আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় কৃষি জমি ও ভূমিকর্ষণের ধারণা ও উদ্দেশ্য
Table of Contents
কৃষি জমি ও ভূমিকর্ষণের ধারণা ও উদ্দেশ্য
কৃষি জমি ও ভূমি কর্ষণের ধারণা ও উদ্দেশ্য
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশে মোট জমির পরিমাণ ১,৪৭,০৩,০০০ হেক্টর। আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ১,১৪,৯৭,০০০ হেক্টর এবং আবাদী জমির পরিমাণ ১,০৮,৩৩,০০০ হেক্টর। এ কৃষি জমি আবার উচ্চভূমি, মাঝারি উচ্চভূমি, মধ্যম জমি, মাঝারি নিচু এবং নিচু প্রভৃতি শ্রেণিতে বিভক্ত। উচ্চ ভূমিগুলো কোন সময়ই প্লাবন দ্বারা প্লাবিত হয় না।
আবার নিচু জমি বছরের কয়েক মাস পানির নিচে থাকে। কাজেই ভূমির উচ্চতার ওপর নির্ভর করে কৃষি জমি চাষাবাদ করা হয়। কৃষি জমিগুলোতে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়। কোন ফসলের পানির চাহিদা বেশি আবার কোনটির কম। ভূমি কর্ষণ করে মাটিতে বিভিন্ন মাত্রায় পানি সংরণ করা সম্ভব। বিভিন্ন ফসলের বীজ আবার বিভিন্ন রকম। কোনটির বীজ খুবই ছোট আবার কোনটি বেশ বড়।
বীজের আকার অনুযায়ী ভূমি কর্ষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে বছরে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০৩ সে.মি.। বৃষ্টিপাত বছরের সব সময় সমানভাবে হয়না। দেশের সব জায়গায়ও বৃষ্টিপাত সমানভাবে পতিত হয় না। কাজেই বছরের বিভিন্ন সময় ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম আর্দ্রতা জমিতে বিরাজ করে। সেজন্য বিভিন্ন রকম জমিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভূমি কর্ষণ প্রয়োজন।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাটি এক রকম নয়। কোন এলাকার মাটি বেলে, কোথাও এঁটেল আবার কোথাও বা দো-আঁশ মাটি। মাটির অম্লত্ব ও ারত্বও বিভিন্ন রকম। কাজেই ভূমি কর্ষণও বিভিন্ন রকম জমিতে বিভিন্ন রকম হওয়া যুক্তিযুক্ত। এসব বিচারে বাংলাদেশের কৃষি জমি সম্পর্কে ও তাদের ভূমিকর্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। বিভিন্ন জমিতে মাটির বিভিন্ন বুনট ও গঠন পরিলতি হয়।
মাটির বুনট ও গঠনভেদে ভূমি কর্ষণ ফসলের ফলনকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। অনেক সময় অতিরিক্ত ভূমিকর্ষণ করে মাটির ভৌত গুণাবলী নষ্ট করা হয়। কাজেই কৃষি জমিতে মাটির গঠনকে সঠিক রেখে ভূমিকর্ষণ করা উচিত। এজন্য টেকসই ভূমি কর্ষণের ধারণা প্রবর্তিত হয়েছে। সচরাচর পদ্ধতির ভূমি কর্ষণের চেয়ে টেকসই ভূমি কর্ষণ ধারণার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
সঠিকভাবে ভূমি কর্ষণ করে কৃষি জমির বিভিন্ন ভৌত গুণাবলী উন্নত করা যায়। কিছু কিছু কৃষি জমিতে মাঝে মাঝে বিষাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে জন্মে এ পরিবেশের সৃষ্টি করে। জমি গভীরভাবে চাষ করলে মাটি ওলট পালট হয়ে বিষাক্ত পদার্থ মাটির উপরে এসে সূর্যালোক, তাপ ও বায়ুর প্রভাবে এসব বিষক্রিয়া অনেকাংশে দুরীভূত হয়।
চাষের ফলে অনেক পোকা-মাকড়, ডিম ও কীড়া মাটির উপরে এসে মারা যায়। সমুদ্রের নিকটবর্তী অঞ্চলে প্লাবনের ফলে লবণাক্ততা দেখা দিলে গভীর চাষ ও প্রচুর পানি সরবরাহ করলে লবণ মিশ্রিত পানি মাটির নিম্নস্তরে চুয়ে লবণাক্ততা হ্রাস পায় এবং এভাবে কৃষি জমির উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয়।
জৈব পদার্থের পরিমাণের উপর মাটির গুণাগুণ অনেকাংশে নির্ভর করে। সবুজ সার প্রস্তুতের জন্য মাটিকে গভীরভাবে চাষ করলে সবুজ সার শস্য (Green manuring crop) মাটির সাথে ভালভাবে মিশে যায় এবং কৃষি জমির উন্নয়ন হয়। অনেক কৃষি জমি ক্রমাগত চাষের ফলে শক্ত লাঙল স্তরের (Plough pan) সৃষ্টি হয়। ফলে জমিতে পানি জমে থাকে। ভূমি কর্ষণের মাধ্যমে এ রকম লাঙল স্তর ভেঙ্গে দিয়ে কৃষি জমির উন্নয়ন ঘটানো যায়।
ভূমি কর্ষণকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। শস্যের বীজ মাটিতে সুষ্ঠুভাবে বপন ও তার অঙ্কুরোদগম, চারা রোপণ এবং গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য মাটিতে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অনুকূল অবস্থা তৈরি কল্পে কৃষি যন্ত্রপাতি দ্বারা মাটির আলোড়নকে ভূমি কর্ষণ বলে ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৭৩৯) জেথ্রোটাল নামে একজন ব্রিটিশ কৃষিবিদ পশুশক্তি দ্বারা লাঙল চালিয়ে কীভাবে উত্তমরূপে জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করা যায় তা দেখান। তার মতে জমি উত্তমরূপে কর্ষিত হলে গাছ শিকড়ের সাহায্যে কর্ষিত মাটির সু ] কণা খাদ্য হিসাবে সরাসরি গ্রহণ করে। কর্ষণই সার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরবর্তীতে গাছপালার খাদ্যোপাদান সম্পর্কে বিজ্ঞনীরা সম্যক ধারণা লাভ করেন। মাটির সুJ কণা গাছ আদৌ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না। মাটিতে বিভিন্ন প্রকার মৌলিক উপাদানকে গাছ বিভিন্ন আকারে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। ভূমি কর্ষণের ফলে এই খাদ্যাপাদানগুলো মৃত্তিকাস্থিত পানির সাথে দ্রবীভূত হয়ে খাদ্য হিসাবে অভিস্রবণ (Osmosis) প্রক্রিয়ায় গাছে পৌঁছে। মাটি কর্ষিত হওয়ার ফলে মূল ও শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করতে পারে।
ফলে মাটির পানি ধারণ মতা বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে আগাছা দমন হয় । অধুনা মাটিকে ন্যূনতম কর্ষণ করে র ণশীল কর্ষণ পদ্ধতির (Conservation tillage) ধারণা অবতারণা হয়েছে। উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য ভূমি কর্ষণ করার পর মাটি যে ভৌত অবস্থা প্রাপ্ত হয় তাকে কর্ষাবস্থা (Tilth) বলে। কর্ষাবস্থা মাটির গতিশীল (Dynamic) অবস্থার একটি রূপ।
যখন কোন মাটিকে বীজের অঙ্কুরোদগম ও ফসল বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত করে চাষ করা হয় তখন তাকে বীজতলা (Seed bed) বলা হয় এবং মাটির ঐ অবস্থাকে ভাল কর্ষাবস্থা বলে। কর্ষাবস্থা কথাটি একটি যথাযথ শব্দ না হলেও এর দ্বারা কৃষিবিদগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম অবস্থা বলে থাকেন। আবার বিভিন্ন প্রকার ফসলের বীজ বিভিন্ন রকম কর্ষাবস্থার উপযোগী।
বীজের আকার যত ছোট হয়, কর্ষাবস্থাও তত সু ] হওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন তামাক ও পিয়াজের বীজের জন্য খুব চিকন কর্ষাবস্থা প্রয়োজন। অপর প ে ভুট্টা ও ছোলার বীজ বড় আকারের বলে এদের বীজের জন্য মাঝারি রকমের কর্ষাবস্থা উপযোগী। কাজেই কর্ষাবস্থা বুঝাতে কৃষকদের নিকট ভাল, মাঝারি বা নিমানের কর্ষাবস্থা বলে বুঝানো হয়।
ভাল কর্ষাবস্থার গুণাবলী ( Qualities of good tilth)
ভাল কর্ষাবস্থায় জমির নিম্নলিখিত গুণাবলী থাকা বাঞ্ছনীয়
১. পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্দ্রতা
২. পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের অবস্থা
৩. বৃষ্টির পানির দ্রুত অনুপ্রবেশ মতা
৪. মাটির বন্ধুরতা
মাটি খুব সু এভাবে কর্ষাবস্থায় থাকলে (Fine tilth) বৃষ্টির পর শুকিয়ে পিঠার মত বেঁকে যায়। ফলে পরবর্তীতে ঐ মাটিতে পানি দিলে, সে মাটি আর পানি শোষণ করতে পারে না এবং ফসল চাষের জন্য অকেজো হয়ে পড়ে।
ভূমি কর্ষণের উদ্দেশ্য
ভূমি কর্ষণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি উত্তম বীজতলা তৈরি করা, আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা এবং উদ্ভিদ বৃদ্ধির অনুকূলে মাটির ভৌত গুণাবলীর উন্নয়ন সাধন করা। এগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. প্রাথমিকভাবে দৃঢ় জমাটবদ্ধ চাপা মাটি আলগা করা।
২. শুকনো জমিতে মাটির ঢিলা ভেঙ্গে ঝুরঝুরা করা যাতে বীজ মাটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যেতে পারে। বীজের আশপাশে বীজের আয়তনের সমান অসংখ্য বায়ুপূর্ণ ফাঁকা স্থান থাকলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভাল হয়।
৩. আলগা করা মাটিকে একটা নির্দিষ্ট দৃঢ়তা দান করা যাতে মাটি, বায়ু ও আর্দ্রতা একটি বিশেষ অনুপাতে বিদ্যমান থাকে।
৪. জমির আগাছা ধ্বংস করা এবং পচনযোগ্য আগাছা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া।
৫. সার ও জৈব পদার্থ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া।
৬. জমিতে সৃষ্ট তিকারক বিভিন্ন পদার্থ দূর করা এবং পোকা-মাকড় ধ্বংস করা।
৭. শুকনো জমিতে মাটির কৈশিকনালী (Capillary pore) ভেঙ্গে দিয়ে পানির বাষ্পায়ন কমানো ।
৮. মাটির উপকারী জীবাণুসমূহের বংশ বৃদ্ধি সহজতর করা।
৯. ভূমি য়রোধের জন্য জমির উপরিভাগ সমান করে তৈরি করা।