বীজ সংরক্ষণ

বীজ সংরক্ষণ

কৃষি উৎপাদনের সাফল্য নির্ভর করে মানসম্পন্ন উপকরণের সঠিক ব্যবহারের উপর, যার মধ্যে অন্যতম হলো বীজ। একটি ভালো ফসলের ভিত্তি গড়ে ওঠে একটি ভাল বীজ থেকেই। তাই বীজের গুণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের জন্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় বীজ সংরক্ষণ, যা কৃষি প্রযুক্তি: বীজ, মাছ ও পশু-পাখির খাদ্য সংরক্ষণ ইউনিটের অন্তর্গত এবং কৃষির ধারাবাহিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

বীজ সংরক্ষণ

 

 

 

বীজ কৃষি উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ । অন্যান্য উপকরণ সঠিক মাত্রায় এবং সঠিক সময়ে ব্যবহার করা সত্ত্বেও বীজ যদি মানসম্পন্ন না হয় তবে ফসলের ফলন ভাল আশা করা যায় না। এজন্য কীভাবে বীজ উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয় সে সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ।

ভালবীজ উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য মাঠ পর্যায়ে আমাদের করণীয় হলো ভালো জমি নির্বাচন, সুস্থ বীজ নির্বাচন, সঠিক সময়ে বীজ বপন/চারা রোপণ, আগাছা নিয়ন্ত্রণ, বিজাত বাছাই এবং সময়মত ফসল কর্তন । এছাড়া, ফসল কাটার পর সঠিকভাবে ফসল মাড়াই, ঝাড়াই, নির্ধারিত মাত্রায় বীজ শুকানো, বীজ শোধন এবং বীজ-সংরক্ষণ বা গুদামজাতকরণ এসব কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

 

 

বীজ সংরক্ষণ:

বীজ সংরক্ষণ বলতে বোঝায়—প্রক্রিয়াজাতকরণ শেষে প্রাপ্ত মানসম্পন্ন বীজকে ভবিষ্যৎ ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত পাত্রে বা পরিবেশে সংরক্ষণ করে রাখা। কৃষি উৎপাদনে বীজের মান ও সজীবতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নিম্নমানের বা অজৈব বীজ ব্যবহার করলে কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন সম্ভব হয় না।

প্রচলিত সংরক্ষণ পদ্ধতি

বাংলাদেশের কৃষকেরা সাধারণত নিম্নলিখিত পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন:

  • চটের বস্তা
  • প্লাস্টিক বস্তা
  • মাটির মটকা
  • ড্রাম
  • কলসী
  • টিনের পাত্র
  • কাচের বৈয়ম
  • বাঁশের তৈরি বেড় বা ডোল
  • পলিব্যাগ

তবে এসব পাত্র, বিশেষ করে চটের বস্তা, বেড়, ডোল, মটকা বা কলসী ইত্যাদি বায়ুরোধী নয়। ফলে বীজের আর্দ্রতা বাইরের বাতাসের আর্দ্রতার দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা সংরক্ষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের পাত্রে সংরক্ষিত বীজে ছত্রাক সংক্রমণ, অঙ্কুরোদগম হ্রাস এবং বীজের সজীবতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

আধুনিক বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি

বায়ুরোধী পাত্র—যেমন:

  • প্লাস্টিক কনটেইনার
  • মোটা প্লাস্টিক ব্যাগ
  • কাচের বৈয়ম
  • টিন বা ধাতব ড্রাম

এগুলোতে নির্ধারিত মাত্রার আর্দ্রতা বজায় রেখে বীজ সংরক্ষণ করলে তা ৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে। এই পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণের সময় বীজের আর্দ্রতা নিয়মিত পরীক্ষা করে প্রয়োজনে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে

 

উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর সংরক্ষণ

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বীজ ব্যাংকসমূহে বীজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার (cold storage) বা ফ্রিজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে বীজের:

  • আর্দ্রতা: সাধারণত ৮–১০% এর মধ্যে রাখা হয়
  • তাপমাত্রা: ৫–১৫°C এর মধ্যে রাখা হয়

এই পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীজ বহু বছর ধরে সজীব থাকে এবং অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় রাখে।

 

সংরক্ষণে কিছু সতর্কতা
  • বীজের পাত্র কখনো সরাসরি মাটিতে রাখা যাবে না
  • সংরক্ষণের স্থান হতে হবে পরিষ্কার, শুষ্ক আলো-বাতাস চলাচলযুক্ত
  • স্তুপ করে রাখার সময় উচ্চতা ২–মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়

 

বীজ সংরক্ষণের মূল লক্ষ্য

বীজ সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বীজের সজীবতা (viability), সতেজতা অঙ্কুরোদগম হার অক্ষুণ্ণ রাখা। সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত বীজ পরবর্তী মৌসুমে উচ্চমানের ফসল উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

 

 

বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতিসমূহকে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ভিত্তিক ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়:

বীজের সজীবতা ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে হলে সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতিগুলিকে মূলত দুইটি নিয়ামকের উপর ভিত্তি করে চারটি ভাগে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়— আর্দ্রতাতাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অনুযায়ী।

. তাপমাত্রা আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণবিহীন সংরক্ষণ পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে বীজের উপর সরাসরি বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার প্রভাব পড়ে। সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত পাত্রগুলো সাধারণত বায়ুরোধী নয় এবং বায়ু অবাধে প্রবেশ করতে পারে। এতে বীজ আর্দ্রতা শোষণ করে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ফাঙ্গাস আক্রান্ত হয়।

উদাহরণস্বরূপ পাত্র:

  • চটের বস্তা
  • ডোল
  • বেড়
  • মাটির মটকা
  • কলসী

বিশেষ লক্ষণ:

  • স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত
  • আর্দ্র আবহাওয়ায় বীজের গুণমান দ্রুত হ্রাস পায়

 

. স্বাভাবিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত আর্দ্রতায় সংরক্ষণ

এই পদ্ধতিতে বীজকে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় যাতে বাইরের আর্দ্রতা পাত্রে প্রবেশ করতে না পারে। যদিও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় না, তবু যেহেতু বীজ শুকনো অবস্থায় বায়ুরোধী পাত্রে থাকে, তাই তা তুলনামূলক বেশি দিন ভালো থাকে।

উদাহরণস্বরূপ পাত্র:

  • কাচের বৈয়ম
  • মোটা প্লাস্টিক ব্যাগ
  • টিনের কনটেইনার
  • লোহার বা প্লাস্টিকের ড্রাম

বিশেষ লক্ষণ:

  • অল্প খরচে কার্যকর সংরক্ষণ
  • স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত

 

. উচ্চ আর্দ্রতা নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ

এই পদ্ধতি সাধারণত অঙ্গজ বীজের জন্য ব্যবহৃত হয়, যেগুলো আর্দ্র পরিবেশে সংরক্ষণের প্রয়োজন হয় এবং শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায় না। হিমাগারে সংরক্ষণের মাধ্যমে এই ধরনের বীজের গুণমান বজায় রাখা হয়।

উদাহরণস্বরূপ বীজ:

  • আলু
  • পেঁয়াজ
  • গাজর

পরিবেশের বৈশিষ্ট্য:

  • আর্দ্রতা: ৮০% বা তার বেশি
  • তাপমাত্রা: ৩–১০°C
  • নিয়মিত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়

 

. নিম্ন আর্দ্রতা তাপমাত্রায় সংরক্ষণ

এই পদ্ধতিতে বীজকে শুষ্ক ও ঠান্ডা পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। এটি দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে, জার্মপ্লাজম ব্যাংকে বা বীজ ভাণ্ডারে এই পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত।

পরিবেশের বৈশিষ্ট্য:

  • আর্দ্রতা: ৫০% এর নিচে
  • তাপমাত্রা: সাধারণত ১০°C বা তার নিচে

বিশেষত সংরক্ষণের উপযোগী:

  • উদ্ভিদতাত্ত্বিক বা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বীজ
  • দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের (৩–৮ বছর পর্যন্ত) জন্য

 

সারকথা:
বীজ সংরক্ষণের সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন ফসলের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা নির্ধারণ করে। আবহাওয়া, সংরক্ষণযোগ্য সময়কাল এবং খরচের বিষয়টি বিবেচনা করে কৃষক বা প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত পদ্ধতি বেছে নিতে হবে।

 

 

বীজ সংরক্ষণে শিক্ষার্থীর কাজ:

শিক্ষার্থী বীজ সংরক্ষণের গুরুত্ব বর্ণনা করবেন।

 

বীজ সংরক্ষণ পাঠের সারাংশ:

মানসম্পন্ন বীজ প্রাপ্তির জন্য ফসল বীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ । বীজ উৎপাদনের জন্য বীজের প্রাথমিক উৎস এলাকার জলবায়ু, মাটি, সার প্রয়োগ, বপন সময়, বীজ হার, নিরাপদ দুরত্ব, রোগিং, কর্তন সময় সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকে ।

মাঠ পর্যায়ে যথাযথ পরিচর্যা সম্পন্ন করে ভাল বীজ উৎপাদন করা হলেও প্রক্রিয়াজাতকরণের যে কোন ধাপে মান হ্রাস পেতে পারে । তাই উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতিতে মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো ও উপযুক্ত পাত্রে সংরক্ষন নিশ্চিত করতে হবে ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *