বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে খাদ্যশস্যের পাশাপাশি মসলা ও ঔষধি ফসলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মসলা ফসল রান্নায় স্বাদ, রঙ, ও ঘ্রাণ যোগ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। অপরদিকে ঔষধি ফসল হাজার বছরের ঐতিহ্যের অংশ, যা আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে মসলা ও ঔষধি ফসলের চাহিদা দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি পাওয়ায় এগুলোকে সম্ভাবনাময় কৃষি খাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মসলাফসল
মরিচ (Chili)
বাংলাদেশে সর্বাধিক চাষকৃত মসলা হলো মরিচ। এটি তাজা, শুকনা এবং গুঁড়ো আকারে ব্যবহৃত হয়।
অর্থনৈতিকগুরুত্ব: মরিচ রপ্তানিযোগ্য একটি প্রধান মসলা।
চাষেরএলাকা: রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও রংপুর অঞ্চলে ব্যাপক উৎপাদন হয়।
উপকারিতা: মরিচে ভিটামিন সি, ক্যাপসাইসিন থাকে যা শরীরকে উষ্ণ রাখে ও প্রদাহ কমায়।
হলুদ (Turmeric)
হলুদ বাংলাদেশের রান্নাঘরে অপরিহার্য একটি মসলা, আবার এটি ঔষধি ফসল হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
চাষেরএলাকা: দিনাজপুর, নাটোর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা।
গুণাগুণ: প্রদাহনাশক, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিসেপটিক।
অর্থনৈতিকদিক: দেশীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানিতেও ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
পেঁয়াজ (Onion)
পেঁয়াজ রান্নার অপরিহার্য উপাদান।
চাষেরএলাকা: পাবনা, ফরিদপুর, বগুড়া।
গুরুত্ব: পেঁয়াজে সালফার যৌগ আছে যা হৃদ্রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
চ্যালেঞ্জ: উৎপাদনের ঘাটতি থাকায় প্রায়ই আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
রসুন (Garlic)
চাষেরএলাকা: নাটোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর।
গুণাগুণ: রসুনে অ্যালিসিন নামক উপাদান রয়েছে যা কোলেস্টেরল কমায় এবং অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে।
অর্থনৈতিকদিক: স্থানীয় বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকলেও রপ্তানির সম্ভাবনাও আছে।
আদা (Ginger)
চাষেরএলাকা: চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল, সিলেট, রংপুর।
গুণ: হজমে সহায়ক, প্রদাহনাশক।
অর্থনৈতিকদিক: দেশীয় উৎপাদন পর্যাপ্ত নয়, আমদানি করতে হয়। তবে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব।
ধনে, জিরাওসরিষা
ধনে (Coriander): পাতা ও বীজ উভয়ই মসলা হিসেবে ব্যবহৃত।
জিরা (Cumin): খাবারে স্বাদ ও হজমশক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর।
সরিষা (Mustard): সরিষার দানা ও তেল রান্না ও আচার তৈরিতে অপরিহার্য।
ঔষধিফসল
বাংলাদেশে প্রায় ৫০০-রও বেশি প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ হলো—
তুলসী (Holy Basil)
ব্যবহার: সর্দি, কাশি ও হাঁপানির চিকিৎসায় কার্যকর।
চাষ: ঘরোয়া ও আঙ্গিনাভিত্তিক চাষ বেশি।
অর্থনৈতিকদিক: হার্বাল ঔষধ ও চা শিল্পে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্ভাবনা: প্রসাধনী ও ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে ব্যাপক চাহিদা।
কালোজিরা (Black Seed)
ব্যবহার: ‘সব রোগের ওষুধ’ নামে পরিচিত। ডায়াবেটিস, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর।
চাষেরএলাকা: রাজশাহী, দিনাজপুর।
অশ্বগন্ধা (Ashwagandha)
ব্যবহার: মানসিক চাপ কমায়, শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
চাহিদা: ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত।
নিম (Neem)
ব্যবহার: চর্মরোগ নিরাময়, প্রাকৃতিক কীটনাশক।
চাষ: সারা দেশেই গাছ জন্মে।
অর্থনৈতিকগুরুত্ব: নিমের পাতা, বীজ ও তেল হার্বাল মেডিসিন ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য।
অন্যউল্লেখযোগ্যঔষধিফসল
হরিতকি, বহেরাওআমলকি: ত্রিফলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। হজম ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর।
বেল: ডায়রিয়া ও হজমের সমস্যায় কার্যকর।
চন্দ্রমল্লিকা: চোখের সমস্যা ও স্নায়ুরোগে উপকারী।
অর্থনৈতিকওসামাজিকগুরুত্ব
রপ্তানিসম্ভাবনা: মসলা ও ঔষধি ফসলের আন্তর্জাতিক বাজার রয়েছে। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে চাহিদা বেশি।
কৃষকেরআয়বৃদ্ধি: ধান বা গমের তুলনায় এসব ফসল অধিক লাভজনক।
প্রক্রিয়াজাতশিল্প: হলুদ, মরিচ, আদা, অ্যালোভেরা প্রক্রিয়াজাত করে গুঁড়া, ক্যাপসুল, তেল, জেল ইত্যাদি বানানো যায়।
চাকরিরসুযোগ: চাষাবাদ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়।
চ্যালেঞ্জওকরণীয়
চ্যালেঞ্জ
মানসম্মত বীজের অভাব।
আধুনিক প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকতার ঘাটতি।
বাজারজাতকরণে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব।
গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা।
করণীয়
সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে গবেষণা ও উন্নয়ন।
কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও আর্থিক সহায়তা।
চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।
রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে নীতি সহায়তা।
উপসংহার
বাংলাদেশের মসলা ও ঔষধি ফসল শুধু খাদ্যাভ্যাসের অংশ নয়, বরং এটি দেশের অর্থনীতি, কৃষি বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই খাতে স্বনির্ভর হতে পারবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে শাকসবজি কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধান, গম কিংবা ভুট্টার পাশাপাশি শাকসবজি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে শুরু করে শহুরে বাজার—সব জায়গাতেই শাকসবজির উপস্থিতি স্পষ্ট। বেগুন, টমেটো, মরিচ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, পুঁইশাক, লাউ, কুমড়া ইত্যাদি শাকসবজি শুধু খাদ্যতালিকাকে সমৃদ্ধই করছে না, বরং কৃষক ও জাতীয় অর্থনীতির জন্যও লাভজনক একটি খাত হয়ে উঠেছে।
এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের প্রধান শাকসবজি সম্পর্কে তাদের অর্থনৈতিকগুরুত্ব, পুষ্টিগুণ, চাষাবাদপদ্ধতি, সমস্যাবলীওসম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শাকসবজিরঅর্থনৈতিকগুরুত্ব
বাংলাদেশে কৃষিজ উৎপাদনের প্রায় ১৫-২০% অংশ শাকসবজি থেকে আসে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ১কোটি৮০লক্ষটনশাকসবজিউৎপাদন হয়। এগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় চাহিদা মেটাতে ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
শাকসবজি চাষ শ্রমঘন হওয়ায় এটি গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বিশেষ করে নারী কৃষকরা সবজি চাষ, পরিচর্যা ও বাজারজাতকরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
পুষ্টিগতদিক
বাংলাদেশের মানুষের খাবারের তালিকায় শর্করার আধিক্য রয়েছে, ফলে প্রোটিন ও ভিটামিনের ঘাটতি থেকে যায়। শাকসবজি এই ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বেগুন: ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও আঁশে সমৃদ্ধ। হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
টমেটো: ভিটামিন এ ও সি, লাইকোপিন সমৃদ্ধ। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
মরিচ: ভিটামিন সি এর ভাণ্ডার। ঝাঁঝালো স্বাদের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
বাঁধাকপি: ভিটামিন কে ও ফলিক অ্যাসিডের উৎস। হজমে সহায়ক এবং ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে।
ফুলকপি: ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম ও আঁশ সমৃদ্ধ। শিশু ও বৃদ্ধ উভয়ের জন্য উপকারী।
শিমওপুঁইশাক: প্রোটিন, লোহা ও আঁশে ভরপুর। অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক।
লাউওকুমড়া: হালকা ও সহজপাচ্য। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে উপকারী।
প্রধানশাকসবজিওতাদেরচাষাবাদ
১. বেগুন
বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাকসবজি। প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায়।
চাষকাল: রবি ও খরিপ উভয় মৌসুমেই হয়।
জাত: বারি বেগুন-৮, উত্তরা, ইশ্বরদী বেগুন।
সমস্যা: লিটল লিফ ডিজিজ, ফলছিদ্রকারক পোকা।
২. টমেটো
শীতকালীন সবজির মধ্যে অন্যতম।
চাষকাল: অক্টোবর–ডিসেম্বর।
জাত: বারি টমেটো-২, বারি টমেটো-১৫, হাইব্রিড জাত।
সমস্যা: লেট ব্লাইট, ভাইরাসজনিত রোগ।
৩. মরিচ
সব ধরনের রান্নায় অপরিহার্য।
চাষকাল: সারা বছর।
জাত: বারি মরিচ-১, জ্যোতি, হাইব্রিড মরিচ।
সমস্যা: পাতাকুঁচকানো রোগ, থ্রিপস পোকা।
৪. বাঁধাকপি
শীতকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি।
চাষকাল: সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর।
জাত: বারি বাঁধাকপি-১, কিউ হাইব্রিড।
সমস্যা: কেচো পোকা, ডাউনি মিলডিউ।
৫. ফুলকপি
বাজারে সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন।
চাষকাল: অক্টোবর–জানুয়ারি।
জাত: বারি ফুলকপি-১, স্নো বল।
সমস্যা: ফলবিকৃতি, ডাউনি মিলডিউ।
৬. শিম
গ্রামীণ পরিবারে খুবই জনপ্রিয়।
চাষকাল: সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর।
জাত: বারি শিম-১, দেশি জাত।
সমস্যা: পাউডারি মিলডিউ, এফিড পোকা।
৭. লাউওকুমড়া
গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সহজলভ্য।
চাষকাল: ফেব্রুয়ারি–এপ্রিল ও জুন–জুলাই।
জাত: বারি লাউ-১, দেশি কুমড়া।
সমস্যা: ডাউনি মিলডিউ, ফল ছিদ্রকারী পোকা।
শাকসবজিউৎপাদনেচ্যালেঞ্জ
আবহাওয়ারপরিবর্তন: অতিবৃষ্টি, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতি হয়।
রোগবালাইওকীটপতঙ্গ: কৃষকরা অনেক সময় অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে, যা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
সংরক্ষণেরঅভাব: শাকসবজি দ্রুত নষ্ট হয়, কিন্তু ঠান্ডা সংরক্ষণাগারের অভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাজারব্যবস্থাপনা: মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে কৃষক ন্যায্য দাম পায় না।
প্রযুক্তিরঘাটতি: আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সব কৃষকের কাছে পৌঁছেনি।
সম্ভাবনাওউন্নয়নেরদিক
রপ্তানি: প্রবাসী বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কারণে বিশ্ববাজারে সবজির বড় চাহিদা রয়েছে।
অর্গানিকসবজি: স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে জৈব সবজির বাজার বাড়ছে।
নারীওযুবউদ্যোক্তা: সবজি চাষ নারী ক্ষমতায়ন ও যুব উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়ক।
গবেষণাওপ্রযুক্তি: নতুন জাত উদ্ভাবন ও রোগ প্রতিরোধী বীজ ব্যবহারে উৎপাদন বাড়বে।
উপসংহার
বাংলাদেশের প্রধান শাকসবজি শুধু খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে না, বরং পুষ্টি, কর্মসংস্থান, অর্থনীতিওরপ্তানিতে বিশাল অবদান রাখছে। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন আধুনিকপ্রযুক্তি, সঠিকবাজারব্যবস্থা, রোগবালাইনিয়ন্ত্রণওসংরক্ষণাগারেরব্যবস্থা।
ভবিষ্যতে সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে শাকসবজি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনধারা কৃষির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। কৃষি খাত জাতীয় আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জোগান দেয় এবং প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী সরাসরি কৃষিকাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা মূলত নির্ভর করে ধান, গমওভুট্টারমতোপ্রধানখাদ্যশস্যের ওপর। এ শস্যগুলো কেবল মানুষের দৈনন্দিন খাবারের প্রধান উৎসই নয়, বরং পশুখাদ্য, শিল্প এবং বৈদেশিক বাণিজ্যেও অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য
ধান: বাংলাদেশেরজীবনরেখা
ধানেরগুরুত্ব
বাংলাদেশকে বলা হয় “ধানের দেশ”। দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হলো চাল, যা ধান থেকে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের মানুষের দৈনিক ক্যালোরি চাহিদার প্রায় ৬০–৭০শতাংশআসেধানথেকে।
ধানেরমৌসুমিশ্রেণি
বাংলাদেশে ধান তিনটি মৌসুমে চাষ হয়:
আউশধান: এপ্রিল থেকে আগস্টে চাষ হয়।
আমনধান: জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।
বোরোধান: নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত (সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল মৌসুম)।
উৎপাদনওপরিসংখ্যান
বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩কোটি৬০লাখমেট্রিকটনধানউৎপন্নহয় (বিভিন্ন সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী)।
সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে।
উত্তরাঞ্চল, হাওর অঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চল ধান উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
আধুনিকপ্রযুক্তিরব্যবহার
HYV (High Yielding Varieties) জাতের ধান যেমন ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ বাংলাদেশে বিপ্লব এনেছে।
BRRI ও BINA ধান গবেষণা করে নতুন জাত উদ্ভাবন করছে।
যান্ত্রিকীকরণ, ট্রান্সপ্লান্টার, কম্বাইন হারভেস্টার ধান উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা।
উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি।
আন্তর্জাতিক বাজারে ধানের দামের ওঠানামা।
গম: চালেরপরপ্রধানখাদ্যশস্য
গমেরগুরুত্ব
বাংলাদেশে গম চালের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। গম থেকে তৈরি হয় রুটি, পাউরুটি, বিস্কুট ও বিভিন্ন বেকারি পণ্য। শহরাঞ্চলে গমের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
উৎপাদনইতিহাস
স্বাধীনতার পর ১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশে গমের চাষ শুরু হয় ব্যাপক আকারে।
তবে বর্তমানে গম উৎপাদন কিছুটা কমেছে এবং আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
উৎপাদনএলাকা
রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর অঞ্চলে গমের চাষ বেশি হয়।
উৎপাদনওব্যবহার
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০–১২লাখমেট্রিকটনগমউৎপাদনহয়। তবে মোট চাহিদা প্রায় ৬০–৭০ লাখ মেট্রিক টন, ফলে বিপুল পরিমাণ গম বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
গবেষণাওউন্নয়ন
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে যেমন BARI Gom-২৫, ২৬ ইত্যাদি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও উচ্চ তাপমাত্রা গমের জন্য বড় সমস্যা।
ভুট্টা: কৃষিরনতুনসম্ভাবনা
ভুট্টারগুরুত্ব
ভুট্টা বর্তমানে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। এটি শুধু মানুষের খাদ্য নয়, বরং পশুখাদ্য, মুরগির খাদ্য (পোল্ট্রি ফিড), মাছের খাদ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উৎপাদনপ্রবৃদ্ধি
১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে ভুট্টার উৎপাদন শুরু হয় ব্যাপক আকারে।
বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৫০–৫৫লাখমেট্রিকটনভুট্টাউৎপাদিতহয়।
ভুট্টা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ দেশ।
উৎপাদনএলাকা
কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ভুট্টা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
পশুখাদ্য: পোল্ট্রি ও মাছ চাষে ভুট্টা প্রধান উপাদান।
শিল্প: কর্ন অয়েল, কর্নস্টার্চ, বায়োফুয়েল উৎপাদন।
গবেষণাওউদ্ভাবন
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) উচ্চফলনশীল ও খরা সহনশীল ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করছে।
মেকানাইজেশন ও আধুনিক প্রযুক্তি উৎপাদন বাড়াচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ
বাজারদর অনিশ্চয়তা।
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা খরা।
সংরক্ষণ অবকাঠামোর অভাব।
বাংলাদেশেরখাদ্যশস্যঅর্থনীতিতেঅবদান
খাদ্যনিরাপত্তা
ধান, গম ও ভুট্টা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। ধান মানুষের প্রধান খাদ্য, গম শহুরে জীবনে অপরিহার্য, আর ভুট্টা পশুপালন ও শিল্পের জন্য অপরিহার্য।
অর্থনৈতিকগুরুত্ব
কৃষি খাত দেশের GDP-এরপ্রায়১৩–১৪শতাংশ অবদান রাখে।
প্রধান খাদ্যশস্যগুলো লাখ লাখ কৃষকের জীবিকার উৎস।
ভুট্টা রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
শিল্পেব্যবহার
গম ও ভুট্টা বেকারি ও খাদ্যশিল্পের কাঁচামাল।
ভুট্টা পশুপালন, মৎস্যচাষ ও কৃষি শিল্পে ব্যবহার হয়ে দেশের খামার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
জলবায়ুপরিবর্তনওখাদ্যশস্যউৎপাদনেরভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও লবণাক্ততা কৃষি উৎপাদনে বড় প্রভাব ফেলছে। এজন্য প্রয়োজন:
লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবন।
আধুনিক সেচ ও সংরক্ষণ প্রযুক্তি।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থাপনা।
উপসংহার
ধান, গম ও ভুট্টা বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য। এগুলো শুধু মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে না, বরং অর্থনীতি, শিল্প ও পশুপালনেও অপরিসীম অবদান রাখে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কৃষি হবে আরও উৎপাদনশীল, টেকসইওপ্রযুক্তিনির্ভর। আর ধান, গম ও ভুট্টা সেই অগ্রযাত্রার মূল ভিত্তি হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এখানকার মাটিতে ধান ও গমের পাশাপাশি ডাল ও তেলবীজ চাষও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, কৃষকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্য মসুর, সরিষা, সয়াবিন, তিল, মুগ, মাষকালাই, সূর্যমুখী ইত্যাদি ফসলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের প্রধান ডাল ও তেলবীজ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
ডালফসলেরগুরুত্বওপ্রধানজাতসমূহ
১. মসুরডাল
গুরুত্ব: বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম প্রধান ডাল। এতে প্রোটিন, লৌহ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স প্রচুর রয়েছে।
চাষএলাকা: কুমিল্লা, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, রংপুর অঞ্চলে বেশি চাষ হয়।
জাত: বারি মসুর-৬, বারি মসুর-৭, বারি মসুর-১০ ইত্যাদি।
চাষপদ্ধতি: সাধারণত আউশ-আমন কাটার পর পতিত জমিতে আবাদ করা হয়। স্বল্প সেচ ও কম সার প্রয়োগেই ফলন ভালো হয়।
২. মুগডাল
গুরুত্ব: প্রোটিন সমৃদ্ধ ও সহজপাচ্য। অঙ্কুরিত অবস্থায় ভিটামিন সি ও বি বেশি পাওয়া যায়।
চাষএলাকা: কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলে বেশি চাষ হয়।
জাত: বারি মুগ-৬, বারি মুগ-৭, বারি মুগ-৮ ইত্যাদি।
সময়: খরিফ-১ মৌসুমে আবাদ করা হয়, সাধারণত গ্রীষ্মকালীন ফসল।
৩. মাষকালাই
গুরুত্ব: মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। এতে প্রোটিন ও খনিজ উপাদান প্রচুর থাকে।
চাষএলাকা: বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা অঞ্চলে বেশি চাষ হয়।
জাত: বারি মাষ-২, বারি মাষ-৩ ইত্যাদি।
৪. ছোলা
গুরুত্ব: ডালের পাশাপাশি ভাজি ও বিভিন্ন খাবারে ব্যবহৃত হয়। উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ।
চাষএলাকা: রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী অঞ্চলে বেশি চাষ হয়।
জাত: বারি ছোলা-৮, বারি ছোলা-৯ ইত্যাদি।
তেলবীজফসলেরগুরুত্বওপ্রধানজাতসমূহ
১. সরিষা
গুরুত্ব: বাংলাদেশের প্রধান তেলবীজ ফসল। সরিষার তেলে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে।
চাষএলাকা: রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায়।
ব্যবহার: ভোজ্যতেল, পশুখাদ্য, সয়ামিল্ক, সয়া সস প্রভৃতি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
৩. তিল
গুরুত্ব: তিল থেকে উৎকৃষ্ট মানের তেল পাওয়া যায়। এছাড়া মিষ্টি, খাদ্য ও ওষুধে ব্যবহৃত হয়।
চাষএলাকা: খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া।
জাত: বারি তিল-৩, বারি তিল-৪।
৪. সূর্যমুখী
গুরুত্ব: ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ হেলথ-ফ্রেন্ডলি তেল উৎপাদন হয়।
চাষএলাকা: খুলনা, যশোর, ময়মনসিংহ, বগুড়া।
জাত: বারি সূর্যমুখী-২, বারি সূর্যমুখী-৩।
ডালওতেলবীজচাষেরসমস্যা
১. আবাদিজমিসংকোচন: ধান ও আলু চাষের জন্য অধিকাংশ জমি ব্যবহৃত হওয়ায় ডাল ও তেলবীজের জমি কমে যাচ্ছে।
২. অল্পফলনশীলজাত: এখনও অনেক কৃষক পুরনো জাত ব্যবহার করছেন।
৩. আবহাওয়ারপরিবর্তন: খরা, অতিবৃষ্টি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪. সরকারিসহায়তারঅভাব: পর্যাপ্ত ভর্তুকি, উন্নত বীজ ও বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় কৃষক নিরুৎসাহিত।
5. আমদানিনির্ভরতা: প্রতিবছর প্রচুর ভোজ্যতেল ও ডাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
উৎপাদনবৃদ্ধিরকরণীয়
১. উন্নতজাতব্যবহার: বিএআরআই ও বিএইউ উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী জাত চাষে উৎসাহিত করতে হবে।
২. ফসলবিন্যাস: ধান-কেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে রবি মৌসুমে পতিত জমিতে ডাল ও সরিষা আবাদ করতে হবে।
৩. প্রযুক্তিসম্প্রসারণ: কৃষকদের হাতে আধুনিক কৃষিযন্ত্র, সার ও সেচ সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে।
৪. প্রসেসিংইন্ডাস্ট্রি: তেলবীজ থেকে তেল উৎপাদন ও ডাল ভাঙানোর আধুনিক কারখানা গড়ে তুলতে হবে।
৫. গবেষণাওউদ্ভাবন: জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
৬. বাজারব্যবস্থাপনা: কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সংগ্রহ কেন্দ্র ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ জরুরি।
অর্থনৈতিকওসামাজিকগুরুত্ব
আমদানিনির্ভরতাহ্রাস: বর্তমানে বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার ৯০% আমদানি নির্ভর। উৎপাদন বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
পুষ্টিনিরাপত্তা: ডাল প্রোটিনের অন্যতম উৎস। সরিষা ও সয়াবিন তেল শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর।
মাটিরউর্বরতাবৃদ্ধি: ডাল জাতীয় ফসল নাইট্রোজেন স্থির করে জমির উর্বরতা বাড়ায়।
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ডাল ও তেলবীজের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে ফলন কম, জমির সংকট ও বাজার সমস্যা বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি সহায়তা, গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষকদের সচেতনতার মাধ্যমে এই ফসলের উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব। ফলে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, আমদানি নির্ভরতা হ্রাস এবং কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।
বাংলাদেশ একটি উর্বর কৃষিভিত্তিক দেশ। নদীমাতৃক এই ভূখণ্ডে বৈচিত্র্যময় ফলের চাষ হয়, যা শুধু কৃষকদের জীবিকা নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিরও অংশ। বাংলাদেশের জলবায়ু, উর্বর মাটি ও মৌসুমি বৈচিত্র্য নানা ধরনের ফল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আম, কলা, পেয়ারা ও লিচু—এই চারটি ফল দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নিচে তাদের বৈশিষ্ট্য, চাষাবাদ, অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও পুষ্টিগুণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
আম: ফলেররাজা
উৎপাদনওজনপ্রিয়তা
আমকে বলা হয় “ফলেররাজা“। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলা আম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত আমের মৌসুম থাকে।
প্রধানজাত
বাংলাদেশে প্রচলিত আমের জাতের মধ্যে রয়েছে—
ল্যাংড়া
হিমসাগর (ক্ষিরসাপাতি)
ফজলি
আম্রপালি
গোপালভোগ
নাজিরহাওয়াই
আশ্বিনা
অর্থনৈতিকগুরুত্ব
আম শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, বিদেশেও রপ্তানি হয়। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে বাংলাদেশের আমের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এটি কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পুষ্টিগুণ
আমে প্রচুর ভিটামিনএ, সি ও ডায়েটারিফাইবার রয়েছে। এটি চোখের দৃষ্টি, ত্বকের স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
কলা: সারাবছরেরফল
উৎপাদনওপ্রাচুর্য
কলা বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজলভ্য ফলগুলোর একটি। এটি সারা বছরই পাওয়া যায়। দেশের প্রায় সব জেলায় কলার চাষ হলেও গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রধানজাত
বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত কলার জাতসমূহ—
সাগরকলা
সাব্রিকলা
কাঠালীকলা
চাপাকলা
বান্দরকলা
অর্থনৈতিকগুরুত্ব
কলা গ্রামীণ অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত ফলন ও কম খরচে উৎপাদনের কারণে কৃষকরা কলা চাষে আগ্রহী। এছাড়া কলা স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন এবং পরিবহন সহজ।
পুষ্টিগুণ
কলা হলো শক্তিদায়ক ফল। এতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেট, পটাশিয়াম, ভিটামিনবি৬ এবং আয়রন রয়েছে। এটি শিশু, বৃদ্ধ ও ক্রীড়াবিদদের জন্য সমান উপকারী।
পেয়ারা: গ্রীষ্মওবর্ষারভরসা
উৎপাদনএলাকা
বাংলাদেশে পেয়ারা চাষ মূলত বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর এবং খুলনা অঞ্চলে বেশি হয়। বরিশালের ভাসমান হাট পেয়ারা বিক্রির জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
প্রধানজাত
কাজীপেয়ারা
লালপেয়ারা
দেশিপেয়ারা
অর্থনৈতিকগুরুত্ব
পেয়ারার উৎপাদন খরচ কম এবং ফলন ভালো। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কিছুটা হলেও বিদেশে রপ্তানি হয়। স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা সবসময়ই থাকে।
পুষ্টিগুণ
পেয়ারা হলো ভিটামিনসি–এরভান্ডার। একটি পেয়ারায় আপেলের তুলনায় চারগুণ বেশি ভিটামিন সি থাকে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হজমে সহায়তা এবং দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর।
লিচু: স্বল্পমেয়াদিরসালোফল
উৎপাদনঅঞ্চল
বাংলাদেশের দিনাজপুর, রাজশাহী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল এবং কুষ্টিয়া লিচু উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে লিচু বাজারে পাওয়া যায়।
প্রধানজাত
বোম্বাইলিচু
চাইনিজলিচু
কালিয়া
বেদানালিচু
অর্থনৈতিকগুরুত্ব
লিচু একটি উচ্চমূল্যের ফল। মৌসুম স্বল্প হওয়ায় বাজারে এর দাম তুলনামূলক বেশি থাকে। দিনাজপুরের লিচু দেশজুড়ে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে।
পুষ্টিগুণ
লিচুতে প্রচুর ভিটামিনসি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খনিজপদার্থ রয়েছে। এটি ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও শরীরকে সতেজ রাখতে সহায়ক।
অন্যান্যগুরুত্বপূর্ণফল
বাংলাদেশে আরও বহু ফল উৎপন্ন হয়, যেমন—
কাঁঠাল (জাতীয় ফল, গ্রীষ্মকালীন শক্তিদায়ক ফল)
পেঁপে (ভিটামিন এ ও হজম সহায়ক)
আনারস (মৌসুমি রসালো ফল, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ)
নারকেল (সারা বছর পাওয়া যায়, পানীয় ও খাবার উভয়েই ব্যবহৃত)
তাল (বর্ষার বিশেষ ফল)
বেল (ঔষধি গুণসম্পন্ন ফল)
অর্থনীতিওকৃষিতেফলেরঅবদান
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ফলমূলের ভূমিকা অপরিসীম। শস্য ফসলের পাশাপাশি ফলমূল দেশের খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে। সরকার সম্প্রতি অগ্রাধিকারকৃষিপণ্যহিসেবেআম, লিচু, পেয়ারা, ড্রাগনফলইত্যাদিরপ্তানিবৃদ্ধিরউদ্যোগ নিয়েছে।
পুষ্টিওস্বাস্থ্যগতগুরুত্ব
বাংলাদেশের প্রধান ফলগুলো—আম, কলা, পেয়ারা, লিচু—শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে। এগুলো—
অপুষ্টি প্রতিরোধ করে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
ত্বক ও চোখের যত্ন নেয়
হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়
শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য সমানভাবে উপকারী
উপসংহার
বাংলাদেশের প্রধান ফলমূল শুধু খাদ্য নয়, বরং সংস্কৃতি ও অর্থনীতিরও অংশ। মৌসুমি এই ফলগুলো আমাদের জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ করে এবং দেশকে বৈদেশিক বাণিজ্যে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। আমের মিষ্টি সুবাস, কলার সহজলভ্যতা, পেয়ারার স্বাস্থ্যগুণ কিংবা লিচুর রসাল স্বাদ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ফলমূল আমাদের ঐতিহ্য ও সম্পদের প্রতীক।
ধানের ডাটাবেজ, ধান বিষয়ক সকল তথ্য নিচে থেকে ডাউলোড করতে পারবেন। সরকার প্রকাশিত প্রতিটি রিপোর্ট পিডিএফ আকারে যুক্ত করা হলো।
ধানের ডাটাবেজ, ধান বিষয়ক সকল তথ্য
সারের ব্যবহার
উৎপাদন ও বছরের ভিত্তিতে সার বিক্রয়
ক্রপিং ইনটেনসিটি
ভূ -স্তরে পানি’র হ্রাস-বৃদ্ধি ও নিরাপদ পানি ব্যবহারের পর্যবেক্ষণ বিষয়ক তথ্য
বাংলাদেশের ধান বিষয়ক আমদানি ও রপ্তানি ডাটা
ধানের আমদানি, রপ্তানি, পরিমাণ ও মূল্যের ডাটা (বৈশ্বিক ধানের পরিসংখ্যান)
বিশ্বের বিভিন্ন ধানের জমি, উৎপাদন ও ফলনের ডাটা ( বৈশ্বিক ধানের পরিসংখ্যান)
সেচের আওতায় বিভিন্ন ফসলের জমি
পদ্ধতি ভেদে সেচ ব্যবস্থাপনা
সেচ ডাটা
সংস্থাওয়ারি সেচ সম্পর্কিত তথ্য (সার সংক্ষেপ)
বছর ভিত্তিতে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির হার
ব্রি ধানের গ্রহণযোগ্যতার হার
বাংলাদেশের ধানের ফলন (মওসুম অনুসারে)
বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন (মওসুম অনুসারে)
বাংলাদেশের ধানের জমি (মওসুম অনুসারে)
বাংলাদেশের ধানের জমি, উৎপাদন ও ফলনের ডাটা
বাংলাদেশের ধানের জমি, উৎপাদন ও ফলনের ডাটা (জেলাভিত্তিক)
বাংলাদেশের রোপা আমন (বৃষ্টিনির্ভর) চাষাবাদের জন্য বিভিন্ন এলাকার উপযুক্ত জাতসমূহ
ডেটাবেজ এর বিভিন্ন উপাদান :
কম্পিউটারে ডেটা একটি নিদির্ষ্ট ধারা অনুসারে থাকে প্রথম ক্ষুদ্রতম একক হল:
বিট( bit ): ১টি ডেটার ক্ষুদ্রতম যে অংশ একটি কম্পিউার ব্যবহার করে তাকে বিট বলে যেমন: ০,১ এগুল বিট
বাইট(Byte): ৮টি বিট নিয়ে ১বাইট গঠিত হয় : ১বাইট নিয়ে ১টি অক্ষর গঠিত হয়,নম্বর বা প্রতিক বুঝানো হয়
ফিল্ড(Field): একাধিক অক্ষর সমন্বয় গঠিত হয় ১টি শব্দ বা সংখ্যা একে ফিল্ড বলে । যেমন: কোন ব্যক্তির নাম বা বয়স ফিল্ড হতে পারে
রেকর্ড(Record): পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত একগুচ্ছ ফাইলকে রেকর্ড বলে । যেমন : স্টুডেন্ট এর নাম,ঠিকানা,যেসব বিষয় নেয়া হয়েছে সবকিছু একত্রে রেকর্ড অধীন
ফাইল(File): একই রকমের অনেকগুলো রের্কড নিয়ে ফাইল গঠিত হয় ।
ডেটাবেজ(Database): অনেক গুলো একই কাজের ফাইল একত্রে একটি ডেটাবেজ তৈরি হয় ।
উপরের সব উপাদান সর্ম্পকে আপনাকে অবশ্যই ভাল ভাবে যানতে হবে কারন প্রত্যেক টি ডাটাবেজ এই ৬টি উপাদান নিয়ে গঠিত হয়।
এনটিটি(Entity):
কোন কিছুর নামই এনটিটি । এক কথায় কোন কিছুর নাম ই এনটিটি ব্যক্তি, বস্তু,বিষয়,ঘটনা,যা কিছু প্রকাশ করা যায় তাই এনটিটি । যেমন :কোন দোকানে আমরা যখন order দিই তা বিভিন্ন ভাবে Processing হয়ে আমাদের কাছে আসে এটাই এনটিটি।
এ্যাট্রিবিউট(Attribute):
এনটিটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য(গুনাগুন) থাকে ওই গুনাগুনই হচ্ছে এ্যাট্রিবিউট । যেমন : স্টুডেন্টের নাম,রোল ইত্যাদি প্রতিটি ১ ১টি এ্যাট্রিবিউট।
ফল ও শাকসবজি বাজারজাত করণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ – বিষয়ক আজকের আলোচনা। এই পাঠটি ইউনিট ৯ এর ৯.৩ নং পাঠ।
ফল ও শাকসবজি বাজারজাত করণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ
ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচনশীল পণ্য এবং এদের উৎপাদন মৌসুম সীমিত বলে এসব পণ্যের বাজারজাতকরণ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। তবে মৌসুমের সময় প্রচুর উৎপাদন হয় বলে এদের দাম কম থাকে। যদিও অন্যান্য খাদ্যোপাদানের সাথে সাথে ফল ও শাকসবজির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই পরিস্থিতি সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একদিকে যেমন কৃষক ন্যায্য মূল পাবে তেমনি ক্রেতাসাধারণও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভালমানের ফল ও শাকসবজি কিনতে পারবে।
ফলে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সবাই লাভবান হবে। আমাদের দেশে ফল ও শাকসবজি বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া এখনও তেমন সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতির আওতায় আসে নাই।
ফল ও সবজি সাধারণত তিনটি ধাপে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পেঁৗছায়—
ধাপ—১ : কৃষক সবজি উৎপন্ন করার পর সংগ্রহ করে এবং আড়তে বিক্রি করে।
ধাপ—২ : আড়ত থেকে ফরিয়া বা মধ্যস্বত্বভোগীরা ফল ও সবজি শহরের পাইকারী বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে।
ধাপ—৩ : খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে ভোক্তারা ফল ও সবজি ক্রয় করে।
এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল এবং এর ফলে কৃষক যেমন ন্যায্যমূল্য পায় না তেমনি ক্রেতা বা ভোক্তাদেরও উচ্চমূল্যে পণ্য কিনেতে হয়। এই পদ্ধতিতে ফল ও সবজি বাজারে পৌছাতে সময় বেশি লাগে। তাই বাজারে নেওয়ার পূর্বে ফল ও সবজি ভালভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। তা না হলে ফল ও সবজি পচে গিয়ে অপচয় বেড়ে যায়। বাজারজাতকরণের ত্রুটি দূর করার জন্য নিম্নের কাজগুলো করতে হবে।
বাজারজাতকরণের ত্রুটি দূর করার জন্য কাজ:
ক) যথাসময়ে সংগ্রহ :
ফল বা শাকসবজি গাছ থেকে সময়মত সংগ্রহ করতে হবে। অতিরিক্ত পাকা বা অপরিপক্ক ফল বা সবজি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
খ) গ্রেডিং করা :
ফল ও শাকসবজিকে আকার, আকৃতি, বর্ণ ইত্যাদি বাহ্যিক গুণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। গ্রেডিং করা ফল ও শাকসবজির সংরক্ষণ কাল বেড়ে যায় এবং গ্রেডিং করা শাকসবজি ও ফলের বাজারমূল্য ভাল পাওয়া যায়।
গ) ফল ও শাকসবজি শীতল করা :
শাকসবজি ও ফল সংগ্রহের পরও শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং এতে এইসব পণ্য দ্রুত পচে যায়। তাই মাঠ থেকে ফল উত্তোলনের পর এগুলোকে বায়ুচলাচলের সুবিধাযুক্ত ছায়াযুক্ত স্থানে কিছুক্ষণ রেখে ঠান্ডা করে নিতে হয়। অনেক সময় ঠান্ডা করার জন্য উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন: সবজি বা ফলের উপর দিয়ে আর্দ্র ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত করা হয়। বরফ পানি ছিটানো হয় বা বরফ পানিতে ফল ও সবজি ডুবানো হয়।
এতে করে ফল ও সবজি দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। বরফ পানিতে ডুবানোর একটি সুবিধা হলো এর সাথে ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ফল ও শাকসবজি জীবাণুমুক্ত করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে ফল ও শাকসবজি দূরের কোন স্থানে পরিবহণ করার আগে এভাবে ঠান্ডা করে নিলে বেশিদিন এগুলো সংরক্ষণ করা যায়।
ঘ) প্যাকেজিং :
প্যাকেজিং নির্ভর করে পণ্য কতদূরে এবং কিভাবে যাবে তার উপর। প্যাকেট এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পরিবহনের সময় পণ্য আঘাত প্রাপ্ত না হয়। উন্নত বিশ্বে বাতাস চলাচলে সুবিধাযুক্ত প্লাস্টিক কাঠ বা হাডবোর্ডের বাক্সে শাকসবজি ও ফল পরিবহন করা হয়।
ঙ) পরিবহণ :
পরিবহণের সময় পণ্য বেশি গাদাগাদি করে বোঝাই করা উচিৎ নয়। এতে, ফল ও সবজি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই পরিবহণের সময় ফল ও সবজি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। শীতকালে একটানা ১২ ঘন্টা এবং গ্রীষ্মকালে ৮ ঘন্টার বেশি ফল ও শাকসবজি যানবাহনে রাখা যাবে না। পরিবহনকালে শাকসবজির প্যাকেট বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য তাকে নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ছয়টি খাদ্য উপাদানের মধ্যে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ উল্লেখযোগ্য।
ফল ও শাকসবজি এই ভিটামিন ও খনিজের প্রধান উৎস, ফল ও শাকসবজি যেমন আমাদের রসনার তৃপ্তি দেয়, তেমনি আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে। ফল ও সবজিতে ভিটামিন ও খনিজ ছাড়াও সহজ প্রাপ্য শর্করা আমিষ ও স্নেহজাতীয় খাদ্য উপাদান রয়েছে। এসব খাদ্য শরীর গঠনে যেমন সাহায্য করে তেমনি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। এতগুণ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ফল ও সবজি দীর্ঘদিন তাজা অবস্থায় রেখে খাওয়া যায় না। এগুলো পচনশীল পণ্য। তাই ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্য তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়। এসব প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত।
বিভিন্ন ফল ও সবজির গুণগত মানের পরিবর্তন না করে ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের আকৃতি প্রকৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের গুরুত্ব:
নিম্নে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণের গুরুত্ব আলোচনা করা হল:
১। পুষ্টিমান সংরক্ষণ :
প্রক্রিয়াজাত করনের ফলে সবজি ও ফলের গুণগত মানের তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। ফলে সারাবছর ঐ ফল বা সবজির স্বাদ গ্রহণ করা যায় ও পুষ্টি ও পাওয়া যায়।
২। উৎপাদিত পণ্যের অপচয় রোধ :
আমাদের দেশে মৌসুমের সময় যে ফল ও সবজি উৎপাদিত হয় সংগ্রহ পরবতীর্ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে এর বড় একটি অংশ পচে নষ্ট হয়। তাই শাকসবজি ও ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন খাবার যেমন, জ্যাম, জেলী, জুস, আচার, ইত্যাদি তৈরি করলে সবজি ও ফল অপচয় রোধ করা যাবে।
৩। কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি :
উৎপাদন মৌসুমে সাধারণত ফল ও সবজির দাম কম থাকে। এ সময় অপচয়ও হয় বেশি। কিন্তু এসব দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য তৈরি করা হলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে।
৪। কর্মসংস্থান সৃষ্টি :
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সাথে অনেক কাজ জড়িত। ফলে সেখানে প্রচুর লোকের প্রয়োজন হয়। এবং এভাবে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
৫। বৈদেশিক মুদ্রা আয় :
প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আর করা সম্ভব।
কুল চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা। বাংলাদেশে কুল একটি ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফল। স্বাদ ও পুষ্টিমান বিচারে কুল অত্যন্ত উৎকৃষ্টমানের ফল। বিশেষ করে ভিটামিন সি-এর দিক থেকে আমলকী ও পেয়ারার পরই এর স্থান। কুল শুধু ফল হিসেবেই নয়, এ থেকে আচার, চাটনি ইত্যাদি মুখরোচক খাবারও তৈরি হয়।
কুল চাষ পদ্ধতি
আপেল কুল
কুলের বংশবিস্তার :
বীজ এবং কলমের মাধ্য , মে কুলের বংশবিস্তার করা যায়। কলমের চারার বংশগত গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। বীজ থেকে চারা পেতে বীজকে ভেজা গরম বালির ভেতর দেড়-দুই মাস রেখে দিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়। না হলে ৬-৮ সপ্তাহ সময় লেগে যায়। কলমের চারা পেতে নির্বাচিত স্থানে বীজ বপণ ও চারা তৈরি করে তার ওপর বাডিংয়ের মাধ্যমে কলম করে নেওয়া ভালো।
কাশ্মীরি আপেল কুল
কুলের জাত পরিচিতি :
বারি কুল-১ :
এটি নারিকেলী জাত নামে পরিচিত। দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় চাষাবাদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত জাত। ফল আকারে বড়, ওজন গড়ে ২৩ গ্রাম ও লম্বা।
বারি কুল-২ :
জাতটি উত্তারাঞ্চলে চাষাবাদের জন্য ভাল হলেও দেশের অন্যত্রও চাষ করা যায়। ফল আকারে বড় ও ডিম্বাকৃতি।
বারি কুল-৩ :
জাতটি সারা দেশেই চাষ করা যায়। ফল বড়, প্রায় গোল আকারের ও হলুদাভ সবুজ রঙের। ফলন প্রতি হেক্টরে ২২-২৫ টন।
আপেল কুল :
আপেল কুল বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মোফাজ্জল হোসেন কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে অনুমোদিত। আপেল এর মতো রঙ হওয়ার জন্যে কুলটির নাম দেওয়া হয়েছে আপেল কুল। মিষ্টি স্বাদের জন্য অন্য কুলের চেয়ে এটি অনেক ভালো।
বাউকুল-১ :
ফল আকারে অনেক বড় হয় (গড়ে ৯০ গ্রাম)। মিষ্টতার পরিমানও অনেক বেশি। আগাম পরিপক্ক হয়। সারা দেশেই চাষ করা যায়।
কাশ্মীরি আপেল কুল :
কাশ্মীরি আপেল কুল দেখতে অনেকটা মাঝারি সাইজের আপেলের মতো। রং আপেলের মতো সবুজ ও হালকা হলুদের ওপর লাল। স্বাদ হালকা মিষ্টি অনেকটা বাউকুলের মতো। প্রচলিত আপেল কুল ও বাউকুলের থেকে আকারে বেশ বড় এই কাশ্মীরি আপেল কুল।
বল সুন্দরী কুল :
বল সুন্দরী দেখতে ঠিক আপেলের মতো। উপরের অংশে হালকা সিঁদুর রং। খেতে সুস্বাদু। ফলটি রসালো ও মিষ্টি।
বল সুন্দরী কুল
কুল চাষের জন্য মাটি :
যেকোনো ধরনের মাটিতেই কুলের সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায়। কুলগাছ লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। তবে ভারি ও সামান্য ক্ষারযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটিতে কুলের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
জমি তৈরি : বাগান আকারে চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি ভালো। তাছাড়া বাড়ির আনাচে-কানাচে, পুকুর পাড়ে বা আঙিনায় পড়ে থাকা অনুর্বর মাটিতেও গর্ত করে চাষ করা যায়।
রোপণ : বাগান আকারে চাষের জন্য বর্গাকার রোপণ প্রণালি অনুসরণীয়। রোপণ দূরত্ব ৬-৭ মিটার। জাত ও স্থানভেদে দূরত্ব কম-বেশি হবে। চারা রোপণের মাসখানেক আগে ১ মি. x১ মি. x১ মি. আকারের গর্ত করতে হবে।
কুল চাষের সময় :
মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-চৈত্র এবং মধ্য-শ্রাবণ থেকে মধ্য-ভাদ্র রোপণ করা যায়।
বারি কুল
কুল চাষের সার ব্যবস্থাপনা :
চারা গাছ লাগানোর ১ মাস পর চারা গাছের চারদিকে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার হিসেবে পচা গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্টা পচানো কম্পোস্ট সার, খৈল ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাসায়নিক সার ভিন্ন বয়সের গাছে ভিন্ন অনুপাতে দেওয়া হয়। কুলের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত ও পরিমাণমতো সার দিতে হবে। সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স, আকার ও মাটির উর্বরতার ওপর। নিম্নে বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা দেওয়া হলো-
গাছের বয়স (বছর)
পচা গোবর (কেজি)
ইউরিয়া (গ্রাম)
টিএসপি (গ্রাম)
এমওপি (গ্রাম)
১-২
১০
২৫০-৩০০
২০০-২৫০
২০০-২৫০
৩-৪
২০
৩৫০-৫০০
৩০০-৪৫০
৩০০-৪৫০
৫-৬
২৫
৫৫০-৭৫০
৫০০-৭০০
৫০০-৭০০
৭-৮
৩৫
৮০০-১০০০
৭৫০-৮৫০
৭৫০-৮৫০
৯ বা তদূর্ধ্ব
৪০
১১৫০-১২৫০
৯০০-১০০০
৯০০-১০০০
সার বছরে ২-৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ফল ধরা, ফল সংগ্রহ ও বর্ষার পর সার প্রয়োগ করা ভালো। সার দেওয়ার পর হালকা সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দেওয়া উচিত।
কুল গাছের পরিচর্যা :
শুষ্ক মৌসুমে বিশেষত ফুল ও ফল ধরার সময়ে মাসে একবার সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। চারাগাছ (বীজের বা কলমে) হলে প্রথম বছর গাছটির কাঠামো মজবুত করার জন্য গাছের গোড়া থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার উঁচু পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। এর উপরে শক্ত-সামর্থ কিছু শাখা-প্রশাখা গাছের অবস্থা অনুযায়ী রাখতে হবে। যেন ডালপালা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
কুল গাছের ছাঁটাই :
ছাঁটাইয়ের সময় শক্ত-সামর্থ শাখাগুলোর গোড়া থেকে না কেটে কিছু অংশ রেখে অগ্রভাগ কেটে ফেলতে হবে। এছাড়া দুর্বল, রোগ ও কীট দৃষ্ট ও ঘনভাবে বিন্যস্ত ডালগুলো গোড়া থেকে কেটে পাতলা করে দিতে হবে। নতুন যে ডালপালা গজাবে সেগুলোও বাছাই করে ভালো ডালগুলো রেখে দুর্বল ডাল কেটে ফেলে দিতে হবে।
কুলের রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ :
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা :
ফল ছিদ্রকারী উইভিল কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুলের উন্নত জাতে এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পোকার সদ্যজাত লার্ভা হালকা হলুদ বর্ণের হয়। এদের পা থাকে না। পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণের হয়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা থেকে পূর্ণ রূপ ধারণ করে।
সদ্য জাত লার্ভা কচি ফলের বীজে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ বীজ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফলের নিচে কাল দাগ পড়ে এবং বীজের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ফল ছোট গোলাকার হয় এবং ফ্যাকাশে ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে বা গাছ শুকিয়ে যায়।
পোকা দমনে করণীয় :
কুল বাগানের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। কুল গাছে অসময়ে আসা ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলতে হবে। গাছ ও মাটিতে পড়ে যাওয়া আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ করে লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে। বেশি আক্রান্ত এলাকায় ফুল ধরার আগেই সব বাগান ও এলাকা অনুমোদিত কার্বারাইল জাতীয় কীটনাশক বা ডাইমেথোয়েট জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। যেহেতু পোকাটি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ফলের ভেতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেজন্য আক্রমণের আগেই পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য পরাগায়নের পর ফল ধরা শুরু হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
জমি সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যেন ডালপালায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় কুল চাষ না করাই উত্তম।
হাত বা শক্ত লাঠি দিয়ে টিউবগুলো নিম্ফসহ ধ্বংস করতে হবে। যেহেতু ফুল ধরার সময় এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় সেজন্য গাছে ফুল আসার সময়ে কা- বা শাখায় টিউব দেখামাত্র সাইপারমেথ্রিন বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
উইভিল পোকা
টিউব স্পিটল বাগ :
এ পোকার নিম্ফগুলো সরু, লম্বা চুন যুক্ত টিউবের মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। নিম্ফগুলো টিউবের মধ্যে তাদের তৈরি ফ্লুয়িডে (fluid) নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং টিউবে এদের মাথা নিচে এবং পেট ওপরে রাখে। নিম্ফগুলোর পেটে একটি বর্ধিত প্লেট থাকে যা টিউবের খোলা প্রান্তে দরজা হিসাবে কাজ করে এবং টিউবকে বন্ধ করে দেয়।
পূর্ণ বয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ ফুল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত ফুল সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারণের অনুপযোগী হয়। অধিক আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ রূপে ফল ধারণে ব্যর্থ হয়।
টিউব স্পিটল বাগ
পাউডারি মিলডিউ :
এটি ছত্রাকজনিত একটি রোগ। এর আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়। আক্রান্ত ফুল ও ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে। গাছের পরিত্যক্ত অংশে এবং অন্যান্য উদ্ভিদে এ রোগের জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। এটি বাতাসের মাধ্যমে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। উষ্ণ ও ভেজা আবহাওয়ায় বিশেষ করে মেঘাচ্ছন্ন অবস্থায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। গাছে ফুল দেখা দেযার পর থিওভিট ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম বা টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। পরবর্তী ১৫ দিন পর পর দুইবার স্প্রে করতে হবে।
