ল্যান্ডস্কেপিং ঘাস শুধু দৃশ্যমান সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং ভূমি সংরক্ষণ, ধুলাবালি প্রতিরোধ ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন অনুযায়ী বেশ কিছু ঘাস বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রজাতিগুলোর বাংলা ও ইংরেজি নাম এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:
Table of Contents
বাংলাদেশে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ব্যবহৃত জনপ্রিয় ঘাসের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য
বিভিন্ন প্রকার ঘাসের বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার, মাটি, জলবায়ু ও পরিচর্যা নির্দেশিকা:
ক্র. | ঘাসের নাম | বৈজ্ঞানিক নাম | উৎপত্তি অঞ্চল | বৈশিষ্ট্য | ব্যবহার | বিশেষ গুণ | উপযোগী মাটি | প্রয়োজনীয় জলবায়ু | পরিচর্যা নির্দেশিকা |
১ | বারমুডা ঘাস (Bermuda Grass) | Cynodon dactylon | আফ্রিকা | দ্রুত বেড়ে ওঠে, ঘন ও মজবুত কাঠামোযুক্ত | পার্ক, ক্রীড়াক্ষেত্র, গলফ কোর্স, বাড়ির লন | খরা-প্রতিরোধী, সূর্যালোকপ্রিয়, দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতা | বেলে-দোআঁশ মাটি, ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা | উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া | নিয়মিত ঘাস কাটা, মাঝারি পানি, বছরে ২-৩ বার সার প্রয়োগ |
২ | বাফেলো ঘাস (Buffalo Grass) | Buchloe dactyloides | উত্তর আমেরিকা | কম উচ্চতা ও ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া, কম রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন | জলস্বল্পতাপূর্ণ অঞ্চল, পরিবেশবান্ধব ল্যান্ডস্কেপ, গ্রিন কভার | খরা সহ্যশক্তি অত্যন্ত বেশি, সার ও পানির প্রয়োজন কম | দোআঁশ ও বেলে মাটি, সামান্য ক্ষারযুক্ত মাটি | শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক জলবায়ু | বছরে ১-২ বার কাটা, কম পানি, কম সার প্রয়োগ |
৩ | জয়সিয়া ঘাস (Zoysia Grass) | Zoysia japonica | দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া | নরম, ঘন ও ধীরগতিতে বৃদ্ধি | সৌন্দর্যবর্ধক লন, বাগানপথ, রিসোর্ট চত্বর | খরা সহ্য করে, সূর্য ও ছায়া উভয় অবস্থায় মানিয়ে নেয় | দোআঁশ ও পলিমাটি, আংশিক ছায়াযুক্ত স্থান | উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় ও উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু | ধীর বৃদ্ধি হওয়ায় কম ঘন ঘন কাটা লাগে, মাঝারি পানি ও সার প্রয়োগ |
৪ | কার্পেট ঘাস (Carpet Grass) | Axonopus compressus | মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা | ঘন ও মাটির ওপর গালিচার মতো বিস্তার লাভ করে | রাস্তার পাশে, বড় খোলা জায়গা, জলাভূমি সংলগ্ন এলাকা | ছায়া ও আর্দ্রতা সহ্য করে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে | আর্দ্র দোআঁশ মাটি, সামান্য অম্লীয় মাটি | আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ু | আর্দ্রতা বজায় রাখা, বেশি কাটা দরকার নেই, মাঝে মাঝে সার প্রয়োগ |
৫ | সেন্ট অগাস্টিন ঘাস (St. Augustine Grass) | Stenotaphrum secundatum | ক্যারিবিয়ান ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল | পুরু ও বিস্তৃত পাতা, নরম কিন্তু দৃঢ় গঠন | উপকূলীয় অঞ্চল, আবাসিক ও বাণিজ্যিক লন | লবণাক্ততা ও আর্দ্রতা সহ্যশীল, ছায়ায় ভালো জন্মায় | আর্দ্র দোআঁশ বা বেলে মাটি | উপকূলীয় ও আর্দ্র উষ্ণ জলবায়ু | নিয়মিত পানি দেয়া, বছরে ৩-৪ বার সার প্রয়োগ, ঘন ঘন কাটা দরকার |
৬ | কিকুয়ু ঘাস (Kikuyu Grass) | Pennisetum clandestinum | পূর্ব আফ্রিকা (কেনিয়া) | খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক প্রকৃতি | বড় মাঠ, পার্ক, ভূমি ক্ষয় প্রতিরোধ | মাটি ধরে রাখে, উচ্চ ট্রাফিক সহ্য করে, স্বল্প পানিতেই টিকে থাকে | বেলে-দোআঁশ ও উর্বর মাটি | উষ্ণ ও শুষ্ক থেকে আর্দ্র সব ধরনের জলবায়ু | ঘন ঘন কাটা প্রয়োজন, আক্রমণাত্মক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি |
৭ | ফেসকিউ ঘাস (Fescue Grass) | Festuca arundinacea | ইউরোপ | ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত, কিছু জাত আংশিক ছায়া ও খারাপ মাটিতে জন্মায় | পাহাড়ি অঞ্চল, ছায়াযুক্ত লন, বাগান, ঢালু জায়গা | ঠান্ডা সহ্য করে, সারবিহীন বা অনুৎপাদনশীল মাটিতেও জন্মায় | দোআঁশ ও কাদামাটি | নাতিশীতোষ্ণ ও শীতল জলবায়ু | নিয়মিত পানি দেয়া, বছরে ২-৩ বার সার প্রয়োগ, ঘাস কাটা প্রয়োজন |
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও জলবায়ুগত অবস্থার কারণে এখানে বারমুডা ও কার্পেট ঘাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে নির্দিষ্ট আবহাওয়া, মাটির গুণমান এবং চাহিদার ভিত্তিতে অন্য ঘাসগুলিও ব্যবহৃত হচ্ছে।
ল্যান্ডস্কেপিং ডিজাইনার, কৃষিবিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা এই ঘাসগুলো ব্যবহারে জায়গার ধরন ও রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে নির্বাচন করে থাকেন। তবে আমরা কিছু সাধারণ পরামর্শ আপনাকে দিতে পারি। আপনি যদি নিজস্ব জায়গায় ঘাস লাগাতে চান, তাহলে মাটি ও আবহাওয়ার ধরন বিচার করে কৃষি/ল্যান্ডস্কেপ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়। নিচের পরামর্শগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিন:
ঘাসের জন্য আবহাওয়া ও মৌসুমি প্রভাব বিবেচনা
বাংলাদেশ একটি উষ্ণ ও আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশ, যেখানে:
- তাপমাত্রা: শীতকালে ১২–১৮°C এবং গ্রীষ্মে ৩০–৩৬°C।
- বর্ষাকাল: জুন–সেপ্টেম্বর (উচ্চ আর্দ্রতা, জলাবদ্ধতা ঝুঁকি)।
- শুষ্ক মৌসুম: নভেম্বর–মার্চ (কম বৃষ্টিপাত)।
➡ তাই এমন ঘাস নির্বাচন করতে হবে যা খরা সহ্যশীল, আর্দ্রতা সহনশীল এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতাসম্পন্ন।
ঘাসের জন্য মাটি প্রস্তুতি
- মাটি পরীক্ষা: pH ৬.০–৭.০ হলে ঘাস ভালো জন্মায়।
- প্রস্তুত প্রক্রিয়া:
- ১০–১৫ সেমি গভীরতা পর্যন্ত মাটি আলগা করুন।
- আগাছা ও পাথর সরান।
- ২–৩ সেমি জৈব সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে দিন।
- পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন যাতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা না হয়।
ঘাস রোপণ পদ্ধতি
- সিড (Seed): কম খরচে, তবে সময় বেশি লাগে (৩–৪ সপ্তাহ)।
- সড (Sod): তাৎক্ষণিক সবুজ লন, তবে খরচ বেশি।
- স্প্রিগ বা প্লাগ (Sprig/Plug): মাঝারি খরচ, ২–৩ মাসে পূর্ণ কাভারেজ।
➡ বাংলাদেশে বর্ষার আগমনের আগে (মে–জুন) বা শীতের শেষে (ফেব্রুয়ারি–মার্চ) রোপণ সবচেয়ে ভালো সময়।
ঘাস পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ
- সেচ:
- গ্রীষ্মে সপ্তাহে ২–৩ বার।
- শীতে সপ্তাহে ১–২ বার।
- ঘাস কাটা:
- বারমুডা: প্রতি ৭–১০ দিনে।
- জয়সিয়া/কার্পেট: প্রতি ১৫–২০ দিনে।
- সার প্রয়োগ:
- NPK (২০:১০:১০) সার বছরে ৩–৪ বার।
- জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণ বজায় থাকে।
- আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
- নিয়মিত হাতে তুলে ফেলা।
- প্রয়োজনে হার্বিসাইড ব্যবহার (শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে)।
- পোকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ:
- লন আর্মিওয়ার্ম, হোয়াইট গ্রাব ইত্যাদি দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
- ফাঙ্গাল রোগের ক্ষেত্রে ফাংগিসাইড ব্যবহার করতে হবে।
ঘাসের ডিজাইন ও নান্দনিকতা
- ফুটপাত ও হাঁটার পথ: ইট/পাথর/টাইলস দিয়ে তৈরি করে লনের ক্ষতি রোধ করুন।
- গাছের অবস্থান: বড় গাছের ছায়া ঘাসের বৃদ্ধি কমায়, তাই উপযুক্ত দূরত্ব রাখুন।
- ফুল ও ঝোপ: লনের পাশে বর্ডার হিসেবে ব্যবহার করলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
- আলোকসজ্জা: সোলার গার্ডেন লাইট রাতে ল্যান্ডস্কেপিংকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
বাজেট অনুযায়ী পরিকল্পনা
- কম বাজেট: সিড রোপণ + জৈব সার + হাতে পরিচর্যা।
- মধ্যম বাজেট: প্লাগ/স্প্রিগ রোপণ + মিশ্র সার + প্রাথমিক ডিজাইন।
- উচ্চ বাজেট: সড রোপণ + ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার + স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা।
বিশেষ টিপস (বাংলাদেশের জন্য)
- বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুব জরুরি।
- উপকূলীয় এলাকায় সেন্ট অগাস্টিন বা কার্পেট ঘাস বেশি টেকসই।
- ঢালু জায়গায় কিকুয়ু বা ফেসকিউ ঘাস মাটি ক্ষয় রোধ করে।
- পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাওয়া যায় এমন জায়গায় বারমুডা সর্বোত্তম।
বালু বা ভরাটকৃত জায়গা স্থিতিশীল করার জন্য উপযোগী ঘাসের তালিকা:
ঘাসের নাম | বৈজ্ঞানিক নাম | প্রধান বৈশিষ্ট্য | কেন উপযোগী | অতিরিক্ত সুবিধা | উপযুক্ত রোপণ সময় |
ভেটিভার ঘাস (Vetiver Grass) | Chrysopogon zizanioides | গভীর ও শক্তিশালী শিকড় (৩–৪ মিটার), লবণাক্ততা ও খরা সহ্যশীল | শিকড় গভীর যায়, মাটিকে আঁকড়ে ধরে ভাঙন রোধ করে | ঢালু জায়গা ও নদীর পাড় স্থিতিশীল করে, বন্যা সহ্য করে | বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে) বা বর্ষার প্রথম দিকে |
কিকুয়ু ঘাস (Kikuyu Grass) | Pennisetum clandestinum | দ্রুত বেড়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক বিস্তার | মাটিকে ঘনভাবে ঢেকে দেয়, ক্ষয় রোধ করে | কম পানিতেও টিকে থাকে, উচ্চ ট্রাফিক সহ্য করে | বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে) |
বারমুডা ঘাস (Bermuda Grass) | Cynodon dactylon | শক্ত ও ঘন শিকড় ব্যবস্থা, দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতা | ঢালু জায়গা ও ভরাট জমিতে মাটি বাঁধতে সক্ষম | খরা সহ্য করে, খেলাধুলার মাঠেও উপযোগী | ফেব্রুয়ারি–মে |
বাফেলো ঘাস (Buffalo Grass) | Buchloe dactyloides | ধীরে বেড়ে ওঠে কিন্তু ঘন মাটির আবরণ তৈরি করে | কম রক্ষণাবেক্ষণে বালু স্থিতিশীল রাখে | সার ও পানির প্রয়োজন কম | মার্চ–মে |
ন্যাপিয়ার ঘাস (Napier Grass) | Pennisetum purpureum | লম্বা ও ঘন কান্ড, বিস্তৃত শিকড় | বাঁধ ও পাড়ে শক্ত মাটি বাঁধতে সাহায্য করে | পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য | মার্চ–জুন |
আমাদের পরামর্শ
- যদি উদ্দেশ্য হয় দীর্ঘমেয়াদি ও সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা, তাহলে ভেটিভার ঘাস সবচেয়ে কার্যকর।
- দ্রুত সবুজায়ন চাইলে কিকুয়ু বা বারমুডা লাগাতে পারেন।
- উপকূলীয় বা লবণাক্ত এলাকায় সেন্ট অগাস্টিন ঘাসও ভালো কাজ করে।
- লাগানোর সময় বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে) বা বর্ষার প্রথম দিকে রোপণ করলে দ্রুত শিকড় গেঁড়ে বসে।
একেবারে কম যত্নে যেসব ঘাস বাঁচে:
একেবারে যত্ন ছাড়া বা খুব কম রক্ষণাবেক্ষণে যেসব ঘাস বাংলাদেশে ভালো জন্মে, সেগুলো মূলত খরা সহ্যশীল, কম সার-পানি প্রয়োজন হয়, এবং স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। যার মধ্যে রয়েছে —
-
বাফেলো ঘাস (Buchloe dactyloides) → খুব ধীরে বেড়ে ওঠে, তাই ঘন হয়ে গেলে আগাছা জায়গা পায় না, সার ও পানির প্রয়োজন খুব কম।
-
ভেটিভার ঘাস (Chrysopogon zizanioides) → লাগানোর পর নিজে থেকেই টিকে যায়, খরা ও অতিরিক্ত পানি দুই-ই সহ্য করতে পারে, এবং বছরে একবার কেটে দিলেই চলে।
এছাড়া বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে আরও কিছু লো-মেইনটেন্যান্স ঘাস আছে, যেমন —
-
কার্পেট ঘাস (Axonopus compressus) → আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত জায়গায় নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ যত্ন লাগে না।
-
জয়সিয়া ঘাস (Zoysia japonica) → ধীরে বাড়লেও একবার প্রতিষ্ঠিত হলে খুব কম পানি ও সারেই ভালো থাকে।
#ল্যান্ডস্কেপিং #বাংলাদেশেরঘাস #BermudaGrass #Zoysia #CarpetGrass #LandscapeDesignBD #GreenBangladesh #GrassVarietiesBD #SustainableLandscaping #EnvironmentalDesign