বাংলাদেশে পশুপাখি ও উৎপাদিত দ্রব্যের পরিসংখ্যান

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বাংলাদেশে পশুপাখি ও উৎপাদিত দ্রব্যের পরিসংখ্যান। আমাদের জীবনে গৃহপালিত পশুর ( domestic animal) গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে বহু ধরনের পশু রয়েছে। এসব পশুর মধ্যে অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে মানুষ যেগুলোকে স্থায়ীভাবে লালনপালন করে এবং বংশবৃদ্ধি ঘটায় তাদের গৃহপালিত পশু বলে।

আমাদের দেশে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া বিশেষভাবে পরিচিত। অন্যান্য দেশে গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ছাড়াও উট, গাধা, হাতি, খরগোশ, ঘোড়া এবং আরও অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু রয়েছে। গৃহপালিত পশুর আদিবাস ছিল জঙ্গলে। কেন, কীভাবে এবং কখন গৃহপালিত পশু মানুষের সান্নিধ্য লাভ করল তার সঠিক ইতিহাস জানা যায় নি। তবে, যেটুকু জানা গেছে তার আলোকে বলা যায়, আদি মানুষও পশুর সঙ্গে জঙ্গলে বাস করতো। তখনকার দিনেও মানুষ অন্নবস্ত্রের জন্য পশুনির্ভর ছিল। তারা মাংস ভক্ষণ করে ক্ষুধা মেটাতো, চামড়া পরিধান করে শীত ও লজ্জা নিবারণ করতো।

হিংস্র জন্তু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য চামড়ার তাবু ব্যবহার করতো। যখন প্রস্তর যুগ এল মানুষ ঘর-বাড়ি তৈরি করা শিখল। জঙ্গল থেকে পশু শিকার করে বাড়িতে আনতে লাগল। এতে তাদেরকে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে হতো। যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বৃষ্টি, সব মৌসুমে শিকার না পাওয়া, জঙ্গলে হিংস্র জন্তুর আক্রমণ ইত্যাদি। এসব অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে পরবর্তীতে মানুষ জঙ্গল থেকে জীবিত পশু ধরে বাড়িতে এনে বেঁধে রাখতো এবং এদেরকে পালন করতো। এভাবেই শুরু হয়েছিল বাড়িতে পশুপালন। মধ্যযুগে কৃষি, পরিবহণ এবং খাদ্য উৎপাদনে পশুর অবদান প্রধান ছিল।

বর্তমান শিল্প বিপ্লবের যুগে কৃষি, শিল্প, খাদ্য উৎপাদন ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও আত্মকর্মসংস্থানে গৃহপালিত পশু অবদান রাখছে। গৃহপালিত পশু থেকে দুধ, মাংস ছাড়াও নানা প্রকার উপজাত দ্রব্য, যেমন- শিং, খুর, চামড়া, পশম, চর্বি, রক্ত, দাঁত, হাড়, নাড়িভুড়ি পাওয়া যায়।

দুধ ও মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উপজাত দ্রব্য থেকে নানাবিধ প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রস্তুত করা হয়। আমাদের দেশে গৃহপালিত পশু একটি বিরাট সম্পদ। এ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারলে আমাদের বর্তমান জাতীয় প্রকট সমস্যাসমূহ, যেমন- বেকার সমস্যা ও আমিষের অভাব সমাধান করা সম্ভব হবে। এছাড়াও ভবিষ্যতে এদেশের দারিদ্রতা দূর করে গৃহপালিত পশু থেকে অধিক হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

এই ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে বাংলাদেশের পশুপাখি ও এদের থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের পরিসংখ্যান, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং দারিদ্র দূরীকরণে গৃহপালিত পশুর গুরুত্ব সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিকসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে

বাংলাদেশে পশুপাখি ও উৎপাদিত দ্রব্যের পরিসংখ্যান

এই পাঠ শেষে আপনি

এদেশের গৃহপালিত পশুর অতীত ও বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করতে পারবেন। পশুসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে বাংলাদেশের মানুষের করণীয় বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারবেন।এদেশের গৃহপালিত পশু ও উৎপাদিত দ্রব্যের পরিসংখ্যান ছক আকারে তুলে ধরতে পারবেন।

বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর অতীত ও বর্তমান অবস্থা

অতীতে বাংলাদেশে প্রায় সব বাড়িতেই গরু, মহিষ, ভেড়া ও ছাগল পালন করা হতো। এদের মধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল ছাড়া অন্য কোনো পশুর জাতই উন্নত নয়। সনাতন পদ্ধতিতে দেশের মানুষ এসব পশু পালন করতো। তথাপি তখনকার দিনে এভাবেই বাংলাদেশের মানুষের দুধ ও মাংসের চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। এর প্রধান কারণ-

পশু পালন গৃহপালিত পশুর সংখ্যা কম থাকায় পর্যাপ্ত পশু খাদ্যের যোগান সম্ভব ছিল। লোকসংখ্যা কম থাকায় চাহিদা কম ছিল এবং পর্যাপ্ত চারণভূমি পাওয়া যেত। শস্য উৎপাদন ব্যবস্থায় গৃহপালিত পশুর জন্য ঘাস উৎপাদিত হতো। পর্যাপ্ত পশু খাদ্য সরবরাহের জন্য পশু থেকে বেশি উৎপাদন পাওয়া যেত।

বর্তমানে বাংলাদেশের সে অবস্থা আর নেই। স্ফীত জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা মেটানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। দেশী জাতের পশুর মাংস ও দুধ দিয়ে বর্তমান চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পশুপালনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েক বছর আগে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের দুধ উৎপাদনকারী গরু এনে এদেশে দেশী গরুর জাত উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর জাত উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃত্রিম প্রজননের জন্য মোট ২২টি কেন্দ্র এবং ৪২৫টি উপকেন্দ্র আছে।

আমাদের দেশের পশু বাছাই প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন ঘটালে এদের উৎপাদন ক্ষমতাও লাভজনক হারে বাড়ানো সম্ভব হবে।বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১.৫০ মিলিয়ন কর্মক্ষম লোক দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে। এদের জন্য কাজ দরকার। দেশের আবাদি জমির পরিমাণ মাথাপিছু মাত্র ০.২১ একর।

এর সম্প্রসারণও সম্ভব নয়। এজন্য দরকার অল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন। এ লক্ষ্যে দেশের পশুসম্পদ বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।দেশের পশুসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা গত বছরগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে৷ দশ বছর আগে যেখানে দেশের কোথাও বেসরকারী পর্যায়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি খামারও ছিল না, বর্তমানে দেশে বেসরকারী পর্যায়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ৩০ হাজার দুগ্ধ খামার ও ৬২ হাজার মুরগি খামার গড়ে ওঠেছে।

পাশাপাশি এসব খামার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পশুসম্পদ উন্নয়নের ফলে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার পূর্বের শতকরা ৩০ ভাগ থেকে বেড়ে ১৯৯৫-এ ১০ ভাগ-এ দাঁড়িয়েছে। গুড়ো দুধ আমদানির পরিমাণ বছরে পূর্বের ৪৫০ কোটি টাকা থেকে কমে ১৪০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।সরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা, উন্নত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ও গবেষণার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারলে এদেশের পশুসম্পদ অদুর ভবিষ্যতে আরও সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠবে বলে আশা করা

পশুসম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারে এদেশের মানুষের করণীয়ঃ

পশুসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পালন করতে হবে। যথা-

  • গৃহপালিত পশু বিজ্ঞানসম্মতভাবে পালন করতে হবে।
  • পশু থেকে প্রাপ্ত উপজাত দ্রব্য বৈজ্ঞানিকভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে ব্যবহার করতে হবে।
  • উন্নত খাদ্য ও প্রজনন ব্যবস্থার মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল পশুর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
  • বিজ্ঞানসম্মতভাবে পশু পালন করে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
  • কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে শহর অভিমুখী না হয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে
  • লাভজনকভাবে গবাদিপশুর খামার গড়তে হবে।
  • পশু বিশেষজ্ঞদের কর্তব্য হবে এদেশের পরিবেশ অনুযায়ী সীমিত সম্পদের বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে পশুপালনে লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। বিদেশী কাঠামোকে হুবহু অনুসরণ না করে পথ নির্দেশনার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • পশুপালন বিষয় শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সম্প্রসারণে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে।
  • শিক্ষার্থীদের জন্য পশুসম্পদ বিষয়ক বিভিন্নমুখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গবাদিপশু এবং এগুলো থেকে উৎপাদিত দ্রব্য এবং উপজাত দ্রব্যসামগ্রী বাজারজাতকরণেরসুব্যবস্থা করতে হবে।
  • বিত্তহীন ও ভুমিহীন লোকের জন্য ঋণের ব্যবস্থা আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। গবেষণার জন্য আর্থিক সুযোগসুবিধা ছাড়াও গবেষণা সম্পর্কিত সকল বাধা দুরীকরণে সরকার ও জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
  • গবেষণার ফলাফল সঠিকভাবে ব্যবহার করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • আমাদের বিপুল জনশক্তি বিজ্ঞানভিত্তিতে পশুসম্পদ লালনপালন করতে পারলেই পৃথিবীর বিভিন্ন
  • উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশও একদিন ধনী হয়ে ওঠতে পারবে।

বাংলাদেশের পশুসম্পদ ও উপজাত দ্রব্যের পরিসংখ্যান বাংলাদেশের পশুসম্পদ ও এদের থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য এখানে সারণির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

সারণি ১ : গৃহপালিত পশুর পরিসংখ্যান (মিলিয়ন)

 

 

সারণি ২ : দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের বর্তমান উৎপাদন ও প্রয়োজনীয়তার উপাত্ত (১৯৯৯-২০০০ সালের)

 

 

সারণি ৩ : চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ও প্রাপ্ত পশুশক্তি এবং প্রতিবছর উৎপাদিত গোবরের একটি হিসাব

 

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version