Category Archives: মাছ

মাছ

কই মাছের চাষ পদ্ধতি

কই মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের” ১ নং ইউনিটের ১.৫ নম্বর পাঠ। কই মাছ বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি ছোট মাছ। এটি খেতেও যেমন সুস্বাদু, পুষ্টিগুণেও তেমন ভরপুর। মাছটি পানির উপরে দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে বলে একে জিয়ল মাছ বলা হয়। এক সময় প্রাকৃতিক ভাবেই এদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোতে প্রচুর পরিমাণে কই মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানুষ সৃষ্ট কারণে এ মাছটি আজ বিলুপ্তির পথে। স্বাদ, পুষ্টিগুণ, উচ্চ বাজারমূল্য ও সর্বোপরি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার্থে এ মাছকে অবশ্যই গুরুত্ব দেবার সময় এসেছে।

কই মাছের চাষ পদ্ধতি

 

কই মাছের একক চাষ পদ্ধতি:

আমাদের চাষ পদ্ধতিতে মাছটি অন্তভূর্ক্ত করে উৎপাদন বাড়ানো এখন সময়ের দাবী। তবে পোনার অপ্রতুলতার কারণে কই মাছের চাষ আশানুরূপভাবে প্রসার লাভ করেনি। দেশীয় কই মাছের কৃত্রিম প্রজননের চেষ্টা সফল হলেও নিম্ন বর্ধন হারের কারণে মাছটির বাণিজ্যিক চাষের আশা অনেকটা মিইয়ে যায় এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে ২০০২ সালে বেসরকারি পর্যায়ে দেশীয় কই মাছের অনুরূপ একটি বর্ধনশীল জাত থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয় যা ‘থাই কই’ নামে পরিচিত। এদেশের আবহাওয়ায় সহজে মানিয়ে নেওয়ায় বর্তমানে স্থানীয়ভাবেই এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন সফলভাবে করা হচ্ছে।

আমাদানিকৃত থাই কই এর উৎপাদন দেশী কই অপেক্ষা ৫০% বেশি হওয়ায় বাণিজ্যিক চাষে অধিক মুনাফা করা সম্ভব। পরবর্তিতে ২০১১ সালে আরো একটি কই এর জাত ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা হয় যা থাই কই এর চেয়েও বেশি বর্ধনশীল। ভিয়েতনামী কই ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং অনেক চাষীই  মাছটি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

কই মাছ চাষের সুবিধা :

(১) যে কোন ধরনের জলাশয় এমনকি চৌবাচ্চা বা খাঁচাতেও চাষ করা যায়।

(২) অধিক ঘনত্বে চাষ করা যায়।

(৩) একক এবং মিশ্র চাষের জন্য উপযোগী।

(৪) টেকসই মাছ হওয়ায় বিরূপ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে।

(৫) কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব, তাই চাষের জন্য সহজেই পোনা পাওয়া যায়।

(৬) প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করে।

(৭) কম সময়ে (৩—৪ মাস) বাজারজাত করা যায়, ফলে দ্রুত পঁুজি ফেরত পাওয়া যায়।

(৮) অতিরিক্ত শ্বসন অঙ্গ থাকায় কই মাছ পানি ছাড়াও দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে, ফলে জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করে বেশি দাম পাওয়া যায়।

(৯) রোগীর পথ্য হিসেবে এবং সুস্বাদু হওয়াতে কই মাছের বাজার চাহিদা ব্যাপক।

কই মাছ চাষ করার জন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে করতে হবে।

কই মাছ চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন :

৪—৬ মাস পানি থাকে এ রকম যে কোন পুকুর কই চাষের জন্য উপযোগী। পুকুরের আয়তন ১৫—৫০ শতাংশ হলে ভালো হয়। নিচের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পুকুর নির্বাচন করা উচিত:

* মজুদ পুকুর আকৃতিতে আয়তকার হবে।

* পুকুরের মাটি দো—আঁশ হবে।

* পুকুরের তলায় ১৫ সে.মি. এর অধিক কাদা থাকবে না।

* বন্যামুক্ত স্থানে পুকুর নির্বাচন করতে হবে। * পুকুরের স্থানটি আলো—বাতাস পূর্ণ হবে।

পুকুর প্রস্তুতকরণ : পুকুর প্রস্তুত ভালোভাবে না হলে মাছ চাষ চলাকালীন নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। তাই নির্বাচিত পুকুর কই মাছ চাষের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। পুকুর প্রস্তুতকরণের ধাপগুলো নিম্নরূপ—

অবাঞ্চিত প্রাণী ও আগাছা দমন পুকুরের পানিতে আগে থেকেই বসবাসকারী রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ ও প্রাণি দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রোটেনন, ফসট*িন ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায় যা ব্যবহার করে উক্ত কাজটি করা যেতে পারে।

তবে পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এসব দ্রব্য যতটা সম্ভব না ব্যবহার করাই ভাল। সেক্ষেত্রে ছোট/চিকন মেসের জাল বার বার টেনে রাক্ষুসে মাছ ও ক্ষতিকর প্রাণি দূর করা যায়। পুকুর সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে কাজটি করলে সবচেয়ে ভাল হয়। এসময় আগাছাও পরিস্কার করে ফেলতে হবে।

তলা ও পাড় মেরামত পুকুরের তলার অতিরিক্ত পঁচা কালো কাদা অপসারণ করে পুকুরের পাড়ের গর্ত খানাখন্দ মেরামত করতে হবে। তলা সমান করে নিতে হবে। পুকুরের পাড়ের ঝোপ—ঝাড় পরিষ্কার করে চারিদিকে এক ফুট উঁচু জাল দিয়ে এমনভাবে ঘিরে দিতে হবে যেন জালের নিচের প্রান্ত পাড়ের মাটিতে গ্রোথিত থাকে। এর ফলে মৎস্যভূক প্রাণি যেমন—সাপ, গোসাপ প্রবেশ করতে পারবে না। আবার কই মাছ ও পুকুর থেকে পালাতে পারবে না।

 

কই মাছ চাষে চুন ও সার প্রয়োগ:

পুকুরের পানিতে অনেক ধরনের ক্ষতিকর রোগ—জীবাণু থাকে। এসব জীবাণু ধ্বংস করতে এবং পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন পানিতে গুলে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে চুন প্রয়োগের ৩—৪ দিন পর এবং কই মাছের পোনা মজুদের ৭—৮ দিন আগে সার প্রয়োগ করতে হবে।

পানির রং বুঝে পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। কারণ উর্বর পুকুরে অনেক সময় চুন প্রয়োগের পর পানিতে প্রচুর ফাইটোপ্ল্যাংকটন জন্মে। সেক্ষেত্রে পুকুরে সার প্রয়োগের কোন প্রয়োজন নাই।

কই মাছ প্রকৃতিতে সাধারণত জুপ্ল্যাংকটন ও জলজ কীটপতঙ্গ খায়। জুপ্ল্যাংকটনের উৎপাদন নির্ভর করে ফাইটোপ্ল্যাংকটনের প্রাচুর্যতার উপর। আর পুকুরে সার প্রয়োগের উদ্দেশ্যই হলো ফাইটোপ্ল্যাংকটনের উৎপাদন বাড়ানো। সাধারণত জৈব ও অজৈব উভয় প্রকার সার পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়।

পুকুরে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ করলে সাধারণত চাষের প্রথম এক মাসের পর আর সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয় না। কারণ চাষের এ পর্যায়ে পানিতে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্য এমনিতেই তৈরি হয় এবং পানির রং যথেষ্ট সবুজ হয়ে যায়। তবে পানিতে যথেষ্ট প্রাকৃতিক খাদ্য না থাকলে চাষ চলাকালীন সার দিতে হবে (সারনি ২)।

পোনা মজুদ নির্ভরযোগ্য সরকারি/বেসরকারি হ্যাচারি থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে। ধানী পোনার ক্ষেত্রে ১৫—২০ দিন নার্সারি পুকুরে রেখে ৪—৬ সে.মি লম্বা হলে অথবা ওজন ৩—৪ গ্রাম হলে স্ত্রী পোনাগুলোকে আলাদা করে পুকুরে চাষ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

পুকুর ব্যবস্থাপনা ও সম্পূরক খাদ্যের ওপর নির্ভর করে শতাংশ প্রতি ৫০০—১০০০টি সুস্থ—সবল পোনা মজুদ করা যেতে পারে। পোনাকে অবশ্যই পুকুরের পানির সাথে কন্ডিশনিং করে তারপর ছাড়তে হবে। পোনা মজুদ করার উত্তম সময় হল সকাল বেলা।

 

কই মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:

কই মাছের পুষ্টি চাহিদা বিশেষ করে আমিষের চাহিদা কার্পজাতীয় মাছের চেয়ে বেশি। কই মাছের পোনার আমিষের চাহিদা ৩০—৩৫% এবং চাষযোগ্য মাছের ক্ষেত্রে তা ৩০%। অধিক ঘনত্বে কই মাছ চাষে ভাল উৎপাদন পেতে হলে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে।

কই মাছের একটি আদর্শ খাবারে আমিষ ৩০—৩৫%, চর্বি ৪—৫%, শর্করা ৪%, ছাই (অংয) ১৪%, অঁাশ (ঋরনৎব) ৫% ও জলীয় অংশ ১১% থাকা প্রয়োজন। ইদানিং বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির পিলেট খাদ্য (ডুবন্ত ও ভাসমান) কিনতে পাওয়া যায়।

এসব খাদ্য প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোম্পানির নির্দেশনাও মানা যেতে পারে। খামারে তৈরি ভিজা খাবারের পাশাপাশি বানিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত ভাসমান পিলেট খাবার কই মাছের পুকুরে প্রয়োগ করা সর্বোত্তম। নিচের সারণি অনুসরণ করে প্রতিদিনের খাদ্যকে দু’ভাগ করে সকাল ও বিকালে ২ বার প্রয়োগ করা যেতে পারে।

 

কই মাছ আহরণ ও বাজারজাতকরণ:

আধা নিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করলে ৩—৪ মাসে কই মাছ গড়ে ৯০—১০০ গ্রাম (ভিয়েতনামী কই ২০০—৩০০ গ্রাম) হবে। এ সময় জাল টেনে বা পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা নিতে হবে। নিচের সারণিতে একর প্রতি কই মাছের উৎপাদন দেখানো হলো

বাজারজাতকরণের আগের দিন জাল টেনে মাছ ধরে ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে বাজারজাত করার সময় মাছের মৃত্যুহার কম হবে। মাছ ধরার পর পরিস্কার পানি দিয়ে মাছগুলো ধৌত করা শ্রেয়। এরপর প্লাষ্টিকের ড্রামে পরিমাণমত পানি নিয়ে জীবন্ত অবস্থায় কই মাছ বাজারজাত করা যেতে পারে। এতে করে ভালো দাম পাওয়া যায়।

কই মাছের রোগ ব্যবস্থাপনা:

* পুকুর প্রস্তুতকরণের কাজটি যথাযথভাবে করতে হবে।

* সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে।

* উৎপাদন উপকরণ ভালভাবে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করতে হবে।

* পরিমিত পরিমানে সুষম খাবার প্রয়োগ করতে হবে।

* প্রতিমাসে অন্তত: একবার নমুনায়নের মাধ্যমে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। * প্রতি ১৫—২০ দিন অন্তর অন্তর ২০—৩০% পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে।

তাছাড়া কই মাছ পরিবহনের সময় আঘাত প্রাপ্ত হলে ক্ষত রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব হলে টিমসেন প্রতি শতাংশ পুকুরে (১ মিটার গভীরতায়) ২.৬৫ গ্রাম হারে ব্যবহার করা যেতে পারে (ইউনিট—৪ এ ক্ষত রোগ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আছে)।

পুকুরে জীবাণুনাশক হিসেবে অ্যাকুয়াম্যাজিক ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যবহার মাত্রা প্রতি একর পুকুরে ১ মিটার গভীরতার জন্য ৫ কেজি। তাছাড়া পোনা মজুদের পর ১০ গ্রাম/শতাংশ হারে কপার সালফেট ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায়।

 

সূত্র:

  • কই মাছের চাষ পদ্ধতি | ইউনিট-১ , পাঠ -১.৬ | কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৫ , পাঠ -৫.৪।

ব্যাবহারিক : ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ

 

প্রাসঙ্গিক তথ্য:

ফরমালডিহাইড বা মিথানল গ্যাসের ৪০% জলীয় দ্রবণকে ফরমালিন বলে। ফরমালিন মূলত: জীবাণুনাশক রাসায়নিক তরল পদার্থ যা ল্যাবরেটরীতে নমুনাসমূহ বিকারের মধ্যে ফরমালিন দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া উদ্ভিদ বা প্রাণীর অংশ বিশেষ সংরক্ষণের জন্য এবং মৃতু প্রানী, মানুষ প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা অনেক সময় খাদ্যদ্রব্যে বা মাছে ফরমালিন মিশিয়ে দেয়। সুতরাং মাছে ফরমালিন দেয়া হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার ।

 

ভূমিকা:

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে অসংখ্য পুকুর ডোবা, খাল বিল, নদ—নদী, হাওর—বাওড় ও বিস্তীর্ণ প্লাবন ভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের এ বিশাল জল রাশি অপরিমেয় মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। এদেশের স্বাদু পানিতে রয়েছে ২৭২ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি এবং সামুদ্রিক উৎসে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি। মাছ পঁচনশীল দ্রব্যের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় মাছের পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য এবং পঁচন রোধ করার লক্ষ্যে মাছ আহরণের পর থেকেই সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হয়। মাছ ও চিংড়ি পঁচনশীল দ্রব্য তাই এদের আহরণের পর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য সঠিক প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ায় যে কোনো ধরনের ক্রটি বা অবহেলার জন্য একদিকে যেমন মাছ বা চিংড়ির পঁচন ধরে অপরদিকে এদের বাজারজাতকরণও বাধাগ্রস্ত হয়।

এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে মাছ ও চিংড়ি সংরক্ষণের ধারনা ও প্রয়োজনীয়তা, মাছ পঁচনের কারণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি, মাছ পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, চিংড়ি পরিবহন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, এবং ফরমালিন শনাক্তকারী কীট দ্বারা ফরমালিনযুক্ত মাছ শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে:

নিরাপদ মাছের (ফরমালিনমুক্ত) লক্ষণসমূহ :

* দেহে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে।

* মাছ সহজে পঁচে যায়।

* মাছে মাছি পড়ে।

* মাছের স্বাভাবিক গন্ধ থাকে।

* ফুলকা লালচে বর্ণের থাকে।

* দেহ ভেজা থাকে।

* মাংশপেশি এবং অঁাইশ নরম থাকে।

* চক্ষু স্বাভাবিক থাকে।

 

ফরমালিনযুক্ত মাছের লক্ষণসমূহ :

* মাছের গায়ে মাছি বসে না।

* মাছ সহজে পঁচে না।

* ফরমালিনের হালকা কটু গন্ধ থাকবে।

* মাছ অসার বা শক্ত মনে হবে।

* মাছের শরীর অনেকটা রাবারের মত মনে হবে।

* মাছের দেহের স্বাভাবিক গন্ধ থাকবে না।

* মাছের ফুলকা কালচে এবং আইশ শুষ্ক মনে হবে।

* চক্ষু ফ্যাকাশে ও ভিতরের দিকে থাকে।

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

ক. ফরমালিন শনাক্তকারী কিট।

খ. একটি প্লেট বা ট্রে।

গ. ওয়াশ বোতল।

ঘ. বিকার।

ঙ. পাতিত পানি।

চ. মেজারিং সিলিণ্ডার।

 

পরীক্ষা পদ্ধতি :

১. প্রথমে বাজার থেকে সন্দেহযুক্ত মাছ সংগ্রহণ করে ট্রে—এর উপর রাখতে হবে।

২. এবার ওয়াশ বোতলের পাতিত পানি ব্যবহার করে মাছটি ধুয়ে ফেলতে হবে।

৩. ধোয়ার পর সেই পানি সংগ্রহ করে ৫ মিলি পানি একটি টেস্ট টিউবে রাখতে হবে।

৪. এবার ফরমালিন কীট থেকে দ্রবণ—১ এর ১৫ ফোটা, মাছ ধোয়া পানির মধ্যে ফেলতে হবে এবং ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে।

৫. অতপর ফরমালিন কীটের দ্রবণ—২ একইভাবে ১৫ ফোটা উক্ত টেস্ট টিউবে মাছ ধোয়া পানির মধ্যে আবার ফেলতে হবে এবং ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে।

৬. একইভাবে দ্রবণ—৩ উক্ত টেস্ট টিউবে আবার ১৫ ফোটা ফেলে ১৫ সেকেন্ড ঝাঁকাতে হবে এবং রঙ পরিবর্তন লক্ষ করতে হবে।

পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত :

১. যদি মিশ্রিত দ্রবণ সবুজাভ বর্ণ থেকে লালচে রং—এ পরিবর্তন হয় তবে মাছটিতে ফরমালিন ছিল।

২. যদি রং অপরিবর্তিত অথবা রংহীন হয় তাহলে বুঝতে হবে মাছে ফরমালিন ছিল না।

 

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ৫ , পাঠ -৫.২। মাছ পরিবহন মাছ চাষের জন্য পোনা পরিবহনে দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাছ চাষে সফলতা আনার জন্য সুস্থ ও সবল পোনা অতীব প্রয়োজন। তাই মাছ চাষের ক্ষেত্রে পোনা পরিবহনের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। রেণু পোনা মূলত: অঁাতুড় পুকুর, লালন পুকুর ও মজুদ পুকুরের জন্য পরিবহণ করা হয়ে থাকে। পোনা পরিবহনকালে অক্সিজেন ঘাটতি, শারীরিক ক্ষত, অ্যামোনিয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর পোনার মৃত্যুর হার অনেকাংশ নির্ভর করে। তাই পোনা পরিবহনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পোনা মারা না যায় বা কম মারা যায় এবং আঘাত না পায়। পোনা পরিবহনের সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং পোনা পরিবহনের পূর্বে পোনাকে কন্ডিশনিং বা টেকসই করে নিতে হয়।

মাছ পরিবহন ও বাজারজাতকরণ

 

পোনা টেকসই বা কন্ডিশনিং পদ্ধতি :

পোনা পরিবহণের সময় যাতে মারা না যায় সেজন্য পোনাকে অবশ্যই টেকসই বা পরিবহনের উপযুক্ত করে নিতে হয়। যদি কাছাকাছি কোনো স্থানে পোনা পরিবহন করতে হয় তাহলে জালের মধ্যে পোনা রেখে চারদিকে পানির প্রবাহ দিতে হয়। এতে করে পোনা অল্প জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত হবে আর পানির প্রবাহে অক্সিজেনের সরবরাহ হওয়ার সাথে সাথে পোনা ভয় পায় এবং তাড়াতাড়ি করে মলমূত্র ত্যাগ করে ও বমি করে পেট খালি করে ফেলবে। ফলে পরিবহনের সময় পোনা মলমূত্র ত্যাগ করে পানি দূষিত করতে পারে না।

আর পরিবহনের সময় যদি দীর্ঘ হয় তাহলে পোনাকে অধিকতর টেকসই করার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে পোনাকে হাপায় রেখে অথবা চৌবাচ্চায় অল্প পানির প্রবাহে রেখে একদিন উপবাসে রাখতে হবে। পোনাগুলো তখন হাপাতে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং তখন তাদের পেট প্রায় সম্পূর্ণ খালি হয়ে যায়। ফলশ্রম্নতিতে পরিবহনের সময় বমি বা মল ত্যাগ করে না এবং পরিবহনের পাত্র দূষিত হয় না। বাংলাদেশে পোনা পরিবহনের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। একটি সনাতন পদ্ধতি এবং অপরটি আধুনিক পদ্ধতি।

 

সনাতন পোনা পরিবহন পদ্ধতি :

অতি প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে পোনা পরিবহনের জন্য মাটির পাত্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে অবশ্য ধাতব পাত্র যেমন কেরোসিনের টিন, কাসা বা অ্যালমুনিয়ামের পাতিল ব্যবহৃত হচ্ছে। ধাতব পাত্রের পানি তাড়াতাড়ি গরম হয়ে যায় ফলে পোনা মারা যেতে পারে। এ অবস্থায় ভেজা কাপড় বা চট পানিতে ভিজিয়ে পাত্রের গায়ে জড়িয়ে রাখলে পাত্র সহজে গরম হয় না। সাধারনত: ২০—২৪ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পাতিল দ্বারা ৩—৫ সে.মি. আকারের ৩০০৬০০ টি পোনা তিন থেকে চার ঘন্টার পথ পরিবহণ করা যায়।

মাটির পাতিলে বাষ্পীভবন খুব ভালো হয় বিধায় পানি ঠান্ডা থাকে। মাটির পাতিল বা হাড়ি দ্বারা পোনা পরিবহনকালে যেসব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত সেগুলো হলো— পোনা পরিবহনকালে পাতিল বা হাড়িতে বেশ জোরে এবং বেশি বেশি ঝাঁকনি দেয়া উচিত নয় কেননা এতে অনেক পোনা পাতিলের গায়ে ধাক্কা খেয়ে জখম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নলকূপের বা টেপের পানি দ্বারা পাতিল বা হাড়ির পানি বদলানো উচিত নয় কেননা এধরনের পানিতে ক্লোরিন থাকে যাতে পোনা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সতর্কতার সাথে পানি বদলাতে হবে এবং পোনা পরিবহনের সময় পানি বদলানোর জন্য মগ, গামছা এবং বালতি ইত্যাদি সাথে রাখা উচিত।

সনাতন পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনের সময় প্রধানত ঃ দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন—

ক. পোনা পরিবহনের সময় যেন অক্সিজেনের অভাব না হয়।
খ. পরিবহনের সময় পোনা যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয়।

 

পোনা পরিবহনের আধুনিক পদ্ধতি :

এ পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনের জন্য অক্সিজেন পূর্ণ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতি অধিক নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে পোনা পরিবহন বেশ সহজ। রেণু অথবা ধাণী পোনা পরিবহনের জন্য অক্সিজেনপূর্ণ পলিথিন ব্যাগই উত্তম। ব্যাগের অংশ পানি এবং অংশ অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। ভর্তিকত অক্সিৃ জেনের ৬০ ভাগ হবে গ্রহণ যোগ্য অক্সিজেন। প্রথমে ব্যাগে পানি ভর্তি করে পরে সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন পূর্ণ করা হয়। চটের ব্যাগের পরিবর্তে কার্ডবোর্ড, কার্টুনও ব্যবহার করা যায়। পরিবহনের দূরত্ব, পরিবহন পাত্রের আকার বা পানি ধারণ ক্ষমতা ও পোনার আকারের ওপর ভিত্তি করে পোনার পরিমান নির্ণয় করতে হয়। একটি ৮—১০ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন পরিবহন পাত্রে ১২—১৮ ঘন্টা পর্যন্ত নিচের সারণি অনুযায়ী রেণু পোনা পরিবহন করা সম্ভব।

সারণি: পোনার সাইজের পার্থক্যভেদে পরিবহণযোগ্য পোনার সংখ্যা

আধুনিক পদ্ধতিতে পোনা পরিবহনকালেও বেশ কতগুলো সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যেমন—

ক. পোনা পরিবহনের জন্য পোনা সাধারণত প্রতিটি প্যাকেটের জন্য দুটি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।

খ. সমান আকারের দুটি পলিথিন ব্যাগ একটির ভিতর আরেকটি ঢুকিয়ে ব্যাগে পরিণত করতে হবে।

গ. পোনা পরিবহনের সময় দূরত্বের উপর নির্ভর করে ব্যাগে পোনা পূর্ণ করতে হয়। দূরত্ব কম হলে পোনার সংখ্যা বেশি হবে আর দূরত্ব বেশি হলে পোনার সংখ্যা কম হবে।

ঘ. যাতায়াতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পোনার বাক্স ছায়া ও নিরাপদ ¯া’ নে থাকে।

ঙ. কোনোভাবেই যেন ব্যাগ কেটে বা ছিঁড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।

চিত্র ৫.২.১ : অক্সিজেনযুক্ত পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহণ।

 

মাছ অর্থনীতিতে মাছ বাজারজাতকরণের গুরুত্ব:

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাছ বাজারজাতকরণের গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো :

১. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি :

মাছ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হয়। কারণ মাছ ক্রয়—বিক্রয়, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, ব্যবসা প্রভৃতি কাজের জন্যে অনেক লোক নিয়োজিত থাকে। মাছ উৎপাদন বাড়ার সাথে সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. মৎস্য পণ্যের সুষম যোগান :

বাংলাদেশে এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে মাছ উৎপাদন হয় না। এই জন্যে বিভিন্ন এলাকার ভোগকারীগণ যাতে সব ধরনের মাছ ভোগ করতে পারে এবং সুষম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এজন্যে মৎস্য পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে হবে যাতে সঠিকভাবে সবাই যোগান পায়।

৩. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন :

বাংলাদেশে থেকে মাছ রপ্তানী করে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যের স্থানানুসারে শ্রেণিবিভাগ ও নমুনাকরণ করা হলে বিদেশে আমাদের মাছের বাজার বিস্তৃত হবে এবং অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা প্রধানতঃ ২ প্রকার। যথা—  অভ্যন্তরীণ মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা।

 

অভ্যন্তরীণ মাছ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা :

বাংলাদেশের মাছের চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান থাকার কারণে অভ্যন্তরীণ বাাজরে মাছ বিপণন খুবই সহজ। বাজারে বিভিন্ন স্তরের ক্রেতা থাকলে ছোট—বড় দামি ও কম দামি মাছ সহজে বিক্রি হয়ে যায়। মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ আহরণ—পরবর্তী পরিচর্যার চেয়ে অধিক মুনাফা অর্জনে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিএফডিসি (বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন সংস্থা) আহরিত মাছ দেশের ভিতর ও বিদেশে উভয় বাাজারের জন্য বিপণন করে। নিচে মাছ বিপনন পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো :

১. আড়ৎদার : চালানীরা মাছ এনে জমা রাখে আড়তদারদের কাছে। আড়তদারগণ শুধু পাইকারী মূলে মাছ বিক্রি করে।

২. পাইকারি বিক্রেতা : আড়তদাররা নিলামের মাধ্যমে পাইকারি বিক্রেতার কাছে মাছ বিক্রয় করে। এরপর খুচরা বিক্রেতাগণ পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে ক্রয় করে।

৩. চালানী : চালানীরা পাইকারীদের কাছ থেকে মাছ ক্রয় করে বাক্স ভর্তি করে পরিবহনের মাধ্যমে শহরে আনে। মাছ বহনের জন্যে বর্তমানে বিভিন্ন ইঞ্জিন চালিত পরিবহন ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪. খুচরা বিক্রেতা : খুচরা বিক্রেতারা স্টলে বা বাজারে বসে ভোক্তাদের কাছে মাছ বিক্রি করে এবং বড় বড় শহরে ভ্যান ও মাথায় করে মাছ বিক্রি করে বেড়ায়।

৫. আন্তর্জাতিক মাছ বাজার ব্যবস্থা : বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত মাছ বিদেশে রপ্তানী করা হয়। এ সকল মৎস্যজাতপণ্য অধিকাংশই সমুদ্রপথে রপ্তানি হয়। মোট রপ্তানিকৃত মৎস্যজাত পণ্যের ৯০% চিংড়ি ও বাকি ১০% অন্যান্য মাছ। হিমায়িত মৎস্য পণ্যের প্রধান বাজার হলো আমেরিকা, ইউরোপীয় দেশসমূহ, জাপান এবং জার্মানি।

বাংলাদেশ থেকে যে সকল মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে তার মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনের দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তরের পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগের। এছাড়া কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এ সকল পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে।

 

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের, ১ নং ইউনিটের ১.৭ নং পাঠ।

 

প্রদর্শিত মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) শনাক্তকরণ ব্যবহারিক

 

রাজপুটি

 

মূলতত্ত্ব :

মাছ আমিষ জাতীয় খাদ্য। আমাদের দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাতে মাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে মাছ শনাক্ত করতে পারে সে দিকে বিবেচনায় রেখেই এই পাঠের অবতরণা।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবহমানকাল থেকেই এদেশের মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে মাছ। আর এজন্যই বলা হয় “মাছে ভাতে বাঙালী। বিপুল জলসম্পদের এই দেশে অগনিত মানুষ মৎস্য আহরণ, চাষ ও বেচা—বিক্রিসহ এ সংক্রান্ত নানা কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে প্রাণীজ আমিষের উত্তম উৎস হিসেবে মাছের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার্জনের পাশাপাশি মৎস্য চাষ করে অনেক বেকার যুবকযুবতী স্বাবলম্বী হচ্ছে।

 

নাইলোটিকা মাছ

 

যার ফলে দেশের আর্থ—সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ত্বরাম্বিত হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার মৎস্য খাতের সার্বিক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনাগত উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সময়োপযোগী ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছসহ অন্যান্য জলসম্পদের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা কার্যকর উদ্যোগ। ফলে দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৪—১৫ অর্থবছরে ৩৬ লক্ষ ৮৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই শেখ হাসিনা সরকারের সুযোগ্য নেতৃত্বে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার মালিকানা অর্জন করেছে।

এখন জাতিসংঘ ঘোষিত “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি)” অর্জনে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পাশাপাশি সামুদ্রিক বিশাল জলজসম্পদকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে।
এ ইউনিটের বিভিন্ন পাঠে মাছ চাষের ইতিহাস, মাছের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, মাছের বাসস্থানসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মাছের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

 

পাঙাশ মাছ

 

প্রয়োজনীয় উপকরণ:

*নমুনা মাছ (রাজপুটি, নাইলোটিকা কই ও পাঙ্গাস) রর.. মাছ রাখার জন্য ট্রে/পাত্র ররর. ফরসেফ বা চিমটা রা. ফরমালিন, খাতা, কলম ইত্যাদি।

 

কার্যপদ্ধতি:

১. প্রথমে বাজার থেকে চারটি নমুনা মাছ জোগাড় করুন। এবার চারটি মাছকে পৃথক পৃথক ট্রেতে রাখুন। ররর. মাছগুলো যাতে তাড়াতাড়ি পচে না যায় তার জন্য সামান্য পরিমাণ ফরমালিন ব্যবহার করুন। রা. এবার চিমটা দিয়ে নমুনা মাছগুলো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে বহিরাকৃতি পর্যবেক্ষণ করুন। ব্যবহারিক নোটবুকে ট্রেতে রাখা মাছ চারটির চিহ্নিত চিত্র অংকন করুন এবং তাদের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য লিখুন। ক্লাস শেষে মাছগুলো গ্লাসজারে ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষণ করুন।

 

 

নমুনা— রাজপুটি শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. রূপালি আঁইশে আবৃত দেহ দেখতে অনেকটা দেশী সরপঁুটির মত। তবে শরীর পাশ্বীর্য়ভাবে বেশ চ্যাপ্টা ও পাতলা। রর. দেশী সরপুঁটি তুলনায় এর মাথা ছোট।
২. দেহের সামনে ও পিছনে চাপা এবং মাঝখানে বেশ চওড়া।
৩. মাছটির পিঠের দিকে হালকা মেটে এবং পেটের পাখনার রং হালকা হলুদ।

নমুনা : নাইলোটিকা শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:
১. মাছটি দেখতে ধুসর—নীলাভ থেকে সাদা লালচে।
২. পৃষ্ঠ পাখনা কালো বর্ণের মার্জিনযুক্ত এবং পুচ্ছ পাখনা সাদা বর্ণের সরু ও লম্বা দাগযুক্ত । ররর. পৃষ্ঠ ও পায়ু পাখনায় শক্ত কাঁটা আছে।

 

 

নমুনা : কই শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. দেশী কই—মাছ ছোট অবস্থায় কালচে ধরনের এবং পরিপক্ক অবস্থায় পিঠের দিকে বাদামী সবুজ আর পেটের দিকে হালকা হলুদ রঙের হয়। থাই/ভিয়েতনামী কই—এর দেহ হালকা ফ্যাকাশে ধরনের। দেহের উপরিভাগে ছোট ছোট
কালো দাগ থাকে এবং পাখনাগুলো হালকা হলুদ রঙের হয়। রর. দেশী কই—এর কানকোর পিছনে কালো দাগ থাকে কিন্তু পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে না। থাই কইয়ের  কানকোর পিছনে এবং পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় কালো দাগ থাকে। ররর. দেশী কই—এর মুখ কিছুটা চোখা (চড়রহঃবফ) এবং থাই কই এর মুখটা ভেঁাতা (ইষঁহঃ)। রা. উভয়েরই পৃষ্ঠ পাখনায় ১৬ থেকে ২০টি এবং পায়ু পাখনায় ৯—১১ টি শক্ত কাঁটা থাকে। া. মাথার উপরেও আঁইশ বিদ্যমান।

 

 

নমুনা : পাঙ্গাস (থাই) শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য:

১. পাঙ্গাসের দেহে কোন আঁইশ থাকে না।
২. পাঙ্গাস দেখতে রুপালি—সাদা, পিঠের দিকটা নীলাভ—কালচে বর্ণের হয়। ররর. পিঠে ৯টি ও কানের পাশে ২টি শক্ত কাঁটা থাকে।
৩. এদের ছোট গোঁফ এবং পিঠে এডিপোজ ফিন থাকে।

 

কচ্ছপ চাষ

আজকের আলোচনার বিষয় কচ্ছপ প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা। কচ্ছপ মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকায় অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুন বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়াও কচ্ছপ রপ্তানী পণ্য বিধায় প্রতি বছর এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। কচ্ছপের বাসস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আহরণ নিশ্চিত করতে না পারলে শীঘ্রই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।

কচ্ছপ চাষ

কচ্ছপের প্রজাতিসমূহ:

পৃথিবীতে কচ্ছপের ৩৪০টি প্রজাতি রয়েছে যাদের ভৌগোলিক বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় যার ৪ টি বিদেশে রপ্তানী করা যায়।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজতিগুলো নিম্নে প্রদত্ত হলো (সারনি ২):

ক্রম ইংরেজী নাম বৈজ্ঞানিক নাম আঞ্চলিক নাম
০১ রুফড টার্টল

(Roofed turtle)

কাচুগা টেনটোরিয়া

(Kachuga tentoria)

মাজহারি কাইট্টা
০২ স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল

(Spotted flap shell turtle)

লাইসেমিস পাঙ্কটাটা

(Lissemys punctata)

শুনধি কাসিম
০৩ পিকক্ সফ্ট শেল টার্টল

(Peacok soft shell turtle)

অ্যাসপিডেরেটেস হুরুম

(Aspideretes hurum)

ধুম কাসিম
০৪ এশিয়াটিক সফ্ট শেল টার্টল

(Asiatic soft shell turtle

চিত্রা ইনডেকা

(Chitra indica)

সিম কাসিম

 

কচ্ছপের বাস ও বাসস্থান:

কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজতি সাগর থেকে শুরু করে নদী-নালা, ডোবা ও স্থলে বাস করে। এদের দেহের ওজন অত্যন্ত অল্প থেকে শুরু করে কয়েকশত কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 

 

কচ্ছপের প্রাকৃতিক প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল:

কচ্ছপের ডিম-ধারণ ক্ষমতা:

কচ্ছপের বয়স ও আকার অনুসারে ডিম-ধারণ ক্ষমতার তারতম্য হয়ে থাকে। সাধারণত এদের ডিম ধারণ ক্ষমতা ২-২০টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিশেষ এক ধরণের সামুদ্রিক কচ্ছপ ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কচ্ছপের ডিম-ধারণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কচ্ছপ জলাশয়ের পাড়ে ডাঙ্গাঁয় এসে ডিম দেয়। ডিম দেয়ার পূর্বে স্ত্রী কচ্ছপ পিছনের পা দিয়ে নরম মাটি বা বালিতে গর্ত করে প্রতিটি গর্তে একটি করে ডিম ছাড়ে।

ডিম ছাড়ার শেষ হলে সংরক্ষণের জন্য স্ত্রী কচ্ছপ মাটি দিয়ে ডিম ঢেকে রাখে। কচ্ছপের ডিম গোলাকার থেকে শুরু করে ক্যাপসুল আকারের হয়। ডিমের খোলস অত্যন্ত শক্ত এবং সাদা বর্ণের। কচ্ছপের প্রজনন সাফল্য, তথা ডিম পরিস্ফুপনের হার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন, মাটিতে তাপমাত্রা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে । ডিম ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ভারী বৃষ্টিপাত বা অতিরিক্ত গরম বা শীতে ডিম নষ্ট হয়ে যায়।

 

কচ্ছপের পোনা উৎপাদন কৌশল:

নরম খোলসধারী কচ্ছপের বৈজ্ঞানিক নাম ট্রায়নিক্স সাইনেনসিস উইজমেন( Trionyx sinenisis Weigmann ) সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় এ প্রজাতির কচ্ছপের চাষ করা হয়। এ কচ্ছপ ২-৩ বছর বয়সে ডিম দেয়। সাধারণত ২০০ বর্গমিটার বা অপেক্ষাকৃত বড় প্রজনন পুকুরে ৩:১ অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ কচ্ছপ মজুদ করে ভাল ফল পাওয়া যায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর সারা বছর ডিম দেয়। এ প্রজাতি পর্যায়ক্রমে ১০-১৫টি ডিম ছাড়ে। পুকুরের এক পাড়ে ১.৫-২.৫ বর্গমিটার স্থানে ১৫-২৫ সে.মি.পুরু বালি বিছিয়ে তার ১.০-১.২ মিটার উপরে ছাউনি দিয়ে প্রজননের স্থান তৈরি করা হয়। কচ্ছপ প্রজনন স্থানে সহজে উঠার জন্য পানি হতে প্রজননের স্থান পর্যন্ত কাঠের তৈরি ঢালু সিঁড়ি স্থাপন করা হয়।

প্রজননের স্থানে কচ্ছপের পায়ের দাগ ও গর্তের চিহ্ন দেখে প্রত্যহ সকালে বালির নীচ থেকে ডিম সংগ্রহ করে কাঠের বাক্সে ১-২ দিন রেখে দিলে নিষিক্ত ও অনিষিক্ত ডিম সনাক্ত করা যায়। নিষিক্ত ডিমের মাথায় সাদা মুকুট তৈরি হয়। অন্যদিকে অনিষিক্ত ডিমের খোলসে সাদা দাগ দেখা যায়। অতঃপর নিষিক্ত ডিমগুলোর সাদা মুকুট উপরের দিকে রেখে হ্যাচারীতে রাখা বালির স্তুপে প্রতিটি ১-২ সে.মি. দূরত্বে বসিয়ে ৫ সে.মি.পুরু বালি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। ডিমের সাদা মুকুট উপরের দিকে না রাখলে ডিম ফোটার হার কমে যায়।

ডিম ফোটার স্থানে সরাসরি সূর্যালোক ও বৃষ্টি পড়তে না দেয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণত ২৫ডিগ্রী-৬০ডিগ্রী সে. তাপমাত্রায় ৪৫-৬০দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। ডিম ফোটার স্থানের এক প্রান্তে অল্প গভীরতায় পানি রাখলে ডিম থেকে বাচ্চ বেরিয়ে গিয়ে পানিতে আশ্রয় নেয়। সদ্য প্রস্ফুটিত বাচ্চার দেহের দৈর্ঘ্য ২-৩ সে.মি. এবং ওজন ২-৪ গ্রাম হয়ে থাকে।

সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাচ্চা লালনের কৃত্রিম খাদ্য পাওয়া যায়। কৃত্রিম খাদ্য ছাড়াও মাছ, কেচোঁ ও মুরগির মাংস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এরা আট সপ্তাহে ৪-৫ সে.মি. লম্বা ও ৯-১৯ গ্রাম ওজনের হয়। এদের দৈহিক বৃদ্ধির হার পানির গুণাগুণ, মজদ ঘনত্ব এবং খাদ্যের গুণগতমানের উপর নির্ভর করে। বাচ্চার দৈহিক আকারে তারতম্য দেখা দিলে বড়গুলোকে আলাদাভাবে লালন করতে হয়। তা না হলে এদের মধ্যে স্বখাদকতা বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। বাচ্চার দৈর্ঘ্য ১০-১২ সে.মি. হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত লালন পুকুরে মজুদ রাখা হয়।

 

 

মজুদ পুকুরে কচ্ছপ চাষ কৌশল

উন্নত ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মজুদ পুকুরের আকার ২০০-১০০০ বর্গমিটার এবং পানির গভীরতা ৫০-৭০ সে.মি. হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরের পাড়ে বেড়া দিয়ে কচ্ছপের বহির্গমন পথ বন্ধ করতে হয়। পুকুর শুকিয়ে তলায় চুন প্রয়োগ করে পানি সরবরাহ দিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ৮-১২ টি পোনা মজুদ করা যায়।

 

কচ্ছপের সম্পূরক খাদ্য

কচ্ছপের খাদ্যে কম চর্বি এবং কমপক্ষে ৪৫-৫৫% প্রোটিন থাকা বাঞ্ছনীয়। ছোট মাছ, মরগির মাংস ও নাড়ী-ভুড়ি কচ্ছপের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায়। পুকুরে প্রতিদিন এক থেকে দুবার খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।

 

পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ ব্যবস্থাপনা

কচ্ছপ চাষের পুকুরকে তন্তুজাতীয় শেওলা ও আগাছা হতে মুক্ত রাখতে হয়। কেননা কচ্ছপ অধিকাংশ সময় পুকুরের তলায় কাদার ভিতরে বাস করে বিধায় পুকুরে জৈবিক পদার্থের পচন ক্রিয়া বেশী হলে অক্সিজেনের অভাব ঘটে কচ্ছপের ব্যাপক মৃত্যু ঘটার আশাংকা থাকে। সেজন্য পানির স্বচ্ছতা ১৫-৩০ সে.মি. রাখা বাঞ্ছনীয়।

 

কচ্ছপের উৎপাদন

বাংলাদেশে কচ্ছপ চাষের কলাকৌশল উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা এখনও তেমন পরিচালিত হয়নি। ফলে কচ্ছপের বাণিজ্যক উৎপাদন এবং মুনাফা সম্পর্কিত তথ্যাদি অত্যন্ত অপ্রতুল। উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষকালে বছরে এদের দেহের ওজন ৫০০-৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে।

 

চাষকালীন সতর্কতা

কচ্ছপ পরিণত বয়সের পুরুষ ও স্ত্রীকে আলাদা করে রাখতে হয়। অন্যথায় পুরুষ কচ্ছপ স্ত্রীকে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। পুকুরে জাল টেনে বা পুকুর শুকিয়ে কচ্ছপ আহরণ করে জীবিত অবস্থায় বাজারজাত করা হয়।

 

 

সংরক্ষণের সুপারিশ

কচ্ছপ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থকরী সম্পদ। পরিবেশের বিপর্যয় এবং মাত্রাতিরিক্ত আহরণের ফলে এর জীববৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশে এদের ভারসাম্যপূর্ণ মজুদ বজায় রেখে আহরণ ও চাষ পদ্ধতির উন্নয়নে দ্রূত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরী। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কতিপয় সুপারিশ উল্লেখ করা হলো:

  • প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য নিরুপনের জন্য বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  • কচ্ছপের যে সমস্ত প্রজাতির বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে,সেগুলোকে সনাক্ত করে এদের প্রজনন আচরণ, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস এবং চাষ পদ্ধতি উন্নয়ন সংক্রান্ত নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন।
  • কচ্ছপের বাস ও বাসস্থানের উন্নয়নের জন্য যথাযথ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  • সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কচ্ছপের বাণিজ্যিক চাষ হয় । সে সমস্ত দেশে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশে মৎস্য হবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা পরিকল্পনা প্রণয়ণ এবং বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। এর ফলে কচ্ছপ চাষ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থপনা কলাকৌশল উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরী করা যাবে।
  • বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কচ্ছপ চাষ অনেকাংশে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত বাচ্চা ও সম্পূরক খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। তাই এ চাষ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কচ্ছপের কৃত্রিম প্রজনন, ব্যাপক পোনা উৎপাদন ও সম্পূরক খাদ্য তৈরীর কৌশল বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।
  • প্রাকৃতিক পরিবেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নিমিত্ত জাতীয় পর্যায়ে টাস্ক ফোর্স গঠন বা এ জাতীয় অন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

কচ্ছপ একটি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন অপ্রচলিত রপ্তানী পণ্য । বিশ্ববাজারে মানুষের উপাদেয় খাদ্য হিসেবে কচ্ছপের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতিসমূহের মধ্যে নরম খোলসধারী কচ্ছপ চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে কচ্ছপের ভারসাম্যহীন আহরণ এবং চাষাবাদের মাধ্যমে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারায় দেশে কচ্ছপের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশাংকা দেখা দিয়েছে।

দেশের বিভিন্ন পরিবেশগত অঞ্চলে এর প্রাচুর্য্য নিরূপন ও আবাসস্থলের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এদের সংরক্ষণ করা যায়। তাছাড়া প্রণোদিত প্রজনন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করে কচ্ছপের প্রাচুর্য্য বৃদ্ধি করা যায় । এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা আবশ্যক । কচ্ছপের সংরক্ষণ , প্রজনন ও চাষ কার্যক্রম হাতে নেওয়ার জন্য সহায়ক পুস্তিকা হিসাবে এ ম্যানুয়েলটি প্রণয়ন করা হলো।

 

গুচি মাছ চাষ পদ্ধতি

আমরা আজ গুচি মাছ চাষ পদ্ধতি বা বাইম মাছের প্রজনন ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। প্রাকৃতিক জলাশয়ের যত মাছ আছে এর মধ্যে গুচি বা বাইম মাছের কদর অনেক বেশি। বাইম মাছ আগে শুধু প্রাকৃতিক ভাবে জলাশ্বয়ে উৎপাদিত হতো। তবে কৃত্রিম উপায়ে বাইম মাছের প্রজনন ও চাষ আজ সফল।

গুচি মাছ চাষ পদ্ধতি

বাংলা মানুষের প্রিয় মাছের তালিকাতে রয়েছে অন্যন্য বাহারি মাছ(Ornamental) যেমন টেংরা, গুলসা, রাণি ও খলিসা মাছের মত তারা বাইম। প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত তারা বাইম মাছের কদর রয়েছে বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের খাদ্য তালিকা তে সে জন্য এ মাছ রপ্তানি করে আসে বৈদাশিক মুদ্র্যা। গুচি মাছ, স্টার বাইম বা তারা বাইম (Macrognathus aculeatus) মাছটি Mastacembelidae পরিবারের আওতাভূক্ত।

দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় বাইম বা গুচি মাছের উপকারিতা ও গুরুত্ব অনেক। তারা বাইম মাছে মানুষের দেহ গঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রোটিন, ভিটামিন–এ, ক্যালসিয়াম ও আয়রন রয়েছে। ফিস প্রোটিন রক্তে কোলেস্টেরল জমতে দেয় না। মাছে উচ্চমানের প্রোটিন ছাড়াও লাইসিন, থিয়োনিন ও ফসফরাস প্রচুর পরিমাণে থাকে যা মানবদেহ গঠন, সুস্থ ও সবল রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গুচি মাছ বা তারা বাইমের বৈশিষ্ট্যঃ

লম্বা, হলুদাভ, সর্পিলাকার এ মাছের লেজের দিকে গোলাকার তারারমত কালো দাগ থাকায় মাছটি তারাবাইম নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল ও মায়ানমারে পাওয়া যায় ভারতের আসামে এটি পিকক ইল, টোরা, মাড্ ইল নামে পরিচিত। স্টার বাইম মাছটি দেখতে খুবই সুন্দর, বাহারি, খেলোয়াড় মাছ হিসাবে (Playful behavior) এ্যাকুরিয়ামের শোভা বর্ধক মাছ হিসাবে বহুল প্রচলন রয়েছে।

গুচি মাছ বা তারা বাইম মাছের স্বভাব ও বাসস্থানঃ

তারা বাইম মাছ কাদার তলা তে এবং অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে। সুদূর অতীত থেকেই পৃথিবীর প্রাকৃতিক জলাশয়ে খাপ খেয়ে টিকে আছে বহু প্রজাতির মৎস্য কুল। এছাড়া তারা বাইম আবহমান কাল থেকে এ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজে প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায় এবং পুষ্টি যোগানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশের নদ–নদী, খাল–বিল, ডোবা, পুকুর, দিঘি এবং প্লাবন ভূমিতে ছোট দেশিয় প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিকভাবেই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত।

দেশিয় প্রজাতির মাছ এদেশের সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যগতভাবে মিশে আছে। মানুষের চাহিদার সাথে সাথে কালের পরিক্রমায় বিরূপ প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর মানুষের অত্যাচার, জুলুমের ফলে আমাদের সমৃদ্ধ মৎস্য ভান্ডার এখন হুমকির মুখে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে জলজ পরিবেশের বিপর্যয়, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার, ডুবন্ত জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা কমে যাওয়ার কারণেও তারা বাইম মাছটি এখন বিলুপ্তির পথে

স্বাদু পানিতে মাছ চাষ ব্যবস্থাপনা লেখা টি পড়লে আপনার স্বাদু পানির মাছ চাষ বিষয়ক কিছু টেকনিক্যাল বিষয় জানা হবে যা মাছ চাষে সাহায্য করবে।

গুচি মাছ বা তারাবাইম মাছের প্রণোদিত প্রজননঃ

প্রনোদনার মাধ্যমে প্রজনন করাকে প্রণোদিত প্রজনন বলা হয়। প্রাকৃতিক ভাবে মাছের প্রজনন ব্যাঘাত ঘটলে মাছের প্রজনন ও বংশ বিস্তার বাধার সম্মুখিন হ্য় এবং মাছ বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হয়। তারাবাইম মাছের প্রণোদিত প্রজননের ক্ষেত্রে ব্রুড মাছ (মা ও বাবা মাছ) ব্যবস্থাপনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্রুড মাছ লালন করার জন্য সাধারণত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুকুরেই লালন করা ভাল। তবে একটু বড় পুকুর হলেও সমস্য হয় না।

গুচি মাছ বা তারা বাইম মাছের জন্য পুকুর প্রস্তুতিঃ

পুকুর প্রস্তুতির জন্য নিমোক্ত কাজ পর্যায়ক্রমে করতে হবে।

  • নার্সারি পুকুরে আয়তন ১০ থকে ৫০ শতক এবং পানির গভিরতা ৪ থেকে ৫ ফিট হলে ভাল।
  • পুকুর হতে অবঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ এবং আগাছা দুর করতে হবে।
  • পুকুরে শুকিয়ে অবঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ এবং আগাছা দুর করা উত্তম। তবে পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে প্রতি শতাংশে ১ ফুট পানির জন্য ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন পাউডার অথবা ফোসটক্সিন ট্যাবলেট দিয়ে রাক্ষুসে মাছ দুর করা যায়।
  • রোটেনন দেবার ৩-৪ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • চুন প্রয়োগের ৩/৪ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৭৫ গ্রাম টিএস পি প্রয়োগ করতে হবে।
  • নার্সারি পুকুরে ৩-৪ ফিট উচু মশারি জালের বেষ্টনি দিতে হবে যাতে সাপ ও ব্যাঙ পুকুরের ভিতরে ঢুকে রেনু ও পোনার ক্ষতি সাধন করতে না পারে।
  • হাস পোকা দমনের জন্য রেনু পোনা মজুদের ২৪ ঘন্টা পূর্বে সুমিথিয়ন দিতে। সুমিথিয়নের ব্যবহারের পরিমান প্যাকের গায়ে লেখা অনুসরণ করা ভাল।
  • পানির রং স্থির রাখতে প্রতি শতকে ২৫০ গ্রাম ব্রাইট গোল্ড (দানাদার) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • সার প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর রেনু অথবা ২-৩ ইঞ্ছি সাইজের পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
  • পুকুরের তলায় যদি গ্যাস থাকে তাহলে গ্যাস উত্তোলন করার জন্য “গ্যাস টপ” ঔষধ দিতে হবে ।
  • মাছ মজুদ করার পর সরিষার খৈল,অটোচালের কুড়া, আটারভুষি, ফিসমিল, ভিটামিন প্রি–মিক্স ও ডাই ক্যালসিয়াম ফসফেট (২০:৩৩:২৫:২০:১:১) অনুপাতে মিশিয়ে মাছের ওজনের ৪–৫% হারে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ও ভোরে খাবার প্রয়োগ করতে হবে। খাবার মাটির প্লেট অথবা ট্রেতেও দেয়া যেতে পারে।
  • তাছাড়া বাজারের ৩০% প্রোটিন সমৃদ্ধ প্যাকেজ ফিড্ও দেয়া যেতে পারে। এভাবে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যার মাধ্যমে তারাবাইম (পুরুষ ও স্ত্রী) মাছ ৩–৫ মাসের মধ্যে প্রজননক্ষম ও পরিপক্ক হয়ে থাকে।
  • তারাবাইম (M. aculeatus) মাছ নিশাচর (Nocturnal feeding habits)। এরা রাতে ও ভোরে খাবার খায়। দিনের বেলায় নিজেদের এরা গর্তে আবর্জনার নিচে ডুবন্ত উদ্ভিদের নিচে লুকিয়ে (hide habits) রাখে। এজন্য এদের আশ্রয়ের জন্য পুকুরে মাটির ভাংগা চাড়ি, ছোট ছোট বাঁশের পুল, প্লাস্টিক পাইপ ইত্যাদি দিয়ে রাখতে হবে।
  • প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তারাবাইম মাছ পুরুষ ও স্ত্রী চেনা কষ্টসাধ্য। তবে একই বয়সের স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছ অপেক্ষা একটু বড় হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক স্ত্রী মাছে পেট বড় নরম ও ওভারি গোলাকার নীলাভ বর্ণের হয়ে থাকে এবং পুরুষ মাছের পেট সমান শক্ত লম্বাটে ও চাপ দিলে বিন্দু বিন্দু সাদা শুক্র (Sperm) বের হয়ে থাকে প্রজননের জন্য সাধারণত ১৫–২০ সে.মি. সাইজের অথবা ১৫–২৫ গ্রাম ওজনের মাছ ব্যবহার করাই ভাল।

 

 

গুচি মাছ বা তারাবাইম মাছের কৃত্রিম প্রজনন

উন্নত ব্রুড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ প্রজননের জন্য পরিপক্ক হলে প্রণোদিত প্রজননের জন্য ২টি পদ্ধতি প্রথম চাপ পদ্ধতি ও দ্বিতীয় কচুরিপানা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রজনন করা যায়।

গুচি মাছ বা তারাবাইম মাছের প্রণোদিত প্রজননের চাপ পদ্ধতি (Striping method):

প্রজনন মৌসুমঃ প্রজননের জন্য মে–জুন হচ্ছে উৎকৃষ্ট সময়। তবে তারাবাইমের মে থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রজনন মৌসুম।

ব্রুড মাছের খাপ খাওয়ানোঃ প্রথমে ব্রড মাছের পুকুর থেকে পরিপক্ক প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ নির্বাচন পূর্বক হ্যাচারীতে ঝর্ণার সাওয়ারের পানিতে ৮-/১০ ঘন্টা রেখে খাপ খাওয়াতে হবে।

পিজি ইঞ্জেকশনঃ প্রথমে স্ত্রী মাছকে পিজি (পিটুইটারি গ্ল্যান্ড) ৪০ মি. গ্রাম/কেজি ডোজ দিয়ে ৬ ঘন্টা ব্যবধানে ২য় মাত্রা ৫০ মি.গ্রাম/কেজি প্রয়োগ পূর্বক পুরুষ মাছকে একক মাত্রায় ৪০ মি.গ্রাম/কেজি দিয়ে সিসর্টানে ঝর্ণার নিচে রাখতে হবে। ২য় ডোজের ৭–৮ ঘন্টা পর (২৭–৩৩০ সে. তাপমাত্রায়) মাছ যখন কোর্টসীপ আচরণে জোড়ায় জোড়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে, আলিঙ্গন করতে থাকবে, তখন স্ত্রী মাছকে নরম টাওয়েল দিয়ে ধরে চাপ পদ্ধতিতে ছোট প্লেটে ডিম সংগ্রহ পূর্বক পুরুষ মাছ হতে একই নিয়মে শুক্রানু বের করে পালকের সাহায্যে মিশিয়ে ডিমকে নিষিক্ত পূর্বক ট্রেতে ছড়িয়ে দিতে হবে।

নিষিক্ত ডিম গুলোকে ট্রেতে রেখে পাইপ লাইনে ফোঁটা ফোঁটা পানি সরবরাহ পূর্বক এরেশন দিয়ে রাখতে হবে। ট্রেতে পানির গভীরতা হবে ১০–১২ সে.মি.। পানি হতে হবে সর্ম্পূণ আয়রন মুক্ত। এভাবে ২০–৩৩ সে. তাপমাত্রায় ৩৬–৪০ ঘন্টা পর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হয়।

গুচি মাছ বা তারাবাইম মাছের প্রণোদিত প্রজননের কচুরিপানায় প্রজনন পদ্ধতি:

চাপ পদ্ধতির মত একই নিয়মে পিজি ১ম ও ২য় মাত্রা প্রয়োগ করে এ পদ্ধতিতে পরিস্কার কচুরিপানা যুক্ত হাপার পানিতে রেখে ঝর্ণার সাওয়ার দিতে হয়। ঝর্ণার সাওয়ারে ৮–১০ ঘন্টা পর স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ার পর পুরুষ মাছ শুক্রানু ছাড়ার মাধ্যমে নিষিক্ত করে থাকে। কচুরিপানায় প্রজনন পদ্ধতিতে ৩৬–৪০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফোটা শুরু হয়। ডিম ফোটা শেষ হলে কচুরিপানা গুলো হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই পদ্ধতিতে পোনা মৃত্যু হার কম, স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও বৃদ্ধি হারও বেশি। তারাবাইমের ডিম আঠালো এবং ডিম গুলো দেখতে গোলাকার ও সবুজ রংয়ের হয়। আঠালো ডিম কচুরিপানার মূলে লেগে থাকে।

 

 

গুচি মাছ বা তারা বাইম লার্ভাল অবস্থায় লালন ও পালনঃ

লার্ভাল অবস্থায় থেকে তারা বাইম নিজেদের দিনের বেলায় লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসে। মাটির ভাংগা অথবা চাড়ি জীবাণুমুক্ত করে পুকুরে দিয়ে রাখতে হবে। তাদের দিনের বেলায় লুকানোর জন্য যায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।

লার্ভাল অবস্থায় খাবারঃ সিদ্ধ ডিমের কুসুম, আটা, জুপ্লাংক্টন দিতে হবে। পুকুরে খড় প্রয়োগ করলে টিউবেফেক্স তৈরি হয় যা তারা বাইমের প্রিয় খাবার। প্রাকৃতিক খাবার ও টিউবেফেক্স খাবার

লার্ভাল অবস্থায় রোগ ব্যবস্থাপনাঃ লার্ভাল অবস্থায় বেশি ব্যাকটেরিয়া ও ফ্যাঙ্গাস বেশি আক্রান্ত করে এবং মাছের মৃত্যু হার বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য নিয়মিত পুকুরে জীবাণুনাশক ব্যবহার এবং দিনে দুইবার মিথিলিন ব্লু দিতে হবে।

গুচি মাছ বা তারা বাইম নার্সারী পুকুর ব্যবস্থাপনাঃ

প্রাকৃতিক খাবার তৈরি করে তারা বাইম কে নার্সারী পুকুরে দিতে হবে। নার্সারী পুকুর কাদা কম এবং ছোট ৮-১০ শতাংশ এর ছোট পুকুর হলে ভাল হয়। নার্সারী তে বাজার প্রাপ্ত নার্সারী খাবার ৩০-৩৫ শতাংশ প্রোটিন যুক্ত খাবার দেয়া ভাল। বাজারে শিং মাগুর ও গুলসা মাছের খাবার তারা বাইম মাছ খায়।

তারা বাইম মাছ কে রাতে খাবার দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রতি মাসে পুকুরে জীবাণুনাশক, চুন এবং সার প্রয়োগ করতে হবে।

গুচি মাছ বা তারা বাইম মাছ চাষে আয় ও ব্যায়ঃ

তারা বাইম মাছ ৭-৮ মাসে ১০০ গ্রাম থেকে ১২০ গ্রাম হয়। ১০০ গ্রাম -১২০ গ্রাম ওজনের হলে তারা বাইম বিক্রির উপযোগী হয়। বাজার এ মাছের দাম ৪৫০ -৫০০ টাকা কেজি। প্রতি শতাংশে ৪০ থেকে ৫০ কেজি তারা বাইম চাষ করা যায়। প্রতি বিঘা পুকুরে ১২০০ কেজি চাষ করলে ৫৪০,০০০ টাকার মাছ বিক্রি সম্ভব। প্রতি বিঘা থেকে ৩০০,০০০ থেকে ৩৫০,০০০ টাকা নেট আয় করা সম্ভব।

 

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ , ধান ক্ষেতে নির্দিষ্ট সময় ধরে বর্ষার পানি জমে থাকে যা নিঃসন্দেহে মাছ চাষের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ। ধান ক্ষেতে ব্যবহৃত সার, গোবর ইত্যাদি, পানি ও মাটির সাথে মিশে প্রাকৃতিকভাবে খাবার তৈরি করে যা মাছ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধানক্ষেতে মাছ চাষের প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন চাষি ধান উৎপাদনের সাথে সাথে বাড়তি আয়ও পেতে পারে । আমন ও বোরো দুই মৌসুমেই ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা সম্ভব । তবে আমন মৌসুমে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ বেশী লাভজনক ।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষ

সেচ সুবিধার আওতাধীন যে সমস্ত ধান জমি রয়েছে সেসকল জমিতে স্বল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প পরিশ্রমে ধানের পাশাপাশি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। ধান ক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু অর্থই যোগান দেয় না সেই সাথে তাদের পুষ্টিও নিশ্চিত করে।

ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সুবিধা:

  • একই জমি থেকে ধানের সাথে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে মাছ পাওয়া যায় সুতরাং জমির সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব।
  • ধান ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে এবং অনিষ্টকারী পোনা-মাকড় মাছ খায়ে ফেলে। ফলে ধানক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
  • মাছের চলাফেরার মাধ্যমে ক্ষেতের কাদামাটি উলটপালট হয় ফলে জমি হতে ধানের পক্ষে অধিকতর পুষ্টি গ্রহণযোগ্য হয়।
  • মাছের বিষ্টা সার হিসাবে ধান ক্ষেতের উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে।

ধান ক্ষেতে চাষ পদ্ধতি:

সাধারণত: দুই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়:

১. ধানের সাথে মাছের চাষ:

  • একই জমিতে ধান ও মাছ একত্রে চাষ করা হয়।
  • আমন মৌসুমে মাঝারি উঁচু জমিতে যেখানে ৪-৬ মাস বৃষ্টি পানি জমে থাকে সেখানে ধানের সাথে মাছ চাষ করা যায়।
  • বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধার আওতাধীন জমিতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।

 

২. ধানের পরে মাছের চাষ

  • বাংলাদেশের যে সমস্ত জমি বর্ষাকালে প্লাবিত হয় এবং রোপা আমন চাষ করা হয় না সেখানে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা যায়।

মাছ চাষের জন্য জমি নির্বাচন:

  • সব ধান ক্ষেত মাছ চাষের জন্য উপযোগী নয়। ধান ক্ষেতে মাছ চাষের সফলতা নির্ভর করে জমি নির্বাচনের ওপর। জমি নির্বাচনের সময় নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জমি নির্বাচনের সময় বিবেচনাধীন বিষয়গুলো:-
  • সাধারণত: দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ এবং এটেল মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা এবং উর্বরা শক্তি বেশি বিধায় এসব মাটির জমি ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্য উপযোগী।
  • অতি উঁচু অর্থাৎ পানি ধরে রাখাতে পারে না এবং অধিক নিচু জমি অর্থাৎ সহজেই প্লাবিত হয় সেসব জমি মাছ চাষের অনুপযোগী।
  • বন্যার পানি প্রবেশ করে না এরূপ উঁচু জমিই মাছ চাষের উপযোগী।
  • বোরো মৌসুমে চাষের ক্ষেত্রে সেচের সুবন্দোবস্ত থাকতে হবে।

ধান ক্ষেত প্রস্তুতকরণ:

  • যথাযথভাবে চাষ ও মই দিয়ে ধান চাষের প্রচলিত নিয়মে জমি প্রস্তুত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন ক্ষেত আগাছামুক্ত হবে তেমনি জমি কাদা হয়ে ধান রোপণের উপযুক্ত হবে।
  • ক্ষেতের চারপাশের আইল কমপক্ষে ০.৩ মিটার বা ১ ফুট উঁচু ও ১ ফুট চওড়া করে তৈরি করতে হবে। তবে আইলের উচ্চতা নির্ভর করবে জমির অবস্থানের ওপর।
  • জমির যে অংশ অপেক্ষাকৃত ঢালু সে অংশে জমির শতকরা ২-৩ ভাগ এলাকা জুড়ে কমপক্ষে২-৩ ফুট গভীর একটি ডোবা খনন করতে হবে, যা ক্ষেতের কোণায়, পাশে বা মধ্যে হতেপারে ।
  • শুঙ্ক বা খরা মৌসুমে অথবা অন্য কোনও কারণে জমির পানি শুকিয়ে গেলে উক্ত গর্ত মাছের জন্য সাময়িক আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।
  • জমি তৈরির জন্য প্রচলিত নিয়মেই জমিতে সার, গোবর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ধান রোপণ করতে হবে।

ধানের জাত নির্বাচন:

ধানের জাত নির্বাচনে যেসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে:-

  • সমন্বিত ধান-মাছ চাষের ক্ষেত্রে যে জাতের ধান বেশী পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে এবং ফলনও বেশি সেই জাত নির্বাচন করতে হবে।
  • আমন মৌসুমের জন্য বি আর-৩ (বিপব), বি আর-১১ (মুক্তা), বি আর-১৪ (গাজী) এবং বোরো মৌসুমের জন্য বি আর-১৪ ও বি আর-১৬ ইত্যাদি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উপযোগী।
  • ধানের সাথে মাছের চাষের জন্য ধানের চারা অবশ্যই সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-২৫ সেমি. এবং গোছা থেকে গোছার দূরত্ব ১৫-২০ সেমি. রাখাতে হবে।

মাছের প্রজাতি নির্বাচন:

মাছের প্রজাতি নির্বাচন লক্ষণীয় বিষয়সমূহ:-

  • অগভীর পানিতে চাষ করা যায় এমন প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে।
  • কম অক্সিজেনে বাঁচতে পারে এমন প্রজাতির মাছ।
  • দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির মাছ নির্বাচন করতে হবে। যেমন- রাজপুঁটি, মিরর কার্প, মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া ইত্যাদি ।

মাছের পোনা মজুত:

  • ধান ক্ষেতে ধান রোপণের পরপরই পোনা মজুদ করতে হয় না, রোপণের পর ধানের চারা মাটিতে শিকড় মেলে শক্ত হতে ও ধানের কুশী গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে । এ জন্য১৫-২০ দিন পর ধান ক্ষেতে মাছের পোনা মজুদ করতে হয়।
  • জমিতে কমপক্ষে ১০-১৫ সেমি. পানি থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১৫-২০টি ৫-৭ সেমি.আকারের রাজপুঁটি/মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়া/ মিরর কার্পের পোনা ছাড়তে হবে।
  • উভয় জাতের মাছ একত্রে চাষ করার ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৮টি রাজপুঁটি ও ৭টি মিরর কার্পের পোনা ছাড়া যেতে পারে।
  • সকালে অথবা বিকালে অর্থাৎ যখন পানি ঠাণ্ডা থাকে তখন ক্ষেতে পোনা মজুদ করা উচিত। এ নিয়মে পোনা মজুত করলে ধান চাষকালীন সময়ের অর্থাৎ ১০০-১২০ দিনের মধ্যেই মাছ খাওয়ার ও বিক্রয়ের উপযোগী হয়ে থাকে।
  • মনোসেক্স গিফট তেলাপিয়ার মিশ্র চাষ না করে একক চাষ করতে হবে।

ধান ক্ষেতে পানি ব্যবস্থাপনা:

  • মাছ ধান ক্ষেতে থাকা অবস্থায় সবসময় পানি থাকতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষেতে পানির গভীরতা ১০-১৫ সেমি. থাকতে পারে, তবে মাছের বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির গভীরতা বাড়াতে হবে।
  • যদি কোনও সময় বাইরে থেকে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়, তখন পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানিসরবরাহ করতে হবে।
  • ইঁদুর, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণী যাতে আইলে গর্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি জমে ক্ষেত প্লাবিত হওয়ার আশংকা থাকলে অপেক্ষাকৃত ঢালু অংশে আইলের কিছু জায়গা ভেঙে বাঁশের বানা বা ছাঁকনিযুক্ত পাইপ দিয়ে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত খাবারই মাছের বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। তবে প্রাকৃতিক খাবারের অপর্যাপ্ততা পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনবোধে মাছের খাবার হিসেবে ক্ষুদি পানা বাচালের কুঁড়া সরবরাহ করা যেতে পারে।
  • প্রচলিত নিয়মে জৈব বা অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM) পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করা যেতে পারে।
  • ধান ক্ষেতের মাছকে ডোবা বা নালায় স্থানান্তরের পর প্রয়োজনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের পর বৃষ্টি হলে ৫-৭ দিন পর মাছগুলোকে ক্ষেতে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আর যদি বৃষ্টি না হয় সে ক্ষেত্রে ৫-৭ দিন পর সেচের মাধ্যমে পুনরায় মাছকে সমস্ত জমিতে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
  • কীটনাশক ব্যবহারের উপযুক্ত সময় হলো বিকেল বেলা কারণ এ সময় ধানের পাতা শুঙ্ক থাকে।
  • পাশের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটানো হলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কীটনাশক মিশ্রিত পানি কোনক্রমেই মাছের ক্ষেতে প্রবেশ না করে।
  • ধান রক্ষার জন্য জমিতে কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হলে মাছকে আইলের সাহায্যে গর্তে আটকে রাখতে হবে।
  • অতিরিক্ত গরম বা খরার সময় ক্ষেতে গর্তের পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য গর্তের কিছু অংশে কচুরিপানা রাখতে হবে ।
  • ক্ষেতের পানির প্রয়োজনের তুলনায় কমে গেলে দ্রুত সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

ধান ক্ষেতে মাছ আহরণ:

  • ধান পাকার পর ক্ষেতের পানি কমিয়ে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে, এসময় মাছ আস্তে আস্তে ডোবায় চলে যাবে এবং মাছ ধরতে হবে।
  • ধান ক্ষেতে সমন্বিত পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে ৩-৪ মাসে হেক্টরপ্রতি ৩২৫-৩৫০ কেজি মাছ এবং ২.০-২.৫ টন মাছের ফলন পাওয়া যায়।
  • অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ধানের সাথে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন গড়ে প্রায় শতকরা১৫ ভাগ বেশি হয়। এতে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকে।

পরামর্শ:

  • ধান ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহারে সর্তক থাকতে হবে।
  • অতি বৃষ্টিতে যেন ধান ক্ষেত প্লাবিত না হয় অথবা খরায় ধান ক্ষেত শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • চাষিকে দৈনিক সকাল-বিকালে ধানক্ষেত পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

 

বড় আকারের রুই জাতীয় মাছ উৎপাদন কৌশল

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী এলাকায় বড় আকারের রুই জাতীয় মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা দেশের বড় বড় শহরের বাজারসমূহে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা বিশেষ করে রাজশাহী জেলার পবা, পুটিয়া, দূর্গাপুর, মোহনপুর; নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাশপুর, বড়ায়গ্রাম, লালপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও রায়গঞ্জে এ ধরনের বড় আকারের কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ দ্রæত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

 

বড় আকারের রুই জাতীয় মাছ উৎপাদন কৌশল

 

 

রাজশাহী বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলেও স্বল্প পরিসরে হোলেও এ পদ্ধতিতে মাছচাষ শুরু হয়েছে। উৎপাদিত এ ধরনের বৃহৎ আকারের (৪-২০ কেজি) মাছ জীবন্ত অবস্থায় রাজধানি ঢাকার বজারসহ দেশের অন্যান্য বৃহৎ শহরগুলোতে পৌছে যাচ্ছে। বড় আকারের মাছের চাহিদা সারা বছরই একই রকম থাকে এবং এর বাজার মূল্যও খুব বেশি উঠা নামা করে না। ফলে প্রতি দিন ২০০-২৫০ ট্রাক মাছ যমুনা সেতু পার হয়ে দেশের ভিবিন্ন শহরে পৌছে যাচ্ছে। বড় আকারের মাছ উৎপাদনের এ কৌশল এ অঞ্চলে মাছচাষে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।

পুকুরে কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষের এ বিশেষ পদ্ধতিটি এলাকা ভিত্তিক নানা মাত্রায় নানাভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং চাষ পদ্ধতিতে কিছু ভুল ভ্রান্তিও চর্চার মধ্যে প্রবেশ করেছে বলে আমাদের প্রতিয়মান হয়। এ পদ্ধতিতে মাছচাষ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান তথ্যগত ঘাটতি পুরণসহ একটি সমন্বিত ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য এবং সঠিক ধারণা সকলের কাছে পৌছে দেবার জন্য আমাদের আজকের এ প্রচেস্টা। আশা করি নতুন আগ্রহী মাছচাষি এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সম্প্রসারণ কর্মীরা বড় আকারের রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন কৌশলের বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারবেন।

কার্প মিশ্রচাষ

বিভিন্ন প্রজাতির কার্প জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ একয় পুকুরে একত্রে প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাবার ব্যবহারকরে যে চাষ করা হয় তাহায় কার্প মিশ্রচাষ হিসাবে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে যখন বড় আকারের (০২ কেজি হতে ১০ কেজি বা এর চেয়েও বড়) মাছ উৎপাদন করা হয় তখন অনেকে এ পদ্ধতিকে কার্প মোট-তাজাকরণ বা কার্প ফ্যাটেনিং বলে থাকেন।

রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত এ বড় আকারের মাছ সারাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বড় আকারের এ মাছ বেশি পরিমাণে উৎপাদন করলেও বিক্রয় করতে কোন সমস্যা হয় না। কার্পজাতীয় মিশ্রচাষের সাথে সাথি ফসল হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ফলি ও চিতল মাছও উৎপাদিত হয়। বর্তমানে অনেকেই এ মাছের সাথে একত্রে শিং-মাগুর, পাবদা, গুলশা ও ট্যাংরা চাষ শুরু করে অধিক লাভ নিশ্চিত করছেন।

 

 

কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষের সুবিধা

১) স্তর ভিত্তিক পোনামাছ মজুদের ফলে পুকুরের সকল স্তরের খাদ্য সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়;
২) সিলভার কার্প মজুদের মাধ্যমে ফাইটোপ্লাংটনের প্রাচুর্যতা (অ্যালগাল বøুম) নিয়ন্ত্রণ করা যায়;
৩) গ্রাসকার্প জলজ উদ্ভিদ (তন্তুজাতীয়) নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি এ মাছের মল কার্পের খাদ্য ও সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়;
৪) তলবাসী মাছ মৃগেল, কমনকার্প, মিরর কার্প কাদায় খাদ্য খোঁজে খায় এর ফলে তলদেশের পুষ্টি পানিতে মিশ্রিত হয়, তলদেশের গ্যাস দূর করে এবং
৫) পুকুরের শামুক নিয়ন্ত্রণে বøাককার্প মজুদ করা হয় এবং
৬) একয় সাথে বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ এক সাথে চাষ করার ফলে পুকুরে সর্বোত্তম উৎপাদন পাওয়া যায়।

 

মাছচাষ ব্যাবিস্থাপনা

মাছচাষের জন্য পুকুর নির্বাচন থেকে শুরু করে মাছ বাজারে বিক্রয় পর্যন্তধারাবাহিকভাবে কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় যার
সমস্টিকে এক কথায় মাছচাষ (অয়ঁধপঁষঃঁৎব) বলে। এসকল কার্যক্রমকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় ক) মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপ
না খ) মজুদ কালিন ব্যবস্থাপনা এবং গ) মজুদ পরবর্তি ব্যবস্থাপনা

ক) মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা পুকুর নির্বাচন ঃ

যে কান পুকুরে এ ধরনের মাছচাষ করা সম্ভব নয়। যেহেতু বড় আকারের মাছ উৎপাদন করা হয় সে জন্য বড় আকারের (২-১০ একর) গভীর (৫-১০ ফুট) পুকুরের প্রয়োজন। বণ্যা মুক্ত মজবুত পাড়যুক্ত রৌদ্রউজ্জল পুকুর এপদ্ধতিতে মাছচাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। মাছচাষের
উপকরণ ও মাছ সহজে পরিবহনের জন্য পুকুরটির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হতে হবে।

১) পুকুর প্রস্তুতি ঃ

ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে পুকুর প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। আগের অধ্যায়ে আলোচিত পদ্ধতিতে নির্বাচিত পুকুরটি মাছাচাষের উপযোগী করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তবে সব সময় একয়ভাবে প্রস্তুত করা যায় না কারণ এখানে বড় আকারের পুকর ব্যবহারকরা হয় যা স্বেচ দিয়ে তৈরি করা যায় না বা সব সময় শুকানো যায় না। ফলে মাছচাষ চলাকালে বিশেষ কিছু সমস্যার সম্মূখিন হতে হয় তা প্রতিরোধের জন্য নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয়।

২) মজুদের জন্য পোনা নির্বাচন ঃ

এ পদ্ধতিতে মাছচাষের জন্য রুই জাতীয মাছের নুন্যতম ২৫০ গ্রাম থেকে ২ কেজি আকারের মাছে প্রয়োজন হয় অনেক সময় এর চেয়েও বড় পোনা পুকুরে মজুদ করা হয় অধিকতর বড় আকারের মাছ উৎপাদনের জন্য। এ পদ্ধতিতে সাধারণত রুই ও কাতল মাছের পোনা তুলনামূলক বেশি লাগে। বাজারসমূহে রুই ও কাতল মাছের চাহিদাও বেশি দামও বেশি এ জন্য মাছচাষিরা এ পদ্ধতিতে রুই-কাতল মাছ যাতে বেশি চাষ করতে পারেন সে জন্য বিশেষ যতœবান থাকেন।

এ পদ্ধতিতে সাধারণত তলদেশের মাছ (মৃগেল, কার্পিও, কালিবাউশ) তুলনামূলক কম চাষ করা হয় যা সাধারণ রুই জাতীয মাছের মিশ্রচাষের অনেকটা বিপরিত। এ মিশ্রচাষ পদ্ধতি ব্যবহৃত পোনা অবশ্যই ভাল মানের হতে হবে।

৩) পোনা সংগ্রহ ঃ

এপদ্ধতির চাষে ব্যবস্থাপনায় যেহেতু বড় আকারের পোনা লাগে এ জন্য পোনা সংগ্রহে খরচ বেশি। বিশেষ করে বড়পুকুরে চাষ করা হয় বলে পোনার পরিমাণও বেশি লাগে। বড় আকারের মাছ উৎপাদন করা হয় বলে পোনার গুণগত মান অবশ্যই ভাল হতে হবে। অন্যথায় ভাল ফলাফল পাওয়া যায় না। এজন্য পোনা সংগ্রহে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

যদি সম্ভব হয় প্রাকৃতিক উৎসের পোনা সংগ্রহ করে নিজের পুকুরে চাষ করে উপযুক্ত আকারের পোনা তৈরি করে নিতে হবে। যদি প্রাকৃতিক উৎসের পোনা না পাওয়া যায় তা হলে অবশ্যই ভাল মানের হ্যাচারি বা উৎস হতে পোনা সংগ্রহ করতে হবে। রাজশাহী অঞ্চলে অবশ্য এক ধরনের চাষি গড়ে উঠেছে যারা কেবল এ ধরনের পোনা উৎপাদন করে বড় খামারীদের নিকট বিক্রয় করেন।

অবশ্য অভিজ্ঞ চাষিরা নিজের চাহিদা মত পোনা নিজের পুকুরে উৎপাদন ও মজুদ রাখেন। অনেক সময় আংশিক আহরণের পর পোনা পুনরায় মজুদ করা হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য নিজের পুকুরে পোনা মজুদ রাখাটায় উত্তম।

৪) পোনা মজুদ হার ঃ

এ পদ্ধতির মাছচাষে পোনা মজুদের পরিমাণ বা মজুদ ঘনত্ব খুবই গুরুত্ব বহন করে। অনেক চাষি দির্ঘ দিন এ পদ্ধতিতে মাছচাষ করে নিজস্ব একটি মজুদ ঘনত্ব ঠিক করে নিয়েছেন। পোনা কি পরিমাণে ছাড়তে হবে তা নির্ভর করে কত বড় আকারের মাছ উৎপাদন করতে চায় তার উপর। রাজশাহী অঞ্চলে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি অনুযায়ী নি¤েœ১০ বিঘা পুকুরে কি পরিমাণ মাছের পোনা মজুদ করতে হবে তার কয়েকটি নমুনা নিন্মে উল্লেখ করা হল ঃ

