভাল হয়। শুকনো হলে সামান্য পানি ছিটাতে হয়।

৪। অত:পর প্রতিটি গর্তের জন্য ১৫০ মি.লি. ট্রাইকো সাসপেনশন তৈরি করতে হবে। গর্তে বর্জ্য তিন ধাপে ঢালতে হবে এবং প্রতিটি ধাপে/স্তরেই ট্রাইকোডার্মা সাসপেনশন স্প্রে করতে হবে।

৫। গর্ত পরিপূর্ণ হয়ে গেলে সমস্ত গর্তের বর্জ্য ভালভাবে মেশাতে হবে।

৬। বৃষ্টি বা প্রচণ্ড রোদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

৭। সমভাবে পচনের জন্য ৭ দিন অন্তর অন্তর আবর্জনা উল্টে—পাল্টে দিতে হবে।

৮। ৫—৬ সপ্তাহ পর আবর্জনা চা পাতার মত ঝরঝরে ও গন্ধহীন হয়ে ব্যবহার উপযোগী হয়।

 

অণুজীব সার

অণুজীব সার – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা বিশেষ উৎপাদন সম্পৃক্ত কৃষি ‘প্রযুক্তি বিষয়ের ইউনিট ৫ এর ৫.১ নং পাঠ।

অণুজীব সার

 

অণুজীব সার :

যে সকল ক্ষুদ্র জীব খালি চোখে দেখা যায় না কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখা যায় তাদের অণুজীব বলে। অণুজীব বা জীবাণু ব্যবহার করে যে সার প্রস্তুত করা হয় তাকে অণুজীব সার বলে। উদ্ভিদ জগতের অন্তভূর্ক্ত অণুজীবগুলো হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শেওলা ও এক্টিনোমাইসিটিস। প্রাণিজগতের অণুজীব হলো নেমাটোড, রটিফার ও প্রক্টোজোয়া।

তবে অণুজীব সার কেবলমাত্র উদ্ভিদ জাতের অন্তর্গত অণুজীব দিয়ে তৈরী করা হয়। গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে যে, জীবাণু সার ব্যবহারে চীনাবাদাম, মসুর, মুগ, ছোলা, সয়াবীন প্রভৃতি ফসলে নাইট্রোজেন গুটি বা নডিউলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। এতে করে ফসলের ফলনও বেড়ে যায় ২০—৪০%। জীবানু সার অত্যন্ত কম ব্যয় সাপেক্ষ। এর ব্যবহার পদ্ধতি সহজ এবং স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর নয়।

 

 

অণুজীব সারের প্রকারভেদ :

১। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী অণুজীব সার
২। ফসফরাস দ্রবীভূতকারী অণুজীব সার ও ৩। কম্পোস্ট তৈরীকারী অণুজীব সার।

 

১। নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী অণুজীব সার :

এরা বায়ুর নাইট্রোজেন আহরণ ও সংবন্ধন করে। অণুজীব প্রধাণত দুই প্রকারে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।

 

(ক) মুক্তজীবী নাইট্রোজেন সংবন্ধন :

এ শ্রেণীর জীবাণুগুলো মাটিতে মুক্তভাবে বসবাস করে বাতাস থেকে সরাসরি নাইট্রোজেন গ্রহণ করে দেহের মধ্যে নাইট্রোজেন যৌগে পরিণত করে। এ শ্রেণীর জীবাণুদের মধ্যে রয়েছে এ্যাজোটোব্যাকটর, ক্লসটিডিয়াম, বেইজার—ইনকিয়া প্রভৃতি। জৈব পদার্থ এ সব জীবাণুকে শক্তি যোগায়। এ জীবাণুরা শিকড়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে না, শিকড়ের উপরে কাজ করে। এসব জীবাণু মারা যাবার পর মাটিতে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে। ঐ নাইট্রোজেন গ্রহণ করে ফসল উপকৃত হয়।

এ শ্রেণীর প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ১০—২৫ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে সরবরাহ করতে পারে। নাইট্রোজেন যোগ করা ব্যতীত এই জীবাণু জমিতে হরমোন তৈরী করে যা অঙ্কুরোদগমে সহায়তা করে। অশিম্বী জাতীয় ফসল, যেমন—ধান, গম, ভুট্টা, আখ, পাট, তুলা প্রভৃতি ফসলে জীবাণু সারের মাধ্যমে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে ফসলের ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো সম্ভব। ১০ কেজি বীজে ২০০ গ্রাম করে ব্যবহার করলে অল্প খরচে নাইট্রোজেন সারের অভাব পূরণ হয়।

 

 

(খ) মিথোজীবী নাইট্রোজেন সংবন্ধন :

সাধারণত গুটি উৎপাদনকারী উদ্ভিদ এবং রাইজোবিয়াম নামক জীবানু মিথোজীবী হিসেবে বাস করে। গাছের শিকড়ে যদি ঠিকভাবে গুটি হয় তবে প্রতি হেক্টরে বার্ষিক ১০০—৩০০ কেজি নাইট্রোজেন মাটিতে জমা হতে পারে এবং ফলন বাড়ে ৫০—১০০ ভাগ। প্রতিটি স্বতন্ত্র গুটি জাতীয় ফসলেরর জন্য আলাদা আলাদাভাবে নির্দিষ্ট জীবাণু সার প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

এ জীবাণুরা শিম জাতীয় উদ্ভিদের মূলে গুটি তৈরী করে এবং সেখানে বসবাস করে বাতাস থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে তাকে উদ্ভিদের গ্রহণোপযোগী নাইট্রোজেনে পরিণত করে। শিম জাতীয় উল্লেখযোগ্য ফসল হলো : সয়াবিন, চিনাবাদাম, মুগ, মসুর, ছোলা, বরবটি, মাসকালাই, শনপাট, ধৈঞ্চা প্রভৃতি। রাইজোবিয়াম জীবাণু সার প্রয়োগ করলে ডালজাতীয় ফসলের শিকড়ে “নডিউল” বা গুটির সংখ্যা তাদের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। গুটি তিন রংঙের হয়— গোলাপী—লাল, বাদামী এবং সবুজ এর মধ্যে গোলাপী—লাল রঙের গুটিই সবচেয়ে বেশি নাইট্রোজেন আবদ্ধ করতে পারে।

 

 

২। ফসফরাস ঘটিত অণুজীব সার :

মাটিস্থ ফসফরাসকে দ্রবীভূত করে গছের জন্য সহজলভ্য করে এরূপ অণুজীব সারকে ফসফরাস অণুজীব সার বলে। মৃত্তিকায় ফসফরাস থাকে সাধারণত ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা বা অ্যালুমিনিয়ামের হাইড্রোক্সাইড, কার্বনেট বা সিলিকেটের সংগে যুক্ত হয়ে অদ্রবণীয় অবস্থায় এবং সহজে দ্রবণীয় ফসফরাস ঘটিত রাসায়নিক সার মৃত্তিকায় প্রয়োগ করায় অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তা আবারও গাছের অগ্রহণযোগ্য ও অদ্রবণীয় যৌগে পরিণত হয়। ফলে মৃত্তিকায় মোট ফসফরাসের পরিমাণ যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহন করতে পারে না। ফসফরাস ঘটিত অণুজীব সার মৃত্তিকার এই অদ্রবণীয় ফসফেটকে গাছের গ্রহণযোগ্য দ্রবনে রূপান্তরিত করে এ অণুজীবগুলো বেশ কিছু এনজাইম ও জৈব এসিড উৎপন্ন করে যা অদ্রবনীয় ফসফেটকে দ্রবণীয় ফসফেটে রূপান্তরিত করে।

৩। কম্পোস্ট তৈরীকারী’ অনুজীব সার :

কম্পোস্ট তৈরী করতে যে অণুজীব সার ব্যবহার করা হয় তাকে কম্পোস্ট তৈরীকারী অণুজীব’ সার বলে। যেমন: বিভিন্ন ছত্রাক (ট্রাইকোডার্মা, মাইকোরাইজা, এসপারজিলাস), ব্যাকটেরিয়া (ক্লসট্রিডিয়াম, ব্যাসিলাস) ও অ্যাক্টিনোমাইসেটিস জৈব পদার্থসমূহকে দ্রুতগতিতে পঁচাতে সাহায্য করে।

 

 

অণুজীব সারের গুরুত্ব :

১। ফসলের পুষ্টির চাহিদা পূরণে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে অণুজীব’ সার গুরুত্বপূর্ণ ।

২। নাইট্রোজেন অণুজীব সার মাটিতে ও ফসলে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে।

৩। মাইকোরাইজা অণুজীব সার মূলের পৃষ্ঠ এলাকা বৃদ্ধি করে। ফলে এর সাহায্যে উদ্ভিদ বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।

৪। জীবাণু সার পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না।

৫। এই সারের উৎপাদন খরচ খুব কম এবং মানুষ ও পশুপাখির কোন ক্ষতি করে না।

৬। জীবাণু সার অত্যন্ত কম ব্যয় সাপেক্ষ।

৭। জীবাণু সারের ব্যবহার পদ্ধতি সহজ এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।

৮। ধানক্ষেতে এই সার জৈব পদার্থ সংযোগ করে।

৯। জীবাণু সার যেমন এ্যজোলা আগাছা দমন করে।

১০। জীবাণু সার যেমন ট্রাইকোডামার্ মাটির ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে এবং জৈব বালাইনাশক হিসাবে মাটি শোধনের কাজ করে।

১১। ফসলে ২৫—১৫০ ভাগ আমিষ বাড়ায়

১২। পরিমাণে খুব কম লাগে।

 

সারাংশ :

অনুজীব থেকে উৎপন্ন সারসমূহকে অনুজীব সার বলা যায়। মাটিতে বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে মাটির পরিবেশ দূষিত হচ্ছে ফলে ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু অনুজীব সার হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিকারক। জীবানু সার শুধুমাত্র উদ্ভিদ জগতে অন্তর্গত অনুজীবগুলোকে নিয়ে তৈরি করা হয়। অনুজীব সার সহজলভ্যতা ও পরিবেশগতভাবে নিরাপদ হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।

 

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধন

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধন – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট – ৪ , পাঠ – ৪.৫।

 

 

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধন

(ক) পিঁয়াজ বীজ শোধন পিঁয়াজ বীজ বেশ ছোট আকৃতির। এর সাথে বিভিন্ন রোগজীবাণু যেমন- ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও নেমাটোড় লেগে থাকতে পারে। পিঁয়াজ গাছ জন্মানোর পর এসব বীজ বাহিত রোগ জীবাণু পিঁয়াজের কন্দ, পাতা, শিকড় ইত্যাদি অংশে আক্রমণ করতে পারে। এজন্য পিঁয়াজ বীজ বপনের পূর্বে তা শোধন (জীবাণযুক্ত) করে নিতে হবে। বীজ শোধন বলতে বীজ জীবাণুমুক্তকরণকে বোঝায়।

 

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধনে প্রয়োজনীয় উপকরণ:

(১) পিঁয়াজের বীজ (২) বীজ শোধক ভিটাভ্যাক্স ২০০ পাউডার (এম ৪৫) (৩) মুখ আটকানো কৌটা (৪) নিক্তি ইত্যাদি।

 

 

 

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধনের কার্যপ্রণালী:

১. এক কেজি পেঁয়াজ বীজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কৌটায় নিন।

২. পরিমাণমত ভিটাভ্যাক্স ২০০ পাউডার (২ গ্রাম/কেজি) নিক্তি দ্বারা মেপে কৌটার বীজের মধ্যে নিয়ে কৌটার মুখ ভালভাবে আটকিয়ে দিন।

৩. এবার বন্ধ কৌটাটি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে কয়েকবার ঝাঁকুন। এতে বীজ শোধক পাউডার বীজের গায়ে লেগে যায়। ৪. শোধন করা বীজ পলিব্যাগ বা উক্ত কৌটায় কয়েক ঘন্টা সংরক্ষণ করুন। অতঃপর নির্ধারিত বীজ তলায় বপন করুন।

 

 

 

 

পিঁয়াজ আলু ও সরিষার বীজ শোধনে সাবধানতা:

১. বীজ শোধক এক ধরনের বিষ। তাই শোধন করা বীজ এবং ঔষধ শিশু ও পশুপাখির নাগালের বাইরে রাখুন।

২. বীজ শোধনের পর হাত ও মুখ ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালভাবে ধৌত করে নিন।

৩. বীজ ও ঔষধ সঠিক পরিমাণে মিশাতে হবে।

(খ) আলু বীজ শোধন বীজ আলুর সাথে বিভিন্ন রোগজীবাণু লেগে থাকতে পারে। তাই আলু বীজ লাগানোর পূর্বে শোধন করে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় উপকরণ:
(১) একটি বড় পাত্র

(২) বাঁশের কঞ্চি

(৩) আলু বীজ

(৪) ডাইথেন এম ৪৫ (বা এমিসন —৬)

 

 

কার্যপ্রণালী:

১. একটি বড় পাত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি নিয়ে তাতে নির্দিষ্ট হারে ডাইথেন এম —৪৫ (৩.৬ গ্রাম/লিটার) নিয়ে ভালভাবে মিশান।

২. দ্রবণের মধ্যে প্রয়োজনীয় বীজ আলু (প্রতি লিটারে দেড় কেজি) এক মিনিট ডুবিয়ে তুলে ছায়ায় শুকিয়ে নিন।

৩. এরপর বীজ আলু মাঠে বপন করুন। তবে আলু বীজ কাটা অবস্থায় দ্রবণে নিলে পানি বেরিয়ে অন্তত ২৪ ঘন্টা চট দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে কাটা অংশের উপর একটি পাতলা আবরণ পড়ে। এ আবরণ আলুর বীজকে পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে রক্ষা করে। (গ) সরিষা বীজ শোধন: সরিষা বীজ ছোট আকৃতির। এর সাথে বিভিন্ন বীজবাহিত রোগজীবাণু লেগে থাকতে পারে। তাই বপনের পূর্বে সরিষাবীজ
শোধন করে নিতে হবে।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

(১) ডাইথেন এম ৪৫ (বা এগ্রোসান জি এন), (২) বীজ শোধন যন্ত্র ইত্যাদি।

কার্যপ্রণালী:

১. একটি বড় বালতিতে ১০ লিটার পানি দিয়ে তার মধ্যে ৩০০ গ্রাম লবন দিয়ে ভালভাবে মিশান।

২. লবণ দ্রবণে সরিষার বীজ ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতে থাকুন। অপুষ্ট বীজগুলো উপরে ভেসে উঠবে। ভেসে
থাকা বীজগুলো ফেলে দিন এবং পানিতে ডুবে থাকা বীজ গুলো উঠিয়ে শুকিয়ে নিন।

৩. শুকনো বীজের সাথে প্রয়োজনমতো ডাইথেন এম ৪৫ (প্রতি কেজিতে ৩ গ্রাম) মিশিয়ে সীড ড্রেসারে নিন।

৪. সীড ড্রেসারটি কিছুক্ষণ ঘোরালে বীজের গায়ে ঔষধ ভালোভাবে লেগে যাবে। এবার শোধন করা বীজ কয়েক ঘন্টার মধ্যে বপন করুন।

 

সাবধান :

১. বীজ শোধক এক ধরনের বিষ। তাই শোধন করা বীজ এবং ঔষধ শিশু ও পশুপাখির নাগালের বাইরে রাখুন।

২. বীজ শোধনের পর হাত ও মুখ ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালভাবে ধৌত করে নিন।

৩. বীজ ও ঔষধ সঠিক পরিমাণে মিশাতে হবে।

বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়

বীজের বিশুদ্ধতা কৃষি উৎপাদনে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি মানসম্পন্ন ও বিশুদ্ধ বীজ সরবরাহ কৃষকের উৎপাদনশীলতা, ফলনের পরিমাণ এবং ফসলের গুণগত মানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশুদ্ধ বীজ বলতে বোঝায়—বীজের মধ্যে কেবলমাত্র কাঙ্ক্ষিত (desired) জাতের বীজ থাকবে, যেখানে অন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা ভিন্ন জাতের বীজের উপস্থিতি থাকবে না। এর ফলে কৃষক নির্ভরযোগ্য ফলনের নিশ্চয়তা পায় এবং উপযুক্ত জাতের গুণাগুণ বজায় থাকে।

বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়

এই পাঠটি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএজি-এড ডিসিপ্লিনের “বীজ বীজ প্রযুক্তি (Course Code: ১১০২)” বিষয়ের চতুর্থ ইউনিটের ‘মৃত্তিকার জৈবিক বৈশিষ্ট্য’ অংশের অন্তর্ভুক্ত।

 

বীজের বিশুদ্ধতার গুরুত্ব

বীজ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা না হলে—

  • ফসলের জাতের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে,
  • উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে,
  • রোগবালাই প্রতিরোধে সমস্যা দেখা দিতে পারে,
  • বাজারে ফসলের মান ও গ্রহণযোগ্যতা কমে যেতে পারে।

 

বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়

বীজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য তার বিশুদ্ধতার হার নির্ধারণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বীজে কাঙ্ক্ষিত জাতের বীজ কত শতাংশ রয়েছে এবং কতটা ভেজাল বা অনুপযুক্ত জাত মিশ্রিত হয়েছে।
বিশুদ্ধতার হার নির্ণয়ের মাধ্যমে কৃষক—

  • সঠিক বীজ নির্বাচন করতে পারেন,
  • ফলন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নির্ভরযোগ্যভাবে করতে পারেন,
  • উচ্চমানসম্পন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনে সক্ষম হন।

এই পাঠে আমরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে বীজের বিশুদ্ধতার হার কীভাবে নির্ণয় করা হয়, তার ধাপ ও ব্যাখ্যা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

 

 

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা:

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়—কোনো বীজ নমুনায় ওজনের ভিত্তিতে শতকরা কত ভাগ মূল শস্য বীজ বিদ্যমান। এই পরীক্ষা কৃষিতে মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং ফলনের গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করে।

একটি বীজ নমুনায় প্রধানত চারটি উপাদান থাকে:

উপাদানের ধরন বর্ণনা উদাহরণ
() বিশুদ্ধ প্রজাতির বীজ এটি কাঙ্ক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য জাতের বীজ যা উচ্চ ফলনশীল ও কৃষির জন্য উপযোগী। যেমন: উন্নত জাতের ধান, গম, টমেটো, পালং ইত্যাদি
() অন্যান্য প্রজাতির বীজ ভিন্ন জাত বা অবাঞ্ছিত শস্যের বীজ যা উদ্দেশ্য ফসলের সাথে অপ্রাসঙ্গিক। যেমন: প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ভিন্ন শস্য বীজ
() আগাছার বীজ এ ধরনের বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ ফসলের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং জমির উর্বরতা নষ্ট করে। যেমন: পুঁইশাক, গাঁদা, নালিশ, মঞ্জরি ইত্যাদি
() জড় পদার্থ মাটি, পাতা, পাথর বা অন্য কোনো অনাবশ্যক বস্তু যা বীজের সঙ্গে মিশে থাকে। যেমন: পাথর, শুকনো পাতা, ধুলাবালি ইত্যাদি

এই চারটি উপাদানকে আলাদা করে ওজন করে দেখা হয় কত শতাংশ বিশুদ্ধ প্রজাতির বীজ রয়েছে। এই শতকরা হারই বীজের বিশুদ্ধতার হার হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশুদ্ধতার হার যত বেশি, বীজ তত বেশি মানসম্পন্ন ও ফলপ্রসূ।

 

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি:

বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ একটি সূক্ষ্ম ও মনোযোগসাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যার জন্য নির্দিষ্ট কিছু যন্ত্রপাতি অপরিহার্য। নিচে এই যন্ত্রপাতিগুলোর নাম ও ব্যবহার সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:

(১) পিউরিটি বোর্ড (বা বীজ বোর্ড):
এটি একটি সাদা, মসৃণ ও সমতল পৃষ্ঠবিশিষ্ট বোর্ড, যা বীজ বিশুদ্ধতা পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। বীজ ছড়িয়ে পরীক্ষার সময় বিভিন্ন উপাদান যেমন — বিশুদ্ধ বীজ, ভেজাল বীজ, ময়লা, খোসা, মৃত বীজ ইত্যাদি সহজে শনাক্ত করা যায়। রঙিন বা অমসৃণ পৃষ্ঠ বিশ্লেষণকে ব্যাহত করে, তাই সাদা পৃষ্ঠ ব্যবহার করা হয়।

(২) মাপক নিক্তি (দশমিক গ্রাম স্কেল, যথা: ±০.০০১ গ্রাম):
বীজের ওজন সঠিকভাবে নির্ধারণের জন্য এই সূক্ষ্ম মাপযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। বিশেষত বিশুদ্ধতা পরীক্ষার সময় মোট ওজন ও বিশুদ্ধ অংশের ওজন নিরূপণ করতে এটি অপরিহার্য।

(৩) সাদা কাগজ:
বিকল্প পৃষ্ঠ হিসেবে, বিশেষ করে পোর্টেবল পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সাদা কাগজ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পরীক্ষার সময় পিউরিটি বোর্ডের কাজ করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান আলাদা করতে সুবিধা দেয়।

(৪) পেট্রি ডিস (মাঝারি ও বড় আকার):
বীজ বিশ্লেষণের সময়, বিশেষ করে অঙ্কুরোদগম বা জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে, পেট্রি ডিস ব্যবহার করা হয়। এতে বীজ সহজে পর্যবেক্ষণযোগ্য অবস্থায় রাখা যায়।

(৫) চিমটা (টুইজার):
ছোট ও সূক্ষ্ম বীজ বাছাই বা পৃথক করার সময় চিমটা ব্যবহার করা হয়। এটি বীজকে আঘাত না করে আলাদা করতে সহায়তা করে।

(৬) স্ট্যান্ডযুক্ত ম্যাগনিফাইং গ্লাস (আয়তন বাড়ানো কাচ):
ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম গঠনের বীজ বা ভেজাল উপাদান বিশ্লেষণের জন্য এই যন্ত্রটি অত্যন্ত কার্যকর। স্থির স্ট্যান্ডের মাধ্যমে দুই হাত মুক্ত রেখে কাজ করা যায়, যা দীর্ঘ সময় ধরে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে সহায়ক।

 

বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার ধাপ:

বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ একটি সঠিক কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়, যাতে বীজের মধ্যে অন্য কোনো প্রজাতির বীজ, আগাছা, বা জড় পদার্থ মিশে না থাকে। নিচে বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষার বিস্তারিত ধাপ উপস্থাপন করা হলো:

১। ওজন মাপুন

প্রথমে, মাপক নিক্তি ব্যবহার করে কার্য সম্পাদন নমুনার সঠিক ওজন নিন। এটি নিশ্চিত করবে যে, আপনার কাছে সঠিক পরিমাণ বীজ রয়েছে যা পরীক্ষা করতে হবে।

২। বীজ ছড়িয়ে দেয়া

ওজন নেওয়ার পর, সমস্ত বীজ পিউরিটি বোর্ডে ছড়িয়ে দিন। তারপর, বীজগুলোকে নিম্নলিখিত উপকরণের ভিত্তিতে পৃথক করুন:

  • (ক) বিশুদ্ধ বীজ: সঠিক জাতের বীজ যা ফসল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত।

  • (খ) অন্য প্রজাতির বীজ: যেগুলো অন্য কোনো জাত বা প্রজাতির, যা সাধারণত উপযুক্ত নয়।

  • (গ) আগাছা বীজ: যেগুলো কৃষিকাজের জন্য অবাঞ্ছিত এবং ফসলের ক্ষতি করতে পারে।

  • (ঘ) জড় পদার্থ: মাটি, পাথর বা অন্য কোনো অবাঞ্ছিত উপাদান, যা বীজের সঙ্গে মিশে থাকে।

এই উপাদানগুলো সঠিকভাবে আলাদা করার জন্য, বিস্তারিতভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য জানুন এবং সঠিকভাবে শনাক্ত করুন।

৩। বীজ পৃথক করা

বাছাই করা প্রতিটি অংশ পৃথক পৃথক পেট্রি-ডিসে রাখুন। এই সময়ে, বীজ শনাক্তকরণের জন্য যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তবে স্ট্যান্ডযুক্ত ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করুন। এটি আপনাকে বীজের বিস্তারিত গঠন এবং তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে।

৪। ওজন নির্ধারণ ও হিসাব করা

এরপর, প্রতিটি অংশের সঠিকভাবে (প্রয়োজনীয় সংখ্যক দশটি ঘর পর্যন্ত) পৃথক ওজন নির্ধারণ করুন এবং নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহার করে হিসেব করুন:

  • কার্য সম্পাদনের নমুনার ওজন (G গ্রাম)

