বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মৎস্য – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “গবাদিপশু ও পোলট্রি” বিষয়ের, ১.৩ নং পাঠ।
বাংলাদেশের কৃষির ক্ষেত্র-মৎস্য, গবাদিপশু ও পোলট্রি
মৎস্য :
মৎস্য উৎপাদন কৃষি ব্যবস্থার একটি গুরত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এ উৎপাদন ব্যবস্থার ভৌত পরিবেশ হচ্ছে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর, বাঁওর, পুকুর, ডোবা, দীঘি, হ্রদ, নদ-নদী এবং সমুদ্র ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে পতিত জমি ও ফসলের জমি খনন করে এবং ঘের তৈরী করেও মাছের চাষ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ফসলের পরেই মাছের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষের শতকরা ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করে মাছ।
মৎস্য প্রজাতি ও এর চাষ (Fish species and cultivation):
মাহ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। এদের দেহে জোড় বক্ষ শ্রেণি পাখনা থাকে। প্রতিটি পাখনার মাঝে কাঁটা থাকে। এরা ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। মৎস্য বলতে সকল জলজ প্রাণী যেমন-মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুক, ডলফিন ইত্যাদিকে বোঝায়। মাছের প্রজাতির সংখ্যা ২০,০০০ এর মত। বাংলাদেশে স্বাদু ও লোনা পানিতে মাছের প্রজাতির সংখ্যা যথাক্রমে ২৯৬ ও ৫১১ (কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)।
মৎস সম্পদের অবকাঠামো:
বাংলাদেশে মৎস্য হ্যাচারীর সংখ্যা ৯০২টি। এর মধ্যে সরকারি ৮৯টি এবং বেসরকারি ৮১৩টি। গলদা হ্যাচারি ৩৬টি (সরকারি ১৭টি, বেসরকারি ১৯টি) এবং বাগদা হ্যাচারি ৪৯টি (বেসরকারি)। বাংলাদেশে মৎস্য। চিংড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৬টি, মৎস্য প্রশিক্ষণ একাডেমি ১টি, মৎস্য ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট ৪টি, চিংড়ি প্রদর্শনী খামার ২টি। মৎস্য হ্যাচারি/মৎস্য বীজ উৎপাদন খামার ১৩৬টি। চিংড়ি আহরণ ও সেবা কেন্দ্র ২০টি। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র (বিএফডিসি) ৯টি এবং মৎস্য গবেষণার জন্য উপকেন্দ্র ১০টি।
মাছ উৎপাদনের গুরুত্ব:
বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুল এবং পানি সম্পদে সমৃদ্ধ। ১৯৮০ সালে প্রথম বাংলাদেশে বিদেশী মৎস্য প্রজাতির চাষ বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়। এ সময় থেকে পতিত জমি, ধান ক্ষেত, ডোবা, নালা ও হাজামজা পুকুরকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলা হয়। বিভিন্ন ধরনের বিদেশী মৎস্য প্রজাতি যেমন কার্প, সিলভার কার্প, পাঙ্গাশ, মিরর কার্প, থাই সরপঁুটি, তেলাপিয়া ইত্যাদি বাংলাদেশে ব্যপক হারে চাষ হয়। এতে মাছের বাজারমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে এবং টাটকা মাছ বাজারে পাওয়া যায়। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক সফলতা লাভ করেছে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ৪র্থ স্থান দখল করেছে। মানুষের আমিষের ঘাটতি কমে আসছে এবং মাথাপিছু মাছ খাবার পরিমান বেড়ে গেছে। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২০১৫—১৬ অর্থবছরে ৩.৬৫%।
মাছ উৎপাদনে পারিবারিক ও জাতীয় উন্নয়নে ভুমিকা :
১। মাছ বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের প্রধান উৎস।
২। মাছ উৎপাদন, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপনন ইত্যাদি বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে।
৩। মাছের উপজাত থেকে প্রস্তুুতকৃত ফিস মিল, জৈব সার ও পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৪। ফসল—গাভী, হাঁস, মুরগী ও মাছের সমন্বিত চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
৫। মাছের তেল, সাবান, ঔষধ, গ্লিসারিন, বার্নিশ প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার হয়।
৬। মাছের কাঁটা, দাঁত, লেজ ইত্যাদি থেকে সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুুত করা হয়।
৭। বাংলাদেশ হিমায়িত মাছ, চিংড়ি, শুটকি, লবণজাত মাছ এবং অন্যান্য মৎস্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
৮। মৎস্যজাত শিল্প কারখানা যেমন বরফ তৈরী, জাল বুনন ও মেরামত, মাছ ধরার অন্যান্য উপকরণ তৈরি শিল্প গড়ে উঠেছে।
মাছের প্রতিবেশ :
মাছের প্রতিবেশ দু’ধরনের:
১। আভ্যন্তরীন জলাশয় ২। উন্মুক্ত জলাশয়
১। আভ্যন্তরীন জলাশয়:
দেশের স্থুলভাগে যে সমস্ত জলাশয় রয়েছে তাই আভ্যন্তরীণ জলাশয়। আভ্যন্তরীন জলাশয়ের প্রকারভেদ:
১. মুক্ত জলাশয়:
নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল, হাওর ইত্যাদি। এই মুক্ত জলাশয়ের জমির পরিমাণ প্রায় ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর ( কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)।
২. বদ্ধ জলাশয়:
পুকুর, ডোবা ও দীঘি। মোট আয়তন ৭৮২৫৫৯ হেক্টর।
৩. বাঁওর:
নদীর প্রবাহ বাধা প্রাপ্তির জন্য নদীর কিছু অংশ বদ্ধ জলাশয়ের সৃষ্টি করে, একেই বাঁওর বলে। এদেশে বিভিন্ন আকারের প্রায় ৮০ টি বাঁওর আছে। কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও সিলেট জুড়ে এই বাঁওরগুলোর অবস্থান এবং আনুমানিক মোট আয়তন ৫.৪৮৮ হেক্টর।
৪. চিংড়ির ঘের প্রতিবেশ:
জোয়ারের পানি আটকিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা যেমন খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামে বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের খামারগুলো অবস্থিত। অধিকাংশ ঘের দেশীয় পদ্ধতিতে করা হয়। ঘের চাষের মোট আয়তন ১৭৫২৭৪ হেক্টরের মত। গলদার ফলন ৫০০—৬০০ কেজি এবং বাগদার ফলন ২৫০—৩০০ কেজি হেক্টরে। ( কৃষি তথ্য সার্ভিস, ২০১৫)
৫. লেক বা হ্রদ:
কৃত্রিম বা স্বাভাবিক বৃহৎ আকারের বদ্ধ জলরাশিকে লেক বা হ্রদ বলে। যেমন ফয়েজ লেক, কাপ্তাই লেক।
উন্মুক্ত জলাশয় (আয়তন ৩৯১৬৮২৮ হেক্টর)।
গবাদি পশু:
বাংলাদেশের কৃষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হল গবাদি পশু। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত পশু গৃহে স্থায়ীভাবে লালন পালন করে আসছে, এদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। বাংলাদেশে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, মহিষ,
ছাগল, ভেড়া প্রধান।
গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত দ্রব্যসমূহ :
গবাদি পশু জবাইয়ের পর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল খাদ্য অনুপযোগী দ্রব্য জমা হয় সেগুলোকে গবাদিপশুর উপজাত দ্রব্য বলা হয়। এগুলো হল বর্জ্য মাংস, হাঁড়, রক্ত, নাড়িভূড়ি, মলমূত্র ইত্যাদি। এ উপজাতদ্রব্যগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে বিভিন্ন কাজে লাগানো যেতে পারে। আবার এগুলো যথাযথ সংরক্ষণের পরিবেশ ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায়। উপজাতগুলো দিয়ে উৎকৃষ্ট জৈব সার ও মাছের খাদ্য তৈরি করা যায়। হাড় ও শিং বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্য তৈরিতে কুটির শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
গবাদি পশুর গুরুত্ব :
আমাদের জীবনে গবাদি পশুর গুরুত্ব অনেক। নিম্নে গবাদি পশুর নানাবিধ গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
১. জমি চাষ করতে গরু—মহিষ ব্যবহৃত হয়।
২. শস্য মাড়াই করতে গরু মহিষ ব্যবহার করা হয়।
৩. পণ্য পরিবহনের জন্য গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
৪. তেলের ঘানি, আখ মাড়াই মেশিন ইত্যাদি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় শক্তি গরু মহিষের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
৫. প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হল গবাদি পশুর মাংস ও দুধ।
৬. গবাদি পশু এবং তাদের মাংস ক্রয়—বিক্রয় করে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
৭. কোন কোন গবাদি পশু যেমন ছাগল ও ভেড়া পালনে মূলধন কম লাগে।
৮. দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করে প্রচুর আয় করা হয়।
৯. গবাদিপশুর চর্বি সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
১০. জ্বালানি হিসেবে গোবর ব্যবহৃত হয়।
১১. গবাদিপশুর মলমূত্র (গোবর) উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে জমিতে ব্যবহৃত হয়।
১২. গোবর থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা যায়।
১৩. গবাদিপশু বিক্রয় করে এককালীন অনেক অর্থ পাওয়া যায়।
১৪. ভেড়া—ছাগলের পশম দ্বারা দামী শীতবস্ত্র তৈরি করা হয়।
১৫. গবাদিপশুর চামড়া, পশম, হাড় ইত্যাদি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যায়।
পোলট্রি:
বাংলাদেশে কৃষির একটি অন্যতম ক্ষেত্র হল পোল্টি্র বা গৃহপালিত পাখি। যে সকল জীবের পাখনা আছে, যারা উড়তে পারে এবং ডিম দেয় তাদেরকে পাখি বলা হয়। আবার অর্থনৈতিক প্রয়োজনে মানুষ যেসব পাখি গৃহে পালন করে তাদের গৃহপালিত পাখি বলে্। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গৃহপালিত পাখি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বাংলাদেশে গৃহপালিত পাখি যেমন হাঁস—মুরগী, কবুতর উল্লেখযোগ্য।
সাধারণত গ্রামের প্রতিটি পরিবারেই গৃহপালিত পাখি পালন করা হয়। এগুলো একদিকে যেমন পরিবারের ডিম ও মাংসের চাহিদা মেটায় তেমনি বাড়তি অংশ বিক্রয় করে অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়া যায়। গ্রামের পরিবারে সাধারণত দেশীয় জাতের পোল্টি্র পালন করা হয়। তবে বর্তমানে অনেকেই পোল্টি্র শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এজন্য নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকেও উন্নত জাত আমদানি করা হয়েছে। যেমন ’জাপানি কোয়েল’ নামক এক প্রকারের পাখি বাংলাদেশে পালন করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারি গবেষণা কেন্দ্রে প্রাণীবিজ্ঞানীরা ’শুভ্রা’ নামে একটি ডিম পাড়া মুরগীর জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাতের মুরগী বছরে ২৮০—২৯৫ টি ডিম দেয়।
পোল্টি্র ও পোল্টি্র বিজ্ঞানের ধারণা:
অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্বলিত যে সব পাখি মানুষের তত্ত্বাবধানে থেকে মুক্তভাবে বংশবৃদ্ধি করে এবং যাদেরকে পারিবারিক বা খামার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিকভাবে পালন করা হয় তাদেরকে গৃহপালিত পাখি বা পোল্টি্র বলে। যেমন হাঁস, মুরগী, কোয়েল, কবুতর ইত্যাদি।
বিজ্ঞানের যে শাখায় গৃহপালিত পাখি নিয়ে গবেষণা করা হয় বিশেষ করে পাখির খাদ্য, প্রজনন, বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে তাদের অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে আালোচনা করা হয় তাকে পোল্টি বিজ্ঞান বলে।
পোল্টি্র শিল্পের ধারনা:
বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নত ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাতের হাঁস মুরগী ও কোয়েল পালন করা হচ্ছে। এ কৃষি ক্ষেত্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে বাণিজ্যিকভাবে একটি শিল্পের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এদেশের অনেক বেকার যুবকযুবতী তাদের শ্রম দিয়ে নতুন নতুন পোল্টি্র শিল্প গড়ে তুলছে এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেড় লক্ষের কিছু কম পোল্টি খামার চালু আছে। ২০০৯—১০ অর্থ বছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের পোল্টি্র খামারের সংখ্যা ১৪৮৯৩৩ এবং এই খাত থেকে নির্বাহকারী মানুষের সংখ্যা হল ২২৩৩৯৯৫ জন।
পোল্টি্রর (মুরগী) শ্রেণীবিন্যাস:
জাত, উপজাত ও স্ট্রেইন মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রকারের মুরগী আছে। এদেরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১। উৎপত্তিভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
২। উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
১। উৎপত্তি স্থানের উপর ভিত্তি করে মুরগীর জাত ৪ প্রকার যথা:
(ক) আমেরিকান শ্রেণীর—যেমন রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পাশায়ার, প্লাইমাউথ রক ইত্যাদি।
(খ) ভূ—মধ্যসাগরীয় শ্রেণী: যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, অ্যানকোনা ইত্যাদি।
(গ) ইংলিশ শ্রেণী: যেমন, অস্ট্রারলর্প, কার্ণিশ, সাসেক্স ইত্যাদি।
(ঘ) এশিয়া শ্রেণী: যেমন: ব্রাহমা, কোচিন, আসিল ইত্যাদি।
২। উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
ডিম ও মাংস উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে মুরগীর বিশুদ্ধজাত গুলোকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
(ক) ডিম উৎপাদনকারী জাত:
এ জাতের মুরগী আকারে ছোট ও ওজনে তুলনামূলকভাবে হালকা হয়ে থাকে। তবে এরা বেশ বড় আকারের ডিম দেয়। বছরে ২৫০—৩০০ টি বা তার চেয়ে বেশি ডিম ও দিতে পারে। যেমন, লেগহর্ণ, মিনর্কা, স্টারক্রস সাদা, ইসাব্রাউন ইত্যাদি।
(খ) মাংস উৎপাদনকারী জাত:
এ মুরগী আকারে বেশ বড় ও ওজনে খুব ভারী। এদের শারীরিক বৃদ্ধি খুব বেশি হয় তবে এরা ডিম কম দেয়। এরা ৬—৮ সপ্তাহে ১.৫—২.০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে এবং পূর্ণবয়সে ৪ কেজি পর্যন্তও হয়। এদের মাংস অত্যন্ত নরম ও সুস্বাদু হয়ে থাকে। এদের খাদ্যকে মাংসতে রুপান্তরিত করার ক্ষমতা (১.৮:১) অর্থাৎ এরা গড়ে ১.৮ কেজি খাদ্য গ্রহন করে ১ কেজি মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম।
(গ) ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী বা দ্বৈত জাত:
এ জাতের মুরগীর আকার মাঝারি ও ওজনে মোটামুটি ভারী, এরা মাঝারি পরিমান ডিম ও মাংস দেয়। উদাহরণ: রোড আইল্যান্ড রেড, নিউ হ্যাম্পশায়ার, অস্ট্রালপ ইত্যাদি।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ [ Biofloc Technology Fish Farming ]
পোল্টি্রর অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
মানুষের খাদ্য সরবরাহ, পুষ্টির চাহিদাপুরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষেত্রে পোল্টির গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে পোল্টি্রর অর্থনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো।
১। পোল্টি্রর মাংস ও ডিমের চাহিদা থাকায় এগুলো বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা যায়।
২। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অল্প সময়ে অনেক মুরগী পালনের মাধ্যমে বেশী অর্থ উপার্জন করা যায়।
৩। হাঁস মুরগীর খামার করে অনেক বেকার জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়।
৪। পোল্টি্রর শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প যেমন: পোল্টি্রর খাদ্য ও ঔষধ ইত্যাদি শিল্প গড়ে ওঠে এবং অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৫। পোল্টি্র পালন করে পরিবারে বাড়তি আয় করা যায়।
৬। হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা ব্যায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এর কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৭। পোল্টি্রর মাংস ও ডিম মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে অনেক ভূমিকা রাখে।
৮। পোল্টি্রর বিষ্ঠা ও লিটার থেকে উৎকৃষ্ট জৈব সার তৈরি করা হয়।
৯। পোল্টি্রর উপজাত দ্রব্য যেমন রক্ত, নাড়িভুড়ি বিশেষ ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করে পাখির ও মাছের খাদ্য তৈরী করা যায়।
১০। বিনোদন: অনেক পাখিই মানুষের বিনোদনের খোরাক যোগায়। যেমন: মোরগের লড়াই, কবুতরের ডাক ইত্যাদি।
সারাংশ :
মাছ শীতল রক্ত বিশিষ্ট জলজ মেরুদন্ডী প্রাণী। বাংলাদেশ মৎস্য প্রতিবেশ ও মৎস্য উৎপাদনের জন্য খুবই অনুকুলে এবং মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ ৪র্থ স্থান দখল করেছে। যেসব পশু গৃহে পালন করা হয় তাদেরকে গবাদি পশু বলা হয়। গবাদি পশুর মাংস, দুধ খাদ্য ও আমিষের উৎস হিসেবে এবং গবাদি পশু হতে প্রাপ্ত উপজাত বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পোল্টি্র শিল্পের ভূমিকা ব্যপক। সাধারণত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গৃহপালিত পাখি ও পোল্টি্র পালন করা হয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা অপরিহার্য।
ছাগলের রোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ১৩ নং ইউনিটের ১৩.৬ নং পাঠ। ছাগলের রোগ ব্যবপনা একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে মুক্তভাবে ছাগল প্রতিপাল নের তুলনায় আবদ্ধ অবস্থায় ছাগল পালন অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যবস্থায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা ও প্রযুক্তির সমন্নয় না ঘটালে খামারীকে বিস্তর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা একটি বাস্তব উপলব্ধি। এজন্য ছাগলের সুখ সাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থার প্রতি খামারীকে স্বতন্ত্র ভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। ছাগলের খামারে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই বিভিন্ন রোগ দমনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে খামার থেকে লাভের আশা করা যায় না।
ছাগলের রোগ ব্যবস্থাপনা
খামারে ছাগল আনার পর থেকে প্রতিদিনই প্রতিটি ছাগলের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। প্রথম পাঁচ দিন সকাল ও বিকালে দুবার থার্মোমিটার দিয়ে ছাগলের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। হঠাৎ কোনো রোগ দেখা মাত্রই গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তীব্র শীতের সময় ছাগী বা বাচ্চাদের গায়ে চট পেঁচিয়ে দেয়া যেতে পারে। মাচার নিচ এবং ঘর প্রতিদিন সকালে পরিস্কার করতে হবে এবং কর্মসূচি অনুযায়ী জীবাণুনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুস্থ ছাগলের বৈশিষ্ট্য সুস্থ ছাগলের নাড়ীর স্পন্দন প্রতি মিনিটে ৭০—৯০ বার, শ^াস প্রশ^াস প্রতি মিনিটে ২৫—৪০ বার এবং তাপমাত্রা ৩৯.৫০ সেঃ হওয়া উচিত। সুস্থ ছাগল দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, মাথা সবসময় উঁচু থাকে, নাসারন্ধ্র থাকবে পরিস্কার, চামড়া নরম, পশম মসৃণ ও চকচকে দেখাবে এবং পায়ু অঞ্চল থাকবে পরিচ্ছন্ন।
ছাগল সুস্থ রাখতে যেসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:কর্মসূচি অনুযায়ী টিকা প্রদান: ভাইরাসজনিত রোগ যেমন এনথ্রাক্স ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি খুবই মারাত্মক বলে এগুলোর বিরুদ্ধে যথারীতি টিকা প্রদান করতে হবে। যেসব ছাগীকে পূর্বে পিপিআর, গোটপক্স, একথাইমা, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি টিকা দেয়া হয়নি তাদেরকে গর্ভের ৫ম মাসে উক্ত ভ্যাকসিনগুলি দিতে হবে। বাচ্চার বয়স যখন ৫ মাস তখন তাকে পিপিআর ভ্যাকসিন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন দিতে হবে।
কৃমিনাশক ঔষধ প্রয়োগ:
সকল ছালকে নির্ধারিত মাত্রায় বছরে দুইবার কৃমিনাশক ঔষধ প্রদান করতে হবে। কমিনাশক ৃ কর্মসূচি অনুসরণের জন্য গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সঠিক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
ছাগলের খামারের জৈব নিরাপত্তা খামার এলাকায় বেড়া বা নিরাপত্তা বেস্টনী এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যাতে সেখানে অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি, শেয়াল— কুকুর ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী প্রবেশ করতে না পারে। প্রবেশপথে ফুটপাতে বা পা ধোয়ার জন্য ছোট চৌবাচ্চায় জীবাণুনাশক মেশানো পানি রাখতে হবে। খামারে প্রবেশের আগে খামারে গমনকারী তার জুতা/পা ডুবিয়ে জীবাণু মুক্ত করবেন। খামারের জন্য সংগৃহিত নূতন ছাগল সরাসরি খামারে পূর্বে বিদ্যমান ছাগলের সাথে রাখা যাবে না। নতুন আনীত ছাগলদের স্বতন্ত্র ঘরে সাময়িক ভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ধরনের ঘরকে পৃথকীকরণ ঘর বা আইসোলেশন শেড বলে। অন্ততপক্ষে দুই সপ্তাহ এই শেডে রাখা বিশেষ জরুরি। এসব ছাগলের জন্য প্রাথমিক কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে এদেরকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে। এজন্য বহিঃপরজিবী এবং আন্তঃপরজিবীর জন্য কার্যকর কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। চর্মরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি ছাগলকে ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে গোসল করাতে হবে। আইসোলেশন শেডে ছাগল রাখার পর ১৫ দিনের মধ্যে যদি কোনো রোগ না দেখা দেয় তাহলে প্রথম পিপিআর রোগের এবং সাত দিন পর গোটপক্সের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হবে। শেষ টিকা প্রদানের সাত দিন পর এসব ছাগলকে মূল খামারে নেয়া যেতে পারে।
প্রদিদিন সকাল এবং বিকালে ছাগলের ঘর পরিষ্কার করতে হবে। কোনো ছাগল যদি অসুস্থ হয় তাহলে তাকে আলাদা করে আইসোলেশন শেডে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো ছাগল মারা যায় তবে অবশ্যই তার কারণ শনাক্ত করতে হবে। ল্যাবরেটরিতে রোগ নির্ণয়ের পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মৃত ছাগলকে খামার থেকে দূরে নিয়ে মাটির গভীরে পুঁতে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। রোগাক্রান্ত ছাগলের ব্যবহার্য সকল সরঞ্জামাদি ও দ্রব্যাদি সঠিকভাবে জীবানু মুক্ত করতে হবে।
গরু, মহিষ ও ছাগলের বাসস্থান – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” ইউনিট – ১২ , পাঠ – ১২.১। গরুর বাসস্থান গরুর বাসস্থানকে সাধারণত গোশালা বা গোয়াল ঘর ব লে যা গরু কে ঝড়-বৃষ্টি, রোদ, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, গরম এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিরূপ পরিবেশ থেকে রক্ষা করে। দু’টি উপায়ে গরু পালন করা হয়, যেমন- ক) চারণভূমিতে গরু চরানোর মাধ্যমে ও খ) গোশালায় বেঁধে রেখে খাদ্য পরিবেশন মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে এ পদ্ধতিগুলোর কোনোটিই বৈজ্ঞানিকভাবে বিকাশ লাভ করেনি। এদেশে গরু পালনের পদ্ধতি হিসেবে গোশালা বা গোয়াল ঘর ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বাড়ির কাছাকাছি একটি উঁচু জায়গায় গোশালা নির্মাণ করা উচিৎ। এর ফলে দুর্গন্ধ ও গরুর মলমূত্র পাশাপাশি বসবাসকারী কোন মানুষের সমস্যার সৃষ্টি করবে না।
গরু, মহিষ ও ছাগলের বাসস্থান
গরুর আদর্শ গোশালার স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথাযথ নর্দমা ও পয়ঃপ্রনালীর ব্যবস্থা, লোকালয় থেকে দূরে, উত্তরদক্ষিণমুখী ঘর এবং চারণভূমির সুবিধার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। গরুর বাসস্থান নির্মাণের জন্য কতিপয় বিষয় বিবেচনা করা উচিৎ। যেমন—
* গোশালাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো—বাতাস চলাচল করতে পারে।
* গোশালা শুষ্ক ও উচু জায়গায় তৈরি করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করতে না পারে।
* ঘরের মেঝে পাকা ও ইট বিছানো হলে ভালো হয়।
* মেঝের পিছনের দিকে একটু ঢালু রাখতে হবে যাতে গোবর ও মূত্র খুব সহজেই নালায় চলে যেতে পারে।
* গোশালা যেন সহজেই পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা থাকে।
* গোশালার চারিদিকে ঝোপজঙ্গল থাকা ঠিক নয়।
* বিশ্রাম করার জন্য গোশালায় প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
* গোশালা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা গরুর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়।
* গোশালায় একই সাথে খাদ্য পরিবেশন, মলমূত্র নিষ্কাশন, আরাম—আয়েস, যত্ন ও পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বাসস্থান নির্মাণ
গরুর বাসস্থান নিমার্ণের ক্ষেত্রে যেসকল বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত তা হলো— * গোশালার উচ্চতা ৯—১০ ফুট বা ২.৭৫—৩.০ মিটার হতে হবে।
* খাদ্য সরবরাহের জন্য চাড়ি এবং পানির পাত্র থাকতে হবে।
* প্রতিটি চাড়ি ও পানির পাত্রের পরিমাপ যথাক্রমে ৩ ফুট ৪ ফুট এবং ১ ফুট ২ ফুট হওয়া উচিত।
* প্রতিটি গরুর জন্য আড়পাতা থাকতে হবে যাতে করে গরু বেঁধে রাখা যায়।
* খাবারের চাড়ি পাকা কনক্রিট ও আড়পাতা মসৃণ লোহার রড বা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা করতে হবে। * মেঝে কোনক্রমেই পিচ্ছিল হওয়া চলবে না।
* প্রতিটি গরুর জন্য ৫ বর্গ মিটার জায়গাই যথেষ্ট।
ছাগলের বাসস্থান:
অন্যান্য প্রাণীদের মতো ছাগলেরও রাত্রি যাপন, নিরাপত্তা, ঝড়বৃষ্টি, ঠান্ডা, রোদ ইত্যাদির কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাসস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। তবে, এদেশের গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক পর্যায়ে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থানের জন্য তেমন কোনো আলাদা ব্যবস্থা দেখা যায় না। গোয়াল ঘর বা গোশালায় গরু মহিষের পাশাপাশি, ঘরের বারান্দা, রান্নাঘর প্রভৃতি স্থানে ছাগলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ছাগলের বাসস্থান বা ঘর তৈরির পূর্বশর্তগুলো হচ্ছে— * শুষ্ক পরিবেশ ও আবহাওয়ায় ঘর তৈরি করতে হবে।
* ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তাতে সহজেই প্রচুর আলো—বাতাস চলাচল করতে পারে ।
* ঘর কোনোক্রমেই স্যাঁতস্যাঁতে হওয়া চলবে না।
* ঘরটি মজবুত ও আরামদায়ক হওয়া চাই।
* ঘর যেন সহজেই পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করা যায় এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকে।
ছাগলের ঘর:
ছাগল পালনের জন্য বিভিন্নভাবে ঘর তৈরি করা যায়। যেমন— ১. ভূমির উপর স্থাপিত ঘর ও ২. খঁুটির উপর স্থাপিত ঘর। ভূমির উপর স্থাপিত ঘরে গ্রামের সাধারণ গৃহস্থরা ছাগল পালন করে থাকেন। এই ধরনের ঘরের মেঝে কাঁচা অথার্ৎ মাটি দিয়ে, আধা পাকা অথার্ৎ শুধু ইট বিছিয়ে অথবা সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে তৈরি করা যায়। খুঁটির উপর স্থাপিত ঘর সাধারণত মাটি থেকে ৩.৩—৪.৯ ফুট (১.০—১.৫ মিটার) উচ্চতায় খুঁটির উপর তৈরি করা হয়। এ ধরনের ঘর ছাগলকে মাটির স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, বন্যার পানি, নালা—নর্দমা থেকে চোয়ানো পানি প্রভৃতি থেকে রক্ষা করে।
ছাগলের ঘরের মেঝে বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে মাঁচার মতো করে তৈরি করা হয়। দু’ধরনের ঘরই একচালা, দোচালা বা চৌচালা হতে পারে এবং ছাগলের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে তা ছোট বা বড় হতে পারে। ছাগলের বয়স এবং আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। একটি পূর্ণ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পালনের জন্য ২.৫ ফুট ১৪.৭৫ ফুট ১৫.৭৫ ফুট জায়গার প্রয়োজন হয়। প্রতিটি পাঠার জন্য খোপের মাপ হলো ৭.৯ ফুট ৫.৯ ফুট। গর্ভবতী ছাগলের জন্য আলাদা প্রসূতি কক্ষের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
মহিষের বাসস্থান মহিষ পালনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের প্রয়োজন। পারিবারিকভাবে মহিষ পালনের ক্ষেত্রে বাসস্থান বা ঘরের ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। তবে খামারভিত্তিতে একসঙ্গে অনেক মহিষ পালন করতে হলে ঘর তৈরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহিষের ঘর গরুর ঘর তৈরির মতোই। তবে ঘর তৈরিতে মজবুত অথচ দামে কম এরূপ জিনিসপত্র ব্যবহার করা উচিত।
একমাস বয়সি একটি বাছুরের জন্য ১.০ মিটার ১.৫ মিটার জায়গার প্রয়োজন হয়। গ্রামাঞ্চলে বকনা মহিষ অন্যান্য মহিষের সঙ্গে একই ঘরে বা গোয়ালে রাখা হয়। তবে সাধারণত প্রতিটি অগর্ভবতী বকনা মহিষের জন্য ৫—৬ বর্গ মিটার উদোম/ছাদবিহীন স্থান; ১.০—১.৫ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৪০—৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন। প্রতিটি গর্ভবতী বকনার জন্য ৮—১০ বর্গ মিটার উদোম/ছাদবিহীন স্থান; ৩—৪ বর্গ মিটার ছাদযুক্ত স্থান ও ৫০—৭৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট চাড়ি প্রয়োজন। অনুরূপভাবে একটি পূর্ণবয়স্ক ষাঁড় মহিষের জন্য ১০—১২ বর্গ মিটার আয়তনবিশিষ্ট ছাদযুক্ত ঘরের প্রয়োজন। মহিষের ঘর তৈরিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিত।
* ঘর স্বাস্থ্যসম্মত ও আরামপ্রদ হবে।
* ঘরে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকবে।
* মেঝে মজবুত হবে তবে তাতে পিচ্ছিল ভাব থাকবে না। * উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে।
ছাগলের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১১ নং ইউনিটের ১১.৫ নং পাঠ। এই পাঠে আমরা বিভিন্ন ধরণের ছাগলের জাত ও তদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো।
ছাগলের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য
ছাগলের জাত ও বৈশিষ্ট্য ছাগল গৃহপালিত প্রাণি । বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ছাগল পালন বেশ লাভজনক। গ্রামে-গঞ্জে প্রায় ৬০% পরিবার ছাগল পালন করে থাকে। ছাগলকে গরিবের গাভী বলা হয়। এরা ছোট প্রাণি বলে দাম কম, তাই অল্প খরচে পালন করা যায়। তাছাড়া মূলধন বিনিয়োগ কম।
এরা ছোবড়া ও নিকৃষ্ট মানের খাদ্য গ্রহণ করে পুষ্টিসাধন করে থাকে। যার গাভী কেনার ও পালনের সামর্থ নেই সে অল্প পুঁজিতে দুটি ছাগল কিনে অধিক লাভবান হতে পারে। যে বেকার সেও ছাগল পালন করে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। গাভী থেকে একটি বাহুর পেতে এক বছরের বেশি সময় লাগে। কিন্তু ছাগল হুমাসে একই সঙ্গে কমপক্ষে দুটি বাচ্চা দেয়। এ হিসেবে দুটি ছাগল থেকে বছরান্তে ন্যূনতম আটটি বাচ্চা পাওয়া সম্ভব। এদের লালন-পালন খরচ অনেক কম। ছাগলের মাংস ও চামড়া দুই ই উৎকৃষ্ট। শুধু চামড়া রপ্তানি থেকে বছরে আয় হয় কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের দেশে বর্তমানে ২৫.১২ মিলিয়ন ছাগল আছে। (এআইএস, ২০১৩)।
ছাগলের জাতের শ্রেণীবিভাগ:
ছাগলের জাতকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন—
১. উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণীবিভাগ
২. দেহের আকৃতিভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ
৩. উৎপাদনভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ
৪. জন্মগত ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ
৫. শিংয়ের গঠনের ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ
এদের আকার, আকৃতি, স্বভাব ও উৎপাদন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ছাগলকে সাধারণত দুধ, মাংস, চামড়া ও লোম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। তাই এগুলোর ওপর ভিত্তি করে পশু বিজ্ঞানীরা ছাগলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-
দুধ উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা অধিক দুধ উৎপাদন করে। যেমন- সানেন, বারবারি, টোগেনবার্গ ইত্যাদি।
বাচ্চা উৎপাদনশীল জাতের ছাগল- এরা অধিক বাচ্চা উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, কাজাং ইত্যাদি।
চামড়া উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা উত্তমমানের চামড়া উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, মারাডি ইত্যাদি।
মাংস উৎপাদনকারী জাতের ছাগল- এরা উন্নতমানের মাংস উৎপাদন করে। যেমন- ব্ল্যাক বেঙ্গল, মা-টু ইত্যাদি।
উৎপাদন বৈশিষ্ট্য, উৎপত্তি ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতের শ্রেণিবিন্যাস
উৎপত্তি অনুসারে শ্রেণিবিভাগ :
১। দেশি জাতের ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল :
বাংলাদেশ, ভারতের আসাম ও মেঘালায়ে এ ছাগল দেখতে পাওয়া যাায়। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব জাত। এ জাতের ছাগলের মাংস সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। ছাগল সাধারণত কালো রঙের হয়ে থাকে, তবে সাদা ও বাদামি রঙের ছাগলও দেখা যায়।
এরা সাধারণত আকারে ছোট হয়। এদের কান সোজা ও খাড়া। শিং পিছনের দিকে বাঁকা থাকে। গায়ের রং সাধারণত কালো, তবে ধুসর, বাদামি বা সাদা বা কালো মিশ্রিতও হয়ে থাকে।
গায়ের লোম ছোট ও মসৃণ। এ জাতের ছাগলের মাংস ও চামড়া অত্যন্ত উন্নতমানের। এদের দুধ খুবই অল্প হয়। তবে এরা বছরে দুই বার এবং প্রতিবারে অন্তত দুইটি বাচ্চা দেয়। এদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এ জাতের একটি পুর্ণ-বয়স্ক পাঠার ওজন ২৫-৩০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ১৫-২০ কেজি হয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে এই জাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উৎকৃষ্টমানের চামড়া ও মাংস উৎপাদন, অধিক সংখ্যক বাচ্চা দেয়া এবং প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার ক্ষমতার জন্য এরা সুপরিচিত। বছরে দু’বার এবং একরে ২- ৬টি বাচ্চা দেয়ার দৃষ্টান্ত এদের রয়েছে। দ্রুত বংশ বিস্তারে এই ছাগলের জুড়ি নেই। এদের চামড়া বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়।
চামড়ায় তৈরি জুতো ও অন্যান্য সামগ্রী অত্যন্ত আকর্ষণীয়, আরামদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী বলে স্বীকৃত। এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে বেশি। এরা আকারে ছোট, ছুট বরাবর উচ্চতা মাত্র ১৫ সেমি। পূর্ণব্যস্ত ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে গড়ে ১৩ ও ৯ কেজি। দেহের লোম খাটো, সুবিন্যাস্ত্র, রেশমি ও কোমল। এরা দ্রুত বয়প্রাপ্ত হয়। এদের পা খাটো, কান খাড়া। শিং আকারে ছোট ও কালো এবং ৫-১০ সে.মি. লম্বা হয়।
১৫ মাস বয়সে প্রথমবার বাচ্চা দেয়। এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম, দুয়ের অধিক বাচ্চা হলে দুধের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে বাচ্চা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগে ও মারা যায়। এদের উৎপত্তি সম্বন্ধে তেমন কোনো তথ্য জানা যায় নি। তবে, স্মরণকাল থেকেই এরা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশে এরা কালো ছাগল বলে পরিচিত। এক মাসের দোহনকালে ছাগী ২৫-৩০ লিটার দুধ দেয়। এই দুধ শিশু ও দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য খুবই উপকারী।
বৈশিষ্ট্য:
১. ছাগী বছরে দুবার এবং প্রতিবারে দুই বা ততোধিক বাচ্চা দেয়।
২. দেহের গড়ন আঁটোসাঁটো, পা খাটো।
৩. কান ছোট, সোজা এবং কিছুটা উপরের দিকে থাকে।
৪. ছাগলের মাংস এবং চামড়া উন্নত মানের হয়।
৫. শিং ছোট ও কালো এবং ৫—১০ সেমি লম্বা হয়।
৬. শিং ওপর দিক হতে পিছনে বাঁকানো থাকে।
৭. পুরুষ ও স্ত্রী ছাগলের ওজন যথাক্রমে ২৫—৩৫ কেজি এবং ২০— ৩০ কেজি।
৮. সুষম খাদ্য ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ০.৫—১.০ লিটার দুধ পাওয়া যায়।
৯. প্রথম বাচ্চা প্রসব করার বয়স হচ্ছে ১৩—১৪ মাস।
১০. লোম মসৃণ এবং মোলায়েম।
২। বিদেশি জাতের ছাগল :
বাংলাদেশে যেসব বিদেশি জাতের ছাগল পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে— যমুনাপাড়ি, বিটল, সানেন, টোগেনাবার্গ, অ্যালপাইন ও অ্যাংলোনোবিয়ান উল্লেখযোগ্য। বিটল জাতের ছাগল পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে। অ্যাংলোনোবিয়ান জাতের ছাগল ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে আনা হয়েছে। সানেন ও অ্যালপাইন এর উৎপত্তিস্থল সুইজারল্যান্ড।
যমুনাপাড়ি ভারতের গঙ্গা, যমুনা ও চম্বল নদীর মধ্যবতীর্ এটাওয়া জেলায় এ জাতের ছাগলের আদি বাসস্থান। এরা রামছাগল নামেই বেশি পরিচিত। এটি দুধ উৎপাদনকারী জাত। আমাদের দেশের সীমান্তবতীর্ এলাকায় এ জাতের ছাগল দেখা যায়। এরা খোলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রঙ সাদা, কালো, হলুদ, বাদামি বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণযুক্ত হয়।
২. শরীরের গঠন বেশ হালকা—পাতলা ও লম্বাকৃতির।
৩. পা লম্বাটে এবং পিছনের পায়ে লম্বা ঘন লোম থাকে।
৪. পুরুষ ছাগলের দাড়ি থাকে, স্ত্রী ছাগলের কদাচিৎ থাকে।
৫. এরা মাঠে চরে জীবনধারন করতে পছন্দ করে।
৬. পেছনের পায়ের দিকটায় লম্বাটে চুল থাকে।
৭. লেজ ছোট ও সরু এবং কান লম্বা, চ্যাপ্টা, বাঁকা ও ঝুলন্ত।
৮. শিং ছোট ও চ্যাপ্টা এবং লেজ ছোট ও পাতলা।
৯. বছরে একবার এবং ১টি করে বাচ্চা দেয়।
১০. দৈনিক ১.৫—২.০ লিটার দুধ পাওয়া যায়। চিত্র ১১.৫.২ : যমুনাপাড়ি
১১. পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬৫—৯০ কেজি এবং ৪০—৬০ কেজি।
১২. ঘাড় ও মুখমন্ডলে হালকা বাদামি বর্ণের ছোপ থাকে।
১৩. ওলান বেশ বড় এবং বাটগুলো মোটা, লম্বা, সুসজ্জিত এবং সম আকারের।
১৪. দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
যমুনা পাড়ি ছাগল বা রামছাগল
ভারতের যমুনা ও চম্বল নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে এদের উৎপত্তি। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এবং শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ ছাগল পালন করা হয়। এদের শরীরের রঙ সাদা-কালো, তামাটে বা বাদামী রঙের হয়। এর আকারে বেশ বড়।
এদের শরীরের গঠন হালকা ও লম্বাটে। কান লম্বা ঝুলানো ও বাঁকা। এদের শরীরের লোম লম্বা হয়। এ ছাগল বছরে একবার এবং একটি করে বাচ্চা দেয়। এ জাতের ছাগল দুধের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এরা দৈনিক ২-৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। এ জাতের একটি পূর্ণ বয়স্ক পাঠা ৫০-৬০ কেজি এবং ছাগী ৪০-৫০ কেজি ওজনের হয়ে থাকে ।
এরা ভারতের একটি জনপ্রিয় ছাগল যা দুধের জন্য ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিচিত। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে আজকাল এই জাতের কিছু ছাগল দেখা যায়। এরা আকারে বড়, কান লম্বা ও ঝুলন্ত। এদের দেহের রঙ সাদা, কালো, হলুদ, বাদামি বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণযুক্ত হতে পারে। ওলোনগ্রন্থি সুবিন্যস্ত এবং বড় ও লম্বা বাটমুক্ত।
পা খুব লম্বা; পেছনের পায়ের পেছন দিকে লম্বা লোম আছে। দেহের অন্যান্য স্থানের লোম সাধারণত ছোট। এরা অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু ও চঞ্চল বছরে একবার এবং একটির বেশি বাচ্চা দেয় না। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬৮-৯১ ও ৩৫-৬০ কেজি। এদের শিং খাটো, চ্যাপ্টা ও ২৫-৩০ সে.মি. লম্বা।
ছাগল ও ছাগীর উচ্চতা যথাক্রমে ১১-১২৭ ও ৭৬-১০৭ সেমি। দুধ উৎপাদন ২১৬ দিনে সর্বোচ্চ ১৩৫ লিটার। দৈনিক উৎপাদন গড়ে ৩২ লিটার। ভারতে এদেরকে গরীবের গাडী বলা হ থাকে। এই ছাগলের মাংস ও চামড়া তেমন উন্নতমানের নয়। এরা চরে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগী। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া তাদের নিজস্ব ছাগলের সঙ্গে সংকরায়নের জন্য ভারত থেকে যমুনাপারি ছাগল আমদানি করেছে।
সানেন ছাগল :
সানেন জাতের ছাগলের উৎপত্তি সুইজারল্যান্ডের পশ্চিমাংশে। পৃথিবীর যেকোন দেশের আবহাওয়া এবং পরিবেশ এ জাত খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
সানেন ছাগল
এদের দেহ সাদা বা উজ্জ্বল সাদা খাটো লোমে আবৃত। গলা, কান ও ওলানে কালো দাগ থাকে। সাধারণত শিং থাকে না। এদের পা ছোট, কান সোজা ও সম্মুখমুখী এবং ওলান বড়। ছাগলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে এরা সর্বোচ্চ পরিমাণ দুধ দেয়। পৃথিবীর বহু দেশ, যেমন- অস্ট্রেলিয়া, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ, ভারত, ফিজি, ঘানা, কেনিয়া, কোরিয়া, ইসরাইল, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে এই জাতের ছাগল আমদানি করা হয়েছে। পৃথিবীর যে কেনো অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে এরা নিজদের খাপ খাওয়াতে পারে। এরা দৈনিক ৩.০-৩.৫ লিটার দুধ দেয়। এক দোহনকালের ৩৩৬ দিনে ১৯০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম।
জাতের ছাগল সুইজারল্যন্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যায়। এরা আকারে বেশ বড়। গায়ের রঙ বাদামি বা চকোলেট হয়। দু’পায়ের হাটুর নিচ ও মুখমণ্ডলে সাদা দাগ থাকে। গলা লম্বা, হালকা ও সোজা, কান কালো রঙের কিন্তু ঘাড়ের দিকে সাদা। ছাগল ও ছাগী কারোই শিং থাকে না। ছাগী দৈনিক ৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। ভারত, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভেনেজুয়েলা, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে দুধের জন্য এদের পালন করা হয়। এরা মাঠে চরে খেতে পছন্দ করে। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ৬০-৬৫ ও প্রায় ৭০ কেজি হয়।
বৈশিষ্ট্য:
১. দেহ সাদা বা উজ্জল সাদা লোমে আবৃত।
২. গলা, কান ও ওলানে কালো দাগ থাকে।
৩. সাধারণত শিং থাকে না থাকলেও ছোট।
৪. এদের পা ছোট, কান সোজা এবং ওলান বড়।
৫. ছাগলের বিভিন্ন জাতের মধ্যে এরা সবোর্চ্চ পরিমাণে দুধ দেয়।
৬. পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের আবহাওয়ার সাথে এরা খাপ খাওয়াতে পারে।
৭. এরা দৈনিক ৩.০—৩.৫ লিটার দুধ দেয়।
৮. ওলান গ্রন্থি বেশ বড় হয়।
৯. দুধে চর্বির পরিমাণ ৩.৫%।
১০. পূর্ণবয়স্ক ছাগল ৬০—৭০ কেজি।
১১. কান সোজা এবং সম্মুখ মুখি।
১২. বছরের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কমবেশি ৯৯০ লিটার।
বিতাল / বিটল ছাগল :
বিটল ভারত ও পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছাগলের জাত। এরা দেখতে অনেকটা যমুনাপাড়ির মতো। এটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী জাত। এ জাত আবদ্ধ ঘরে পালনের জন্য উপযোগী এবং এরা সহজেই বিভিন্ন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে। ভারতের পাঞ্জাব, শিয়ালকোট, গুরুদাসপুর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোর এবং বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে পালন করা হয়।
এ জাতের ছাগল কালো, সাদা, বাদামি বা একাধিক রঙের হতে পারে। এদের কান লম্বা হয়। শিং পিছনের দিকে বাঁকা। পূর্ণ বয়সে পাঁঠার ওজন ৫০-৭০ কেজি এবং ছাগী ৪০-৫০ কেজি হয়ে থাকে। এ জাতের ছাগল থেকে দৈনিক ৪-৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।
এই ছাগলের গায়ের রঙ প্রধানত লাল; তবে, লালের মধ্যে সাদা দাগ দেখা যায়। তাছাড়া কালো রঙের ছাগলও ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং অন্ধ্র প্রদেশে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। এদের নাক বাঁকা ও কান লম্বা। ছাগলের দাড়ি আছে, ছাগীর নেই। শিং পেছনের দিকে বাঁকানো। ছাগী দৈনিক গড়ে ৪৫ লিটার এবং এক দোহনকালের ১৩৩ দিনে ৩২০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিতে সক্ষম। এরা মাংস উৎপাদনের জন্যও বিখ্যাত। প্রতি বছর বাচ্চা দেয়। এই জাতের ছাগল খুব কষ্টসহিষ্ণু এবং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।
বৈশিষ্ট্য
১. গায়ের রং প্রধানত লাল, তবে লালের মধ্যে সাদা দাগ দেখা যায়।
২. আকারে বড় হয়, তবে যমুনাপাড়ির চেয়ে কিছুটা ছোট।
৩. পা লম্বা হয়, কান লম্বা এবং ঝুলানো থাকে।
৪. ছাগল বছরে একবার এবং ১ জোড়া বাচ্চা দেয়।
৫. এরা দুধ বেশি দেয়। একটি ছাগী হতে দৈনিক ৩—৪ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।
৬. পুরুষ ছাগলের দাড়ি থাকে কিন্তু ছাগীর দাড়ি নেই।
কাশ্মীরি ছাগল ভারতের কাশ্মীর এদের আদি বাসস্থান। এরা বেশ বড় ও কষ্টসহিষ্ণ হয়। এ জাতের ছাগল লোম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এদের শরীর ১০-১২ সে.মি. লম্বা লোমে ঢাকা থাকে। এদের ওজন ৫০-৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের লোম দিয়ে উন্নতমানের পশমী কাপড় তৈরি হয়। ছাগলের বাসস্থান অন্যান্য প্রাণীর মত ছাগলেরও বাসস্থানের প্রয়োজন।
কাশ্মীরি ছাগল
বৈশিষ্ট্য:
১. গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পার না।
২. গায়ের রঙ সাধারণত সাদা, তবে ধূসর ও বাদামি বর্ণের ছাগল দেখা য়ায়।
৩. শিং লম্বা এবং পেছনের দিকে বাঁকানো। কান ছোট, খাড়া, ফানেলের মতো।
৪. দেহ মোলায়েম সিল্কজাতীয় লোমে আচ্ছাদিত থাকে। এ লোমের নিচে ছাই রঙের পশমিনা থাকে। এ পশমিনা মোটা কম্বল ও শাল তৈরির কাজে লাগে।
৫. এরা ২২ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
অ্যাংগোরা বা অ্যাঙ্গোরা ছাগল:
অ্যাংগোরা ছাগল এদের আদি বাসস্থান তুরস্ক। তবে কোন কোন সোর্স বলে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া এদের আদি বাসস্থল। লোম ও মাংস উৎপাদনের জন্য এরা সুপরিচিত। এদের শরীর লম্বা লোমে ঢাকা থাকে। এটি উন্নতমানের পশম উৎপাদনকারী জাতের ছাগল। এর পশমকে মোহেয়ার বলা হয়। এই জাতের ছাগলের উৎপত্তি মধ্য এশিয়ায়। ১৩০০ শতাব্দিতে তুরস্কের অ্যাংগোরা প্রদেশে এই ছাগল আনা হয়। ফলে ঐঐ প্রদেশের নামানুসারে এর নামকরণ হয় অ্যাংগোরা। ১৮৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ১৮৪৯ সালে আমেরিকা এই ছাগল তুরস্ক থেকে আমদানি করে তাদের দেশে নিয়ে যায় এবং মূল্যবান মোহেয়ারের শিল্প গড়ে তোলে। তুরস্কের সুলতান ১৮৮১ সালে এই জাতের ছাগল যাতে বিদেশে রপ্তানি না হয় সেজন্য এক আইন পাশ করেন।
বর্তমানে নিজস্ব জাতের সাথে সংকরায়নের জন্য ভারত, পাকিস্তান, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই জাতের ছাগলের বিস্তৃতি ঘটেছে অ্যাংগোরা ছোট আকারের ছাগল। উচ্চতায় ৫৪ সেমি, কান কিছুটা ঝুলন্ত। ছাগল ও ছাগী উভয়ই দেখতে খুব চকচকে ও গুচ্ছ লোমযুক্ত। এরা নিয়মিত বাচ্চা দেয়; তবে, বছরে একবার এবং সাধারণত দু’টির বেশি নয়। ছাগল ও ছাগীর দৈহিক ওজন যথাক্রমে ৬৫-৮৫ ও ৪০-৪৫ কেজি। প্রতি দোহনকালে ছাগী ২০-২৫ লিটার করে দুধ দেয়। এরা বছরে ১৫-২০ কেজি পশম উৎপাদন করে। তবে, কোনো কোনো ছাগল ৩ কেজির বেশিও উৎপাদন করে থাকে। এই পশম বছরে দু’বার সংগ্রহ করা হয়।
অ্যাঙ্গোরা ছাগল
বৈশিষ্ট্য:
১. এদের লোম বেশ বড়, প্রায় ১৩—২৫ সেমি লম্বা ও উজ্জ্বল।
২. দুধ উৎপাদন কম, গড়ে দৈনিক ৪০০মিলি।
৩. দুধে চর্বিও পরিমাণ ৫.৭%।
৪. এরা প্রতিবারে ১টি বাচ্চা দেয়।
৫. এদেরকে লোমের জন্য প্রধানত পালন করা হয়।
দেহের আকৃতিভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ:
ছাগলের স্কন্ধ পর্যন্ত উচ্চতার ভিত্তিতে ছাগলের জাতকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
১. বড় জাতের ছাগল: যেমন— অ্যাংগোরা, বিটল, যমুনাপাড়ি ইত্যাদি।
২. ছোট জাতের ছাগল: যেমন কিলিস, ফিজি ইত্যাদি
৩. বামন জাতের ছাগল: যেমন— সুদান, ব্ল্যাক বেঙ্গল ইত্যাদি
বারবারি ছাগল :
এটি আফ্রিকা মহাদেশের ছাগল। তবে বর্তমানে ভারতীয় উপ মহাদেশেও এ জাতের ছাগল পাওয়া যায়। মাংস ও দুধের জন্য এরা যমুনা পাড়ি ছাগলের অনুরূপ।
বারবারি ছাগল
আলপাইন ছাগল:
সানেন এটি উজ্জ্বল সাদা সাদা লোমে ঢাকা ইউরোপীয় জাতের ছাগল। এদের শিং আকারে বেশ বড় হয়। এ জাতের ছাগল দৈনিক ৪-৫ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। এটি অধিক দুধ উৎপাদনকারী জাতের ছাগল। এদের উৎপত্তিস্থল সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের পাদদেশে। ইউরোপের সর্বত্র এই জাতের ছাগল দেখতে পাওয়া যায়। এরা আবদ্ধাবস্থায় খামারে পালনের জন্য খুবই উপযোগী এবং যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে সহজেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে।
এদের দেহের রঙ কালো তবে সাদা ডোরাকাটা দাগ বা সাদা, কালো ও বাদামি ইত্যাদি রঙের মিশ্রণও হতে পারে। বর্তমানে ভারত, মরিসাস, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ঘানা, মাদাগাস্কার, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি দেশে এই ছাগল খামারে প্রতিপালিত হচ্ছে। ছাগী দৈনিক ৪-৫ লিটার দুধ দেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসব ছাগলের দুধ থেকে বহুবিধ দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়।
আলপাইন ছাগল
এংলো নুবিয়ান ছাগল :
এটি একটি সংকর জাতের ছাগল। যমুনা পাড়ি ও মিশরীর জেরিবাই সাথে সংমিশ্রনে এ জাতের উৎপত্তি। ভারতের যমুনাপারি ও মিশরের জারাই বাই জাতের ছাগল হতে এই জাতের উৎপত্তি। চেহারা ও দুগ্ধ উৎপাদনে এদের জুড়ি নেই। দেহের রঙ সাদা, কালো, বাদামি বা মিশ্র হতে পারে। কান ঝুলন্ত এবং সাধারণত শিং থাকে না।
পা লম্বা ও ওলান বড়। সুইজারল্যান্ডে উদ্ভাবিত নুবিয়ান ছাগলের চেয়ে এরা বেশি দুধ দিয়ে থাকে। অ্যাংলো নুবিয়ান থেকে দুধ ও মাংস দু’টোই অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এরা চরে খেতে ভালোবাসে কিন্তু আবদ্ধ অবস্থায় পালন করার জন্যও বিশেষ উপযোগী। এরা অতি সহজে পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। ছাগী দৈনিক ২-৩ লিটার দুধ দেয়। বাচ্চার জন্ম ওজন ২-৪ কেজি। ছাগী ২৪৭ দিনের দোহনকালে প্রায় ২২১ লিটার দুধ দিতে সক্ষম।
এংলো নুবিয়ান ছাগল
মারাডি ছাগল (Maradi)
এটি আফ্রিকার একটি উন্নত জাতের ছাগল। এদের গায়ের রঙ ঘন লাল। ছাগল ও ছাগী কারোরই শিং নেই। গায়ের লোম ছোট, কান খাটো এবং সমান্তরাল। এরা ছোট আকারের, ওজন গড়ে ২৫-৩০ কেছি। এরা শুষ্ক অঞ্চলে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। এদের বিস্তৃতি আফ্রিকার মধ্যেই। এই ছাগলের চামড়া উন্নতমানের ও মূল্যবান। অধিক মাংস উৎপাদনের জন্য এই ছাগল পরিচিত। এমনিতে দৈনিক গড়ে ৭.৫ কেজি ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় ১৫ কেজি দুধ দেয়। সাধারণত দু’বছরে ৩- ৪ বার বাচ্চা দেয়। দোহনকালের ১০০ দিনে প্রায় ১৫০ লিটার দুধ দেয়। এরা সারাবছরই প্রজননক্ষম থাকে।
বোয়ার ছাগল:
এই জাতের পুরুষ ছাগলের ওজন ১০০ থেকে ১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই জাতের স্ত্রী ছাগলের ওজন ৯০ থেকে ১২০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এই জাতের ছাগলের ওজন প্রতি সপ্তাহে প্রায় দুই কেজি করে বাড়ে। বাংলাদেশে এই জাতের ছাগল খুব একটা দেখা যায় না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে এই ছাগল অধিক পরিমানে পালন করা হয়।
মা-টু ছাগল (Ma-Tou)
এটি মধ্য চীনের দুপেছ প্রদেশের একটি উন্নত জাতের ছাগল। অধিক সংখ্যায় বাচ্চা উৎপাদন এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতি ১০০টি ছাগী বছরে প্রায় ৪৫০টি বাচ্চা দিয়ে থাকে। এরা বছরে দু’বার বাচ্চা দেয়। এর মধ্যে ২১.৭% ক্ষেত্রে একটি বাচ্চা, ৭০% ২-৩টি বাচ্চা এবং ৮.৩% ৪টি বাচচা দেয়।
এই জাতের ছাগল দুধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। পূর্ণবয়স্ক ছাগল ও ছাগীর ওজন যথাক্রমে ২৫-৫৫ ও ২০-৪৫ কেজি। ছাগীর দৈনিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ১.৫ লিটার। এদের পশমের রঙ সাদা, এগুলো লম্বা বা খাটো হতে পারে। এদের পা খুবই লম্বা এবং ছাগল বা ছাগী কারোই শিং নেই।
উৎপাদনভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ :
উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—
১. মাংসল জাতের ছাগল: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল
২. দুধের জাতের ছাগল: যেমন— যমুনাপাড়ি
৩. পশম জাতের ছাগল: যেমন— গাড্ডি, অ্যাংগোরা
৪. দ্বৈত জাত: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল
৫. চামড়া উৎপাদক জাত: যেমন— ব্ল্যাক বেঙ্গল
জন্মগত ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ :
জন্মস্থানের ওপর ভিত্তি করে ছাগলের জাতকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।
১. এশিয়ান ছাগল: যেমন— যমুনাপারি
২. আফ্রিকান ছাগল: যেমন— মারাডি
৩. ইউরোপিয়ান ছাগল: যেমন— সানেন
৪. ওরিয়েন্টাল ছাগল: যেমন— মালাবার
বিভিন্ন জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যগুলো জানার ব্যবহারিক পাঠ:
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বিভিন্ন জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা
এই পাঠ শেষে আপনি-
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের আকার, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বলতে পারবেন।
ব্ল্যাক বেঙ্গল এবং যমুনাপারি ছাগলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ
প্রাসঙ্গিক তথ্য
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের একটি অমূল্য সম্পদ। উন্নতমানের মাংস ও চামড়া উৎপাদন এবং ঘন ঘন ও অধিক সংখ্যায় বাচ্চা উৎপাদনের জন্য এই ছাগলের সুনাম বিশ্বজোড়া। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের কান খাড়া, শিং ছোট ও কালো, চামড়া মোটা, লোমের গোড়া চামড়ার কম গভীরে প্রবিষ্ট।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখে প্রথমে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম জেনে নিন।
১. মাথা, ২. গলা ও ঘাড়, ৩ পিঠ, ৪. পাজর, ৫. পেছনের পার্শ্বদেশ বা ফ্ল্যাঙ্ক, ৬. পাছা, ৭ ওলানগ্রন্থি, ৮. পেছনের পা ও হাঁটু, ৯. দুধের বাট, ১০. ওলানের সম্মুখভাগ, ১১. দুগ্ধশিরা, ১২. সামনের পা, ১৩ চোয়াল।
এই নামগুলো পাঠ্যবইয়ে উল্লেখিত ছবির সাথে মিলিয়ে নিন।
এই জাতের ছাগলের আকার, আকৃতি, ওজন, বয়স প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করুন ও খাতায় লিখুন।
ব্যবহারিক খাতায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ছবি এঁকে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পুরো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন এবং শিক্ষককে দেখান।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ও যমুনাপারি ছাগলের মধ্যে পার্থক্যকরণ
প্রাসঙ্গিক তথ্য যমুনাপারি ছাগল দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই জাতের ছাগলের কান লম্বা ঝুলন্ত, পা খুব লম্বা, পেছনের পায়ে লম্বা লোম আছে, শরীরের অন্যান্য স্থানের লোম ছোট।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
একটি যমুনাপারি ও একটি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
প্রথমে একটি যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখে এদের দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম জেনে নিন।
এই দু’জাতের ছাগলের আকার, আকৃতি, ওজন, বয়স প্রভৃতি প্রত্যক্ষ করুন ও খাতায় লিখুন।
যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমুহের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য যাচাই করুন। ব্যবহারিক খাতায় পাশাপাশি যমুনাপারি ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ছবি এঁকে এদের দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।
দু’জাতের ছাগলের বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পুরো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়াটি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিখুন এবং শিক্ষককে দেখান।
মহিষের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের এই পাঠটি ১১ নং ইউনিটের ১১.৪ নং পাঠ। এই পাঠে আমরা বিভিন্ন ধরণের মহিষের জাত ও তদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো। মহিষ অন্যতম গৃহপালিত স্তন্যপায়ী। মহিষ মুখ্যত উত্তর গোলার্ধের এক প্রজাতি এবং চেহারায় গরুর সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। উত্তর আমেরিকার বাইসনকে (bison) অনেক সময় মহিষ বলা হলেও প্রকৃত মহিষের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই।
মহিষের জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের সব এলাকেতেই মহিষ পালন করা হয়ে থাকে। তবে বিশেষ নদীর চর, সমুদ্র উপকূল দ্বীপাঞ্চল এবং হাওর-বাঁওড় এলাকায় মহিষ পালন করা হয় বেশি। এদেশে গৃহপালিত মহিষের সংখ্যা প্রায় ১.৪৭ মিলিয়ন(বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫-২০১৬)। মহিষ প্রধানত হালচাষ ও গ্রামীণ পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। তবে মহিষের দুধ ও মাংস উৎকৃষ্ট খাদ্য। এ ছাড়া মহিষের গোবর জৈব সার ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মহিষের হাড় পন্যসামগ্রী যেমন বোতাম, চিরুনি ইত্যাদি তৈরি এবং গবাদি প্রাণিখাদ্য ও সার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
মহিষে জাতের শ্রেণীবিভাগ
গৃহপালিত মহিষের জাতগুলোকে আবাসস্থান ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি কওে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- জলাভূমি মহিষ বা কাদাপানির মহিষ (Swamp Buffalo) এবং নদী মহিষ বা পরিষ্কার পানির মহিষ (River Buffalo)।
জলাভূমির মহিষ (Swamp Buffalo ):
জলাভূমির মহিষের বুক সাধারণত চওড়া, দেহ মাংসল ও গোলাকৃতির যা দেখতে অনেকটা ব্যারেলের মতো। এদের শিং বেশ চওড়া, লম্বা ও চন্দ্রাকৃতির। ষাঁড় ও গাভীর ওজন সাধারণত যথাক্রমে ৫০০ ও ৪০০ কেজি। ষাঁড় ও গাভীর উচ্চতা
সাধারণত গড়ে ১৩৫ সে.মি, হয়ে থাকে। এদের পা খাটো এবং কপাল ও মুখমন্ডল চ্যাপ্টা। গায়ের রং গাঢ় ধূসর থেকে সাদা হয়। চামড়ার রঙ নীলচে কালো থেকে ধূষর কালো হয়ে থাকে। গলকম্বলের উপরিভাগ থেকে গলার পাদদেশে পর্যন্ত বক্রাকৃতির দাগ থাকে। এরা অত্যন্ত কম দুধ উৎপাদন করে, দৈনিক গড়ে ১ লিটারের মতো যা বাছুরের জন্যই যথেষ্ট নয়। এরা ৩৯৪ দিনে গড়ে মাত্র ৩৩৬ লিটার দুধ দিয়ে থাকে।
শারীরিক বৃদ্ধির হার কম, ফলে বয়: প্রাপ্তি বিলম্বে ঘটে; সাধারণত তিন বছরের পূর্বে পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটে না। গর্ভকালে ৩২৫—৩৩০ দিন। সাধারণত নিচু কর্দমাক্ত জলাভূমিতে থাকতে পছন্দ করে, কাদায় গড়াগড়ি দেয় এবং জলাভূমি ও আইলের মোটা অঁাশজাতীয় ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। এরা প্রধানত শক্তির কাজেই পটু। তাই হাল, মই ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম কিন্তু মাংসের জন্য ভালো।
জলাভূমির মহিষ
কোয়া কাম ও কোয়াইটুই (Kwua Cum and Kwaitui)
এই দু’জাতের মহিষ থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। কোয়াইটুই মহিষের দেহ দীর্ঘ ও প্রশস্ত। গায়ের রঙ কালো, চামড়া পুরু, মুখমণ্ডল লম্বা। গাভীর গলা সরু। উচ্চতা ও ওজন গড়ে যথাক্রমে ১৪০ সে.মি. ও ৪৫০ কেজির মতো।
কোয়াদুরে মহিষ (Kwa kui)
এরা আকারে তুলনামূলভাবে খাটো। দেহ ও গলা সরু, ঘাড় সরু, মুখমণ্ডল লম্বা। গায়ের রঙ হালকা ধূসর। উচ্চতা ও ওজন গড়ে যথাক্রমে ১৩০ সে.মি ও ৩৫০ কেজির মতো। এরা হাল-চাষ ও ভারবাহী জন্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কোয়াইয়া (Quipra)
এই উপজাতের মহিষ ধাইল্যান্ডের মি সড টক (Mae Sod Tak) অঞ্চলে দেখা যায়। এরা আকারে ছোট। ওজন ৩০০-৩৫০ কেজির মতো। বন্য স্বভাবের কারণে এদের কদর তুলনামূলকভাবে কম।
ম্যারিড (Marid)
এই উপজাতের মহিষ মায়ানমারে দেখা যায়। মায়ানমারের সমতলভূমির মহিষ থেকে এরা আকারে ছোট। দেহের কালো লোমগুলো দীর্ঘ, সরু ও খাড়া। ধড় ও গাভীর ওজন গড়ে যথাক্রমে ৩০০ ও ৩২৫ কেজির মতো।
লাল মহিষ (Red Buffalo )
এই উপজাতের মহিষ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে দেখা যায়। এদের দেহ ঘন ও লম্বা লাল রঙের লোমে আবৃত থাকে। তাই এদের নাম লাল মহিষ। এদের দৈহিক ওজন গড়ে সাধারণত ৩৫০ কেজি হয়ে থাকে। তবে, গায়ের রঙ, দেহের গঠন ও ব্যবহারর দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জলাভূমির মহিষের সঙ্গে ভারতের আসামের পশ্চিমাঞ্চলের মহিষের পার্থক্য দেখা যায়।
এদের গায়ের রঙ কালো। শিং অনেকটা কাস্ত্রের মতো থাকা। এরা প্রধানত দুধ উৎপাদনকারী জাত। বিজ্ঞানী মিলেণর ১৯৩৯ সালে এদেরকে নদীর মহিষ হিসেবে নামকরণ করেন। এদের উৎপত্তি ভারত ও পাকিস্তানে, কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চালেও এদের দেখতে পাওয়া যায়।
মনিপুরি মহিষ
মনিপুরি মহিষ
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান
আসামের অন্তর্গত মনিপুর এদের আদি বাসস্থান। আসামের প্রায় সর্বত্র এবং বাংলাদেশের সিলেটে দেখতে পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
এদের গায়ের রঙ ধূসর। এরা সুঠাম দেহের অধিকারী। মাথা অপেক্ষাকৃত ছোট। শিং বড় এবং ভেতরের দিকে বাঁকানো। এরা সব রকমের খাদ্যে অভ্যস্থ। এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ধাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে প্রায় ৫০০ ও ৬০০ কেজি।
নদীর মহিষ:
নদীর মহিষের বুক প্রশস্ত, দেহ সাধারণত মাংসল ও অপেক্ষাকৃত কম গোলাকৃতির। শিংয়ের আকার ও আকৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। ভারত এবং পাকিস্তানে নদীর মহিষের অনেকগুলো জাত দেখা যায়। মহিষ ষাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৩০০-৭০০ ও ২৫০-৬৫০ কেজি হয়।
সাধারণত মহিষ ষাঁড় ও গাভীর উচ্চতা যথাক্রমে ১২০-১৫০ ও ১১৫-১৩৫ সে.মি. হয়। নদীর মহিষের দেহ তুলনামূলকভাবে লম্বা, বুকের বেড় কম, পা খাটো, মাথা ভারি, কপাল প্রশস্ত ও মুখাকৃতি লম্বা। নদীর মহিষের শিংয়ের আকার জলাভূমির মহিষের মতো নয় এবং শিংয়ের অবস্থান ঠিক কপালের একই জায়গায় নয়। এই মহিষের শিং দু’প্রকার। যথা- গোলাকৃতি ও সোজা। এরা সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র স্থানে বাস করতে পছন্দ করে এবং পানির মধ্যে দেহ ডুবিয়ে রাখে। বিভিন্ন জাতের নদীর মহিষের মধ্যে মুররা, নীলি, রাভি, সুরাটি, মেশানা, জাফরাবাদি ইত্যাদি প্রধান। এখানে নদীর মহিষের কয়েকটি জাতের উৎপত্তি, প্রাপ্তিস্থান ও বৈশিষ্ট্যাবলী উল্লেখ করা হয়েছে।
উন্নত জাতের মহিষের মধ্যে মুররা, নিলি রাভি, মনিপুরী, জাফরাবাদী, নাগপুরী, কুন্ডি, সুরাটি, টোডো, মন্ডা, সম্বলপুরী, টরাই, মেহসানা উল্লেখযোগ্য। মুররা, নিলি রাভি জাতের মহিষ সরকারী খামারে ( মহিষ প্রজনন খামার, বাগেরহাট) পালন করা হয়।
নীলি মহিষ :
এ জাতের মহিষের সাথে মুররা মহিষের বেশ মিল আছে। এদের অনেক বৈশিষ্ট্য প্রায় এক রকম। বিজ্ঞানীদের মতে মুররা জাত থেকেই এদের উদ্ভব হয়েছে। তবে আকার, মুখাকৃতি ও কপালের মধ্যে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার শতদ্রু নদীর উভয় পাশে এদের আদি বাসস্থান। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নীলি জাতের মহিষ পাওয়া যায়। শতদ্রু নদীর নীল পানির বর্ণনায় এদের নামকরণ নীলি রাখা হয়েছে।
নীলি মহিষ
জাত বৈশিষ্ট্য:
এদের গায়ের ও পশমের রং কালো। কিন্তু ১০—১৫% বাদামি রঙেরও দেখা যায়। দেহাকৃতি মাঝারি ধরনের। কপাল, মুখ, থুতনি, পা এবং লেজের অগ্রভাগে সাদা চিহ্ন দেখা যায়। অনেকটা লম্বাকৃতির মাথার উপরিভাগ স্ফীত এবং দুচোখের মধ্যবর্তী স্থান একটু চাপা। ওলান এবং সিনায় মাঝে মাঝে পিঙ্গল চিহৃ দেখা যায়। শিং ছোট ও শক্তভাবে প্যাঁচানো ঘাড় লম্বা, চিকন ও মসৃণ। ওলান উন্নত লেজ লম্বা। ষাঁড় ও গাভী মহিষের গড় উচ্চতা যথাক্রমে ১৩৭ ও ১২৭ সে.মি. এবং দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৫৭ ও ১৪৭ সে.মি.।
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান
পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার শতদ্রু নদীর উভয় পার্শ্বে এদের আদি বাসভূমি। ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে নীলি জাতের মহিষ পাওয়া যায়৷ শতদ্রু নদীর নীল পানির বর্ণনায় এদের নামকরণ নীলি রাখা হয়েছে।
রাভি মহিষ
রাভি মহিষ :
এ জাতের মহিষ দুধের জন্য প্রসিদ্ধ। পাক—ভারতের অন্তর্গত রাভি নদীর উভয় পাশে^র্ এদের আদি বাসভূমি। এজন্য এদের নাম রাভি রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলা, ওকারা, মন্টগোমারি, ভারতের গুজরাট ও চিনাব নদীর উপতাকায় এবং ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে এদের পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
রাভি মহিষ বৃহদাকৃতির দেহের অধিকারী। গাভীর মাথা মোটা ও ভারি। মাথার মধ্যভাগ উত্তল, শিং প্রশস্ত, মোটা ও কোকড়ানো। থুতনি স্পষ্ট, ওলান সুগঠিত। লেজ বেশ লম্বা এবং প্রান্তদেশে সাদা লোম আছে। গায়ের রং কালো, তবে কোনো সময় বাদামি রঙেরও হয়। ষাঁড় ও গাভী মহিষের উচ্চতা যথাক্রমে ১৩২ ও ১২৭ সেমি এবং দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৫৪ ও ১৪৯ সেমি এবং ওজন যথাক্রমে ৬০০ ও ৬৪৫ কেজি।
মুররা মহিষ :
এ জাতের মহিষের উৎপত্তিস্থল ভারতের উত্তর—পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে, দিল্লির আশপাশ এলাকা। বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে এ জাতের মহিষ বেশি পাওয়া যায়। এটি দুগ্ধপ্রদানকারী বিশেষ জাত।
মুররা মহিষ
বৈশিষ্ট্য:
১. এদের দেহ আকারে বেশ বড় হয়।
২. শিং ছোট এবং বাঁকানো হয়।
৩. গায়ের রং সাধারণত কালো হয়।
৪. স্ত্রী মহিষের পিছনের তুলনায় সম্মুখ ভাগ হালকা হয়।
৫. এরা দুধের জন্য প্রসিদ্ধ।
৬. একটি গাভী মহিষ দিনে প্রায় ২২—২৭ লিটার দুধ দিয়ে থাকে।
৭. কপাল বড়, চওড়া ও উন্নত।
৮. পা খাটো, মোটা এবং ওলানগ্রন্থি খুব বড়।
৯. দেহের পশ্চাৎ ভাগ অপেক্ষাকৃত চওড়া ও ভারী।
১০. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন কম বেশি ৫৬৭ ও ৫৩০ কেজি।
১১. বলদ মহিষ হালচাষ ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়।
জাফরাবাদি গাভী দুধ উৎপাদনকারী এবং ষাঁড় চাষাবাদ ও গাড়ি টানার জন্য বিখ্যাত।
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান
ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের গুজরাট, গির অরন্য ও জাফরাবাদ শহরের আশেপাশে এই জাতের মহিষ দেখা যায়। জাফরাবাদের নামানুসারে এদেরকে জাফরাবাদি বলা হয়।
জাত বৈশিষ্ট্য
এরা আকারে বড়, দেহ গভীর ও সুগঠিত। কপাল স্ফীত, শিং ভারি এবং চ্যাপ্টা। গায়ের রঙ কালো তবে মুখ, পা এবং লেজে সাদা দাগ দেখা যায়। ঘাড় মাংসল, গলকম্বল ও ওলান সুগঠিত। এদের দেহ লম্বাটে, পা লম্বা ও সরু, লেজ খাটো। ষাঁড় ও গাভী মহিষের ওজন যথাক্রমে ৫৯০ ও ৪৫০ কেজি। গাভী দিনে গড়ে ১৫-২০ লিটার দুধ দেয়। দুধে চর্বির পরিমাণ খুব বেশি। ষাড় চাষাবাদ ও গাড়ি টানার কাজে ব্যবহৃত হয়।
মেশানা জাতের মহিষ
মেশানা মহিষ
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান
গুজরাট প্রদেশের বারোদা অঞ্চল ও মেশানা জেলা এদের আদি বাসস্থান। মুররা এবং সুরাটি মহিষের সংকরায়নের মাধ্যমে মেনশানা জাতের উৎপত্তি ।
জাত বৈশিষ্ট্য
এরা মুররা এবং সুরাটি মহিষের মধ্যবর্তী, দেহে দু’জাতেরই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। গায়ের রঙ কালো, বাদামি বা ধূসর। মুখমন্ডল, পা এবং লেজের অগ্রভাগে সাদা দাগ আছে। দেহ লম্বা এবং সুগঠিত। কপাল প্রশস্ত্র, মাঝের অংশ কিছুটা নিচু, শিং কোকড়ানো এবং দেখতে কাস্ত্রের মতো কান মাঝারি এবং অগ্রভাগ চোখা।
ঘাড় মাংসল, সুগঠিত, গলকম্বল নেই। বুক প্রশস্ত, কাঁধ চওড়া এবং দেহের সাথে সুবিনাস্ত্র, পা মাঝারি আকারের। ওলান সুগঠিত ও উন্নত। ষাঁড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৪৫০ ও ৬৫০ কেজি। এই জাতের মহিষ ভারতের গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দুধ ও ঘি সরবরাহের জন্য সুপরিচিত। দুধ উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। এরা নিয়মিত বাচ্চা প্রদানের জন্যও বিখ্যাত।
বাংলাদেশের মহিষ:
বর্তমানে বাংলাদেশে মহিষের সংখ্যা প্রায় ৬,২১,৪৭। এর মধ্যে প্রায় ৫৪,০০০ মহিষ শক্তির কাছে নিয়োজিত থাকে। তবে এদেশে মহিষের কোনো উল্লেখযোগ্য জাত নেই । উপকূলীয়, হাওর এবং আখ উৎপাদনকারী এলাকাসমূহে মহিষের বিস্তৃতি তুলনামূলক ভাবে বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের মহিষকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— নদী, জলাভূমি এবং নদী ও জলাভূমির মহিষের সংকর। দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যে সমতলভূমিতে নদীর মহিষ দেখা যায়। এরা প্রধানত ভারতের দক্ষিণ, মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের মহিষের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। দেশের পূর্বাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় জলাভূমির মহিষ ও সংকর মহিষের অবস্থান।
দূরপ্রাচ্যের জলাভূমির মহিষ ও আদি মহিদের সাথে এদের বেশ মিল রয়েছে। বাংলাদেশের জলাভূমির মহিষ মূলত শক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের দুধ উৎপাদনের পরিমাণ খুব কম। দক্ষিণাঞ্চলে ছোট ছোট কৃষক পরিবারে ১-৪টি পর্যন্ত মহিষ দেখতে পাওয়া যায়। গাভী দিনে ১-৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে। দুধ প্রধানত মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গরুর দুধের চেয়ে মহিষের দুধ বাজারে কম দামে বিক্রি হয়।
দুধে স্নেহের ভাগ বেশি। গবাদিপশুর মাংসের মধ্যে মহিষের মাংস বাজারে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। গাড়ি টানা, ঘানি টানা, হালচাষ, সেচকার্য, ধান মাড়াই প্রভৃতি শক্তির কাছে এরা ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মহিষ প্রধানত দেশী মহিষ হিসেবেই পরিচিত। দেহের আকার, পাড়েন এবং রঙের দিক থেকে এদের মধ্যে বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শিংয়ের আকার এবং পড়নও ভিন্নতর। প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদা, পশুশক্তির ঘাটতি প্রভৃতি মেটানোর জন্য উন্নত প্রজনন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদেশের মহিষের উন্নতি অত্যাবশ্যক।
অনুশিলন:
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বিভিন্ন জাতের মহিষের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা।
এই পাঠ শেষে আপনি-
দেশী মহিষের আকার, আকৃতি বলতে পারবেন।
দেশী মহিষের সাথে উন্নত জাতের মহিষের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন।
গরু ও মহিষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
বাংলাদেশের সিলেট জেলায় মনিপুরি মহিষ দেখা যায়। এরা প্রধানত মাংস উৎপাদন, হালচাষ বা পরিবহণের জন্য উপযোগী। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কোনো অঞ্চলে মুররা জাতের কিছু মহিষ দেখা যায়। মুররা ও মনিপুরি জাতের মধ্যে দৈহিক এবং উৎপাদনগত পার্থক্য নিরূপন করা যায়।
মহিষ ও গরুর মধ্যে পার্থক্য খুব বেশি নয়। মহিষের গলকম্বল নেই, দেহে লোম খুব কম, জলাভূমির মহিষের শিং বড় ও অনেকটা কাস্ত্রের ন্যায়। তাছাড়া আকারে মহিষ সাধারণত গরু থেকে বড় হয়ে থাকে। এছাড়া বাকি সবগুলো বৈশিষ্ট্য মহিষের ক্ষেত্রে গরুর মতোই।
প্রয়োজনীয় উপকরণ
একটি মহিষ ষাড় বা গাভী, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
প্রথমে একটি মহিষ দেখে তার অঙ্গপ্রতঙ্গের নাম জানুন ও খাতায় আঁকুন ।
যেসব কৃষকের বাড়িতে মহিষ আছে তাদের বাড়ি যান এবং প্রত্যক্ষভাবে মহিষের আকার,
আকৃতি ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করুন। মহিষের জাতসমূহের বৈশিষ্ট্যের সাথে আপনার দেখা মহিষের
বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে দেখুন এবং ব্যাবহারিক খাতায় লিখুন।
মহিষ দেখার পর তার জাত বৈশিষ্ট্যসমূহ ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করুন।
সতর্কতা
প্রত্যক্ষভাবে মহিষ দেখার সময় সতর্কতার সাথে অগ্রসর হোন।
সারমর্ম :
বাংলাদেশের সিলেট জেলায় মনিপুরি মহিষ আছে যা প্রধানত মাংস উৎপাদন, হালচাষ বা পরিবহণের জন্য উপযোগী। এদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে মুররা জাতের মহিষও দেখা যায়। মহিষ ও গরুর মধ্যে পার্থক্য অল্প। মহিষের গলকম্বল নেই, দেহে লোম কম, জলাভূমির মহিষের শিং বড় ও কাস্তের ন্যায়। সাধারণত আকারেও এরা বড় হয়ে থাকে। এছাড়া বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো গরুর মতোই।
গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করবো আজ। গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র বিষয়ের ১১ নং ইউনিটের, ১১.৩ নম্বর পাঠ। গবাদি প্রাণির মধ্যে গরু প্রধান। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ২—৪ টি গরুপালন করতে দেখা যায়। এমনকি আজকাল শহর ও শহরতলিতেও গরু পালনের গুরুত্ব বেড়েছে।
লাল চট্টগ্রাম
গরুর জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের গরু পাওয়া যায়। গরুর জাতকে ২টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যথা — ক) উৎপত্তির ভিত্তিতে ও খ) উৎপাদন বা ব্যবহারের ভিত্তিতে।
উৎপত্তির ভিত্তিতে গরুর জাতভেদ:
দেশি জাতের গরু
বিদেশি উন্নত জাতের গরু
উন্নত সংকর জাতের গরু
দেশি জাতের গরু:
কখন, কীভাবে এদেশে গরুর গৃহপালিতকরণ (domestication) হয়েছিল তার কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় নি। তবে, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার সময়কাল থেকেই সম্ভবত গরুর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে যে গরু পালিত হয়ে আসছে এরা জেবু অর্থাৎ বস ইন্ডিকাস ( Bos indicus) প্রজাতিভুক্ত।
এদেশের আবহাওয়ার সাথে ভালোভাবে খাপ খেয়ে বেঁচে থাকা এদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বস ইন্ডিকাসের অনেকগুলো জাত ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ অঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তেমন কোনো গরুর জাত ছিল না। যা ছিল তার সবই দেশী গরু।
১৯৩৭ সালের দিকে ভারতের তদানিন্তন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো বর্তমান বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে বস ইন্ডিকাস প্রজাতির বিশুদ্ধ গরুর জাত, যেমন- হারিয়ানা, সিন্ধি, শাহিওয়াল আনেন (আলী, ১৯৮৫)। বস টরাস ( Bos taurus) প্রজাতির উন্নত জাতের গরু, যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি প্রভৃতি আনা হয় ১৯৭৪ সালে (আলী, ১৯৮৫)।
নিয়মিত কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব জাতের ষাঁড়ের বীজ দেশী গাভীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয় যা এখনও চলছে। এই সংকর জাতের গরুগুলো বর্তমানে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায়। এর উদ্দেশ্য উৎপাদন বাড়ানো। বর্তমানে বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস ছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ঘন জঙ্গলে মিথুন বা গয়াল অর্থাৎ বস ফ্রন্টালিস ( Bos frontalis) প্রজাতির গরু দেখা যায়। বস ফ্রন্টালিস একটি বন্য প্রজাতির গরু। এদের বংশধরদের এখনও পোষ মানানোর চেষ্টা চলছে।
বাাংলাদেশে আদিকাল থেকে যে জাতের গরু পালন করা হচ্ছে সেগুলোকে দেশি জাতের গরু বলা হয়া। দেশি জাতের গরু মূলত পরিশ্রমী জাত। এ জাতের বলদ কৃষিকাজ ও ভার বহনের কাজে বেশ উপযোগী। তবে চট্টগ্রাম, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর এবং ঢাকার কিছু এলাকায় বেশকিছু দেশি জাতের গরু আছে যেগুলো আকারে কিছুটা বড় হয় এবং এগুলো থেকে বেশি পরিমাণে দুধ পাওয়া যায়। দেশি জাতের গরুর মধ্যে পাবনাইয়া, লাল চাঁটগাঁ, ফরিদপুর দেশি ছোট গরু প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের গরুর শ্রেণিবিন্যাস
উৎস অনুসারে বাংলাদেশের গরুকে নিম্নলিখিত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক) স্থানীয় – দেশী টাইপ এবং লাল চাঁটগেয়ে।
খ) বিদেশী – হারিয়ানা, শাহিওয়াল, সিদ্ধি, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ও জার্সি।
গ) সংকর – দেশী গাভী X বা টরাস প্রজাতির গরু এবং
দেশী গাভী X মিথুন বা গয়াল
দেশী গরুর প্রথম বাচ্চা প্রসবের গড় বয়সকাল ৪৫ মাস। বর্তমানে মাত্র ২% গাভী কৃত্রিম প্রজননের আওতায় আনা গেছে। প্রতিটি গাভী গড়ে ১৩ কেজি দুধ দেয় এবং গড়পড়তা দোহনকাল (lactation period) সময় ৭-৮ মাস (বিবিএস, ১৯৯৪)।
দেশি জাতের বৈশিষ্ট্য:
১. আকারে ছোট, পরিশ্রমী, কুঁজ উচু।
২. প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর ওজন গড়ে ২৫০ কেজি।
৩. মাংস বেশ সুস্বাদু।
৪. গাভী হতে দৈনিক ১—৩ লিটার দুধ পাওয়া যায়।
৫. গাভীর গড়পড়তা দোহনকাল ৭—৮ মাস।
নিচে কয়েকটি দেশি জাতের গরুর বিবরণ দেওয়া হল।
লাল চট্টগ্রাম গরু:
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম লাল চাটগেয়ে গরুর আবাসভূমি। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বত্রই এদের পাওয়া যায়। এদের উৎপত্তি, উৎপাদন এবং দৈহিক বৈশিষ্ট্য প্রায় দেশী গরুর মতো, তবে আকারে বড়। এদের গায়ের রঙ, শিং ও ক্ষুর লাল বলে এরা লাল চাটগেয়ে (Red Chittagong) নামে পরিচিত। বাংলাদেশের গরুর মধ্যে এরা ভালো জাতের।
এরা আকারে মাঝারি, গায়ের রঙ হালকা লাল, শিং পাতলা এবং ভেতরের দিকে আংশিক বাঁকানো। গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন। মুখমণ্ডল, থুতনি ও পেটের নিম্নাংশ আপেক্ষাকৃত হালকা রঙের। গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ২৫০-৩০০ ও ৩৫০-৪০০ কেজি। দৈনিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২-৫ লিটার। ওলানগ্রন্থি বেশ সুঠাম, তবে বাট আকারে ছোট। বাণিজ্যিক খামারের জন্য এ জাতের গরু মোটেও সুবিধাজনক নয়। তবে, পারিবারিক খামারে পালনের জন্য মোটামুটি ভালো।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রঙ লাল, মুখ খাটো ও চওড়া।
২. গরু দেখতে ছোটখাটো, পেছনের দিক বেশ ভারি।
৩. চামড়া পাতলা, শিং ছোট ও চ্যাপ্টা।
৪. ওলানের শিরা বেশ স্পষ্ট এবং ওলান বেশ বড়।
৫. গাভী দৈনিক ২—৩ লিটার দুধ দেয়।
৬. পূর্ণবয়স্ক ষাড় ও গাভীর ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি ও ২৫০—৩০০ কেজি।
৭. লেজ যথেষ্ট লম্বা এবং শেষ প্রান্তের চুলের গুচ্ছ লাল বর্ণের।
৮. গলকম্বল ছোট এবং ঘাড় চিকন।
৯. মাথা ছোট ও পোল উন্নত।
১০. দুধে চর্বির পরিমাণ ৪—৫%।
দেশি ছোট গরু:
এই ধরনের গরু বাংলাদেশের সর্বত্রই দেখা যায়। এরা আকারে ছোট, গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ হতে পারে। গাভী ও ষাঁড়ের গড় দৈহিক ওজন যথাক্রমে ১৫০-২০০ ও ২২৫-২৫০ কেজি। এদের মাথা ছোট এবং অনেকটা বর্গাকৃতির।
কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা। শিং চোথা এবং সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো। কান ও চুট ছোট এবং উন্নত। গলকম্বল মাঝারি গড়নের। ষাঁড়ের প্রজননতন্ত্রের আবৃত চামড়া বা থলে আকারে ছোট। দেশী গরু খুবই কষ্টসহিষ্ণু এবং এরা প্রধানত শক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। একেকটি গাভী গড়ে ০.৬ লিটার দুধ দেয়। এদেরকে দ্বৈত ব্যবহারোপযোগী পশু বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
১. এরা আকারে ছোট এবং শান্ত প্রকৃতির।
২. গায়ের রঙ সাদা, কালো, লাল, কাজলা বা বিভিন্ন রঙ— এর মিশ্রণ হতে পারে।
৩. মাথা ছোট এবং অনেকটা বগার্কৃতির।
৪. কপাল চওড়া ও চ্যাপ্টা।
৫. শিং চোখা ও সামনে ও উপরের দিকে বাঁকানো।
৬. গাভী দৈনিক ০.৫—১ লিটার দুধ দেয়।
৭. দুধে চর্বির পরিমাণ কম।
মাঝারি আকারের দেশী গরু
মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও পাবনার শাহজাদপুরে বেশ কিছু উন্নত ধরনের গরু দেখা যায় যাদের উৎপাদন মোটামুটি ভালো। মাঝারি আকারের এ গরুগুলো অন্যান্য অঞ্চলের গরুর চেয়ে বড়। এ অঞ্চলগুলোতে এদেরকে দুধ উৎপাদনের গরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে, এরা কোনো জাত নয়। মূলত এরা দুধ উৎপাদন ও ভারবাহী পশু হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। বৃটিশ আমলে শাহিওয়াল, সিন্ধি ও হারিয়ানা জাতের কিছু ষাঁড় এসব অঞ্চলে আনার ফলেই এ অঞ্চলের গরুর উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এ অঞ্চলগুলোতে প্রচুর ঘাস পাওয়া যায় বলে এদের উৎপাদন ক্ষমতা এখনও টিকে আছে।
বিদেশি উন্নত জাতের গরু:
আমরা জানি, প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের বিভিন্নতা প্রাণীর জাত নির্ধারণ করে। এজন্য বিদেশী উন্নত গরুর জাত ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করার আগে এদের পূর্ব বংশধরদের কথা জানা উচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানকালের গরুর পূর্বপুরুষ বা টরাস ও বস ইন্ডিকাস প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
ইউরোপের সকল গরু বা টরাসের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রজাতির প্রধান শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের কোনো চুট নেই। যেমন- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, জার্সি, আয়ারশায়ার, ব্রাউন সুইস প্রভৃতি জাতের গরু। কা ইন্ডিকাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এদের চুট আছে এবং কোনো কোনো জাতের ক্ষেত্রে তা বেশ বড়। সিদ্ধি, শাহিওয়াল, হারিয়ানা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ।
বাংলাদেশে যে সকল বিদেশি উন্নত জাতের গরু পাওয়া যায় সেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা— ইউরোপীয় জাতের গরু এবং উপমহাদেশীয় গরু।
ইউরোপীয় জাতের গরুর মধ্যে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান, জার্সি, ব্রাউন সুইস, আয়ারশায়ার উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে হলস্টেন ফ্রিজিয়ান এবং জার্সি ষাঁড় প্রজননের কাজে ব্যবহার করা হয়। এদের কুঁজ নেই।
সারণি ১০ : বস টরাস ও বস ইন্ডিকাস গরুর মধ্যে পার্থক্য
প্রাণিজগতে গরুর শ্রেণিবিন্যাস
জগৎ (Kingdom)ঃ প্রাণিজগৎ (Animalia)
পর্বঃ মেরুদন্ডী প্রাণী (Cordata)
শ্রেণী (Class): স্তন্যপায়ী প্রাণী (Mammalia) যারা বাচ্চা প্রসব করে ও বাচ্চাকে দুধ পান করায়
বর্গ (Order): জোড় খুরবিশিষ্ট প্রাণী (Artiodactyla)
গোত্র (Family): বভিডি (Bovidae) – রোমন্থক প্রাণী যারা জাবর কাটে।
গন (Genus): বস (Bas) – চতুষ্পদ প্রাণী, বন্য এবং গৃহপালিত, শক্তিশালী দেহ।
প্ৰজাতি (Species)ঃ Bos taurus, Bos indicus, Bos frontalis ইত্যাদি।
গরুর বিভিন্ন জাতকে তিন উপায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-
উৎপত্তি বা আকার অনুসারে
ব্যবহার বা কাজ অনুসারে
জাতির মৌলিকত্ব বা বিশুদ্ধতার পরিমাণ দিয়ে
উপত্তি ও আকার অনুযারী জাতের শ্রেণিবিন্যাস:
বস প্রমিজেনিয়াস (Bas promigenious) : উদাহরণ- হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান, আয়ারশায়ার ইত্যাদি।
বস ব্র্যাকিসেফালাস (Bas brachycephalus) : উদাহরণ- কেরি, সাসেক্স, হারফোর্ড ইত্যাদি।
হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু
হলস্টেন ফ্রিজিয়ান গরু:
এই দুধাল জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান হল্যান্ডের ফ্রিজল্যান্ড। বর্তমানে প্রথিবীর প্রায় সর্বত্র পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান দুধাল জাতের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের গরু। গাভীর গড়পড়তা ওজন ৭৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ১১০০ কেজি। শরীর বেশ পুষ্ট, পেছনের অংশ ভারি এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়। পেছনের পা সোজা, লম্বা এবং অপেক্ষাকৃত সরু, মাথা ও শরীর পেশিযুক্ত। গাভী শান্ত প্রকৃতির, কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি। গো-চারনের অভ্যাস মাঝারি ধরনের। এদের গায়ের রঙ সাদা, কালো মিশ্রিত। উভয় রঙের কোনো একটির প্রাধান্য হতে পারে। জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০-৪৫ কেজি হয়, বয়ঃপ্রাপ্তি দেরিতে ঘটে। এজাতীয় গাভী বছরে ৪৫০০-৯০০০ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। দুধে চর্বির পরিমাণ মাত্র ৩.৫%। দুধ উৎপাদনকারী গাভীর মধ্যে এরা অধিক দুগ্ধদানের জন্য বিখ্যাত।
১. এ জাতের গরুর বর্ণ ছোট—বড় কালো—সাদা রঙে মেশানো হয়।
২. উন্নত জাতের গাভীর মধ্যে এরা আকারে সবচেয়ে বড় হয়।
৩. মাথা লম্বাটো হয়। অন্যান্য জাতের গরুর ন্যায় এদের কুঁজ হয় না।
৪. পূর্ণবয়স্ক ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৮০০—১০০০ কেজি ও গাভীর ওজন প্রায় ৫০০—৬০০ কেজি হয়ে থাকে।
৫. গাভী দিনে প্রায় ৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
৬. এ জাতের বকনা প্রায় দেড় থেকে দুই বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
৭. দুধে চর্বি থাকে ৩.৫% থেকে ৪%।
৮. শরীর বেশ পুষ্ট, পিছনের অংশ ভারী এবং ওলানগ্রন্থি বেশ বড়।
৯. গাভী শান্ত প্রকৃতির কিন্তু ষাঁড়গুলো বদমেজাজি।
১০. জন্মের সময় বাছুরের ওজন গড়ে ৪০—৪৫ কেজি হয়।
১১. অধিক দুধ দানের জন্য এ জাত বিশ্ববিখ্যাত ।
১২. মাথা ও পেছনের পা বেশ সোজা।
১৩. এ জাতের গাভী পরবতীর্ বাচ্চা দেয়ার আগ পর্যন্ত একটানা দুধ দেয়।
১৪. এরা বছেও ৪৫০০—৯০০০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।
জার্সি গরু
জার্সি গরু:
ইংল্যান্ডের জার্সি, ওয়েরেন্সি, অ্যালডারনি ও সার্ফ চ্যানেল দ্বীপসমূহে এদের উৎপত্তি। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার পূর্ব ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোতে এদের বিস্তৃতি রয়েছে।
বিদেশী দুধাল জাতের গাভীর মধ্যে জার্সির আকার সর্বাপেক্ষা ছোট। গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ এবং ষাঁড়ের ওজন ৬০০-৮০০ কেজি। দেহের গঠন সুন্দর ও নিখুঁত, গুলানগ্রন্থি, বেশ বড় এবং সুগঠিত। শিরদাড়া সোজা এবং মাথা ও ঘাড় সামঞ্জস্যপূর্ণ। গায়ের রঙ ফিকে লাল (fawn)। জিহ্বা এবং লেজের রঙ কালো।
গো-চারনে অভ্যস্ত। জার্সির বাচ্চা আকারে ছোট ও দুর্বল হয়। তাই জন্মের পর বাচ্চা লালনপালন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বাচ্চার জন্ম ওজন ২২-৩৩ কেজি পর্যন্ত হয়। অতি অল্প সময়ে জার্সি গাভী কয়প্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুধ উৎপাদনে সক্ষম।
ভালো মান ও অধিক পরিমাণ দুধ উৎপাদনের জন্য জার্সি জাতের গরু বিখ্যাত। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০-৪০০০ লিটার দুধে চর্বির গড় হার ৫%। জার্সি গরু মাংসল হয় না।
বৈশিষ্ট্য:
১. আকার তুলনামূলক ভাবে ছোট।
২. জন্মের সময় বাচ্চা দুর্বল ও ছোট হয়।
৩. গায়ের রঙ ফিকে লাল এবং গাঢ় বাদামি হয়।
৪. মাথা লম্বা, এদের কুঁজ হয় না, ফলে শিরদাড়া সোজা হয়।
৫. শরীরে মেদ কম থাকে, লেজের রঙ কালো।
৬. গাভীর ওলান বেশ বড় হয়, পা গুলো ছোট কিন্তু মজবুত।
৭. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪.—০০—৫০০ কেজি ও ৬০০— ৮০০ কেজি।
৮. একটি গাভী হতে বছরে ৩৫০০—৪৫০০ কেজি দুধ পাওয়া যায়।
৯. গরু স্বল্পসময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং দীর্ঘসময় ধরে বাচ্চা ও দুধ দেয়।
১০. শিং পাতলা ও সামনের দিকে কিছুটা বাঁকানো থাকে
১১. দৈনিক ১৫—২০ কেজি দুধ দেয়।
১২. দুধে চর্বিও পরিমাণ ৫% হয়।
২। উপমহাদেশীয় জাতের গরু Ñ এদের কুঁজ হয়।
আয়ারশায়ার গরু (Ayreshire):
আয়ারশায়ারের উৎপত্তি স্কটল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম আয়ারশায়ার প্রদেশে। এ জাতের গরু গ্রেট বৃটেন, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য ঃ
আয়ারশায়ার গাভীর ওজন ৫৫০-৭০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৮৫০-১১৫০ কেজি। এদের শিরদাড়া গোজা এবং শিং প্রসারিত ও থাকা। ওলানগ্রন্থি বেশ বড় ও সুগঠিত। গায়ের রঙ লালের মধ্যে সাদা ফোঁটা ফোঁটা। সাধারণত মাথা ও শরীরের সম্মুখভাগে গাঢ় রঙ দেখা যায়। গাভীর রঙ হালকা লাল, তবে ষাঁড়ের রঙ গাঢ় লাল।
গো-চারনে ভালোভাবে অভ্যস্ত। আয়ারশায়ার বয়ঃপ্রাপ্ত হয় ওয়েরেন্সির পরে কিন্তু হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান অপেক্ষা তাড়াতাড়ি। হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের বায়ুরের ন্যায় আয়ারশায়ারের বাছুর জন্মের সময় সতেজ ও সবল হয়। বাছুরের জন্ম ওজন (birth weight) ৩৫-৪০ কেজি। এরা দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ৫০০০ লিটার। দুধে চর্বির হার ৪%।
শাহীওয়াল গরু
আদি বাসস্থান: শাহীওয়াল জাতের গরুর আদি বাসস্থান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্টগোমারী জেলা। এশিয়া মহাদেশের অনেক দেশেই শাহীওয়াল জাতের গরু পাওয়া যায়। পাকিস্তান থেকে এ জাতের গরু আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে।
শাহীওয়াল গরু
বৈশিষ্ট্য:
১. এ জাতের গরু আকারে বেশ বড় হয়।
২. এদের মাথা চওড়া, পা ছোট ্এবং শিং পুরু।
৩. গায়ের রং তামাটে লাল ।
৪. মাথা প্রশস্ত কিন্তু শিং ছোট ও মোট হয়।
৫. নাভীর চার পাশের চামড়া মোটা ও ঢিলা।
৬. ওলান বড় ও ঝুলন্ত।
৭. বলদ অলস প্রকৃতির ও ধীরগতি সম্পন্ন।
৮. গলকম্বল, কান ও নাভী সাধারণত ঝুলানো থাকে।
৯. পূর্ণবয়স্ক গাভীর ওজন প্রায় ৩৫০—৪৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন প্রায় ৫০০—৭০০ কেজি হয়ে থাকে।
১০. একটি গাভী দিনে প্রায় ১২—১৫ কেজি দুধ দেয় এবং বছেও ৩০০ দিন পর্যন্ত দুধ দিয়ে থাকে।
১১. শাহীওয়াল ষাঁড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরুর দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভাল।
১২. বকনা তিন থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
১৩. এদের লেজ লম্বা এবং প্রায় মাটি ছুয়ে যায়।
১৪. লেজের মাথায় একগোছা কালো লোম থাকে।
১৫. জন্মের সময় বাছুরের ওজন ২২—২৮ কেজি হয়।
লাল সিন্ধি গরু
লাল সিন্ধি গরু (Red Sindhi):
পাকিন্তানের সিন্ধু প্রদেশের করাচী, লাসবেলা ও হায়দারাবাদ, এ জাতের গরুর আদি বাসস্থান। এ জাতের গরু লাল বলে এদের লাল সিন্ধু বলা হয়। পাকিস্তান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও আফ্রিকাতে এ জাতের গরু পাওয়া যায়।
গাভীর ওজন ৩৫০-৪০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৪২৫-৫০০ কেজি। চুট উন্নত, গলকম্বল ও নাভীর চারদিকের চামড়া বেশ ঢিলা, কপাল বেশ প্রশস্ত ও উন্নত, শিং মাঝারি আকারের এবং কিছুটা ভেতরের দিকে বাঁকানো। কান মাঝারি আকারের, গুলান গ্রন্থি বড়। গায়ের রঙ গাঢ় লাল, কিন্তু কালচে হলুদ থেকে গাঢ় মেটেও হতে পারে।
বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। এরা ভারতীয় উপমহাদেশে দুধাল গাভী হিসেবে পরিচিত। গিন্ধি গাভী বছরে গড়ে ২000 লিটার দুধ দেয়। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। এ জাতের গরু আমাদের দেশের আবহাওয়ায় মোটামুটি ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। সিন্ধি বলদ একটু আলসে প্রকৃতির। কিন্তু ষাঁড় ও বাংলাদেশী গাভীর মিলনে সৃষ্ট বলদ হাল-চাষ ও গাড়ি টানার জন্য ভালো। বকনা তিন বছরেই গাভীতে পরিণত হয়। পরিমাণ ৪.৫%। বলদ সাধারণত অলস প্রকৃতির ও মন্থর গতিসম্পন্ন। শাহিওয়াল ধাড় ও দেশী গাভীর সংকরায়নে উৎপন্ন গরু দুধ উৎপাদন ও হালচাষের জন্য ভালো।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রং গাঢ় লাল হয় এবং নাভী বড় ও ঝুলানো হয়।
২. কপাল প্রশস্ত ও উন্নত কান নিচের দিকে ঝুলানো হয়।
৩. দেহের অনুপাতে মাথা ছোট, নাকের চূড়া চওড়া।
৪. ওলানের বাটগুলো সুগঠিত এবং চার কোণায় সমদূরত্বে সমভাবে বসানো।
৫. শিং ভোতা, যা পাশে ও পিছনের দিকে বাঁকানো।
৬. গাভী দৈনিক ১০ লিটার পর্যন্ত এবং বছরের ৩৫০ দিন দুধ সিন্ধি দেয়।
৭. বকনা ৩ বছর বয়সে প্রথম বাচ্চা দেয়।
৮. বলদ বা ষাঁড় হালচাষ ও গাড়ি টানার কাজে বেশ উপযোগী।
৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৩৫০—৪০০ কেজি এবং ৪০০—৫০০ কেজি।
১০. গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৫০০ লিটার।
১১. দুধে চর্বির ভাগ ৫%।
হারিয়ানা গরু
হারিয়ানা গরু:
ভারতের রোহটক, হিসার, গুরগাও, কার্নাল ও দিল্লি হারিয়ানার আদি বাসস্থান। ভারতের সব জায়গায় হারিয়ানা দেখা যায়। তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেজন্য ল্যাটিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিনাঞ্চলে এদের সাহায্যে বিভিন্ন প্রকার সংকর জাতের গরু উৎপাদন করতে দেখা যায়।
গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০-৫০০ ও ৬০০-১১০০ কেজি। উচ্চতা ১৪০-১৪৫ সে.মি। বাছুরের জন্ম ওজন ২২-২৫ কেজি। মাথা লম্বা ও অপেক্ষাকৃত গরু। শিং লম্বা, চিকন ও মসৃন। ওলান সুগঠিত ও আটোসাটো, গায়ের রঙ হালকা ধূসর বা সাদাটে। কোনো কোনো ষাঁড়ের খাড়, চুট, বুক প্রভৃতি স্থান গাঢ় ধূসর রঙের। হারিয়ানা অত্যধিক পরিশ্রমী ও শক্তিশালী গরু। এরা দৈত কাজ, যথা- দুধ উৎপাদন ও গাড়ি টানার উপযোগী। বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ কেজি। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%। বকনা ৩-৪ বছরের মধ্যে গাভীতে পরিণত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
১. গায়ের রং সাদা বা হালকা ধূসর।
২. এরা বেশ শক্তিশালী ও পরিশ্রমি হয়।
৩. সুগঠিত ও আঁটিসাঁট ও লাল হয়।
৪. শিং লম্বা, চিকন এবং মসৃণ হয়।
৫. মাথা লম্বা ও অপেক্ষকৃত সরু।
৬. নাভী শরীরের সাথে লাগানো।
৭. গাভী প্রায় ৩০০ দিন দুধ দেয় এবং বছরে ৩০০০—৩৫০০ কেজি দুধ দেয়।
৮. তাপ সহনশীলতা হারিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৯. গাভী ও ষাঁড়ের ওজন যথাক্রমে ৪০০—৫০০ কেজি ও ৮০০—১০০০ কেজি।
১০. বকনার প্রথম বাচ্চা প্রসব করতে ৪ বছর সময় লেগে যায়।
১১. দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
ধারপারকার গরু (Tharparkar )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ধারপারকার জেলায় এদের উৎপত্তি। সিন্ধু প্রদেশের সর্বত্র এবং পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে এদের পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য:
থারপারকার বেশ শক্তিশালী গরু। গায়ের রঙ সাদা। এরা মধ্যম আকৃতির ও হারিয়ানার চেয়ে কম উচ্চতাসম্পন্ন। শিং ও চুট মধ্যম আকারের। গলকম্বল বর্ধিত কিন্তু শাহিওয়াল ও সিদ্ধির চেয়ে ছোট। দেহ সুঠাম ও সুন্দর। ধারপারকার হারিয়ানার ন্যায় দৈত উদ্দেশ্যে অর্থাৎ দুধ ও মাংস উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। গাভীর বার্ষিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে ২০০০ লিটার। দুধে চর্বির পরিমাণ ৫%।
অমৃত মহল (Amrit Mahal )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এ জাতের গরুর উৎপত্তি ভারতের কর্ণাটক প্রদেশে। তবে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের খামারেও এদের দেখতে পাওয়া যায়।
জাত বৈশিষ্ট্য ঃ
দেহ সুগঠিত, পিঠ সোজা এবং পা দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুখাকৃতি লম্বা ও কপাল উন্নত। শিং লম্বা ও প্রশস্ত, গলকম্বল ও চুট উন্নত এবং বড়। চামড়া বেশ আটোসাটো, লেজ মাঝারি লম্বা এবং লেজের গুচ্ছ কালো। গায়ের রঙ ধূসর, তবে মাথা, গলা, চুট ও পা কালো লোমে আবৃত। ভারতের শক্তি উৎপাদনশীল গরুর মধ্যে এরা উৎকৃষ্ট জাত। এরা অত্যন্ত কর্মক্ষম, তবে গাভীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কম৷
ব্রাহ্মণ গরু (Brahman)
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এই জাতের গরুর উৎপত্তিস্থান ভারত। তবে, বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই পাওয়া যায়। ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের গরুর সাথে ইউরোপ ও আমেরিকায় উন্নত টাইপের গরুর দীর্ঘ সংকরায়নের ফলে এই জাতের সৃষ্টি হয়েছে। ব্রাহ্মাণ সম্প্রদায়ের নামের সাথে মিল রেখেই এই জাতের গরুর নাম দেয়া হয়েছে ব্রাহ্মণ।
জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ
গায়ের রঙ ধূসর অথবা লাল। তবে, বাদামি, কালো, সাদা ও ফুটফুটে রঙেরও দেখা মেলে৷ মুখাকৃতি লম্বা, কান ঝুলন্ত, ছুট উঁচু, গলকম্বল পুরু ও মোটা চামড়ায় আবৃত। এরা মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।
অ্যাঙ্গাস গরু (Angus )
উৎপত্তি ও প্রাপ্তিস্থান :
এদের আদি বাসস্থান স্কটল্যান্ড, অ্যাবারডিন, অ্যাঙ্গাস, ঝিংকারডিন ও ফরফার-এর উত্তর পূর্বাঞ্চল।
জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ
এদের গায়ের রঙ কালো। কোনো শিং নেই। গায়ের চামড়া ও লোম মসৃণ। দেহ লম্বাকৃতির। এরা উন্নত এবং অধিক মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু।
উন্নত জাতের সংকর গরু:
উন্নত জাতের ষাড়ের সঙ্গে দেশী গাভীর মিশ্রণে যে জাতের গরু উৎপাদন করা হয় তাকে সংকর জাতের গরু বলে। সংকর জাত আসলে মিশ্রজাত। সংকর জাত সৃষ্টি করার প্রক্রিয়াকে সংকরায়ন বলে। আমাদের দেশে দেশী অনুন্নত গাভীকে বিদেশী উন্নত জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে সংকরায়ন করে তার থেকে উন্নত সংকর বাছুর উৎপাদন করা হচ্ছে।
সংকরায়নের জন্য আগে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ধাড় আমদানি করা হতো। কিন্তু দেশের চাহিদার তুলনায় এত বেশি ষাড় আমদানি করা বায়বহুল। এজন্য কমসংখ্যক গাড় দিয়ে বেশিসংখ্যক গাভীকে প্রজনন করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অর্থাৎ কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা দেশে চালু হয়েছে। কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থায় উন্নত জাতের ধাড় থেকে সংগ্রহ করা বীর্য বা বীজ গাভীর জনন অঙ্গে সংস্থাপন করে ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। আমাদের দেশে এই পদ্ধতি খুব ধীরে ধীরে চালু হয়েছে। বর্তমানে গ্রাম ও শহর সর্বত্রই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বহু সংকর বাছুর উৎপাদিত হচ্ছে।
হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান গরু
সংকর গরু সৃষ্টির উদ্দেশ্য
সংকর জাতের গরু সৃষ্টির প্রধান উদ্দেশ্য অনুন্নত জাতের গরুকে উন্নত করে অধিক হারে দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদন করা। দুধ, মাংস ও শক্তি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত গরুর জাতগুলো বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। যেমন- দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত জাতের গরু হলস্টেইন- ফ্রিজিয়ান ও জার্সির আদি বাস ইউরোপে।
শক্তি ও মাংস উৎপাদনকারী জাতের গরু অমৃত মহল, কৃষ্ণ ভেলি, হারিয়ানা, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি ভারতে পাওয়া যায়। মাংস উৎপাদনকারী জাত, যেমন- ব্রাহ্মণ, অ্যাঙ্গাস, হারফোর্ড প্রভৃতি আমেরিকায় পাওয়া যায়। এসব জাতের গরু অন্য দেশের আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। লালনপালনে অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। তারপরও অনেক সময় বাচানো কঠিন হয়।একদেশ থেকে অন্যদেশে এসব জাতের গরু স্থানান্তর করা ব্যয়বহুল।
ফলে গরুর ব্যবসায় লাভবান হওয়া যায় না। এসব অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে খুব সীমিত সংখ্যায় এ জাতের ষাড় বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর নিজ দেশের গাভীর সঙ্গে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাতের গাভী ও ষাড় উৎপাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের বাংলাদেশের কথা বলা যায়। সরকার বিদেশ থেকে উন্নত জাতের ষাড় এনে সরকারী খামারে লালনপালন করেন। উক্ত ষাঁড় থেকে কৃত্রিম উপায়ে বীজ সংগ্রহ করে সারাদেশে বিভিন্ন কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। উক্ত বীজ দিয়ে দেশী গাভীর প্রজনন করানো হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ দেশী গাভী থেকে সংকরায়নের মাধ্যমে সংকর গাভী সৃষ্টি করতে পারছে।
সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য
নিম্নে সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য দেয়া হলো-
দুধ, মাংস কিংবা শক্তির জন্য সৃষ্ট সংকর গরুর উৎপাদন দেশী গরুর থেকে বেশি হয়।
সংকরায়নের ফলে জিনের (gene) সংমিশ্রণ ঘটে বলে পরবর্তী প্রজন্মের রোগপ্রতিরোধ ও পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
দু’টি ভিন্ন জাতের গাভী ও ষাঁড়ের মধ্যে সংকরায়নের ফলে যে বাছুর উৎপন্ন হয় সে তার মাতা-পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বৈশিষ্ট্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। চিত্র ২৯-এ নিয়মটি রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
একটি দেশী গাভীকে একটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়ের মাধ্যমে প্রজনন করানো হলে যে বাচ্চা জন্ম নেয় তার দেহে ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ানের রক্ত থাকে। এই বাছুর বরুনা হলে বড় হওয়ার পর হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান জাতের ষাড় দিয়ে তাকে প্রজনন করানো হলে বাচ্চার দেহের আদি দেশী মা গাভীর রক্ত আরও অর্ধেক কমে ২৫% হয়ে যাবে।
অর্থাৎ এটি ৭৫% উন্নত জাতের বৈশিষ্ট্য পাবে। এভাবে সংকর গাভী থেকে গাত পুরুষে তাত্ত্বিকভাবে ১০০% খাটি হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান আনা যায়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম বংশের গাভী বা ধাড়ই ৫০% দেশী ও ৫০% হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান রক্ত বৈশিষ্ট্য বহন করে বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
অনুশীলন (Activity) :
ধরুন, আপনার বাড়িতে একটি অনুন্নত দেশী গাভী আছে। উন্নত জাতের ষাঁড়ের বীজ দিয়ে একে প্রজনন করালেন। উক্ত গাভীর পঞ্চম বংশধরের ক্ষেত্রে দেশী ও উন্নত ষাঁড়ের রক্তের শতকরা হার যথাক্রমে কত হবে?
সংকর গরুর উৎস
উন্নত জাতের গরু সংকর গরুর উৎস বা পূর্বপুরুষ। আমাদের দেশে দুধ উৎপাদন করার লক্ষ্যে হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের সাথে দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। অনেকে শাহিওয়াল ষাঁড়ের সঙ্গেও দেশী গাভীর কৃত্রিম প্রজনন করে থাকেন। তবে বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায়, হলস্টেইন-ফ্রিজিয়ান ষাঁড়ের বীজ দিয়ে দেশী গাভীকে প্রজনন করিয়ে যে বাচ্চা পাওয়া যায় তা এদেশের আবহাওয়ায় বেশি উৎপাদন দিতে সক্ষম। শক্তি ও মাংসের জন্য বাংলাদেশ এখনও সংকর গাভী উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। আমাদের দেশে মাংস ও শক্তির চাহিদা যথেষ্ট। এই চাহিদা মেটানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
উৎপাদন ব্যবহারের ভিত্তি করে গরুর শ্রেণীবিভাগ:
দুধ ও মাংস উৎপাদন এবং কার্যকারিতর উপর ভিত্তি করে গরুর জাতকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যেমন—
দুধাল জাত:
এ শ্রেণীর গাভীগুলো সাধারণত অধিক পরিমাণে দুধ দিয়ে থাকে। যেমন—হলস্টেইনফ্রিজিয়ান, শাহীওয়াল, জার্সি, লাল সিন্ধি, ব্রাউন সুইস, আয়ার শায়ার, গুয়ারেন্সি ইত্যাদি।
মাংসল জাত:
মাংস উৎপাদনের জন্য এ জাতগুলো বেশি পরিচিত। যেমন— অ্যাঙ্গাস, বিফ মাষ্টার, ব্রাহ্মণ, ডেবন, সর্টহর্ন, হালিকার ইত্যাদি।
দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাত:
এ শ্রেণীর গাভী মোটামুটি ভাল দুধ দেয় এবং এদেরকে কৃষিকাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন— হারিয়ানা, থাষ্টার্কার, রেডপোল,কাংক্রেজ,মিল্কিং সর্টহর্ন ইত্যাদি।
শ্রম বা ভারবাহী জাত :
এ জাতের বলদ গরুগুলো কৃষিকাজ এবং ভার বহনে বেশি উপযোগী। যেমন— অমৃত মহল, মালভি, হরিয়ানা, ধান্নি, কৃষ্ণভেলি, ভাগনারি ইত্যাদি।
দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন:
দুগ্ধবতী গাভীর জাত নির্বাচন – পাঠটি বাউবি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয়ের ইউনিট – ১৪ , পাঠ – ১৪.১। ভূমিকা আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধিতে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও দারিদ্র দূরীকরণে দুগ্ধ খামারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুগ্ধ খামার স্থাপনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই একই সুতোয় গাঁথা। খামার স্থাপনের পূর্বে যেমন বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করে কাজ করতে হয় ঠিক তেমনি খামার স্থাপনের পর খামারের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি দিতে হয়। দুগ্ধ খামারের মূল উৎপাদিত দ্রব্য হচ্ছে দুধ। তাই দুধ বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। খামার স্থাপনের উদ্দেশ্যই হলো তা থেকে মুনাফা অর্জন করা। সুতরাং দুগ্ধ খামারের আয় ব্যয়ের হিসেব সম্পর্কেও জানা আবশ্যক।
এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে দুগ্ধবতী গাভী ও মহিষের জাত নির্বাচন, গর্ভকালীন ও প্রসবকালিন গাভীর যত্ন, দুগ্ধবতী গাভীর যত্ন ও খাদ্য, নবজাত বাছুরের যত্ন, দুধ উৎপাদনে প্রভাবক বিষয়বসমূহ। বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদন ও দুধ পরীক্ষা, দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বাণিজ্যিক ডেইরি ফার্ম পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরি, গর্ভবতী গাভী শনাক্তকরন নিয়ে তাত্বিক ও ব্যাবহারিকভাবে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
উন্নত জাতের গাভীর লক্ষণ (Sign of Hybrid Cow) একটি উন্নত জাতের দুধালো গাভীর লক্ষণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১. উন্নত জাতের গাভী সামঞ্জস্যপূর্ণ নিখুঁত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সুন্দর ও আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হবে ২. পিছনের অংশ বেশি চওড়া এবং দাঁড়ানো অবস্থায় পিছনের পা দুটি বেশি ফাঁক থাকে।
৩. দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
৪. ভালজাতের গাভীর পাঁজরগুলো আলাদা এবং স্ফীত দেখায় ।
৫. দেহ বেশ বড় এবং দেহের আকার সামনের দিকে সরু এবং পিছনের দিকে ভারী হয়।
৬. চামড়া পাতলা ও মসৃণ প্রকৃতির হয়।
৭. ভালজাতের গাভীর শরীর ঢিলেঢালা ও নাদুশ-নুদুশ হয়।
৮. ওলান সুগঠিত নরম, আকারে বড়, চওড়া এবং ওলান শক্তভাবে শরীরের সাথে আটকানো থাকে ।
৯. ওলানের বাট চারটি সমান আকৃতির ও সমান দূরত্বে অবস্থিত হবে।
১০. দুধ দোহনের আগে ওলান শক্ত থাকে এবং দোহনের পর চুপসে যায়।
১১. ওলানের সামনে নাভীর দিকে সুস্পষ্ট ও উন্নত দুগ্ধশিরা স্পষ্ট দেখা যায়।
১২. উন্নত জাতের গাভীর নাকের ছিদ্র বড় ও খোলা হয়।
১৩. একটি উন্নত ও স্বাস্থ্যবান গাভীর স্বভাব অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির হয়।
সারসংক্ষেপ:
দেশী গাভী সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত জাতের গাভীর উদ্ভাবন করা হয়েছে। সুষম খাদ্য প্রদান ও স্বাস্থ্যসম্মত পালন ব্যাবস্থার মাধ্যমে একটি সংকর বা উন্নত জাতের গাভী হতে দৈনিক ২৫ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। উন্নত জাতের গাভী সাধারনত ত্রিকোনাকৃতির হয়। এদের দেহের আকার অনুপাতে বুকের ও পেটের বেড় গভীর হয়।
আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা।
এই পাঠ শেষে আপনি –
দেশী গরুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম বলতে ও লিখতে পারবেন। দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো বলতে পারবেন।
প্রাসঙ্গিক তথ্য
দেশী -গরু আমাদের দেশে যদিও পরিচিত, তথাপি এর বিভিন্ন গুণাবলী ও উৎপাদন বৈশিষ্ট্যসমূহ অনেকেরই জানা নেই। আমাদের দেশী- গরুকে উন্নত করতে হলে এর মধ্যে যেসব ভালো অথবা নিম্নমানের গুণাবলী আছে তা জানা দরকার।
দেশী গরুর বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও খাতায় লেখা
প্রয়োজনীয় উপকরণ
একটি ষাঁড় বা গাভী, কলম, পেন্সিল, রাবার, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি।
কাজের ধাপ
একটি দেশী- গরু দেখে প্রথমে এর দেহের বিভিন্ন অংশ ও অঙ্গের নাম জানুন।
নিজ বাড়িতে বা প্রতিবেশীর বাড়িতে যেখানে দেশী- গরু আছে সেখানে যান এবং পাঠ্য বইয়ে উল্লেখিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামের সাথে ঐ গরুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মিলিয়ে নিন।
ব্যবহারিক খাতায় একটি ষাঁড় ও একটি গাভীর ছবি এঁকে এদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিহ্নিত করুন।