আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হাঁস-মুরগির আবাসন – যা কৃষি উপকরণ : গৃহপালিত পশু-পাখির আবাসন ও খাদ্য এর অন্তর্ভুক্ত ।
Table of Contents
হাঁস-মুরগির আবাসন
হাঁস-মুরগির আবাসনের প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক পদ্ধতিতে খামারভিত্তিতে অথবা ছোট আঙ্গিকে নিজ বাড়িতে, বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দায় হাঁস-মুরগি পালন করতে হলে এদের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন বা বাসস্থানের প্রয়োজন। যদিও পারিবারিকভাবে ১০-১৫টি হাঁস-মুরগি পালনের ক্ষেত্রে শুধু রাতের আশ্রয়ের জন্য একটি খোঁয়াড় বা ঘর হলেই যথেষ্ট, কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে খামারভিত্তিতে হাঁস-মুরগির জন্য আবাসন বা ঘর তৈরির ক্ষেত্রে খামারের ধরন, খামারে পাখির সংখ্যা ও খামারির আর্থিক সঙ্গতির কথা প্রথমেই বিবেচনায় আনতে হবে। এরপর ঘর তৈরিতে যেসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে তা নিম্নরূপঃ:-
- হাঁস-মুরগির জন্য আরামপ্রদ পরিবেশ নিশ্চিত করা।
- প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনের সময় তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা।
- অতিরিক্ত শীত, গরম বা বৃষ্টি ও স্যাঁতসেঁতে অবস্থার হাত থেকে হাঁস-মুরগিদের রক্ষা করা।
- চোরের হাত থেকে রক্ষা করা।
- বন্য পশুপাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা করা।
- একাধিক ঘর তৈরি করলে নির্দিষ্ট দূরত্বে ও প্রয়োজনীয় আকারে তা নির্মাণ করা।
- বিভিন্ন জাতের হাঁস-মুরগি একই খামারে পালন না করাই ভালো। তাছাড়া একই প্রজাতির বিভিন্ন বয়সের পাখি একসঙ্গে পালন না করে এদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা উচিত। লেয়ার (ডিম উৎপাদনের মুরগি) ও ব্রয়লার (মাংস উৎপাদনের মুরগি) একই খামারে পালন না করাই ভালো।
- ইঁদুর ও অন্যান্য ক্ষতিকর জন্তুর হাত থেকে এদের রক্ষা করা।
- রোগজীবাণুর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।
- হাঁস-মুরগি বিষ্ঠার কারণে যেন কোন দুর্গন্ধ না হয়, সেজন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
হাঁস-মুরগির বাসস্থান তৈরির ধাপসমূহ
- হাঁস-মুরগির আবাসন বা বাসস্থান তৈরির ধাপসমূহ নিম্নরূপ:-
- প্রথমে হাঁস-মুরগির বাসস্থানের জন্য স্থান নির্বাচন করা।
- এরপর হাঁস-মুরগি পালনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ঘরের সঠিক ডিজাইন নির্বাচন করা ।
- ডিজাইন নির্বাচন হয়ে গেলে হাঁস-মুরগি পালনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঘর তৈরির পরিকল্পনা করা।
- এরপর হাঁস-মুরগির জন্য ঘর তৈরি করা।
- ঘরে হাঁস-মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা করা।
হাঁস-মুরগির আবাসন বা বাসস্থানের জন্য স্থান নির্বাচন
- হাঁস-মুরগির বাসস্থান বা ঘর এমন জায়গায় তৈরি করতে হবে যেন নিম্নলিখিত সুবিধাদি পাওয়া যায়। যথা:-
- উঁচু জমি ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসম্পন্ন স্থান।
- ডিম ও মাংস বাজারজাত করার সুবিধা ।।
- উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা।
- বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের সুবিধা।
- ভবিষ্যতে খামার বড় করার সুবিধা।
হাঁস-মুরগির ঘরের ধরন
হাঁস-মুরগি পালনের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে এদের জন্য বিভিন্ন ধরন বা প্রকারের ঘর তৈরির প্রয়োজন পড়ে। যেমন:-
ব্রিডার ঘর (Breeder House)
এখানে ডিম উৎপাদনকারী (লেয়ার) এবং মাংস উৎপাদনকারী (ব্রয়লার) হাঁস- মুরগির দাদা-দাদি (Grand Parent) বা বাবা-মাদের (Parent) প্রজননের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়।
ডিম ফোটানোর ঘর (Hatchery):
ব্রিডার খামারে উৎপাদিত ডিম হ্যাচারিতে ফোটানো হয়। এখান থেকেই একদিন বয়সের লেয়ার বা ব্রয়লারের বাচ্চা বিভিন্ন খামারে পালনের জন্য সরবরাহ করা হয়। বাচ্চা
ভাপানোর ঘর (Brooder House)
ডিম থেকে সদ্যফোটা বাচ্চাদের জন্মের পর থেকে ৪ / ৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ব্রুডার বা বাচ্চা তাপানোর ঘরে কৃত্রিমভাবে তাপ দিয়ে পালন করা হয়।
বৃদ্ধির ঘর (Grower House)
এখানে ডিম উৎপাদনকারী অর্থাৎ লেয়ার মুরগির বাচ্চাগুলোকে ৬/৭ সপ্তাহ থেকে ১৮/২০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়।
ডিমপাড়া ঘর (Layer House)
এখানে ডিমপাড়া অর্থাৎ লেয়ার মুরগিগুলোকে ১৯/২১ সপ্তাহ থেকে ৭২ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়।
ব্রয়লার ঘর (Brailer House)
এখানে সদ্যফোটা বা একদিন বয়সের মাংস উৎপাদনকারী বা ব্রয়লার মুরগির বাচ্চাগুলোকে বাজারজাত করার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫-৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়।
হাঁস-মুরগির ঘর
হাঁস-মুরগির ঘর নানা ধরনের হতে পারে। তবে, যে ধরন বা ডিজাইনেরই হোক না কেন মুরগি পালনের জন্য আয়তাকার ঘরই সবচেয়ে উপযোগী। মুরগির দলের ( Flock) সংখার ওপর নির্ভর করে ঘরের দৈর্ঘ্য। তবে ঘরের দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন প্রস্থ ৪.৫-৯.০ মিটারের বেশি হবে না। তাছাড়া ঘরটি পূর্বপশ্চিমে লম্বা হবে এবং পূর্বমুখী বা দক্ষিণমূখী হবে। এতে বায়ু চলাচলের সুবিধা হয়।
হাঁস-মুরগির ঘরের প্রকারভেদ
হাঁস-মুরগির ঘরের ছাদের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে মুরগির ঘর বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন:-
একচালা বা শেড টাইপ (Shed Type) ঘর
ছাড়া অবস্থায় বা অর্ধ ছাড়া অবস্থায় মুরগি পালনের জন্য একচালা ঘর বেশি উপযোগী । এ ধরনের ঘর খুব সহজেই তৈরি করা যায়।
দোচালা বা গেবল টাইপ (Gable Type) ঘর
সচরাচর বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে মুরগি পালনের জন্য এ ধরনের ঘর বেশি উপযোগী। এ ধরনের ঘরের চাল ঢালু হয়ে থাকে। দোচালা ঘর তৈরিতে বেশি খরচ পড়ে।
মনিটর বা সেমিমনিটর টাইপ (Monitor or Semi-monitor Type) ঘর
যেসব ঘরের উভয় দিকে মুরগির খোপ (Pen) রাখা হয় সেসব ঘর বেশি প্রশস্ত করে তৈরি করতে হয়। আর এক্ষেত্রে মনিটর বা সেমিমনিটর ঘর তৈরি করতে হয় । তাছাড়া ব্রুডার ঘরও এ ধরনের ডিজাইনে তৈরি করা হয়। এতে খরচও বেশি পড়ে।
কম্বিনেশন টাইপ (Combination Type) ঘর
এ ধরনের ঘরের চাল দু’দিকেই চালু হয়। বেশিরভাগ ঘরেরই উপরের দিক বেশি ঢালু হয়। এতে নির্মাণ খরচও বেশি। বাণিজ্যিক খামারগুলোর ঘর মনিটর, সেমিমনিটর বা কম্বিনেশন ধরনের হতে পারে। তবে, পারিবারিক খামারের জন্য অল্প খরচে মজবুত ঘর তৈরি করাই শ্রেয়। ছাদের ধরন একচালা বা দোচালা হওয়াই ভালো।
ঘর তৈরিতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী
ঘর তৈরিতে বাঁশ, কাঠ, ইট, ঢেউটিন, হার্ডবোর্ড, অ্যারেস্টোস শিট, পলিথিন, জি আই শিট, সিমেন্ট, তারজালি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। ঘরের মেঝে এমনিভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা সব সময় শুকনো থাকে, কোথাও কোন ফাটল বা গর্ত না থাকে এবং পরিষ্কার করা যায় সহজেই। মেঝে সিমেন্ট দিয়ে ভালোভাবে পলেস্তরা করলে ঘরে ইঁদুরের উপদ্রব বন্ধ হয়। ঘরের দেয়াল ইট, বালি, সিমেন্ট, বাঁশের কঞ্চি, কাঠ এবং লোহার তারজালি দিয়ে হাঁস-মুরগির ঘরের দেয়াল তৈরি করা যায়।
মনে রাখা উচিত, দেয়াল যে দ্রব্য দিয়েই তৈরি করা হোক না কেন, তা যেন মজবুত ও হায়ী হয়। দেয়ালের ভিতরের দিকটা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তা সহজেই পরিষ্কার করা যায় ও জীবানুনাশক ওষুধ দিয়ে। শোধন করা যায়। ঘরে অবশ্যই মজবুত দরজা ও জানালা লাগাতে হবে। ঘরের দরজা অবশ্যই দক্ষিণ দিকে থাকতে হবে। ঘরের চার দেয়ালেই জানালা থাকতে হবে।
জানালায় ২.৫ সেন্টিমিটার ফাঁকযুক্ত তারজালি লাগিয়ে দিলে ভালো হয়। ঘরের চাল খড়, টালি, ঢেউটিন, অ্যারেস্টোস এবং ছাদ সিমেন্ট, রড ও খোয়া দিয়ে ঢালাই করে তৈরি করা যায়। গৃহপালিত পাখির ঘরের ছাদ সস্তা বা দামি যে সামগ্রী দিয়েই তৈরি করা হোক না কেন এটি ভালোভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বারবার মেরামতের প্রয়োজন না পড়ে।
ঘরে মুরগিপ্রতি প্রয়োজনীয় জায়গা
প্রতিটি ঘরে মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। কখনোই গাদাগাদি করে মুরগি রাখা যাবে না। সারণি ০১-এ বয়সভেদে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার পরিমাণ উল্লেখ করা হলো:-
সারণি ০১: বয়সভেদে বিভিন্ন পদ্ধতিতে মুরগির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা
সারসংক্ষেপ
হাঁস-মুরগি পালনের জন্য আবাসন বা বাসস্থানের প্রয়োজন। প্রথমেই আবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন স্থান নির্বচন করতে হয়। পালনের উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্রিডার, হ্যাচারি, ব্রুডার, গ্রোয়ার, পেয়ার, ব্রয়লার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের ঘর তৈরি করা হয়। ছাদের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে হাঁস-মুরগির ঘর একচালা, দোচালা, মনিটর, |
সেমিমনিটর বা কম্বিনেশন ধরনের হতে পারে। ঘর তৈরিতে বাঁশ, কাঠ, ইট, ঢেউটিন, হার্ডবোর্ড, অ্যাসবেস্টোস শিট, | পলিখিন, জি.আই. শিট, সিমেন্ট, তারজালি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। হাঁস-মুরগি যেন আরামে থাকতে পারে সেজন্য ঘরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গা দিতে হবে।