আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- মহিষের বাসস্থান, পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ব্যবস্থা।
এই পাঠ শেষে আপনি-
- বিভিন্ন বয়সের মহিষের জন্য বাসস্থান তৈরি ও প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ লিখতে পারবেন।
- মহিষের সাধারণ পরিচর্যাসমূহ বলতে পারবেন।
- বিভিন্ন বয়সের মহিষের পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ব্যবস্থা বর্ণনা করতে পারবেন।
Table of Contents
মহিষের বাসস্থান, পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ব্যবস্থা
মহিষের বাসস্থান
গরু, ছাগল এবং অন্যান্য গবাদিপশুর ন্যায় মহিষেরও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের প্রয়োজন। যদিও গ্রামে- গঞ্জে দুচারটা মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থান বা ঘরের ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না । তথাপি, খামারভিত্তিতে একসঙ্গে অনেক মহিষ পালন করতে হলে ঘর তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
এদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, হাওড় এলাকা ও আঁখ উৎপাদনকারী এলাকায় অনেকেই ৪০/৫০ থেকে ১০০ বা ততোধিক মহিষ পালন করে থাকেন। এদের জন্য বাসস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । মহিষের ঘর গরুর অনুরূপভাবেই তৈরি করা যায়।
তবে, ঘর তৈরিতে মজবুত অথচ সস্তা জিনিসপত্রই ব্যবহার করা উচিত। মহিষের ঘর তৈরিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিত। যেমন-
- ঘর স্বাস্থ্যসম্মত ও আরামপ্রদ হবে । এতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকবে।
- মেঝে মজবুত হবে ও তাতে পিচ্ছিলভাব থাকবে না। ঘরে প্রতিটি মহিষের জন্য বয়স অনুপাতে প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা থাকবে।
- উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে।
- এই পাঠে বিভিন্ন বয়সের মহিষের জন্য ঘর ও প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ আলাদাভাবে বর্ণনা করাহয়েছে।
বাছুরের ঘর
বাছুরের ঘর শুদ্ধ ও আলো-বাতাসপূর্ণ হওয়া উচিত। এতে ঝড়ঝাপ্টা ও ঠান্ডা হাওয়া প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জন্মের প্রথম মাসে একঘরে একসঙ্গে অনেক বাছুর রাখা উচিত নয়। বরং এদেরকে পৃথক পৃথক খোপে (pon) রাখলে প্রতিটি বাছুরের আলাদাভাবে যত্ন নিতে সুবিধা হয়। একমাস বয়স পর্যন্ত প্রতিটি বাছুরের জন্য ১.০ মিটার x ১.৫ মিটার আকারের খোপের প্রয়োজন।
বাছুরের বয়স একমাসের বেশি হলে ১০, ১৫, ২০ বা ততোধিক বাছুর একসঙ্গে একই ঘরে পালন করা যেতে পারে। এসব ঘরের সামনের দিকে কিছুটা খোলা জায়গা রাখতে হবে যাতে এরা সেখানে সুবিধামতো চলাফেরা বা ব্যয়াম করতে পারে এবং দেহে সূর্যের আলো লাগাতে পারে।
বকনা মহিষের ঘর
গ্রামাঞ্চলে বকনা মহিষ অন্যান্য মহিষের সঙ্গে একই ঘরে বা গোয়ালে রাখা হয়। এতে অনেক সময় গোয়াল ঘর অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পালন করতে হলে অবশ্যই বকনা ও ষাঁড় মহিষ পৃথক পৃথক ঘরে রাখতে হবে। এদেরকে সাধারণত ছাদবিহীন বা উদোম ঘরে (loose house) রাখা হয়। এখানে বিশ্রাম ও খাবার খাওয়ানোর জায়গার ব্যবস্থা থাকে। বিশ্রামের স্থানটুকু ছাদযুক্ত হয় এবং মেঝেতে খড় বা শুকনো ঘাস বিছানো থাকে।
খাবার খাওয়ানোর জায়গাটি পাকা হবে। পানি ও খাবারের জন্য আলাদা পাত্র বা চাড়ির (manger) ব্যবস্থা করতে হবে। তবে, এই স্থানে কোনো ছাদ থাকে না। এই ধরনের ঘরে প্রতিটি অগর্ভবর্তী বকনা মহিষের জন্য ৫-৬ বর্গ মিটার উদোম/ছাদবিহীন স্থানঃ ১.০-১.৫ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৪০-৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন। প্রতিটি গর্ভবর্তী বকনার জন্য ৮-১০ বর্গ মিটার উদোম / ছাদবিহীন স্থান; ৩-৪ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৫০- ৭৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন।
প্রসূতি মহিষের ঘর
গর্ভবতী মহিষকে বাচ্চা প্রসবের সপ্তাহখানেক পূর্বে অন্যান্য মহিষ থেকে পৃথক করে প্রসূতি ঘরে (maternity box or pen) রাখা উচিত। প্রসূতি ঘর ৯-১০ বর্গ মিটারের চেয়ে ছোট হওয়া উচিত নয়।
এঁড়ে মহিষের ঘর
এঁড়ে মহিষকে ছয় মাস বয়সের সময় বকনা থেকে পৃথক করে আলাদা ঘরে পালন করা হয়। এঁড়ের ঘর বকনার মতোই উদোম হয়। ৬-১২ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিটি এঁড়ে মহিষের জন্য ৪-৫ বর্গ মিটার বিশ্রামের স্থান এবং ১৩-১৪ মাস বয়স পর্যন্ত প্রতিটির জন্য ৫-৬ বর্গ মিটার বিশ্রামের স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ষাঁড় মহিষের ঘর
একটি পূর্ণবয়স্ক ষাঁড় মহিষের জন্য ১০-১২ বর্গ মিটার আয়তনবিশিষ্ট ছাদযুক্ত ঘরের প্রয়োজন। এই ঘরের দুপার্শ্ব উন্মুক্ত হবে এবং উন্মুক্ত দিকে ১৫-২০ বর্গ মিটার স্থান জুড়ে খোলা ওঠোন থাকবে। ওঠোনের চারদিকে মোটা লোহার পাইপ বা শক্ত ইটের দেয়াল থাকা উচিত। ষাঁড়ের ঘরে খাবারের চাড়ি ও ষাঁড়কে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মহিষের পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন ব্যবস্থা
মহিষকে সুস্থ সবল ও কর্মক্ষম রাখা এবং এদের থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন পেতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও যত্ন বা পরিচর্যার প্রয়োজন। তাছাড়া এদেরকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে লালনপালন করতে হবে। পরিচর্যা ও স্বাস্থ্যসম্মত লালনপালন বলতে সময়মতো খাবার পরিবেশন করা, গর্ভবতী মহিষের যত্ন, বিভিন্ন বয়সের মহিষের পরিচর্যা, অসুস্থদের চিকিৎসা করানো, সুস্থগুলোকে সময়মতো টিকা প্রদান, কৃমির ওষুধ খাওয়ানো, ঘর ও আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করা ইত্যাদি বোঝায়। সব বয়সের মহিষের জন্যই কিছু কিছু সাধারণ পরিচর্যা রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন বয়স ও অবস্থাভেদে বিশেষ ধরনের পরিচর্যারও প্রয়োজন হয় ।
সাধারণ পরিচর্যাসমূহ
- মহিষ মূলতঃ আধা-পানির (semi aquatic) নিশাচর প্রাণী। তাই পানির প্রতি এদের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। মহিষের দেহে প্রয়োজনের তুলনায় ঘর্মগ্রন্থির সংখ্যা খুবই কম। তাই নদীর মহিষ পরিষ্কার পানি এবং জলাশয়ের মহিষ ডোবা-নালার কর্দমাক্ত পানি গায়ে মেখে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। একারণে যেখানে ডোবা-নালা নেই সেখানে ছায়াযুক্ত স্থানে পাইপের সাহায্যে দিনে অন্তত দুবার মহিষের গায়ে পানি ছিটানো প্রয়োজন।
- প্রতিদিন এদের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। গোবর, চনা আলাদা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার জীবাণুনাশক ওষুধ (যেমন- আয়োসান) দিয়ে ঘর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- এদের গা ভালোভাবে ডলে দিতে হবে এবং নিয়মিত গোসলের ব্যবস্থা করতে হবে।
- মহিষের সংখ্যা বেশি হলে চিহ্নিত করার জন্য কানে ট্যাগ নম্বর লাগাতে হবে। প্রয়োজনে, বিশেষ করে ভারবাহী মহিষের ক্ষেত্রে, পায়ে লোহার তৈরি সু বা জুতো লাগাতে হবে।
- নিয়মিত সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। তাছাড়া পরিষ্কার পানিরও ব্যবস্থা করতে হবে।
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের সময় পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
- ঘরের কোনো মহিষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে পৃথক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
- সকল বয়সের মহিষকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা প্রদান করতে হবে।
বিশেষ পরিচর্যা
বাছুরের পরিচর্যা
প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাছুর ও প্রস তি মহিষের আলাদা বাসস্থান ও খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সদ্যপ্রসূত বাছুর যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে শালদুধ বা কলস্ট্রাম পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাছুরের নাভিতে জীবাণুনাশক ওষুধ লাগাতে হবে ও নিয়মিত যত্ন করতে হবে যেন তাতে কোনো রোগজীবাণুর সংক্রমণ না ঘটে।
বাছুরের বয়স দুসপ্তাহ হওয়ার পূর্বেই কৃমিনাশক ওষুধ, যেমন- পাইপারজিন অ্যাডিপেট বা সাইট্রেট সেবন করাতে হবে। গোবসন্ত, বাদলা, তড়কা ও গলাফোলা রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শমতো নির্দিষ্ট সময়ে টিকা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনবোধে বাছুরকে নির্দিষ্ট সময়ে বলদ বানিয়ে নিতে হবে।
বকনা মহিষের পরিচর্যা
বকনা মহিষের সঠিক পরিচর্যার ওপর এদের থেকে ভবিষ্যতে ভালো উৎপাদন পাওয়া নির্ভর করে। বকনা মহিষ পরবর্তীকালে দুগ্ধবতী মহিষকে প্রতিস্থাপন করে, তাই এদেরকে সঠিকভাবে যত্ন না করলে ভবিষ্যতে দুধ উৎপাদন ভালো হবে না। বকনা মহিষের যত্ন সঠিক না হলে এদের পূর্ণতাপ্রাপ্তি দেরিতে ঘটবে। ফলে বাচ্চা পেতে বিলম্ব হবে। এদের খাবারদাবারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। তাছাড়া এদের ঘর নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। কোনো পোকামাকড় যেন বকনার ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত ধৌত করা, গা ডলা ও পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মহিষের পরিচর্যা
গর্ভবতী মহিষকে বাচ্চা প্রসবের অন্তত এক সপ্তাহ পূর্বে অন্যান্য মহিষ থেকে পৃথক করে প্রসূতি ঘরে পালন করতে হবে। প্রসূতি ঘরে স্থানান্তরের পূর্বে তা উত্তমরূপে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। গর্ভবর্তী মহিষকে প্রসবের ৬-৮ সপ্তাহ পূর্ব থেকে দানাদার খাদ্যসহ প্রচুর পুষ্টিকর খাদ্য প্রদান করতে হবে।
প্রসবের এক সপ্তাহ পূর্ব থেকে প্রচুর কাঁচা ঘাস সরবরাহ করতে হবে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রসবের সময় কোনো প্রসববিঘ্ন ঘটে কি-না তা দূর থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রসববিঘ্ন দেখা দিলে বা প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গর্ভফুল (placenta) জরায়ু (uterus) থেকে বেরিয়ে না আসলে নিকটস্থ ভেটেরিনারি সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে।
প্রসবের পর প্রসূতির দেহ কুসুম গরম পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। এরপর এদেরকে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রদান করতে হবে।