GOLN-Agro-Logo transparent_

বাংলাদেশের মাটির ধরন ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী, বন্যা, পলি ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার কারণে এখানে মাটির বৈচিত্র্য অনেক বেশি। দেশের কৃষি, অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনজীবন মূলত এই মাটির ওপর নির্ভরশীল। নিচে বাংলাদেশের মাটির ধরন, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার ও সমস্যাবলি নিয়ে একটি বিস্তারিত আলোচনা দেওয়া হলো।

 

ভূমিকা

বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ড প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৮০% এর বেশি অঞ্চল গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা নদী ও তাদের শাখা–প্রশাখা থেকে আসা পলি দ্বারা গঠিত। জলবায়ু, ভৌগোলিক অবস্থা ও বন্যা প্রক্রিয়া মাটির গঠন ও বৈচিত্র্য নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখে। ফলে বাংলাদেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর হলেও অঞ্চলভেদে গুণগত পার্থক্য দেখা যায়।

 

বাংলাদেশের মাটির প্রধান শ্রেণিবিন্যাস

বাংলাদেশের মাটি সাধারণত ৩টি বৃহৎ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়:

  1. অ্যালুভিয়াল মাটি (পলিমাটি)
    • নদী দ্বারা আনা পলি থেকে তৈরি।
    • বাংলাদেশের প্রায় ৮০% ভূমি এ ধরনের মাটিতে গঠিত।
    • রং ধূসর থেকে বাদামি।
    • উর্বরতা বেশি হওয়ায় ধান, গম, পাট, সবজি চাষে উপযোগী।
  2. লাল হলুদ মাটি
    • টেরেস ও পাহাড়ি অঞ্চলে পাওয়া যায়।
    • আয়রন অক্সাইডের উপস্থিতির কারণে মাটি লালচে।
    • উর্বরতা তুলনামূলক কম হলেও সঠিক সার ব্যবহারে উন্নত ফলন দেয়।
    • প্রধানত চট্টগ্রাম, সিলেট, মধুপুর গড়, দিনাজপুর টেরেসে দেখা যায়।
  3. পাহাড়ি বা পডজোলিক মাটি
    • পাহাড়ি বনভূমিতে পাওয়া যায়।
    • পুষ্টি উপাদান কম থাকলেও চা, আনারস, কমলা, আদা ও অন্যান্য বাগান ফসলের জন্য উপযোগী।
    • প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিস্তৃত।

 

অঞ্চলভিত্তিক মাটির ধরন

বাংলাদেশে ৩০টির বেশি স্বতন্ত্র মাটির অঞ্চল (Soil Tract) চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো:

  1. বঙ্গোপসাগরীয় পলি মাটি – দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীতে।
  2. ব্রহ্মপুত্রযমুনা বন্যাপ্রবাহ মাটি – টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিরাজগঞ্জে।
  3. পদ্মাগঙ্গা বন্যাপ্রবাহ মাটি – কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জে।
  4. মধুপুর গড়ের লাল মাটি – টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, গাজীপুরে।
  5. চট্টগ্রামসিলেট পাহাড়ি মাটি – পাহাড়ি ঢালে লালচে ও দোআঁশ মাটি।
  6. সুন্দরবন এলাকার লবণাক্ত মাটি – খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট অঞ্চলে।

 

মাটির রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য

  • pH মাত্রা: দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মাটি সাধারণত নিরপেক্ষ থেকে সামান্য ক্ষারীয় (pH ৬.৫–৭.৫)। পূর্বাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলে অম্লীয় মাটি (pH ৫–৬) বেশি দেখা যায়।
  • জৈব পদার্থ: বাংলাদেশের মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি বড় সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১.৫% এর কম।
  • পুষ্টি উপাদান:
    • নাইট্রোজেন ঘাটতি প্রবল।
    • ফসফরাস, পটাশ, জিঙ্ক ও সালফারের ঘাটতিও অনেক এলাকায় দেখা যায়।
    • বোরন ও মলিবডেনাম ঘাটতিজনিত সমস্যাও বাড়ছে।

 

বাংলাদেশের মাটির সমস্যা

  1. লবণাক্ততা: উপকূলীয় অঞ্চলে (প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি) লবণাক্ততা দিন দিন বাড়ছে।
  2. অম্লীয় মাটি: চট্টগ্রাম, সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলের অম্লীয় মাটিতে সঠিক শস্য উৎপাদন কঠিন।
  3. ক্ষয় (Erosion): পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টির কারণে প্রচণ্ড মাটি ক্ষয় হয়।
  4. জৈব পদার্থের ঘাটতি: অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে উর্বরতা কমে যাচ্ছে।
  5. পলি জমা নদী ভাঙন: বন্যার কারণে একদিকে উর্বর পলি জমে, অন্যদিকে নদীভাঙনে জমি হারিয়ে যায়।

 

কৃষিতে মাটির ব্যবহার

বাংলাদেশে বিভিন্ন মাটির বৈচিত্র্য ভিন্ন ফসল চাষে সহায়ক:

  • পলিমাটি: ধান, গম, ভুট্টা, পাট, ডাল, শাকসবজি।
  • লাল মাটি: ফল বাগান, আনারস, কলা, আলু।
  • অম্লীয় পাহাড়ি মাটি: চা, কফি, আনারস, কমলা, আদা।
  • লবণাক্ত মাটি: লবণসহিষ্ণু ধান, চিংড়ি চাষ।

 

মাটির সংরক্ষণ টেকসই ব্যবহার

  1. জৈব সার ব্যবহার: গোবর, কম্পোস্ট, সবুজ সার ব্যবহার করে জৈব পদার্থ বৃদ্ধি।
  2. ফসল আবর্তন: এক ফসলের পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন ফসল চাষ।
  3. লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ: খাল খনন, স্লুইসগেট ব্যবহার ও লবণসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন।
  4. অম্লীয় মাটির জন্য চুন প্রয়োগ।
  5. পাহাড়ি অঞ্চলে সোপান (Terrace) চাষ: মাটি ক্ষয় রোধে সহায়ক।

 

উপসংহার

বাংলাদেশের মাটি বৈচিত্র্যময় ও উর্বর হলেও জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত সার ব্যবহার, লবণাক্ততা ও ক্ষয়ের কারণে এর উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে হলে মাটির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, জৈব পদার্থ বৃদ্ধি, পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি ও সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটি কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার শক্ত ভিত হয়ে থাকতে পারবে।