ছাগলের বাচ্চাকে খাসি বানানো

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়- ছাগলের বাচ্চাকে খাসি বানানো। প্রথমেই প্রশ্ন আসতে পারে – খাসি এবং ছাগলের মধ্যে পার্থক্য কী? আসলে এরা উভয়ই ছাগলের পুরুষ প্রজাতি। তবে জন্মের কিছুদিন পরে যেসব পুরুষ ছাগলের লিঙ্গের অণ্ডকোষ কেটে ফেলে দেওয়া হয় সে সব শাবককেই খাসি বলা হয়। আর যেসব শাবক পুরুষ ছাগলের এই অপারেশন হয় না তাদেরকেই পাঠা বলা হয়। অণ্ডকোষ কাটলে খাসী প্রজনন অক্ষম হয়, ফলে অন্যদিকে মনোযোগ না দিয়ে, শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া করে মোটাতাজা হয়। পাশাপাশি খাসি করলে মাংস থেকে দুর্গন্ধ চলে যায় ও আরও সুস্বাদু হয়।

 

এই পাঠ শেষে আপনি-

  • ছাগলের বাচ্চার খাসিকরণ ও তার পদ্ধতিসমূহের নাম লিখতে পারবেন।
  • বাচ্চাকে খাসি বানানোর বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো নিজ হাতে করে দেখাতে পারবেন।

 

Table of Contents

ছাগলের বাচ্চাকে খাসি বানানো

 

 

খাসিকরণ/খোজাকরণ (Castration):

পুরুষ ছাগল ছানার প্রজনন ক্ষমতা লোপ বা নষ্ট করে দেয়াকে খানিকরণ বা খোঁজাকরণ বলে।

খাসি করার সুবিধা:

  • এতে ছাগলের বিশৃঙ্খল বা অপরিকল্পিত যৌন মিলন রোধ হয়।
  • খাসিকৃত ছাগল কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই ছাগীর সঙ্গে একত্রে পালন করা যায় ।
  • এতে মাংসের মান উন্নত হয়।
  • খাসিকরণের ফলে এরা শান্ত স্বভাবের হয়ে যায়, ফলে পালন করতে বেশ সুবিধা হয় ।
  • প্রজনন নীতিমালা সহজে কার্যকরী করা যায়।

 

খাসি করার বয়স:

সাধারণত ২-৩ মাস বয়সের মধ্যেই ছাগল ছানাকে খাসি করা হয়। তবে ১-২ সপ্তাহ বয়সের বাচ্চাকেও খাসি করা যেতে পারে। কিন্তু এত অল্প বয়সে খাসি করা হলে ভবিষ্যতে এদের মূত্রপথে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

 

খাসি করার পদ্ধতি:

খাসি বানানোর বেশ ক’টি পদ্ধতি রয়েছে। প্রতিটি পদ্ধতিরই সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। পদ্ধতিগুলো নিম্নোক্ত দু’ভাগে বিভক্ত। যথা-

১. উন্মুক্ত পদ্ধতি (Open method) :

যে পদ্ধতিতে অন্ডকোষথলি (scrotum) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে উন্মুক্ত বা ছেলন করে স্পারমেটিক কর্ড বা শুক্রবাহী নালী (spermatic cord) কেটে নিয়ে অন্ডকোষ বা শুক্রাশয় (testes) বের করে ফেলা হয়, তাকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খাসিকরণ বলে।

২. আবৃত পদ্ধতি (Closed method) :

অন্ডকোষথলি ছেদন বা উন্মুক্ত না করে খাসি বানানোর পদ্ধতিকে আবৃত পদ্ধতিতে খাসিকরণ বলে। যেমন- ক. বার্ডিজো ক্যাস্ট্রেটর পদ্ধতি ও খ. রাবার রিং পদ্ধতি।

 

১. উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খাসি বানানো

প্রয়োজনীয় উপকরণ

১.        ২-৩ মাস বা তার চেয়েও কম বয়সী একটি পুরুষ ছাগল ছানা

 

২.        যন্ত্রপাতি-

ক. যন্ত্র পাতি রাখার জন্য স্টিল বা প্লাস্টিকের তৈরি ট্রে- ১টি

খ. শেভিং ব্লেড- ১ টি

গ. কাঁচি (scissors) – ১ জোড়া

ঘ. স্কালপেল (scalpel)- ১টি

ঙ. সিরিঞ্জ ও সূঁচ (syringe and needle)- ১টি করে

চ. বাঁকা সূঁচ (curved traumatic needle)- ১টি

ছ. নাইলন বা সিল্ক সুতো- পরিমাণমতো

ঝ. তুলো- পরিমাণমতো

 

৩. রাসায়নিক দ্রব্য-

ক. স্থানিক অবশকারী দ্রব্য (local anaesthetics)- (উদাহরণ- লিগনোকেইন হাইড্রোক্লোরাইড, যেমন- জেসোকেইন)

খ. টিঙ্কচার আয়োডিন

গ. আয়োসান (১%)

ঘ. সাবান ইত্যাদি

 

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খাসি করার কাজের ধাপ:
  • জীবাণুনাশকপূর্ণ (আয়োসান ১%) ট্রেতে করে প্রয়োজনীয় যন্ত্র পাতি ও তুলো নিন।
  • ছাগল ছানাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন। এই কাজে সহায়তা করার জন্য একজন সহকারী নিন। সহকারী চেয়ারে বসে বাচ্চার দু’টো করে পা দু’হাতে ধরে (চিত্র ৭১ দেখুন) নিয়ন্ত্রণ করবেন। এছাড়াও কাঠের পিড়িতে বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
  • অন্ডকোষথলির ত্বকের লোম শেভিং ব্লেডের সাহায্যে ভালোভাবে হেঁচে সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করে টিঙ্কচার আয়োডিন লাগিয়ে নিন ।
  • সিরিঞ্জ ও সূঁচের সাহায্যে ২-৫ মি.লি. পরিমাণ স্থানিক অবশকারী দ্রব্য নিন। এর কিছু পরিমাণ অন্ডকোষথলির ত্বকের নিচে এবং বাকি অংশ সরাসরি শুক্রাবাহী নালী বা স্পারমেটিক কর্ডে ইনজেকশন করুন। ৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে অন্ডকোষ, ডারমেটিক কর্ডও অন্ডকোষথলি অবশ হয়ে যাবে।
  • অন্ডকোষথলির গলা বাম হাতে করুন। ডান হাতে স্কালপেল নিয়ে অন্ডকোষথলির ত্বকের নিাংশ “ঔ” আকৃতিতে ছেলন করুন। এবার স্কালপেল জীবাণুনাশকপূর্ণ ট্রেতে রেখে ডান হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে অণ্ডকোষকে টেনে বের করুন।
  • স্ক্রুটাল লিগামেন্ট (scrotal ligament) স্কালপেল বা কাঁচি দিয়ে কেটে স্পারমেটিক কর্ড নাইলন বা সিল্ক সুতো দিয়ে শক্ত করে বেধে নিন। বাধা স্থানের প্রায় ২ সে.মি. নিচ থেকে অন্ডকোষ কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলুন।
  • কাজের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন ও শিক্ষককে দেখান।

 

 

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খাসি করার সুবিধা

অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এটি নির্ভরযোগ্য। অস্ত্রোপচারোত্তর ব্যাথা বা যন্ত্রণা অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা কম ।

উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খাসি করার অসুবিধা

ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় সহজেই জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। একারণে এই পদ্ধতি প্রয়োগের পূর্বে ও পরে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

 

২. আবৃত পদ্ধতি

ক. বার্ডিঙ্গো ক্যাস্ট্রেটর পদ্ধতি (Burdizzo’s Castrator method)

আবৃত পদ্ধতির প্রাসঙ্গিক তথ্য

বার্ডিজো যন্ত্র আবিষ্কারকের নামানুসারে এই পদ্ধতিটির নামকরণ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিটি রক্তপাতহীন পদ্ধতি (bloodless method) নামে বিশেষভাবে পরিচিত। এই যন্ত্রটির পেষণ তল দু’টি ভোতা হয়। এর সাহায্যে অন্ডকোষথলির মধ্যের স্পারমেটিক কর্ডকে প্রবল চাপে পেষণ করা যায়। এতে শুক্রাশয়ের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পুষ্টির অভাবে অন্ডকোষ দু’টি ধীরে ধীরে শুকিয়ে অকেজো হয়ে যায়।

আবৃত পদ্ধতিতে খাসি করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ
  1. বার্ডিজো ক্যাস্ট্রেটর
  2. টিচার আয়োডিন
  3. ভুলো
  4. স্থানিক অবশকারী দ্রব্য (প্রয়োজনবোধে )

 

আবৃত পদ্ধতিতে খাসি করার কাজের ধারা
  • প্রথমে ছাগলটিকে উন্মুক্ত পদ্ধতির ন্যায় ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করুন ।
  • অন্ডকোষথলির গলার চারদিকে তুলোর সাহায্যে টিঙ্কচার আয়োডিন লাগান।
  • প্রয়োজনবোধে স্থানিক অবশকারী দ্রব্য উন্মুক্ত পদ্ধতির ন্যায় প্রয়োগ করুন ।
  • প্রথমে ডান পাশের অন্ডকোষটি বাম হাত দিয়ে টেনে অন্ডকোষের ১-২ সে.মি. উপরে অন্ডকোষথলির গলায় স্পারমেটিক কর্ডের উপর ডান হাতের সাহায্যে বার্ডিঙ্গো ক্যাস্ট্রেটর লাগিয়ে জোরে পেষণ করুন। প্রায় আধা থেকে এক মিনিট পর যন্ত্রটি ছুটিয়ে নিন। এরপর স্পারমেটিক কর্ডটি ভালোভাবে পেষণ হয়েছে কি-না দেখে নিন।
  • এবার পেষণ করা স্থানের ১ সে.মি. নিচে পুনরায় একই নিয়মে পেষণ করুন।
  • ডানপাশের পর বামপাশও একই নিয়মে দু’বার পেষণ করুন। এভাবে পেষণে খাসিকরণের ফলাফল সন্তোষজনক হয়।
  • কাজের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন ও শিক্ষককে দেখান।

 

আবৃত পদ্ধতির সাবধানতা
  • পেষণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন স্পারমেটিক কার্ডটি পিছলে না যায়।
  • ত্বকের ভাঁজে যেন পেষণ করা না হয়।
  • অন্ডকোষ যেন পেষণ করা না হয়।

 

আবৃত পদ্ধতির সুবিধা

বাইরের অংশে কোনো ক্ষতের সৃষ্টি হয় না। তাই জীবাণু সংক্রমণের তেমন কোনো ঝুঁকি থাকে না।

 

আবৃত পদ্ধতির অসুবিধা

অনেকক্ষেত্রে বার্ডিজো ক্যাস্ট্রেটর কর্ডকে পেষণ করতে ব্যর্থ হয়। আবার অত্যধিক পেষণে অন্ডকোষথলির ত্বক ও অন্যান্য অঙ্গের কলা (tissue) বিনষ্ট হতে দেখা যায়। এ পদ্ধতি প্রয়োগের পর অত্যধিক ব্যথা হয় এবং দু’তিন সপ্তাহ পর্যন্ত জায়গাটি ফুলে থাকে।

 

৩. রাবার রিং পদ্ধতি (Rubber ring method)
রাবার রিং পদ্ধতির প্রাসঙ্গিক তথ্য

এই পদ্ধতিতে ইলাস্ট্রেটর ( elastrator) নামক যন্ত্রের সাহায্যে একটি শক্ত রাবারের রিং বা বলয় বাচ্চা ছাগলের অন্ডকোষথলির গলায় পরিয়ে দেয়া হয়। ফলে অক্রাশয়ের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে পুষ্টির অভাবে শুক্রাশয় অন্ডকোষথলিসহ শুকিয়ে খসে পড়ে। সাধারণত বাচ্চার ৭দিন বয়সের মধ্যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। অবশ্য এটি আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয় না। সাধারণত বৃহৎ ছাগল খামারে যেখানে শত শত বা হাজার হাজার ছাগল পালন করা হয় সেখানে এই পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয় ।

রাবার রিং পদ্ধতির প্রয়োজনীয় উপকরণ

১. ইলাস্ট্রেটর

২.রাবার রিং

 

রাবার রিং পদ্ধতিতে কাজের ধাপ
  • রাবারের রিং পরানোর পূর্বে থলির নিচে অন্ডকোষ নেমে আছে কিনা তা দেখে নিন। মনে রাখতে হবে যে, স্ক্রুটাল হার্ণিয়ার (scrotal hernia) ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে না।
  • রাবারের রিং অন্ডকোষের উপরে ও অন্ডকোষথলির গলায় (চিত্র ৭৪ দেখুন) পরিয়ে দিন। অন্ডকোষদ্বয় থলির মধ্যে আছে কিনা আগে তা দেখে নিন ।
  • বাচ্চা যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ মায়ের দুধ পান করতে পারে এবং অস্বস্থিবোধ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
  • কাজের ধাপগুলো ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন ও শিক্ষককে দেখান।

 

রাবার রিং পদ্ধতির সুবিধা
  • খাসিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে এটিই সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।
রাবার রিং পদ্ধতির অসুবিধা
  • বাচ্চার ৭দিন বয়সের পর এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে না।
  • অন্ডকোষথলি খসে পড়ার কারণে ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয় যা জীবাণু সংক্রমণের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ থাকে ।

 

অনুশীলন (Activity) : খাসিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে আপনার মতে ছাগলের জন্য কোটি সবচেয়ে ফলদায়ক? আপনার মতামতের স্বপক্ষে যুক্তি দিন।

 

ছাগলের বাচ্চাকে খাসি বানানো পাঠের সারমর্ম :

পুরুষ ছাগল ছানার প্রজনন ক্ষমতা লোপ বা নষ্ট করে দেয়াকে খাসিকরণ বলে। সাধারণত ২-৩ মাস বয়সের মধ্যেই ছাগল ছানাকে খাসি করা হয়। তবে, ১-২ সপ্তাহ বয়সেও করা যেতে পারে। খাসি বানানোর বেশ ক’টি পদ্ধতি রয়েছে। প্রতিটি পদ্ধতিরই সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। এগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। যথা- উন্মুক্ত পদ্ধতি ও আবৃত পদ্ধতি। আবৃত পদ্ধতি আবার দু’ভাগে বিভক্ত। যথা- বার্ডিজো ক্যাস্ট্রেটর পদ্ধতি ও রাবার রিং পদ্ধতি।

খাসিকরণের সবগুলো পদ্ধতির মধ্যে অনাবৃত পদ্ধতি বেশি নির্ভরযোগ্য। এতে অস্ত্রোপচারোত্তর ব্যাথা বা যন্ত্রণা অন্যান্য পদ্ধতি | অপেক্ষা কম। তবে, ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় সহজেই জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই এই পদ্ধতি | প্রয়োগের পূর্বে ও পরে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। আবৃত পদ্ধতির মধ্যে বার্ডিজো পদ্ধতি বেশি প্রচলিত।

এতে কোনো ক্ষতের সৃষ্টি হয় না। তবে, অনেকক্ষেত্রে বার্ডিজো ক্যাস্ট্রেটর কর্ডকে পেষণ করতে ব্যর্থ হয়। এই পদ্ধতি প্রয়োগের পর অত্যধিক ব্যথা হয় ও দু’তিন সপ্তাহ পর্যন্ত জায়গাটি ফুলে থাকে । খাসিকরণের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে রাবার রিং পদ্ধতিই সবচেয়ে সহজ। এতে অন্ডকোষথলি খসে পড়ার কারণে ছোট ক্ষতের সৃষ্টি হয় যা জীবাণু সংক্রমণের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ থাকে । তবে, বাচ্চার ৭ দিন বয়সের পর এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে না ।

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version