  • নির্ধারিত অংশের মোট ওজন (W গ্রাম)

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পরীক্ষার পর যদি G ও W এর মধ্যে ৫% এর বেশি পার্থক্য থাকে, তাহলে আবার পরীক্ষা করুন।

৫। বিশুদ্ধতা গণনা

প্রস্তুত করার পর, আপনি বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণ করতে পারবেন। বিশুদ্ধতা হিসাব করার জন্য, নিম্নলিখিত সূত্র অনুসরণ করুন:

বীজের বিশুদ্ধতা (শতকরা হার)=(বিশুদ্ধ বীজের ওজনমোট নমুনার ওজন)×100\text{বীজের বিশুদ্ধতা (শতকরা হার)} = \left( \frac{\text{বিশুদ্ধ বীজের ওজন}}{\text{মোট নমুনার ওজন}} \right) \times 100

উদাহরণ:
মনে করুন, কার্য-সম্পাদন নমুনার ওজন ১০০ গ্রাম এবং এর মধ্যে বিশুদ্ধ বীজ পাওয়া গেছে ৯২ গ্রাম। তাহলে বিশুদ্ধতার হার হবে—

৯২১০০×১০০=৯২%\frac{৯২}{১০০} \times ১০০ = ৯২\%

এটি নিশ্চিত করবে যে, আপনার নমুনার মধ্যে কত শতাংশ বীজ বিশুদ্ধ। মনে করি, সম্পাদনের নমুনার ওজন এ গ্রাম, তখন অন্যান্য ওজন ও বীজের বিশুদ্ধতার সূত্র নিম্নরূপ হবে:

কার্য সম্পাদনের নমুনার ওজন G গ্রাম কার্য সম্পাদনের নমুনা বিভিন্ন অংশে পৃথক করার পর মোট ওজন W গ্রাম এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে হিসেব শেষ করার পর যদি কার্য সম্পাদন নমুনা G ও W এর মধ্যে ৫% এর বেশি পাথক্য থাকে তাহলে পূনরায় পরীক্ষা করুন।

এখন আমরা বিশুদ্ধ বীজ, অন্য প্রজাতির বীজ, আগাছা বীজ ও জড় পদার্থ সম্পর্কে আলোচনা করব।

 

বিশুদ্ধ বীজ অংশ:

বীজের বিশুদ্ধতা নির্ধারণে বিভিন্ন উপাদান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট প্রজাতির বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মানের উপর। নিচে বিশুদ্ধ বীজ, অন্য প্রজাতির বীজ, আগাছার বীজ ও জড় পদার্থ চিহ্নিত করার বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হলো:

১. সম্পূর্ণ অক্ষত ও সুস্থ বীজ:
একটি বিশুদ্ধ বীজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি সম্পূর্ণ অক্ষত, দাগহীন ও সুস্থ হতে হবে। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন এই বীজগুলোই পরবর্তীতে সুস্থ ও উৎপাদনক্ষম গাছের জন্ম দেয়।

২. ভ্রণসমৃদ্ধ ভাঙা বীজ:
যেসব ভাঙা বীজে অন্তত ৫০% অংশ, বিশেষত ভ্রণ অংশ অক্ষত থাকে, সেগুলোকে অনেক সময় বিশুদ্ধ বীজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এসব বীজের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে পরীক্ষা করা আবশ্যক।

৩. চিটা বা আংশিক বিকৃত বীজ অন্তর্ভুক্ত নয়:
চিটা, অপরিপূর্ণ বা অর্ধ-গঠিত বীজকে বিশুদ্ধ বীজ হিসেবে গণ্য করা যায় না। এদের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা নেই এবং এগুলো উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

অবিশুদ্ধ উপাদানসমূহ

১. অন্য প্রজাতির বীজ:
মূল ফসল ছাড়া অন্য যেকোনো প্রজাতির বীজ এই অংশে পড়ে। এদের উপস্থিতি চাষের কাঙ্ক্ষিত ফলন ব্যাহত করতে পারে, কারণ তারা অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য বহন করে।

২. আগাছার বীজ:
পরিচিত বা অজানা সব ধরনের আগাছার বীজ—যা সম্পূর্ণ, ভাঙা বা চিটা হতে পারে—বিশুদ্ধতার বাইরে বিবেচিত। এগুলো ফসলের পুষ্টি গ্রহণে প্রতিযোগিতা তৈরি করে এবং ক্ষেত্রকে আগাছা আচ্ছাদিত করে ফেলে।

৩. জড় পদার্থ:
যেসব উপাদান বীজ নয়—যেমন মাটি, ধুলো, পাথর, শুকনো শিকড়, খোসা, খড়কুটা ইত্যাদি—তারা জড় পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এসব পদার্থ বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।

 

 

জড় পদার্থ নিম্নরূপ হবে:

বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে জড় পদার্থের উপস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। জড় পদার্থ বলতে বোঝায়—বীজ ছাড়াও অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয়, অবাঞ্ছিত ও অজৈব বস্তু যা বীজের গুণগত মান ও অঙ্কুরোদগমে বাধা সৃষ্টি করে। এইসব উপাদান বীজের ভৌত গঠনকে নষ্ট করে এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জড় পদার্থের ধরন ও তাদের প্রভাব

১. মূল শস্য বা অন্যান্য শস্য বীজের ৫০% এর কম উপস্থিতি:
যখন বীজের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত জাতের উপস্থিতি ৫০% এর কম হয়, তখন তা অদক্ষ বা নিম্নমানের বীজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ব্যবহার কৃষকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

২. ছাতাগুটি বা কৃত্রিম গুলের উপস্থিতি:
ছত্রাকজনিত ছাতাগুটি বা রোগাক্রান্ত অংশ কিংবা কৃত্রিমভাবে গঠিত গুল বীজের গুণগত মান নষ্ট করে দেয়। এটি বীজের সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ক্ষেত্রেও রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে।

৩. চিটা বীজের উপস্থিতি:
চিটা বা অপুষ্ট বীজ বীজতলার বা ক্ষেতে অঙ্কুরিত হয় না, ফলে এটি উৎপাদন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে

৪. খড়কুটা, পাতা ও কান্ড:
এসব জৈব অবশিষ্টাংশ সংরক্ষণের সময় পচে যেতে পারে, যার ফলে বীজের আর্দ্রতা বাড়ে ও ছত্রাক জন্মায়, যা বীজের সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করে।

৫. মাটি কণা, নুড়ি, ইটের টুকরা, ধুলাবালি ও মৃত/জীবিত কীটপতঙ্গ:
এ ধরনের অনুজৈব বস্তু বীজের ওজন বাড়িয়ে দেয়, পরীক্ষায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশেষত মৃত বা জীবিত কীটপতঙ্গ শস্যের ক্ষতি করে ও গুদামে সংরক্ষণের সময় ঝুঁকি বাড়ায়।

সূত্র:

  • বীজের বিশুদ্ধতার হার নির্ণয় , বীজ উৎপাদন , ইউনিট-৪ , পাঠ-৪.৪

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট-৪ ,পাঠ-৪.৩। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ বীজ শুকানো, পরিচারকরণ, বিভিন্ন আকা রে শ্রেণীবিন্যাসকরণ এবং ওষুধ প্রয়োগ করে শোধন ইত্যাদিকার্যাদির মাধ্যমে বীজকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করার পর বস্তাবন্দি করে বাজারজাতকরণ ও বিতরণ করা হয়। বীজ জমিতে পূনরায় বপন করার পূর্বে উক্ত কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয়। বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন প্রক্রিয়া কত নিপুণ ও কার্যকরভাবে করা হলো তার উপর নির্ভর করে বীজ বাজারজাতকরণ।

 

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

 

প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি:

সদ্য মাড়াইকৃত বীজের মধ্যে খড়—কুটা, ভাংগা দানা, অন্য জাতের বীজ, আগাছা বীজ এবং পোকামাকড় থাকতে পারে। এছাড়াও বীজের মধ্যে পানি থাকে। বীজের পানির পরিমাণ ১২% বেশি হলে বীজ পোকা—মাকড় ও ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে। বীজের সাথে থেকে যাওয়া খড়—কুটা আবর্জনা, পোকামাকড় ও রোগ—জীবাণুর আবাসের ব্যবস্থা করে। এসব মিলিয়ে বীজের তাপ বেড়ে যায় এবং এভাবে কিছুদিন থাকলে বীজ জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। বীজের ভিতর থেকে খড়কুটা, আবর্জনা, অন্য বীজ, পোকামাকড় ইত্যাদি পরিষ্কার করে বেছে ফেলে বীজকে উত্তমরূপে শুকিয়ে সংরক্ষণ করলে বীজ ভাল থাকবে।

ধান ও গমবীজের ক্ষেত্রে ১২% এবং অন্যান্য বীজের ক্ষেত্রে ১০% জলীয় ভাগের নিচে বীজ সংরক্ষণ করা উচিত। পরিষ্কার করা বীজ মাড়াই করার সাথে সাথে কুলা দিয়ে ঝেড়ে খড়—কুটা, ছোট দানা ইত্যাদি আলাদা করা হয়। তারপর চালুনি দিয়ে চেলে ছোট দানা, আগাছা ইত্যাদি চেলে ফেলে দেয়া হয়। প্রয়োজন হলে হাত দিয়ে বেছে বড় বড় খড়—কুটা বেছে ফেলে দেয়া হয়। বীজের মধ্যে যদি দাগ, ফ্যাকাশে রঙ বা কালচে রঙ থাকে তবে সেগুলোকেও বেছে ফেলা উচিত। বীজ পরিষ্কার করা এবং গ্রেডিং করার জন্য ইঞ্জিনচালিত বা হস্তচালিত যন্ত্র পাওয়া যায়।

বীজের আর্দ্রতা :

বীজের মধ্যে প্রধানত শুকনো পদার্থ ও পানি থাকে। যদি বাতাস শুষ্ক হয় তাহলে বীজ থেকে পানি বাতাসে চলে আসে। আবার বীজ শুকনা হলে বাতাস থেকে পানি বীজে ঢুকে পড়ে। বাতাস ও বীজ একই মাত্রায় শুকনা হলে বাতাস থেকে বীজে বা বীজ থেকে বাতাসে পানি চলাচল করে না। অন্যদিকে, বীজ ভেজা হলে পোকা মাকড় দিয়ে আক্রান্ত হয়, ছত্রাকের আক্রমণ ঘটে এবং বীজের তাপ বেড়ে গিয়ে বীজ মরে যায়। বীজ ভেজা হলে বীজকে উত্তমরূপে শুকাতে হবে। শুকনা বীজ এমন পাত্রে রাখতে হবে যাতে বাতাসের সংস্পর্শে আসতে না পারে।

শুকানো রোদে পলিথিন সিট, মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে অথবা পাকা মেঝেতে বীজ শুকানো যেতে পারে। বীজ কখনোও মাটির উপর শুকাতে দেয়া উচিত নয়। খুব সকালে এবং পড়ন্ত বিকালে বীজ শুকানো উচিত নয়। সাধারণত সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত বীজ শুকানো ভাল। বীজ উত্তমরূপে শুকিয়ে ঠান্ডা করে গুদামজাত করতে হবে। বীজ শুকানো কি না তা দাঁত দিয়ে চেপে দেখতে হবে। কটকট শব্দ হলে সাধারণত ধারণা করা যায় যে, বীজ শুকিয়েছে। তবে সব থেকে ভালো উপায় আর্দ্রতামাপক যন্ত্র দিয়ে বীজের আর্দ্রতা মাপা হলো উত্তম পন্থা।

বীজ সংরক্ষণ:

শুকনো বীজ টিনের পাত্রে বা ড্রামে রাখলে ভাল থাকে। এছাড়া মোটা পলিথিন ব্যাগে বীজ রাখলেও বীজ ভালো থাকে। অন্যান্য পাত্র যেমন: মাটির পাত্র, বাঁশের ডোল ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ভাল নয়, কারণ এগুলো বায়ু নিরোধী নয়। মোট কথা যে পাত্রে বীজ রাখা হবে তা অবশ্যই বায়ু নিরোধক হতে হবে।

 

বীজ সংরক্ষণকালীন পরিচর্যা:

বায়ু নিরোধ পাত্রে রক্ষিত বীজ মাঝে মাঝে খুলে দেখতে হবে যে পোকার আক্রমণ হয়েছে কিনা এবং বীজের মধ্যে হাত দিয়ে দেখতে হবে গরম লাগে কিনা। যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে পূর্বে বর্ণিত পদ্ধতিতে বীজ শুকাতে হবে। যদি পোকা থাকে তাহলে বীজ চেলে পোকামুক্ত করতে হবে। যদি এভাবে পোকামুক্ত না হয় তবে বীজের সঙ্গে ঔষধ মিশিয়ে পোকা মেরে ফেলে বীজ ঠান্ডা করে পুনরায় গুদামজাত করতে হবে। ফসফিন ঔষধ মিশিয়েও পোকা মারা যায়, তবে ঔষধ মিশ্রিত বীজ কোন ক্রমেই খাওয়া যাবে না।

 

বীজ এর প্যাকিং:

উপরে বর্ণিত পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে সংরক্ষিত বীজ বিক্রয়ের জন্য ছোট ছোট প্যাকেট ভরে প্যাকেট এর গায়ে বীজের নাম, জাত, গুণগত মান ইত্যাদি লিখে প্রয়োজন মোতাবেক বাজারে সরবরাহ করা যেতে পারে। নিজে ব্যবহারের জন্য বীজ প্যাকিং করার প্রয়োজন নেই।

 

বীজ সংরক্ষণ:

অল্প সময়ের জন্য বস্তায় বীজ সংরক্ষনই উপযুক্ত পদ্ধতি। তবে বীজের বস্তা অবশ্যই পরিষ্কার, শুষ্ক এবং পোকামাকড় মুক্ত হতে হবে। বীজ ভর্তি প্রতিটি বস্তা যথাযথভাবে চিহ্নিত হতে হবে (যেমন: বীজের নাম, জাতের নাম, উৎপাদনের উৎস) ইত্যাদি। বস্তাগুলো সরাসরি মেঝের উপর না রেখে কাঠের মাচার উপর রাখা উচিত। গাদা করে গাদার উচ্চতা

দানা শস্য বীজের বেলায় ৩—৪ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। বীজের বস্তা খুব সাবধানের নাড়াচাড়া করা উচিত যাতে কোন যান্ত্রিক ক্ষতের (গবপযধহরপধষ উধসধমব) সৃষ্টি না হয়। বীজের বস্তার উপর হাঁটা বা বীজের বস্তার উপর বসে থাকা মোটেও উচিত নয়। সাময়িক সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত গুদাম অবশ্যই পরিচ্ছন্ন, শুষ্ক, শীতল হতে হবে এবং ম্যালথিয়ন দ্বারা স্প্রে করে নিতে হবে।

পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে ফিউমিগেট করে নিতে পারলে ভাল হয়। ফসটকসিন প্যালেটস ফিউমিগেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আর্দ্রতা প্রতিরোধক যে কোন পাত্র যেমন: ধাতব টিন, ড্রাম ইত্যাদি বীজ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা অবশ্যই নির্ধারিত মাত্রায় থাকতে হবে এবং পাত্রটি বায়ুরোধক হতে হবে।

 

 

বীজ সংরক্ষণের অর্থ জীবনের সংরক্ষণ। অনুপযুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণের ফলে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে থাকে। এমনকি বীজের জীবন অবসানও ঘটাতে পারে। নির্দিষ্ট সংরক্ষণ কালের পর বীজের তেজ ও মান নিম্নবর্ণিত বিষয়সমূহের পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর নির্ভর করে।

১। সংগ্রহকালে বীজের তেজ ও মান।

২। বীজের জাত।

৩। সংরক্ষণাগারে পারিপাশ্বিক অবস্থা বিশেষ করে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।

৪। বীজের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার হার।

 

বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি:

বীজ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। সংরক্ষণকালে বীজের পারিপাশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বর্ণিত চার পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

১। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই খোলা অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণের জন্য ডোল, বস্তা, গোলা, টিন কিংবা মাটির পাত্র, কাঁচের বোতল ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শুষ্ক ও ঠান্ডা মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। কিন্তু উষ্ণ ও আর্দ্র মৌসুমে অধিকাংশ সবজি বীজের জন্য এ সংরক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করতে হলে পোকা দমন করার জন্য ফিউমিগেশন করা অথবা কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে সাধারণত সবজি বীজ এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। বীজকে রোদে শুকিয়ে উপরোল্লিখিত যেকোন পাত্রে রেখে দেয়া হয়।

এ পদ্ধতিতে বীজের জলীয় ভাগ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় না। কুমড়া জাতীয় সবজি, ডাটা, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি বীজ এ পদ্ধতিতে অন্তত: ১ (এক) বৎসর সংরক্ষণ করা যায়।

অল্প পরিমাণ গম বীজ তেলের ড্রাম কিংবা কেরোসিন বা বিস্কুটের টিনে সংরক্ষণ করা যায়। তবে নিশ্চিত হতে হবে যে, পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার, পাত্রের গায়ে কোন প্রকার ছিদ্র নেই এবং পাত্রের মুখ বন্ধ করে দিলে ভিতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে অথাৎ পাত্রটি সম্পূর্ণরূপে বায়ুরোধক হতে হবে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে অধিক পরিমাণ বীজ সংরক্ষণ করতে হলে কীটপতঙ্গমুক্ত পরিষ্কার ও শুকনা চটের বস্তায় এবং বীজ সংরক্ষণের উপযুক্ত গুদামে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

প্রতি তিন দিন পর হিমাগারের দরজা খুলে খুব সকালে মুক্তবাতাস দিতে হবে। সংরক্ষণ কালে অন্ততঃপক্ষে দু’বার বস্তা উল্টিয়ে দিলে বীজ ভালো থাকে এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে অঙ্কুরিত হয় না। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রনবিহীন হিমাগারে কোনক্রমেই সবজি বীজ খোলা অবস্থায় রাখা উচিত নয়। তবে বায়ুরোধক পাত্রে বীজ রেখে তা অনায়াসে এ জাতীয় হিমাগারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

২। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পন্ন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

এ ধরনের হিমাগারকে ডি—হিউমিডিফাইড কোল্ড স্টোরেজ বলে। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ সংরক্ষনের জন্য এ হিমাগার অত্যন্ত
উপযোগী। এ হিমাগারের তাপমাত্রা সাধারণত ১০ সে: ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৫০% এর উপর রাখা হয় না। এ অবস্থায় রাখা বীজ ৩—৮ বৎসর পর্যন্ত সজীব ও সতেজ থাকে অবশ্য এই ধরনের হিমাগার স্থাপন ও পরিকল্পনা ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে বীজ গুদামের অভ্যন্তরে বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

 

৩। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বীজ সংরক্ষণ:

এ পদ্ধতিতে শুকনা বীজকে বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। আর্দ্র মৌসূমে বীজ সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এ পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষনের জন্য বায়ুরোধক টিন, এলুমিনিয়াম, কাঁচ কিংবা প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও মোটা পলিথিনের ব্যাগ এলুমিনিয়াম ফয়েল সংযুক্ত কাগজের ব্যাগ এবং বার্ণিশ করা বা বিটুমিনের প্রলেপ দেয়া মাটির পাত্র ও ব্যবহার করা চলে। তবে পাত্রের মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দিতে হবে যাতে ভিতর দিয়ে কোন বাতাস চলাফেরা না করে। অল্প পরিমাণ বীজ হলে তা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড কিংবা সিলিকাজেল সমেত ডেসিকেটর বা বীজ জারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

 

আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণবিহীন হিমাগারে বীজ সংরক্ষণ:

অধিকাংশ হিমাগারে সাধারণতত: ৮০% এর উপর আর্দ্রতা রাখা হয়। এসব হিমাগার আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি উচ্চ জলীয়ভাগ সম্পন্ন কৃষিজাত দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বীজ আলু হিমাগারে নেয়ারপূর্বে ২৪—২৮ ঘন্টা কাল ১৬—১৮০ সে. তাপমাত্রায় প্রিকুলিং (চৎব—পড়ড়ষরহম) করতে হয়। অতঃপর বস্তা হিমকক্ষে তাকের উপর খাড়াভাবে রেখে আস্তে আে¯ Í তাপমাত্রা কমিয়ে ৪ ০ সে. এ নামিয়ে আনতে হয়। হিমাগারের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮০% বা তার বেশি হওয়া দরকার।

সারাংশ :

বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বাজারজাত ও ভবিষ্যতের ব্যবহারে উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করা হয়। বীজের প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে বীজের আর্দ্রতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিচর্যা সঠিকভাবে করতে হবে। অনুপযুক্ত অবস্থায় বীজ সংরক্ষণ করা যাবে না। এতে বীজের তেজ ও মানের অবনতি ঘটে।

 

 

পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল

পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট – ৪, পাঠ-৪.২।

পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন কৌশল

পিঁয়াজের বীজ উৎপাদন পিঁয়াজ একদিকে একটি মসলা এবং অপরদিকে একটি সবজিও বটে। পিঁয়াজের পাতা ও ডাঁটা ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। সাধারণত রবি মৌসুমে পিঁয়াজ চাষ করা হয়। এর জন্য উপযুর্ক্ত তাপমাত্রা হলো ১৫—২০০ সে.। গাছ বৃদ্ধির প্রথম দিকে তাপমাত্রা কম থাকা ভালো। কন্দের বৃদ্ধি ও পরিপক্কতা পর্যায়ে তাপমাত্রা কিছু বেশি এবং শুষ্ক বাতাস বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পিঁয়াজের ফুল ধারনের জন্য নিম্ন তাপমাত্রা প্রয়োজন। পিঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য কন্দ বা বাল্ব উৎপাদন করা হয়। সাধারণত কন্দ থেকে উৎপাদিত পিঁয়াজ পরবর্তী বছর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালেও পিঁয়াজের আবাদ শুরু হয়েছে।

 

পিঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ধাপগুলো নিচে বর্ণনা করা হল:

১। মাটি ও আবহাওয়া:

দোঅঁাশ ও বেলে দোঅঁাশ মাটি পিঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়। ১৫—২০০ সে. তাপমাত্রা পিঁয়াজ চাষের জন্য উপযোগী। মাটির অম্লমান ৬.৫—৭.৫ পিঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম।

২। জমি তৈরি:

গভীর চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। বড় ঢেলা ভেঙ্গে সমতল ও আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। মাটি ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে যাতে পিঁয়াজের শিকড় ও কন্দের বৃদ্ধি ভাল হয়।

৩। বপন/রোপন পদ্ধতি ও সময়:

সরাসরি জমিতে বীজ বুনে, কন্দ ও চারা রোপন করে পিঁয়াজ উৎপাদন করা হয়। বৃষ্টিপাতজনিত সমস্যা না থাকলে আগাম ফসলের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে কন্দ রোপন করা যায়।

 

৪। বীজের পরিমাণ:

কন্দের আকারভেদে হেক্টর প্রতি প্রায় ১.২—১.৫ টন কন্দের প্রয়োজন।

 

৫। সার প্রয়োগ:

বীজ পিঁয়াজের জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

 

ইউরিয়া ও এমওপি সারের অর্ধেকসহ অন্যান্য সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি সার কন্দ রোপনের ২৫—৫০ দিন পর দিতে হবে।

 

৬। কন্দ নির্বাচন ও রোপন:

প্রতি কেজিতে ৭০ থেকে ১০০ পেঁয়াজ ধরে এরূপ আকারের কন্দ বীজ পিঁয়াজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। কন্দ থেকে কন্দের রোপন দূরত্ব হবে ১৫ সে.মি. এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩০ সে.মি.।

 

৭। অন্তর্বতীকালীন পরিচর্যা:

পিঁয়াজের জমিতে মাটির প্রয়োজনীয় রস না থাকলে প্রতি ১০—১৫ দিন অন্তর পানি সেচ প্রয়োজন, পিঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং পিঁয়াজের জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জমি আগাছামুক্ত রাখা বাঞ্চনীয়, এমনভাবে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে যাতে পিঁয়াজের শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।

 

৮। পোকমাকড় দমন:

থ্রিপস ও জাব পোকা পিঁয়াজের পাতা ও কচি ডগার রস শুষে গাছের ক্ষতি করে। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করে পোকা দমন করা যায়।

৯। রোগবালাই দমন:

পিঁয়াজের রোগের মধ্যে গোড়াপঁচা ও অলটারনারিয়া লিফ ব্লাইট (পার্পল ব্লচ) প্রধান। গোড়াপঁচা রোগে গাছের গোড়া পচে যায়। এক্ষেত্রে ডাইথেন এম—৪৫ ২০ গ্রাম/১০লিটার প্রতি হেক্টরে স্প্রে করে ভাল ফল পাওয়া যায়। অলটারনারিয়া লিফ ব্লাইট হলে পাতায় লালচে রং এর ঠোসা দেখা যায়। পরে পাতা কালো হয়ে পুড়ে যায়। এ রোগ দমনের জন্য রোভরাল ৫০ ডব্লিউপি (২০ গ্রাম/ ১০ লিটার, প্রতি হেক্টরে) স্প্রে করতে হবে।

 

১০। রোগিং:

বীজ ক্ষেত থেকে রোগাক্রান্ত সন্দেহযুক্ত ও অন্য জাতের গাছ তুলে ফেলাকে রোগিং বলে। পিঁয়াজ বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুল আসার আগে, ফুল আসার সময় এবং ফল পরিপক্ক পর্যায়ে রোগিং করতে হয়।

 

১১। বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

কন্দ রোপনের দুই থেকে আড়াই মাস পর পিঁয়াজ গাছে ফুল আসে এবং এর ৬—৭ সপ্তাহ পর ফল পাকতে শুরু করে। ফল পেকে শুকিয়ে গেলে এবং কালো রং ধারণ করলে তখন সেগুলোকে সংগ্রহ করতে হবে। একবারে সকল ফল পাকে না বিধায় ২—৩ বারে সংগ্রহ করতে হবে। ডাঁটার খানিক অংশ সহ ফলগুলো তুলে ভালো করে শুকিয়ে মাড়াই ও ঝাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এরপর বীজগুলো ভালভাবে শুকিয়ে বায়ুবন্ধ টিনে বা পলিথিন ব্যাগে ভরে শুকনা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।

 

১২। ফলন :

হেক্টরপ্রতি ফলন ৭০০—৮০০ কেজি হতে পারে।

সরিষা বীজ উৎপাদন সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তৈলবীজ ফসল। সরিষা বীজে ৪০—৪৪% তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০% আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। খৈল একটি উৎকৃষ্ট জৈব সার। বাংলাদেশে সাধারনত রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়।

 

 

উৎপাদন প্রযুক্তি:

১. জমি ও মাটি নির্বাচন:

উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু জমি যেখানে বৃষ্টি বা সেচের পানি জমে না অথবা বন্যার পানি আগাম সরে যায় সেখানে সরিষার আবাদ করা যায়। দেঁাআশ ও এঁটেল দেঁাআশ এবং বর্ষার পলি পড়ে এমন মাটি সরিষা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

 

২. জমি তৈরি:

জমি ৪—৫ বার ভাল করে চাষ ও মই দিতে হবে। এমনভাবে জমি সমতল করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি বেরিয়ে যায়। মাটি অত্যন্ত মিহি হতে হবে কারণ সরিষা বীজ খুব ছোট।

 

৩. সার প্রয়োগ:

জাত, মাটি ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হবে। ইউরিয়া সার অর্ধেক ও অন্যান্য সমুদয় সার বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক ইউরিয়া গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি প্রয়োগের জন্য মাটিতে রস থাকা দরকার।

 

৪. বীজ বপন পদ্ধতি:

অক্টোবর—নভেম্বর মাস সরিষার বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য অক্টোবর থেকে শেষ অক্টোবর এই সময়ের মধ্যে সরিষা বীজ বপন করা উত্তম। জাতভেদে বীজের হার ৭—৯ কেজি প্রতি হেক্টরে। সাধারণত সরিষা বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়। জমিতে সমভাবে ছিটানোর জন্য বীজের সাথে ছাই, বালি বা গুঁড়া মাটির যে কোন একটি মিশিয়ে বপন করা ভাল।

 

৫. আন্ত:পরিচর্যা:

জমিতে বীজ বপনের ১৫—২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে। জমিতে রসের পরিমাণ কমে গেলে সেচ দিতে হবে বিশেষ করে উঁচু জমিতে ১—২ বার সেচ দেয়া প্রয়োজন। একবার সেচ দিলে সাধারণত বীজ বোনার ২৫—৩০ দিন পর (ফুল ফোটার শুরুতে) দিতে হবে। দু’বার সেচের প্রয়োজন হলে বীজ বোনার ২৫—৩০ দিন পর প্রথম এবং এবং ৪০—৬০ দিন পর (শুটি বৃদ্ধির সময়) দ্বিতীয় সেচ দেওয়া দরকার।

 

৬. পৃথকীকরণ দূরত্ব:

সরিষা পরপরাগায়নধর্মী ফসল হওয়ায় এর বীজ ফসলের মাঠ একই পরিবারভুক্ত অন্যান্য জাতের ফসল বা একই জাতের ফসলের মাঠ থেকে ১০০০ মিটার দূরে অবস্থিত হতে হবে। এতে করে জাতের বিশুদ্ধতা বজায় থাকবে।

 

 

৭. রোগবালাই দমন:

অলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট অলটারনারিয়া ব্লাইট বা পাতা ঝলসানো রোগ সরিষার অন্যতম মারাত্মক রোগ। এ রোগ হলে গাছের বয়স্ক পাতায় গাঢ় বাদামি দাগ দেখা যায়, পরে দাগ গাছের কান্ডে শুটি বা বীজে আক্রমণ করে, এ রোগ প্রতিরোধ করতে হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ও রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। আক্রান্ত সরিষা ক্ষেতে ২.৫ গ্রাম ক্যাপটেন বা ভিটাভেক্স—২০০ দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হয়। এ রোগের আক্রমণ বেশি হলে রোভরাল—৫০, ডাইথেন এম—৪৫ বা এ জাতীয় ঔষধ ২ গ্রাম প্রতি লিটারে মিশিয়ে ১২ দিন পর পর ৩বার স্প্রে করতে হবে।

 

৮. রোগিং:

সরিষা বীজ ফসলের জমিতে বেশ কয়েকবার রোগিং করতে হয়। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে আগে ফুল আসা গাছ, হলুদ ফুলের মধ্যে সাদা ফুলযুক্ত গাছ, বিজাতীয় বা অন্য জাতের গাছ এবং স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা গাছ উঠিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে।

 

৯. পোকামাকড় দমন:

জাব পোকা সরিষা ক্ষেতে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। পূর্নবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই সরিষার পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল হতে রস হতে রস শোষণ করে। এ পোকার আক্রমণ হলে ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা জুলন ৩৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলিমিটার হারে মিশেয়ে সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক অবশ্যই বিকেলে স্প্রে করতে হবে। সকালের দিকে স্প্রে করলে মৌমাছির ক্ষতি হয়। মৌমাছি পরাগায়নের জন্য উপকারী।

 

১০. ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

বিভিন্ন জাতের সরিষা পাকতে বিভিন্ন সময় লাগে। সাধারণত টরি সরিষা পাকতে ৭০—৮০ দিন এবং অন্যান্য সরিষা পাকতে ৯০—১১০ দিন সময় লাগে। গাছের শতকরা ৭০—৮০ ভাগ শুটি পাকলে সকালের ঠান্ডা পরিবেশে গাছ কেটে মাড়াইয়ের স্থানে নিতে হবে। তারপর ২—৩ দিন রোদে শুকিয়ে লাঠি দ্বারা পিটিয়ে মাড়াই করতে হয়। ফল অতিরিক্ত পাকলে মাঠে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। মাড়াইয়ের পর বীজ ২/৩ দিন রোদে শুকিয়ে শুকনা বীজ যেকোন পরিষ্কার এবং শুকনো পাত্রে দুবছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

সারাংশ :

সরিষা বাংলাদেশের প্রধান তৈলবীজ ফসল। রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা পরিচর্যার মাধ্যমে সরিষা বীজ উৎপাদন করলে রোগ মুক্ত ও অধিক ফসল পাওয়া যায়।

 

আলুর বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি

আলুর বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি – পাঠটি বাউবির “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়র “বীজ উৎপাদন” অধ্যয়ের এর ইউনিট-৩, পাঠ-৪.১। বাংলাদেশে গমের পরই আলুর স্থান। ১৯৬০ সাল থেকে বিদেশের বহু আলুর জাত বাংলাদেশে চাষ করা হচ্ছে। পৃথিবীর ৪০ টির ও বেশি দেশে আলু প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আলুর বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি

 

উন্নত মানের আলু বীজ উৎপাদন :

১। জমি নির্বাচন ও তৈরি:

বীজ আলু চাষের জন্য বেলে দেঁাআশ মাটি উত্তম। জমিতে একই গোত্রভুক্ত (সোলানেসী) ফসল যেমন—আলু, টমেটো, মরিচ, তামাক ইত্যাদি ক্ষেত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে রাখতে হবে। মাটি ৫—৬ টি চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত করতে হবে। মাটি বেশি শুকনো হলে সেচ দিয়ে মাটিতে “জো” আসার পর আলু লাগাতে হবে।

২। বীজ শোধন:

আলু হিমাগারে রাখার আগে শোধন করা হয়ে না থাকলে অঙ্কুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু বরিক এসিড দ্রবণে (২০ গ্রাম/লিটার) ১৫—২০ মিনিট চুবিয়ে ছায়ায় শুকাতে হবে।

 

৩। বীজ প্রস্তুতি:

বীজ আলু ্উৎপাদনের জন্য আস্ত আলু ব্যবহার করা ভাল, এতে বপনের পর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। আলু কেটে লাগালে প্রতি কাটা অংশে কমপক্ষে ২টি চোখ থাকতে হবে। আলু কাটার সময় সাবান পানি দ্বারা বারবার ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগজীবাণু এক বীজ হতে অন্য বীজে ছড়াতে না পারে। বীজ আলু না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হয়। টিস্যু কালচার পদ্ধতি এবং প্রকৃত বীজের মাধ্যমেও আলুর চারা উৎপাদন করা হয়।

 

৪। মাটি শোধন:

ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি শোধন করা উচিত। এতে মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু মারা যাবে।

 

৫। সুষম সার প্রয়োগ:

আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত বীজ আলুর গুণগত মান ভালো হওয়ার জন্য সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০—৩৫ দিন পর গাছের গোড়ায় মাটি তুলে প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে।

 

৮। সেচ ব্যবস্থাপনা:

মাটির আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করে ২—৪ টি সেচ প্রদান করা উচিত। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বীজ আলুর অঙ্কুরোদগমের জন্য হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। তবে সেচ বেশি হলে বীজ পচে যাবে। বপনের ৩০৩৫ দিন পর ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে।

 

৯। আগাছা দমন:

বীজ বপনের পর থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত মাঠে আগাছা পরিস্কার রাখতে হবে। গাছ ছোট অবস্থায় থাকাকালীন আগাছা যথাসম্ভব দমন করে রাখতে হবে।

 

 

১০। রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন:

আলুর রোগ ও পোকা মাকড় সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হলো—

(ক) আলুর রোগ:

আলুর রোগসমূহের মধ্যে মড়ক রোগ, ঢলে পড়া রোগ, দাদ রোগ, কান্ড পচা রোগ ও ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। নিম্নতাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও মেঘলা আকাশ আলুর চাষের জন্য ক্ষতিকর। এতে আলুর মড়ক রোগের (লেট ব্লাইট) আক্রমণ বেশি দেখা যায়। এ অবস্থা থেকে ফসলকে রক্ষা করার জন্য ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হবে।

(খ) আলুর পোকা:

আলুতে আক্রমণকারী পোকার মধ্যে কাটুই পোকা, আলু গাছ কেটে দেয় এবং আলু আক্রমণ করে। কাটুই পোকার উপদ্রব বেশি না হলে গাছের আশে পাশের মাটি খঁুড়ে কীড়া খঁুজে মেরে ফেলতে হবে। জাব পোকা আলু গাছের রস খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। গাছের পাতা গজানোর ৭—১০ দিন পর কীটনাশক প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়। সুতলী পোকা আলুর মধ্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করে আলুর ক্ষতি সাধন করে। এজন্য বীজ আলুতে সুতলী পোকা আক্রাš Í আলু বেছে আলু বপন করতে হবে।

 

১১। ফসল সংগ্রহ এবং পরিচর্যা:

আলুর পরিপক্কতা আসতে ৮৫—৯০ দিন সময় লাগে। বীজ আলু সংগ্রহের অন্তত ১০ দিন আগে সেচ বন্ধ করতে হবে।

 

১২। হামপুলিং:

মাটির উপরের আলু গাছের সম্পূর্ণ অংশকে উপড়ে ফেলাকে হামপুলিং বলে। আলু সংগ্রহের ৭—১০ দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। এতে সম্পূর্ণ শিকড়সহ গাছ উপড়ে আসবে কিন্তু আলু মাটির নিচে থেকে যাবে।

 

১৩। আলু সংগ্রহে ও সংরক্ষণ:

আলু তোলার পর কোনো অবস্থাতেই ক্ষেতে স্তুপাকারে রাখা যাবে না কারণ বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকা দ্বারা আলু আক্রান্ত হতে পারে। আলু উত্তোলনের পর সাথে সাথে কাটা, দাগি ও পচা আলু আলাদা করে বেছে ফেলতে হবে। তারপর ৭—১০ দিন ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে রাখতে হবে। অত:পর আবারও দাগি ও পচা আলু বেছে বাদ দিতে হবে, পরে আলু ব¯ায় ভÍ রে হিমাগারে রাখতে হবে।

 

 

সারাংশ :

বাংলাদেশে গমের পরেই আলুর স্থান। বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পরিমিত ও সময়মতো সার প্রয়োগ, আন্তঃপরিচর্যা রোগ বালাই দমন ইত্যাদি সঠিকভাবে করলে ভাল আলু বীজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

 

পানি নিস্কাশন [ পানি সেচ ও নিষ্কাশন ]

পানি নিস্কাশন , পানি সেচ ও নিষ্কাশন , ইউনিট ৩ , পাঠ – ৩.৪ , পানি নিষ্কাশন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা সেচ, বন্যা বা জলোচ্ছাস প্রভৃতির মাধ্যমে ফসলের জমিতে অতিরিক্ত পানি জমা হতেপারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি উন্নয়ন ও ভালো ফসলের জন্য জমি থেকে গাছের জন্য অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় পানি অপসারন করাকে পানি নিস্কাশন বলে।

পানি নিস্কাশন , পানি সেচ ও নিষ্কাশন

পানি নিস্কাশনের প্রয়োজনীয়তা :

জমি হতে সময়মত অতিরিক্ত পানি নিস্কাশনের ফলে ফসলের যে উপকার হয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. অতিরিক্ত পানি অপসারণ করলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় ফলে গাছের মূলের বৃদ্ধি ভালো হয়। অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গাছের মূল মারা যায়। পানি নিস্কাশন করলে গাছ সতেজ হয়, পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু সহজে আক্রমন করতে পারে না।

২. পানি নিস্কাশনের ফলে পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বাড়ে।

৩. অতিরিক্ত পানি সরে গেলে অক্সিজেনের পরিমান বাড়ে এবং সাথে সাথে বিভিন্ন গৌন পুষ্টি উপাদান যেমন ম্যাংগানিজ, জিংক, কপারের বিষাক্ততা কমে যায়।

৪. পানি নিস্কাশনের ফলে মাটিতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া যেমন নাইট্রোজেন আবদ্ধকারী ব্যাকটেরিয়া, জৈব পদার্থ বিয়োজনকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় বলে মাটিতে পুষ্টি উপাদান সহজলভ্য হয়।

 

 

৫. পানি অপসারণ করলে মাটির তাপমাত্রা বাড়ে যা বীজ অংঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত হয়।

৬. অতিরিক্ত পানির সাথে ক্ষতিকর লবন অপসারণ হয়।

৭. শস্য উৎপাদন মৌসুমের ব্যপ্তিকাল হ্রাস করা সম্ভব হয়। কারণ জমি হতে অতিরিক্ত পানি সরালে আগাম অথবা সময়মত ফসল লাগানো সম্ভব হয় এজন্য পরবতীর্ ফসল ও সময়মতো লাগানো যায়।

৮. অধিকাংশ ফসলই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না যেমন তোষা পাট, মরিচ, তুলা, বেগুন ইত্যাদির জন্য পানি নিস্কাশন অত্যাবশ্যক।

৯. জমিতে অতিরিক্ত পানির জন্য গাছের মূল ঠিকমত বিস্তার লাভ করতে পারে না। পরবতীর্তে মাটির উপরিস্তর শুকিয়ে
গেলে অগভীর মূলের জন্য নিচের স্তরের পানি নিতে পারে না। যেমন আমন ধানের ক্ষেত্রে এ সমস্যা দেয়া যায়।

১০. মাটিতে উদ্ভিদের জন্য বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের উৎপাদন কম হয়।

১১. বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের হাত থেকে ফসল রক্ষা করা যায়।

 

 

পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময় নিধার্রন কৌশল ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য ফসলের জমিতে সেচ দেয়া যেমন জরুরী তেমনি জমি থেকে অতিরিক্ত পানি অপসারণ করাও জরুরী। মাটির বুনট, ফসলের প্রকৃতি, ফসলের জীবনকাল, বৃষ্টিপাতের ধরণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পানি নিস্কাশনের উপযুক্ত সময় নিধার্রণ করা হয়। ধানের পানি নিস্কাশনের সময়
চারা রোপনের সময় জমির পানি খুব কম গভীরতায় রাখা।

১. চারা রোপনের পর ৫ম থেকে ৮ম দিন পর্যন্ত অবিরতভাবে ৩—৫ সে.মি. পানি রাখা।

২. কুশি হওয়া ত্বরান্বিত করার জন্য রোপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত পানি নিস্কাশন করা।

৩. রোপনের ৫৫ হতে ৭০ দিন পর্যন্ত জমিতে ৭—১০ সে.মি. পানি আটকে রাখতে হবে যাতে কুশি হওয়া কমে যায়।

৪. এরপর ৭০—৮০ দিন পর্যন্ত জমির পানি কমিয়ে ফেলতে হবে প্রায় ৩ সে.মি. এ নামিয়ে আনা।

৫. রোপনের ৮০ দিন থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত আবার পানির গভীরতা ৭—১০ সে.মি. এ বাড়িয়ে দেয়া।

৬. ফসল কাটার সুবিধার্থে ফসল কাটার এক সপ্তাহ আগে জমি থেকে পানি বের করে দেয়া।

 

ডাল জাতীয় শস্যে পানি নিস্কাশনের সময় :

ডাল জাতীয় শস্য কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারেনা। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে জমিতে পানি থাকলে তা মূলের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় ও মূলে গুটি গঠনে বাঁধা দেয়। মাটিতে বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য পানি নিস্কাশন করতে হবে।

পাট : তোষা পাট জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। দেশী পাট জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে কিন্তু পরিপক্ক পর্যায়ে পানি জমে থাকলে গোড়ার দিকে শিকড় হয়ে পাটের গুনগতমান কমিয়ে দেয়। এজন্য পরিপক্ক পর্যায়ে পানি নিস্কাশন করতে হবে।

তুলা : তুলার বল গঠনের সময় জমিতে অতিরিক্ত পানি থাকলে তা বল বিলম্বিত করে। তাই পুস্পায়নের পর জমিতে পানি জমা থাকলে তা নিস্কাশন করতে হবে।

 

পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাপনা :

প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ফসলের জমি হতে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে অপসারণ করে কাঙ্খিত ফলন পাওয়াই পানি’ নিস্কাশনের মূল উদ্দেশ্য। কোন জমিতে পানি নিস্কাশন পদ্ধতি নির্ভর করে ভূ—গর্ভস্থ পানির তল, পানির উৎস, জমির প্রকার ইত্যাদির উপর। প্রধানত দুইটি পদ্ধতিতে পানি’ নিস্কাশন করা হয়।

১. খোলা নালা পদ্ধতি
২. বদ্ধ নালা পদ্ধতি

১. খোলা নালা পদ্ধতি :

আমাদের দেশে এ পদ্ধতি বেশি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে জমির উপর কয়েকটি প্রধান নালা কাটা হয়। এরপর আরও কিছু শাখা নালা কাটা হয় এবং প্রধান নালার সাথে যুক্ত করা হয়। এ নালার গভীরতা ও প্রশস্থতা মাটির প্রকারের উপর নির্ভর করে। পানি দ্রুত অপসারনের জন্য নালা একদিকে ঢালু হওয়া প্রয়োজন।

সুবিধা
১. পানি ‘নিস্কাশন দক্ষতা বেশি।
২. কাঁদা বুনটের মাটির জন্য উপযুক্ত।
৩. ভূ—গর্ভস্থ পানির তল উচঁু হলে ও পানি ‘নিস্কাশন সম্ভব।

অসুবিধা
১. নালা তৈরিতে জমি নষ্ট হয়।
২. ভূমি ক্ষয় হয়।
৩. বেলে মাটির জন্য উপযুক্ত নয়।
৪. কৃষি যন্ত্রপাতি চলাচলে সমস্যা হয়।

 

২. বদ্ধ নালা পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে ১—১.৫ মিটার গভীরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নালা তৈরি করা হয় এবং নালা—গুলিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। অতিরিক্ত পানি মাটির রন্ধে্রর মাধ্যমে নিচে গিয়ে নালাার মাধ্যমে নিকাশ হয়।

সুবিধা
১. জমির অপচয় হয় না।
২. ভূমি ক্ষয় হয় না।
৩. ভূ—গর্ভস্থ পানি অপসারনের জন্য উপযোগী।
৪. হালকা বুনটের মাটিতেও এ পদ্ধতিতে নিস্কাশন করা যায়।

অসুবিধা
১. নালা তৈরির জন্য প্রাথমিক খরচ খুব বেশি।
২. নিকাশ দক্ষতা কম।
৩. ভারী বুনটের মাটিতে এ পদ্ধতি তেমন কার্যকর নয়।
৪. এ পদ্ধতির জন্য কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়

সারাংশ :
ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ভালো ফলনের জন্য জমি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অপসারণই পানি ‘নিস্কাশন। পানি নিস্কাশণের ফলে বায়ু চলাচল পথ সুগম হয়, পুষ্টি উপাদানের সহজলভ্যতা বাড়ে। ক্ষতিকর লবণ অপসারিত হয়। এছাড়াও আরও অনেক উপকারী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পানি’ নিস্কাশন পদ্ধতি দুই প্রকার; বন্ধ নালা পদ্ধতি, খোলা পদ্ধতি।

ব্যবহারিক : কয়েকটি টব ব্যবহার করে পানি বদ্ধ অবস্থায় ধান চাষের সাথে ঝজও এর তুলনা , ইউনিট-৩ , পাঠ-৩.৪ , মূলতত্ব : ঝজও হলো কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যেখানে পরিবর্তিত ফসল, মাটি, পানি ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধানের ফলন বৃদ্ধি করা হয়। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো ধান ক্ষেতে অবিরাম প্লাবিত পানি রাখার পরিবর্তে সর্বনিম্ন পরিমান পানি প্রদান করা এবং মূল ও কুশি জন্মানোর জন্য অধিক জায়গা বরাদ্দের উদ্দেশ্য বগার্কারে খুব ছোট চারা রোপন করা। পানিবদ্ধ অবস্থায় ধান চাষ গতানুগতিক পদ্ধতি এবং ঝজও পদ্ধতিতে ধান চাষ একটি আধুনিক পদ্ধতি।

 

ব্যবহারিক : কয়েকটি টব ব্যবহার করে পানি বদ্ধ অবস্থায় ধান চাষের সাথে ঝজও এর তুলনা

প্রয়োজনীয় উপকরণ

১. মাটির তৈরি মাঝারী আকারের ৪টি টব।

২. বোরো ধানের চারা

৩. জৈব ও রাসায়নিক সার

৪. দোঅঁাশ মাটি

৫. পানি

৬. নিড়ানি

৭. খাতা, কলম ইত্যাদি

 

কার্যপদ্ধতি

১. প্রথমে দোঅঁাশ মাটির সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিমান জৈব সার এবং সামান্য পরিমান রাসায়নিক সার নিয়ে খুব ভালোভাবে মিশান।

২. এরপর ঝজও পদ্ধতির জন্য দু’টি বড় টব এ মাটি দিয়ে ২/৩ ভাগ পর্যন্ত ভর্তি করুন।

৩. এরপর গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় রাসায়নিক সার মিশিয়ে অন্য দু’টি বড় টব ২/৩ অংশ পর্যন্ত ভর্তি করুন।

৪. ঝজও পদ্ধতির জন্য প্রথমে কাদা করে ৩০ সে.মি. দূরে ১টি করে ১০—১২ দিনের চারা রোপন করুন।

৫. গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য কাদা করে ২৫—৩০ দিন বয়স্ক ৩—৪ টি চারা ১৫ সে.মি. দূরে রোপন করুন।

৬. ঝজও পদ্ধতির জন্য টব দু’টিতে পর্যায়ক্রমিক ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করুন।

৭. গতানুগতিক পদ্ধতির জন্য সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থার সেচ প্রদান করুন অথার্ৎ সবসময় পানি ভতি করে রাখুন।

৮. উভয় পদ্ধতির ধানের চারার পরিচর্যা করুন।

৯. উভয় পদ্ধতিতে লাগানো ধানের চারার বৃদ্ধি ও অন্যান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করুন এবং সিদ্ধান্ত নিন।
সিদ্ধান্ত : ঝজও পদ্ধতিতে লাগানো ধান গাছগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বেশি কুশি উৎপন্ন হচ্ছে। অন্যদিকে গতানুগতিক জলাবদ্ধ অবস্থার ধান গাছের বৃদ্ধি ও কুশি উৎপাদন কম হচ্ছে।

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি  “পানি সেচ ও নিষ্কাশন” বিষয়ক ইউনিট ৩ এর ৩.৩ নম্বর পাঠ।

ধানের পানি সেচ ব্যবস্থাপনা

ধানের ফসল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হয়। ঝজও পদ্ধতিতে চাষ করার কৌশল সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালের দিকে মাদাগাস্কারে উদ্ভাবিত হয়। এই পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন, রোপন, সেচ, সার, কীটনাশক কম লাগে। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা করতে হয় এবং ফলন বেশি হয়।

 

ঝজও পদ্ধতিতে ধান চাষের মূলনীতি/বৈশিষ্ট্য:

১. এ পদ্ধতিতে ধান চাষের ক্ষেত্রে ৮—১২ দিন বয়সের চারা একটি করে রোপন করতে হয়।

২. বীজতলা থেকে চারা তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে চারা ভেঙ্গে না যায়; চারা তোলার পর পরই রোপন করতে হবে।

৩. চারা বর্গাকারে ২৫—৪০ সে.মি দূরত্বে লাগাতে হবে; অথার্ৎ সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব সমান। বর্গাকারে লাগানো গাছ পর্যাপ্ত আলো—বাতাস পাবে এবং আগাছা দমন সহজ হবে।

৪. জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে এবং যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সারও প্রয়োগ করতে হবে।

৫. মাটি পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো (অডউ) পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে। এতে মূলের বৃদ্ধি ভালো হবে ও মাটির অনুজীবের কার্যাবলী বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও মিথেন গ্যাস উৎপাদন কম হবে।

৬. ধানের থোড় অবস্থা থেকে ফসল পাকার ১৫ দিন আগ পর্যন্ত ধানের জমিতে ১—২ সে.মি. এর একটি পানির স্তর রাখতে হবে।

 

 

ঝজও পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন কৌশল :

ঝজও পদ্ধতিতে ধান উৎপাদন কৌশলগুলো নিচে ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো—

 

১. চারার বয়স :

ঝজও পদ্ধতিতে খুব কম বয়সের (৮—১২ দিনের) চারা রোপন করা হয়। প্রতি গুছিতে একটি করে চারা রোপন করা হয়। কম বয়সের চারা শক্ত থাকে বলে মারা যায় না এবং আগাম থোড় বের হয় না। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে ১০—১৫ দিন আগে ধান পরিপক্ক হয়।

 

২. রোপন দূরত্ব :

এ পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫—৪০ সে.মি. করে বর্গাকারে চারা রোপন করা হয়। এতে গাছ আলো বাতাস বেশি পায়, কুশি বেশি হয় এবং ফলনও বেশি হয়।

৩. সার প্রয়োগ :

এ পদ্ধতিতে প্রচুর জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। যদি প্রয়োজন হয় তবে রাসায়নিক সার স্বল্প পরিমানে প্রয়োগ করা হয়। জৈব সার প্রয়োগের ফলে মাটির ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয় এবং মাটির উর্বরতা বাড়ে।

 

৪. আগাছা দমন :

এ পদ্ধতিতে রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় যা পচে জৈব সার তৈরি করে। চারা রোপনের ১০—১২ দিন পর আগাছা দমন শুরু করতে হয়।

 

৫. সেচ ব্যবস্থাপনা :

পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে জমিতে সেচ দিতে হয়। ঝজও পদ্ধতিতে যখন গাছের প্রয়োজন হয় তখনই পরিমানমত সেচ দেয়া হয়।

 

৬. শস্য সংগ্রহ :

ফসল পরিপক্ক হবার সাথে সাথে সংগ্রহ করতে হবে। ধান কাটার ১৫ দিন পূর্বে থেকে জমি শুকিয়ে ফেলতে হবে।

 

 

ঝজও পদ্ধতির সুবিধা:

১. কৃষি উপকরণ কম লাগে।

২. একটি করে চারা রোপন করা হয় বলে বীজ হার কম; ৬—৭ কেজি/হেক্টর। সাধারন পদ্ধতির চেয়ে ৭০—৮০% বীজ কম লাগে।

৩. সেচের পানি কম লাগে।

৪. সব সময় পানি বদ্ধ অবস্থায় থাকে না বলে মিথেন গ্যাস কম তৈরি হয়।

৫. জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও শুকানোর ফলে মাটিতে বায়ু চলাচল সুগম হয় এবং গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।

৬. অধিক জৈব সার ব্যবহার করা হয় ফলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

৭. রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়।

৮. ধানের জীবনকাল ১—২ সপ্তাহ কমে যায়।

৯. ফলন বৃদ্ধি পায়।

 

ঝজও পদ্ধতির অসুবিধা:

১. ঝজও পদ্ধতিতে ধান চাষের জন্য কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।

২. এ পদ্ধতিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা হয় যা বড় খামার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। তাছাড়া কৃষকরা রাসায়নিক সারের উপর বেশি বিশ্বাসী।

৩. চারা রোপনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় কারন চারা অনেক ছোট থাকে যা তোলা থেকে শুরু করে লাগানো সব ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকতে হয়।

 

ধান চাষে পর্যায়ক্রমে জমি ভেজানো ও শুকানো সেচ পদ্ধতি:

(Alternate Wetting and Drying (AWD) Method of Irrigation) ভড়ৎ জরপব ঈঁষঃরাধঃরড়হ ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য শস্য। স¤প্রতি বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সেচ নির্ভর বোরো ধানের অবদান সবচেয়ে বেশি। বোরো ধান উৎপাদনে জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে ধানের জমিতে সব সময় দাড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। এজন্য ধানের জমিতে অডউ পদ্ধতি ব্যবহার করে সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সেচ প্রদান করলে পানির অপচয় রোধ হয় এবং উৎপাদন খরচ কমে যায়।

অডউ বা পযার্য়ক্রমে ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতি হলো ধান ক্ষেতে সময়মতো ও প্রয়োজনমত সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে একটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশ বা প্লাস্টিকের পাইপ বসিয়ে মাটির ভেতরের পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করে সেচ দেয়া হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত পানি থাকলে ধান গাছ তার শিকড়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পানি নিতে পারে। পর্যবেক্ষণ পাইপে মাটির পানির পরিমান নির্ণয় করে প্রয়োজনমত সেচ প্রদান করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অডউ ২০—২৫ ভাগ পানি সাশ্রয়ী।

অডউ পদ্ধতিতে সেচের জন্য ৭—১৫ সে.মি. ব্যাস ও ৩০ সে.মি. দীর্ঘ প্লাস্টিক বা বাঁশের পাইপ প্রয়োজন। পাইপের উপরের ১০ সে.মি. ছিদ্রহীন এবং নিচের ২০ সে.মি. ছিদ্রযুক্ত। ৫ সে.মি. পর পর ৩ মি.মি. ব্যাসের ছিদ্র করতে হবে। পাইপটি ধানক্ষেতে এমনভাবে বসাতে হবে যাতে উপরের ১০ সে.মি. মাটির উপরে থাকে যাতে সেচের পানির মাধ্যমে আবর্জনা বা খড়কুটা পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। নিচের ছিদ্রযুক্ত ২০ সে.মি মাটির নীচে থাকলে যাতে মাটির ভেতরের পানি ছিদ্র দিয়ে সহজেই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে বা বের হয়ে যেতে পারে।

 

অডউ পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের ধাপসমূহ :

১. এ পদ্ধতিতে সেচ প্রদানের জন্য জমি খুব ভালভাবে সমতল করে নিয়ে চারা রোপন করতে হয়। এরপর একই সমতলে অবস্থিত এক একর পরিমান ধানের জমির জন্য ২—৩টি জায়গায় গর্ত করে পর্যবেক্ষণ পাইপ খাড়াভাবে বসাতে হবে।

২. রোপনের ১০—১৫ দিন পর্যন্ত জমিতে ২—৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এরপর অডউ পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে।

৩. প্রতিবার সেচ প্রদানের সময় এমন পরিমান পানি প্রয়োগ করতে হবে যাতে জমিতে ৫ সে.মি. গভীরতায় পানি থাকে। এরপর পানি কমতে কমতে যখন পানির স্তর পাইপের ভেতরে ২০ সে.মি. এর নিচে নেমে যাবে অথার্ৎ পাইপের তলার মাটি দেখা যাবে তখন আবার সেচ দিতে হবে। এ অবস্থায় আসতে মাটি ভেদে ৪—৮ দিন সময় লাগে। ফুল আসার পূর্ব পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।

৪. ধানের ফুল আসার পর ২ সপ্তাহ পর্যন্ত জমিতে সব সময় ২—৪ সে.মি. দাঁড়ানো পানি রাখতে হবে। এ সময়ে কোন অবস্থাতেই মাটিতে আদ্রতার ঘাটতি রাখা যাবে না।

৫. ধান কাটার ২ সপ্তাহ আগে সেচ বন্ধ করতে হবে।

 

অডউ পদ্ধতির সুবিধা :

১. ধান চাষ চলাকালীন সময়ে ৪—৫ টি সেচ সাশ্রয় করে।

২. এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে।

৩. জ্বালানী সাশ্রয় হয় প্রায় ৩০%।

৪. এ প্রযুক্তিতে মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং জমির জৈবিক গুনাবলির উন্নতি হয়।

৫. ফলন বৃদ্ধি পায় প্রায় ০.৫ টন/হেক্টর।

৬. এটি পরিবেশ বান্ধব কারণ ভূ—গর্ভস্থ পানি উত্তোলন কম হয় এবং মশা—মাছির উপদ্রব কম হয়। অডউ পদ্ধতির অসুবিধা :

১. জমি সমতল এবং পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।

২. পর্যবেক্ষণ পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

৩. অনেক সময় আগাছার উপদ্রব বেশি হয়।

 

সারাংশ

ঝজও পদ্ধতিতে পানি সেচ ব্যবস্থাপনা ধান চাষের একটি এমন কৃষি পরিবেশিক পদ্ধতি যা ধানের ফলন বৃদ্ধি করে। এ পদ্ধিতে সেচ কম লাগে। জমি পর্যায়ক্রমে ভেজানো ও এ পদ্ধিতে সেচ কম লাগে। জমি পর্যায় ক্রমে ভেজানোও শুকানোর ফলে বায়ু চলাচল সুগম হয়। এপদ্ধতি কৃষকের কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। ধান চাষে পর্যায়ক্রমিক ভেজানো ও শুকানো পদ্ধতিগুলো ধান ক্ষেতে প্রয়োজনমতো ও সময়মতো সেচ দেয়া। এ পদ্ধতিতে ২৫% সেচের পানি কম লাগে। তবে জমি সমতল ও পাইপ স্থাপনের জন্য কারিগরি জ্ঞান ও পাইপে পানির স্তর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

 

পানি সেচ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা

পানি সেচ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা , ইউনিট – ৩ , পাঠ – ৩.২ , পানি গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য উপাদন যা গাছের বিভিন্ন ধরনের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত। জমির প্রকৃতি, মাটির ধরন, আবহাওয়াগত কারণ এবং পানির প্রাপ্যতার উপর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ফসল জন্মায়। পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই ভালো ফসল উৎপাদন সম্ভব। পানি ব্যবস্থাপনার মূল বিষয় হচ্ছে, সেচের পানির অপচয় না করে গাছের প্রয়োজনের সময় পরিমিত পরিমান পানি সঠিক পদ্ধতিতে গাছের মূলাঞ্চলে সরবরাহ করা এবং পানির অপচয় রোধ করা।

পানি সেচ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা

 

সেচ পদ্ধতি :

ফসলের জমিতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়। এটি নির্ভর করে মাটির প্রকার, ভূ—প্রকৃতি, পানির উৎস, ফসল, মজুরি খরচ ইত্যাদির উপর। পানি সেচ পদ্ধতিকে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—

১. ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি

২. ভূ—নিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি

৩. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতি

৪. ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি

 

১। ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি  :

বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় এই পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পানি উপর থেকে ঢালু নালা দিয়ে আবাদী জমিতে নেয়া হয়। ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

ক) প্লাবন সেচ পদ্ধতি

খ) নালা সেচ পদ্ধতি

গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি

ঘ) বাঁধ এবং নালা সেচ পদ্ধতি

ঙ) বৃত্তাকার বেসিন সেচ পদ্ধতি

ক) পাবন স্ন সেচ পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে জমির চারপাশে আইল বেঁধে প্রধান নালার সাহায্যে ঢালুর দিকে পানি প্রবাহিত করা হয়। সাধারণত: ছিটিয়ে বোনা ফসল এবং গোখাদ্য ফসলে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়। যেখানে অতি সহজে প্রচুর পানি পাওয়া যায় সেখানে এ পদ্ধতি উপযোগী।
সুবিধা

১. জমিতে সেচ দেয়া সহজ এবং দক্ষ শ্রমিকের দরকার হয় না।

২. নালার জন্য জমির অপচয় কম হয়।

৩. এ পদ্ধতিতে পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।

৪. পানির প্রাপ্যতা সহজ হলে এ পদ্ধতি উপযুক্ত।

৫. ছিটিয়ে বোনা ফসলের জন্য এ পদ্ধতি বেশি উপযোগী।
অসুবিধা

১. পানির অপচয় বেশি হয়।

২. নিচু জায়গায় বেশি পানি জমা হয় এবং উঁচু জায়গা শুকনো থাকে।

৩. জমি সমান করতে খরচ বেশি হয় এবং ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা বেশি।

৪. পানির প্রতি সংবেদনশীল ফসলগুলো ঢালুর দিকে অতিরিক্ত পানির জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

 

খ) নালা সেচ পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে সারিতে বপন বা রোপন করা ফসলে দুই সারির মধ্যবতীর্ নালায় পানি সরবরাহ করে সেচ দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে দুই সারির মাঝখানে নালা তৈরি করা হয় যাতে উভয় পাশের ফসল পানি দিতে পারে। এ পদ্ধতিতে প্রধান নালা থেকে শাখা নালায় পানি সরবরাহ করা হয়। নালা পদ্ধতির মাধ্যমে সারিতে লাগানো ফসল যেমন আলু, আখ, বাদাম, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন ইত্যাদি এবং ফলগাছে সেচ দেয়া হয়।

সুবিধা

১. প্লাবন পদ্ধতির চেয়ে পানির অপচয় কম হয়।

২. পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না।

৩. সমস্ত জমি সমানভাবে সিক্ত হয়।

৪. জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না এবং ভূমি ক্ষয়ের সম্ভাবনা কম।

৫. অধিক পানির প্রতি সংবেদনশীল ফসলের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী।

 

অসুবিধা

১. জমি সমতল করা এবং নালা তৈরির জন্য প্রচুর অর্থ ও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

২. নালা তৈরির জন্য জমির অপচয় বেশি হয়।

৩. নালার পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

৪. সকল ফসলের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী নয়।

 

গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি

এ পদ্ধতিতে জমি প্রথমে সমতল করে নিয়ে চারপাশে উঁচু আইল তৈরি করা হয়। এরপর পার্শ্ববতীর্ প্রধান নালা থেকে
জমিতে সেচ দেয়া হয়। জমির আকার বড় হলে ঢাল অনুসারে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করা হয়। এরপর প্রতিটি খন্ডে
আলাদাভাবে সেচ প্রদান করা হয়। সুবিধা

১. এ পদ্ধতিতে পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।

২. পানির প্রাপ্যতা সহজ হলে এ পদ্ধতি উপযুক্ত।

৩. ছিটিয়ে বোনা এবং সারিতে লাগানো ফসলে সেচ দেয়া যায়।

অসুবিধা

১. পানির অপচয় বেশি হয়।

২. জমি সমান করতে খরচ বেশি হয়।

৩. আইল তৈরির জন্য জমির অপচয় হয়।

 

ঘ) বাঁধ ও নালা পদ্ধতি

জমি ঢালু হলে জমির ঢালের আড়াআড়িভাবে নালা কাটা হয়। এরপর সবচেয়ে উঁচু জায়গায় নালায় পানি ছেড়ে দিয়ে পযার্য়ক্রমিকভাবে সবগুলো নালায় পানি সরবরাহ করা হয়।

সুবিধা

১. পানির অপচয় কম হয়।

২. ঢালু জমিতে সেচ দেয়া যায়।

৩. সমস্ত জমিতে সমানভাবে সেচ দেয়া যায়।

৪. পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ এবং জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা নেই।

 

অসুবিধা

১. খরচ বেশি হয়।

২. নালা তৈরির জন্য জমির অপচয় হয়।

৩. সকল ফসলের জন্য উপযোগী নয়।

 

ঙ) বৃত্তাকার বা বেসিন সেচ পদ্ধতি

এ পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ জমিতে সেচ না দিয়ে শুধুমাত্র গাছের গোড়ায় পানি দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে গাছের গোড়ার চারিদিকে বৃত্তাকারে নালা কাটা হয়। প্রথমে প্রধান নালায় পানি সরবরাহ করা হয়। পরপর প্রধান নালা থেকে পানি শাখা নালার মাধ্যমে বৃত্তাকার নালায় প্রবেশ করে। সাধারণত বহুবর্ষজীবী বৃক্ষজাতীয় গাছের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া হয়।

সুবিধা

১। জমি ও পানির অপচয় কম হয়।

২। অসমতল ও ঢালু জমিতে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়।

৩। পানি নিয়ন্ত্রণ সহজ।

৪। মূলে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।

অসুবিধা

১. অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শ্রমিক প্রয়োজন।

২. নালা তৈরির জন্য প্রাথমিক খরচ বেশি।

৩. মাঠ ফসলের জন্য উপযোগী নয়।

 

২। ভূ—নিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি

মাটির নিচে বিশেষ ধরনের পাইপ বসিয়ে বা নালা কেটে গাছের শিকড়ে পানি সরবরাহ করার পদ্ধতিকে ভূ—নিম্নস্থ পানি সেচ পদ্ধতি বলে। ছিদ্রযুক্ত পাইপের পানি চুঁইয়ে উদ্ভিদের মূলাঞ্চলকে ভিজিয়ে দেয়। সুবিধা

১. পানির অপচয় কম হয়।

২. মাটির শক্ত স্তর তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না।

৩. ভূমি ক্ষয় হয় না।

৪. জলাবদ্ধতার আশংকা কম।

অসুবিধা

১. নল বা পাইপ বসানোর জন্য প্রাথমিক খরচ বেশি।

২. শ্রমিক বেশি লাগে।

৩. মাঝে মাঝে পাইপ তুলে পরিস্কার করতে হয়।

 

৩. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতি:

যে পদ্ধতিতে পানি পাম্পের সাহায্যে উচ্চ চাপে নলের মধ্যে দিয়ে সরবরাহ করে বৃষ্টির আকারে জমিতে পড়ে তাকে ফোয়ারা বা বর্ষন সেচ পদ্ধতি বলে। নলের মুখে নজল লাগানো থাকে তাই পানি ফোয়ারার মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঢালু, খাড়া, পাহাড়ী, বেলে মাটিতে এবং অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।

সুবিধা

১. যেখানে পানির প্রাপ্যতা কম সেখানে এ পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যায়।

২. পাহাড়ী বা অসমতল জমিতে এ পদ্ধতি উপযোগী।

৩. পানির অপচয় কম হয়।

৪. জমির অপচয় কম হয়।

৫. ভূমিক্ষয় হয় না জমি সমতল করার প্রয়োজন নেই।

অসুবিধা

১. ফোয়ারা সেচ পদ্ধতিতে খরচ বেশি হয়।

২. অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকের দরকার।

৩. কান্ড ও পাতা ভিজে যায় বলে উদ্ভিদের রোগের প্রকোপ হতে পারে।

৪. অপরিস্কার পানি নজলের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলে নজল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

 

৪. ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে গাছের শিকড় অঞ্চলে ফেঁাটা ফেঁাটা করে পানি সরবরাহ করা হয়। এটি সেচের আধুনিকতম পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের নলের সাহায্যে পানির অপচয় ছাড়াই ফেঁাটায় ফেঁাটায় গাছের গোড়ায় পানি সরবরাহ করা হয়। জমি সব সময় সিক্ত থাকে বলে গাছে কখনও পানির অভাব হয় না। যে সমস্ত অঞ্চলে পানির অভাব যেমন মরুভূমি, পাহাড়ী এলাকা এবং মাটি লবনাক্ত সে সমস্ত অঞ্চলে এ সেচ পদ্ধতি খুবই কার্যকর। এ পদ্ধতিতে ফলগাছ এবং শাকসবজিতে সেচ দেয়া হয়।

সুবিধা

১. পানির অপচয় কম হয়।

২. সেচের পানির সাথে সারও প্রয়োগ করা যায়।

৩. পানির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে ফসলের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়।

৪. শিকড় অঞ্চলের লবনের ঘনমাত্রা হ্রাস পায়।

৫. অসমতল বা ঢালু যে কোন জমিতেই সেচ দেয়া যায়।

অসুবিধা

১. প্রাথমিক খরচ বেশি।

২. মাঠ ফসলের জন্য উপযোগী নয়।

৩. দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

 

সেচের পানির কার্যকারিতা বৃদ্ধির উপায় ঃ

১. পানির অপচয় রোধ করে পরিমিত পরিমান সেচ দিতে হবে।

২. বিভিন্ন ফসলের বিভিন্ন সময়ে পানির প্রয়োজন। তাই ফসলের সেচ প্রদানের উপযুক্ত সময়ে সেচ দিলে সেচের পানির কার্যকারিতা বেশি হয়।

৩. জমির চারিদিকে ভালভাবে আইল দিয়ে সেচ দিতে হবে যাতে পানি বের না হয়ে যায়।

৪. সঠিকভাবে পানির উৎস হতে জমি পর্যন্ত সেচ নালার ঢাল দিতে হবে। অথার্ৎ সেচ নালা জমির দিকে ঢালু করে তৈরি করতে হবে।

৫. যথা সম্ভব পাকা নালা তৈরি করতে হবে।

৬. জৈব পদার্থ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমান জৈব পদার্থ যেমন পঁচা গোবর, কম্পোষ্ট ও সবুজ সার প্রয়োগ করতে হবে।

৭. সারিবদ্ধ ফসলে নালায় সেচ দিলে পানির অপচয় কম হয়।

৮. পানির বাস্পীভবন কমানোর জন্য বিকেল বা সন্ধ্যা বেলা সেচ দিতে হবে।

৯. ফসলের প্রকৃতি, জমির ঢাল, মাটির বুনট, পানির প্রাপ্যতা, লবনাক্ততা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে উপযুক্ত পদ্ধতিতে সেচ দিতে হবে।

১০. স¯প্রতি সেচের পানির সরবরাহজনিত অপচয় রোধের জন্য পলিথিন নির্মিত ফিতা পাইপ প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। কাঁচা নালার তুলনায় এটি ৫০—৬০ ভাগ পানির অপচয় রোধ করে।

 

সারাংশ:

পানি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে পানি সমভাবে শিকড় এলাকায় সরবরাহ করা। সেচ পদ্ধতি মাটির প্রকার ও ভূমির ঢাল, ফসলের প্রকৃতি, পানির উৎস কৃষকের আর্থিক সংগতি এসব বিবেচনা করা হয়। সেচ পদ্ধতি প্রধানত: চারভাগে ভাগ করা হয়; (১) ভূপৃষ্ঠের সেচ পদ্ধতি, (২) ভূনিম্নস্থ সেচ পদ্ধতি, (৩) ফোয়ারা পদ্ধতি, (৪) ড্রিপ বা ফেঁাটা ফেঁাটা সেচ পদ্ধতি। আবার ভূ—পৃষ্ঠস্থ সেচ পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে (ক) প্লাবন পদ্ধতি, (খ) নালা পদ্ধতি, (গ) বাঁধ সেচ পদ্ধতি, (ঘ) বাঁধ ও নালা পদ্ধতি, (ঙ) করোগেশন সেচ পদ্ধতি, (চ) বৃত্তাকার সেচ পদ্ধতি।