জৈব পদার্থের গুরুত্ব

জৈব পদার্থের গুরুত্ব

জৈব পদার্থের গুরুত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি বাউবি’র মৃত্তিকা বিজ্ঞান – ১২০৪ কোর্সের ইউনিট ৪ এর,  ৪.২ নম্বর পাঠ।

জৈব পদার্থের গুরুত্ব

জৈব পদার্থের সংজ্ঞা :

উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবশিষ্টাংশ, অণুজীব ও মৃত্তিকাস্থিত জীবের কোষকলা বিযোজিত (Decomposed) হয়ে যে গাঢ় দ্রব্য অবশিষ্ট থাকে তাকে মৃত্তিকা জৈব পদার্থ বলে। জৈব পদার্থকে মৃত্তিকার প্রাণ বলা হয়।

জৈব পদার্থের উৎস:

অসংখ্য উৎস থেকে জৈব পদার্থ মৃত্তিকায় মজুদ হয়। এগুলো হচ্ছে ফসলের অবশিষ্টাংশ, কান্ড, পাতা, সবুজ সার, গোবর, খৈল, খামারজাত সার, কম্পোস্ট, ডাস্টবিনের আবর্জনা, ঘরবাড়ীর আবর্জনা, পরিত্যক্ত কাগজ, শহর বন্দরের আবর্জনা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর মল ও ব্যবহৃত খাদ্যদ্রব্য বন জঙ্গলে পরিত্যক্ত পাতা, হার্ব, ঘাসের শিকড়, ঘাস, ধনচে, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রটোজোয়া, কেঁচো, শৈবাল, প্রভৃতির মৃতদেহ, মেরুদন্ডী ও অমেরুদন্ডী প্রাণীর মৃতদেহ, কলকারখানার বিশেষ বিশেষ কাঁচামাল প্রভৃতি ।

মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব অপরিসীম। জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়।

 

ভৌত গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

মৃত্তিকার ভৌত গুণাবলী কৃষি উৎপাদনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। এসব গুণাবলীকে উন্নত করতে জৈব পদার্থ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। মাটির রং, গঠন, পানি ধারণ ক্ষমতা, বাতাস চলাচলসহ প্রায় সব ভৌত ধর্মই জৈব পদার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। নিচে জৈব পদার্থের প্রধান অবদানগুলো তুলে ধরা হলো:

১। মৃত্তিকার রং পরিবর্তন করে

  • মাটিকে ধূসর, গাঢ় ধূসর, বাদামী, গাঢ় বাদামী কিংবা কালো করতে সাহায্য করে।

  • মাটির রং গাঢ় হলে তাপ শোষণ বেশি হয়, যা উদ্ভিদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

২। মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে

  • ঘনত্ব, পানি ধারণ, বুনট ও রন্ধ্রতা জৈব পদার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

৩। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে

  • মাটির উষ্ণতা ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করে, ফলে গাছপালা আবহাওয়ার পরিবর্তনে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।

৪। বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে

  • মাটির ভেতর বায়ুর আদান–প্রদান সহজ হয়।

  • শিকড়ের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে।

৫। সংযুক্তি ও দলা উন্নত করে

  • মাটির গঠন মজবুত হয়।

  • দলা (aggregate) তৈরি হয়, যা মাটিকে সহজে ভাঙা বা ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করে।

৬। পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

  • মাটি দীর্ঘ সময় আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে।

  • পানির অপচয় কম হয়।

৭। উপরিভাগের আস্তরণ রোধ করে

  • মাটির উপরে শক্ত স্তর তৈরি হওয়া বন্ধ হয়।

  • ফলে চারা গজানো সহজ হয়।

৮। বেলে ও কাদা মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

  • বেলে মাটিকে উর্বর করে তোলে।

  • কাদা মাটিকে ঝুরঝুরে ও সহজে চাষযোগ্য করে।

৯। ভূমিক্ষয় রোধ করে

  • মাটির দলা মজবুত থাকায় বৃষ্টির পানিতে ক্ষয় হয় না।

  • পাহাড়ি বা ঢালু জমিতে মাটি ধরে রাখতে সাহায্য করে।

১০। দুর্বহ এঁটেল মাটি হালকা করে

  • ভারী এঁটেল মাটিকে চাষযোগ্য করে তোলে।

  • মাটির সহজ বায়ু চলাচল ও পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত হয়।

জৈব পদার্থ মৃত্তিকার ভৌত গুণাবলী উন্নত করার মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি মাটিকে উর্বর, চাষযোগ্য ও টেকসই করে তোলে। তাই টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে জৈব সার ও জৈব পদার্থ মাটিতে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

 

মৃত্তিকার রাসায়নিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

মৃত্তিকার রাসায়নিক গুণাবলী সরাসরি ফসল উৎপাদন, পুষ্টি সরবরাহ এবং মাটির উর্বরতার ওপর প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে জৈব পদার্থের অবদান অপরিসীম। এটি মাটিকে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ করে, রাসায়নিক ভারসাম্য বজায় রাখে এবং উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান সহজলভ্য করে। নিচে এর প্রধান গুরুত্বগুলো তুলে ধরা হলো:

১। উদ্ভিদের খাদ্য ভান্ডার হিসেবে কাজ করে

  • জৈব পদার্থকে উদ্ভিদের খাদ্য ভান্ডার বলা হয়।

  • এটি উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান মজুদ রাখে এবং প্রয়োজনমতো ধীরে ধীরে সরবরাহ করে।

২। নাইট্রোজেনের মূল উৎস

  • মৃত্তিকায় নাইট্রোজেনের প্রায় ৯৮% জৈব যৌগে বিদ্যমান থাকে।

  • এই নাইট্রোজেন উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৩। অম্লত্ব ও ক্ষারকত্ব নিয়ন্ত্রণ

  • জৈব এসিড ও কার্বনিক এসিড তৈরি করে মাটির ক্ষারকত্ব কমায়।

  • ফলে উদ্ভিদের জন্য উপযোগী পরিবেশ বজায় থাকে।

৪। রাসায়নিক বাফার হিসেবে কাজ করে

  • চুন বা রাসায়নিক সার প্রয়োগে মাটিতে যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে তা জৈব পদার্থ শোষণ করে প্রশমিত করে।

  • এটি মাটির pH ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক।

৫। পুষ্টির সুষম সম্পর্ক বজায় রাখা

  • সার ও মৃত্তিকাস্থিত অন্যান্য উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।

  • একক পুষ্টির আধিক্য বা ঘাটতি রোধ করে।

৬। পুষ্টি উপাদান সংরক্ষণ

  • খনিজ সার থেকে মুক্ত হওয়া পুষ্টি উপাদান জৈব কোলয়েড শক্তভাবে আটকে ধরে।

  • এতে চুয়ানি ক্ষয় (Leaching) কমে যায় এবং পুষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয়।

৭। আয়ন মুক্তকরণে সহায়ক

  • জৈব পদার্থের বিয়োজনের ফলে বিভিন্ন আয়ন (আয়রন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) মুক্ত হয়।

  • এগুলো উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য হয়ে যায়।

৮। ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

  • মৃত্তিকার ক্যাটায়ন এক্সচেঞ্জ ক্যাপাসিটি (CEC) বৃদ্ধি পায়।

  • বিশেষ করে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অ্যামোনিয়াম সহজে উদ্ভিদ শোষণ করতে পারে।

৯। বিষ শোষণ ক্ষমতা

  • কীটনাশক বা পেস্টিসাইড ব্যবহারে মাটিতে জমে থাকা বিষাক্ত উপাদান জৈব পদার্থ শোষণ করে।

  • এতে মাটি নিরাপদ ও টেকসই থাকে।

১০। পানি শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

  • সেলুলোজ ও হেমিসেলুলোজের রাসায়নিক প্রকৃতি মাটির পানি শোষণকে ত্বরান্বিত করে।

  • ফলে মাটির আর্দ্রতা দীর্ঘসময় বজায় থাকে।

১১। ফসফরাসের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করে

  • অম্ল মাটিতে জৈব পদার্থ লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের সঙ্গে বিক্রিয়া করে স্থায়ী যৌগ তৈরি করে।

  • এতে ফসফরাস ফিক্সেশন রোধ হয় এবং ফসফরাস সহজলভ্য হয়।

১২। জারণ ও বিজারণ বিক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে

  • জৈব পদার্থ মাটির বিভিন্ন রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় (Oxidation–Reduction) অংশগ্রহণ করে।

  • এর ফলে মাটির রাসায়নিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকে।

১৩। প্রয়োজনীয় মৌল সরবরাহ করে

  • জৈব পদার্থে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাসসহ বিভিন্ন মৌল থাকে।

  • এগুলো উদ্ভিদের জন্য অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান।

জৈব পদার্থ মৃত্তিকার রাসায়নিক গুণাবলীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটি মাটিকে পুষ্টিসমৃদ্ধ, ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই করে তোলে। তাই টেকসই কৃষি ও দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদনশীলতার জন্য নিয়মিতভাবে জৈব পদার্থ (কম্পোস্ট, গোবর সার, সবুজ সার) মাটিতে প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি।

 

মৃত্তিকার জৈবিক গুণাবলীতে জৈব পদার্থের গুরুত্ব:

১। জৈব পদার্থের প্রধান উপকরণ হচ্ছে কার্বন। কার্বন জারিত হওয়ার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় সে শক্তি গ্রহণ করেই মাটিতে জীবাণুরা তাদের কার্যক্ষমতা রক্ষা করে। যে মাটিতে যত বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়, সে মাটিতে তত অধিক জীবাণু থাকে। ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাইকোরাইজা, শেওলা, একটিনোমাইসিটিস প্রভৃতি অণুজীব মৃত্তিকার উর্বরতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। মৃত্তিকায় জৈব পদার্থ না থাকলে এসব জীবাণুর সংখ্যা কমে যায় ফলে মৃত্তিকার উর্বরতা ব্যহত হয়।

২। কেঁচো, পিঁপড়া, উইপোকা, ইঁদুর, সেন্টিপেড ইত্যাদি জীব জৈব পদার্থ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। এরা মাটিতে গর্ত করে, ফলে শিকড় অধিক পরিমাণ অক্সিজেন পায়, গাছের বৃদ্ধি ও সতেজতা বাড়ে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড সহজে বের হয়ে যেতে পারে।

৩। মৃত্তিকা জৈব পদার্থ মৃত্তিকা অণুজীবের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে।

8। জৈব পদার্থস্থিত প্রোটিন মৃত্তিকাস্থ অণুজীব দ্বারা ভেঙ্গে বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিড উৎপন্ন করে। এনজাইমের সাহায্যে এমোনিয়াম যৌগ তৈরি করে ও সর্বশেষে নাইট্রেটে রূপান্তরিত হয়। ফলে গাছের পক্ষে এমোনিয়াম ও নাইট্রেট গ্রহণ সহজতর হয়। মৃত্তিকা জৈব পদার্থ উল্লিখিত অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া) সংখ্যা বাড়ায়।

 

গাছপালার উপর জৈব পদার্থের প্রভাব বা গুরুত্ব:

জৈব পদার্থ গাছপালার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি হলে কোন গাছপালা ভালভাবে বাড়তে পারে না এবং ফসলের ফলনও কমে যায়। কোন কোন গাছ জৈব নাইট্রোজেনও গ্রহণ করতে পারে। তবে পরিমাণে অতি সামান্য, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতি সামান্য অংশ পূরণ করতে পারে। জৈব পদার্থ গাছের বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অজৈব নাইট্রোজেন ও সালফার সরবরাহে সহায়তা করে। তাছাড়া ইহা কার্বন, হাইড্রোজেন এবং পানিরও অন্যতম উৎস।

জৈব পদার্থ শুধু যে গাছপালার খাদ্যের উৎস তা নয়, ইহা মৃত্তিকায় ভিটামিন ও হরমোন জাতীয় পদার্থেরও যোগান দেয়। জৈব পদার্থ বিয়োজিত হয়ে এ সকল পদার্থ মুক্ত হয়। পরিমাণের দিক থেকে সামান্য হলেও গাছপালার বৃদ্ধিতে অসামান্য প্রভাব ফেলে। জৈব পদার্থ সরাসরি মালচিং হিসাবেও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

আবার গাছপালা লাগিয়ে গোড়ায় জৈব পদার্থ মালচিং আকারে দেয়া হয় যাতে গোড়ার মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে না যায়। যুগ যুগ ধরে চাষাবাদের ফলে মাটির যে গুণগত মান হ্রাস পায় এবং ফসলের ফলনের ওপর প্রভাব ফেলে জৈব পদার্থ মাটির এ সুস্থতা নিশ্চিত করে। বীজের অংকুরোদগম, শিকড়ের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন জৈব পদার্থ দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়।মৌলিক পদার্থ থাকে যা উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান হিসেবে বিবেচিত।

কখনও কখনও জৈব পদার্থ গাছপালার পক্ষে অনিষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। জৈব পদার্থ থেকে ডাই হাইড্রোস্টিয়ারিক এসিড নামক পদার্থ উৎপন্ন হতে পারে যা গাছপালার পক্ষে ক্ষতিকর। অতিরিক্ত পানি জমে এরূপ পদার্থ উৎপন্ন হয়। সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন, চুন প্রয়োগ, যথাযথ সার ও উন্নত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে এ অবস্থার উন্নতি হয় এবং ক্ষতিকর যৌগগুলো আপনা থেকে নষ্ট হয়। মৃত্তিকা জৈব পদার্থের সুষ্ঠু পচনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।

সূত্র:

  • জৈব পদার্থের গুরুত্ব , পাঠ ৪.২, ইউনিট ৪ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *