আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-কৃষিকাজে পশুর গুরুত্ব
এই পাঠ শেষে আপনি-
কৃষিকাজে গবাদিপশুর প্রত্যক্ষ ব্যবহার বলতে ও লিখতে পারবেন। ধান মাড়াই, আখ মাড়াই, ঘানি টানা প্রভৃতি কৃষির সাথে সম্পর্কিত কাজে পশুর ব্যবহার বর্ণনা করতে পারবেন। মাঠে শস্য উৎপাদন ছাড়াও পশুপাখি এবং মাছ চাষও কৃষিকাজের অন্তর্ভুক্ত। কৃষির সাথে সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি কাজে গবাদিপশুর কিছু না কিছু অবদান রয়েছে।
তবে, মাঠে ফসল উৎপাদনে গবাদিপশুর অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ, বাংলাদেশের সকল কৃষিযোগ্য ভূমি যান্ত্রিক চাষের অধীনে আনা আপাতত সম্ভব নয়। এদেশে পশুশক্তিকে একেবারে বাদ দিয়ে যান্ত্রিক চাষের প্রচলন করতে আরও সময় লাগবে। তাই আমরা বলতে পারি, এদেশে কৃষি আয়ের সিংহভাগই নির্ভর করছে পশুসম্পদের ওপর।
পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কৃষিকাজে পশুশক্তির ব্যবহার হয়। এক তথ্য থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে হালচাষ, গাড়ি টানা ইত্যাদি বাবদ প্রাপ্ত শক্তি এবং গোবর, চনা ইত্যাদির দাম ধরলে পশুসম্পদ জাতীয় অর্থনীতিতে প্রায় ১৫.০% অবদান রাখে। ফসল উৎপাদন করার জন্য যেসব কাজে প্রত্যক্ষভাবে পশুশক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে সেগুলো হলো—
- জমিতে হালচাষ করা,
- শস্যক্ষেতে শস্য নিড়ানি, পশুচালিত পরিবহন,
- জমিতে গোবর ও কম্পোস্ট সারের ব্যবহার প্রভৃতি।
Table of Contents
কৃষিকাজে পশুর গুরুত্ব
হালচাষ
জমিতে বীজ বপনের পূর্বে মাটি নরম করার জন্য চাষ করতে হয়। এজন্য বাঁশ বা কাঠের তৈরি লাঙ্গল ও মই ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ষাঁড় বা মহিষ দিয়ে লাঙ্গল ও মই টানা হয়। একেই হালচাষ বলে। ষাঁড়, মহিষ প্রভৃতি সাধারণত হালচাষের কাজে ব্যবহার করা হয়।
আগেকার দিনে যখন কলের লাঙ্গল ছিল না তখন হালচাষ সম্পূর্ণভাবে গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমান যান্ত্রিক যুগে জমি চাষ করার জন্য ট্র্যাক্টর বা কলের লাঙ্গল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খন্ড খন্ড জমিতে ট্র্যাক্টর চালানো যায় না। ব্যক্তিমালিকানাধীনে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত খণ্ড খণ্ড জমির সৃষ্টি হয়। এসব জমিতে ট্র্যাক্টরের পরিবর্তে পশুচালিত লাঙ্গলের ব্যবহার হয়।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন- ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর প্রভৃতি বিভিন্ন অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ট্র্যাক্টর অপেক্ষা পশুচালিত লাঙ্গলের প্রচলন বেশি।আমাদের দেশে ষাঁড় ও মহিষ জমি চাষে ব্যবহার করা হয়। এদেশে ১০.৮২ মিলিয়ন হালের গরু আছে।
গবেষণা থেকে জানা যায়, একটি মহিষ প্রত্যহ ৫ ঘন্টা কাজ করলে ৫২০ মেগাওয়াট শক্তি ব্যয় হয় এবং কোনো বিরতি ছাড়াই একটানা কয়েকঘন্টা কাজ করতে পারে। একজোড়া বলদ দৈনিক এক একর জমির এক-তৃতীয়াংশ চাষ করতে পারে। হালের পশুর সংখ্যার অভাব মাত্র ৭.৮৫% হলেও মোট কর্ষণ শক্তির অভাব প্রয়োজনের তুলনায় ৪০.৮%।
কারণ, প্রতিটি পশুর শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা ০.২৫ হর্স পাওয়ার থেকে কমে ০.১৭ হর্স পাওয়ারে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও প্রজননের জন্য উন্নতমানের ষাঁড়ের অভাবই এর প্রকৃত কারণ। দেশে ২৩৩৪ মিলিয়ন একর কৃষিভূমির জন্য মোট ৪৯৪২.৩ মিলিয়ন মেগাওয়াট শক্তির প্রয়োজন। কিন্তু, পশু ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া যায় মাত্র ২৯২২.৪ মেগাওয়াট। এরপরও আরও ২০১৯.৮ মিলিয়ন মেগাওয়াট শক্তির প্রয়োজন থেকে যায়। পশু থেকে কতটুকু শক্তি পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর ওপর। যথা-
- পশুর দৈহিক বৈশিষ্ট্য, দেহের গঠন, ওজন ও জাত।
- পশুর খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থা৷
- জলবায়ু, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা।
- পশুর লিঙ্গ (স্ত্রী/পুরুষ)।
- জোয়াল ও মইয়ের আকার, ওজন ও শারীরিক গঠন ইত্যাদি।
সারণি ৫ : খামারপ্রতি ও একরপ্রতি উৎপাদিত পশুশক্তি জরিপের একটি প্রতিবেদন
পশুচালিত পরিবহন
মৌণ পরিবহনে ও মহিষেরকরা হয়।কৃষির সঙ্গে পরিবহন গভীরভাবে সম্পর্কিত। বীজ, যন্ত্রপাতি, সার প্রভৃতি মাঠে আনা-নেয়া, ফসল বাড়িতে ও বাজারে নিয়ে যাওয়া প্রভৃতির জন্য পরিবহনের প্রয়োজন। এসব কাজের জন্য পৃথিবীরবিভিন্ন দেশে গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, মহিষের গাড়ির প্রচলন আছে।
উন্নয়নশীল দেশে যেসব অঞ্চলে পাকা রাস্তা নেই সেখানকার মানুষ পশুচালিত পরিবহনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। পাকিস্তান, ভারত, আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোতে পশুচালিত পরিবহণের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মহিষ ও গরুর গাড়ি প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়।
কৃষির বিভিন্ন কাজে কৃষক প্রধানত এসব গাড়ি ব্যবহার করেন। কারণ—
- বেশিরভাগ গ্রামে পাকা রাস্তা নেই।
- দরিদ্র কৃষক বেশি মূল্য দিয়ে মোটরযান ভাড়া করতে পারে না।
- ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে পশুচালিত পরিবহণ চালানো যায়।
- এসব গাড়ির দাম ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম।
কৃষির অন্যান্য কাজে পশুর গুরুত্ব
মাঠে ফসল উৎপাদন ছাড়াও কৃষির সঙ্গে জড়িত আরও বিভিন্ন ধরনের কাজ আছে, — শস্য নিড়ানি, ধান মাড়াই, আখ মাড়াই, শস্য ভাঙ্গানো ইত্যাদি। এগুলোতেও পশুর ব্যবহার হয়ে থাকে।
শস্য নিড়ানি
শসাক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার না করলে শস্যের ক্ষতি হয়। আগাছা পরিষ্কার করার পদ্ধতিকে নিড়ানি বলে। এজন্য কাঠ দিয়ে লম্বা চিরুনির মতো যন্ত্র তৈরি করা হয়। দেশীয় ভাষায় এটিকে মারাকাচি আঁচড়া বলে। মই ও লাঙ্গলের মতোই মারাকাচিও গরু দিয়ে টানা হয়। তাতে আগাছা উঠে আসে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে আগাছা রৌদ্রে শুকিয়ে যায় ও মাঠ আগাছামুক্ত হয়।
জামিতে গোবর সারের ব্যবহার
বাংলাদেশের কৃষিজমি দিন দিন অনুর্বর হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক মাত্রা ও অনুপাতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। কৃষিজমির উর্বরাশক্তি ফিরে পেতে হলে গবাদিপশুর গোবর সার অত্যন্ত প্রয়োজন। এ সার একদিকে যেমন মাটির সার্বিক অবস্থা উন্নত করে অন্যদিকে অধিক ফসল ঘরে তুলতে সাহায্য করে।
কাজেই প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কৃষি উন্নয়নে পশুসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। গোবর কিছুদিন মাটির গর্তে রাখলে পচে উত্তম সারে রূপান্তরিত হয়। এটা কালো রঙের ও মাটির মতো নরম। এ সার আদিকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে৷ শুষ্ক পদার্থের ভিত্তিতে আমাদের দেশের গোবরে শতকরা ১.৪০-২.০ ভাগ নাইট্রোজেন, ০.৯০-১০ ভাগ ফসফরাস এবং ০.৭০-০৮০ ভাগ পটাশিয়াম থাকে।
এক টন গোবরের শুষ্ক পদার্থে পড়ে ১৭০ কেজি জৈব পদার্থ, ৪৬ কেজি নাইট্রোজেন, ১৯০ কেজি ফসফরাস ও ১৫০ কেজি পটাশিয়াম পাওয়া যায়। এদেশের গোমূত্রে ০.০৪-০.১% নাইট্রোজেন, ০.১৩-০.৪০% পটাশিয়াম, ০.০২-০.১৩% ফসফরাস থাকে। তবে, গবাদিপশুর গোবর ও মূত্রের রাসায়নিক গঠন অবশ্যই খাদ্যেরগুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮০ মিলিয়ন টন কাঁচা বা ২২ মিলিয়ন টন শুকনো গোবর উৎপন্ন হয় যা বর্তমানের রাসায়নিক সারের ১০%।
কম্পোস্ট যা আবর্জনা
গবাদিপশুর উচ্ছিষ্ট খড়কুটা থেকে কম্পোস্ট সার তৈরি করা যায়। কম্পোস্ট অর্থ মোটামুটি অপচনশীল ও পূর্ণক্ষহীন জৈব পদার্থ যা বায়ুর উপস্থিতিতে উত্তাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এক বা একাধিক জৈব পদার্থের মিশ্রণ পচনের পর উৎপন্ন হয়। কম্পোস্ট (দখলাময়া) ল্যাটিন শব্দ। গরু-বাছুরের উচ্ছিষ্ট খাবারের সঙ্গে আগাছা, কচুরিপানা, শস্যের অবশিষ্টাংশ মিশ্রিত করে কয়েকটি স্তরে সাজিয়ে পচানো হয়৷ কম্পোস্ট সার জমিতে আদর্শ জৈব পদার্থ যোগ করে। শাকশবজি ও ফলের চারা জন্মানোর জন্যেই এ সার বীজতলায় ব্যবহার করা অপরিহার্য।
জ্বালানি কাজে শুকনো গোবরের ব্যবহার
শুকনো গোবর আমাদের গ্রাম বাংলায় কৃষকের ঘরে উত্তম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এদেশের গরীব কৃষক সম্প্রদায় নিতান্ত অভাবী। কেরোসিন কিংবা কাঠ কেনার মতো সঙ্গতি তাদের নেই। অথচ কৃষকের বাড়িতে কৃষির আনুসাঙ্গিক কাজ, যেমন- ধান সিদ্ধ, মুড়ি বা খই ভাজা প্রভৃতিতে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন।
সাধারণত শুকনো গোবর, গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে তারা জ্বালানির কাজ চালায়। এছাড়াও গরুর গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানি হিসেবে এবং অবশিষ্ট গোবর সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এখানে ধান মাড়াই, আখ মাড়াই, ঘানি টানা প্রভৃতি কৃষিকাজে পশুশক্তির ব্যবহার সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
ধান মাড়াই
ধান মাড়াইয়ের কাজেও পশুশক্তি ব্যবহৃত হয়। গাছ থেকে ধান ছাড়ানোকে ধান মাড়াই বলে। ধান মাড়াই কাজে একরে অনেকগুলো গরু ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে মাঠে ধানগাছগুলো হাত দিয়ে ছাড়িয়ে ধানগাছের বিছানা তৈরি করা হয়।
বিছানো ধানের মাঝখানে একটি গরু রাখা হয়। ঐ গরুটির সংগে আরও গরু সারিবদ্ধভাবে বেঁধে ছড়ানো ধানের উপর ঘোরানো হয়। মাঝখানের গরুটি আস্তে আস্তে ঘুরতে থাকে এবং সবগুলো গরুকে চক্রাকারে ঘুরতে সাহায্য করে। গরুর পা দিয়ে দলিত মথিত হয়ে গাছ থেকে ধান আলাদা হয়ে আগে।
আখ মাড়াই
আমাদের দেশের বহু কৃষক আখ চাষ করেন। আখ থেকে গুড়ও উৎপাদন করেন, বিশেষ করে যেসব এলাকায় চিনির কল নেই। আখ থেকে রস বের করার পদ্ধতিকে আখ মাড়াই বলে। আখ মাড়াইয়ের কাছে গবাদিপশু ব্যবহার করা হয়।
খানি টানা
এদেশের কৃষকদের মধ্যে কলু নামে এক সম্প্রদায় আছে যারা তেলবীজ থেকে তেল উৎপাদন করেন। সরিষা, তিল বা নারিকেল থেকে তেল উৎপাদন করার জন্য ঘানি টানার কাজে গবাদিপশু ব্যবহার করা হয়।