Category Archives: কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা

কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের কৃষিতে কৃষি বিষ নিরাপত্তা

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি অর্থনীতির ধারাবাহিক উন্নতির জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং বিভিন্ন কৃষি বিষ ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষের অযাচিত ও অনিরাপদ ব্যবহার কৃষক, ভোক্তা, মাটি, পানি, পরিবেশ এবং সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই কৃষি বিষ নিরাপত্তা আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও বৈশ্বিক আলোচ্য বিষয়।

বাংলাদেশের কৃষিতে কৃষি বিষ নিরাপত্তা

 

 

কৃষি বিষের ধরন ও ব্যবহার

বাংলাদেশে সাধারণত চার ধরনের কৃষি বিষ ব্যবহৃত হয়—

  1. কীটনাশক (Insecticides): পোকামাকড় দমন করতে ব্যবহৃত হয়।
  2. ছত্রাকনাশক (Fungicides): ফসলের ছত্রাকজনিত রোগ দমনে ব্যবহৃত হয়।
  3. শাকনাশক (Herbicides): আগাছা দমনে ব্যবহৃত হয়।
  4. ইঁদুরনাশক অন্যান্য: দানাদার ফসল ও গুদামজাত পণ্যে ক্ষতিকর প্রাণী দমনে ব্যবহৃত হয়।

১৯৭০–এর দশকে বাংলাদেশে কৃষি বিষের ব্যবহার ছিল সীমিত। কিন্তু সবুজ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে হাইব্রিড বীজ, উচ্চফলনশীল জাত এবং নিবিড় চাষাবাদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি বিষের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

 

কৃষি বিষ ব্যবহারের ইতিবাচক দিক

  • কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
  • পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
  • খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা
  • কৃষকের আর্থিক ক্ষতি রোধ

তবে অতি ব্যবহার বা অনিরাপদ ব্যবহার করলে এসব সুফল পরিণত হয় ক্ষতির দিকে।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তা সমস্যা

বাংলাদেশে কৃষি বিষ ব্যবহারে কয়েকটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে:

  1. অতিরিক্ত ব্যবহার: অনেক কৃষক ধারণা করেন বেশি কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসল ভালো হয়। এর ফলে বিষাক্ততা বেড়ে যায়।
  2. অসচেতনতা: কৃষকরা লেবেলে লেখা নির্দেশনা অনেক সময় মানেন না।
  3. নকল নিম্নমানের কৃষি বিষ: বাজারে ভেজাল ও নকল কীটনাশকের প্রবণতা রয়েছে।
  4. সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব: কৃষকরা সঠিক মাস্ক, গ্লাভস বা চশমা ছাড়া স্প্রে করেন।
  5. সংরক্ষণ সমস্যা: ঘরে, রান্নাঘরে বা শোবার ঘরে কৃষি বিষ মজুত রাখা হয়, যা পরিবারের শিশু ও গবাদি পশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
  6. প্রশিক্ষণের ঘাটতি: কৃষকদের অনেকের কাছে বিষ ব্যবহারের সঠিক প্রশিক্ষণ নেই।

 

কৃষি বিষের স্বাস্থ্যঝুঁকি

কৃষি বিষের প্রভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়:

  • তাৎক্ষণিক প্রভাব: মাথা ব্যথা, বমি, চোখ জ্বালা, শ্বাসকষ্ট, ত্বক জ্বালা।
  • দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ক্যান্সার, কিডনি বিকল, স্নায়বিক সমস্যা, বন্ধ্যত্ব, শিশু জন্মগত ত্রুটি।
  • অকালে মৃত্যু: প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কৃষক কৃষি বিষে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

পরিবেশগত প্রভাব

  • মাটির উর্বরতা নষ্ট: বিষাক্ত রাসায়নিক মাটির অণুজীব ধ্বংস করে।
  • পানি দূষণ: কীটনাশক বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদী-খালে মিশে যায়।
  • জলজ প্রাণী হুমকির মুখে: মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়াসহ জলজ প্রাণী মারা যায়।
  • জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: মৌমাছি ও পরাগায়নকারী পোকা নষ্ট হয়, ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তায় আইনি কাঠামো

বাংলাদেশ সরকার কৃষি বিষ ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে—

  • কৃষি বিষ আইন, ২০১৮
  • কৃষি বিষ নিয়মাবলি, ২০১৯
  • কীটনাশক আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অনুমোদন ও নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
  • ভেজাল বা অবৈধ কৃষি বিষ বিক্রির জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

তবে আইন বাস্তবায়নে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন—বাজার পর্যবেক্ষণ দুর্বল, কৃষকের সচেতনতা কম, দুর্নীতি ইত্যাদি।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তা নিশ্চিতের উপায়

  1. সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। লিফলেট, পোস্টার, টিভি প্রোগ্রাম, ইউটিউব ভিডিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
  2. আইন প্রয়োগ: ভেজাল ও নকল কৃষি বিষ নির্মূল করতে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।
  3. ব্যক্তিগত সুরক্ষা: কৃষকদের স্প্রে করার সময় মাস্ক, গ্লাভস, বুট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  4. অর্গানিক জৈব কৃষি: রাসায়নিক বিষের পরিবর্তে জৈব সার, নিম তেল, ট্রাইকোডার্মা, ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।
  5. ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (IPM): প্রাকৃতিক উপায়ে কীট দমন, জৈবিক শত্রু ব্যবহার, ফসলের আবর্তন ইত্যাদি কার্যকর করতে হবে।
  6. সংরক্ষণ ব্যবস্থা: বিষ আলাদা ঘরে তালাবদ্ধ স্থানে রাখতে হবে।
  7. মনিটরিং গবেষণা: বিষের ক্ষতি ও বিকল্প প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা বাড়াতে হবে।

 

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

  • ইউরোপীয় ইউনিয়ন: অনেক ক্ষতিকর কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে এবং অর্গানিক চাষাবাদ উৎসাহিত করছে।
  • ভারত: IPM প্রোগ্রাম চালু করে ধীরে ধীরে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়েছে।
  • শ্রীলঙ্কা: ভেজাল কীটনাশকের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশ এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নীতিমালা ও বাস্তবায়ন কাঠামো শক্তিশালী করতে পারে।

 

কৃষি বিষ নিরাপত্তায় প্রযুক্তির ভূমিকা

  • মোবাইল অ্যাপ: কৃষকরা কোন বিষ, কতটা ব্যবহার করবেন তা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারেন।
  • ড্রোন প্রযুক্তি: ফসলের রোগ সনাক্তকরণ ও সুনির্দিষ্ট জায়গায় বিষ প্রয়োগে ড্রোন ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • ডিজিটাল ডাটাবেস: বাজারে কোন কোন কীটনাশক অনুমোদিত, তার তালিকা অনলাইনে দেওয়া যেতে পারে।

 

টেকসই কৃষির পথে

বাংলাদেশে কৃষি বিষের সঠিক ব্যবহার, জৈব ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগ এবং কৃষক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া কৃষি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কৃষি বিষ নিরাপত্তা শুধু কৃষকের জীবন রক্ষার প্রশ্ন নয়, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাংলাদেশের কৃষি আজ এক দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন—একদিকে বাড়তে থাকা খাদ্যের চাহিদা, অন্যদিকে কৃষি বিষ ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি। তাই কৃষি বিষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের নয়, কৃষক, কৃষি বিজ্ঞানী, গবেষক, ভোক্তা এবং সমাজের সকলের দায়িত্ব। সচেতনতা, আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিকল্প জৈব পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুস্থ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি।

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনের মূল চালিকা শক্তি হলো কৃষি। তবে কৃষি উৎপাদনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিভিন্ন রোগ, পোকা-মাকড় ও আগাছার আক্রমণ। দীর্ঘদিন ধরে এসব সমস্যার মোকাবেলায় কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু অতিরিক্ত ও নির্বিচারে রাসায়নিক ব্যবহারে পরিবেশ, মাটির উর্বরতা, পানির গুণগত মান এবং মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি (Biological Control Technology) ক্রমে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি

 

 

জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি কী?

জৈব নিয়ন্ত্রণ হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে প্রাকৃতিক শত্রু যেমন—শিকারী (Predators), পরজীবী (Parasitoids), রোগজীবাণু (Pathogens) ইত্যাদি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগ দমন করা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতির ভারসাম্যকে কাজে লাগিয়ে, কৃত্রিম রাসায়নিকের বদলে প্রাকৃতিকভাবে শস্যকে সুরক্ষিত রাখা।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জৈব নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা

  1. রাসায়নিক কীটনাশকের অপব্যবহার
    বাংলাদেশের কৃষকরা দ্রুত ফল পেতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করেন। এতে কীট প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে অধিক মাত্রার কীটনাশক দরকার হয়।
  2. স্বাস্থ্যঝুঁকি
    ফসলের অবশিষ্ট কীটনাশক মানুষের শরীরে গিয়ে ক্যানসার, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা তৈরি করছে।
  3. পরিবেশের ক্ষতি
    রাসায়নিক কীটনাশক মাটি ও পানিকে দূষিত করছে এবং উপকারী কীটপতঙ্গ যেমন মৌমাছি ও প্রজাপতির ক্ষতি করছে।
  4. রপ্তানি বাজারে বাধা
    ইউরোপ ও আমেরিকার মতো বাজারে বাংলাদেশি শাকসবজি ও ফল রপ্তানির ক্ষেত্রে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের কারণে প্রায়ই সমস্যা হয়।

 

জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির ধরন

১. শিকারী কীট (Predators) ব্যবহার
  • লেডি বার্ড বিটল (Ladybird beetle) এফিড বা লিফ হপার দমন করে।
  • ড্রাগনফ্লাই ও ড্যামসেলফ্লাই ধানের ক্ষতিকর পোকা যেমন প্ল্যান্ট হপার দমন করে।
২. পরজীবী (Parasitoids) ব্যবহার
  • ট্রাইকোগ্রামা (Trichogramma) বোলওয়ার্মের ডিমে পরজীবী হয়ে ফসলকে রক্ষা করে।
  • ব্রাকোনিড বোলতা (Braconid wasp) শস্যক্ষেতে শুঁয়োপোকা দমন করে।
৩. প্যাথোজেন বা রোগজীবাণু ব্যবহার
  • ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (Bacillus thuringiensis বা Bt) শুঁয়োপোকা দমন করতে কার্যকর।
  • বভেরিয়া বাসিয়ানা (Beauveria bassiana) পোকায় সংক্রমণ ঘটিয়ে তাদের মেরে ফেলে।
  • এনটোমোপ্যাথোজেনিক নিমাটোড মাটিতে বসবাসকারী কীট দমন করে।
৪. ফেরোমন ট্র্যাপ
  • ফেরোমন ব্যবহার করে ক্ষতিকর কীটকে ফাঁদে ফেলে ধ্বংস করা যায়। ধানের পোকা ও সবজি ক্ষেতের ফলছিদ্রকারী পোকায় এটি কার্যকর।
৫. সাংস্কৃতিক পদ্ধতি
  • ফসলের আবর্তন (Crop rotation)
  • প্রতিরোধী জাত ব্যবহার
  • সঠিক সময়ে বপন ও কাটাই
  • আগাছা নিয়ন্ত্রণ

 

বাংলাদেশে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো—

  • ধানক্ষেতে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার: ধানের মাজরা পোকা ও পাতাফড়িং নিয়ন্ত্রণে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • সবজি ক্ষেতে ট্রাইকোগ্রামা রিলিজ: বাঁধাকপি, ফুলকপি ও বেগুনের ফসলকে লার্ভা আক্রমণ থেকে রক্ষা করছে।
  • Bt স্প্রে: বাঁধাকপি ও টমেটোর ফলছিদ্রকারী পোকা দমনে কার্যকর।
  • বায়োপেস্টিসাইড: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নীমভিত্তিক জৈব কীটনাশক দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে।

 

কৃষকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা

যদিও কৃষকদের মধ্যে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রতি নির্ভরশীলতা বেশি, তবে বিভিন্ন প্রকল্প ও সচেতনতা কর্মসূচির কারণে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষকেরা উপলব্ধি করছেন যে এটি—

  • কম খরচে
  • পরিবেশবান্ধব
  • দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধান

 

সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ

  1. কৃষকের অজ্ঞতা: অধিকাংশ কৃষক জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত নন।
  2. বাজারজাতকরণ সমস্যা: জৈব কীটনাশক ও বায়োপেস্টিসাইড সহজলভ্য নয়।
  3. ধৈর্য্যের অভাব: রাসায়নিক কীটনাশকের মতো তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় না।
  4. গবেষণা বিনিয়োগের অভাব: প্রযুক্তিকে আরও কার্যকর করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি।

 

সম্ভাবনা

  • রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্য বৃদ্ধি
  • পরিবেশ সংরক্ষণ জীববৈচিত্র্য রক্ষা
  • জনস্বাস্থ্যের উন্নতি
  • কৃষকের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস

 

ভবিষ্যৎ করণীয়

  1. কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  2. স্থানীয়ভাবে জৈব নিয়ন্ত্রণ উপকরণ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা।
  3. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গবেষণা ও প্রচার বাড়ানো।
  4. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া।

 

 

বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি শুধু একটি বিকল্প নয়, বরং একটি অপরিহার্য পথ। রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এই প্রযুক্তির বিস্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জৈব নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

বাংলাদেশের কৃষির জন্য কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশল

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত এবং জাতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি খাত। তবে কৃষির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ফসলের কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই। প্রতিবছর অগণিত কৃষক এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাতীয় উৎপাদনেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। কার্যকর কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ ছাড়া টেকসই কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের কৃষিতে কীটপতঙ্গ ও রোগের প্রকৃতি, ক্ষতির ধরণ, ব্যবস্থাপনার প্রচলিত ও আধুনিক কৌশল এবং টেকসই সমাধানের দিকগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

 

 

কীটপতঙ্গ রোগের প্রকৃতি প্রভাব

কীটপতঙ্গের আক্রমণ

বাংলাদেশে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আলু, সবজি ও ফলমূলসহ প্রায় সব ধরনের ফসলেই কীটপতঙ্গের আক্রমণ দেখা যায়। ধানের ক্ষেত্রেই দানোপজীবী পোকা, গলমাছি, পাতা মোড়ানো পোকা, মাজরা পোকা, লেদাপোকা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। সবজিতে ফলছিদ্রকারী পোকা, পাতাখেকো পোকা, এফিড ও সাদা মাছি উৎপাদন ব্যাহত করে।

রোগবালাই

ফসলের রোগের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ সবচেয়ে বেশি। ধানে ব্লাস্ট, শীথ ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট এবং গমে উষ্টা, পাতাঝরা, মরিচা রোগ দেখা যায়। টমেটোতে ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, আলুতে লেট ব্লাইট, বেগুনে উইল্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব রোগ শুধু উৎপাদন কমায় না, মানও নষ্ট করে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে ফসলের কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের কারণে প্রতিবছর গড়ে ২০-৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে যায়। কখনও কখনও তা ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে দাঁড়ায়, যা কৃষকের জীবনযাত্রা ও খাদ্যনিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে।

 

প্রচলিত কীটপতঙ্গ রোগব্যবস্থাপনা

রাসায়নিক কীটনাশক

বাংলাদেশের কৃষকরা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল কীটনাশকের ওপর। দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য এটি কার্যকর হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, পানিদূষণ হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

জীবাণুনাশক জৈব পদার্থ

কিছু ক্ষেত্রে কৃষকরা ছত্রাকনাশক বা ব্যাকটেরিয়ানাশক ব্যবহার করে। পাশাপাশি সার, গোবর, ছাই, নিমপাতা, তিতকুটে গাছের নির্যাস ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে এর কার্যকারিতা রাসায়নিকের তুলনায় কিছুটা কম হলেও পরিবেশবান্ধব।

কৃষিকাজের কৌশল

ফসলের সময় পরিবর্তন, মাটি ভালোভাবে চাষ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার, ফসলের আবর্তন ইত্যাদি প্রচলিত কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

আধুনিক কীটপতঙ্গ রোগব্যবস্থাপনা

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM)

বাংলাদেশ সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management – IPM) কার্যক্রম চালু করেছে। এতে রাসায়নিকের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে জৈব পদ্ধতি, কৃষি কৌশল ও প্রাকৃতিক শত্রুপোকা ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন:

  • ক্ষেতের মধ্যে পাখির বসার বাঁশ স্থাপন করে ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা কমানো।
  • আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে রাতের পোকা দমন।
  • ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করে ফলছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণ।
  • পরজীবী বোলতা ও শত্রুপোকার বিস্তার ঘটিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা।

রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। যেমন, ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধান জাত কিংবা লেট ব্লাইট প্রতিরোধী আলুর জাত।

জৈব প্রযুক্তি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিরোধী ও রোগ সহনশীল ফসল উদ্ভাবনে গবেষণা চালাচ্ছেন। যেমন, বিটি-বেগুন বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই চাষ হচ্ছে, যা ফলছিদ্রকারী পোকার বিরুদ্ধে কার্যকর।

ডিজিটাল কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি

কৃষকরা এখন স্মার্টফোন অ্যাপ, হেল্পলাইন, কৃষি তথ্যসেবা কেন্দ্র ও কৃষি টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত বালাই শনাক্ত ও প্রতিকার জানতে পারছে। ড্রোন ও সেন্সরের মাধ্যমে ক্ষেত পর্যবেক্ষণও কিছু জায়গায় চালু হয়েছে।

 

টেকসই বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল

পরিবেশবান্ধব সমাধান

অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করে জৈব কীটনাশক, নিম তেল, ফারমেন্টেড গাছের নির্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

কৃষক প্রশিক্ষণ

প্রশিক্ষিত কৃষকই সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে। গ্রামভিত্তিক কৃষক স্কুল (Farmer Field School) চালু করে কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন কীটপতঙ্গ ও রোগ দেখা দিচ্ছে। তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত অভিযোজিত জাত উদ্ভাবনে কাজ করতে হবে।

সমন্বিত নীতি বাস্তবায়ন

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত নীতি গ্রহণ, কৃষকের কাছে সহজে জৈব ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ পৌঁছে দেওয়া, এবং কৃষি সম্প্রসারণ সেবার শক্তিশালীকরণ অপরিহার্য।

 

 

বাংলাদেশের কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশলকে আধুনিকীকরণ ও পরিবেশবান্ধব রূপে গড়ে তুলতে হবে। রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে IPM, জৈব প্রযুক্তি, প্রতিরোধী জাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষক প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দিলে কৃষকরা ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে পারবে। সঠিক সময়ে সঠিক কৌশল প্রয়োগ করলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশের কৃষির জন্য কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনায় রোগ সনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করা এবং রপ্তানি আয়ের একটি বড় উৎস কৃষি। তবে ফসল উৎপাদনে কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। সঠিকভাবে রোগ সনাক্তকরণ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, যা টেকসই কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

 

. ফসলের রোগ কীটপতঙ্গ: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

বাংলাদেশে ধান, গম, ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ, সবজি ও ফল উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও কীটপতঙ্গ আক্রমণ দেখা যায়।

  • ধানের রোগ: ব্লাস্ট, শীথ ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট, উফরা।
  • গমের রোগ: পাতার মরিচা, গমের ব্লাস্ট।
  • সবজির রোগ: ডাউনি মিলডিউ, পাউডারি মিলডিউ, লেট ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট।
  • ফলের রোগ: আমের টপ ডাইব্যাক, আমের গুটি ঝরা, কলার প্যানামা রোগ।
  • প্রধান কীটপতঙ্গ: ধানের পাতা মোড়ানো পোকা, মাজরা পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা, সাদা মাছি, এফিড, থ্রিপস।

এগুলো সময়মতো সনাক্ত করা না গেলে ফসলের ফলন ২০% থেকে ৮০% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।

 

. রোগ সনাক্তকরণের কৌশল

সঠিকভাবে রোগ সনাক্তকরণ সফল ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ।

) মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ

  • কৃষকদের নিয়মিত জমি পরিদর্শন করা উচিত।
  • পাতা, কান্ড, শিকড় ও ফলের অস্বাভাবিক দাগ, পচন বা শুকিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করতে হবে।

) ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণ

  • মাইক্রোস্কোপিক পর্যবেক্ষণ ও কালচার মিডিয়াতে পরীক্ষা করে রোগজীবাণু চিহ্নিত করা হয়।
  • ডিএনএ ভিত্তিক টেস্ট (PCR) বা সিরোলজিক্যাল টেস্ট (ELISA) দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য রোগ সনাক্ত করতে সাহায্য করে।

) আধুনিক প্রযুক্তি

  • ড্রোন স্যাটেলাইট ইমেজিং: ফসলের স্বাস্থ্যের মানচিত্র তৈরি করে রোগাক্রান্ত এলাকা চিহ্নিত করা যায়।
  • মোবাইল অ্যাপ: কৃষকরা আক্রান্ত ফসলের ছবি তুলে অ্যাপে আপলোড করলে বিশেষজ্ঞরা দ্রুত রোগ নির্ণয় করতে পারেন।

 

. রোগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল

রোগ নিয়ন্ত্রণে একক কোনো পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি (Integrated Pest Management – IPM) গ্রহণ করা সবচেয়ে কার্যকর।

) সাংস্কৃতিক পদ্ধতি

  • ফসল চক্র: একই জমিতে বারবার একই ফসল না করে ডাল, তেলবীজ বা শাকসবজি চাষ করলে মাটিতে জীবাণুর চাপ কমে।
  • সঠিক সময় পদ্ধতিতে বপন: মৌসুমি রোগ এড়ানো যায়।
  • রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার: মানসম্মত সার্টিফায়েড বীজ ব্যবহার করলে রোগের ঝুঁকি অনেক কমে।
  • আগাছা দমন: আগাছা অনেক সময় রোগজীবাণুর আশ্রয়স্থল হয়।

) যান্ত্রিক শারীরিক নিয়ন্ত্রণ

  • আক্রান্ত পাতা বা গাছ দ্রুত তুলে ধ্বংস করা।
  • সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখা যাতে অতিরিক্ত আর্দ্রতায় ছত্রাক না বাড়ে।
  • ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে ক্ষতিকর পতঙ্গ আকর্ষণ ও ধ্বংস করা।

) জৈব নিয়ন্ত্রণ

  • রোগ দমনকারী অণুজীব যেমন ট্রাইকোডার্মা, ব্যাসিলাস সুবটিলিস প্রভৃতি ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার।
  • শিকারি পোকা যেমন লেডিবার্ড বিটল, মাকড়সা ইত্যাদি এফিড ও সাদা মাছি দমন করে।
  • জৈব কীটনাশক যেমন নিমপাতার নির্যাস, পাইরেথ্রিন ইত্যাদি।

) রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ

  • প্রয়োজন অনুযায়ী অনুমোদিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার।
  • সর্বদা সঠিক মাত্রা, সঠিক সময়সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে।
  • একই রাসায়নিক বারবার ব্যবহার করলে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তাই বিকল্প রাসায়নিক ব্যবহার জরুরি।

) প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার

  • রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও চাষ কৃষকদের জন্য টেকসই সমাধান। যেমন, বিএআরআই ও বিএরিআই ধানের অনেকগুলো রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেছে।

 

. সমন্বিত রোগ ব্যবস্থাপনা (IPM)

বাংলাদেশে বর্তমানে IPM কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রচলিত হচ্ছে। IPM হলো—

  1. কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
  2. রোগ ও পোকা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
  3. সাংস্কৃতিক, জৈবিক, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতির সমন্বয়।
  4. পরিবেশবান্ধব ও খরচ সাশ্রয়ী।

 

. কৃষক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

  • কৃষক: সময়মতো রোগ শনাক্তকরণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে।
  • গবেষণা প্রতিষ্ঠান: নতুন প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, জৈব নিয়ন্ত্রণ উপকরণ তৈরি এবং আধুনিক প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
  • সরকারি ভূমিকা: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে।

 

. চ্যালেঞ্জ ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

চ্যালেঞ্জ

  • জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব।
  • অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।
  • অনেক কৃষকের আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের অভাব।

ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

  • ডিজিটাল কৃষি সম্প্রসারণ: মোবাইল অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দ্রুত রোগ সনাক্তকরণ।
  • জৈব নিয়ন্ত্রণের প্রসার: পরিবেশবান্ধব কৃষি গড়ে তোলা।
  • জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি (CRISPR) ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন।
  • কৃষকগবেষক সমন্বয়: মাঠপর্যায়ে গবেষণা ও বাস্তবায়ন বৃদ্ধি।

 

 

বাংলাদেশের কৃষি টেকসই করতে হলে কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সময়মতো রোগ সনাক্তকরণ, পরিবেশবান্ধব জৈব নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধী জাতের ব্যবহার এবং কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রোগের ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। টেকসই রোগব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, বরং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যও সুরক্ষিত হবে।

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা। কৃষি উৎপাদনে বালাই বা ক্ষতিকর পোকামাকড়, রোগজীবাণু ও আগাছা অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। অতিরিক্ত বা অযৌক্তিকভাবে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করলে যেমন পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে, তেমনি তা দীর্ঘমেয়াদে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management – IPM) একটি কার্যকর ও টেকসই পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হলো— অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমা বজায় রেখে, বালাই দমনে সকল সম্ভাব্য কৌশলকে একত্রে প্রয়োগ করে পরিবেশবান্ধবভাবে কৃষিজ উৎপাদন নিশ্চিত করা।

এই ব্যবস্থায় কেবল রাসায়নিক নয়, বরং জৈব, যান্ত্রিক, জেনেটিক ও সাংস্কৃতিক কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। IPM ব্যবস্থা কৃষকের খরচ কমিয়ে দেয়, ফসলের গুণমান বৃদ্ধি করে এবং কৃষিকে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের দিক থেকে অধিক নিরাপদ করে তোলে।

আপদের সঠিক কোন সংজ্ঞা দেয়া যায় না কারণ এটা বিভিন্নভাবে পরিবর্তনশীল । শুরু ব্যাপক অর্থে যে কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ যা মানুষ, তাদের পালিত পশু-পাখি, ফসল, ব্যবহৃত দ্রব্যাদি প্রভৃতির ক্ষতিসাধন করে বা বিরক্তির উদ্রেক করে থাকে তাকে আপন বা বালাই বলা হয়।

যেমন- পোকামাকড়, ইদুরজাতীয় প্রাণী, শিয়াল, পাখি, কাঠবিড়ালি, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, কৃমি, আগাছা ইত্যাদি। ফল বিবেচনা করলে আপসসমূহের মধ্যে পোকামাকড়ের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা হলো উদ্ভিদ সংরক্ষণের একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দমন কৌশলের সমন্বয় ঘটিয়ে ক্ষতিকর বালাইগুলোকে অর্থনৈতিক ক্ষতির সীমার নিচে রাখা হয়। এতে রাসায়নিক, জৈব, যান্ত্রিক, জেনেটিক এবং সাংস্কৃতিক পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি সুষম কৌশল গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ফসলের ক্ষতি কমানো এবং পরিবেশ ও উপকারী প্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা।

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য:
  • IPM-এ শুধু রাসায়নিক কীটনাশক নয় বরং কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমস্যার নিরূপণ ও সমাধানে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
  • পোকা-মাকড়, রোগ ও আগাছার চক্র বুঝে তাদের সংক্রমণের মাত্রা ও প্রকৃতি অনুযায়ী কৌশল প্রয়োগ করা হয়।
  • নির্দিষ্ট ক্ষতির মাত্রা (“Economic Threshold Level – ETL”)-এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কীটনাশক ব্যবহার করা হবে কিনা।

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার উপকারিতা:
ক্র. উপকারিতা ব্যাখ্যা
প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা উপকারী জীব যেমন ব্যাঙ, গিরগিটি, টিকটিকি ও পরজীবী পোকা সংরক্ষিত থাকে
পরিবেশ দূষণ কমানো অকার্যকর বা অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করায় মাটি, পানি ও বায়ু কম দূষিত হয়
উপকারী পোকামাকড় সংরক্ষণ পরজীবী এবং পরভোজী পোকামাকড়ের জীবিত থাকা ফসলের জন্য প্রাকৃতিক রক্ষা দেয়াল
কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস শুধুমাত্র প্রয়োজন হলে ও পরিমাণ বুঝে ব্যবহার করা হয়
ফসলের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়মিত আক্রমণ থেকে ফসল নিজে রক্ষা করার ক্ষমতা তৈরি করে
কীট প্রতিরোধীতা হ্রাস অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে যে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, তা অনেকাংশে রোধ হয়
উৎপাদন খরচ কমে, ফলন বাড়ে কম কীটনাশক, সঠিক কৌশল ও সময়ে ব্যবস্থাপনার ফলে খরচ কমে, ফলন বাড়ে

 

IPM ব্যবস্থায় ব্যবহৃত প্রধান কৌশলগুলো:
কৌশল উদাহরণ
১. সাংস্কৃতিক দমন সঠিক সময়ে চাষ, ফসলের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ, ফসল পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন (Crop Rotation)
২. যান্ত্রিক দমন হাত দিয়ে বা ফাঁদ দিয়ে পোকা ধরা, আলোর ফাঁদ, পিপিই ব্যবহার
৩. জৈব দমন ট্রাইকোগ্রামা পোকা ছাড়া, বিটি ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার
৪. রাসায়নিক দমন (সীমিতভাবে) নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে কীটনাশক ব্যবহারে অনুমোদিত প্রয়োগ
৫. প্রতিরোধী জাত ব্যবহার রোগ ও পোকা সহিষ্ণু বা প্রতিরোধী জাত ব্যবহার

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, অন্যদিকে কৃষকের জন্য একটি লাভজনক ও দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন পদ্ধতি নিশ্চিত করে। একে যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে এটি বাংলাদেশের কৃষিতে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বিপ্লব এনে দিতে পারে।

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) হলো এমন একটি পরিবেশবান্ধব কৌশল, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতির নিচে থেকে বালাই নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। এতে একাধিক দমন কৌশল (সংস্কৃতিক, জৈবিক, যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও প্রতিরোধক জাত) একত্রে এবং সুনির্দিষ্টভাবে ব্যবহার করা হয়।

নিম্নে এই ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:

 

. আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে দমন

  • জমি গভীরভাবে চাষ করলে মাটির নিচের পোকা ও ডিম উঠে এসে রোদে বা পাখির খাদ্য হয়ে মারা যায়।
  • ফসল পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করলে নির্দিষ্ট পোকামাকড় বা রোগের চক্র ভেঙে যায়।
  • সুষম সার ব্যবহারে গাছ সুস্থ থাকে, ফলে রোগ বা পোকার আক্রমণ কমে।
  • ধানখেতে অতিরিক্ত পানি অপসারণ বা সেচ ব্যবস্থা বদল করে নির্দিষ্ট পোকার (যেমন গাছ ফড়িং বা শীষকাটা পোকা) আক্রমণ কমানো যায়।

 

. প্রতিরোধক শস্যের মাধ্যমে দমন

  • প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করলে প্রাকৃতিকভাবেই রোগ বা পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়।
  • উদাহরণ:
    • চান্দিনা ধান – মাজরা পোকার প্রতিরোধী।
    • প্রগতি ধান – টুংরো ভাইরাস, রস্ট ও বাকানী রোগ প্রতিরোধী।

 

. যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমন

  • মানুষের হাত বা যন্ত্র ব্যবহার করে পোকা ধ্বংস করা হয়।
  • পদ্ধতিসমূহ:
    • হাতজাল বা দলে ধরে পোকা ধরা
    • পিটিয়ে, ঝাঁকিয়ে ফেলা
    • কুলা বা চালুনিতে চেলে ফেলা
    • আলো ফাঁদ – আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পোকা ধরা পড়ে

 

. জৈবিক পদ্ধতিতে দমন

  • প্রাকৃতিক শত্রু বা পরজীবীর মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকা দমন করা।
  • উদাহরণ:
    • Trichogramma spp. – ডিমপর্যায়ে পরজীবী
    • Beauveria bassiana – ছত্রাক, যা পোকামাকড়ে সংক্রমণ ঘটায়
    • লেডি বিটল – অ্যাফিড দমন করে

 

. রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমন

  • অনুমোদিত এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় বালাইনাশক ব্যবহার করে বালাই দমন করা।
  • উদাহরণ:
    • ডায়াজিনন ৬০ ইসি – উদ্ভিদভোজী পোকা দমনে ব্যবহৃত
    • ম্যালাথিয়ন – চুষে খাওয়া পোকা দমনে কার্যকর
    • কুইনালফস, কার্বারিল, ক্লোরপাইরিফস – অন্যান্য বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক

 

পদ্ধতিগুলোর তুলনামূলক টেবিল:

দমন পদ্ধতির নাম কার্যপদ্ধতি / কৌশল উদাহরণ / মন্তব্য
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি গভীর চাষ, ফসল পরিবর্তন, সুষম সার প্রয়োগ, পানি ব্যবস্থাপনা চুঙ্গি পোকার দমন, শীষ কাটা পোকা নিয়ন্ত্রণ
প্রতিরোধক শস্য রোগ ও পোকা প্রতিরোধী জাত ব্যবহার চান্দিনা, প্রগতি জাত
যান্ত্রিক পদ্ধতি ফাঁদ, ঝাঁকানো, কুলা, আলো ফাঁদ ধানক্ষেতে আলো ফাঁদ
জৈবিক পদ্ধতি পরজীবী ও শিকারি জীবের ব্যবহার Trichogramma, Lady Beetle, ছত্রাক
রাসায়নিক পদ্ধতি অনুমোদিত কীটনাশকের সঠিক মাত্রায় ব্যবহার ডায়াজিনন ৬০ ইসি, ম্যালাথিয়ন

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা হলো আধুনিক কৃষির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে না, বরং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায়ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সঠিক সময়ে ও সঠিক পদ্ধতি বেছে নিয়ে IPM বাস্তবায়ন করলে কৃষক অধিক লাভবান হতে পারে এবং কৃষি ব্যবস্থাপনা আরও টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হতে পারে।

 

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার উপাদানসমূহ

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) হলো এমন একটি ফসলভিত্তিক টেকসই কৌশল, যার মাধ্যমে ফসলের পুরো চাষাবাদ চক্রে (চারা অবস্থা, বৃদ্ধির পর্যায়, ফুল ও ফল ধরা পর্যন্ত) বালাই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। IPM-এর লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রার নিচে বালাই রাখা এবং পরিবেশ, মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা।

IPM বাস্তবায়নে নিচের ৫টি প্রধান উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

 

. পর্যবেক্ষণ (Monitoring)

  • ফসলের ক্ষেতে নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে বালাই বা তাদের উপসর্গ আছে কি না তা খেয়াল রাখা।
  • এটি প্রাথমিক সংকেত দেয় যে বালাই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন কি না।

. জরিপ (Survey)

  • জমিতে উপস্থিত বালাই ও তাদের প্রাকৃতিক শত্রুদের সনাক্তকরণ ও গণনা করা।
  • উদাহরণ: প্রতি নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছে কীটপতঙ্গ বা রোগ লক্ষণ কত শতাংশে বিদ্যমান তা নথিভুক্ত করা।

. দমননীতি (Decision-Making Rules)

  • নির্ধারণ করা যে কখন, কত পরিমাণ আক্রমণ হলে এবং কোন পদ্ধতি বেছে নিয়ে বালাই দমন করতে হবে।
  • একে ইকোনমিক থ্রেশহোল্ড লেভেল (ETL) বা অর্থনৈতিক সহনশীল মাত্রাও বলা হয়।

. দমন পদ্ধতি (Control Methods)

  • নিচের চারটি পদ্ধতি থেকে প্রয়োজনে একাধিক কৌশল প্রয়োগ করা হয়:
    • যান্ত্রিক পদ্ধতি: ফাঁদ, হাতজাল, আলো ফাঁদ ইত্যাদি
    • জৈবিক পদ্ধতি: পরজীবী পোকা বা ছত্রাকের ব্যবহার
    • রাসায়নিক পদ্ধতি: অনুমোদিত কীটনাশক, নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ
    • কৃষিনির্ভর পদ্ধতি: জমি চাষ, ফসল পরিবর্তন, সময়মতো সেচ

. অজীবীয় উপাদান (Abiotic Factors)

  • তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, কুয়াশা, বৃষ্টি, বাতাসের গতি ইত্যাদি পরিবেশগত উপাদান অনেক সময় বালাইকে প্রাকৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।
  • যেমন—গ্রীষ্মকালে অধিক তাপমাত্রায় ছত্রাকজাত রোগ কমে যায়, বর্ষায় কিছু পোকা প্রাকৃতিকভাবে ধ্বংস হয়।

 

টেবিলে উপস্থাপন: IPM এর উপাদান কার্যকারিতা

উপাদান কার্যকারিতা বা ভূমিকা
পর্যবেক্ষণ ক্ষেতে নিয়মিত পরিদর্শন করে বালাই উপস্থিতি শনাক্তকরণ
জরিপ বালাই ও প্রাকৃতিক শত্রুর সংখ্যা নিরূপণ
দমননীতি কখন ও কী পদ্ধতিতে দমন করতে হবে তা নির্ধারণ
দমন পদ্ধতি যান্ত্রিক, রাসায়নিক, জৈবিক ও কৃষিনির্ভর উপায় প্রয়োগ
অজীবীয় উপাদান আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রতিকূলতা কাজে লাগিয়ে বালাই দমন

 

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনার এই উপাদানসমূহ একে অপরের পরিপূরক। এসব উপাদান কার্যকরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ফসলের গুণগত মান বজায় থাকে, উৎপাদন ব্যয় কমে, পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে এবং কৃষি হয় অধিক টেকসই ও লাভজনক।

 

 

 

সারমর্ম

সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা হলো উদ্ভিদ সংরক্ষণের একটি পদক্ষেপ যেখানে বিভিন্ন প্রকার দমন পদ্ধতির সমন্ধ্যা সাধন ও প্রয়োগ করাকে বুঝায় অর্থাৎ যখন যে পদ্ধতির দরকার সেটির ব্যবহার বুঝায়। এ ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো পোকামাকড় সম্পূর্ণভাবে নয় বরং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকর পর্যায়ের নিচে রাখা হয়। এ ব্যবস্থাপনা শস্যভিত্তিক হয়ে থাকে। এর প্রধান উপাদান ৫টি। যথা- পর্যবেক্ষণ, জরিপ, দমননীতি দমন পদ্ধতি ও অজীবীয় উপাদান।