বন পরিচিতি ও বনের গুরুত্ব

বন পরিচিতি ও বনের গুরুত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-বন পরিচিতি ও বনের গুরুত্ব

বন পরিচিতি ও বনের গুরুত্ব

বন

এক কথায় বন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের সমাবেশ। বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ তথা গাছের সমাবেশ হলেও বনে বড় বড় গাছের সংখ্যা বেশি থাকে। বনে বড় গাছের সংখ্যা বেশি হওয়ায় উপরের দিকে একটা আচ্ছাদনের সৃষ্টি হয় যা নিচে ছায়ার সৃষ্টি করে।

বনের নিচে ছায়াতে বিভিন্ন জীব-জন্তু পাখি ও কীট-পতঙ্গ নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারে। কাজেই বিভিন্ন ধরনের গাছ দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকা যেখানে নানা ধরনের জীব-জন্তু, পাখি, পোকামাকড়, অণুজীব ইত্যাদি প্রাকৃতিকভাবে নির্বিঘ্নে বসবাস করে তাকে বন বলা হয়।

বনাঞ্চলে গাছপালা, জীব-জন্তু ও পোকামাকড়গুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকে। বন সৃষ্টির উপর ভিত্তি করে বনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

প্রাকৃতিক বন ও

কৃত্রিম বন।

প্রাকৃত্রিক বন

যে বনাঞ্চল মানুষের সহায়তা ছাড়া প্রাকৃত্রিক নিয়মে গড়ে উঠেছে তাকে প্রাকৃতিক বন বলা হয়। যেমন— সুন্দরবন, মধুপুরের শালবন, গজারী বন ইত্যাদি। পৃথিবীর অধিকাংশ বনাঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে আফ্রিকার ঘন গহীন অরণ্য, আমাদের দেশের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘন পাহাড়ি বনাঞ্চল সবই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি ।

 

 

কৃত্রিম বন

মানুষ দ্বারা সৃষ্ট বনাঞ্চল তথা বিভিন্ন এলাকায় নতুনভাবে গাছ লাগিয়ে যে বন সৃষ্টি করা হয়, তাকে কৃত্রিম বন বলে। বন বিভাগ কর্তৃক লাগানো চট্টগ্রামের সেগুন বন বা গামার বন কৃত্রিম বনের উদাহরণ। বর্তমানে ব্যাপকভাবে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টির উদ্যেগে দেখা যাচ্ছে, এদের মধ্যে সড়ক বনায়ন বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বসত বাড়ির পাশের বন সামাজিক বনায়নের অন্তর্ভুক্ত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে। মধুপুরের শালবনের মধ্যবর্তী ফাঁক স্থানগুলোতে কৃত্রিমভাবে শালের পাশাপাশি অন্যান্য উদ্ভিদ লাগানোর ব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে।

বনের গুরুত্ব

কোন দেশের পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে সে দেশের বনাঞ্চলের পরিমাণের উপর। দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার্থে সে দেশের সর্বমোট এলাকার শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা আবশ্যক। পৃথিবীতে গাছপালাই সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে।

আদি হতে মানব সভ্যতার বিকাশে বন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আদিকালে মানুষ বনের গাছে বাস করত; এই ছিল তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল, তারা বনের ফলমূল খেয়েই বেঁচে থাকত। বর্তমানকালে ও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে গাছের ভূমিকা তুলনাহীন।

মানবজাতীর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান থেকে শুরু করে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও গাছের কোন বিকল্প নেই। বনাঞ্চল আছে বলেই বন্য জীব জন্তু বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়া বন মাটির ক্ষয়রোধ করে, মাটির উর্বরা শক্তি বাড়ায়, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

এছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে জীব ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় বেষ্টনী হিসাবে কাজ করে। এভাবে দেখা যায় বনের গুরুত্ব অপরিসীম। এসব অবদানের প্রেক্ষিতে বনের গুরুত্বকে চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

