মৃত্তিকা পানি ও পানি সেচ

মৃত্তিকা পানি ও পানি সেচ – আজকের পাঠের বিষয়। এই পাঠটি “পানি সেচ ও নিষ্কাশন” বিষয়ের ইউনিট ৩ এর ৩.১ নং পাঠ।

মৃত্তিকা পানি ও পানি সেচ

 

মৃত্তিকা কনা ও জৈব পদার্থ হচ্ছে কঠিন পদার্থ। মাটিতে কঠিন পদার্থের কনাগুলোর ফাঁকা স্থানে পানি ও বায়ু থাকে। মৃত্তিকা পানি মাটিতে যেসব প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদন রয়েছে তা দ্রবীভূত করে গাছের গ্রহণ উপযোগী করে তুলে।

মাটিতে দুই প্রকার রক্ত থাকে যেমন সূক্ষ রন্ধ্র (Micro pores) ও স্থূল রন্ধ্র ( Macro pores ) । সাধারণত সূক্ষ রন্ধ্রে যে পানি থাকে তা গাছ পরিশোষণ করতে পারে। স্কুল রক্তের পানি মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে নিচে চলে যায় যা গাছ গ্রহণ করতে পারে না। মাটির ভৌত বৈশিষ্ট্য এবং মাটিতে পানির পরিমান পরীক্ষা করে সেচের সময় ও পরিমান নির্ধারণ করতে হয়। বৃষ্টিপাত, তুষার, কুয়াশা, সেচের পানি ইত্যাদি মৃত্তিকা পানির উৎস।

 

শস্য উৎপাদনে মৃত্তিকা পানির গুরুত্ব :

১. পানি বিভিন্ন শিলা ও খনিজ পদার্থের ক্ষয় ঘটিয়ে মাটি গঠন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

২. পানি একটি সার্বজনীন দ্রাবক যাতে সমস্ত পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। এটি মাটি থেকে উদ্ভিদে পুষ্টি উপাদান এর বাহক হিসেবে কাজ করে এবং উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য করে।

৩. উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণে পানি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে। আলো CO2 + H2O ক্লোরোফিল C6H12O6 + O20

৪. উদ্ভিদকে সজীব ও সতেজ করে।

৫. মাটিকে নরম করে ও কর্ষণ কাজ সহজ করে। এর ফলে বীজের অংকুরোদগম ত্বরান্বিত হয়। পানি ছাড়া বীজের অংকুরোদগম সম্ভবপর নয়।

৬. মাটির ভৌত, রাসায়নিক এবং অণুজৈবিক কার্যাবলীর জন্য পানি অত্যাবশ্যক।

৭. মাটির তাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং গাছকে অতিরিক্ত ঠান্ডা ও গরম থেকে রক্ষা করে।

৮. সর্বোপরি ফসলের ফলন, উৎপাদন ও গুনগতমান বাড়ায়।

 

মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী উপাদান :

১. মৃত্তিকা বুনট ও সংযুক্তি

২. জৈব পদার্থের পরিমান

৩. রন্ধে্রর প্রকৃতি

৪. মাটির প্রোফাইলের গভীরতা

 

মৃত্তিকা পানি অপচয় উপাদান :

১. বাস্পীভবন

২. প্রস্বেদন

৩. চুয়ানো

 

মৃত্তিকা পানির শ্রেনি বিভাগঃ 

মৃত্তিকা পানি প্রধানত তিন প্রকার—

১. মহাকষীর্য় পানি

২. কৈশিক পানি

৩. জলাকষীর্ বা আদ্রিক পানি

১। মহাকষীর্য় পানি :

অধিক বৃষ্টিপাত বা সেচের ফলে মাটির রন্ধ্র পরিসর যখন পানি দ্বারা পূর্ণ হয় এবং বায়ুশূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে যে পানি নিচের দিকে অপসারিত হয় যাকে মহাকষীর্য় পানি বলে। মাটির সমস্ত সূক্ষ্ম ও স্থুল রন্ধ্র পরিসর পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই অবস্থাকে মাটির সম্পৃক্তাবস্থা বলে। এই পানি গাছের গ্রহণ উপযোগী নয়। উপরন্ত পুষ্টি উপাদান অনুস্রবনের (চবৎপড়ষধঃরড়হ) মাধ্যমে নষ্ট হয়।

 

২। কৈশিক পানি :

ভারী বর্ষনের পরে অথবা সেচ প্রদানের পরে অতিরিক্ত পানি মধ্যাকর্ষন শক্তির প্রভাবে নিচের দিকে অপসারণ হওয়ার পর মৃত্তিকা কনার গায়ে পানি মোটা আস্তরণের মত লেগে থাকে তাকে কৈশিক পানি বলে। উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পানি কৈশিক পানি থেকে গ্রহন করে। এ পানির মধ্যে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। মৃত্তিকার গঠন, বিন্যাস, বুনট, জৈব পদার্থ এবং কলয়ডাল পদার্থের উপর মৃত্তিকায় অবস্থানরত কৈশিক পানির পরিমান নির্ভর করে। কৈশিক পানি দুই প্রকার—

 

১) উদ্ভিদের গ্রহন উপযোগী কৈশিক পানি :

এই পানি গাছ সহজে গ্রহণ করতে পারে। টেনশন ০.৩৩ থেকে ১৫ বার। অথার্ৎ যে কৈশিক পানি মাঠ ক্ষমতা ও ঢলে পড়া অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান করে এবং মাটির রন্ধ্র পরিসরে ২৫ থেকে ৫০ ভাগ পানি থাকে সেই পানিকেই উদ্ভিদের গ্রহনোপযোগী কৈশিক পানি বলে।

 

২) উদ্ভিদের গ্রহণ অনুপযোগী কৈশিক পানি :

যে পানির টেনশন ১৫—৩১ বার এবং উদ্ভিদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় তাকে উদ্ভিদের গ্রহণ অনুপযোগী কৈশিক পানি বলে। মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসরে ১৫—২৫ ভাগ পানি থাকে।

৩. জলাকষীর্ বা আদ্রিক পানি

যে পানি শুকনো মাটি কনার সাথে শক্তভাবে প্রলেপের ন্যায় থাকে তাকে জলাকষীর্ বা আদ্রিক পানি বলে। এই পানি খুব কম পরিমানে থাকে যা উদ্ভিদ কোন অবস্থাতেই গ্রহণ করতে পারে না। এই পানি গতিশীল হয় না। এই পানির পরিমান মৃত্তিকা কনা, মৃত্তিকার বুনট, জৈব পদার্থ এবং অন্যান্য কলয়ডাল পদার্থের উপর নির্ভর করে।

 

পানি সেচ:

উদ্ভিদের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য কৃত্রিম উপায়ে ফসলের জমিতে পানি প্রয়োগ করাকে সেচ বলে। অপর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে বা সময়মত বৃষ্টিপাত না হলে উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পরিমান পানি পায় না। এর ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য জমিতে সময়মত সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে শীতকালে সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা খুবই অনিশ্চিত। কারণ এ সময়ে বৃষ্টিপাত খুবই কম হয় বলে জমিতে রসের অভাব দেখা দেয় যা শীতকালীন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।

 

সেচের প্রয়োজনীয়তা:

ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পানি অপরিহার্য। এজন্য কৃষি কাজে পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ঃ

১. সেচের পানি মাটিতে সঞ্চিত খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য করে।

২. গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানির সাহায্যে মাটি থেকে পরিশোষণ করে।

৩. সেচের পানি জৈব পদার্থের দ্রুত পচন ঘটিয়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।

৪. মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

৫. জমির লবনাক্ততা বা ক্ষারত্ব দূর করার জন্য সেচ প্রয়োজন।

৬. সেচের পানি মাটিতে উপকারী অণুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।

৭. জমির জো অবস্থা আনতে সেচের প্রয়োজন।

৮. বপনকৃত বীজের জন্য পযার্প্ত আদ্রর্তা সরবরাহ করে বীজের অঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত করে।

৯. সেচ দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বতীর্কালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।

১০. সেচ দেয়ার জন্যই শুকনো মৌসুমে বোরো ধান আবাদ সম্ভব হয়।

১১. সেচ দেয়ার ফলে কৃষক উচ্চ মূল্যমানের ফসল যেমন সবজি, আলু, আখ ইত্যাদি উৎপাদন করতে পারে।

১২. মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু দমনের জন্য সেচ প্রয়োজন।

১৩. সেচের মাধ্যমে একই জমিতে বছরে একের অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়।

১৪. আগাছা দমন, বীজতলায় চারা উৎপাদন ও চারা উত্তোলনের জন্য সেচ প্রয়োজন।

১৫. সবোর্পরি ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম।

সেচের পানির উৎস :

সেচের পানি প্রধানত দুটি উৎস থেকে পাওয়াা যায়, যথা : (১) ভূ—পৃষ্ঠস্থ পানি বা মাটির উপরের পানি এবং (২) ভূ—গর্ভস্থ পানি বা মাটির অভ্যন্তরের পানি।

 

১। ভূ—পৃষ্ঠস্থ পানি :

বৃষ্টিপাত, নদী—নালা, খাল—বিল, হাওড়, পুকুর, হ্রদ, বরফ গলা পানি ইত্যাদি ভূ—পৃষ্ঠস্থ পানির উৎস। নদী—নালা, খাল—বিল, হাওড়, পুকুর এসব জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পানি জমা করে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়া যায়। পাওয়ার পাম্প, সেউতি, দোন ইত্যাদি সেচ যন্ত্রের সাহায্যে ভূ—পৃষ্ঠের পানি সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়।

 

২। ভূ—গর্ভস্থ পানি :

মাটির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত পানি হচ্ছে ভূ—গর্ভস্থ পানি। ভূ—গর্ভস্থ পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেচের উৎস। বৃষ্টিপাত, বরফ গলা পানি, বন্যা ও বিভিন্ন জলাশয়ের পানি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে মাটির গভীরে গিয়ে জমা হয়। এ পানি গভীর ও অগভীর নলকূপ খনন করে পাম্প দ্বারা তুলে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ভূ—গর্ভস্থ পানি দ্বারা চাষাবাদ করা হয়।

সেচের পানির গুণাগুণ ফসল উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা অনেকটা নির্ভর করে সেচের পানির গুণাগুণের উপর। ভূ—পৃষ্ঠস্থ ও ভূ—নিম্নস্থ পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লবণ ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত থাকে। এসব লবণ ও রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমান বেশি হলে তা গাছের জন্য ক্ষতিকর। রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, বাইকার্বনেট, সালফেট ইত্যাদি। সোডিয়াম কার্বনেট যৌগ পানিতে বেশি পরিমান থাকলে ফসল তা সহ্য করতে পারে না। সেচের পানি ঘোলা হলে তা মাটির রন্ধ্র বন্ধ করে দেয় ফলে মাটি শক্ত করে ফেলে। সেচের পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিক, ক্যালসিয়াম, সীসা থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর।

 

সেচকৃত পানির গুনগতমান যাচাই:

সেচকৃত পানির গুনগতমান যাচাই এর জন্য নিম্ন বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করা হয়।

১. পানিতে দ্রবীভূত লবণের মোট ঘন মাত্রা

২. সোডিয়ামের ঘনত্ব (ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সাপেক্ষে)

৩. কার্বনেট ও বাই—কার্বনেটের ঘনমাত্রা

৪. বোরনের পরিমান।

 

বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম পানির চাহিদা :

কোন একটি ফসল তার জীবন চক্র সম্পন্ন করতে মাটি হতে মোট যে পরিমান পানি গ্রহণ করে তাকে ফসলের পানি চাহিদা বলে। অপরদিকে যে পরিমান পানি গ্রহণ করতে না পারলে কোন ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় সেই পারিমান পানিকে ফসলের নূন্যতম পানির চাহিদা বলে। ফসলের পানির পরিমান ফসলের জীবনকাল, মাটির ধরন, বৃদ্ধি পাওয়া ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। আবার গাছের জীবনচক্রে সব সময় সমান পরিমান পানি লাগে না। ফসলের যে বৃদ্ধি পর্যায়ে পানির অভাব হলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় তাকে ফসলের পানির ক্রান্তিকাল বলে। নিম্নবর্ণিত সূত্রের সাহায্যে ফসলের পানি চাহিদা নির্ণয় করা যায়।

 

সারাংশ:

মাটিতে দুই প্রকার রন্ধ্র থাকে— সূক্ষ্ম রন্ধ্র ও স্থুল রন্ধ্র। মাটির রন্ধ্র পরিসরে যে পানি থাকে তাকে মৃত্তিকা পানি বলে। পানি একটি সার্বজনীন দ্রাবক যাতে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান দ্রবীভূত থাকে। পানি মাটি থেকে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের বাহক হিসেবে কাজ করে। মৃত্তিকা পানি প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়: মহাকষীর্য় পানি, কৈশিক পানি ও জলাকষীর্ বা আদ্রিক পানি। কৈশিক পানি গাছের গ্রহণ উপযোগী পানি। ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য জমি বা মাটির কোন ক্ষতি সাধন না করে কৃত্রিম উপায়ে প্রয়োজনীয় পরিমান পানি ফসলের জমিতে সরবরাহ করাকে পানি সেচ বলে। সেচের পানি মাটির খাদ্য উপাদান দ্রবীভূত করে এবং গাছের জন্য সহজলভ্য করে।

জমির জো অবস্থা আনতে, জমির লবনাক্ততা, ক্ষারত্ব দূর করতে, অনুজীবের কার্যাবলি বাড়াতে, সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সেচ প্রয়োজন। সেচের পানির দুইটি উৎস রয়েছে : ভূ—পৃষ্ঠস্থ ও ভূ—গর্ভস্থ পানি। মাটির উর্বরতা ও ফসল উৎপাদন সেচের পানির গুণাগুণের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। ফসলের পানির ন্যূনতম চাহিদা হল যে পরিমাণ পানি গ্রহণ করতে না পারলে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। ্আবার ফসলের যে বৃদ্ধি পর্যায় পানির অভাব হলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় তাকে ফসলের পানির ক্রান্তিকাল বলে।

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version