বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পশুর গুরুত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পশুর গুরুত্ব।

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অর্থ বলতে পারবেন।
  • গবাদিপশু থেকে উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যাদির নাম এবং এসব দ্রব্যাদি রপ্তানি করে বাংলাদেশ কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তা বলতে পারবেন।
  • গবাদিপশু থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে আছে তার কারণ ব্যাখ্য করতে পারবেন।
  • গবাদিপশু থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে ও মুদ্রা
  • অর্জনে আমাদের দেশে কী সুবিধা আছে তা তুলে ধরতে পারবেন।

বৈদেশিক  মুদ্রা অর্জনে গবাদিপশুর বেশ গুরুত্ব রয়েছে। একটি দেশের পন্যদ্রব্য অন্যদেশে রপ্তানি করে যে মুদ্রা অর্জন করা হয় তাকে বৈদেশিক- মুদ্রা বলে। সাধারণত নিজের দেশের চাহিদা মেটানোর পর বাড়তি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গৃহপালিত পশু এমন এক সম্পদ যা থেকে যে কোনো দেশ বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জন করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন হয় শুধু এ সম্পদের উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার।

উন্নত দেশগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে পশুপালন করে পশুজাত দ্রব্যের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি অংশ বিদেশে রপ্তানি করছে। এভাবে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। যে দেশ যত বেশি আকর্ষনিয় ও উন্নতমানের এবং অধিক হারে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে পারছে বিশ্ববাজার থেকে সে দেশ তত বেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারছে।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পশুর গুরুত্ব

 

 

গবাদিপশু থেকে উৎপাদিত রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যসামগ্রীঃ

গবাদিপশুর উপজাত দ্রব্য থেকে নিম্নলিখিত রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে তা থেকে প্রচুর বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জন ক সংরক্ষিত পুগ ও মাংস ভেড়ার পশম থেকে উত্তম শীতবস্ত্র তৈরি হয়। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ ভেড়ার পশম থেকে উত্তম কাপড় তৈরি করে যা পৃথিবীর সর্বত্রই রপ্তানি হয়। তবে, আমাদের দেশের ভেড়ার পশম নিম্নমানের হওয়ায় এ থেকে রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি হয় না। পশুর চামড়া থেকে ভ্যানেটি ব্যাগ, আসবাব পত্র, বাদ্যযন্ত্র, খেলনা, সৌমিন দ্রব্য ছাড়াও অসংখ্য দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করা হয়।

শিং, খুর ও হাড় থেকে জিলাটিন, আঠা, গহনা, চিরুনি, বোতাম, ছাতা ও ছুরির বাট, হাড়ের ভয়া থেকে সার প্রভৃতি তৈরি করা যায়। পশুর রক্তে যণিজপাদার্থ, হরমোন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। রক্ত সংগ্রহ করে শুকিয়ে মানুষ ও পশুর খাদ্য তৈরি করা যায়। রক্ত থেকে কোলাজেন তৈরি করা হয়। পশুরা ক্ষুদ্রান্ত থেকে সার্জিক্যাল সুতো, টেনিস র্যাকেট স্ট্রিং, মিউজিকাল স্ট্রিং প্রভৃতি তৈরি হয়।

দাত দিয়ে বোতাম, চিরুনি প্রভৃতি তৈরি করা যায়। চর্বি থেকে মোমবাতি, গ্লিসারিন, সাবান, লুব্রিক্যাটিং তেল, সিনথেটিক রাবার ও প্লাস্টিক তৈরি হয়। অগ্ন্যাশয় (এতশদক্ষনতড়) থেকে ইনসুলিন তৈরি হয়। এড্রেনাল গ্রন্থি (অলক্ষনশতর দরতশত) থেকে ওষুধ তৈরি হয়। পশুরা চুল থেকে প্রাশ, বস্ত্র, কৃত্রিম চুল প্রভৃতি তৈরি করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দুধ, মাংস ও উপজাত দ্রব্য থেকে তৈরি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে বহু বৈদেশিক -মুদ্রা অর্জন করছে। এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া মাংস ও দুধ মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করছে।

পশুসম্পদ থেকে বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশ একবার টাটকা ও ড্রেসড মাংস বিদেশে রপ্তানি করেছিল যা নানা কারণে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫১১৫ টন পশুর হাড় উৎপাদিত হচ্ছে। বেক্সিমকো কোম্পানি ১৯৯০ সালে ১৮৯৪ টন হাড়ের গুড়া রপ্তানি করে ১০.৭১ মিলিয়ন টাকা উপার্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় বিশটির মতো হাড় গুড়া করার কারখানা রয়েছে।

দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ বিদেশে চামড়া রপ্তানি করছে। চামড়া উৎপাদনের ৮১% ওয়েট ব্লু (wet blue) বিদেশে রপ্তানি হয়। ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশ চামড়া রপ্তানি করে ৫৩৭৮ মিলিয়ন টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জন করেছে। সে সময় রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে চামড়া তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। বাংলাদেশ শুধু চামড়া থেকেই প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জন করে থাকে

বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে

  • বৈদেশিক -মুদ্রা অর্জনে বিদেশের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এর কারণগুলো সংক্ষেপে এখানে দেয়া হয়েছে। যথা-
  • পশুসম্পদ উন্নায়নে সরকারের নীতি প্রনয়ণে মন্থর গতি ও স্বল্প বিনিয়োগ।
  • মানুষ শহরমুখী হওয়ায় পশুপালনে অনীহা দেখা দিয়েছে।
  • পশুসম্পদ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থার অভাব।
  • লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চারণভূমি কমে গেছে।
  • পশু খাদ্যের অভাব ও দরিদ্রতার কারণে পশুপালনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে।
  • বাস্তবমুখী গবেষণার অভাব, গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগে নানা ধরনের বাধা, যেমন- অর্থাভাব,ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, উৎসাহের অভাব, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি।
  • পশু ও পশুজাত দ্রব্যের সঠিক মূল্যমান নির্ধারণ না করায় পশু ব্যবসায়িদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি।
  • পশু উপজাত দ্রব্য ব্যবহারের উপর গবেষণার অভাব।
  • শস্য উপজাতসহ অন্যান্য পশুখাদ্য রপ্তানি করা।বৈজ্ঞানিক উপায়ে পশুর উপজাত দ্রব্যের সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাব।

 

বাংলাদেশের গবাদিপশু থেকে বৈদেশিক -মুদ্রা অর্জন করার উপায়

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়ার প্রচুর চাহিদা। কাজেই এর উৎপাদন বাড়িয়ে অধিক পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। দুধ উৎপাদন বাড়িয়ে তা থেকে দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য, যেমন- মিষ্টি, সন্দেশ, কেক, বিস্কুট, চকোলেট তৈরি করে রপ্তানি করা যেতে পারে। মাংস থেকে উৎপাদিত খাদ্য ও সংরক্ষিত মাংস রপ্তানি করা যায়।

বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, যেমন- খেলনা, গহনা প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানি করা যায়। এসব কাছে এদেশের কুমার, স্বর্ণকার, কাঠ মিস্ত্রি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক নিয়োজিত করলে সুন্দর ও নতুন ধরনের রপ্তানিযোগ্য দ্রব্য প্রস্তুত করা সম্ভব হবে। কারণ, এরা এসব কাজে সুনিপুণ ও দক্ষ কারিগর। মহিলা ও বেকার ব্যক্তিদের দিয়ে কুটির শিল্প কাজ, যেমন- ভেড়ার পশম থেকে কার্পেট, মোটা কম্বল প্রভৃতি তৈরিতে লাগানো যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের ভেড়ার জাত উন্নয়ন করে উত্তম পশম উৎপাদন করা যেতে পারে যা রপ্তানি করে বৈদেশিক- মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের সুবিধা

  • বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠিকে কর্মশক্তিতে বিভিন্নমুখী কর্মে নিয়োগ করা যায়।
  • কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কারণে শস্য উপজাত সহজেই গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
  • কম মূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায়।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version