বাংলাদেশে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ব্যবহৃত জনপ্রিয় ঘাসের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য

ভেটিভার ঘাস

ল্যান্ডস্কেপিং ঘাস শুধু দৃশ্যমান সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং ভূমি সংরক্ষণ, ধুলাবালি প্রতিরোধ ও পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন অনুযায়ী বেশ কিছু ঘাস বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রজাতিগুলোর বাংলা ও ইংরেজি নাম এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিচে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশে ল্যান্ডস্কেপিংয়ে ব্যবহৃত জনপ্রিয় ঘাসের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য

 

ন্যাপিয়ার ঘাস

 

বিভিন্ন প্রকার ঘাসের বৈশিষ্ট্য, ব্যবহার, মাটি, জলবায়ু পরিচর্যা নির্দেশিকা:

ক্র. ঘাসের নাম বৈজ্ঞানিক নাম উৎপত্তি অঞ্চল বৈশিষ্ট্য ব্যবহার বিশেষ গুণ উপযোগী মাটি প্রয়োজনীয় জলবায়ু পরিচর্যা নির্দেশিকা
বারমুডা ঘাস (Bermuda Grass) Cynodon dactylon আফ্রিকা দ্রুত বেড়ে ওঠে, ঘন ও মজবুত কাঠামোযুক্ত পার্ক, ক্রীড়াক্ষেত্র, গলফ কোর্স, বাড়ির লন খরা-প্রতিরোধী, সূর্যালোকপ্রিয়, দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতা বেলে-দোআঁশ মাটি, ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা উষ্ণ ও রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া নিয়মিত ঘাস কাটা, মাঝারি পানি, বছরে ২-৩ বার সার প্রয়োগ
বাফেলো ঘাস (Buffalo Grass) Buchloe dactyloides উত্তর আমেরিকা কম উচ্চতা ও ধীরে বৃদ্ধি পাওয়া, কম রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন জলস্বল্পতাপূর্ণ অঞ্চল, পরিবেশবান্ধব ল্যান্ডস্কেপ, গ্রিন কভার খরা সহ্যশক্তি অত্যন্ত বেশি, সার ও পানির প্রয়োজন কম দোআঁশ ও বেলে মাটি, সামান্য ক্ষারযুক্ত মাটি শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক জলবায়ু বছরে ১-২ বার কাটা, কম পানি, কম সার প্রয়োগ
জয়সিয়া ঘাস (Zoysia Grass) Zoysia japonica দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নরম, ঘন ও ধীরগতিতে বৃদ্ধি সৌন্দর্যবর্ধক লন, বাগানপথ, রিসোর্ট চত্বর খরা সহ্য করে, সূর্য ও ছায়া উভয় অবস্থায় মানিয়ে নেয় দোআঁশ ও পলিমাটি, আংশিক ছায়াযুক্ত স্থান উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় ও উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু ধীর বৃদ্ধি হওয়ায় কম ঘন ঘন কাটা লাগে, মাঝারি পানি ও সার প্রয়োগ
কার্পেট ঘাস (Carpet Grass) Axonopus compressus মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা ঘন ও মাটির ওপর গালিচার মতো বিস্তার লাভ করে রাস্তার পাশে, বড় খোলা জায়গা, জলাভূমি সংলগ্ন এলাকা ছায়া ও আর্দ্রতা সহ্য করে, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আর্দ্র দোআঁশ মাটি, সামান্য অম্লীয় মাটি আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ু আর্দ্রতা বজায় রাখা, বেশি কাটা দরকার নেই, মাঝে মাঝে সার প্রয়োগ
সেন্ট অগাস্টিন ঘাস (St. Augustine Grass) Stenotaphrum secundatum ক্যারিবিয়ান ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পুরু ও বিস্তৃত পাতা, নরম কিন্তু দৃঢ় গঠন উপকূলীয় অঞ্চল, আবাসিক ও বাণিজ্যিক লন লবণাক্ততা ও আর্দ্রতা সহ্যশীল, ছায়ায় ভালো জন্মায় আর্দ্র দোআঁশ বা বেলে মাটি উপকূলীয় ও আর্দ্র উষ্ণ জলবায়ু নিয়মিত পানি দেয়া, বছরে ৩-৪ বার সার প্রয়োগ, ঘন ঘন কাটা দরকার
কিকুয়ু ঘাস (Kikuyu Grass) Pennisetum clandestinum পূর্ব আফ্রিকা (কেনিয়া) খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক প্রকৃতি বড় মাঠ, পার্ক, ভূমি ক্ষয় প্রতিরোধ মাটি ধরে রাখে, উচ্চ ট্রাফিক সহ্য করে, স্বল্প পানিতেই টিকে থাকে বেলে-দোআঁশ ও উর্বর মাটি উষ্ণ ও শুষ্ক থেকে আর্দ্র সব ধরনের জলবায়ু ঘন ঘন কাটা প্রয়োজন, আক্রমণাত্মক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি
ফেসকিউ ঘাস (Fescue Grass) Festuca arundinacea ইউরোপ ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত, কিছু জাত আংশিক ছায়া ও খারাপ মাটিতে জন্মায় পাহাড়ি অঞ্চল, ছায়াযুক্ত লন, বাগান, ঢালু জায়গা ঠান্ডা সহ্য করে, সারবিহীন বা অনুৎপাদনশীল মাটিতেও জন্মায় দোআঁশ ও কাদামাটি নাতিশীতোষ্ণ ও শীতল জলবায়ু নিয়মিত পানি দেয়া, বছরে ২-৩ বার সার প্রয়োগ, ঘাস কাটা প্রয়োজন

 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও জলবায়ুগত অবস্থার কারণে এখানে বারমুডা ও কার্পেট ঘাস সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে নির্দিষ্ট আবহাওয়া, মাটির গুণমান এবং চাহিদার ভিত্তিতে অন্য ঘাসগুলিও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বারমুডা ঘাস

ল্যান্ডস্কেপিং ডিজাইনার, কৃষিবিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা এই ঘাসগুলো ব্যবহারে জায়গার ধরন ও রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে নির্বাচন করে থাকেন। তবে আমরা কিছু সাধারণ পরামর্শ আপনাকে দিতে পারি। আপনি যদি নিজস্ব জায়গায় ঘাস লাগাতে চান, তাহলে মাটি ও আবহাওয়ার ধরন বিচার করে কৃষি/ল্যান্ডস্কেপ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়। নিচের পরামর্শগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিন:

ঘাসের জন্য আবহাওয়া মৌসুমি প্রভাব বিবেচনা

বাংলাদেশ একটি উষ্ণ আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশ, যেখানে:

  • তাপমাত্রা: শীতকালে ১২–১৮°C এবং গ্রীষ্মে ৩০–৩৬°C।
  • বর্ষাকাল: জুন–সেপ্টেম্বর (উচ্চ আর্দ্রতা, জলাবদ্ধতা ঝুঁকি)।
  • শুষ্ক মৌসুম: নভেম্বর–মার্চ (কম বৃষ্টিপাত)।
    ➡ তাই এমন ঘাস নির্বাচন করতে হবে যা খরা সহ্যশীল, আর্দ্রতা সহনশীল এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতাসম্পন্ন

 

বাফেলো ঘাস

 

ঘাসের জন্য মাটি প্রস্তুতি

  • মাটি পরীক্ষা: pH ৬.০–৭.০ হলে ঘাস ভালো জন্মায়।
  • প্রস্তুত প্রক্রিয়া:
    1. ১০–১৫ সেমি গভীরতা পর্যন্ত মাটি আলগা করুন।
    2. আগাছা ও পাথর সরান।
    3. ২–৩ সেমি জৈব সার বা কম্পোস্ট মিশিয়ে দিন।
    4. পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখুন যাতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা না হয়।

 

জয়সিয়া ঘাস

 

ঘাস রোপণ পদ্ধতি

  • সিড (Seed): কম খরচে, তবে সময় বেশি লাগে (৩–৪ সপ্তাহ)।
  • সড (Sod): তাৎক্ষণিক সবুজ লন, তবে খরচ বেশি।
  • স্প্রিগ বা প্লাগ (Sprig/Plug): মাঝারি খরচ, ২–৩ মাসে পূর্ণ কাভারেজ।
    ➡ বাংলাদেশে বর্ষার আগমনের আগে (মেজুন) বা শীতের শেষে (ফেব্রুয়ারিমার্চ) রোপণ সবচেয়ে ভালো সময়।

 

কার্পেট ঘাস

 

ঘাস পরিচর্যা রক্ষণাবেক্ষণ

  • সেচ:
    • গ্রীষ্মে সপ্তাহে ২–৩ বার।
    • শীতে সপ্তাহে ১–২ বার।
  • ঘাস কাটা:
    • বারমুডা: প্রতি ৭–১০ দিনে।
    • জয়সিয়া/কার্পেট: প্রতি ১৫–২০ দিনে।
  • সার প্রয়োগ:
    • NPK (২০:১০:১০) সার বছরে ৩–৪ বার।
    • জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণ বজায় থাকে।
  • আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
    • নিয়মিত হাতে তুলে ফেলা।
    • প্রয়োজনে হার্বিসাইড ব্যবহার (শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে)।
  • পোকা রোগ নিয়ন্ত্রণ:
    • লন আর্মিওয়ার্ম, হোয়াইট গ্রাব ইত্যাদি দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
    • ফাঙ্গাল রোগের ক্ষেত্রে ফাংগিসাইড ব্যবহার করতে হবে।

 

কিকুয়ু ঘাস

 

ঘাসের ডিজাইন নান্দনিকতা

  • ফুটপাত হাঁটার পথ: ইট/পাথর/টাইলস দিয়ে তৈরি করে লনের ক্ষতি রোধ করুন।
  • গাছের অবস্থান: বড় গাছের ছায়া ঘাসের বৃদ্ধি কমায়, তাই উপযুক্ত দূরত্ব রাখুন।
  • ফুল ঝোপ: লনের পাশে বর্ডার হিসেবে ব্যবহার করলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
  • আলোকসজ্জা: সোলার গার্ডেন লাইট রাতে ল্যান্ডস্কেপিংকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

 

ভেটিভার ঘাস

 

বাজেট অনুযায়ী পরিকল্পনা

  • কম বাজেট: সিড রোপণ + জৈব সার + হাতে পরিচর্যা।
  • মধ্যম বাজেট: প্লাগ/স্প্রিগ রোপণ + মিশ্র সার + প্রাথমিক ডিজাইন।
  • উচ্চ বাজেট: সড রোপণ + ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার + স্বয়ংক্রিয় সেচ ব্যবস্থা।

 

বিশেষ টিপস (বাংলাদেশের জন্য)

  • বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুব জরুরি।
  • উপকূলীয় এলাকায় সেন্ট অগাস্টিন বা কার্পেট ঘাস বেশি টেকসই।
  • ঢালু জায়গায় কিকুয়ু বা ফেসকিউ ঘাস মাটি ক্ষয় রোধ করে।
  • পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাওয়া যায় এমন জায়গায় বারমুডা সর্বোত্তম।

 

বালু বা ভরাটকৃত জায়গা স্থিতিশীল করার জন্য উপযোগী ঘাসের তালিকা:

ঘাসের নাম বৈজ্ঞানিক নাম প্রধান বৈশিষ্ট্য কেন উপযোগী অতিরিক্ত সুবিধা উপযুক্ত রোপণ সময়
ভেটিভার ঘাস (Vetiver Grass) Chrysopogon zizanioides গভীর ও শক্তিশালী শিকড় (৩–৪ মিটার), লবণাক্ততা ও খরা সহ্যশীল শিকড় গভীর যায়, মাটিকে আঁকড়ে ধরে ভাঙন রোধ করে ঢালু জায়গা ও নদীর পাড় স্থিতিশীল করে, বন্যা সহ্য করে বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে) বা বর্ষার প্রথম দিকে
কিকুয়ু ঘাস (Kikuyu Grass) Pennisetum clandestinum দ্রুত বেড়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক বিস্তার মাটিকে ঘনভাবে ঢেকে দেয়, ক্ষয় রোধ করে কম পানিতেও টিকে থাকে, উচ্চ ট্রাফিক সহ্য করে বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিল–মে)
বারমুডা ঘাস (Bermuda Grass) Cynodon dactylon শক্ত ও ঘন শিকড় ব্যবস্থা, দ্রুত পুনরুদ্ধার ক্ষমতা ঢালু জায়গা ও ভরাট জমিতে মাটি বাঁধতে সক্ষম খরা সহ্য করে, খেলাধুলার মাঠেও উপযোগী ফেব্রুয়ারি–মে
বাফেলো ঘাস (Buffalo Grass) Buchloe dactyloides ধীরে বেড়ে ওঠে কিন্তু ঘন মাটির আবরণ তৈরি করে কম রক্ষণাবেক্ষণে বালু স্থিতিশীল রাখে সার ও পানির প্রয়োজন কম মার্চ–মে
ন্যাপিয়ার ঘাস (Napier Grass) Pennisetum purpureum লম্বা ও ঘন কান্ড, বিস্তৃত শিকড় বাঁধ ও পাড়ে শক্ত মাটি বাঁধতে সাহায্য করে পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য মার্চ–জুন

 

আমাদের পরামর্শ

  • যদি উদ্দেশ্য হয় দীর্ঘমেয়াদি সর্বোচ্চ স্থিতিশীলতা, তাহলে ভেটিভার ঘাস সবচেয়ে কার্যকর।
  • দ্রুত সবুজায়ন চাইলে কিকুয়ু বা বারমুডা লাগাতে পারেন।
  • উপকূলীয় বা লবণাক্ত এলাকায় সেন্ট অগাস্টিন ঘাসও ভালো কাজ করে।
  • লাগানোর সময় বর্ষা শুরুর আগে (এপ্রিলমে) বা বর্ষার প্রথম দিকে রোপণ করলে দ্রুত শিকড় গেঁড়ে বসে।

 

ফেসকিউ ঘাস

 

একেবারে কম যত্নে যেসব ঘাস বাঁচে:

একেবারে যত্ন ছাড়া বা খুব কম রক্ষণাবেক্ষণে যেসব ঘাস বাংলাদেশে ভালো জন্মে, সেগুলো মূলত খরা সহ্যশীল, কম সার-পানি প্রয়োজন হয়, এবং স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। যার মধ্যে রয়েছে —

  • বাফেলো ঘাস (Buchloe dactyloides) → খুব ধীরে বেড়ে ওঠে, তাই ঘন হয়ে গেলে আগাছা জায়গা পায় না, সার ও পানির প্রয়োজন খুব কম।

  • ভেটিভার ঘাস (Chrysopogon zizanioides) → লাগানোর পর নিজে থেকেই টিকে যায়, খরা ও অতিরিক্ত পানি দুই-ই সহ্য করতে পারে, এবং বছরে একবার কেটে দিলেই চলে।

এছাড়া বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে আরও কিছু লো-মেইনটেন্যান্স ঘাস আছে, যেমন —

  • কার্পেট ঘাস (Axonopus compressus) → আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত জায়গায় নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ যত্ন লাগে না।

  • জয়সিয়া ঘাস (Zoysia japonica) → ধীরে বাড়লেও একবার প্রতিষ্ঠিত হলে খুব কম পানি ও সারেই ভালো থাকে।

#ল্যান্ডস্কেপিং #বাংলাদেশেরঘাস #BermudaGrass #Zoysia #CarpetGrass #LandscapeDesignBD #GreenBangladesh #GrassVarietiesBD #SustainableLandscaping #EnvironmentalDesign

By ফিচার ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের ফিচার ডেস্ক

Exit mobile version