পাতা মোড়ানো পোকা

বাংলাদেশের কৃষির জন্য কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশল

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত এবং জাতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি খাত। তবে কৃষির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ফসলের কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই। প্রতিবছর অগণিত কৃষক এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জাতীয় উৎপাদনেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। কার্যকর কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ ছাড়া টেকসই কৃষি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের কৃষিতে কীটপতঙ্গ ও রোগের প্রকৃতি, ক্ষতির ধরণ, ব্যবস্থাপনার প্রচলিত ও আধুনিক কৌশল এবং টেকসই সমাধানের দিকগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

 

 

কীটপতঙ্গ রোগের প্রকৃতি প্রভাব

কীটপতঙ্গের আক্রমণ

বাংলাদেশে ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আলু, সবজি ও ফলমূলসহ প্রায় সব ধরনের ফসলেই কীটপতঙ্গের আক্রমণ দেখা যায়। ধানের ক্ষেত্রেই দানোপজীবী পোকা, গলমাছি, পাতা মোড়ানো পোকা, মাজরা পোকা, লেদাপোকা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। সবজিতে ফলছিদ্রকারী পোকা, পাতাখেকো পোকা, এফিড ও সাদা মাছি উৎপাদন ব্যাহত করে।

রোগবালাই

ফসলের রোগের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ সবচেয়ে বেশি। ধানে ব্লাস্ট, শীথ ব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্লাইট এবং গমে উষ্টা, পাতাঝরা, মরিচা রোগ দেখা যায়। টমেটোতে ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট, আলুতে লেট ব্লাইট, বেগুনে উইল্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব রোগ শুধু উৎপাদন কমায় না, মানও নষ্ট করে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি

কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে ফসলের কীটপতঙ্গ ও রোগবালাইয়ের কারণে প্রতিবছর গড়ে ২০-৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে যায়। কখনও কখনও তা ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে দাঁড়ায়, যা কৃষকের জীবনযাত্রা ও খাদ্যনিরাপত্তাকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে।

 

প্রচলিত কীটপতঙ্গ রোগব্যবস্থাপনা

রাসায়নিক কীটনাশক

বাংলাদেশের কৃষকরা সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল কীটনাশকের ওপর। দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য এটি কার্যকর হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। অতিরিক্ত ব্যবহারে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, পানিদূষণ হয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়।

জীবাণুনাশক জৈব পদার্থ

কিছু ক্ষেত্রে কৃষকরা ছত্রাকনাশক বা ব্যাকটেরিয়ানাশক ব্যবহার করে। পাশাপাশি সার, গোবর, ছাই, নিমপাতা, তিতকুটে গাছের নির্যাস ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে এর কার্যকারিতা রাসায়নিকের তুলনায় কিছুটা কম হলেও পরিবেশবান্ধব।

কৃষিকাজের কৌশল

ফসলের সময় পরিবর্তন, মাটি ভালোভাবে চাষ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার, ফসলের আবর্তন ইত্যাদি প্রচলিত কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

আধুনিক কীটপতঙ্গ রোগব্যবস্থাপনা

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (IPM)

বাংলাদেশ সরকার ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (Integrated Pest Management – IPM) কার্যক্রম চালু করেছে। এতে রাসায়নিকের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে জৈব পদ্ধতি, কৃষি কৌশল ও প্রাকৃতিক শত্রুপোকা ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন:

  • ক্ষেতের মধ্যে পাখির বসার বাঁশ স্থাপন করে ক্ষতিকর পোকার সংখ্যা কমানো।
  • আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে রাতের পোকা দমন।
  • ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করে ফলছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণ।
  • পরজীবী বোলতা ও শত্রুপোকার বিস্তার ঘটিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা।

রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে। যেমন, ব্লাস্ট প্রতিরোধী ধান জাত কিংবা লেট ব্লাইট প্রতিরোধী আলুর জাত।

জৈব প্রযুক্তি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং

আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস প্রতিরোধী ও রোগ সহনশীল ফসল উদ্ভাবনে গবেষণা চালাচ্ছেন। যেমন, বিটি-বেগুন বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই চাষ হচ্ছে, যা ফলছিদ্রকারী পোকার বিরুদ্ধে কার্যকর।

ডিজিটাল কৃষি তথ্যপ্রযুক্তি

কৃষকরা এখন স্মার্টফোন অ্যাপ, হেল্পলাইন, কৃষি তথ্যসেবা কেন্দ্র ও কৃষি টিভি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত বালাই শনাক্ত ও প্রতিকার জানতে পারছে। ড্রোন ও সেন্সরের মাধ্যমে ক্ষেত পর্যবেক্ষণও কিছু জায়গায় চালু হয়েছে।

 

টেকসই বালাই ব্যবস্থাপনা কৌশল

পরিবেশবান্ধব সমাধান

অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার বন্ধ করে জৈব কীটনাশক, নিম তেল, ফারমেন্টেড গাছের নির্যাস ইত্যাদি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

কৃষক প্রশিক্ষণ

প্রশিক্ষিত কৃষকই সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে। গ্রামভিত্তিক কৃষক স্কুল (Farmer Field School) চালু করে কৃষকদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন কীটপতঙ্গ ও রোগ দেখা দিচ্ছে। তাই গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত অভিযোজিত জাত উদ্ভাবনে কাজ করতে হবে।

সমন্বিত নীতি বাস্তবায়ন

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত নীতি গ্রহণ, কৃষকের কাছে সহজে জৈব ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ পৌঁছে দেওয়া, এবং কৃষি সম্প্রসারণ সেবার শক্তিশালীকরণ অপরিহার্য।

 

 

বাংলাদেশের কৃষিকে টেকসই ও লাভজনক করতে হলে কীটপতঙ্গ ও রোগব্যবস্থাপনা কৌশলকে আধুনিকীকরণ ও পরিবেশবান্ধব রূপে গড়ে তুলতে হবে। রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে IPM, জৈব প্রযুক্তি, প্রতিরোধী জাত, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষক প্রশিক্ষণকে অগ্রাধিকার দিলে কৃষকরা ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে পারবে। সঠিক সময়ে সঠিক কৌশল প্রয়োগ করলে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।