ভেড়া পালন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় ভেড়া পালন – যা কৃষিজ উৎপাদন: গৃহপালিত পশুপাখি পালন পদ্ধতি এর অন্তর্ভুক্ত।

ভেড়া পালন

 

 

বাংলাদেশের ভেড়া

ভেড়ার অত্যন্ত গুণী প্রাণী। কিন্তু এত গুণাগুণ থাকা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশে এরা বেশ অবহেলিত ও তেমন একটা জনপ্রিয় নয়। সংখ্যাও খুব অল্প। এদেশের ভেড়ার কোনো ভালো জাত নেই। ভেড়া শুষ্ক ও শীতল আবহাওয়ার প্রাণী । এদেশের ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া এদের জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশে নোয়াখালী ও বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলেই বেশি সংখ্যায় ভেড়া পালন করা হয়।

আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের ভেড়ার লোম সাদা হলেও অযত্নের কারণে তা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এদের পশম অত্যন্ত মোটা ও নিম্নমানের। তাই এ থেকে উৎকৃষ্টমানের উল তৈরি করা যায় না। এ উল থেকে কম্বল ছাড়া অন্য কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়।

বাস্তবে, এদেশে ভেড়া থেকে মাংস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না বললেই চলে। এ মাংসও বেশিরভাগ লোকই পছন্দ করেন না। তবে এদেশের ভেড়ার প্রতি কিছুটা নজর দিলে সহজেই এ থেকে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। বিদেশী উন্নত জাতের ভেড়ার সঙ্গে প্রজনন ঘটিয়ে সংকর জাত সৃষ্টি করলে তা থেকে উন্নতমানের উপও পাওয়া যাবে। ফলে ভেড়া পালন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়ে ওঠবে।

ভেড়া পালনের সুবিধাদি

ভেড়া পালনের অনেক সুবিধা রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ:-

  • ভেড়া তুলনামূলকভাবে নামে সঙ্গা ও দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। প্রতি বিয়ানে একেকটি ভেড়ি ১-৪টি বাচ্চার জন্য দেয় । ছাগলের মতো এরাও ১৫ মাসে দু’বার বাচ্চা দেয়। তবে এদের পরিপক্কতা কিছুটা দেরিতে আসে।
  • তেমন কোন সম্পূরক খাদ্য ছাড়াই শুধু ঘাস থেকে এরা বেঁচে থাকতে পারে। আগাছাপূর্ণ ভূমি পরিষ্কার করতে এদের জুড়ি নেই। আগাছা, ঘাস, লতাগুল্ম, মূল, কন্দ, শস্যদানা, পাতা, ছাল, এমনকী খাদ্য ঘাটতির সময় প্রয়োজন হলে মাছ বা মাংসও খেতে সক্ষম ।
  • ঘাস খেয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এরা তা উল ও মাংসে রূপান্তরিত করতে পারে।
  • ছাগলের মতো ভেড়া গাছগাছড়া নষ্ট করে না। এরা সর্বদা দলনেতাকে অনুসরণ করে, তাই লালন-পালন ও ব্যবস্থাপনা বেশ সহজ।
  • এদের জন্য তেমন কোনো উন্নতমানের বাসস্থানের প্রয়োজন হয় না।
  • ভেড়ার মাংস ও দুধ বেশ সুস্বাদু। এদের চামড়া বিক্রি করেও ভালো অর্থ আয় করা যায়।
  • ভেড়ার লোম বা পশমই উল (wool) নামে পরিচিত। এগুলো অত্যন্ত দামি। উপ থেকে শীতের কাপড়, কম্বল, শাল ইত্যাদি তৈরি হয়।
  • গোবর ও চনা উৎকৃষ্টমানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
  • ভেড়ার হাড়ের গুঁড়ো গবাদিপশু ও পোল্ট্রির খাদ্য এবং উৎকৃষ্ট সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নাড়িভুঁড়ি ও রক্তে রয়েছে উন্নতমানের আমিষ যা হাঁসমুরগির খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ।
  • সর্বোপরি ভেড়া অত্যন্ত অর্থকরী প্রাণী।

ভেড়ার বাসস্থান

ভেড়ার জন্য বাসস্থান তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ এরা প্রধানত মাঠে চরে ঘাস খাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এদেরকে ঘাসপূর্ণ বিস্তীর্ণ মাঠে পালন করা হয় যেখানে দল বেধে ঘাস খেতে খেতে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে থাকে। রাতের বেলা মাঠেই একসঙ্গে বিশ্রাম নেয়। তবে শীতপ্রধান দেশে শীতকালে এদের জন্য বাসস্থানের দরকার পড়ে। তাছাড়া আরও কয়েকটি কারণে ভেড়ার বাসস্থানের প্রয়োজন পড়ে। যেমন:-

  • রাতের বেলা ভালোভাবে বিশ্রাম নেয়ার
  • শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
  • যেসব ভেড়া বেশি দুধ দেয় তাদের দুধ দোহনের জন্য ।
  • গর্ভবর্তী, প্রসূতি ও বাচ্চা ভেড়ার সঠিক পরিচর্যা করার জন্য ।
  • চোরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
  • আমাদের মতো সাতিস্যাঁতে দেশে ঝড়বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ।

ভেড়ার ঘরের ধর

ভেড়া পালনের জন্য প্রধানত তিন ধরনের ধর ব্যবহার করা হয়। যেমন:-

  • ক) খোলা বা উন্মুক্ত ঘর: ফোর অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অত্যন্ত কম হয় সেখানে উন্মুক্ত ঘরে ভেড়া পালন করা হয়। নির্দিষ্ট জায়গার চারদিকে বেড়া দিয়ে এ ধরনের ঘর তৈরি করা হয়। এতে কোন ছাদ থাকে না। মেঝেতে প্রধানত খড় ব্যবহার করা হয় ।
  • খ) আধা-উন্মুক্ত ঘর: চারদিক ঘিরে বেড়া দেয়া একটি নির্দিষ্ট স্থানের এক কোনে খানিকটা জায়গা ছাদ দিয়ে ঘিরে এ ধরনের ঘর তৈরি করা হয়।
  • গ) আবদ্ধ বা ছাদযুক্ত ঘর: এ ধরনের ঘরের পুরো অংশই ছাদ দিয়ে ঘেরা থাকে। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে। মেঝে পাকা বা আধাপাকা হতে পারে। আমাদের মতো দেশে ভেড়া পালনের জন্য এ ধরনের ঘরই বেশি উপযোগী। ভেড়া সারাদিন মাঠে চড়বে ও রাতের বেলা ঘরে আশ্রয় নেবে। তাছাড়া ঝড়বৃষ্টি বা খারাপ আবহাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এ ধরনের ঘর অত্যন্ত দরকারি ।

ভেড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা

ভেড়ার জন্য ভূমিসমতল মেঝে (গড়ের তৈরি) বা মাঁচার মেঝে তৈরি করা যায়। মাঁচার মেঝেতে জীবাণু ও ভূমি সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে । তাছাড়া এটি স্বাস্থ্যসম্মতও বটে। মাঁচার তৈরি মেঝেতে ভেড়ার জন্য তুলনামূলকভাবে জায়গাগু কম লাগে। সারণি ১৭-এ বিভিন্ন বয়সের ভেড়ার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।

সারণি ১৭: মাঁচা মেঝে ও খড়ের মেঝেতে বিভিন্ন বয়সের ভেড়ার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার পরিমাণ

 

 

ভেড়ার পরিচর্যা

ভেড়াকে সুস্থ-সবল ও কর্মক্ষম রাখা ও এর থেকে পর্যাপ্ত উৎপাদন পেতে হলে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হবে। গরু মহিষ বা ছাগলের মতোই দৈনিক ভেড়ার পরিচর্যা করতে হবে। বিভিন্ন বয়সের ভেড়াকে প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা করতে হবে । তাছাড়া গর্ভবতী, প্রসূতি, নবজাতক প্রভৃতি ভেড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিতে হবে। নিম্নলিখিতভাবে ভেড়ার পরিচর্যা করা যায়। যথা:-

  • প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের করে মাঠে চড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তারা যেন পর্যাপ্ত সময় মাঠে চড়তে পাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • ঘর ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। গোবর বা চনা যেন কোন রোগের কারণ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । সপ্তাহে অন্তত একবার জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে ঘর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  • এদের চিহ্নিত করার জন্য অবশ্যই কানে ট্যাগ নম্বর লাগাতে হবে।
  • সাধারণত বিশেষ অবস্থা ছাড়া ভেড়াকে তেমন কোন দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হয় না। তবে, গর্ভবতী, প্রসূতি, বাচ্চা ভেড়া ও প্রজননের পাঠার জন্য সম্পূরক (supplementary) খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে ।
  • নিয়মিত ব্রাশ দিয়ে দেহ পরিষ্কার করতে হবে। এতে উলের ভেতরের ময়লা বেরিয়ে আসবে ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পাবে। নিয়মিত ব্রাশ করলে উল উজ্জ্বল দেখাবে ও চামড়ার মান বৃদ্ধি পাবে।
  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ভেড়ীর দুধ দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
  • ভেড়ার উল কাটার পূর্বে এদেরকে বহিঃপরজীবীনাশক ওষুধ দিয়ে গোসল করাতে হবে বা ওষুধ গায়ে ছিটিয়ে দিতে হবে । লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনভাবেই ভেড়া যেন বিষাক্ত বহিঃপরজীবীনাশক ওষুধ খেয়ে না ফেলে। এভাবে বহিঃপরজীবীনাশক ব্যবহার করলে বিভিন্ন ধরনের উকুন, আটালি ও অন্যান্য বহিঃপরজীবী ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ট্রল থেকে বিভিন্ন ময়লা দূর হয়, মাছির কীড়া দেহে বাসা বাঁধতে পারে না। এতে উলের মানও বৃদ্ধি পায়।
  • নির্দিষ্ট মৌসুমে ভেড়ার দেহ থেকে ভুল কেটে নিতে হবে। প্রজননের উদ্দেশে ব্যবহৃত ভেড়াকে একাজে ব্যবহারের পূর্বে উল কেটে দিলে প্রজনন ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ে।
  • প্রজননের কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্য না থাকলে পুরুষ বাচ্চা ভেড়াকে সময়মতো বাসি করে নিতে হবে ।
  • অসুস্থ ভেড়াকে অন্যান্য সুস্থ ভেড়া থেকে পৃথক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে । সকল বয়সের ভেড়াকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা প্রদান করতে হবে।

 

 

সারসংক্ষেপ

ভেড়া তুলনামূলকভাবে দামে সস্তা। দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। ১৫ মাসে দুবার বাচ্চা দেয়। এদের পশম বা উপ অত্যন্ত দামি। উল থেকে শীতবস্তু, কম্বল, শাল ইত্যাদি তৈরি হয়। ভেড়ার জন্য তেমন কোন বাসস্থান লাগে না। এরা শুধু খাস খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, তেমন কোন সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। কারণ এরা প্রধানত মাঠে চরে ঘাস খাওয়ার ওপর নির্ভরশীল।

ভেড়ার জন্য তিন ধরনের ঘর ব্যবহার করা হয়, যথা:- উন্মুক্ত আধা-উন্মুক্ত ও আবদ্ধ ঘর। এদের | ঘরের জন্য ভূমিসমতল মেঝে বা খাঁচার মেঝে তৈরি করা যায়। মাঁচার মেঝেতে জীবাণু ও ভূমি সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা কম । নিয়মিত ব্রাশ দিয়ে দেহ পরিষ্কার করলে উলের ভিতরের ময়লা বেরিয়ে আসে ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাড়ে। কাটার পর্বে এদেরকে বহিঃপরজীবীনাশক ওষুধ দিয়ে গোসল করাতে হবে। সকল বয়সের ভেড়াকে নিয়মিত কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা প্রদান করতে হবে।

 

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version