জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল – যা কৃষি ও জলবায়ু এর অন্তর্ভুক্ত ।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল

 

উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় ও জৈবরাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে। জীবের অভিযোজন পরিবেশের তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুর উপাদান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঐ স্থানের উচ্চতা এবং জীবের শারীরিক গঠন ও দৈহিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।

হঠাৎ জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হলে উদ্ভিদ সেই পরিবেশে নিজেকে অভিযোজন করতে পারে না। ফসলের অভিযোজন কৌশলের জ্ঞানকে কাজে লাগি কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন। এ ক্ষেত্রে খরা, বন্যা ও জলোচ্ছাসজনিত সমস্যা সমাধানের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

খরা অভিযোজন

খরা পীড়ন অবস্থায় দুইভাবে ফসল অভিযোজন করে থাকে, যথা খরা এড়ানো এবং খরা প্রতিরোধ। খরা পীড়ন অবস্থায় অভিযোজনের কার্যকরি উপায় হলো খরাবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে মাটিতে রস থাকা বা মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরু থেকে খরা শুরু হওয়ার মধ্যবর্তি সময়ে ফসলের জীবনকাল সম্পন্ন করার উপর জোর দেওয়া হয়। যেসব জীবনকাল স্বল্প, খরা এড়ানোর জন্য তারা এক চমৎকার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।

অপরদিকে খড়াপীড়ন অবস্থায় ফসলের মাঠে টিকে থাকার কৌশলকে খরা প্রতিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণত খরা প্রতিরোধের জন্য ফসল তার কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সাধন করে।

ক্ষেত্র বিশেষ দেহাভ্যন্তরে স্বল্প পানি নিয়ে খরা পীড়ন টিকে থাকে এবং খরা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি সাধন করে এবং জীবনচক্র সম্পন্ন করে। সকলক্ষেত্রে মোট কোষপ্রাচীর, উদ্ভিদ কর্তৃক প্রোটিন জমাকরণ, প্রস্বেদন নিয়ন্ত্রন, সালক সংশ্লেষণ-এর দক্ষতা বৃদ্ধি, পাতা মোড়ানো ও পাতা কুঞ্চিতকরণ কার্যকরী উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ততা সহনশীল ফসল চাষ

লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো, ফসলের চাষ, দ্রুত ও গভীর চাষের মাধ্যমে মাটির ক্যাপিলারি নালিকা ভেঙ্গে দিয়ে লবণাক্ততা কমানো। এজন্য পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে: আমন মৌসুমে বিআর ২৩, বিধান ৪০ এবং ৪১ এর চাষ। বোরো মৌসুমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৮৫ টি ইনব্রিড ও ৬টি হাইব্রিড সহ মোট ৯১ টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন যার মধ্যে রয়েছে ৮টি লবণাক্ততা সহনশীল, ৫টি খরাসহিষ্ণু, ২ টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, ধানের জাত। সাম্প্রতিক সময়ে ইরির বিজ্ঞানীদের ধানের জিন বিন্যাস উন্মোচন বা জেনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন দেশের ধান গবেষণার এই সাফল্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

 

 

চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিকল্প এবং কৌশলগত চাষাবাদের বিভিন্ন পদ্ধতি, যেমন- লবণাক্ত এলাকায় ধানের পর মুগ ডালের চাষ, পাহাড়ের পাদদেশে সরিষার পর খরিপ-১ মৌসুমে বারি মুগ-৫ চাষ, রোপা আমন ধানের সাথে মসুরের সাথী ফসল চাষ করার জন্য কৃষকগণকে উৎসাহিতকরণ।

পানি কম লাগে এমন ফসলের চাষ, মালচিং ও ড্রিপ সেচের প্রবর্তন, অল্প চাষ বা বিনাচাষে উৎপাদন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযোগী ফসলের চাষ করতে হবে, খরা সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো। আইল উঁচু করে চাষ করা । খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরী হলে নারি ও আলোক সংবেদনশীল বিষার ২২, ২৩ ও ব্রি-ধান ৪৬ এর চাষ করা। আউশ মৌসুমে বিষার ২৪, বিআর ২৬, বিআর ২৭, ব্রিধান ৪২ ও ব্রিধান ৪৩ আবাদ করা।

আমন ধান কাটার পরে খরা সহনশীল ফসল যেমন- ছোলা চাষ করা যায়। তেল ফসল হিসেবে তিলের চাষ করা যায়। এছাড়াও মাটির গভীরে বীজ বপন, পূর্বে ভিজানো বীজ বপন, সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খরা মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায় ।

 

 

স্থানীয় ও উফশী আগাম জাতের চাষাবাদ

বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় ও উফশী জাতের আগাম পাকা ও স্বল্প মেয়াদের বোরো চাষাবাদ ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। প্রচলিত জাতের চেয়ে আগাম পাকে এমন ফসলের জাত চাষ, যেমন বিধান ২৯ এর চেয়ে ব্রিধান ২৮ পনের দিন আগে কাটা যায়।

শিষ পাকা পর্যায়ে ব্রিধান ২৯ ও ব্রিধান ৩৬ এর জলমগ্নতা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এছাড়াও ব্রিধান ৪৫ চাষ করা যায় যার জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ব্রি-ধান ২৯ এর ২০-৩০ দিন বয়সের চারা সঠিক সময়ে রোপণের মাধ্যমে এর জীবনকাল ১৫ দিন কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

 

বন্যা মোকাবেলা ও বন্যা পরবর্তী ফসলের অভিযোজন

ভাসমান ধাপে ফসলের ও সবজির চাষ। বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবী জাতের ধান যেমন- নাইজারশাইল, বিআর-২২ ও ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬ চাষ করা। দাপোগ পদ্ধতির বীজতলা তৈরি। বন্যা পরবর্তী সময়ে বেশি বয়সের চারা ঘন করে লাগানো যেতে পারে। বন্যা মোকাবেলা সক্ষম ধানের পাশাপাশি সবজিও অন্যান্য ফসলের চাষ করা সম্ভব। ফ্রেঞ্চ শিম, মুলা, আলু পেয়াঁজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, করলা, চালকুমড়া, পালংশাক, পুঁইশাক, মটরশুঁটি এসব চাষ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছবাস পরবর্তী ফসলের অভিযোজন

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ক্ষতির প্রকৃতি, এলাকার মাটি বা ভূপ্রকৃতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে জলোচ্ছবাস পরবর্তী ফসল চাষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

এক্ষেত্রে আউশ মৌসুমে উফশী রোপা আউশ যেমন: বিআর ১৪. বিজার বিআর ২০, বিআর ২১, বিআর ২৬, ব্রিধান ২৭, বিধান ২৮, ব্রিধান ৪৫ এর ১ মাস বয়সী চারা বৈশাখ মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমে নারী আমন জাত যেমন: বিআর ২২, বিআর ২৩ এর এক মাসের অধিক বয়সী চারা ভাদ্র আশ্বিন মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে।

 

তাপমাত্রা সহনশীল জাতের চাষ

উচ্চতাপমাত্রা অভিযোজিত হওয়ার জন্য ফসলের নিজস্ব অভিযোজন কৌশল রয়েছে, যেমনঃ ক্ষেত্র বিশেষ উদ্ভিদ মূলের দৈর্ঘ্য, সংখ্যা ও ঘনত্ব বাড়িয়ে অধিক পরিমান পানি আহরণের মাধ্যমে অধিক তাপমাত্রায় টিকে থাকে।

মূলের গভীরতা ও ঘনত্ব একই ফসলে বিরাজমান থাকলে তার পানি আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বলে অধিক তাপমাত্রা সহনশীল হয়। এছাড়া উচ্চতাপ সহনশীল কিছু জাত ইতোমধ্যে কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যেমন-বারি আলু-১ (হীরা) তাপসহন শীল । বারি টমেটো-৪ উচ্চ তাপসহনশীল। বারি টমেটো-৬ (চৈতী), বারি টমেটো-১০ ( অনুপমা) উচ্চতাপ সহনশীল এবং ব্যাক্টেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ সহনশীল।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *