পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা।

এই পাঠ শেষে আপনি-

হালচাষের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলোর সাথে পরিচিত হতে পারবেন। গবাদিপশুর কাধে জোয়াল বাধতে ও লাঙ্গল লাগাতে পারবেন এবং অন্যকে দেখাতে পারবেন। গরু নিয়ে নিজেই হালচাষ করতে পারবেন।

প্রাসঙ্গিক তথ্য

হালচাষ বা গবাদিপশু দিয়ে জমি কর্ষণ আমাদের দেশে একটি অতি পুরাতন পেশা যা কৃষির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গণ্য। গ্রাম বাংলার কৃষকরা ভোর না হতেই লাঙ্গল কাঁধে মাঠের পানে ছুটেন। দৃশ্যটি খুবই মনোরোম। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কৃষক মাঠে যাওয়ার আগে তার গরু, লাঙ্গল, জোয়াল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে নেন। জমি, গরু, লাঙ্গল ও মই এই চারটি উপকরণ সমন্বয়ে জমিতে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব।

 

পশু দিয়ে নিজ হাতে হালচাষ করা

 

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ

জমি, একজোড়া বলদ, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, শলা, টুই, রশি ইত্যাদি।

পূর্ব প্রস্তুতি

হালচাষের জন্য সকাল অথবা বিকেলে সময় নির্ধারণ করুন। হালচাষে যাবার পূর্ব রাতে গরুকে ভালোভাবে ঘাস ও দানাদার খাবার দিন। হালচাষের জন্য মাঠে যাবার পূর্বে গরুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিষ্কার পানি পান করান। কীভাবে গরুর জোয়াল এবং জোয়ালের সাথে লাঙ্গল বাধতে হয় তা পার্শ্ববর্তী কৃষকের বাড়িতে গিয়ে তার কাছে শিখুন এবং নিজে করার জন্য চেষ্টা করুন।

প্রধান কর্ষণ যন্ত্রপাতির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

দেশী লাঙল

বাংলাদেশে এটি অতি পরিচিত কর্ষণ যন্ত্র। একটি বাঁকা কাঠের আগায় লোহার একটি ফলক বা ফলা সন্নিবেশে এটি প্রস্তুত করা হয়। এর বিভিন্ন অংশ নিম্নরূপ-

কাঠের শরীরঃ

লাগলের শরীর গজারি, বেল, কুল প্রভৃতি কাঠের বাঁকা কান্ড দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। শরীরের উপরের অংশকে বলা হয় হাতল। হাতলের শেষ প্রান্তে মুটি থাকে। এই মুটি চেপে ধরে কৃষকরা লাঙ্গল চালিয়ে থাকেন। শরীরের নিচের সরু অংশে ফলক লাগানো হয়। শরীরের মধ্যবর্তী জায়গায় একটি ছিদ্র করা হয় এবং সে ছিদ্রে ঈশ সংযোজন করা হয়।

ঈশঃ

এটি একটি সরু চ্যাপ্টা কাষ্ঠদণ্ড যা লম্বায় ২.৫ মিটার অর্থাৎ প্রায় আট ফুট। ঈশের গোড়ার অংশ লাঙ্গলের শরীরের ছিদ্রপথে শক্তভাবে আটকানো থাকে, ঈশের অগ্রভাগ অপেক্ষাকৃত চিকন বা গরু হয়। এতে ৪-৫টি দাত বা খাজকাটা হয়। এ দাঁতগুলোর যে কোনো একটি রশি বেঁধে ছোয়ালের সঙ্গে লাঙ্গল লাগানো হয়।

বিলঃ

ঈশ লাগলের শরীরের ছিদ্রের মধ্যে শক্ত করে আটকানোর জন্য একটি কাঠের টুকরো ব্যবহার করা হয়। দেশীয় কাথায় একে দিল বা গোজ বলে।

হাতল:

লাগলের শরীরের উপরের যে অংশ হাতে ধরে গরুর সাহায্যে লাঙ্গল চালনা করা হয়, তাকে হাতল বলে। হাতলের উপরের প্রান্তে মুটি থাকে। এই মুটিতে চাপ প্রয়োগ করে চাষি গরু দিয়ে জমি চাষ করেন।

ফলকঃ

গ্রাম্য ভাষায় এটিকে লাঙ্গলের ফাল বলে। এটি নরম স্টিলপাত বা লোহার পাত দিয়ে তৈরি এবং লম্বায় ১৫-১৭ সেন্টিমিটার। লাঙ্গলের সরু আগার উপরের দিকে লোহার পিন দিয়ে ফলকটি আটকে দেয়া হয়। এ ফলার সাহায্যেই লাঙ্গল মাটি চিরে জমি কর্ষণ করে।

