Category Archives: জলবায়ু ও মাটি

জলবায়ু ও মাটি

উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান

উদ্ভিদের সঠিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় নানা ধরণের পুষ্টি উপাদানের। এই পুষ্টি উপাদানগুলো উদ্ভিদের কোষ থেকে শুরু করে পুরো শিকড়, ডাল, পাতা এবং ফলের গঠন ও কার্যক্রমে অবদান রাখে। যেমন পানি, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম সহ বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও অণুসমূহ উদ্ভিদের সুস্থ জীবনধারণের মূল ভিত্তি। পুষ্টি উপাদানের অভাব হলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, ফলন কমে যায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়। তাই কৃষি ও বাগান ব্যবস্থাপনায় উদ্ভিদের পুষ্টি চাহিদা বোঝা ও পূরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনায় আমরা উদ্ভিদের প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলো, তাদের ভূমিকা এবং সঠিক পরিমাণে প্রয়োগের গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান

উদ্ভিদের অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান

উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, পুষ্টি সংগ্রহ এবং প্রজননের জন্য মাটি, পানি ও বায়ু থেকে যে উপাদানগুলো গ্রহণ করা হয়, সেগুলোকে পুষ্টি উপাদান বলা হয়। উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য মোট ১৬ প্রকার অজৈব উপাদান প্রয়োজন, যাদেরকে অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান বলা হয়।

এই উপাদানগুলো উদ্ভিদের গঠন ও কার্যক্রমে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কোনো একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের অভাবে উদ্ভিদের অস্বাভাবিক লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং রোগের সৃষ্টি হতে পারে। একটি উপাদানের অভাব অন্য কোনও উপাদান দ্বারা পূরণ করা যায় না। মাটিতে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ও অবস্থান সম্পর্কে ধারনা পেতে গাছপালার পাতা, বৃদ্ধি এবং ফলনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি মাটি ও গাছপালা রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করেও পুষ্টির সঠিক অবস্থা নির্ণয় করা যায়।

অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানের শ্রেণিকরণ

উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো তাদের প্রয়োজনীয়তার পরিমাণ অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:

১. মুখ্য পুষ্টি উপাদান
২. গৌণ পুষ্টি উপাদান

মুখ্য পুষ্টি উপাদান

এই উপাদানগুলো উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ পরিমাণে প্রয়োজন হয়। মুখ্য পুষ্টি উপাদানগুলো হলো:

  • কার্বন (C)
  • হাইড্রোজেন (H)
  • অক্সিজেন (O)
  • নাইট্রোজেন (N)
  • ফসফরাস (P)
  • পটাশিয়াম (K)
  • ক্যালসিয়াম (Ca)
  • ম্যাগনেসিয়াম (Mg)
গৌণ পুষ্টি উপাদান

এই উপাদানগুলো তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে হলেও উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়। গৌণ পুষ্টি উপাদানগুলো হলো:

  • লৌহ (Fe)
  • জিংক (Zn)
  • ম্যাঙ্গানিজ (Mn)
  • মলিবডেনাম (Mo)
  • বোৰন (B)
  • কোবাল্ট (Co)
  • তামা (Cu)
  • ক্লোরিন (Cl)

 

পুষ্টি উপাদানের প্রাপ্তির উৎস

উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান প্রধানত দুইটি উৎস থেকে আসে:

১. প্রাকৃতিক উৎস
২. কৃত্রিম উৎস

. প্রাকৃতিক উৎস

মাটি, বায়ু ও পানি হলো উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের প্রাকৃতিক উৎস।

  • উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন ও অক্সিজেন গ্রহণ করে।
  • পানি থেকে হাইড্রোজেন গ্রহণ করে।
  • অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ইত্যাদি মাটি থেকে গ্রহণ করে।

. কৃত্রিম উৎস

উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কৃত্রিমভাবে জৈব ও রাসায়নিক সারের মাধ্যমে সরবরাহ করা যায়।

() জৈব সার

জৈব পদার্থ থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদান উদ্ভিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ:
গোবর, কম্পোস্ট, খড়কুটা, খৈল, হাড়ের গুঁড়া ইত্যাদি জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

() রাসায়নিক সার

রাসায়নিক সারে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান থাকে, যেমন:

  • ইউরিয়া → নাইট্রোজেন
  • টি.এস.পি. (ট্রিপল সুপার ফসফেট) → ফসফরাস
  • এম.পি. (মিউরেট অব পটাশ) → পটাশিয়াম
  • জিপসাম → গন্ধক

 

১। নাইট্রোজেন (N)

উৎস:

  • মাটিতে নাইট্রোজেনের উৎস হলো নাইট্রোজেন লবণ।
  • যদিও বায়ুমণ্ডলে ৮০% নাইট্রোজেন থাকে, উদ্ভিদ সরাসরি তা গ্রহণ করতে পারে না।
  • বাংলাদেশে ইউরিয়া (৪৫% নাইট্রোজেন) ও অ্যামোনিয়াম সালফেট (২০.৫% নাইট্রোজেন) ব্যবহৃত হয়।

কাজ:

  • উদ্ভিদের কান্ড, পাতা ও অন্যান্য অংশ গাঢ় সবুজ করে।
  • শাখা-প্রশাখার বৃদ্ধি ঘটায়।
  • অধিক কুশি সৃষ্টি করে।
  • পাতার আকৃতি বড় করে সালোকসংশ্লেষণ বৃদ্ধি করে।
  • ফুল ও ফল বড় করে।
  • দানা জাতীয় ফসলে কুশির সংখ্যা, বীজের পুষ্টতা এবং বীজে আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • পাতা হালকা সবুজ থেকে হলুদ হয়ে যায়।
  • নিচের দিকের পাতাগুলো প্রথমে হলুদ হয়।
  • গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
  • দানা জাতীয় ফসলের কুশির সংখ্যা ও বীজের পুষ্টতা হ্রাস পায়।
  • ফলন কমে যায়, ফল সঠিকভাবে পুষ্ট হয় না।
  • ফলগাছের পাতা ঝরে পড়ে।

 

২। ফসফরাস (Phosphorus)

উৎস:
বাংলাদেশে ফসফরাসের উৎস হিসেবে মূলত দুটি সার ব্যবহৃত হয়—টি.এস.পি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ও ডি.এ.পি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট)। টি.এস.পিতে ফসফেটের পরিমাণ থাকে শতকরা ৪৮–৫২ ভাগ এবং ডি.এ.পিতে থাকে প্রায় ৫৪ ভাগ।

কাজ:

  • উদ্ভিদের কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করে।
  • উদ্ভিদের সামগ্রিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে।
  • পার্শ্ব ও গুচ্ছ মূল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
  • খাদ্য পরিবহনে সহায়তা করে, ফলে ফল ও বীজের পুষ্টতা বৃদ্ধি পায়।
  • মাইটোকন্ড্রিয়ার স্বাভাবিক কাজের জন্য অপরিহার্য। মাইটোকন্ড্রিয়া হলো কোষের শ্বসনের কেন্দ্র ও শক্তির উৎস।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • পাতা বেগুনি বা লালচে বর্ণ ধারণ করে।
  • মূলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
  • কোষ বিভাজনে বিঘ্ন ঘটে, ফলে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয় এবং গাছ বামন আকৃতির হয়।
  • খাদ্য পরিবহন বিলম্বিত হওয়ায় ফসলের পরিপক্বতা দেরিতে ঘটে।
  • পাতা ও ফুলের সংখ্যা কমে যায়।
  • ফল ছোট হয় এবং সহজে ঝরে যায়।
  • ডাল জাতীয় ফসলে গুটি উৎপন্নকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রম ব্যাহত হয়।

 

৩। পটাশিয়াম (Potassium)

উৎস:
উদ্ভিদ মাটি থেকে আয়ন রূপে পটাশিয়াম শোষণ করে। মিউরেট অব পটাশ (এম.পি) সার পটাশিয়ামের প্রধান উৎস, এতে শতকরা ৫০–৬০ ভাগ পটাশিয়াম থাকে।

কাজ:

  • উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
  • পাতায় শর্করা উৎপাদনে সহায়তা করে।
  • কোষ বিভাজনে সহায়ক।
  • পত্ররন্ধ্র খোলা ও বন্ধ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • নাইট্রোজেন ও ফসফরাস শোষণে সাম্যতা বজায় রাখে।
  • দানাদার ফসল হেলে পড়ে না।
  • ফসলের খরা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • গাছের বৃদ্ধি ও উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
  • পাতার কিনারা তামাটে বর্ণ ধারণ করে।
  • দানাদার ফসল হেলে পড়ে যেতে পারে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
  • সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়।
  • খরা ও তুষারপাত সহ্য করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

 

৪। ক্যালসিয়াম (Calcium)

উৎস:
মাটিতে ক্যালসিয়াম লবণের মাধ্যমে বিদ্যমান থাকে। উদ্ভিদ এটিকে আয়ন হিসেবে শোষণ করে। জিপসাম বা ক্যালসিয়াম সালফেট ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে শতকরা প্রায় ২২ ভাগ ক্যালসিয়াম থাকে।

কাজ:

  • কোষ প্রাচীর গঠনে সহায়তা করে।
  • মূল গঠন ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
  • ডাল জাতীয় ফসলে ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • কচি পাতায় মারাত্মক রোগ দেখা দেয়।
  • মূলের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
  • পাতার স্বাভাবিক সবুজ বর্ণ বিবর্ণ হয়ে যায়।
  • ফুল ফোটার সময় কান্ড শুকিয়ে যেতে পারে এবং উদ্ভিদ নেতিয়ে পড়ে।
  • শীর্ষ কুঁড়ি বা শাখা মারা যায়।

 

৫। ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium)

উৎস:
ম্যাগনেসিয়াম মাটিতে লবণের আকারে থাকে এবং উদ্ভিদ এটি আয়ন রূপে শোষণ করে। ইপসম লবণ ম্যাগনেসিয়ামের একটি সাধারণ উৎস, যাতে শতকরা ৯.৬ ভাগ ম্যাগনেসিয়াম থাকে।

কাজ:

  • সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
  • ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • পাতার শিরার মাঝখানের অংশ হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
  • পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।

 

৬. গন্ধক (Sulfur)

উৎস:
গন্ধক সাধারণত মাটিতে সালফেট লবণ হিসেবে থাকে। উদ্ভিদ মূলত সালফেট (SO₄²⁻) ও সালফাইড (S²⁻) আয়ন আকারে গন্ধক শোষণ করে। গন্ধকের একটি পরিচিত উৎস হলো ক্যালসিয়াম সালফেট বা জিপসাম, যাতে প্রায় ১৪% গন্ধক থাকে।

গন্ধকের কাজ:

  • (i) উদ্ভিদের সবুজ কণিকা (ক্লোরোফিল) তৈরিতে সহায়তা করে।
  • (ii) তেলজাতীয় শস্যে তৈল উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
  • (iii) গাছের দৈহিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • (iv) লিগুমিনাস (ডালজাতীয়) ফসলের শিকড়ে নাইট্রোজেন গুটি উৎপাদনে সহায়তা করে।
  • (v) উদ্ভিদে নাইট্রোজেন আত্মিকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • (i) কোষ বিভাজনে বিঘ্ন ঘটে।
  • (ii) গাছ খর্বাকৃতি হয়।
  • (iii) পাতা ছোট ও বিবর্ণ হয়, বিশেষ করে কচিপাতা।
  • (iv) কান্ডের শীর্ষ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পার্শ্ব কুঁড়ি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

 

গৌণ পুষ্টি উপাদান: উৎস, কাজ ও অভাবজনিত লক্ষণ

১. লৌহ (Iron)

উৎস:
ফেরাস সালফেট সার লৌহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এটি মাটিতে প্রয়োগ করা যায় অথবা পাতায় স্প্রে করা হয়।

কাজ:

  • (i) সবুজ কণিকা (ক্লোরোফিল) গঠনে সহায়তা করে।
  • (ii) নাইট্রোজেন শোষণে সাহায্য করে।
  • (iii) জারক রসের ক্রিয়াশীলতা রক্ষায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • (i) কচি পাতার সবুজ রং বিবর্ণ হয়ে যায়।
  • (ii) পাতার সরু শিরার মধ্যবর্তী অংশ হলুদ রঙ ধারণ করে।
  • (iii) গাছ খর্বাকৃতি হয়।

 

২. দস্তা বা জিংক (Zinc)

উৎস:
জিংক সাধারণত খনিজ লবণ হিসেবে মাটিতে থাকে। উদ্ভিদ জিংক আয়ন আকারে গ্রহণ করে। জিংক সালফেট সার দস্তার একটি প্রচলিত উৎস, যাতে প্রায় ৩৬% দস্তা ও ১৭% গন্ধক থাকে।

কাজ:

  • (i) গাছের বৃদ্ধি, আমিষ গঠন ও শ্বসন প্রক্রিয়ায় জারণকার্যে সহায়তা করে।
  • (ii) ফুল ও ফল উৎপাদনে ভূমিকা রাখে।

অভাবজনিত লক্ষণ:

  • (i) কচি পাতার গোড়া বিবর্ণ হয়ে যায়।
  • (ii) পুরনো পাতা মরচে পড়া বাদামি থেকে হলুদাভ-কমলা রঙ ধারণ করে।
  • (iii) জমির চারার বৃদ্ধি অসমান হয়—কোথাও বড় কোথাও ছোট থাকে।
  • (iv) পাতার আকার ছোট হয় এবং অনেক পাতার কিনারা কুঁচকে যায়।