মুরগির রোগ ব্যবস্থাপনা, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দানাদার খাদ্য তৈরি

মুরগির রোগ ব্যবস্থাপনা, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দানাদার খাদ্য তৈরি- আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের, ৯ নং ইউনিটের ৯.৩ এবং ৯.৪ নং পাঠ।

 

Table of Contents

মুরগির রোগ ব্যবস্থাপনা, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দানাদার খাদ্য তৈরি

 

রোগব্যাধি মুরগির জন্য এক বিরাট হুমকি। মুরগি খামারে লোকসানের যতগুলো কারণ রয়েছে রোগব্যাধি তার অন্যতম। রোগব্যাধি থেকে মুরগিকে রক্ষা করতে না পারলে খামার থেকে লাভ তো দূরের কথা খামারের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কাজেই মুরগির রোগব্যাধি সম্পর্কে খামারিদের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবেই এ ব্যাপারে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন। সুস্থ ও অসুস্থ মুরগির লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো জানা থাকলে খামারিরা তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

 

 

মুরগির রোগ ব্যবস্থাপনা:

 

সুস্থ ও অসুস্থ মুরগি চেনার উপায়:

১. সুস্থ মুরগি সব সময় সতর্ক ও সক্রিয় থাকবে। অসুস্থ মুরগি দীর্ঘক্ষণ ধরে চুপ করে ঝুমতে থাকবে।

২. সুস্থ মুরগি স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াবে। অসুস্থ মুরগি দল থেকে আলাদা হয়ে মাথা দেহের ভিতরে গুঁজে থাকবে।

৩. সুস্থ মুরগির মাথার ঝুঁটি উজ্জ্বল লাল হবে। তবে অসুস্থ মুরগির মাথায় ঝুঁটি নীলচে বর্ণের হতে পারে।

৪. সুস্থ মুরগির পালক চকচকে হবে। অসুস্থ মুরগির পালক উসকো—খুসকো থাকবে।

৫. সুস্থ মুরগির পায়ের আঁইশগুলো মসৃণ হবে। আঁইশ ঝুলে পড়া মুরগি মাইট আক্রান্ত।

৬. সুস্থ মুরগির চোখ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকবে। অসুস্থ মুরগির চোখ ও নাক দিয়ে কোন তরল পদার্থ নিংসৃত হবে।

৭. সুস্থ মুরগির পায়ের আঙুল সোজা থাকবে। মুরগির উপর ও নিচের ঠোঁট মাঝখানে মিলিত হবে। ঠোঁট দুটি কখনো ও পরস্পর ছেদ করবে না।

৮. সুস্থ মুরগির পায়ুপথের চারিদিকের পালক পরিষ্কার থাকবে।

৯. সুস্থ মুরগি স্বাভাবিকভাবে খাবার গ্রহণ করবে। অসুস্থ হলে খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে চাইবে।

১০. সুস্থ মুরগির দেহের তাপমাত্রা ১০৬—১০৭ ফারেনহাইটের মধ্যে থাকবে। কম বা বেশি হলে বুঝতে হবে মুরগিটি অসুস্থ।

 

 

মুরগির রোগব্যাধির শ্রেণি বিভাগ:

মুরগি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রোগ সৃষ্টিকারী কারণের উপর ভিত্তি করে মুরগি রোগ নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করা হয়েছে। যথা:

 

১. ভাইরাসঘটিত রোগসমূহ:

ভাইরাসঘটিত রোগগুলোর মধ্যে রাণীক্ষেত, বসন্ত, গামবোরো, ইনফেক্শাস বার্সাইটিস, সংক্রামক ক্লোমনালী প্রদাহ, মারেক—এর রোগ, লিউকোসিস, এনসেফালোমাইয়েলাইটিস, বৃক্ক প্রদাহ, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইতাদি অন্যতম।

 

২. ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগসমূহ:

ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগগুলোর মধ্যে পুলোর, কলেরা, টাইফয়েড, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বা সি.আর.ডি., ক্ষতসৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ, করাইজা, যক্ষা, বটুলিজম, ই.কলাই ইনফেকশান ইত্যাদি অন্যতম।

 

৩. ছত্রাকঘটিত রোগসমূহ:

ছত্রাকঘটিত রোগগুলোর মধ্যে ব্রুডার নিউমোনিয়া, আফলাটক্সিকোসিস, মাইকোটক্সিকোসিস ইত্যাদি অন্যতম।

 

৪. মাইকোপ্লাজমাঘটিত রোগসমূহ:

মাইকোপ্লাজমাঘটিত রোগগুলোর মধ্যে মাইকোপ্লাজমোসিসই প্রধান।

 

৫. পরজীবীঘটিত রোগসমূহ:

পরজীবীঘটিত রোগগুলোর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:

ক. প্রোটোজোয়াঘটিত:

প্রোটোজোয়াঘটিত রোগগুলোর মধ্যে কক্সিডিওসিসই প্রধান।

খ. অন্তঃপরজীবী বা কৃমি:

বিভিন্ন কৃমি, যেমনÑ গোলকৃমি, সিকাল কৃমি, গেপ কৃমি, ফিতা কৃমি প্রভৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি রোগগুলোই প্রধান।

গ. বহিঃপরজীবী:

বহিঃপরজীবীগুলোর মধ্যে উকুন, আটালি, মাইট ইত্যাদির কারণে সৃষ্টি রোগগুলোর প্রধান।

 

৬. অপুষ্টিজনিত রোগসমূহ:

অপুষ্টিজনিত রোগগুলোর মধ্যে নিউট্রিশনাল রোপ, রিকেট, কার্লড টো প্যারালাইটিস, চিক ডার্মাটাইটিস, এনসেফালোম্যাসিয়া ইত্যাদি অন্যতম।

 

মুরগির সাধারণ রোগ বালাই :

উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির মধ্যে কয়েকটি সাধারণ রোগ যা সবসময়ই মুরগি খামারে দেখা যায়, সেগুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

 

১। রাণীক্ষেত/চুনা হাগা রোগ

এটি একটি মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ। এ রোগ এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে খুব দ্রুত ছড়ায়। এ রোগ মুরগি থেকে মানুষ বা মানুষ থেকে মুরগিতে ছড়াতে পারে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে চোখে সমস্যা দেখা যায়। সাধারণত অতিরিক্ত গরম/ঠান্ডা পড়লে এ রোগ দেখা যায়। ছোট বাচ্চা এবং বড় মুরগি উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এতে মৃত্যুর হার ১০০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।

লক্ষণ:

১. সাদা চুনের মতো পায়খানা করে। সবুজ ও হলুদ পায়খানাও হতে পারে।
২. ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে মাথা দুই পায়ের ভিতরে ঢুকাতে দেখা যায়।
৩. ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে।
৪. শ্বাসকষ্ট হয় এবং ঘড় ঘড় শব্দ করে।
৫. কাশি হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

সময় অনুযায়ী টিকা দিলে এ রোগ ৯০% প্রতিরোধ করা যায়। আক্রান্ত মুরগি দ্রুত পৃথক করে ফেলতে হবে। খামারে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। দক্ষ প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

 

 

২। ফাউল পক্স বা মুরগির বসন্ত

এটি একটি ছোঁয়াছে রোগ। কোন মুরগি আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা না করলে সব মুরগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত তিন সপ্তাহ বয়সের বাচ্চার এ রোগ হয়। তবে যে কোনো বয়সের মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

 

লক্ষণ:

১. পালকবিহীন জায়গা, যেমন— চোখ, মাথার ঝুঁটি, কানের লতি, পা—এর খালি জায়গায় ছোট ছোট গুটি দেখা যায়।
২. শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং খাবার খেতে চাইবে না।
৩. ডিম পাড়া কমে যায়।

 

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

প্রতিরোধের জন্য ৪০ দিন বয়সের বাচ্চাকে ফাউল পক্সের টিকা দিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খামার পরিচালনা করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দক্ষ প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট/ডেটল/সেভলনমিশ্রিত পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান দিনে ৩—৪ বার পরিষ্কার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

 

 

৩। মুরগির কলেরা:

মানুষের মতো মুরগিরও কলেরা রোগ হয়। যে কোনো বয়সের মুরগি এতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বাড়ন্ত বয়সের মুরগি অথার্ৎ ১২ সপ্তাহ বা তার বেশি বয়সের মুরগিতে এ রোগ হয়ে থাকে।

লক্ষণ:

১. অধিক পানিযুক্ত অথার্ৎ ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়। পায়খানার রং সবুজ ও দূর্গন্ধযুক্ত হয়।
২. আক্রান্তের মাত্রা বেশি হলে হঠাৎ মারা যায়।
৩. খাদ্য গ্রহণে অনিহা ও ওজন দ্রুত কমে যায়।
৪. শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

নয় সপ্তাহ বয়সের মুরগিকে কলেরা প্রতিরোধক টিকা বুকে বা রানের মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। পরিষ্কার খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী।

 

 

৪। অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা

এ রোগ ভাইরাস দ্বারা ঘটে যা বার্ড ফ্লু নামে পরিচিত। এটি মুরগি থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। বন্য পাখি ও পরিযায়ী পাখি এ রোগের প্রধান বাহক। এ রোগে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যু হার বেশি।

লক্ষণ

১. আক্রান্ত মুরগির আকস্মিক মৃত্যু হয়।
২. মাথার ঝঁুটি ও কানের লতি নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।
৩. নাক ও মুখ দিয়ে পানি ঝরে।
৪. পায়ের ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হয় এবং প্যারালাইসিসও হতে পারে।
৫. ক্ষুধামান্দ হয় ও ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:

বন্যপ্রাণী ও পাখির সংস্পর্শ থেকে মুরগিকে মুক্ত রাখতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত হলে সমস্ত মুরগি মেরে ফেলতে হবে এবং উপযুক্ত সৎকার করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পালনের মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায়। এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোর চিকিৎসা নেই।

 

 

ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দানাদার খাদ্য তৈরি:

ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির সুষম খাদ্যতালিকা (প্রতি ১০০ কেজি সুষম রেশন তৈরির সূত্র):

 

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version