বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.২ নং পাঠের অংশ। বীজের শ্রেণীকরণ বিভিন্নভাবে করা যায়। বীজের আকার-আকৃতি, ব্যবহার, শারীরবৃভীয় গুণাবলী ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বীজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। নিয়ে তা আলোচনা করা হলোঃ
Table of Contents
বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ
বীজের ধারণা:
উদ্ভিদের বংশবিস্তারের অন্যতম মাধ্যম হলো বীজ। উদ্ভিদ যৌন পদ্ধতিতে বীজের মাধ্যমে অথবা অযৌন পদ্ধতিতে কোন অঙ্গজ অংশের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত : উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবেচনায় নিষিক্ত পরিপক্ব ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন- ধান, গম, পেঁপে।
দ্বিতীয়ত : কৃষিতাত্বিক বিবেচনায় উদ্ভিদের শারীরিক বা জাননিক অঙ্গ উপযুক্ত পরিবেশে আপন জাতের নতুন উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে, তাকে কৃষি বীজ বলে। যেমন- আদা ও হলুদের কন্দ, মিষ্টি আলুর লতা, পাথরকুচির পাতা, ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি।
ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য:
ভালো বীজ হলো এমন বীজ যা স্বাস্থ্যসম্মত, উৎপাদনশীল এবং শস্যের ভালো ফলন নিশ্চিত করতে সক্ষম। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১। বীজ পরিষ্কার থাকবে; এতে ধুলো, বালি, ময়লা, আগাছা বা অন্য ফসলের বীজ মিশ্রিত থাকবে না।
২। বীজ পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুপরিপক্ক হবে, যাতে চারা শক্তিশালী হয়।
৩। বীজের রং উজ্জ্বল এবং জাতের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বহন করবে।
৪। বীজ পোকামাকড় ও কীটের আক্রমণমুক্ত থাকবে।
৫। বীজ রোগমুক্ত হবে, যাতে উদ্ভিদ সুস্থভাবে বৃদ্ধি পায়।
৬। বীজ কৌলিকভাবে বিশুদ্ধ (Genetic purity) হবে; এক জাতের বীজে অন্য জাতের সংমিশ্রণ থাকবে না।
৭। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৮০% বা তার বেশি হবে।
৮। বীজের আর্দ্রতা ৪–১২% এর মধ্যে থাকবে।
৯। বীজে সমরূপিতা থাকবে; আকার, আকৃতি ও রঙ প্রায় একই রকম হবে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করলে বীজ থেকে শক্তিশালী চারা উৎপন্ন হয় এবং ফসলের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বীজের শ্রেণীবিভাগ:
বিভিন্নভাবে বীজের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
বীজপত্রের সংখ্যা অনুসারে:
১ একবীজপত্রী বীজ (Monocotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে কেবল একটিমাত্র বীজপত্র থাকে, তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলে। উদাহরণ: পাট, হোগা, ধান, গম, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি।
২ দ্বিবীজপত্রী বীজ (Dicotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে দুটি বীজপত্র থাকে। উদাহরণ: ছোলা, সয়াবিন, আম, কাঠাল ইত্যাদি।
৩ বহুবীজপত্রী বীজ (Poly-cotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে দুইয়ের বেশি বীজপত্র থাকে। উদাহরণ: পাইন বীজ।
ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে:
১. একজনী বীজ (Monoembryonic seed): যে সমস্ত বীজে একটিমাত্র ভ্রূণ থাকে, তাদেরকে একজনী বীজ বলে। উদাহরণ: ধান, পাট, গম।
২. বহুজনী বীজ (Polyembryonic seed): যে সমস্ত বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রতিটি ভ্রূণ পৃথক উদ্ভিদ উৎপন্ন করতে সক্ষম, তাদেরকে বহুজনী বীজ বলা হয়। উদাহরণ: আম, লেবু ইত্যাদি।
নিষিকতা অনুসারে:
১. নিষিক্ত বীজ (Fertilized seed): যে বীজ ডিম্বক ও পরাগরেণুর মাধ্যমে নিষিক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়। উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি।
২. অনিষিক্ত বীজ (Unfertilized seed): যে বীজ ডিম্বক নিষিক্ত না হয়েই উৎপন্ন হয়। এ ধরনের বীজকে এপোমিকটিক বীজ (Apomictic seed) বলা হয়। উদাহরণ: লেবু, জাম্বুরা, কমলা ইত্যাদি।
শস্যের Endosperm উপস্থিতি অনুসারে:
১. সস্যল বীজ (Endospermic seed): যে বীজের ভ্রূণের বাইরের অংশে খাদ্য হিসেবে সস্য (Endosperm) থাকে। উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা।
২. অসস্যল বীজ (Non-endospermic seed): যে বীজে ভ্রূণের বাইরের অংশে খাদ্য সঞ্চিত থাকে না। উদাহরণ: ছোলা, কুমড়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী:
বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুসারে বীজকে উৎপাদন ও বংশগত বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণির উদ্দেশ্য হলো বীজ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষকদের কাছে উচ্চমানের বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। শ্রেণীবিভাগগুলো নিম্নরূপ:
(ক) মৌল প্রজননবিদ বীজ (Breeder seed):
১. অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো মৌল বীজ উৎপাদন।
২. উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠানে বা প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত বীজকে মৌল বীজ বলা হয়।
৩. মৌল বীজে সর্বাধিক বংশগত বিশুদ্ধতা (Genetic purity) বজায় থাকে এবং এটি ভবিষ্যতের সমস্ত বীজ উৎপাদনের মূল উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(খ) ভিত্তি বীজ (Foundation seed)
১. মৌল বীজ থেকে বিস্তার ঘটানোর জন্য ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়।
২. এটি বীজ অনুমোদনকারী সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মনীতি অনুসরণ করে প্রজননবিদের তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত হয়।
৩. ভিত্তি বীজে জাতের স্বাতন্ত্র্য ও কৌলিক বিশুদ্ধতা বজায় থাকে।
(গ) নিবন্ধিত বীজ ( Registered seed)
১. ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে নিবন্ধিত বীজ বলা হয়।
২. এটি সাধারণত বীজ বর্ধন খামার বা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ব্যক্তিগত খামারে উৎপাদিত হয়।
৩. নিবন্ধিত বীজে ভিত্তি বীজের সমস্ত কৌলিক গুণাবলী ও বিশুদ্ধতা বজায় থাকে।
(ঘ) প্রত্যায়িত বীজ (Certified seed)
১. ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে প্রত্যায়িত বীজ বলা হয়।
২. চুক্তিভিত্তিক চাষীর মাধ্যমে বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি অনুসরণ করে জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা হয়।
৩. উৎপাদিত বীজ পরে বীজ প্রত্যায়ন সংস্থা (Seed Certification Agency) পরীক্ষা ও অনুমোদন করার পর বাজারে সরবরাহ করা হয়।
উদ্ভিদের বংশবিস্তারে মৌলিক উপকরণ হলো বীজ। উচ্চমানের ফসল উৎপাদনের জন্য অবশ্যই ভালো এবং মানসম্মত বীজ ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যা বীজ উৎপাদন, বংশগত বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ এবং কৃষকদের জন্য মানসম্মত বীজ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুসারে শ্রেণীবিন্যাস:
বাংলাদেশে বা সাধারণ উদ্ভিদবিজ্ঞান অনুযায়ী বীজকে ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুসারে প্রধানত দুইটি ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়।
১। প্রকৃত বীজ (True Seed):
১.১ নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিম্বক থেকে উৎপন্ন বীজকে উদ্ভিদতাত্তিক বা প্রকৃত বীজ বলা হয়।
১.২ প্রকৃত বীজ সাধারণত দানাদার, তৈলবীজ বা ডালবীজ আকারে হয়।
১.৩ উদাহরণ:
- দানাদার বীজ: ধান, গম, ভুট্টা প্রভৃতি
- তৈলবীজ: সরিষা, সয়াবীন, তিল প্রভৃতি
- ডালবীজ: মসুর, ছেসারী, মুগ প্রভৃতি
২। কৃষি বীজ (Vegetative/Propagative Seed):
২.১ উদ্ভিদের যে কোনও অংশ যা উপযুক্ত পরিবেশে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নতুন উদ্ভিদ জন্ম দিতে সক্ষম, তাকে কৃষি বীজ বলা হয়।
২.২ কৃষি বীজ সাধারণত কাণ্ড, শিকড় বা পাতা থেকে উৎপন্ন হয়।
২.৩ উদাহরণ:
- কাণ্ড: আখ, আলু প্রভৃতি
- শিকড়: মিষ্টি আলু, কাকরোল, পটল প্রভৃতি
- পাতা: পাথরকুচি প্রভৃতি
- প্রকৃত বীজের উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়: ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি কুষিত বীজ
প্রকৃত বীজ এবং কৃষি বীজের পার্থক্য মূলত উৎপাদনের উৎস ও প্রজনন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। উচ্চফলন ও মানসম্মত ফসলের জন্য সঠিক ধরনের বীজ ব্যবহার অপরিহার্য।
বীজের আবরণের উপর ভিত্তি করে:
বীজকে আবরণের উপস্থিতি অনুযায়ী প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১। নগ্নবীজ (Naked Seed):
১.১ যে সকল বীজে কোন প্রাকৃতিক আবরণ বা স্তর থাকে না, তাকে নগ্নবীজ বলা হয়।
১.২ এই ধরনের বীজ সাধারণত সরাসরি জমিতে রোপণযোগ্য এবং খাদ্যশস্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১.৩ উদাহরণ:
- গম
- ভুট্টা প্রভৃতি
২। আবরিত বীজ (Covered Seed):
২.১ যে সকল বীজে প্রাকৃতিক আবরণ বা বীজপাতলা থাকে, তাকে আবরিত বীজ বলা হয়।
২.২ এই বীজ সাধারণত অতিরিক্ত সুরক্ষা পায় এবং খাদ্য, তৈলশস্য বা ডালবীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২.৩ উদাহরণ:
- ধান
- ডালবীজ
- তৈলবীজ ইত্যাদি
বীজের আবরণ তার সংরক্ষণ ক্ষমতা, অঙ্কুরোদগমের গতি এবং প্রজননশীলতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। সঠিক বীজ নির্বাচন ফসলের ফলন ও মানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বীজ পত্রের সংখ্যা অনুযায়ী:
১। একবীজপত্রী বীজ (Monocot Seed):
১.১ যে সকল বীজে কেবল একটি বীজপত্র থাকে, তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলা হয়।
১.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, নারিকেল, তাল ইত্যাদি।
২। দ্বিবীজপত্রী বীজ (Dicot Seed):
২.১ যে সকল বীজে দুটি বীজপত্র থাকে, তাদেরকে দ্বিবীজপত্রী বীজ বলা হয়।
২.২ উদাহরণ: পাট, ছোলা, সয়াবীন, আম, কাঠাল ইত্যাদি।
৩। বহুবীজপত্রী বীজ (Polyploid Seed):
৩.১ যে সকল বীজে দুটি বা ততোধিক বীজপত্র থাকে, তাদেরকে বহুবীজপত্রী বীজ বলা হয়।
৩.২ উদাহরণ: পাইন বীজ।
বীজপত্রের সংখ্যা অনুযায়ী বীজকে শ্রেণীবদ্ধ করলে উদ্ভিদের প্রজনন প্রক্রিয়া ও গঠন বোঝা সহজ হয়। একবীজপত্রী, দ্বিবীজপত্রী ও বহুবীজপত্রী বীজের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য স্পষ্ট থাকে।
বীজে ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে:
১। একজণী বীজ (Monoembryonic seed):
১.১ যে সকল বীজে কেবল একটি মাত্র ভ্রূণ থাকে, তাদেরকে একজণী বীজ বলা হয়।
১.২ উদাহরণ: পাট, ধান, গম।
২। বহুভ্রূণী বীজ (Polyembryonic seed):
২.১ যে সকল বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রত্যেকটি ভ্রূণ একটি স্বতন্ত্র উদ্ভিদের জন্ম দিতে সক্ষম, তাদেরকে বহুভ্রূণী বীজ বলা হয়।
২.২ উদাহরণ: আম, লেবু ইত্যাদি।
৩। সস্যল বীজ (Endospermic seed):
৩.১ যে সকল বীজে বীজপত্রের বাইরে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য খাদ্য হিসেবে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম সঞ্চিত থাকে, তাদেরকে সস্যল বীজ বলা হয়।
৩.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি।
৪। অসস্যল বীজ (Non-endospermic seed):
৪.১ যে সকল বীজে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সস্য হিসেবে জমা না থেকে বীজপত্রের মধ্যে সঞ্চিত থাকে, তাদেরকে অসস্যল বীজ বলা হয়।
৪.২ উদাহরণ: কুমড়া, ছোলা ইত্যাদি।
ভ্রূণের সংখ্যা এবং সস্যের উপস্থিতি অনুযায়ী বীজকে শ্রেণীবিন্যাস করলে উদ্ভিদের প্রজনন ও বীজের পুষ্টি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বোঝা সহজ হয়।
নিষিক্ততা (Fertilization) অনুসারে:
১। নিষিক্ত বীজ (Fertilized seed):
১.১ যে সকল বীজ ডিম্বক পরাগরেণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়, তাদেরকে নিষিক্ত বীজ বলা হয়।
১.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি।
২। অনিষিক্ত বীজ (Unfertilized seed):
২.১ যে সকল বীজ পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত না হয়ে উৎপন্ন হয়, তাদেরকে অনিষিক্ত বীজ বলা হয়।
২.২ এই ক্ষেত্রে ডিম্বকের দেহকোষ (Vegetative cell) থেকে ভ্রূণ উৎপন্ন হয়। এই ধরনের বীজকে এপোমিকটিক (Apomictic seed) বীজ বলা হয় এবং বীজ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটিকে এপোমিক্সিস (Apomixis) বলা হয়।
২.৩ এপোমিকটিক বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ফলে মাতৃগুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে, যা অঙ্গজ বংশবৃদ্ধি (Clonal propagation) হিসেবে পরিচিত।
২.৪ উদাহরণ: লেবু, জাম্বুরা, কমলা ইত্যাদি সাইট্রাস ফল।
নিষিক্ততা অনুযায়ী বীজ শ্রেণীবিন্যাস করলে বীজ উৎপাদন ও প্রজনন প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য এবং বংশগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝা যায়।
বিভিন্ন অঙ্গজ বীজের পরিচিতি:
রাইজোম (Rhizome) :
রাইজোম ভূ-নিম্নস্থ রূপান্তরিত কান্ড। আদা, হলুদ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য রাইজোম ব্যবহৃত হয়।
স্ফীত কন্দ (Tuber) :
স্ফীত কন্দ ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড। নিম্ন কান্ডের শীর্ষে খাদ্য সঞ্চিত হয়ে তা স্ফীত হয়ে কন্দের রূপ ধারণ করে। এতে চোখ (Eye বা bud), শল্কপত্র (Scale leaves) বর্তমান থাকে। গোল আলুর বংশ বিস্তার টিউবারের সাহায্যে করা হয়ে থাকে।
টিউবারকল (Tubercol বা Bulbil) :
এ জাতীয় উদ্ভিদে পাতার কক্ষীয় কুঁড়ি রূপান্তরিত হয়ে স্ফীত ও গোলাকার ধারণ করে। এদের টিউবারকল বা বুলবিল বলে। যেমনঃ মেটে আলুর বুলবিল।
শঙ্ক কন্দ (Bulb) ঃ
এটা ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং স্কেল (Scale) সমন্বয়ে গঠিত। পিয়াজের অংঙ্গজ বংশ বিস্তার শঙ্ক কন্দের দ্বারা করা হয়। অনেক সময় শঙ্কের কক্ষীয় কুঁড়িও আবার ক্ষুদ্রাকার কন্দে পরিণত হয়। এগুলো কোয়া (Bulblet) নামে পরিচিত। যেমনঃ রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি।
গুঁড়িকন্দ (Corm) :
কান্ডের নিচের অংশ স্ফীত ও গোলাকার হলে একে গুঁড়িকন্দ বলে। এতে সন্ধি (Node) ও পর্বসন্ধি (Inter node) বিদ্যমান থাকে। গুঁড়িকন্দের উপরিভাগ শল্কপত্র দ্বারা আবৃত থাকে। আবার গুঁড়িকন্দের নিচের দিকে কতিপয় কুড়ি ক্ষুদ্রাকার গুঁড়িকন্দে পরিণত হয়। এগুলো মুখি নামে পরিচিত। কচুর বংশ বিস্তার গুঁড়িকন্দ দ্বারা করা হয়।
কন্দালমূল (Tuberous root) :
যখন কোন মূল খাদ্যদ্রব্য সঞ্চিত করে স্ফীত হয়ে উঠে তখন তাকে কন্দালমূল বলে। মিষ্টি আলু ও বিভিন্ন জাতের আলুর বংশ বিস্তারে কন্দালমূল ব্যবহৃত হয়।
শোষক (Sucker) :
মাতৃগাছের গোড়া থেকে নতুন চারা বের হয় এবং বৃদ্ধির প্রথম পর্যায় মাতৃগাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে যেমন: কলা, আনারস, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি।
শিকড় (Root cutting) :
অনেক গাছের মূল নতুন চারা গাছের জন্ম দেয় এবং পরে তা কেটে পৃথক করে রোপণ করলে স্বতন্ত্র উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। বেল ও পেয়ারা ফলের এরূপ শিকড় ব্যবহার করা হয়।
পাতা ঃ
পাতা থেকেও চারা উৎপন্ন করা যায়। যেমন : পাথরকুচি। অনেক সময় চায়ের পাতা থেকে চারা উৎপন্ন করা হয়।
শাখা কলম (Stem cutting) :
বিভিন্ন প্রকার ফসল, ফল ও ফুল গাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য শাখা কলম ব্যবহৃত হয়। যেমন : আম, মিষ্টি আলু, আংগুর, গোলাপ, গন্ধরাজ, ইত্যাদি। যথাঃ কর্তন বা ছেদ কলম : এক্ষেত্রে সরাসরি কচি ডাল কেটে মাটিতে লাগিয়ে চারা তৈরি করা হয়। যেমন : সজিনা, শিমুল, এলামন্ডা ইত্যাদি।
প্রধানত পাঁচভাবে কলমের চারা তৈরি করা হয়।
দাবা কলম ঃ
এক্ষেত্রে গাছের শাখার খানিক মাটিতে চাপা দিয়ে তাতে মূল গাজিয়ে মাতৃগাছ থেকে আলাদা করা হয়। যেমন : লেবু।
গুটি কলম ঃ
নির্বাচিত গাছের ডালের ৫ সে.মি. পরিমাণ অংশের ছাল তুলে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে গুটি তৈরি করে চট দিয়ে আটকে দিতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত লিচু, ডালিম, লেবুতে, এ ধরণের কলম করে চারা তৈরি করা হয়।
জোড় কলম ঃ
এক্ষেত্রে একই জাতের দুটি গাছের কান্ডকে পরিমিত চেছে একত্রে বেঁধে দিলে ২-৩ মাসের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। অতঃপর কাঙ্খিত গাছের মধ্যে অন্যটির নিচের অংশ কেটে আলাদা করে কলমের চারা পাওয়া যায়। আমের ক্ষেত্রে জোড় কলম উত্তম।
চোখ কলম :
পাতা বা ডালের সংযোগ স্থানের কুঁড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে অন্য উদ্ভিদে স্থানান্তরিত করাকে চোখ কলম বলে। গোলাপ, লেবু, কুল প্রভৃতি উদ্ভিদে এ কলম ব্যবহৃত হয়। কুলের ক্ষেত্রে টক কুল গাছকে চোখ কলমের সাহায্যে মিষ্টি কুলে রূপান্তরিত করা যায়।
আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতির শ্রেণিবিন্যাস:
এতক্ষণ আপনি প্রকৃত বীজের শ্রেণিবিন্যাস এবং কৃষি বীজের বিভিন্ন অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যম সম্পর্কে ধারণা পেলেন। এখন আমরা আলোচনা করবো আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতি (International Crop Improvement Association, ICIA) বীজকে কীভাবে শ্রেণিবিন্যাস করছেন। উক্ত সমিতি বিভিন্ন বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা, উৎপাদন ও বিতরণের প্রকৃতির ভিত্তিতে বীজকে প্রধানতঃ ৪টি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন (ক-ঘ)। কিন্তু বাংলাদেশ বীজ বিধি ১৯৮০ এর ১৮ ধারা মোতাবেক বীজকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে (ক, খ, ঘ)।
বাংলাদেশ বীজ বিধিতে নিবন্ধিত ও প্রত্যায়িত বীজকে একই ধরণের বিবেচনা করে নিবন্ধিত বীজকে বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ এ দুই শ্রেণির বীজই ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত হয়।
প্রজননবীদের বীজ (Breeder seed) :
উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠান বা কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কোন প্রজননবিদের ঘনিষ্ঠ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপন্ন বীজ, যা থেকে ভিত্তি বীজ (Foundation seed) উৎপন্ন করা হয় তাকে প্রজনন বীজ বলে। এ বীজের মধ্যে সর্বাধিক কৌলিক বিশুদ্ধতা (Genetic purity) থাকে। অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো প্রজনন বীজ। প্রজনন বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়।
ভিত্তি বীজ :
বীজের পরবর্তী বিস্তার ঘটানোর জন্য কৌলিকভাবে শনাক্তকরণযোগ্য জাতের প্রথমিক উৎসকে ভিত্তি বীজ বলে। ভিত্তি বীজে কৌলিক স্বাতন্ত্র্য (Genetic identity) ও জাতের বিশুদ্ধতা (Varietal purity) বিদ্যমান থাকে। ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। অনুমোদনকারী সংস্হা কর্তৃক অনুমোদিত বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি পালন করে ও সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক কমিটির তত্ত্বাবধানে এ বীজ উৎপাদন করা হয়।
নিবন্ধিত বীজ ঃ
অনুমোদিত সরকারী উৎসের ভিত্তি বীজ থেকে নিবন্ধিত উৎপাদনকারী যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করে যে বীজ উৎপন্ন করে তাকে নিবন্ধিত বীজ বলে। ভিত্তি বীজের সকল কৌলিক গুণাবলী ও বিশুদ্ধতা নিবন্ধিত বীজে বিদ্যমান রাখা হয়।
প্রত্যায়িত বীজ :
ভিত্তি বীজ হতে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয় যাতে বংশগত ও বাহ্যিক বিশুদ্ধতা নির্ধারিত মানের থাকে। প্রয়োজনবোধে প্রত্যায়িত বীজ হতেও সর্বাধিক তিন ধাপ পর্যন্ত প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা যেতে পারে।বীজের গুণাবলী সংরক্ষণের জন্য প্রত্যয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্হা। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী নামে একটি সরকারী সংস্হা এই অনুমোদনের কাজটি করে থাকে।
বীজের অপরিহার্য অংগসমূহ :
একটি বীজের প্রধানতঃ দুইটি অংশ থাকে। যথাঃ
(১) বীজত্বক :
বীজের আবরণকে বীজত্বক বলে। ডিম্বকের ত্বক বীজত্বকে পরিণত হয়। বীজত্বক আবার দুইটি আবরণ দ্বারা গঠিত। বাহিরের অপেক্ষাকৃত পুরু ও শক্ত স্তরটিকে বলে বহিঃত্বক বা টেস্টা (Testa)। ভিতরের পাতলা স্বচ্ছ আবরণকে বলে অন্তঃত্বক বা টেগমেন (Tegmen)। বীজত্বক দুইটি সংযুক্ত থাকতে পারে অথবা একটি হতে অন্যটি পৃথক থাকতে পারে। বীজ যে অংশ দ্বারা ফলের সংগে যুক্ত থাকে সেই সংযোগস্থলকে বলে হাইলাম (Hilum) বীজনাভি বা ডিম্বকনাভি। বীজ ফিউনিকুলাস (Funiculus) নামক বোটার সংগে হাইলামের সংগে যুক্ত থাকে। হাইলামের সন্নিকটে বীজত্বকে একটি ছিদ্র থাকে যাকে মাইক্রোপাইল (Micropyle) বা বীজরন্ধ্র বলে। কোন কোন বীজের ত্বকে লম্বালম্বি যে প্রবর্ধন দেখা যায় তাকে র্যাফি ( Raphe) বলে। রাফির সাহায্যে বীজ বোঁটার সংগে লেগে থাকে।
(২) অস্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার :
বীজত্বক অপসারণের পর বীজের অবশিষ্ট অংশকে বলে অন্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার। কার্নেল শুধু ভ্রূণ দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ছোলা বীজ) অথবা ভ্রূণ ও সস্য (Endosperm) দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ধান বীজ)।
অন্তবীজ বা কার্নেল এর বিভিন্ন অংশ:
ভ্রূণ (Embryo) :
বীজত্বক দ্বারা আবৃত সুপ্ত উদ্ভিদকে ভ্রূণ বলে। কার্নেলের মূল অংশ ভ্রূণ। ভ্রূণের দুইটি অংশ যথাঃ ভ্রূণাক্ষ বা টাইজেলাম (Tigellum) ও বীজপত্র (Cotyledon)। ভ্রূণাক্ষের আবার দুইটি অংশ যেমন: ভ্রূণমূল (Radicle) যা থেকে বীজ গজানোর পর শিকড় হয় এবং ভ্রূণকান্ড ভ্রূণমুকুল (Plumule) যা থেকে কান্ড উৎপন্ন হয়।
ভ্রূণাক্ষ :
যে অক্ষের সংগে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণাক্ষ বলে। ভ্রূণাঙ্কের যে স্হানে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণপর্ব (Nodal zone) বলে। ভ্রূণাক্ষের উপরের অংশ ভ্রূণমুকুল এবং নিচের অংশ ভ্রূণমূল। ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের উপরে অবস্থিত তাকে এপিকোটাইল (Epicotyle) বা বীজ পত্রাধিকান্ড বলে। অপরপক্ষে ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের নিচে অবস্থিত তাকে বলে হাইপোকোটাইল (Hypocotyle) বা বীজপত্রাবকান্ড। একবীজপত্রী উদ্ভিদে ভ্রূণমুকুল ও ভ্রূণমূল যে আবরণীসমূহ দ্বারা আবৃত থাকে তাদেরকে যথাক্রমে কলিওপটাইল (Coleoptyle) এবং কলিওরাইজা (Coleorrhiza ) বলে।
বীজপত্র (Cotyledon) :
দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে দুইটি বীজপত্র এবং একবীজপত্রী উদ্ভিদে একটি বীজপত্র থাকে। বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকলে তা পুরু ও রসাল হয়। যেমন : ছোলা বীজ। যে বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকে না তা পাতলা ও স্বচ্ছ হয় (যেমন : রেডি)। নিম্নে চিত্রে বীজের বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে।
বীজপত্রের কাজ :
- বীজপত্র নরম ও কোমল ভ্রূণমুকুলকে রক্ষা করে।
- বীজপত্র ভ্রূণের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে।
- বীজপত্র ভ্রূণাক্ষকে খাদ্য সরবরাহ করে।
সস্য (Endosperm) :
কোন কোন কার্নেলে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম পাওয়া যায়। বীজের এন্ডোস্পার্মে শিশু উদ্ভিদের খাদ্য সঞ্চিত থাকে। সকল বীজে সস্য থাকে না। সস্য যুক্ত বীজকে বলে সসাল (Albuminous) বীজ। যে বীজে সস্য থাকে না তাকে বলে অসস্যল বীজ (Exalbuminous)।
পেরিস্পার্ম (Perisperm) :
ডিম্বকের নিউসেলাসের অবশিষ্টাংশকে পেরিস্পার্ম বলে। ইহা বর্ধিষ্ণু ভ্রূণে খাদ্য সরবরাহ করে। সকল বীজে পেরিস্পার্ম থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক বীজে পেরিস্পার্ম থাকে। যেমন : শাপলা।
উদ্ভিদের বংশবিস্তার ও কৃষি উৎপাদনের জন্য বীজ অপরিহার্য উপাদান। বীজের গুণমান, শ্রেণীবিন্যাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে কৃষি চাষে ভালো ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব। বীজের শ্রেণীবিভাগ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে করা যায়—পত্র সংখ্যা, ভ্রূণের সংখ্যা, নিষিক্ততা, এন্ডোস্পার্ম উপস্থিতি, ব্যবহার, আবরণ ইত্যাদি। বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ, নিবন্ধিত বীজ ও প্রত্যায়িত বীজ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
বীজের প্রধান অঙ্গসমূহ হলো বীজত্বক এবং অন্তবীজ বা কার্নেল, যার মধ্যে ভ্রূণ, ভ্রূণাক্ষ, বীজপত্র, সস্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পেরিস্পার্ম থাকে। এই অঙ্গসমূহের কার্যক্রম ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং চাষের জন্য শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যসম্মত চারা উৎপাদন সম্ভব হয়।
সার্বিকভাবে, বীজ ও এর অঙ্গসমূহের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কৃষক ও বীজপ্রজনকদের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি কৃষি উৎপাদনকে সফল এবং টেকসই করার মূল ভিত্তি স্থাপন করে।