 

 

বড় পুকুরে মাছচাষ করার কারণে এ সকল পুকুরে প্রচুর গুড়া মাছ হয় যা মাছের খাদ্যে ভাগ বসায় এবং অক্সিজেন ঘাটতির সৃষ্টি করে। এ সব মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বাড়তি উৎপাদন পাবার জন্য উপরে উল্লেখিত মাছের সাথে কিছুচিতল মাছের পোনা বা ফলি মাছ ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এ সব মাছের বাজার দর অনেক বেশি, মূল চাষের মাছের পাশাপাশি এ মাছ থেকে একটি ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়।

৫) পোনা পরিবহন ঃ

যেহেতু পুকুরে বড় আকারের পোনা মজুদ করতে হয় সে জন্য এক্ষেত্রে পোনা পরিবহন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পোনা পরিবহনের সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

  • কাছাকাছি উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করতে হবে
  • পোনা পরিবহনের সময় এ্যারেশন নিশ্চিত করতে হবে
  • পরিবহনের আগের দিন খাবার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে
  • পরিবহনের আগে ভালভাবে কন্ডিশনিং করে নিতে হবে
  • দূর থেকে পরিবহনের সময় পরিবহন ট্যাংকের পানির সাথে স্যালাইন মিশিয়ে নেয়া যেতে পারে
  • অথবা পরিবহন ট্যাংকের পানিতে ভিটামিন সি বা প্যানভিট একুয়া মিশিয়ে নেয়া যেতে পারে

 

৬) পুকুরে পোঁকা মারার ঔষধ প্রয়োগ ঃ

পুকরে পোনা মজুদের আগের দিন পুকুরে বিদ্যমান পোঁকা মাকড় বা বড় আকারের জুপ্লাংকটন মারার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। রিবকর্ড বা সাইপারমেথ্রিন গ্রæপের যে কোন একটি ঔষধ বিঘাতে ৫০-৭০ এমএল প্রয়োগ করতে হবে। পোঁকা-মাকড় মজুদকৃত মাছের নানাভাবে ক্ষতি করে থাকে, মাছের শরীরে আক্রমণ করে মাছকে অস্বস্তিতে ফেলে পিড়ন অবস্থায় সম্মূখিন করে। অনেক সময় মাছে রোগের সৃষ্টি করে মৃত্যুহার বৃদ্ধি করে।

বিঃদ্রঃ বড় বাকারের মাছচাষে ৫০০ গ্রামের বড় আকারের মাছ ছাড়া হয় যেমন ধরে নেয়া যাক এক একরে মোট মাছ ছাড়া হয় ১০০০টি যার ওজন প্রায় ৫০০ কেজি, যার ক্রয় মূল্য পড়ে ১৫০/Ñ টাকা দরে মোট ৭৫,০০০/- টাকা। এখানে একটি বিষয় অনেকে বুঝতে চাইনা যে এই মাছ ৬ মাস বা এক বছর পরে যখন বিক্রয় করা হয় তখন এই ৫০০ কেজি মাছ বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ কেজি বা আরো বেশি হয়ে যায়।

এ সময় গড়ে মাছের ওজন ২-৪ কেজি হয় যার বাজারে বিক্রয় মূল্য ৩০০-৪০০/- টাকা প্রতি কেজি। এখানে ক্রয় করা ৫০০ কেজি মাছ এই ২০০০ কেজি মাছের মধ্যেয় আছে যার বিক্রয় মূল্য বেড়ে ১,৫০,০০০/- হতে ২,০০,০০০/- টাকা হয়ে গেছে। খুব মজার বিষয় হলো এ ৫০০ কেজি এর পিছনে কোন খাবার খরচ না করেই প্রায় লক্ষাধিক টাকা বাড়তি আয় হচ্ছে। এখানেই বড় আকারের মাছচাষের গুড় রহস্য।

 

 

খ) মজুদ কালিন ব্যবস্থাপনা

১) পোনা শোধন ঃ

পোনা জালদিয়ে ধরা, পরিবহন গাড়িগে উঠাতে ও পরিবহনের সময় পোনার পাখনা ভেঙ্গে যেতে পারে কিছু আইশঁ উঠে যেতে পারে। যেখানে পরবর্তিতে ইনফেকশন হয়ে পোনার মৃত্যুহার বেড়ে যেতে পারে, পোনার বৃদ্ধিহার কমে যেতে পারে। এ জন্য পোনা মজুদের আগে পোনা পটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট দিয়ে শোধন করতে হবে। পোনা পুকুর পাড়ে আসার আগে একটি পাত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পটাশ গুলিয়ে রাখতে হবে। পরিবহন ট্যাংকে সরাসরি পটাশের দানা না দিয়ে গুলানো পটাশ দিতে হবে। এ কাজটি লবণ (NaCl) দিয়েও করা যেতে পারে।

২) পোনা খাপখাওয়ানো (Acclimatization) ঃ

পুকুরে পোনা মজুদের আগে পোনা শোধনের পাশাপাশি পুকুরের পানির সাথে খাপখাওয়াতে হবে। হঠাৎ নতুন পরিবেশে (যেখানে তাপমাত্রা, পিএইচ, অক্সিজেন এর মাত্রা একই রকম নয়) পোনা অবমুক্ত করলে পোনা শক বা পিড়ন (Stress) এর সম্মূখিন হতে পারে। এর ফলে পোনার নানাবিধ ক্ষতি হতে পারে যেমন পোনার বর্দন হার কমে যেতে পারে।

৩) পোনা পর্যবেক্ষণ ঃ

পোনা ছাড়ার পরের দিন ভোরে পুকুরের চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে কোন পোনা মারা গেছে কিনা বা দূর্বল হয়ে ঘুরছে কিনা। দু-একটি পোনা মারা গেলে তা উৎপাদনে তেমন প্রভাব ফেলবে না তবে বেশি সংক্ষ্যক (৫০-১০০) পোনা মারা গেলে অবশ্যই প্রজাতি ভিত্তিক সে পরিমাণ পোনা পুনরায় মজুদ করে দিতে হবে।

গ) পোনা মজুদের পরে করণীয় কার্যক্রম

১) মাছের খাদ্য প্রদান ঃ

পুকুরে পোনা মজুদের পরের দিন হতে নিয়মিত খাবার দিতে হবে। মাছের মোট ওজনের ৩-৪% হারে প্রতি দিন খাবার দিতে হবে। কার্পজাতীয় মাছের খাদ্যে ২২-২৫% আমিষ থাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি চর্চা হয়ে আসছে। পুকুরে মাছের বৃদ্ধি ভাল পাবার জন্য প্রতিদিন দুইবার (সকাল-বিকাল) মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।

সকাল ৯-১০ ঘটিকার মধ্যে একবার এবং বিকাল ৪-৫ ঘটিকার মধ্যে আর একবার। তবে দিনে একবার ডুবন্ত খাবার দিয়েও মাছচাষ করা যেতে পারে। ডুবন্ত খাবার দুই রকম হতে পারে। ক) বাজারের পিলেট খাবার এবং খ) পুকুরের পাড়ে তৈরি ভিজা খাবার। ভিজা খাবার নানা উপকরণ মিশ্রণে তৈরি করা হয়ে থাকে যার কয়েকটি ধরন নি¤েœ উল্লেখ করা হল।

১০০ কেজি খাবার তৈরিতে ভিভিন্ন উপকরণের পরিমাণ (কেজিতে)

 

 

২) খাবার প্রয়োগ পদ্ধতি ঃ

সমস্ত খাবার নির্ধারিত কয়েকটি স্থানে দিতে হবে। খাবার প্রদানের ১ ঘন্টা পরে খাবার অবশিস্ট আছে কিনা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী খাবার বাড়াতে বা কমাতে হবে। খাবারের প্রতি মাছের আচারণও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অতিরিক্ত খাবার পঁচে পুকুরের পরিবেশই নস্ট করে না অর্থেরও অপচয় হয়।

৩) খাদ্য দানিতে (Feed Tray) ঃ

মাছের খাবার গ্রহণের হার পর্যবেক্ষণ করার জন্য বড় মাছ উৎপাদন কারীরা সাধারণত পুকুরে খাদ্য দানিতে খাবার প্রয়োগ করে থাকেন। পুকুরে বিঘা প্রতি নুন্যতম একটি খাদ্য দানি স্থাপন করতে হবে। খাদ্য দানিতে খাবার দিলে মাছ সমস্তখাবার খেয়েছে কিনা পর্যবেক্ষণ করা যায়। খাদ্যের অপচয় রোধ করা যেতে পারে। খাদ্য দানিতে খাবার দিলে রুই মাছের জন্য সবচেয়ে ভাল হয়।

খাদ্য পুকুরের তলায় চলে গেলে সাধারণত সে খাবার মৃগেল ও কার্পিও মাছে সহজে খেতে পারে কিন্তু রুই মাছের নাগালের বাহিরে চলে যায়। অনেক চাষির মতে এভাবে খাবার দিলে কাতলের জন্যও সুবিধা হয়। খাদ্য দানিতে খাবার দেবার জন্য এ অঞ্চলের চাষিরা সিমেন্টের চাড়ির নৌকা ব্যবহারকরে থাকেন, যা দেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না।

৪) বস্তায় খাবার ঝুলিয়ে দেয়া ঃ

বানানো ভিজা খাবার বা ডুবন্ত পিলেট খাবার অনেকে বস্তার মধ্যে ভরে বাশের খুটির সাথে বা আড়ার সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে থাকেন। খাবারের বস্তার চারিদিকে ছোট ছিদ্র করে দেয়া হয়। এভাবে খাবার দিলেও খাবার গ্রহণের পরিমাণ বা খাবার শেষ করার সময় সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায়। বস্তার খাবার ৩-৪ ঘন্টার মাঝে ফুেিয় যায় কিনা দেখতে হবে।

 

 

৫) ভাসমান খাদ্য প্রদান ঃ

মাছের দ্রæত বর্ধন বা বিশেষ করে রুই মাছের ভাল উৎপাদন পাবার জন্য পুকুরে ডুবন্ত খাবার দেবার পাশিাপাশি বিকাল ৪-৫ ঘটিকার মধ্যে মোট খাবারের অর্ধেক ভাসমান খাবার দিতে হয়। বাজারে বিভিন্ন কম্পানির ভালমানের খাবার পাওয়া যায়। ভাসমান খাবার দেবার জন্য পুকুরের ৩-৪ স্থানে ভাসমান নেট বৃত্তাকার বা আয়তকারভাবে স্থাপন করে তার মধ্যে খাবার দেয়া হয় যাতে খাবার সারা পুকুরে ছড়িয়ে না যায়। পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের সময় অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা করে থাকে যা এ ধরনের ঘের তৈরি করে প্রতিরোধ করা যায়। আকবার মাছের ভাসমান খাবার সারা পুকুরে ছড়িয়ে গেলে মাছের খাদ্য গ্রহণে অনেক শক্তি ব্যায় হয় এবং খাদ্য অপচয় হতে পারে।

 

 

৬) খাদ্য প্রয়োগে সতর্কতা ঃ

খাদ্য প্রয়োগের সময় কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয় যা নি¤েœ উল্লেখ করা হল

  • প্রয়োজনের অধিক খাবার দেয়া যাবে না;
  • নিয়মিত এবং পরিমাণমত খাবার দিতে হবে;
  • নির্ধারিত স্থানে প্রতিদিন খাবার দিতে হবে;
  • আবহাওয়া ঠান্ডা বা ঝির ঝির বৃষ্টি বা মেঘলা হলে খাবার কম দিতে হবে;
  • পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার বেশি থাকলে খাবার কমিয়ে দিতে হবে;
  • খাদ্য উপকরণ ২-৩ দিন ভিজিয়ে রেখে পুকুরে প্রয়োগ করা ঠিক নয়;
  • গোবরের সাথে কোন সময় খাদ্য উপকরণ মিশিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করা ঠিক নয়;
  • অনেকে খাদ্য উপকরণের সাথে সার মিশিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করে থাকেন যা কোন ভাবেই উচিৎ নয়।

অধিক ফলন পেতে ৬-৭ দিন পরপর প্রতি কেজি খাদ্যে ১-২ গ্রাম ভিটামিন ও ১-২ গ্রাম লবণ এবং ফিশফিড সাপ্লিমেন্ট বা গাট-প্রোবায়োটিক ১-২ গ্রাম মিশ্রিত করে প্রয়োগ করা যেতে পারে ।

 

৭) মাছের উৎপাদন অধিকতর ভাল পাওয়ার জন্য করণীয় ঃ

বাজারে রুই মাছের চাহিদা ও দামও বেশি সুতরাং অনেক প্রতিষ্ঠিত
অগ্রসর মাছচাষিগণ মাছের বর্ধন ভাল পাবার জন্য বিশেষ করে রুই মাছের উৎপাদন বেশি করার জন্য পুকুরে তুলনা মূলকভাবে রুই মাছ বেশি মজুদ করেন এবং রুই মাছের বর্ধন দ্রæত করার জন্য নানবিধভাবে চেস্টা করে থাকেন। এ জন্য মাছচাষিরা খাবারের সাথে বাড়তি ফিড এডিটিভস (এ্যামিনোএসিড) এবং বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন প্রিমিক্স মিশিয়ে খাওয়ান যা মাছের খাদ্যের পুস্টির ভারসাম্য (Balance Feed) রক্ষা করে, খাদ্যের হজম বা পরিপাক (Digestion) তরান্বিত করে এবং খাদ্যের আত্বিকরণ (Assimilation) বাড়িয়ে খাদ্যের মাংসে রুপান্তর হার (Feed Conversion Ratio-FCR) বাড়িয়ে দেয়।

পাশাপাশি এ সকল উপাকরণ মাছের খাদ্য গ্রহণের রুচি বাড়িয়ে দেয় এবং খাদ্যের পানিতে স্থায়িত্ব কালও বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিন না হলেও ৬-৭ দিন পরপর খাদ্যের সাথে (প্রতি কেজি খাবারে ১ গ্রাম) মিশিয়ে খাওয়ালে মাছের বর্ধন হার বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, মাছ ভাল থাকে এবং মাছের উজ্জলতা ও বর্ণ আকর্ষণীয় হয়।

 

৮) সার প্রয়োগ ঃ

পুকুরে প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্যতা বৃদ্ধির জন্য পুকুরে নিয়মিত জৈব-অজৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। যে সব পুকুরে নিয়মিত খাদ্য প্রয়োগ করা হয় সে সব পুকুরে ইউরিয়া সার কম দিতে হয় এবং যে সব পুকুরে নিয়মিত ভিজা খাবার প্রয়োগ করা হয় সে সব পুকুরে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগ না করাই ভাল কেবল টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এ সব পুকুরে মাছের পায়খানা থেকে পর্যাপ্ত নাইট্রোজেন ঘটিত যৌগ পদার্থ নিয়মিত পুকুরের পানিতে যুক্ত হয়। ফলে অনেক সময় নাইট্রোজেনের এ প্রাচুর্যতা পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটনের বøুম ঘটিয়ে পুকুরে অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

পানি হালকা সবুজ বা হালকা বাদামী রং থাকায় ভাল। পানি গাঢ় সবুজ হলে সার দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পুকুরের পানির রং এবং জুপ্লাংকটনের উপস্থিতি দেখে পুকুরে সার দেবার প্রয়োজন আছে কি না বুঝতে হবে।

 

 

সরিষার খৈল ২৪ ঘন্টা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে পুকুরে প্রয়োগের সময় ভালভাবে গুলিয়ে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। বৃষ্টির দিনে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। টিএসপি ব্যাবহারের আগে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হবে, দানাদার অবস্থায় টিএসাপি সার পুকুরে ব্যবহারকরা ঠিক নয়।

সার প্রয়োগ ছাড়াও পুকুরে পর্যাপ্ত জুপ্লাংটন তৈরির জন্য আগের অধ্যায়ে বর্ণিত ইস্ট মোলাসেস পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে।

 

ঘ) মাছের চাষ নিরাপদ রাখার জন্য অন্যান্য কার্যক্রম

মাছেরচাষ নিরাপদরেখে অধিক উৎপাদন পাবার জন্য বেশ কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। নি¤েœ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

১) নমুনায়ন ঃ

মাছ বিক্রয় করার সময় ছাড়া মাছ ধরে পর্যবেক্ষন করা ঠিক নয়। মাছের খাবার প্রয়োগের সময় খাবারের প্রতি মাছের সাড়া এবং মাছের গতি প্রকৃতি পর্যক্ষেণ করে মাছের বর্ধন ও খাদ্য প্রদানের পরিমাণ নির্ণয় করায় উত্তম। মাছ ধরে নমুনাকরণ করে পুকুরের মাছকে বিরক্ত করা বা পিড়ন অবস্থায় ফেললে মাছের বর্ধনে খারাপ প্রভাব পড়ে।

২) পুকুরে চুন প্রয়োগ ঃ

পুকুরের পানির পরিবেশ ভাল রাখার জন্য মাছচাষ চলাকালে প্রতিমাসে একবার বিঘা প্রতি ৫-৬ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ বজায় রাখতে হবে। ক্ষারীয় পরিবেশে সারের কার্যকারিতা ভাল হয়। মাছ থাকা অবস্থায় পুকুরের পানিতে চুন ভিজান মাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পুকুরে মাছ থাকা অবস্থায় সকাল ৭-৮ ঘটিকার মধ্যে চুন প্রয়োগ করতে হবে।

চুন পুকুরে প্রয়োগের ১-২ ঘন্টা আগে সিমেন্টর চাড়ি বা বড় ড্রামে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে ভিজাতে হবে এবং পাতলা করে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুন অধিক সময় ধরে ভিজিয়ে রাখলে চুনের কার্যকারিতা কমে যায়। চুন প্রয়োগের আগে পুকুরের পানির পিএইচ অবশ্যই মেপে নিতে হবে। পি এইচ ৭ এর উপরে থাকলে পুকুরে চুন প্রয়োগের প্রয়োজন নাই। মেঘলা দিনে পুকুরে চুন দেয়া যাবে না। চুন সব সময় সারা পুকুরে সমভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।

৩) জীবণুনাশক ও প্রোবায়োটিক্স প্রয়োগ ঃ

চাষের মাছ নিরাপদ রাখার জন্য ২-৩ মাস পরে বাজারে প্রাপ্ত ভাল মানের যে কোন একটি জীবাণু নাশক প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে শীতের সময় এ কাজটি অবশ্যই করতে হবে। তবে পুকুরে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করলে পুকুরের ক্ষতিকর জীবাণুর সাথে সাথে উপকারী ব্যাক্টেরিয়াসমূহও মারা যায় এর ফলে পুকুরের বাস্ততন্ত্রের ((Ecology) ক্ষতি হয় বিশেষ করে ক্ষতিকর এ্যামোনিয়াকে উপকারি নাইট্রাইটে রুপান্তরে জড়িত ব্যাক্টেরিয়ার অনুপস্থিতি পুকুরের মাছের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

এ জন্য জীবাণুনাশক প্রয়োগের ৩-৪ দিনের মধ্যে এক ডোজ ভালমানের প্রোবায়টিক্স প্রয়োগ করতে হবে। প্রোবায়টিক্স পুকুরে দ্রæত উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার উৎপাদন করে এবং পরিবেশের জৈব পদার্থ ব্যবহার করে পুকুরের পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। প্রতিবারে পরিমাণ মত প্রোবায়োটিক বিঘাপ্রতি ৩-৪ কেজি চিটাগুড়ের সাথে একটি পাত্রে ১০-১৫ লিটার পানিতে মিশ্রিত করে ছায়াযুক্ত স্থানে ১-৩ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে তারপর পানিতে প্রয়োগ করতে হবে।

 

৪) জুপ্লাংকটনের প্রাচুর্যতা কমানো ঃ

বৃহৎ পুকুরে বড় আকারের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এবিষয়টি একটি অপরিহার্য সমস্যা। চাষি বড় আকারের রুই এবং কাতল উৎপাদনের জন্য খুবই তৎপর থাকে সে জন্য পুকুরে একাধিকবার খাবার দেবার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সরিষার খৈল ভিজিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করে। এ ছাড়া বিশেষ করে যে সব পুকুরে ভিজা খাবার প্রদান করা হয় সে সব পুকুরে পর্যাপ্ত প্লাংকটন তৈরি হয় যা মাছে খেয়ে শেষ করতে পারেনা।

এ সব অতিরিক্ত জুপ্লাংকটন মাছের ক্ষতির পাশাপাশি পুকুরের অক্সিজেনের ঘাটতিসৃষ্টি করে। এ জন্য জুপ্লাংকটনের প্রাচুর্যতা (মাখোন পোঁকা বা সুজি পোঁকা) দেখে মাঝে মধ্যে সাইফারমিথ্রিন ১০ ইসি (বিঘা প্রতি ২৫-৩০ এমএল) বা বিঘা প্রতি ডেলটামিথ্রিন ৬০-১০০ এমএল প্রয়োগ করা হয়। তবে অভিজ্ঞ চাষিরা সন্ধার পরে পুকুরের কর্ণারে জমা হওয়া প্লাংকটনের উপর ঔষধ ছিটিয়ে দেন মারার জন্য। এতে খরচ কিছুটা কম হয় এবং অধিক ঔষধ ব্যবহারপরিহার করা যায়। নিরুপায় না হলে বা সমস্যা প্রকট না হলে এ ধরনের ঔষধ পুকুরে না প্রয়োগ করাই ভাল।

 

৫) পুকুরে এ্যারেটর স্থাপন ঃ

বিগত ২০২০ সনের সেপ্টেম্বর মাসের ১ ও ২ তারিখে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায় বড় মাছচাষের পুকুরে হঠাৎ করে অক্সিজেন ঘাটতি হয় এবং লক্ষ লক্ষ টাকার মাছের ক্ষতি হয়ে যায়। এ ছাড়াও মনে রাখা দরকার বড় মাছের অক্সিজেনের চাহিদা কিছুটা বেশি থাকে। এজন্য মাছ যখন বড় হয়ে যায় তখন মাছকে নিরাপদ রাখার জন্য পুকুরে এ্যারেশনের ব্যবস্থা রাখা নিরাপদ।

পুকুরের অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য এ্যারেশন নানাভাবে করা যেতে পারে। প্রতিদিন পুকুরে ডিজেল মেশিন বা গভীর-অগভীর নলক‚পের পানি দিয়ে পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পর্যাপ্ততা বাড়ানো যেতে পারে অথবা বর্তমান সময়ে বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের যে এ্যারেটর মেশিন পাওয়া যাচ্ছে তা পুকুরে এক বা একাধিক স্থাপন করে মাছচাষকে অধিকতর নিরাপদ ও লাভজনক করা যেতে পারে।

 

 

৬) মাছের রোগ ও তার প্রতিকার ঃ

চাষের পুকুরে দ্রবণীয় অক্সিজেনের সংকট ছাড়াও এ ধরনের মাছচাষ পদ্ধতিতে প্রধানত কয়েকটি রোগের সমস্যা প্রায় দেখা দেয়:

ক) মাছের উকুন ঃ

এ ধরনের মাছচাষে সাধারণত এ সমস্যাটি বেশি হয়ে থাকে কারণ বড় পুকুরে যারা মাছচাষ করেন তাঁরা পুকুর শুকাতে পারেন না। বছরের পর বছর একইভাবে মাছচাষ করার কারণে পুকুরের তলদেশে জৈব পদার্থের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। চাষ পদ্ধতিতে ভিজা খাবার এবং সরিষার খৈল ভিজিয়ে পুকুরে প্রয়োগ করা হয় এ জন্য পুকুরে পঁচনশীল জৈব পদার্থ বেশি থাকে।

এ চাষ পদ্ধতিতে ৪ মাস পরে প্রতি মাসেই মাছ ধরে বিক্রয় করা হয় ফলে মাছের গায়ের শ্লাইম উঠে যায় ফলে উকুনের আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মাছের উকুন সাধারণত রুই মাছকে হোস্ট হিসাবে পছন্দ করে। এ জন্য পুকুরে উকুন হলে রুই মাছের বেশি ক্ষতি হয়। আক্রন্ত হলে টের পাবার সাথে সাথে পর পর তিন সপ্তাহ প্রতি বিঘাতে (৩-৪ ফুট গভীরতায় ) ২০০-২৫০ এমএল সুমিথিয়ন বা এ জাতীয় ঔষধ সন্ধার সময় প্রয়োগ করতে হবে। তবে পুকুরে যাতে এ সমস্যা না হয় সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার।

খ) এংকর ওয়ার্ম ঃ

মাছের উকুন হওয়ার পাশাপাশি রুই মাছের আর একটি সমস্যা বেশি হয় তা হল এংকর ওয়ার্ম এটি মাছের শরীরের রক্ত চুষে নেয়। এ পরজীবীর একটি অংশ মাছের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে সুতার মত ঝুলতে থাকে। পুকুরে বড় আকারের জুপ্লাংকটন বেশি উৎপাদিত হলে এরা মাছের শরীরে আক্রমণ করে ক্ষত সৃষ্টি করে যেখানে এংকর ওয়ার্ম আক্রমণ করে।

এ রোগে আক্রান্ত হলে রুই মাছের খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় কাতলের ফুলকার মধ্যেও আক্রমণ করতে দেখা যায়। রুই মাছের শরীরে লাল ক্ষতের সুষ্টি হয়ে ছোপ ছোপ দাগের সুষ্টি হয়। বেশি দিন ধরে আক্রান্ত মাছে এংকর ওয়ার্মকে মাছের দেহে সুতার মত ঝুলতে দেখা যায়। মাছ দ্রæত দূর্বল হয়ে পড়ে। অন্যান্নমাছেও এর আক্রমণ দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে। এ সমস্যার প্রতিকারে ডেলটামিথ্রিন বা এ জাতীয় ঔষধ বিঘাতে ৬০-১০০ এমএল প্রয়োগ করতে হয় পর পর ২ সপ্তাহ। পাশাপাশি বিঘাতে ২০০ গ্রাম পটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এ সমস্যা সমাধানে তুতে (CuSO4) বিঘা প্রতি ৩০০ গ্রাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে পুকুরে এ ধরনের ঔষধ ব্যাহার না করায় ভাল। চেস্টা করা দরকার যাতে এ ধরনের সমস্যা না হয়।

গ) ক্ষত রোগ ঃ

সাধারণত শেিতর সময় মৃগেল, থাই সরপুটি, বাটা, দেশি পুটি এবং শৈল-টাকি মাছে এ রোগ দেখা দেয়। এ রোগের প্রতিরোধ করতে না পারলে অনেক মাছ মারা যেতে পারে। এ রোগ হয়ে গেলে শতকে ১ কেজি চুন ও ১ কেজি লবণ প্রয়োগ করতে হয়। পাশাপাশি পাটাশিয়াম পারমেঙ্গানেট শতকে ৫-৮ গ্রাম প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাছ থাকা অবস্থায় পুকুরে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা ঠিক নয়। সমস্ত চুন দুভাগে ভাগ করে মাঝে একদিন বিরতী দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রতিরোধেকল্পে শীতের শুরুতে শতকে ১ কেজি (৫ ফুট গভীরতায়) হারে চুন প্রয়োগ করলে এ রোগ আর দেখা দেয় না।

আংশিক আহরণ ও পুনঃমজুদ

বড় আকারের মাছ উৎপাদনে মাছের আহরণ বিষয়টি একেক চাষি একেকভাবে করে থাকেন। কারো উদ্দেশ্য থাকে কিছু খরচ বের করা আবার কারো লক্ষ্য থাকে মাছকে অধিকতর বড় হওয়ার জন্য পুকুরের জীবভর কমিয়ে দেয়া। সাধারণত চাষের সময় ৪ মাস পর হতে আংশিক আহরণ শুরু হয় এবং আহরণ উপযোগী মাছের আকার বুঝে প্রতি মাসেই মাছ আহরণ করে হয়। যারা অধিকতর বড় আকারের মাছ উৎপাদনের জন্য আংশিক আহরণ করেন তাঁরা ব্যতিত অন্যরা ধৃত মাছের পরিমাণ বুঝে আবার সমপরিমাণ বড় আকারের প্রজাতি ভিত্তিক পোনা মজুদ করে উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখেন।

১) আহরণ ও জীবন্তমাছ বাজারজাতকরণ ঃ

মাছের ওজন ও দর কাঙ্খিত হলে মাছ আহরণ করা হয় এবং তা জীবন্তঅবস্থায় বাজারজাত করা হয়। জীবন্তমাছ বিপণন অধিক লাভজনক এবং অন্তত ১০% বেশি দামে বিক্রয় হয়। ভোক্তা পর্যায়ে তাজা ও জীবন্তপঁচনমুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত এ মাছের চাহিদা অনেক বেশি। উপরের আলোচিত পদ্ধতিতে মাছচাষ করা হলে বছরে প্রতি শতাংশে প্রায় ২০-২৫ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

২) আয় ব্যয়ের হিসাব ঃ

এক একর জলায়তন একটি পুকুরে

 

 

যে সকল চাষিগণ কার্পমিশ্রচাষের সাথে কিছু ফলি বা চিতল মাছ মজুদ করবেন তাঁরা দামি এ মাছের একটি বাড়তি মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। বর্তমান সময়ে বাজারে যে চিতল বা ফলি মাছ পাওয়া যায় তার মূখ্য অংশ এই বড় মাছের পুকুরে একই সাথে উৎপাদিত হয়। বড় মাছের প্রতি গাড়িতে কার্প জাতীয় বড় মাছের সাথে ৩০-৪০ কেজি এ ধরনের মাছ জিবন্ত অবস্থায় বাজারে নেয়া হয়। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে বর্তমান অনেকে চাষি এ মিশ্রচাষ পদ্ধতির সাথে গুলশা, পাবদা ও ট্যাংরা মাছ মজুদ করে বাড়তি উৎপাদন ঘরে তুলছেন। সেক্ষেত্রে চিতল বা ফলি মাছ মজুদ করা নিরাপদ হবে না।

পাঙ্গাশ মাছ চাষ

পাঙ্গাশ মাছ চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করবো আজ। আবহমানকাল থেকে পাঙ্গাস মাছ এদেশের মানুষের জন্য রসনার উৎস হিসেবে পরিচিত। এই মাছটি প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। এক সময়ে পাঙ্গাস মাছ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে উচ্চবিত্তের মাছ হিসেবে বিবেচিত ছিল। বর্তমানে পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে নদীর নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সাথে সাথে এর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রসমূহ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদনও ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। তবে পুকুরে পাঙ্গাস চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকায় আশির দশক থেকেই এর ওপর কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে।

 

 

পাঙ্গাস মাছ চাষ

পাঙ্গাশ মাছের বিভিন্ন জাত:

পাঙ্গাস মাঝের জাতগুলোর মধ্যে দেশী পাঙ্গাস ও থাই পাঙ্গাস সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। চলুন এদের পরিচয় সম্পর্কে এখন কিছু তথ্য জেনে নেই,

দেশী পাঙ্গাশ:

দেশী পাঙ্গাসের রূপালী রঙের পিঠের দিকে কালচে এবং পার্শ্ব রেখার ওপরে সামান্য ধূসর। এ মাছের দেহে কোন আঁশ নেই। এখনও আমাদের দেশীয় প্রজাতির পাঙ্গাস সুস্বাদু এবং বেশি মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, বহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে এ মাছটি বেশি পাওয়া যায়। এরা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন নদীসহ প্রধান নদীগুলোতে এর পোনা পাওয়া যায়।

থাই পাঙ্গাশ:

এদের আদিবাস থাইল্যান্ডে, কম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম এবং পাশ্ববর্তী অঞ্চলের দেশে। আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সনে বিদেশী এ প্রজাতির মাছের সফল প্রজনন করানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাস একটি জনপ্রিয় নাম। দেশী পাঙ্গাসের চেয়ে এ জাত দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ মাছটি সর্বোচ্চ ১০-১২ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 

 

পাঙ্গাশ মাছের চাষ পদ্ধতি:

মাছ চাষের পদ্ধতিটি নির্ভর করে পুকুর বা জলাশয়ের বৈশিষ্ট্য, পরিবেশেগত অবস্থা, পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, পুঁজি, মানসম্মত পোনা প্রাপ্তি, বাজার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ের ওপরে। এসব বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় চাষ পদ্ধতিটি কেমন হবে। আজকে আমরা জানব পাঙ্গাস মাছের একক চাষ বা নিবিড় চাষ সম্পর্কে।

 

পাঙ্গাশ চাষের পুকুর নির্বাচন:

  • পাঙ্গাস চাষের পুকুর আয়তাকার হলে ভাল হয়। পুকুরের তলা ভালভাবে সমতল করে নিতে হবে। পুকুরের পানির গভীরতা ১.৫ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত রাখা দরকার।
  • পাঙ্গাস চাষের জন্য দোআঁশ মাটির পুকুর সবেচেয়ে ভাল। জরুরি প্রয়োজনে যাতে দ্রুত পানি দেয়া যায় সেজন্য পুকুরের কাছেই গভীর বা অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা রাখা দরকার।
  • বর্ষায় বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে যাতে করে পুকুর ভেঙ্গে না যায় সেজন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় মেরামত সেরে ফেলতে হয়।
  • সর্বোপরি এমন জায়গায় পুকুরটি বেছে নিতে হবে যেখানে যোগাযোগের সুবিধা ভাল এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে।

 

পাঙ্গাশ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি:

পুকর নির্বাচন করার পরের কাজটি হলো পুকুরকে ভালভাবে প্রস্তুত করে নেয়া। এবার জেনে নেয়া যাক পুকুর প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

  • পুকুরে নানা প্রকৃতির ও বৈশিষ্ট্যে জলজ আগাছা থাকলে প্রথমেই সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
  • পাঙ্গাস চাষের পুকুরে অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছ যেমন-শোল, বোয়াল, গজার, টাকি, বাইম, মলা, ঢেলা ইত্যাদি মাছকে পাঙ্গাস চাষের আগেই অপসারণ করতে হবে। বিভিন্নভাবেই এদেরকে অপসারণ করা যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে-
  • ঘন ফাঁসের জাল বারবার টেনে সব ধরণের অনাকাক্সিক্ষত মাছ সরিয়ে ফেলতে হবে;
  • পুকুরের পানি পরিষ্কার করে এবং সম্ভব হলে তলার মাটি লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে দিতে হবে;
  • অনেক সময় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করলেও অপ্রয়োজনীয় ও রাক্ষুসে মাছদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে স্থানীয় মৎস্য অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে এদের দমন করা যেতে পারে।
  • পুকুরকে মাছ চাষের উপযুক্ত ও টেকসই করতে চুন প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে সব পুকুরের পানিতে অম্লত্বের সমস্য নেই সেখানে প্রতি হেক্টরের জন্য ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। চুন প্রয়োগের আগে গুড়ো করে মিহি করে নিলে এর কার্যকারিতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
  • পুকুরের প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জৈব এবং রাসায়নিক সার দুটোই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত চুন প্রয়োগের ৪/৫ দিন পর সার প্রয়োগ করতে হয়। নতুন পুকুর এবং বেলে মাটির পুকুরে জৈব সার বেশি প্রয়োগ করতে হয়। তবে পুরাতন কাদাযুক্ত পুকুরে রাসায়নিক সার প্রয়োগের হার বেশি হবে। পুকুর প্রস্তুতকালীন সময়ে জৈব সার হিসেবে প্রতি শতকে ৮ থেকে ১০ কেজি গোবর অথবা ৪ থেকে ৫ কেজি মুরগীর বিষ্ঠা ব্যবহার করতে হবে।
  • সারের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম টিএসপি জৈব সারের সাথে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহারের আগে প্রতি শতকে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে মিশ্রনটি সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৪ থেকে ৫ দিন পর পুকুরের পানির রঙ সবুজ বা বাদামী হলে সাধারণত পোনা মজুদের উপযোগী হয়।

 

 

পাঙ্গাশের পোনা সংগ্রহ ও পরিবহন:

পুকুরের প্রস্তুতি শেষ হলে উন্নত গুনাগুন সম্পন্ন পাঙ্গাস মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়। এ জন্য বিশ্বস্ত কোন হ্যাচারী থেকে পোনা সংগ্রহ করা উচিত। পোনা পরিবহনের সময় বিশেষ সতর্কতা নিতে হবে যাতে করে পরিবহনের সময় পোনার কোন ক্ষতি না হয়। পরিবহনের আগেই চৌবাচ্চায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা পোনাকে উপোস রেখে টেকসই করে নিতে হবে। পরিবহনের সময় পোনাকে বেশি উত্তেজিত করা উচিৎ নয়।

পাঙ্গাশের খাদ্য প্রয়োগ:

পাঙ্গাস চাষে পুকুরে যে প্রাকৃতিক খাবার তৈরি হয়, তা মাছের আশানুরূপ ফলনের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাই সুষম খাদ্য প্রয়োগ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে চাষ পর্যায়ে দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমান খাদ্য সরবরাহ না করতে পারলে পাঙ্গাসের উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হবে। মাছের খাদ্যের পরিমান মাছের বয়স এবং দেহের ওজনের ওপর নির্ভর করে।

১৫ দিন পর পর নমুনা হিসেবে কয়েকটি মাছের ওজন পরীক্ষা করে দেখতে হবে মাছ ঠিক মতো বাড়ছে কিনা। নির্দিষ্ট পরিমান খাদ্য পুকুরের আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত ৬ থেকে ৮ টি স্থানে প্রদান করা ভাল। দানাদার জাতীয় খাবার ছিটিং এবং সম্পূরক খাবার বল আকারে নির্দিষ্ট জায়গায় সরবরাহ করতে হয়। খাবার একবারে না দিয়ে ২ থেকে ৩ বারে সমানভাবে ভাগ করে প্রয়োগ করলে খাদ্যের কার্যকারীতা অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রয়োজনমতো চুন এবং সার প্রয়োগ করাটাও জরুরি।

পাঙ্গাশ মাছ সংগ্রহ ও বিক্রয় :

বাজারের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে মাছ মজুদের ৫-৬ মাস পর যখন পাঙ্গাসের গড় ওজন ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হয়, তখনই মজুদকৃত মাছের ৫০% বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়। এতে করে অবশিষ্ট মাছ দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

পাঙ্গাশ মাছের রোগ ব্যবস্থাপনা:

পাঙ্গাস বেশ শক্ত প্রকৃতির মাছ। তারপরও পাঙ্গাসের রোগ—বালাই দেখা দিতে পারে। রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই উত্তম। সেক্ষেত্রে— পুকুর প্রস্তুতকরণ ধাপটি যথাযথভাবে করতে হবে। সুস্থ—সবল রোগমুক্ত পোনা মজুদ করতে হবে। সাধারণত নিম্নমানের চাষ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশগত ধকলের কারণে পাঙ্গাস মাছ প্রোটোজোয়া ও ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়।

এসব ব্যাকটোরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় তঁুত ব্যবহার বেশ ফলদায়ক ইকঈ (ইবহুধষ কড়হরঁস ঈযষড়ৎরফব) দ্রবণে ৭—১০ দিন আক্রান্ত মাছকে গোসল করালেও প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক যেমন— টেট্রাসাইক্লিন (মাত্রা ৫৫—৭৭ মিগ্রা/কেজি খাবার) খাবারের সাথে মিশিয়ে ৭—১০ দিন আক্রান্ত মাছকে খাওয়ালে প্রতিকার পাওয়া যাবে।

 

 

পাঙ্গাশ মাছের একক চাষ পদ্ধতি:

পাঙ্গাস মাছের একক চাষ পদ্ধতি নিয়ে আজকের পাঠ। এই পঠটি কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র এর ইউনিট-১ এর পাঠ -১.৫ এর অংশ। আবহমানকাল থেকে পাঙ্গাস মাছ এদেশের মানুষের জন্য রসনার উৎস হিসেবে পরিচিত। এই মাছটি প্রাকৃতিক মুক্ত জলাশয়ে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসহ উপকূলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। এক সময়ে পাঙ্গাস মাছ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে উচ্চবিত্তের মাছ হিসেবে বিবেচিত ছিল।

বাংলাদেশের নদ—নদীতে এক সময় প্রচুর দেশী পাঙ্গাস পাওয়া যেত। নদী থেকে মাছটির পোনা সংগ্রহ করে পুকুর দীঘিতে চাষের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু সফলতা আসেনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। পরবর্তিতে ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ড থেকে “থাই পাঙ্গাস” আমদানি করা হয়। ১৯৯৩ সালে মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউটে থাই পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদনের সফলতার পর থেকে এর চাষ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে।

এ পদ্ধতিতে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বেশি ঘনত্বে পোনা মজুদ করা হয়। এক্ষেত্রে আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে বেশি মুনাফা করা যায়। উন্নত চাষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হেক্টর প্রতি ১৫ থেকে ২০ টন পাঙ্গাস উৎপাদন করা সম্ভব। একক চাষে প্রতি হেক্টরে ৮ থেকে ১০ সেমি. আকারের ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বিগত বছরের পোনা মজুদ করে অধিক উৎপাদন ও বেশি মুনাফা বাড়ানো সম্ভব।

 

থাই পাঙ্গাশ মাছের একক চাষ :

জলাশয় বা পুকুরে শুধু একটি প্রজাতি অর্থাৎ শুধু থাই পাঙ্গাস চাষ করলে তাকে থাই পাঙ্গাসের একক চাষ বলা হয়। এ ধরনের চাষ মূলত নিবিড় ব্যবস্থাপনায় করা হয়। থাই পাঙ্গাস মাছের একক চাষ পদ্ধতির ধাপগুলো নিচে আলোচনা করা হল:

পুকুর নির্বাচন বন্যামুক্ত আলো—বাতাস পূর্ণ এলাকায় পুকুর নির্বাচন করতে হবে। এঁটেল দো—আঁশ বা দো—আঁশ মাটির পুকুর পাঙ্গাস চাষের জন্য উত্তম। পুকুর আয়তাকার হলে ব্যবস্থাপনা করতে সুবিধা হয়। পুকুরের আয়তন হতে হবে ২৫—১০০ শতাংশ এবং গভীরতা হবে ১.৫—২ মিটার। পুকুরের তলায় কাদার পরিমান ১৫ সে.মি এর বেশি না থাকাই ভাল।

 

থাই পাঙ্গাশ মাছ চাষের সুবিধা :

(১) সব ধরনের জলাশয়ে চাষযোগ্য।

(২) চাষের জন্য পোনা পাওয়া যায়।

(৩) দ্রুত বর্ধনশীল।

(৪) একক ও মিশ্র প্রজাতির সাথে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা যায়।

(৫) সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করে।

(৬) পরিবেশের প্রতিকূলতা সহ্য করতে পারে।

(৭) দাম কিছুটা কম হলেও বাজার চাহিদা ভাল।

(৮) জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায়।

(৯) বিদেশেও রপ্তানিযোগ্য।

 

একক পাঙ্গাশ চাষের  জন্য পুকুর প্রস্তুতকরণ :

জলজ আগাছা দমন, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, রাক্ষুসে মাছ ও অবাঞ্ছিত প্রাণি দমন এবং পাড় ও তলা মেরামত করার পর যথাক্রমে চুন ও সার প্রয়োগ করে চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুত করতে হয়। উক্ত কাজগুলো যথারীতি আগের মতই করতে হবে (কই চাষের পুকুর প্রস্তুতকরণ অংশ দেখে নিতে পারেন)।

চুন ও সার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কই মাছের একই মাত্রা প্রযোজ্য। তবে অধিক ঘনত্বে পাঙ্গাস চাষ করলে পুকুরে জৈব সার প্রয়োগ না করাই উত্তম। কারণ পাঙ্গাস চাষে যে পরিমাণ খাদ্য প্রয়োগ করা হয় তাতে পাঙ্গাসের মল—মূত্রের কারণে পরিবেশ এমনিতেই উর্বর থাকে এবং পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মে। অনেক সময় প্রাকৃতিক খাদ্যাধিক্যের ফলে মাছের সমস্যা দেখা দেয়। যে সব খামারি ভাসমান খাদ্য দিয়ে অধিক ঘনত্বে পাঙ্গাস চাষ করবেন তাদের ক্ষেত্রে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখা উচিত।

পোনা মজুদ পুকুর প্রস্তুতির কাজ চলাকালীন ভাল পোনার জন্য নির্ভরযোগ্য নার্সারি/হ্যাচারি মালিকের সাথে যোগাযোগ শুরু করা বাঞ্চনীয়। ভাল ব্যবস্থাপনা আর ভাল খাবার খাওয়ালেই যে মাছের ভাল উৎপাদন পাওয়া যাবে তা অনেক সময় ঠিক নাও হতে পারে। ভাল উৎপাদন পাওয়ার পূর্বশর্ত হল ভালো মানসম্মত পোনা। অন্তঃপ্রজনন জনিত সমস্যার কারণে সব হ্যাচারির পোনার মান সমান নয়। ভাল ও বিশ্বস্ত হ্যাচারির পোনা দেখে কিনতে হবে। পুকুরে মজুদ করার জন্য একটু বড় মাপের পোনা (৬—৭ ইঞ্চি লম্বা) হলে ভাল হয়।

অনেকে অধিক ফলন পেতে আরো বড় আকারের পোনা (১০০১৫০ গ্রাম ওজন/ প্রতিটি) মজুদ করে। সকালের কম তাপমাত্রায় পুকুরে পোনা মজুদ করতে হবে। পোনাকে অবশ্যই পুকুরের পানির সাথে কন্ডিশনিং (অভ্যস্তকরণ) করে তারপর ছাড়তে হবে। নিম্নের সারণি অনুসারে পোনার সংখ্যা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

 

পাঙ্গাশ মাছের একক চাষে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:

পাঙ্গাসের একক চাষ সম্পূর্ণভাবে সম্পূরক খাদ্য নির্ভর। তাই পাঙ্গাসকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার সরবরাহ করতে হবে। খাদ্য প্রয়োগে ব্যাঘাত ঘটলে উৎপাদনে বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। পাঙ্গাসের খাবারে ২৫—৩০% আমিষ থাকা বাঞ্চনীয়। ইদানিং বাজারে বিভিন্ন ধরনের (ভাসমান, ডুবন্ত ইত্যাদি) পিলেট খাদ্য বিক্রি হয়। তবে এসব খাদ্যের আমিষের মাত্রা জেনে তারপার কেনা উচিত। তাছাড়া খৈল, চাউলের কঁুড়া, গমের ভূষি, ফিসমিল, ময়দা/আটা, ভিটামিন প্রিমিক্স ইত্যাদি সমম্বয়ে ৩০% আমিষ সমৃদ্ধ খাবার খামারেই তৈরি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খাদ্যের খরচ কিছুটা কমে যায়। এ ধরনের খাদ্যকে। নিম্নোক্ত হারে উপাদানগুলো ব্যবহার করে সহজেই ৩০% আমিষ নিশ্চিত করা যাবে—

(বি:দ্র: উপাদানগুলোর ব্যবহার মাত্রা যৎসামান্য পরিবর্তন করা যেতে পারে। তবে বেশি পরিমাণ হেরফের করলে কাঙ্খিত আমিষ নিশ্চিত করা যাবে না।) মাছের দেহের ওজনের ৩—৮% হারে খাবার দিতে হবে। চাষের শুরুতে মজুদকৃত পোনার জন্য বেশি হারে খাবার দিতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে ওজন বাড়ার সাথে সাথে তা হ্রাস করতে হবে। সারণিতে বর্ণিত নিয়মে খাদ্য দিলে ভাল ফল পাওয়া যাবে।

দিনে দুই বার খাবার দিতে হবে। পিলেট খাদ্য পুকুরের বিভিন্ন জায়গায় ছিটিয়ে দিতে হবে। খামারে তৈরি ভিজা খাদ্য পুকুরে স্থাপিত ট্রে—তে দেয়া বাঞ্ছনীয়। আহরণ ও বাজারজাতকরণ : পাঙ্গাসের ওজন ৫০০ গ্রামের ওপর হলে আহরণ করে বাজারজাতকরণ করা যেতে পারে। বেড় জাল, ঝাঁকি জাল ব্যবহার করে অথবা পুকুর শুকিয়ে সমস্ত মাছ একবারে আহরণ করা যেতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারিপারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে মাছের চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সারা দেশের প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর পুকুর, দীঘি ইত্যাদিসহ প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ হেক্টর জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পাঙ্গাস মাছের চাষ করলে দেশের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদন কয়েকগুন বেড়ে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এদেশের বিপুল সংখ্যক বেকার যুব ও যুব মহিলাদের। প্রায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের ঐতিহ্য ’মাছে ভাতে বাঙ্গালী’-কে পুনরুদ্ধার করতে তাই পাঙ্গাস মাছের চাষ একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।