জোয়ালঃ

ছোয়াল ভূমি কর্ষণের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জোয়াল ছাড়া লাঙ্গল দিয়ে ভূমি কর্ষণ সম্ভব নয়। জোয়ালের দু’প্রান্ত রশি দিয়ে একজোড়া গরুর কাঁধে বেঁধে দেয়া হয়। লাঙ্গলের ঈশ রশির সাহায্যে জোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে বেঁধে জমি কর্ষণ করা হয়। জোয়াল কাঠের অথবা বাঁশের হতে পারে। জোয়াল যেন বলদের কাধের নির্দিষ্ট স্থানে থাকে সেজন্য বাশের দু’টি শলা দু’প্রান্তে এবং রশি দিয়ে জোয়ালকে কাধের সাথে বাধা হয়।

মইঃ

আমাদের দেশে প্রধানত বাশের তৈরি মই ব্যবহৃত হয়। বাশেঁর তৈরি মই মোট তিনটি ফালি দিয়ে তৈরি হয় যার মধ্যবর্তী ফালিটি সোজা রাখা হয়। দু’পার্শ্বের দু’টি ফালি কতকটা অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁকানো থাকে এবং গাইট দিয়ে সংযোজন করা হয়। গাইটগুলোর প্রায় ৩৭৫ সে.মি. (২.৫ ইঞ্চি) করে উভয়দিকে বাড়তি রাখা হয়। প্রান্তিক গাইট দু’টির মাধ্যায় পাটের রশি দিয়ে জোয়ালের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। দু’টি সোজা বাশের ফালি দিয়েও মই তৈরি করা যায়।

অনুশীলন (Activity) :

ধরুন, আপনার এক টুকরো জমি আছে, হালচাষের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো সংগ্রহ করে সেটি নিজে চাষ করুন

কাজের ধাপ

  • প্রথমে নিজ হাতে জোয়ালটি বলদ দু’টোর দু’কারে পাটের রশি দিয়ে বাধুন। এরপর লাঙ্গলের ঈশটিকে জোয়ালের সাথে জোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে ভালোভাবে বাধুন।
  • এরপর লাঙ্গলের মাথার মুটি বাম হাতে শক্তভাবে সোজা করে ধরুন যাতে লাঙ্গলের ফালটি জমির বুকে ঢুকে যায়।
  • চাষ করার সময় গরুর সাথে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কথা বলুন যাতে গরু আপনার নির্দেশনা বুঝতে পারে। গরুর প্রতি কখনো নিষ্ঠুর আচরণ করা ঠিক নয়। হাতের শলা দিয়ে গরুকে ডানে/বামে চলার নির্দেশনা দিন।
  • হালচাষের মাঝামাঝি সময়ে গরুকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম দেয়া প্রয়োজন। পরে আবার চাষাবাদ শুরু করা যেতে পারে।
  • কোনো অবস্থাতেই দৈনিক ৪-৬ ঘণ্টার বেশি সময় একই গরু দিয়ে হালচাষ করা সমিচীন নয়।
  • হালচাষ চলাকালীন সময়ে গরু বা হালের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সমস্যা দেখা দিলে প্রতিবেশী অভিজ্ঞ কৃষকের সাথে আলাপ করে সমাধান করুন।
  • হালচাষের পর গরুকে ঘরে উঠানোর পূর্বে পুকুর বা খালে ভালোভাবে গোছল করান। ব্রাশ দিয়ে তাদের শরীর পরিষ্কার করে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘাস, দানাদার খাদ্য ও পানি দিন এবং পরিষ্কার জায়গায় রাখুন যাতে বিশ্রাম নিতে পারে।
  • লাগলসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে সযত্নে উঁচু জায়গায় তুলে রাখুন। আপনি নিজে হালচাষ করুন এবং ধাপগুলো ব্যবহারিক খাতায় পর্যায়ক্রমে লিখুন।

 

 

সাবধানতা এবং করণীয়

  • হালচাষে যাবার আগে লাঙ্গলসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
  • হালের গরুকে প্রত্যেহ নির্ধারিত সময় ঘাস ও দানাদার খাদ্য সরবরাহ করুন এবং গোছল করান।
  • ব্রাশ দিয়ে শরীর পরিষ্কার করুন। গরুর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখুন।
  • গর্বদা গরুর কাছে পরিষ্কার খাবার পানি রেখে দিন।
  • প্রত্যেহ নির্ধারিত সময়ে হালচাষ করুন। এতে গরু অভ্যস্থ হয়ে যাবে।
  • লাগলের মুটি শক্ত করে না ধরলে ফালা যে কোনো সময় গরুর পায়ে লেগে পা কেটে যেতেপারে। এদিকে সতর্ক থাকুন।
  • জোয়াল ব্যবহারের ফলে পশুর দেহে যেন কোনো ক্ষত সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version