কুলের পাউডারি মিলডিউ রোগ
কুল ফল সংগ্রহ :
জাত অনুসারে মধ্য-পৌষ থেকে মধ্য-চৈত্র মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। ফলের রং হালকা সবুজ বা হলদে হলে সংগ্রহ করতে হয়। গাছপ্রতি ৫০-২০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
বাঁশ চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা। বাঁশ চাষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে করা যায়। বর্তমানে কাটিং ও কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ করে বিভিন্ন জেলার কৃষকরা সফলতার মুখ দেখছেন। সারাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ। নিম্নে কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে বাঁশ চাষ বর্ণিত হলো-
বাঁশ চাষ পদ্ধতি
বাঁশের কঞ্চি কলম সংগ্রহ:
কলম কাটার জন্য সুস্থ, সবল, অপেক্ষাকৃত মোটা আকৃতির এক বছর বা তার কম বয়সের বাঁশ নির্বাচন করতে হবে। বাঁশের গা ঘেঁষে আঙ্গুলের মতো মোটা কঞ্চি হাত করাত দিয়ে কেটে সংগ্রহ করতে হবে। কঞ্চির গোঁড়া হতে ৩-৫ গিট বা দেড় হাত লম্বা করে কঞ্চি কলম কাটতে হবে। সংগৃহীত কঞ্চিগুলি নার্সারি বেডে লাগানোর পূর্ব পর্যন্ত ভেজা চট দিয়ে মুড়িয়ে রাখুন অথবা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। কার্তিক-মাঘ (অক্টোবর – ফেব্রুয়ারি) মাস বাদে সারা বছরই কঞ্চি কলম করা যাবে। ফাল্গুন-আশ্বিন (মার্চ -সেপ্টেম্বর ) মাস কঞ্চি কলম কাটার উপযুক্ত সময়।
বাঁশ চাষের জন্য বালির বেড তৈরি:
চার ফুট চওড়া এবং প্রয়োজন মতো লম্বা বালির বেড তৈরি করতে হবে। বালির বেডের উচ্চতা বা পুরুত্ব কমপক্ষে ১০ ইঞ্চি হতে হবে। বালি সব রকমের আবর্জনামুক্ত হতে হবে। বালির বেডের কিনার বাঁধার জন্য চারদিকে ইট বা তরজা ব্যবহার করতে হবে অথবা সমতল মাটিতে বেডের আকৃতিতে মাটি কেটে আয়তকার ১০ ইঞ্চি গভীরতার ব্লক তৈরি করতে হবে। মাটিতে কাটা ব্লকটি বালি দিয়ে ভরে দিতে হবে।
বাঁশ চাষের জন্য বালির বেডে কঞ্চি কলম রোপণ:
বালির বেডে কঞ্চিগুলি ২-৩ ইঞ্চি দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে ৩-৫ ইঞ্চি গভীরে ভালোভাবে বালি চেপে লাগাতে হবে। বেডে কঞ্চি রোপণের পর হতে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত দিনে ২-৩ বার ঝরনা দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে। এ সময়ের মধ্যেই কঞ্চিতে নতুন শাখা-প্রশাখা ও পাতা গজিয়ে সম্পূর্ণ বেড সবুজ আকার ধারণ করবে এবং কঞ্চি-কলমের গোঁড়ায় যথেষ্ট শিকড় গজাবে। তখন বেডে ধীরে ধীরে পানি সেচের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
বাঁশের কলম স্থানান্তর ও রোপণ:
শিকড়যুক্ত কলম পলিথিন ব্যাগ বা উপযুক্ত পাত্রে ৩:১ অনুপাতে মাটি-গোবর মিশ্রণের মধ্যে স্থানান্তর করতে হবে। প্রতিটি ব্যাগ বা পাত্রে একটি করে শিকড় গজানো কঞ্চি কলম স্থানান্তর করতে হবে। ৭-১০ দিন কলমটি ছায়ায় রাখতে হবে। এ সময় নিয়মিত দিনে একবার পানি দিতে হবে। এরপর ব্যাগগুলি সারিবদ্ধ ভাবে বেডে সাজিয়ে রাখতে হবে। মাঠে রোপণের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাগের আগাছা বাছাই করতে ও পরিমিত পানি দিতে হবে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ১৫-২০ ফুট দূরত্বে ১.৫ X ১.৫ X ১.৫ ফুট গর্তে কঞ্চি কলম মাঠে লাগিয়ে দিতে হবে। চার বছরে একটি কঞ্চি কলম ঝাড়ে পরিণত হবে এবং ছয় বছর হলে ঝাড় হতে বাঁশ আহরণ করা যাবে।
বাঁশের ঝাড় ব্যবস্থাপনা:
বাঁশঝাড়ের উন্নত ব্যবস্থাপনা করে খুব কম খরচে বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ উৎপাদন করা যায় ও অধিক সবল বাঁশ পাওয়া যায়। বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা দ্বারা সুস্থ-সবল ও পুষ্ট বাঁশ উৎপাদন করে ভালো বাজার মূল্য পাওয়া যায়। পরিচর্যার ফলে ঝাড় থেকে বেশি সংখ্যক বাঁশ পাওয়া সম্ভব। এতে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাড়তি আয়ও বাড়ানো সম্ভব।
বাঁশের ঝাড় পরিষ্কারকরণ:
বাঁশঝাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। ময়লা-আবর্জনা, পাতা, খড়কুটো, পচা বা রোগাক্রান্ত বাঁশ, কঞ্চি, কোঁড়ল ঝাড় থেকে নিয়মিতভাবে অপসারণ করতে হবে। চারা, কঞ্চি, মুথা বা অফসেট মাটিতে লাগানোর পর প্রথম ১ -২ বছর চিকন ও সরু বাঁশ গজায়, যা মরে গিয়ে ঝাড়ে গাদাগাদি করে থাকে। গাদাগাদি করে থাকা চিকন ও মরা বাঁশ অপসারণ করে ফেলতে হবে। প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হালকা নিয়ন্ত্রিত আগুন দিয়ে ঝাড় এলাকার আবর্জনা ও শুকনো পাতা পুড়িয়ে দিতে হবে। এতে ঝাড়ে অনুকূল স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে যা প্রচুর নতুন কোঁড়ল মাটি থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্যবান ঝাড় সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।
বাঁশের ঝাড়ে নতুন মাটি প্রয়োগ:
সাধারণত প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাঁশের কোঁড়ল গজায়। তাই প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি দেওয়া উচিত। এতে কোঁড়ল দ্রুত বেড়ে উঠবে ও সুস্থ বাঁশ পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত বা পুরাতন ঝাড়ের মাটি কখনও ব্যবহার করা যাবে না। এতে সুস্থ বাঁশ ঝাড়ে রোগ বিস্তারের সম্ভাবনা থাকে।
বাঁশে সার প্রয়োগ:
মাঝারি আকারের ঝাড়ের গোঁড়ায় প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ১০০-১২৫ গ্রাম ইউরিয়া, সমপরিমাণ ফসফেট ও ৫০-৬৫ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। ঝাড়ের চারিদিকে মাটিতে ১৮ ইঞ্চি চওড়া ও ২৪ ইঞ্চি গভীর নালা কেটে সেই নালায় সার প্রয়োগের পর নালাটি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর বৃষ্টি না হলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে।
বাঁশে পানি সেচ:
খরা মৌসুমে চারা গাছ সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পায় না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মারাও যায়। তাই প্রথম কয়েক বছর নতুন ঝাড়ে পরিমিত পানি সেচ দেওয়া প্রয়োজন। এক সপ্তাহে পর পর এক বা দুই কলস পানি বাঁশের চারার গোঁড়ায় ঢেলে দিয়ে ছন বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বাঁশ পাতলাকরণ:
বাঁশের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট জায়গা প্রয়োজন। অতিরিক্ত কঞ্চি বা পচা ও আঘাতপ্রাপ্ত বাঁশ নিয়মিত কাটা উচিত। ঝাড় থেকে বাঁশ এমনভাবে কাটতে হবে যেন একটি থেকে অন্যটি ৬-১০ ইঞ্চি দূরে থাকে।
আগাছা, মরা/ পচা বাঁশ ও পুরনো মোথা অপসারণ:
আগাছাপূর্ণ স্থানে ঝাড় থেকে নতুন বাঁশ সহজে গজাতে পারে না অথবা সরু ও দুর্বল বাঁশ গজায়। কোন কোন সময় আগাছার চাপে চারা বাঁশ মারা যায়। তাই নতুন বাঁশঝাড় আগাছা মুক্ত রাখা উচিত। এছাড়া মাথাপচা রোগে আক্রান্ত মরা ও পচা বাঁশ ঝাড় থেকে সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। আবার পুরাতন পরিত্যক্ত মোথা থেকে প্রকৃতপক্ষে কোন কোঁড়ল বের হয় না বরং জায়গা নষ্ট করে বাধা সৃষ্টি করে। তাই বয়স্ক বাঁশঝাড়ের পুরাতন মোথা সাবল দিয়ে কেটে অপসারণ করলে বাঁশঝাড় আবার অনেকটা নতুন জীবন লাভ করে।
বাঁশ আহরণ:
বাঁশের কোঁড়ল বের হওয়ার পর ৩ মাসের মধ্যে একটি বাঁশ পূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং এরপর আর বাড়ে না। বর্ষায় যে কোঁড়ল বের হয় তা আশ্বিন-কার্তিক মাসের মধ্যে পূর্ণ উচ্চতা প্রাপ্ত হয়। ঝাড়ের ফলন ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে একটি বাড়িতে কমপক্ষে তিনটি বাঁশঝাড় লাগাতে হবে। একটি বাঁশ পাকতে তিন বছর সময় লাগে। প্রতি বছরই বাঁশ ঝাড় থেকে পাকা বাঁশ আহরণ করতে হবে। তাহলে গুনগত দিক দিয়েও ভালো বাঁশ পাওয়া যাবে।
ঝাড় থেকে বাঁশ কাটা ও টেনে বের করার সময় যে সব বিষয়ে যত্নবান হওয়া উচিত তা হলো:-
বাঁশে কঞ্চি বেশি থাকলে, গোঁড়ার দিকের কঞ্চিগুলো আগে কেটে ফেলতে হবে। এতে ঝাড় থেকে কাটা বাঁশ টেনে বের করা সহজ হবে। কাজ শেষে কাটা কঞ্চি ও ডালপালা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
কোনও নির্দিষ্ট ঝাড় থেকে বয়স্ক বাঁশের ৩ ভাগের ২ ভাগ বাঁশ কাটতে হবে। অর্থাৎ একটি ঝাড়ে ১০টি বয়স্ক বাঁশ থাকলে ৫-৬টি কাটা যাবে। এমনভাবে বাঁশ সংগ্রহ করুন যেন থেকে যাওয়া বয়স্ক বাঁশ পুরো ঝাড়ে ছড়িয়ে থেকে ঝাড়টিকে ঝড়-বাদলের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
প্রতিটি বাঁশ গোঁড়া থেকে কাটতে হবে। মাটির কাছাকাছি গিটের ঠিক ওপরে তেরছা করে কেটে বাঁশটিকে গোঁড়া থেকে আলাদা করতে হবে। এতে বাঁশের অপচয় হয় না। এ ছাড়া ফেলে আসা গোঁড়ার অবশিষ্টাংশে বৃষ্টির পানি জমে পোকা-মাকড় বা ছত্রাকের আবাসস্থলে পরিণত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
বাঁশ গজানোর মৌসুমে (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ মাস) কখনও বাঁশ কাটা উচিত নয়। এতে কাটার সময় সদ্যজাত বাঁশের কোঁড়ল ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বাঁশ কাটার উপযুক্ত সময়। এ সময় বাঁশে সঞ্চিত খাদ্যের অর্থাৎ শর্করা জাতীয় পদার্থের পরিমাণ কম থাকে বলে কাটা বাঁশে ঘুণে ধরার সম্ভাবনা কম থাকে।
যে বছর ঝাড়ে ফুল ও বীজ হয় সে বছর ঝাড়ের বাঁশ কাটা উচিত নয়। বাঁশ ফুল হলে ঝাড়ের সব বাঁশ মরে যায়। পাকা বীজ থেকে বাঁশের চারা তৈরি করে নতুন বাঁশ বাগান করা সম্ভব। তাই বীজ সংগ্রহের পরে বাঁশ কেটে ফেলা যেতে পারে।
মূলী বাঁশের ফল/ বীজ সংগ্রহ: মূলী বাঁশ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ। প্রাকৃতিক নিয়মে মূলী বাঁশে ৪০-৫০ বছর পর পর ফুল আসে। মূলী বাঁশের ফুল ও ফল ধরা ব্যাপক এলাকা জুড়ে ৪-৫ বছর স্থায়ী হয়। ১-২ বছর ব্যাপক হারে ফল হয়। ব্যাপক হারে ফুল ও ফল হওয়ার পর মূলী বাঁশের ঝাড় সম্পূর্ণ মরে যায়। মূলী বাঁশের ফলটিই বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ফল/বীজের আকৃতি: মূলীর ফল/বীজ দেখতে অনেকটা বড় আকারের পিয়াজের মতো, উপরের দিক একটু চিকন ও লম্বা। পরিপক্ব বীজ শক্ত এবং সাধারণত হালকা বাদামি রঙের হয়। ফুল আসার বছর সমূহে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মূলী বাঁশে ফুল আসে। মে-জুন মাসে মূলী বাঁশের ফুল পরিপক্ব হয়। ফল পাকলে বাঁশটিকে হালকাভাবে নাড়া দিলে পরিপক্ব ফল মাটিতে পড়বে। ঝরে পড়া পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে। পরিপক্ব বীজ/ফল এর আয়ুষ্কাল মাত্র ১-২ সপ্তাহ। সংগৃহীত ফল/বীজ সরাসরি মাঠে রোপণ করতে হবে।
বাঁশ রোপণ পদ্ধতি:
৪-৫ ফুট দূরত্বে দাঁ বা কোদাল দিয়ে মাটিতে ৪ x ৬ ইঞ্চি মাপের গর্ত করতে হবে। ফলটি আড়াআড়িভাবে গর্তে রোপণ করে সামান্য মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
বাঁশ কোথায় রোপণ করতে হবে:
পাহাড়ি ঢাল ও উপরিভাগে মূলীর বীজ রোপণ করতে হবে। বসতবাড়ির আশে-পাশে একটু উঁচু জায়গায় এবং ছড়ার পাড়ে মূলী বাঁশের বীজ লাগাতে হবে। বর্ষার পানিতে ডুবে যায় এমন জায়গায় মূলীর বীজ রোপণ করতে হবে। অনুকূল পরিবেশে ৫-১০ দিনের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজায়।
বাঁশের বীজতলার পরিচর্যা:
বীজ রোপণের পর বৃষ্টি না হলে হালকা পানি দেওয়ার ব্যবস্থা। প্রয়োজনে রোপিত স্থানটি ঘেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
বাঁশের চারার পরিচর্যা:
মাঠে রোপিত বীজ ও কচি চারা ইঁদুর ও সজারু থেকে রক্ষা করতে হবে। কচি চারাকে গরু-ছাগল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোন জায়গায় চারা মরে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় চারা রোপণ করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ ঝাড়ে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর বাঁশ ঝাড়ের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। বীজ থেকে গজানো একটি চারা ৪-৫ বছরে একটি পূর্ণ ঝাড়ে পরিণত হয়ে থাকে।
বাঁশের মড়ক দমন ব্যবস্থা:
বাঁশের ঝাড়ে বাঁশের আগা মরা রোগ: এ রোগের জন্য দায়ী এক ধরনের ছত্রাক যা মাটিতে বাস করে। সাধারণত বরাক বা বড় বাঁশ, মাকলা বাঁশ, তল্লা বাঁশ এবং বাইজ্যা বাঁশ ঝাড়ে এ রোগ মড়ক আকারে দেখা যায়।
বাঁশের রোগের লক্ষণ:
প্রাথমিক অবস্থায় নতুন কোঁড়ল আক্রান্ত হলে কোঁড়লের আগা বাদামি-ধূসর রঙের হয়ে সব খোলস ঝড়ে পড়ে। এক সময় আগা পচে ধীরে ধীরে বাঁশটি শুকিয়ে যায়। কম বয়সি বাড়ন্ত বাঁশ আক্রান্ত হলে এর মাথায় বাদামি-ধূসর রঙের দাগ দেখা যায় এবং আক্রান্ত বাঁশের সকল খোলসপত্র ঝড়ে পড়ে। এক সময় আগা পচে ভেঙে পড়ে বা ঝুলে থাকে।
আক্রান্ত অংশের নিচের গিট থেকে অসংখ্য কঞ্চি বের হয়। পরবর্তীতে রোগ নিচের দিকে আগাতে থাকে এবং এক সময় পুরো বাঁশটি নষ্ট হয়ে যায়।
বয়স্ক বাঁশে এ রোগ দেখা দিলে আগা পচে যায়, ফলে বাঁশের মাথা ভেঙ্গে পড়ে। দূর থেকে এ ধরনের ঝাড়কে মাথাশূন্য ও আগুনে ঝলসানো বাঁশ ঝাড় বলে মনে হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পুরো বাঁশঝাড়ই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
বাঁশের রোগের বিস্তার:
রোগাক্রান্ত মুথা বা রোগাক্রান্ত বাঁশের কঞ্চিকলমের চারা ব্যবহার করলে; আক্রান্ত বাঁশ ঝাড়ের মাটি ব্যবহার করলে; ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি না দিলে; গোঁড়ায় জমে থাকা পাতা ও আবর্জনা সরিয়ে না ফেললে; বাঁশ ঝাড়ে কীট-পতঙ্গ (বিশেষ করে পিঁপড়া) বেশি থাকলে এই রোগ দ্রুত ছড়ায়।
বাঁশের রোগ প্রতিরোধ:
সকল আক্রান্ত বাঁশ ঝাড় থেকে কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বাঁশ গজানোর আগে গোঁড়ায় জমে থাকা কঞ্চি, আবর্জনা, শুকনো পাতা, আক্রান্ত বাঁশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (আগুন দেওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আশপাশের বাড়ি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়)। প্রতি বছর নতুন বাঁশ গজানোর পূর্বে চৈত্র-বৈশাখ মাসে বাঁশ ঝাড়ের গোঁড়ায় নতুন মাটি দিতে হবে। পুরানো বাঁশ ঝাড়ের মাটি ব্যবহার না করে পুকুরের তলার মাটি অথবা দূরের পলিযুক্ত মাটি ব্যবহার করতে হবে। ২০ গ্রাম ডায়থেন/ইণ্ডোফিল এম-৪৫ প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে ঝাড়ের গোঁড়ার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। ৩-৪ হাত লম্বা হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায়ই ওষুধ স্প্রে করে নতুন কোঁড়লগুলো ভিজিয়ে দিতে হবে।
ধান চাষ পদ্ধতির বিস্তারিত নিয়ে তথ্য সূত্র অপেক্ষাকৃত কম। তথ্যগুলো নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পাঠককে একাধিক সাইটে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে মেলাতে হয়। তাই আমরা চেষ্টা করেছি ধান চাষ সম্পর্কিত সকল তথ্য একটি জায়গায় নিয়ে আসতে। আশা করি আপনাদের সাহায্য করবে।
ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তাই এর সাথে দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ঘন বসতিপূর্ণ এ দেশের জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে, অপরদিকে বাড়িঘর, কলকারখানা, হাট-বাজার, সড়ক-জনপথ স্থাপন এবং নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে আবাদি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমছে। তদুপরি রয়েছে খরা, বন্যা, জোয়ার-ভাটা, লবণাক্ততা, শৈত্য প্রবাহ ও শিলাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে বেশি ধান উৎপাদন করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য ।
ধান চাষ
ধান চাষ
বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশ গুলোর মধ্যে চতুর্থ হলেও এখানকার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৪.২ টন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এ ফলন হেক্টর প্রতি ৬-৬.৫ টন। দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। সনাতন জাতের ধান এবং মান্ধাতার আমলের আবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এজন্য প্রয়োজন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন।
বাংলাদেশে ১৯৬৮ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) থেকে প্রথম উফশী জাতের ধান (আইআর ৮) মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ শুরু হয়। খাটো আকৃতির এ উফশী ধান থেকে প্রতি হেক্টরে ৫-৬ টন (বিঘাপ্রতি ১৮-২১ মণ) ফলন পাওয়া যায়। তখন থেকে উফশী ধান লোকমুখে ইরি ধান নামে পরিচিতি লাভ করে । বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগী উফশী ধানের জাত এবং ধান উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ফসল, মাটি, পানি, সার ইত্যাদি বিষয়ক কলা-কৌশল উদ্ভাবন করছে।
বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের মোট ধানি জমির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগে চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯০ ভাগ । ব্রি ধান এভাবে ইরি ধানের ̄স্থলাভিষিক্ত হয়েছে । আমাদের সৃষ্ট ওয়েব সাইটে ধানের উন্নত জাত ও এদের উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে । আমরা আশা করি এসব তথ্য প্রয়োগ করে ব্যবহারকারীগণ উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধানের চাষ করা হয়। এর মধ্যে ধানের জমি শতকরা ১১ ভাগ আউশ, ৪৮ ভাগ আমন ও ৪১ ভাগ বোরো ধান চাষ করা হয়। কিন্তু উৎপাদনের দিক থেকে বোরো শতকরা ৪৮ ভাগ, আমন ৪২ ভাগ ও আউশ ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয় সবচেয়ে বেশি এবং আউশে সবচেয়ে কম। তিন মৌসুমে ধান চাষ প্রায় একই রকম। জমি নিবার্চন আউশ ধান চাষের জন্য উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু জমি উপযোগী। মাটির বুনট পলি দোঁআশ, পলি এঁটেল ও এেঁটল হলে ভালো।
মাঝারি উঁচু ও নিচু জমিতে রোপা আমন চাষ করা যায়। তবে সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে উঁচু জমিতেও রোপা আমন ধান চাষ করা যায়। দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও এঁটেল মাটি আমন ধান চাষের জন্য উপযোগী। ভারী বুননের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধ—জলাবস্থায় উপযোগী তা বোরো ধান চাষের জন্য উত্তম। মাটিতে ৪০৬০% কর্দম কনা থাকলে ভাল হয়। সেচের ব্যবস্থা থাকলে উঁচু, মাঝারি উঁচু এবং নিচু যে কোন জমিতেই বোরো ধান চাষ করা যায়। মাটির অম্লমান ৫.০ হতে ৬.০ হলে ভাল।
মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ:
চাষাবাদের মৌসুম অনুযায়ী ধানের চাষ তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন :
১. আউশ ধান (Aus rice): খরিপ ১ মৌসুমে এ ধান মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত চাষ করা হয়।
২. আমন ধান (Aman rice): খরিপ ২ মৌসুমে জুন থেকে ডিসেম্বর মাসে পর্যন্ত চাষ করা হয়।
৩. বোরো ধান (Boro rice): রবি মৌসুমে নভেম্বর থেকে মে মাসে এ ধান চাষ করা হয়।
বাংলাদেশের মোট ধানী জমির শতকরা প্রায় ১১ ভাগ জমিতে আউশ, ৪১ ভাগ জমিতে বোরো ও ৪৮ ভাগ জমিতে আমন ধানের চাষ হয়। উৎপাদন হয় বোরোতে শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ, আমান ৪২ ভাগ ও আউশে ১০ ভাগ। বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদনশীলতা বেশি।
জলবায়ু ব্যাপক ও বি¯তৃত জলবায়ুতে ধান চাষ করা যায়। ধান চাষের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০—৩৫ক্কসে. ডিগ্রি। এর মধ্যে বীজ অংকুরোদগমের জন্য ৩০—৩৫ক্ক সেন্টিগ্রেড। অঙ্গজ বৃদ্ধির জন্য ২৫—৩১ক্কসে. পুস্পায়নের জন্য ৩০—৩৩ক্কসে. এবং পরিপক্কতার জন্য ২০—২৯ক্ক তাপমাত্রা উপযোগী। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৫—৯৫%।
মাঝারি বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক ধান চাষের জন্য প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত কম হলে সেচের মাধ্যমে পানির চাহিদা পূরণ করতে হয়। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৪০% এর কম ও ৯৫% এর বেশি হলে পুস্পায়ন ব্যহত হয়। মাটি ও ভূমি বন্ধুরতা ভারী বুনটের মাটি যার পানি ধারন ক্ষমতা বেশি এবং যে মাটি অর্ধজলাবস্থার উপযোগী তা ধান চাষের জন্য ভালো। তবে দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিও ধান চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। মাটিতে ৪০—৬০% কর্দম কনা থাকলে ভালো হয়। সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থা থাকলে যে কোন মাটিতেই ধান চাষ করা যায়। উঁচু, মাঝারি উঁচু ও নিচু সব ধরনের জমিতেই ধান চাষ করা যায়। তবে মাঝারি উঁচু জমি উত্তম। মাটির অম্লমান ৫.০—৬.০ উত্তম।
ধান চাষের জন্য জমি নির্বাচন:
ধানের ফলন সব ধরনের জমিতে ভাল হয় না । মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন সবচেয়ে ভাল হয়। মাঝারি উঁচু জমিতেও ধান চাষ করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। এঁটেল ও পলি দো-আঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।
ধানের জাত নির্বাচন:
কৃষি পরিবেশিক অবস্থা এবং রোপনের সময়ের উপর ভিত্তি করে ধানের জাত নিবার্চন করতে হয়। রোপা আউশ ধান চাষের জন্য বিআর ২৬ (শ্রাবনী) ও ব্রিধান ৪৮ এবং অপেক্ষাকৃত নিচু জমিতে ব্রিধান ২৭ নিবার্চন করতে হয়। বোনা আউশ ধান বৃষ্টিবহুল এলাকার জন্য বিআর ২১ (নিয়ামত), বিআর ২৪ (রহমত) ও ব্রিধান ২৭ এবং খরাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রিধান ৪২ এবং ব্রিধান ৪৩ নিবার্চন করতে হয়। নিচু জমির জন্য জলমগ্নতা সহনশীল জাত যেমন ব্রিধান ৫১, ব্রিধান ৫২, বৃষ্টি নির্ভর রোপা আমনের জন্য খরাসহিষ্ণু জাত যেমন ব্রিধান ৫৫; নাবী আমনের জন্য বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রিধান ৪৬; লবনাক্ততা সহনশীল জাত ব্রিধান ৪০, ব্রিধান ৪১, ব্রিধান ৫৩, ব্রিধান ৫৫; সুগন্ধি চালের জন্য বিআর ৫, ব্রিধান ৩৪, ব্রিধান ৫০ ইত্যাদি।
আগাম বোরো ধানের জাত শীতসহিষ্ণু হলে ভালো যেমন ব্রিধান ৩৬; হাওড় অঞ্চলের জন্য বিআর ১৭, বিআর ১৮, বিআর ১৯ ভালো; লবনাক্ততা সহিষ্ণুজাত যেমন ব্রি—ধান ৫৫, ব্রিধান ৬১, ব্রিধান ৬৭, বিনাধান ৮, বিনাধান ১০, বিনাধান ১১, বিনাধান ১২, বিনাধান ১৩, বিনাধান ১৪ ও বিনাধান ১৫। এছাড়া বিশেষ পুষ্টিগুন সম্পন্ন জাত যেমন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬২, ব্রিধান ৬৩, উচ্চমাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ জাত ব্রিধান ৬৬।
বাংলাদেশে তিন জাতের ধান আছে।
১। স্থানীয় জাত : টেপি, গিরবি, দুধসর, বতিশাইল ইত্যাদি।
২। স্থানীয় উন্নত জাত : হবিগঞ্জ, কটকতারা, পাজাম, কালিজিরা, হাসিকলমি, নাইজার শাইল, লতিশাইল, বিনাশাইল ইত্যাদি।
৩। উচ্চ ফলনশীল জাত : মুক্তা, ময়না, শাহজালাল, মঙ্গল, নিজামী ইত্যাদি।
ধানের স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট্য :
১. এ জাত সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকায় চাষ করা হয়।
২. ধান গাছ লম্বা হয় তাই হেলে পড়ে।
৩. পাতা লম্বাটে, হেলে পড়ে।
৪. কান্ড নরম এবং কুশির সংখ্যা কম।
৫. রোগ ও পোকা মাকড় আক্রমনের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
৬. এ জাতের ফলন কম, হেক্টর প্রতি ১.৫—২.৫ টন।
৭. জীবনকাল বেশি।
৮. মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার ক্ষমতা কম।
স্থানীয় জাতের উদাহরণ:
আউশ মৌসুমে : কটকতারা, হাসিকলমি, ধারিয়াল আমন মৌসুমে : হরিনমুদা, লাল মোটা, সাদা মোটা, কালিজিরা বোরো মৌসুমে : দুধসর, বাজাইল, হবিগঞ্জ ইত্যাদি
ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের বৈশিষ্ট্য:
নিচে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো :
১। ধান গাছ খাটো ও শক্ত হয় এবং সহজে হেলে পড়ে না।
২। ধান গাছের পাতা ঘন সবুজ ও পুরু থাকে।
৩। পাতাগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে একটি অন্যটিকে ঢেকে রাখে না। এতে আলো-বাতাস প্রতিটি পাতা সমানভাবে পায় এবং শর্করা জাতীয় খাদ্য বেশি তৈরি হয়।
৪। গাছ মাটি থেকে বেশি পরিমাণ পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
৫। জমি থেকে উৎপাদিত ধানের ওজন ও খড়ের ওজন প্রায় সমান হয় অর্থাৎ ১৪১
৬। পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ কম হয়।
৭। পাকার সময়ও কিছু কিছু ধান সবুজ থাকে।
বাংলাদেশে মোট ৮১টি উফশী জাত রয়েছে যার মধ্যে ৭৫টি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট এবং ১৬টি বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে। নিচের তালিকাতে এর জাতগুলির নাম, জন্মানোর মৌসুম, গড় জীবনকাল, গড় ফলন এবং চালের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো:
ধানের বীজ বাছাই ও চারা তৈরি:
দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে। এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে। পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে। আর অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির ওপরে ভেসে উঠবে। হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসেবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
দোআঁশ ও এেঁটল মাটি যেখানে প্রচুর আলো বাতাস আছে এমন জমি বীজতলার জন্য উপযোগী। বীজতলার জমি উর্বর হওয়া প্রয়োজন। তবে অনুর্বর জমি হলে প্রতি বর্গমিটার ২ কেজি হারে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। এর পর জমিতে ৫৬ সে.মি. পানি দিয়ে দু—তিনটি চাষ ও মই দিয়ে ৭—১০ দিন পানি বদ্ধ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। জমিতে ব্যবহৃত জৈব সার পচে গেলে পুনরায় চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। একটি আদর্শ বীজতলায় ৪টি বেড থাকবে। প্রতিটি জমির দৈর্ঘ্য বরাবর এক মিটার চওড়া বেড তৈরি করতে হবে এবং দু—বেডের মাঝে ২৫—৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রাখতে হবে।
বেডের উপরের মাটি কাঠ বা বাঁশ দিয়ে সমান করে নিতে হয়। বেডের মধ্যবতীর্ নালা সেচ ও নিস্কাশন এবং চারার পরিচযার্র জন্য ব্যবহৃত হয়।
ধানের বীজের পরিমাণ:
চারা তৈরির জন্য প্রতি কাঠা বীজতলায় ২.৫-৩.০ কেজি বীজ বুনতে হয়। এক কাঠা বীজতলার চারা দিয়ে ২০ কাঠা জমিতে ধানের চারা রোপণ করা যায়।
ধানের বীজ শোধন:
ধানের বীজে যাতে রোগজীবাণু না থাকে সেজন্য ওষুধ দ্বারা শোধন করে নিতে হয়। প্রতি কেজি ধান বীজ ৩০ গ্রাম এগ্লোসান জি এন বা ২০ গ্রাম এপ্রোসান এম ৪ ওষুধ দ্বারা শোধন করতে হয়।
বিভিন্ন ধানের বীজ
ধানের বীজ বাছাইয়ের জন্য করণীয়:
দশ লিটার পরিষ্কার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মেশাতে হবে।
এবার ১০ কেজি বীজ ঐ পানিতে দিয়ে নাড়তে হবে।
পুষ্ট বীজ ডুবে নিচে জমা হবে এবং অপুষ্ট ও হালকা বীজ পানির উপরে ভেসে উঠবে।
হাত অথবা চালনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
ভারী বীজ নিচ থেকে তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। ইউরিয়া মিশানো পানি সার হিসাবে বীজতলায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
ধানের বীজতলার ধরণ:
দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সেমি পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১মি চওড়া বেড তৈরি করতে হবে।
দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সেমি জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।
মৌসুম ভেদে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য চার ধরনের বীজতলা তৈরি করা যায়। যেমন:
১। শুকনা বীজতলা;
২। ভেজা বা কাদাময় বীজতলা
৩। ভাসমান বীজতলা:
৪। দাপোগ বীজতলা।
উঁচু ও দো-আঁশ মাটি সম্পন্ন জমিতে শুকনা বীজতলা এবং নিচু ও এঁটেল মাটি সম্পন্ন জমিতে। ভিজা বীজতলা তৈরি করা হয়। আর বন্যাকবলিত এলাকায় ভাসমান ও দাপোগ বীজতলা তৈরি করা হয়। প্রচুর আলো-বাতাস থাকে ও বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে ডুবে যাবে না এমন জমি বীজতলার জন্য নির্বাচন করতে হয়।
শুকনা বীজতলা
এখানে শুকনা ও ভিজা বীজতলা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
শুকনা বীজতলা:
জমিতে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। মাটিতে অবশ্যই রস থাকতে হবে যাতে বীজ ভালোভাবে গজাতে পারে। প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে। এর আগে জমি থেকে আগাছা বেছে ফেলতে হবে এবং পরিমাণ মতো পচা গোবর সার বা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে।
বীজতলায় রসায়নিক সার ব্যবহার না করাই উত্তম। হালকা বুনটের মাটি হলে ১১/২-২ টন জৈবসার দিলে ভালো হয়। বীজতলার মাপ- বীজতলার বেডের দৈর্ঘ্য বেডের গ্রন্থ।
= সুবিধামত লম্বা
= ১২৫ সে.মি
জমির আইল বা বেডের মাঝখানের দূরত্ব প্রতি দুই বেডের মাঝখানের দূরত্ব
২৫ সে.মি
৫০ সে. মি
এতে চারার পরিচর্যা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে সুবিধা হয়। প্রতি দুই বেডের মাঝখানের মাটি তুলে নিয়ে বেডের উপর সমান করে দিতে হয়। এতে বেড উঁচু হয়। এরপর বীজ বেডের উপর সমানভাবে ছিটিয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে নিতে হয়।
শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি
ভেজা বা কাদাময় বীজতলা:
এক্ষেত্রে জমিতে পানি দিয়ে ২-৩ টি চাষ ও মই দেয়ার পর ৬-৭ দিন ফেলে রাখতে হয়।। এতে জমির আগাছা, খড়কুটা ইত্যাদি পড়ে গিয়ে সারে পরিণত হয়। এরপর আবার ২-৩ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হয়। ভিজা বীজতলায় বীজ বাড়িতে গজিয়ে নিয়ে বুনা ভাল। এক্ষেত্রেও বীজতলার মাপ একনা বীজতলার মতোই।
শুকনা ও ভিজা মাটিতে কর্ষণ ও বীজতলা তৈরি
উর্বর দোআঁশ ও এেঁটল দোআঁশ মাটি এ বীজতলার জন্য উত্তম। জমিতে দাড়ানো পানি থাকলে ভাল তা না হলে সেচের মাধ্যমে ৫—৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২—৩ বার চাষ ও মই দিয়ে এক সপ্তাহ পানিসহ রেখে দিতে হয়। এর ফলে আগাছা ও খড় পচে যাবে। এরপর আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদাময় বীজতলা তৈরি করতে হয়। শুকনো বীজতলার মতো করেই বেড তৈরি করতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বীজতলায় কাদা বেশি না হয়। কাদা বেশি হলে বীজ ডুবে যাবে এবং বীজ ভালভাবে গজাবে না। এ রকম অবস্থা হলে বেড তৈরির ৩—৪ ঘন্টা পর বীজ বপন করতে হবে। এক্ষেত্রে জাগ দেয়া অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়।
ভাসমান বীজতলা:
আমন মৌসুমে বিশেষ অবস্থার মোকাবেলার জন্য ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। বন্যাজনিত কারনে বীজতলা করার জায়গা পাওয়া না গেলে ভাসমান বীজতলায় চারা উৎপন্ন করা যায়। বন্যাকবলিত জমি, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির উপর বাঁশের মাচা বা কলাগাছের ভেলা তৈরি করে তার উপর ২—৩ সে.মি. উঁচু কাদার প্রলেপ দিয়ে কাদাময় বীজতলার মত ভাসমান বীজতলা তৈরি করা যায়। এ বীজতলায় কাদাময় বীজতলার মতই অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। বীজতলা যাতে বন্যার পানিতে ভেসে না যায় এজন্য এটি খুটির সাথে বেঁধে রাখতে হয়।
ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয় মূলত কচুরিপানাসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি ভেলার ওপর মাটি দিয়ে। ধানের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পর এই ভাসমান বীজতলায় ছিটিয়ে দিতে হয়। সেখানে জমিতে রোপণের উপযোগী চারা উৎপাদন হতে ২০ থেকে ২৫ দিন লাগে। পরে চারাগুলো জমিতে রোপণ করা হয়।
বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ একটি দেশ। প্রায় প্রতিবছরই এখানে বন্যা হয়। তখন বন্যার কারণে অনেক এলাকার বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া ঝড়, অতিবৃষ্টি এবং জোয়ারের পানিতেও বহু বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এতে করে যথাসময়ে ফসল উৎপাদনে বিলম্ব হয়। দেখা দেয় ফসলের ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রান্তিক কৃষকেরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ভাসমান বীজতলা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
১০ মিটারের একটি ভাসমান বীজতলায় এক কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছিটানো সম্ভব। এ থেকে উৎপাদিত চারা এক বিঘা জমিতে রোপণ করা সম্ভব। পানির ওপর ভেসে থাকার কারণে এই বীজতলায় পানি সেচেরও দরকার হয় না। দেশের অনেক জেলায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করে ধানের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এ বীজতলায় ধানের চারা উৎপাদন ছাড়াও পেঁপে, লাউ, কুমড়া, বেগুন, করলাসহ বিভিন্ন সবজির চারাও উৎপাদন সম্ভব। দেশের অনেক কৃষক ভাসমান বীজতলায় সবজির চারা উৎপাদন করে লাভবান হয়েছেন।
ভাসমান বীজতলা
ডাপোগ বা দাপোগ বীজতলা :
বন্যাকবলিত এলাকায় চারা উৎপাদনের আরেকটি কৌশল হলো ডাপোগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পাকা অথবা কাঁচা বারান্দা, করিডোর, বাড়ির উঠান অথবা যে কোন শুকনো জায়গায় ডাপোগ বীজতলা তৈরি করা যায়। এ পদ্ধতিতে নিধার্রিত স্থানে চারিদিকে মাটি, ইট, কাঠ বা কলাগাছের বাকল দিয়ে ঘিরে নিতে হবে। তারপর কলাপাতা বা পলিথিন বিছিয়ে তার উপর ঘন করে অংকুরিত বীজ বপন করতে হয়। বীজে সঞ্চিত খাদ্যই চারার প্রাথমিক খাবার। তাই এই চারার বয়স ১৫—১৮ দিন হলেই রোপন করতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থাকে না তাই ৫—৬ ঘন্টা পর পর পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পানি জমে না থাকে।
বাড়ির উঠান বা যে কোনো শুকনো জায়গায় অথবা কাদাময় সমতল জমিতে পলিথিন, কাঠ অথবা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে তার মধ্যে অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থেকে চারাগাছ কোনোরূপ খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে বীজতলায় প্রয়োজন মাফিক পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি অঙ্কুরিত বীজ দিতে হয়। এভাবে প্রস্তুতকৃত ২ থেকে ৩ বর্গমিটার দাপোগ বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা দিয়ে এক বিঘা জমি রোপণ করা যায়। দাপোগ বীজতলার প্রস্থ প্রায় ১.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রয়োজনমতো নিতে হবে।
এভাবে করা বীজতলা থেকে ১৪ থেকে ১৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে। চারার বয়স বাড়ার সাথে সাথে চারার গুণগতমান নষ্ট হতে থাকে। চারার বয়স কম থাকে বলে অনেক সময় চারার মৃত্যুহার কিছুটা বেশি থাকে। সেজন্য চারা রোপণের সময় প্রতি গোছায় ৪ থেকে ৫টি চারা দিলে এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা যায়। দাপোগের চারার উচ্চতা কম থাকে বলে জমিতে লাগানোর সময় এমন পরিমাণ পানি রাখতে হবে যাতে করে চারা পানির নিচে ডুবে না যায়। এক্ষেত্রে রোপিত চারার সব পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা অন্যসব চারার মতোই হবে। দাপোগ পদ্ধতিতে লাগানো চারা পরবর্তীতে অন্যান্য স্বাভাবিক চারার মতোই ফলন দেয়।
দাপোগ বীজতলা
ধানের বীজ শোধন ও জাগ দেওয়ার পদ্ধতি:
বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২-৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবাণুমুক্ত হয়। বীজ যদি দাগমুক্ত হয় এবং বাকানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকে তাহলে কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা যায়। ক্ষেতে ২-৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে ১ কেজি পরিমাণ বীজ পানিতে ডুবিয়ে নাড়াচাড়া করে ১২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর বীজ পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে।
এভাবে শোধনকৃত বীজ বাঁশের টুকরি বা ড্রামে ২/৩ পরত শুকনো খর বিছিয়ে তার উপর বীজের ব্যাগ রাখুন এবং আরও ২/৩ পরত শুকনো খর দিয়ে ভালভাবে চেপে তার উপর ইট বা কোন ভারী জিনিস দিয়ে চাপ দিয়ে রাখুন। এভাবে জাগ দিলে আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘণ্টা, বোরো মৌসুমে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভাল বীজের অঙ্কুর বের হবে এবং বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হবে।
ধানের বীজ শোধন
আদর্শ বীজতলা তৈরির নিয়ম:
দো-আঁশ ও এটেল মাটি বীজতলার জন্য ভাল। জমি অনুর্বর হলে প্রতি বর্গমিটারে ২ কেজি হারে জৈব সার মেশানো যেতে পারে। এরপর জমিতে ৫-৬ সে.মি. পানি দিয়ে ২/৩টি চাষ ও মই দিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিতে হবে। আগাছা ও খড় ইত্যাদি পচে গেলে আবার চাষ ও মই দিয়ে কাদা করে জমি তৈরি করতে হবে। এবার জমির দৈর্ঘ্য বরাবর ১ মি. চওড়া বেড তৈরি করতে হবে। দু’বেডের মাঝে ২৫-৩০ সে.মি. জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে। নির্ধারিত জমির দু’পাশের মাটি দিয়ে বেড তৈরি করতে হবে। এরপর ওপরের মাটি ভালভাবে সমান করে ৩/৪ ঘণ্টা পর বীজ বোনা উচিত।
বীজতলায় বীজ বপনের আদর্শ পদ্ধতি:
প্রতি বর্গমিটার বেডে ৮০-১০০ গ্রাম বীজ বোনা দরকার। বপনের সময় থেকে ৪/৫ দিন পাহারা দিয়ে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং নালা ভর্তি পানি রাখতে হবে।
বীজতলায় বীজ বপনের সময় রোপা পদ্ধতিতে আউশ ধান চাষের জন্য এপ্রিল মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। চারার বয়স ২০—২৫ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করতে হয়। বোনা আউশ ধানের বীজ মধ্য মার্চ থেকে মে এর প্রথম সপ্তাহে জমিতে বপন করতে হয়। রোপা আউশ চাষের জন্য বীজতলায় মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয়। রোপা আমন ধান ১৫ই জুলাই হতে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত মুল জমিতে রোপন করা হয়। কাজেই রোপন সময়ের একমাস আগে বীজতলায় বীজ বুনতে হবে যেন রোপনের সময় চারার বয়স ২৫—৩০ দিন হয়।
বোরো ধানের ক্ষেত্রে নভেম্বর—ডিসেম্বর মাসে বীজতলায় বীজ ফেলতে হয় এবং চারার বয়স ৪০—৪৫ দিন হরে রোপন করতে হয়। বীজের পরিমান বীজের পরিমান নির্ভর করে বপন অথবা রোপন দূরত্ব, বীজের আকার ও আয়তন ইত্যাদির উপর। সারিতে বপনের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ সে.মি. হলে বীজ প্রয়োজন ৫০—৬০ কেজি/হেক্টর। ডিবলিং পদ্ধতিতে বপনের ক্ষেত্রে ২৫ সে.মি. দূরে দূরে সারি ও ২০ সে.মি. দূরে দূরে বীজ বপন করলে বীজের প্রয়োজন হয় ৩০—৩৫ কেজি/হেক্টর।
রোপা আউশের জন্য বীজতলায় চারা তৈরিতে বীজের প্রয়োজন ২০—৩০ কেজি/হেক্টর। বীজ বাছাই ভালো ফলনের জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালো বীজ। বপনের জন্য সুস্থ ও পুষ্ট বীজ নিবার্চন করতে হবে। এজন্য দশ লিটার পানিতে ৩৭৫ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশিয়ে নিয়ে এ দ্রবনে ১০ কেজি বীজ ছেড়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিয়ে পুষ্ট বীজ নীচে জমা হবে।
অপুষ্ট হাল্কা বীজ ভেসে উঠবে। ভারীগুলো ভালোভাবে পরিস্কার পানিতে ৩—৪ বার ধুয়ে নিতে হবে। বীজ শোধন ও জাগ দেওয়া বাছাইকৃত বীজ দাগমুক্ত ও পরিপুষ্ট হলে সাধারণভাবে শোধন না করলেও চলে। তবে শোধনের জন্য ৫২—৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট বীজ ডুবিয়ে রাখলে জীবানুমুক্ত হয়। বীজ শোধনের জন্য ২—৩ গ্রাম ছত্রাকনাশক ১ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে এক কেজি পরিমান বীজ ডুবিয়ে ১২ ঘন্টা রেখে দিতে হয়।
এরপর বীজ পরিস্কার পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হয়। আউশ ও আমন মৌসুমের জন্য ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিন ও বোরো মৌসুমে ৭২ ঘন্টা বা তিন দিনের বীজের অংকুর বের হয় এবং তা বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হয়। বীজতলায় বীজ বপন শুকনো বীজতলার জন্য প্রতি বর্গমিটার ১৫০ গ্রাম শুকনো বীজ বুনতে হয়। বীজ ছিটিয়ে বোনার পর বীজগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। ভেজা বীজতলায় প্রতি বর্গমিটার ৮০—১০০ গ্রাম হারে বীজ বপন করতে হয়। এক বর্গমিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২০—৩০ বর্গমিটার রোপন করা যায়। তবে ডাপোগ বীজতলায় ঘন করে বীজ বুনতে হয় প্রতি বর্গমিটারে ২.৫৩.০ কেজি বীজ।
শুকনো বীজতলায় শুকনো বীজ বুনতে হয়। কিন্তু অন্যগুলিতে অংকুরিত বীজ বুনতে হয়। এজন্য বীজ জাগ দেয়ার প্রয়োজন হয়। ভেজা বীজতলায় বীজ বপনের পর ৪—৫ দিন পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হয়। বীজতলার পরিচযার্ বীজতলায় নিয়মিত সেচ প্রদান করতে হবে এবং আগাছা দমন করতে হবে। চারা হলদে হলে প্রতি বর্গমিটার ৭ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের পরও চারা সবুজ না হলে সালফারের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম হারে জিপসাম সার ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়া বীজতলায় পোকামাকড় ও রোগবালাই এর উপদ্রব হলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
জমি তৈরিজমির জো অবস্থা থাকলে মার্চ—এপ্রিল মাসে আউশ ধানের বীজ বপন করা যায়। জমিতে প্রয়োজনমত পানি দিয়ে ২—৩টি চাষ ও মই দিয়ে জমি কাদাময় করতে হয়। আউশ ধানে আগাছার প্রকোপ বেশি হয় বলে প্রথম চাষের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচে যাবে। রোপা আউশের জন্য মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি বা সেচের পানির সহায়তায় কর্দমাক্ত করে জমি প্রস্তুত করতে হয়।
রোপা আমনের জন্য মধ্য জুন থেকে মধ্য আগস্ট এ সময়ের মধ্যে বৃষ্টি বা সেচের পানির সাহায্যে জমি প্রস্তুত করা হয়। বোরো ধানের জন্য মধ্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারী এ সময়ের মধ্যে সেচের পানির সাহায্যে থকথকে কর্দমাক্ত করে জমি তৈরি করতে হয়। জমি তৈরির সময় জমির উপরিভাগ ভালভাবে সমতল করতে হয় যাতে সেচের পানি সব জায়গায় পৌছে।
অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় ধানের বীজতলার যত্ন:
শৈত্য প্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে দিলে, বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিলে, প্রতিদিন সকালে চারার ওপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিলে ধানের চারা ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়।
ধানের বীজতলার সাধারণ পরিচর্যা:
বীজতলায় সব সময় নালা ভর্তি পানি রাখা উচিত। বীজ গজানোর ৪-৫ দিন পর বেডের ওপর ২-৩ সে.মি. পানি রাখলে আগাছা ও পাখির আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চাৱা উঠানো ও সংরক্ষণ:
জাত ও মৌসুম ভেদে ২৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা ভালো। চারা তোলার পূর্বে বীজতলাতে পানি সেচ দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নেয়া ভালো। এতে চারা তুলতে সুবিধা হয়। চারা তোলার সময় যাতে গোড়া বা কাজ ভেজে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চারা তোলার পর তা ছোট ছোট আঁটি আকারে বেঁধে নিতে হয়।
বীজতলা থেকে চারা তোলার পর পর মূল জমিতে লাগানো সম্ভব না হলে চারার আঁটি ছায়ার মধ্যে ছিপছিপে পানিতে রেখে দিতে হয়।
ধানের চারা উঠানোর সময় বা বহন করার সময় সতর্কতা:
বীজতলায় বেশি করে পানি দিয়ে বেডের মাটি নরম করে নিতে হবে যাতে চারা উঠানোর সময় শেকড় বা কাণ্ড মুচড়ে বা ভেঙে না যায়। বস্তাবন্দী করে ধানের চারা কোনক্রমেই বহন করা উচিত নয়।
ধান রোপণ
ধানের চারা রোপণ:
রোপণের জন্য জমি তৈরি:
মাটির প্রকারভেদে ৩-৫ বার চাষ ও মই দিলেই জমি তৈরি হয়ে মাটি থকথকে কাদাময় হয়। জমি উঁচুনিচু থাকলে মই ও কোদাল দিয়ে সমান করে নিতে হবে।
রোপা আউশ ও আমনের চারা ২০—২৫ দিন বয়সে লাগাতে হয়। কিন্তু বোরোর ক্ষেত্রে একটু বেশি বয়সের ৪০—৪৫ দিনের চারা রোপন করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০—২৫ সে.মি ও গুছি থেকে গুছির দূরত্ব ১৫—২০ সে.মি। চারা মাটির ২—৩ সে.মি. গভীরে রোপন করতে হয়। এর চেয়ে বেশি গভীরতা হলে গাছে কুশি উৎপাদন কমে যায়। সারি করে চারা লাগালে নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহার করা সহজ হয়।
চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি:
আউশে ২০-২৫ দিনের, রোপা আমনে ২৫-৩০ দিনের এবং বোরোতে ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করা উচিত। এক হেক্টর জমিতে ৮-১০ কেজি বীজের চারা লাগে। প্রতি গুছিতে ১টি সতেজ চারা রোপণ করাই যথেষ্ট। তবে চারার বয়স একটু বেশি হলে প্রতি গুছিতে ২-৩টি চারা রোপণ করা যেতে পারে। সারিতে চারা রোপণ করার সময় সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং প্রতি গুছির দূরত্ব ১৫-২০ সে.মি. হওয়াই উত্তম।
সমান জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা অবস্থায় চারা রোপণ করতে হয়। লম্বা রশির সাহায্যে সোজা সারি করে চারা রোপণ করা উত্তম। এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২০-২৫ সে.মি. এবং সারিতে গুছি থেকে জহির দূরত্ব হবে ১৫-২০ সে.মি.। প্রতিটি হিতে ২-৩টি চারা দিতে হয়। দেরিতে রোপণ করলে চারার সংখ্যা বেশি ও ঘন করে লাগাতে হয়।
ধান চাষে দ্বি-রোপণ পদ্ধতি:
জলাবদ্ধতা পূর্ববর্তী ফসলের কর্তন বিলম্বিত হলে বা অন্য কোন কারণে যদি রোপণের জন্য নির্ধারিত জমিতে রোপণ বিলম্বিত হয় তবে বেশি বয়সের চারা ব্যবহারের পরিবর্তে দ্বি-রোপণ পদ্ধতিতে ধান রোপণ একটি ভাল প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে ধানের চারা বীজতলা হতে উত্তোলন করে অন্য জমিতে ঘন করে ১০-১০ সে.মি. দূরত্বে সাময়িকভাবে রোপণ করা হয়, আমন মৌসুমে ২৫-৩০ দিন পর এবং বোরো মৌসুমে ৩০-৪০ দিন পর আবার উত্তোলন করে মূল জমিতে ২০-২০ সে.মি. দূরত্বে দ্বি-রোপণ করা হয়।
ধান চাষে সার ব্যবস্থাপনা
সারের মাত্রা আবহাওয়া, মাটি, ধানের জাত, জীবনকাল, ফলন দেয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ভালো ফলনের জন্য সময়মত ও পরিমানমত সার প্রয়োগ করতে হয়। নিচে মৌসুম ভেদে ধানের বিভিন্ন জাতের সারের পরিমান দেয়া হলো:
জমির উর্বরতার উপর ভিত্তি করে সারের মাত্রা নির্ধারন করা হয়। এছাড়া জমিতে গোবর বা আর্বজনা পচা সার হেক্টর প্রতি ৮—১০ টন ব্যবহার করা হলে রাসায়নিক সারের মাত্রা প্রায় অর্ধেক নামিয়ে আনা সম্ভব। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সব সার জমি তৈরির সময় শেষে চাষের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়। গাছের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয় বলে ইউরিয়া সার ধাপে ধাপে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সারকে সমান তিনভাগে ভাগ করে চারা রোপনের ১০—১৫, ৩০—৩৫ ও ৪৫—৫০ দিন পর জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় নিম্নের বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে :
১ / সার দেয়ার সময় জমিতে ছিপছিপে পানি থাকা প্রয়োজন, শুকনো জমিতে অথবা অতিরিক্ত পানি থাকলে সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়।
২/ সারের উপরি প্রয়োগের পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করলে অথবা হাত দিয়ে মিশিয়ে দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।
৩/ শেষ কিস্তির সার ধানের কাইচথোড় আসার ৫—৭ দিন আগে প্রয়োগ করা উচিত।
৪/ ইউরিয়া সারের প্রভাব পরবতীর্ ফসলে থাকে না বলে প্রত্যেক ফসলেই মাত্রানুযায়ী ইউরিয়া ব্যবহার করতে হবে।
৫/ ইউরিয়া প্রয়োগের পরও ধান গাছ যদি হলদে দেখায় তবে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ভালো ফলন পেতে চাইলে অবশ্যই জমিতে সার দিতে হবে। এছাড়া উচ্চফলনশীল ধানের জাত মাটি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যের উপাদান গ্রহন করে বিধায় সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। গোবর বা আবর্জনা পচা জাতীয় জৈব সার জমি তৈরির সময় মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।।
ইউরিয়া ব্যতীত সকল রাসায়নিক সার যেমন- টিএসপি, এমপি, জিপসাম, না প্রভৃতি। জমিতে শেষ চাষ দেয়ার আগে প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সার চারা রোপণ করার পর ও কিস্তিতে ছিটিয়ে প্রযোগ করতে হয়। এবার দেখা যাক শতক প্রতি সারের পরিমাণ কি?
জাত ও মৌসুম ছাড়া সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে মারও কিছু কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। যেমন:
১। পাহাড়ের পানভূমির মাটি ও লাল বেলে মাটিতে এমপি সার নেতৃতণ দিতে হয়।
২। গঙ্গাবাহিত পলিমাটি ও সেচ প্রকল্প এলাকার মাটিতে লক্ষা সার বেশি পরিমাণে নিতে হয়।
৩। হাওড় এলাকার মাটিতে সার কম পরিমাণে দিতে হয়।
৪। স্থানীয় জাতের ধানে সারের পরিমাণ অর্ধেক দিলেই চলে।
৫। পূর্ববর্তী ফসলে প্রতিটি সার সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ হয়ে থাকলে উপস্থিত ফসলে প্রতিটি সারের অর্ধেক পরিমাণ ব্যবহার করলেই চলে।
৬। পূর্ববর্তী ফসলে দস্তা সার ব্যবহার হয়ে থাকলে পরবর্তী ২টি ফসলে আর এ সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
৭। বেলে মাটিতে এম পি সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়।
৮। কোন জমিতে সবুজ সার ফসলের চাষ হলে পরবর্তী ফসলে ইউরিয়া সার ৪০-৫০% কমিয়ে ব্যবহার করলেও চলে।
ধান চাষে সার প্রয়োগে
ধান চাষে সার প্রয়োগের নিয়মাবলী:
ধান গাছের বাড়-বাড়তির বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন মাত্রায় নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। প্রথম দিকের কুশি গজানোর সময় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে তা থেকে গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ কুশি উৎপাদন থেকে কাইচথোর আসা অবধি গাছ প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন পেলে প্রতি ছড়ায় পুষ্ট ধানের সংখ্যা বাড়ে। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার যেমন টিএসপি, মিউরেট অব পটাশ, জিপসাম, জিংক সালফেট মাত্রানুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে ছিটিয়ে প্রয়োগ করে চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে।
তবে বেলে মাটিতে পটাশ সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। তিন ভাগের দুই ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষের সময় এবং এক-তৃতীয়াংশ কাইচথোড় আসার ৫-৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার ব্যবহার করা সম্ভব হলে তা প্রথম চাষের সময়ই জমিতে সমভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। জৈব সার খরিফ মৌসুমে ব্যবহার করাই শ্রেয়।
ধানে গন্ধক ও দস্তা সার প্রয়োগের সময়:
ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার পরও ধান গাছ যদি হলদে থাকে এবং বাড়-বাড়তি কম হয় তাহলে গন্ধকের অভাব হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ হিসাবে জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে। অত:পর বিঘা প্রতি ৮ কেজি জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
দস্তা সার
ইউরিয়া সার ব্যবস্থাপনায় এলসিসি ব্যবহার:
লিফ কালার চার্ট বা এলসিসি প্লাস্টিকের তৈরি চার রং-বিশিষ্ট একটি স্কেল। এলসিসি পদ্ধতি অবলম্বন করলে ধান গাছের চাহিদানুযায়ী ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যায়। ফলে ইউরিয়া সারের খরচ কমানো ও অপচয় রোধ করা যায় এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, এলসিসি ব্যবহারে শতকরা ২০-২৫ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় করা যায়।
ইউরিয়া সার
গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের বিভিন্ন দিক:
গুটি ইউরিয়া হল, ইউরিয়া সার দিয়ে তৈরি বড় আকারের গুটি যা দেখতে ন্যাপথালিন ট্যাবলেটের মত। গুটি ইউরিয়া ব্যবহারে সারের কার্যকারিতা শতকরা ২০-২৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইউরিয়া সার পরিমাণে কম লাগে। আবার গুটি ইউরিয়া জমিতে একবারই প্রয়োগ করতে হয়।
এরপর সব সময় গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী নাইট্রোজেন সরবরাহ থাকায় গাছের কোন সুপ্ত ক্ষুধা থাকে না। গুটি ইউরিয়া প্রয়োগের পূর্ব শর্ত হল, ধান রোপণ করতে হবে সারিবদ্ধভাবে। সারি থেকে সারি এবং গোছা থকে গোছার দূরত্ব হবে ২০ সে.মি.। বোরো মৌসুমে চারা রোপণের ১০-১৫ দিন এবং আউশ ও আমন মৌসুমে চারা রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রতি ৪ গোছার মাঝখানে ৩-৪ ইঞ্চি কাদার গভীরে গুটি পুঁতে দিতে হবে।
গুটি ইউরিয়া
অঞ্চল-ভিত্তিক পরিমিত সার প্রয়োগ:
কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-ভিত্তিক (৩০টি) থানা নির্দেশিকায় উল্লেখিত নিয়মানুযায়ী সার-এর পরিমাণ ও নির্দেশনা অনুযায়ী সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
ধান চাষে আগাছা ব্যবস্থাপনা:
আগাছা ফসলের একটি মারাত্মক শত্রু। আগাছা ফসলের ক্ষেতে অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ যেমন শ্যামা, ছেঁচড়া, হলদে মুথা ইত্যাদি। যে উদ্ভিদ ভুল জায়গায় জন্মেছে যেমন ধান ক্ষেতে পাট গাছ। আগাছা ধান গাছের আলো, পানি ও খাদ্য উপাদানের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং ফসলের ক্ষতি করে।
ধান ক্ষেতে আগাছা
আগাছার প্রকার:
জীবনকালের ভিত্তিতে: বর্ষজীবী (শ্যামা, বথুয়া), দ্বি-বর্ষজীবী (বন্য গাজর) এবং বহুবর্ষজীবী (দূর্বা, ভেদাইল)। পাতা ও কাণ্ডের আকৃতির ভিত্তিতে: ঘাস-জাতীয় (শ্যামা, ক্ষুদে শ্যামা, দূর্বা, আরাইল, গৈচা, ফুলকা ঘাস, মনা ঘাস, ঝরা ধান), সেজ(Sedge)(হলদে মুথা, বড় চুচা, ছেঁচড়া, জয়না, পানি সেজ) ও চওড়া পাতা-জাতীয় (পানি কচু, শুষনি শাক, ঝিল মরিচ, পানি লং, পানি ডোগা, চাঁদমালা, হেলেঞ্চা, ঘেঁচু, বড় পানা, ক্ষুদে পানা ও কচুরি পানা)।
আগাছা দমনের পদ্ধতিসমুহ:
(ক)হাত বাছাই
(খ)রাইচ উইডার ও
(গ)আগাছানাশক-এর যে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে আগাছা দমন করা যায়। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মীদের সাথে পরামর্শক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আগাছানাশক ব্যবহারে সতর্কতা:
(ক)সঠিক আগাছানাশক নির্বাচন,
(খ)সঠিক মাত্রায় আগাছানাশক প্রয়োগ,
(গ)সঠিক সময়ে আগাছানাশক প্রয়োগ,
(ঘ)সঠিক প্রয়োগ পদ্ধতির অনুসরণ,
(ঙ)সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অনুসরণ,
(চ)আগাছা-নাশকের বোতলে সঠিক নির্দেশনা পালন এবং
(ছ)স্থানীয় কৃষি কর্মীদের পরামর্শ মেনে চলা।
আগাছা-নাশক ব্যবহারের সঠিক সময়:
(ক)আগাছা-নাশকের কার্যকারিতা পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।
(খ)প্রয়োগের সময়-ভিত্তিক আগাছা-নাশক ভিন্ন ভিন্ন:
(১) “গজানোর পূর্বে” (Pre-emergence), আগাছা গজানোর পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে,
(২) “গজানোর পরে” (Post-emergence), আগাছা জন্মানোর পর প্রয়োগ করতে হবে,
(৩) “গজানোর পর পর” (Early post-emergence, আগাছা জন্মানোর পর পরই প্রয়োগ করতে হবে এবং
(৪) সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকৃত আগাছা-নাশকের বোতল/প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশাবলী ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সর্বদা মেনে চলতে হবে।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন ক্যানালের মাধ্যমে সেচ
ধান চাষে সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
ধান চাষে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার:
ধান চাষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধানের জমিতে সব সময় দাঁড়ানো পানি রাখার প্রয়োজন নেই। ধানের চারা রোপণের পর জমিতে ১০-১২ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখতে হবে যাতে রোপণ-কৃত চারায় সহজে নতুন শিকড় গজাতে পারে। এরপর কম পানি রাখলেও চলবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ধানগাছ যেন খরা কবলিত না হয়।
রোপা ধানে সবসময় দাড়ানো পানি রাখার দরকার নেই। চারা রোপনের পর ৬—৭ সে.মি. পানি রাখতে হবে। চারা রোপনের ৬—৭ দিন পর্যন্ত ৩—৫ সে.মি. সেচ দিলে আগাছা দমন হয়। কুশি উৎপাদন পর্যায়ে ২—৩ সে.মি. এবং থোর আসার সময় ৭—১০ সে.মি. সেচ দেয়া উত্তম। দানা পুষ্ট হওয়া শুরু হলে আর সেচ দিতে হয় না।
রোপা আমন সাধারণত বৃষ্টি নির্ভর। আমন মৌসুমে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বৃষ্টির পানি যেন সরাসরি জমির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে না পারে এজন্য উচু আইল তৈরি করে দিতে হয়। কারণ বৃষ্টির পানি জমির পুষ্টি উপাদান ধুয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বৃষ্টির সময় কাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখা যায় রোপনের সময় বৃষ্টির পানির অভাবে জমি তৈরি করা যায় না অথবা অতি বৃষ্টির জন্য জমিতে অনেক দাড়ানো পানি থাকে যার জন্য চারা রোপন করা যায় না। বর্তমানে রোপা আমনে সম্পূরক সেচ বিশেষ করে শীষ উদগম থেকে দানা পুষ্ট হওয়া পর্যন্ত সময়ে প্রয়োগ করে ফসল ফলানো হয়। এতে ফলন বেড়ে যায়।
মাঠ পর্যায়ে কৃষক বোরো ধান চাষে ২৫—৩০ বার সেচ প্রদান করে যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত। বোরো ধান চাষে একবার ৫—৭ সে.মি. পানি দেয়ার পর জমিতে দাড়ানো পানি শেষ হওয়ার তিন দিন পর পুনরায় সেচ দিলে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পানি কম লাগে। বোরো চাষে পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে (অডউ) সেচ দিলে গাছে মূলের বৃদ্ধি ভালো হয় ও সেচ খরচ ও কমানো যায়।
আগাছা দমন সাধারণত বোরো ও রোপা আমনের চেয়ে আউশ মৌসুমে বিশেষ করে বোনা আউশে আগাছার উপদ্রব বেশি হয়। এজন্য আউশ মৌসুমে প্রথম বৃষ্টিপাতের পর জমিতে দু—একটি চাষ দিয়ে পতিত রাখলে আগাছার বীজ গজিয়ে উঠে। কিছুদিন পর পুনরায় মই দিয়ে ধান বপন করলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। রোপা জমিতে ৫—১০ সে.মি. পানি রাখলে জমিতে আগাছা কম হয়। বোরো ধানে দাড়ানো পানি থাকে বলে আগাছার উপদ্রব কম হয়। তারপরও আগাছা হলে আগাছা পরিস্কার করতে হয়। আগাছা পরিস্কারের সময় হাত দিয়ে মাটি নেড়ে দিলে বাতাস চলাচলের সুযোগ পায় যা গাছের মূলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
জমিতে দাড়ানো পানি না থাকলে আগাছার প্রকোপ বেড়ে যায়। সারিতে রোপনকৃত রোপা আমনে জাপানি রাইস উইডার দিয়ে আগাছা দমন করা যায়। আগাছানাশক প্রয়োগ করেও আগাছা দমন করা যায়। ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ ধানের শিষের শতকরা ৮০—৯০ ভাগ অংশের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে এবং ধানের রং সোনালি হলে ধান কাটতে হয়।
ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য ধান পরিপক্ক হবার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব ধান কাটতে হবে। এরপর মাড়াই করে খড়কুটা বেছে পরিস্কার করে ধান পরপর ৪—৫ দিন শুকাতে হবে। শুকানোর সময় ধানের আর্দ্রতা ১২% এ চলে আসলে চিটা, আবর্জনা, ভাঙ্গা ধান, ধুলাবালি পরিস্কার করে নিতে হবে। এরপর ধান ছায়ায় ঠান্ডা করে ড্রামে, মটকায়, পলিকোটেড বায়ুরোধক পাত্রে রাখতে হবে।
ফলন মৌসুম ভেদে ধানের ফলন ভিন্ন হয়। বোরো মৌসুমে ধানের ফলন সবচেয়ে বেশি ও আউশ মৌসুমে সবচেয়ে কম। উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরোতে গড়ে হেক্টর প্রতি ৫—৬ টন, রোপা আমনে ৪—৫ টন এবং আউশে ৩—৪ টন।
বৃষ্টি-নির্ভর রোপা আমন এলাকায় জমির আইল ১৫ সে.মি. উঁচু রাখলে অনেকাংশে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায় যা খরা থেকে ফসলকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এরপরও যদি ধান ফসল খরা কবলিত হয় তাহলে প্রয়োজন মাফিক সম্পূরক সেচ দিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, খরা কবলিত ধানের চেয়ে সম্পূরক সেচযুক্ত ধানের ফলন হেক্টরে প্রায় ১ টন বেশি হয়।
ধান চাষে সেচ
সেচের পানির অপচয় রোধ:
বোরো মৌসুমে ধানের জমিতে সাধারণত মাটির নালা দিয়ে সেচ দেয়া হয়। ফলে ফসলের জমি ও সেচের পানি উভয়েরই অপচয় হয়। এ অপচয় রোধকল্পে পিভিসি অথবা প্লাস্টিক পাইপ ব্যবহার করে পানির অপব্যবহার ও অপচয় রোধ করা যায়। এ পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কমানোর সাথে সেচের খরচও কমানো যায়। গভীর/অগভীর নলকূপ থেকে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সেচ দিলে একই পরিমাণ পানি দিয়ে কাঁচা নালার তুলনায় শতকরা প্রায় ৪০-৪২ ভাগ বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব। বোরো মৌসুমে ধান আবাদে পানি সাশ্রয়ী আর একটি পদ্ধতির নাম অলটারনেট ওয়েটিং এন্ড ড্রাইং (AWD)।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যায়ক্রমে ভিজানো ও শুকানো পদ্ধতিতে সেচ চলবে জাত ভেদে ৪০-৫০ দিন পর্যন্ত। যখনই গাছে থোড় দেখা দেবে তখন থেকে দানা শক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষেতে স্বাভাবিক ২-৫ সে.মি. পানি রাখতে হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সেচের পানি, জ্বালানি ও সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদন খরচও হ্রাস পায়।
সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে জমিতে সেচ
ধান চাষে অনিষ্টকারী পোকা ও মেরুদন্ডী প্রাণী ব্যবস্থাপনা:
ধান ফসলে বিভিন্ন ধরনের পোকার আক্রমণ দেখা যায়। যেমন- সবুজ পাতা ফড়িং, মাজরা পোকা, পামরী পোকা, গান্ধী পোকা, গল মাছি, শীষ কাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। জমিতে গাছের ডাল বা বাশের কঞ্চি পুঁতে দিলে সেখানে পাখি বসে এবং পোকা ধরে খায়। তাছাড়া প্রতিরোধী ফসলের জাত ও বিভিন্ন দমন পদ্ধতি দ্বারা পোকা দমন করা যায়। তবে দ্রুত দর্শনের ক্ষেত্রে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে একটি তালিকা দেয়া হলো ।
রোগ দমন ধান ফসলে বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। যেমন- কান্ড পচা রোগ, টুংরো রোগ, বাদামী দাগ রোগ, উফরা রোগ, ট্রাস্ট রোগ ইত্যাদি। এসব রোগ সঠিক সময়ে দমন করতে না পারলে ফলন যথেষ্ট কমে যায়। বীজ শোষন, আগাছা দমন ও সুষম সার প্রয়োগে বিভিন্ন রোগ দমন হয়। এছাড়া প্রতিরোধী জাত যেমন- মালা ও গাজী জাতের ধানে বাদামী দাগ রোগ কম হয়। বিভিন্ন রোগনাশক যেমন- কুপ্রাভিট ৫০, হিমোসান ৫০ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ও রোগ দমন করা যায়।
ধানের রোগ ব্যবস্থাপনা:
নিবিড় চাষাবাদের কারণে ধান ফসলে বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন রোগ-বালাই ধানের ক্ষতি করে এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এজন্য রোগ শনাক্ত করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
ধানের টুংরো রোগ:
ভাইরাসজনিত রোগ। সবুজ পাতাফড়িং এ রোগের বাহক। চারা অবস্থা থেকে গাছে ফুল ফোটা পর্যন্ত সময়ে এ রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের ক্ষেতে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গাছের পাতা হলুদ বা কমলা রঙ ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সালফার বা নাইট্রোজেন সারের ঘাটতিজনিত কারণে এবং ঠাণ্ডার প্রকোপে এরূপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্ত জমির ধান বিক্ষিপ্তভাবে না হয়ে সমভাবে হলুদাভ বা কমলা রঙ ধারণ করে। গাছের বাড়-বাড়তি ও কুশি কমে যায় ফলে আক্রান্ত গাছ সুস্থ গাছের তুলনায় খাটো হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগের প্রাথমিক অবস্থায় রোগাক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। আগাম বীজতলায় বিশেষ করে আমন ধান কাটার সময়, বোরোর বীজতলায় সবুজ পাতাফড়িং দেখা গেলে হাতজাল বা কীটনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা নিন।
নিবিড় ধান চাষ এলাকায় ভলান্টিয়ার রাইস/রেটুন ধান তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন অথবা জমিতে চাষ দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিন। আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে বাহক পোকা সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলুন। সবুজ পাতাফড়িং দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া:
চারা রোপণের ১৫-২০ দিনের মধ্যে এবং বয়স্ক ধান গাছে এ রোগ দেখা যায়। আক্রান্ত চারা গাছের গোড়া পচে যায়, পাতা নেতিয়ে পড়ে হলুদাভ হয়ে মারা যায়। এ অবস্থাকে কৃসেক বলে। রোগাক্রান্ত কাণ্ডের গোড়ায় চাপ দিলে আঠালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ বের হয়। বয়স্ক গাছে সাধারণত থোড় অবস্থা থেকে পাতাপোড়া লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে পাতার অগ্রভাগ থেকে কিনারা বরাবর আক্রান্ত হয়ে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। আক্রান্ত অংশ প্রথমে জলছাপ এবং পরে হলুদাভ হয়ে খড়ের রং ধারণ করে।
ক্রমশ সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে মরে যায়। অতিমাত্রায় ইউরিয়া সারের ব্যবহার, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ো আবহাওয়া এ রোগ বিস্তারে সাহায্য করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। রোগ দেখা দিলে প্রতি বিঘায় অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। ঝড়-বৃষ্টি এবং রোগ দেখা দেওয়ার পর ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রাখুন। কৃসেক হলে আক্রান্ত জমির পানি শুকিয়ে ৭-১০ দিন পর আবার সেচ দিন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।
ধানের উফরা রোগ:
কৃমিজনিত রোগ। কৃমি ধানগাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটেফোঁটা সাদা দাগ দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে সে দাগ বাদামি রঙের হয়ে পুরো আগাটাই শুকিয়ে মরে যায়। আক্রমণের প্রকোপ বেশি হলে গাছে বাড়-বাড়তি কমে যায়। থোড় অবস্থায় আক্রমণ করলে থোড়ের মধ্যে শিষ মোচড়ানো অবস্থায় থেকে যায়। ফলে শিষ বের হতে পারে না।
কৃমি পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটো এবং ঘাসে এমনকি মাটিতে কুণ্ডলী পাকিয়ে বেঁচে থাকে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগ দেখা দিলে হেক্টরপ্রতি ২০ কেজি হারে ফুরাডান ৫জি অথবা কিউরেটার ৫জি প্রয়োগ করুন। রোগাক্রান্ত জমির ফসল কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন। সম্ভব হলে জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন ফেলে রাখুন। আক্রান্ত জমিতে বীজতলা করা উচিৎ নয়। ধানের পর ধান আবাদ না করে অন্য ফসলের চাষ করুন। জলী আমন ধানে আক্রান্ত জমিতে কারবেনডাজিম ২% হারে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
ধানের ব্লাস্ট রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ পাতায় হলে পাতা ব্লাস্ট, গিটে হলে গিট ব্লাস্ট ও শিষে হলে শিষ ব্লাস্ট বলা হয়। পাতায় ব্লাস্ট হলে পাতায় ছোট ছোট ডিম্বাকৃতির দাগের সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে দাগ বড় হয়ে দু’প্রান্ত লম্বা হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে।
দাগের চার ধারে বাদামি ও মাঝের অংশ সাদা বা ছাই বর্ণ ধারণ করে। অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে গিয়ে পুরো পাতা মরে যায়। এ রোগের কারণে জমির সমস্ত ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ রোগ বোরো মৌসুমে বেশি হয়। গিট ব্লাস্ট এবং শিষ ব্লাস্ট হলে গিট ও শিষের গোড়া কালো হয়ে যায় ও ভেঙে পড়ে এবং ধান চিটা হয়ে যায়। রাতে ঠান্ডা, দিনে গরম, রাতে শিশির পড়া এবং সকালে কুয়াশা থাকলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। জমিতে পানি ধরে রাখুন। রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ সাময়িক বন্ধ রেখে প্রতি হেক্টরে ৪০০ গ্রাম ট্রপার, জিল বা নেটিভো ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রয়োগ করুন।
সকল সুগন্ধি ধান, হাইব্র্রিড ধান এবং লবণ-সহনশীল ধানে ফুল আসার সময় নিম্নচাপ দেখা দিলে উল্লিখিত ছত্রাকনাশক আগাম স্প্রে করতে হবে।
ধানের খোলপোড়া রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। ধান গাছের কুশি গজানোর সময় হতে রোগটি দেখা যায়। প্রথমে খোলে ধূসর জলছাপের মত দাগ পড়ে। দাগের মাঝখানে ধূসর হয় এবং কিনারা বাদামি রঙের রেখা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। দাগ আস্তে আস্তে বড় হয়ে সমস্ত খোলে ও পাতায় অনকেটা গোখরো সাপের চামড়ার মত চক্কর দেখা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, বেশি মাত্রায় ইউরিয়ার ব্যবহার ও ঘন করে চারা রোপন এ রোগ বিস্তারে সহায়তা করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে শেষ মই দেয়ার পর পানিতে ভাসমান আবর্জনা সুতি কাপড় দিয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলুন। পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করুন।
নেটিভো, ফলিকুর, কনটাফ, হেক্সাকোনাজল খোলপোড়া রোগ দমনে কার্যকর ছত্রাকনাশক। আক্রান্ত ধানগাছের চারপাশের কয়েকটি সুস্থ গুছিসহ বিকেলে গাছের উপরিভাগে এটি স্প্রে করুন। ছত্রাকনাশকের মাত্রা লেবেলে দেখে নিন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন।
ধানের বাকানি রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। আক্রান্ত কুশি দ্রুত বেড়ে অন্য গাছের তুলনায় লম্বা ও লিকলিকে হয়ে যায় এবং হালকা সবুজ রঙের হয়। গাছের গোড়ার দিকে পানির উপরের গিঁট থেকে শিকড় বের হয়। ধীরে ধীরে আক্রান্ত গাছ মরে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোগাক্রান্ত কুশি তুলে ফেলুন। এ রোগ বীজবাহিত। তাই বীজ শোধন করতে পারলে ভাল হয়। এ জন্য কারবেনডাজিম গ্রুপের যেকোনও ছত্রাকনাশকের ৩ গ্রাম ওষুধ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে অঙ্কুরিত বীজে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া একই পরিমাণ ওষুধ দিয়ে সারা রাত চারা শোধন করেও ভাল ফল পাওয়া যায়।
ধানের বাদামি দাগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ হলে পাতায় প্রথমে ছোট ছোট বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগের মাঝখানটা হালকা বাদামি রঙের হয়। অনেক সময় দাগের চারদিকে হলুদ আভা দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করুন। ইউরিয়া ও পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করুন। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার করুন। পর্যায়ক্রমে জমিতে পানি সেচ দিন এবং জমি শুকিয়ে নিন। আক্রান্ত জমিতে শিষ বের হওয়ার পর ৬০ গ্রাম পটাশ ও ৬০ গ্রাম থিওভিট/কমুলাস ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫শতক জমিতে স্প্রে করলে ধানে বাদামি দাগ কম হয়। কারবেনডাজিম-জাতীয় ছত্রাকনাশক দিয়ে (বীজ ০.৩% দ্রবণে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে) বীজ শোধন করুন।
ধানের খোল পচা:
ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগ ধানগাছের ডিগপাতার খোলে হয়। রোগের শুরুতে ডিগপাতার খোলের ওপরের অংশে গোলাকার বা অনিয়মিত আকারের বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে দাগটি বড় হতে থাকে এবং গাঢ় ধূসর রঙ ধারণ করে। এ অবস্থায় অনেক সময় শিষ বের হতে পারে না অথবা রোগের প্রকোপ অনুযায়ী আংশিক বের হয় এবং বেশিরভাগ ধান কালো ও চিটা হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আক্রান্ত খড়কুটো জমিতে পুড়িয়ে ফেলুন। সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করুন। খোলপোড়া রোগের ছত্রাকনাশক এ রোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করুন।
ধানের লক্ষ্মীর গু রোগ:
ছত্রাকজনিত রোগ। ধান পাকার সময় এ রোগ দেখা যায়। ছত্রাক ধানের বাড়ন্ত চালকে নষ্ট করে বড় গুটিকার সৃষ্টি করে। গুটিকার ভিতরের অংশ হলদে-কমলা রঙ এবং বহিরাবরণ সবুজ যা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
এ রোগ ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভাল উপায় হল রোগাক্রান্ত শিষ তুলে ফেলা ও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার না করা।
ধানের পাতা লালচে রেখা রোগ:
ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। ব্যাকটেরিয়া পাতার ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে এবং শিরার মধ্যবর্তী স্থানে সরু রেখার জন্ম দেয়। আস্তে আস্তে রেখা বড় হয়ে লালচে রঙ ধারণ করে। পাতা সূর্যের বিপরীতে ধরলে দাগের ভেতর দিয়ে স্বচ্ছ আলো দেখা যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
এ রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বীজ শোধন করা দরকার, আক্রান্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত নয় এবং নাড়া পুড়িয়ে ফেলা দরকার।
ধান অনিষ্টকারী পোকা ও প্রাণী নিয়ন্ত্রণ:
নিবিড় চাষাবাদের কারণে ফসলে পোকার প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন পোকার প্রাদুর্ভাব বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহ একে একে নিম্নে বর্ণনা করা হল:
মাজরা পোকা
মাজরা পোকা ব্যবস্থাপনা (Stem borer):
মাজরা পোকার আক্রমণ ফুল ফোঁটার আগে হলে মরা ডিল এবং ফুল ফোঁটার পরে হলে সাদা শিষ বের হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ডিমের গাদা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলুন।
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা (মথ) সংগ্রহ করে দমন করুন।
ধান ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির সাহায্য নিন।
জমিতে শতকরা ১০-১৫ ভাগ মরা ডিগ অথবা শতকরা ৫ ভাগ সাদা শিষ দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করুন। আমন ধান কাটার পর চাষ দিয়ে নাড়া মাটিতে মিশিয়ে বা পুড়িয়ে ফেলুন।
ধানের নলিমাছি বা গলমাছি
নলিমাছি বা গলমাচি ব্যবস্থাপনা (Gall midge):
এই মাছির দ ধানগাছের বাড়ন্ত কুশিতে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত কুশি পেঁয়াজ পাতার মত হয়ে যায়। ফলে কুশিতে আর শিষ হয় না।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
রোপণের পর নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করুন।
আলোক-ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণবয়স্ক পোকা দমন করুন।
জমিতে শতকরা ৫ ভাগ পেয়াজ পাতার লক্ষণ দেখা গেলে কীটনাশক ব্যবহার করুন।
ধানের পামরি পোকা
পামরি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice hispa):
পামরি পোকার কীড়া পাতার ভেতরে সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খায়, আর পূর্ণবয়স্ক পোকা পাতার সবুজ অংশ কুরে কুরে খায়। এভাবে খাওয়ার ফলে পাতা সাদা দেখায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন।
জমিতে শতকরা ৩৫ ভাগ পাতার ক্ষতি হলে অথবা প্রতি গোছায় চারটি পূর্ণ বয়স্ক পোকা অথবা প্রতি কুশিতে ৫টি কীড়া থাকলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
পাতা মোড়ানো পোকা
পাতা মোড়ানো পোকা ব্যবস্থাপনা (Leaf roller):
পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া গাছের পাতা লম্বালম্বিভাবে মুড়িয়ে পাতার ভিতরের সবুজ অংশ খায়। খুব বেশি ক্ষতি করলে পাতা পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
গাছে থোড় আসার সময় বা ঠিক তার আগে যদি শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের চুঙ্গি পোকা
চুঙ্গি পোকা ব্যবস্থাপনা (Rice caseworm):
চুঙ্গি পোকা পাতার উপরের অংশ কেটে ছোট ছোট চুঙ্গি তৈরি করে ভেতরে থাকে। আক্রান্ত ক্ষেতে গাছের পাতা সাদা দেখায় এবং পাতার উপরের অংশ কাটা থাকে। দিনের চুঙ্গিগুলো পানিতে ভাসতে থাকে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
পানি থেকে হাতজাল দিয়ে চুঙ্গিসহ কীড়া সংগ্রহ করে ধ্বংস করুন।
জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের লেদা পোকা
লেদা পোকা ব্যবস্থাপনা (Swarming caterpillar):
এ পোকার কীড়া পাতার পাশ থেকে কেটে এমনভাবে খায় যে কেবল ধানগাছের কাণ্ড অবশিষ্ট থাকে। সাধারণত: শুকনো জমিতে এ পোকার আক্রমণের আশঙ্কা বেশি।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ধান কাটার পর জমি চাষ দিয়ে রাখুন অথবা নাড়া পুড়িয়ে ফেলুন।
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা বা মথ দমন করুন।
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন।
জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে ঘাসফড়িং:
ঘাসফড়িং পাতার পাশ থেকে শিরা পর্যন্ত খায়। জমিতে অধিক সংখ্যায় আক্রমণ করলে এদেরকে পঙ্গপাল বলা হয়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
হাতজাল বা মশারির কাপড় দিয়ে পোকা ধরে মেরে ফেলুন। ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। জমির শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে লম্বাশুড় উরচুঙ্গা:
এ পোকা ধানের পাতা এমনভাবে খায় যে পাতার কিনারা ও শিরা বাকি থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত পাতা ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পোকাখেকো পাখির বসার ব্যবস্থা নিন। আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পূর্ণবয়স্ক উরচুঙ্গা দমন করুন। জমিতে শতকরা ২৫ ভাগ পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হলে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে সবুজ পাতাফড়িং:
সবুজ পাতাফড়িং ধানের পাতার রস শুষে খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছ খাটো হয়ে যায়। এ পোকা টুংরো ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
আলোক-ফাঁদের সাহায্যে পোকা দমন করুন। হাতজালের প্রতি টানে যদি একটি সবুজ পাতাফড়িং পাওয়া যায় এবং আশেপাশে টুংরো রোগাক্রান্ত ধান গাছ থাকে তাহলে বীজতলায় বা জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করুন।
ধানের মাঠে বাদামি গাছফড়িং:
বাদামি গাছফড়িং ধানগাছের গোড়ায় বসে রস শুষে খায়। ফলে গাছ পুড়ে যাওয়ার রং ধারণ করে মরে যায় তখন একে বলা হয় ‘হপার বার্ন’ বা ‘ফড়িং পোড়া’।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
বোরো মৌসুমে ফেব্রুয়ারি এবং আমন মৌসুমে অগাস্ট মাস থেকে নিয়মিত ধান গাছের গোড়ায় পোকার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করুন। এ সময় ডিম পাড়তে আসা লম্বা পাখাবিশিষ্ট ফড়িং আলোক-ফাঁদের সাহায্যে দমন করুন। ধানের চারা ঘন করে না লাগিয়ে পাতলা করে রোপণ করলে গাছ প্রচুর আলো বাতাস পায়; ফলে পোকার বংশ বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।
ধানের মাঠে ইঁদুর দমন:
ইঁদুর ধান গাছের কুশি কেটে দেয়। ধান পাকলে ধানের ছড়া কেটে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে জমা রাখে।
ব্যবস্থাপনার জন্য করণীয়:
জমির আইল ও সেচ নিষ্কাশন নালা কম সংখ্যক ও চিকন রাখতে হবে। একটি এলাকায় যথাসম্ভব একই সময় ধান রোপণ ও কর্তন করা যায় এমনভাবে চাষ করতে হবে। ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করুন। বিষটোপ, যেমন-ব্রমাডিওলন দিয়ে ইঁদুর দমন করা যায়।
ধান কাটা
ধান ফসল কর্তন, মাড়াই ও সংরক্ষণ:
শীথের উপরের অর্ধেক দানার শতকরা ৮০ ভাগ এবং নিচের অর্ধেক নানার শতকরা ২০ ভাগ শক্ত হলে ধান কাটার উপযুক্ত সময় হয়। তাছাড়া কিছু কিছু ধান সোনালী রং ধারণ করে এবং নীলের মতন ছেলে পড়ে। এমতাবস্থান কেটে আঁটি বেঁধে পরিষ্কার জানালার দিয়ে প্যাডেল প্রেসার বা গরু দিয়ে বা পিটিয়ে মাড়াই করতে হয়। এরপর কেড়ে পরিষ্কার করে ৩- ৪ বার ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়।
অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝরে পড়ে, শিষ ভেঙে যায়, শিষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। শিষের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। কাটার পর ধান মাঠে ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাড়াই করা উচিত। কাঁচা খলার উপর ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নিন। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে।
মাড়াই করা ধান অন্তত ৪-৫ দিন রোদে ভালভাবে শুকানোর পর যেন বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগের নিচে থাকে এবং এমতাবস্থায় গুদামজাত ও আর্দ্রতা-রোধক গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে।
কৃষি, কৃষি শিক্ষা, কৃষি প্রশিক্ষণ, কৃষি শিল্প, কৃষি গবেষণা