পরিবেশগত গুরুত্ব

 

 

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

অর্থনৈতিকভাবে বনের গুরুত্ব অপরিসীম। বন থেকে প্রধানত কাঠ, জ্বালানি কাঠ, শিল্পের কাঁচামাল, ভেষজ উপাদান ইত্যাদি পাওয়া যায়। নিচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেওয়া হলো

১. কাঠ

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কাঠের গুরুত্ব অতীব। মানুষের ঘরবাড়ি তৈরি ও আসবাবপত্র তৈরিতে কাঠের বিকল্প নেই বললেই চলে। নদী-নালা, খাল-বিলের দেশ বাংলাদেশ, এখানকার অধিকাংশ লোক কৃষিজীবী। নৌকা, কৃষি যন্ত্রপাতি ও সাজসরঞ্জামসহ অনেক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে কাঠের ব্যবহার সেই আদিকাল থেকেই।

অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কাঠের প্রয়োজন ও দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু বনাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের কাঠের উৎপাদন এ বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পারছে না। এজন্য আমাদের কাঠ উৎপাদনকারী উদ্ভিদ ব্যাপকহারে লাগানো জরুরী হয়ে পড়েছে।

২. জ্বালানি কাঠ

রান্না বান্না ও অন্যান্য কাজে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার আদিম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে; এমনকি আদিকালে মানুষেরা শুকনা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাত। জানা যায় বাংলাদেশে জ্বালানি গ্যাস উল্লেখযোগ্য পরিমানে রয়েছে, কিন্তু গ্যাসের ব্যবহার কেবলমাত্র ঢাকা শহর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ; খুব সামান্য পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডারে ভর্তি করে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়।

ফলে দেশের সর্বত্র জ্বালানীর ব্যাপক চাহিদা মেটাতে মানুষের কাঠের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে অধিকহারে বনাঞ্চলের গাছ কাটা হচ্ছে। যার ফলে গ্রামাঞ্চলে ইতোমধ্যেই গোবর ও ময়লা আবর্জনাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার বাড়ছে, যা ভূমির উর্বরতা শক্তির সহায়ক। তাছাড়া সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ইটের ভাটাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সমস্ত দিক বিবেচনায় জ্বালানি কাঠের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপক।

 

 

৩. শিল্পোত্তর কাঁচামাল

অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বনাঞ্চলের উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমরা লেখাপড়ার কাজে যে কাগজ ব্যবহার করি তার কাঁচামাল হিসেবে বাঁশ, কাঠ, আখের ছোবড়া, পাট ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। দেশের বৃহত্তম নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে সুন্দরবনের গেওয়া কাঠকে ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া খুলনার হার্ডবোর্ড মিল, চন্দ্রঘোনার রেয়ন মিল এবং ম্যাচ ফ্যাকটরি সমূহের উৎপাদন বাঁশ ও কাঠের উপর নির্ভর করে। দেশের অনেক ছোট ছোট শিল্প কারখানা এবং কুটির শিল্পের কাঁচামালের যোগান আসছে বন এবং গ্রামাঞ্চলের গাছ থেকে। কুটির শিল্পের মধ্যে আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, বাঁশ, বেত ও হস্তশিল্পের যথেষ্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বর্তমানে এ সব হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।

৪. ভেষজ বা ওষুধি উদ্ভিদ

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার আদিকাল থেকেই। আদিকালে  মানুষেরা তাদের বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে বিভিন্ন গাছপালা ও লতাপাতা ব্যবহার করত। এমনিভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বনাঞ্চলের উদ্ভিদ ব্যবহার হতে হতে আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রের উৎপত্তি ঘটে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের কাঁচামাল হয় কোন উদ্ভিদ বা উদ্ভিদাংশ।

পরিবেশগত গুরুত্ব

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বন মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রাখতে সে দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ ৭ ভাগের কম।

কোন স্থানের বা অঞ্চলের আবহাওয়া সেকানকার ভূপ্রকৃতি, মাটি, নদ-নদী, সমুদ্রের অবস্থান ও বনাঞ্চল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোন স্থানের অবস্থান নদ-নদী, সমুদ্রের অবস্থিতি ভূপ্রকৃতির উপর সার্বিক কোন পরিবর্তন ঘটানো মানুষের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

কিন্তু আবহাওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এ বনাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা মানুষের পক্ষে সম্ভব। বনের উদ্ভিদ নিলিখিতভাবে আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে-

মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে।

এমনিভাবে উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বনাঞ্চলের উদ্ভিদ প্রশ্বেদন প্রক্ষিায় বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। এ জলীয়বাষ্প পরবর্তীতে বৃষ্টিপাত ঘটাতে সহায়তা করে। বনাঞ্চল ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস রোধ করে।

জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র বলতে জীবের প্রকরণ ও বিভিন্নতাকে বুঝায়। অর্থাৎ জীববৈচিত্র হচ্ছে উদ্ভিদ, প্রাণী ও বিভিন্ন প্রকার অণুজীবের প্রাপ্যতা, বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা অনেক ফসল গাছের বন্য প্রজাতি জাত বনাঞ্চল হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।

আপনারা শুনলে অবাক হবেন আমাদের খাদ্য ভাত যে ধান গাছ থেকে পাই, এ ধান গাছ কিন্তু পূর্বে এমন ছিল না ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ থেকে বিভিন্ন সংকরায়নের মাধ্যমে বর্তমানকালের ধান গাছের উৎপত্তি হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে হয়ত এখনও অনেক অজানা উদ্ভিদ বনাঞ্চলে আছে। এজন্য নিজস্ব প্রয়োজনে ব্যক্তি, দেশ ও বিশ্বপরিবেশের সাথে জীববৈচিত্র্য রক্ষা অতীব জরুরি।

চিত্তবিনোদনে বনের ভূমিকা

বিশ্বব্রহ্মান্ডে শহরের পরিমাণ তথা শহর এলকার বিস্তৃতি যেমনভাবে বাড়ছে, ঠিক তেমনিভাবে বাড়ছে শহুরে লোকসংখ্যা। আর শহুরে লোক মানে সে চলমান; তার যেন কোন বিরাম নেই। শহুরে মানুষ এভাবে কাজ করতে করতে একসময় হাঁপিয়ে ওঠে, মানুষ চায় বিশ্রাম, শরীর হয়ে পড়ে ক্লান্ত। চিত্তবিনোদন মন ও শরীরের এ অবসাদ দূর করে।

বর্তমান কর্মচঞ্চল সমাজ জীবনে বন নানাভাবে চিত্ত বিনোদনে ভূমিকা পালন করে। বনের উন্মুক্ত পরিবেশে, নির্মল বাতাস, খোলা আকাশ, প্রবাহমান ঝরনা বা নদী, সবুজ গাছপালা, বণ্যপ্রাণী ইত্যাদি সব চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপাদান।

মানুষের উপর এ সব উপাদানের প্রভাব দীর্ঘদিনের। এ কারণে বনের বেষ্টনীতে চিত্তবিনোদন একটু আলাদা, বৈচিত্র্যময় ও প্রাণবন্ত। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি উক্তির মাধ্যমে বনের গুরুত্বকে যথার্থভাবে তুলে ধরেছেন- “দাও ফিরিরে সে অরণ্য লও এ নগর। ”

সারমর্ম

  • বন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদের সমাবেশ।
  • বন প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হতে পারে আবার কৃত্রিমভাবে একে সৃষ্টি করা সম্ভব।
  • পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বনের গুরুত্ব অপরিসীম।
  • অর্থনৈতিক দিক থেকে বন গুরুত্বপূর্ণ।
  • মানুষের চিত্তবিনোদনের প্রথম আকর্ষণ বনাঞ্চল।
  • জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বনাঞ্চল রক্ষা করা জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *