Tag Archives: কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র

মৎস্য চাষের গুরুত্ব

মৎস্য চাষ ও মাছ চাষ পদ্ধতির ধারণা – কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ বিষয়ের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১ নং ইউনিটের ১.৪ নং পাঠ। মৎস্য চাষ ও মাছ চাষ পদ্ধতির ধারণা বাংলাদেশে মাছ চাষের ইতিহাস খুব বেশী দিনের নয়। তবে নাজির আহমেদ (১৯৪৭—১৯৬০) নতুনভাবে এদেশে মাছ চাষের গোড়া পত্তন করেন। স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প পরিশ্রমে প্রচুর মাছ উৎপাদন এবং মাছের ব্যবসা হতে আর্থিক আয়ের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় কালক্রমে এ অঞ্চলে পুকুরে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দেশে বর্তমানে মাছের চাষ পদ্ধতিতে বেশ উন্নতি সাধিত হলেও এখনও বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প হিসেবে এটি গড়ে ওঠেনি।

 

মৎস্য চাষের গুরুত্ব

 

মৎস্য বা মাছ বলতে শীতল রক্ত বিশিষ্ট (ectothermic= cold blooded) জলজ মেরুদন্ডী প্রাণিকে বোঝায় যারা অভ্যন্তরিন ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য পরিচালনা করে এবং জোড় বা বিজোড় পাখনার সাহায্যে পানিতে চলাচল করে। তবে সব মাছই যে শীতল রক্তবিশিষ্ট এমনটি ভাবার অবকাশ নেই। কিছু মাছ আছে যেমন—White shark এবং Tuna মাছ তাদের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ পরিবেশের তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে তাদের দেহের তাপমাত্রার তারতম্য হয় না।

Fish Base এর তথ্য মতে অক্টোবর, ২০১৬ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৩৩,৪০০ প্রজাতির কথা জানা যায়। তবে অনেক প্রজাতি আছে যাদের সস্পর্কে এখনও বর্ণনা করা হয়নি অথবা এখনও অজানা। জানা মাছের প্রজাতির সংখ্যাটি মেরুদন্ডী প্রাণির অন্যান্য সকল শ্রেণীর (স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ ও পাখী) সম্মিলিত যোগফলের চাইতেও বেশী।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যখন আমরা মাছ বা মৎস্য বলি তখন শুধুমাত্র মাছকেই বোঝানো হয়। আর যখন মাৎস্য বলি তখন মাছের সাথে সাথে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন সকল জলজ প্রাণীকে বোঝায়।

জীববিজ্ঞানের যে শাখায় মাছের বিভিন্ন দিক যেমন— শ্রেনীবিন্যাস, মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা, মাছের প্রজনন, প্রতিপালন, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন, রোগতত্ত্ব তথা মাছ সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মৎস্যবিজ্ঞান বলে। বর্তমানে মাছ চাষের সাথে অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলজ প্রাণি যেমন— চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ, ব্যাঙ ইত্যাদি চাষ করা হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় মাছ চাষকে বলা হয় একোয়াকালচার (Aquaculture)।

Aquaculture শব্দটি Latin শব্দ Aqua’ যার অর্থ “পানি” এবং English শব্দ ‘culture’ যার অর্থ “চাষ” নামক দু’টি শব্দের সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ Aquaculture অর্থ পানিতে চাষ অথবা মাছ চাষ। অন্যভাবে, নিয়ন্ত্রিত বা অনিয়ন্ত্রিতভাবে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলজ জীবের চাষকে একোয়াকালচার বলে। একে অয়ঁধভধৎসরহম ও বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ: মাছ চাষ (Fish farming/culture), চিংড়ি চাষ (Shrimp farming/culture), ওয়েস্টার চাষ (Oyster farming/culture), সীউঈড চাষ (Seaweed farming/culture) ইত্যাদি।

 

 

মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব (Economic improtance of fish culture) :

পরিবেশিক ও প্রাকৃতিক কারণে মৎস্য চাষে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। “মাছে ভাতে বাঙালি”— প্রবাদ বাক্যটি বাংলাদেশের মৎস্য ঐতিহ্যেরই ইঙ্গিত বহন করে। মাছ এদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে। পুষ্টিমান উন্নয়ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার্জন, আর্থ—সামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাছ চাষের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে।

 

(১) পুষ্টিমান উন্নয়ন:

পুষ্টিগত দৃষ্টিকোন থেকে দেহগঠনে আমিষের ভূমিকা ব্যাপক। তুলনামূলক বিচারে প্রাণিজ আমিষ দেহের জন্য ভালো উচ্চ মূল্যের কারণে এদেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ দৈনন্দিন খাবারের সাথে প্রাণিজ আমিষ বিশেষ করে গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির মাংসের সংস্থান করতে পারে না। এই শ্রেণির মানুষের পুষ্টিমান উন্নয়নে মৎস্য আমিষের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।

সস্তায় পওয়া যায় এমন মাছ খেয়ে এদের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মিটে। শুধু এরাই নয়, এদেশের প্রায় সব শ্রেনির সব মানুষের কাছেই মাছ সমানভাবে প্রিয়। সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক যে পরিমান প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করে তার প্রায় ৬০% ই আসে মাছ এবং চিংড়ি থেকে। গুণগত মানে অন্যান্য আমিষের চেয়ে মৎস্য আমিষ ভালো।

পর্যাপ্ত পরিমান মাছ খেলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ে, রোগের ঝঁুকি কমে এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়। মিঠা ও লোনা পানির মাছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় যা মানুষের শরীরের জন্য বেশ উপকারি। এছাড়া আয়রণ ও জিংকের ভালো উৎস হলো ছোট মাছ। কাজেই মানুষের দৈনিক খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ খাওয়া উচিত। ২০১৫—১৬ অর্থবছরে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, এদেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমান ৬০ গ্রামে উন্নীতকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

 

(২) কর্মসংস্থান সৃষ্টি:

দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক বা ১ কোটি ৮৫ লক্ষ লোক হ্যাচারি পরিচালনা, মৎস্য চাষ, মৎস্য আহরণ, বিক্রি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি কাজের সাথে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। এসব কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশগ্রহণ করে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে প্রায় ১৫ লক্ষ নারী মৎস্যখাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মৎস্য সেক্টরে বেকার পুরুষ ও নারীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে প্রচলিত হ্যাচারির ব্যবহার আধুনিকায়ন করে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও চাহিদা—মাফিক মানসম্পন্ন পোনার উৎপাদন ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করত: সম্ভাব্য সকল জলাশয়কে আধুনিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। একই সাথে উৎপাদিত মৎস্য বিপণন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে যাতে করে মাছের গুণগত মান ঠিক থাকে এবং মাছ ও মাছজাত পণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত হয়। এসকল ক্ষেত্রে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বেকার নর—নারীদেরকে খাতওয়ারী প্রশিক্ষণের আওতায় এনে দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 

(৩) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন:

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দিনে দিনে এ সেক্টরের অবদান ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে মৎস্য খাতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় দেশ।কাজেই, এখাতের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

 

(৪) আর্থ:

সামাজিক উন্নয়ন: বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে অসংখ্য পুকুর ডোবা ছড়িয়ে আছে। এসব পুকুরের সিংহভাগ মাছ চাষের আওতায় আনা হলেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখনও পতিত। পতিত বা আপাত মাছ চাষ অযোগ্য এসব পুকুরের মালিকানা দেশের প্রান্তিক চাষী বা বিত্তহীনদের হাতে। সংস্কারের মাধ্যমে এ সমস্ত পুকুরে মাছ চাষ করে বিত্তহীন লোক এবং বেকার যুবকদের আর্থ—সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

 

(৫) হাঁস:

মুরগির খাদ্য:

বাংলাদেশে হাঁস—মুরগির চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।

সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে এদের খাদ্যের চাহিদা। মাছের অব্যবহৃত অংশ যেমন—আঁইশ, কাটা, নাড়িভঁুড়ি ইত্যাদি এবং ফিসমিল (ঋরংযসবধষ) দ্বারা হাঁস—মুরগির জন্য উত্তম সুষম খাদ্য তৈরী করা সম্ভব। এসব আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য হাঁস—মুরগিকে খাওয়ালে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

 

(৬) পতিত জমির সদ্ব্যবহার:

পতিত/অব্যবহৃত জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করলে পারিবারিক মাছের চাহিদা মেটানোর সাথে সাথে আর্থিকভাবেও কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।

কাজেই উপরের আলোচনা থেকে এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশে মাছ চাষের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

 

 

শস্য পরিকল্পনা, শস্য পঞ্জিকা ও শস্য আবর্তন

শস্য পরিকল্পনা, শস্য পঞ্জিকা ও শস্য আবর্তন – কৃষি শিক্ষা ২য় পত্রের একটি পাঠ। এই পাঠটি ১৭ নং ইউনিটের ১৭.৫ নং পাঠ। শস্য পরিকল্পনা সাফল্যজনকভাবে ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত হল শস্য পরিকল্পনা। বৈজ্ঞানিক ও সঠিকভাবে শস্য পরিকল্পনা প্রনয়ন করলে ফসল উৎপাদনের ধারা বজায় থাকবে এবং উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে যাবে।

শস্য পরিকল্পনা যেমন— প্রাকৃতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে তেমনি কৃষকের পারিবারিক খাদ্য চাহিদা, শ্রম ও পঁুজির সংস্থান, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হয়।

শস্য পরিকল্পনা, শস্য পঞ্জিকা ও শস্য আবর্তন

 

সাধারণভাবে শস্য পরিকল্পনা প্রনয়নের জন্য পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক বাজেট করতে হবে। যেসব অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে বিবেচনা করতে হবে তা হলো—

ক) পারিবারিক খাদ্য চাহিদা।

খ) কৃষকের মোট জমির পরিমান।

গ) পারিবারিক শ্রমের পরিমান।

ঘ) উপকরণ খরচ ও পঁুজির পরিমান।

ঙ) ঋনের সংস্থান।

চ) আগাম জাতের ফসল।

ছ) ফসল চক্র অণুসরণ করা।

জ) ফসলের দাম।

ঝ) নগদ অর্থের চাহিদা।

 

শস্য পঞ্জিকা:

শস্য পঞ্জিকা সঠিক শস্য নির্বাচন এবং সফলভাবে শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন একটি নির্দেশিকা। এই নির্দেশিকাই শস্য পঞ্জিকা। ফসলের জীবনকাল, উৎপাদন কৌশল প্রভৃতি তথ্যাবলিকে সারণি ছক, রেখাচিত্র বা চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপনাকে ফসল পঞ্জিকা বলে, অর্থাৎ কোন মাসে কোন কাজ সম্পাদনা করতে হবে তার সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনাই শস্য পঞ্জিকা।

 

শস্য পঞ্জিকার প্রকারভেদ:

শস্য পঞ্জিকা নিম্ন লিখিতভাবে তৈরি করা যায়।

ক) ছক/সারণিমূলক: এই শস্য পঞ্জিকাতে সারণির মাধ্যমে ফসল সংক্রান্ত ও চাষাবাদ কলাকৌশল তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

১। বিস্তারিত/বর্ণনামূলক।

২। মাসওয়ারী/কাজভিত্তিক।

খ) রেখাচিত্র: এ ধরনের পঞ্জিকায় রেখাচিত্রের মাধ্যমে শস্যে বপনকাল, বৃদ্ধির, পাকার এবং কর্তনের সময় প্রকাশ করা হয়।

গ) ছবি সম্বলিত: এই পঞ্জিকায় ফসলের চাষাবাদ কৌশল বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। নিরক্ষর কৃষকগণের জন্য পঞ্জিকা উপযোগী তবে ব্যয়বহুল।

 

শস্য পঞ্জিকার গুরুত্ব:

১। ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন কলাকৌশল সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়।

২। বিভিন্ন ফসলের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা যায়।

৩। শস্য পর্যায় তালিকা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৪। শস্য চাষ পরিকল্পনা প্রণয়নে সহজতর করে।

৫। খামার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।

৬। কোন কারনে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হলে ফসল পঞ্জিকার মাধ্যমে সেই স্থানে বিকল্প ফসল চাষ করা যায়।

৭। ফসল উৎপাদনের আয়ব্যয় হিসাব করা সহজ হয়।

শস্য পর্যায় বা ফসল চক্র :

একটি নির্দিষ্ট ভূ—খন্ডে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচিত কিছু শস্য ধারাবাহিকভাবে জন্মানোকে শস্য পর্যায় বলে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এবং মাটির উর্বরতা সংরক্ষনের জন্য সঠিক শস্য পর্যায় বা শস্য চক্র অনুসরন করা অত্যাবশ্যক। শস্য পর্যায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ফসলগুলো সাজাতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পর্যায়ক্রমে চাষ করতে হবে। শস্য পর্যায় সাধারণত ২—৪ বছর হলে লাভজনক ফসল উৎপাদন সম্ভব।

শস্য পর্যায়ের নীতিমালা:

১। স্থানীয় জলবায়ু, মাটি ও আর্থ—সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করতে হবে।

২। অগভীর শস্য উৎপাদনের পর গভীর শস্য উৎপাদন করতে হবে।

৩। অধিক পুষ্টি উপাদান শোষণকারী ফসলের পর কম খাদ্যেপাদান শোষনকারী ফসলের চাষ করতে হবে।

৪। অধিক লাভজনক ফসল নির্বাচন করতে হবে। যেমন— শহর এলাকার নিকট শাক সবজি, চিনি কলের পাশে আখ ও পাট কল শিল্প এলাকার পাশে পাট ফসল নির্বাচন করতে হবে।

৫। পশু খাদ্যের উপযোগী ফসল শস্য পর্যায়ে অন্তভূর্ক্ত করতে হবে।

৬। শস্য পর্যায় এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সারাবছর শ্রমিকের কাজ থাকে।

৭। স্থানীয় চাহিদা ও বাজার ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে ফসল নির্বাচন করতে হবে। ৮। তিন বা চার বছর পর এক মৌসুম জমি পতিত রাখতে হবে।

 

শস্য পর্যায় অবলম্বনের মৌলনীতি :

প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারের মাধ্যমে মানসম্পন্ন অধিক ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে নিম্নবর্ণিত বিষয় বিবেচনা করতে হবে।

১. এলাকার জলবায়ু ও মাটিতে অভিযোজিত ফসলসমূহ হতে কৃষকের পারিবারিক চাহিদা (খাদ্য, নগদ অর্থ, গো—খাদ্য ইত্যাদি) ও বাজারমূল্য বিবেচনায় লাভজনক ফসল নির্বাচন করতে হবে।

২. ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রযুক্তির প্রাপ্যতা বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করা।

৩. লিগুমিনোসী পরিবারের ফসল নির্বাচন করা।

৪. গভীরমূলী/অগভীরমূলী ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করা।

৫. সবুজ সার ফসল চাষ করা।

 

 

শস্য পর্যায়ের সুবিধা:

১। বছরে একাধিক ফসল পাওয়া যায়।

২। জমির উর্বরতা রক্ষা পায়।

৩। কৃষকের সুষম খাবারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে।

৪। মোট উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধি পায়।

৫। সারা বছর শ্রমিকের কাজের সৃষ্টি হয়।

৬। খামার ব্যবস্থাপনার কাজ সুশৃঙ্খল হয়।

 

শস্য পর্যায়ের অসুবিধা:

১। শস্য পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী ফসল অন্তভুক্তর্ করা যায় না।
২। বাজার মূল্যের কারণে শস্য পর্যায় ব্যাহত হতে পারে। ৩। সব এলাকায় শস্য পর্যায় অবলম্বন সম্ভব হয় না।

 

কখন শস্য পর্যায় বাস্তবায়ন হয় না:

১. ফসলের বাজার মূল্য অস্থিতিশীল থাকলে।

২. নির্বাচিত ফসলের বীজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের দু®প্রাপ্যতা হলে।

৩. ভূমির বন্ধুরতার কারণে কোন এলাকায় বিশেষ কোন ফসল অধিক লাভজনক হলে।

৪. বর্ষজীবি উদ্ভিদ চাষ করলে শস্য পর্যায় অবলম্বন সম্ভব হয় না।

 

 

শস্য পর্যায় সিডিউল তৈরির ধাপসমূহ:

১. সাধারণত যত বছরের জন্য শস্য পর্যায় অবলম্বন করা হবে জমিকে ততটি খন্ডে বিভক্ত করা হয়। তবে জমি বেশি বড় হলে গুণিতক সংখ্যক ভাগে বিভক্ত করে একই শস্য পর্যায়’ সিডিউল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

২. খামারে জমির বন্ধুরতার ভিন্নতা থাকলে তা বিবেচনায় পৃথক শস্য পর্যায়’ সিডিউল তৈরি করতে হবে।

৩. শস্য পর্যায়ের মেয়াদ ও নির্বাচিত জমি কয় ফসলী অর্থাৎ বছরে কোন কোন মৌসুমে ফসল উৎপাদন হয় তা বিবেচনা করে ফসলের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। যেমন ৪ বছরের জন্য শস্য পর্যায় ‘সিডিউল করার ক্ষেত্রে ৪  ৩ = ১২ টি ফসল নির্বাচন করতে হবে।

৪. ফসল নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌসুম এবং মূলনীতি বিবেচনা করতে হবে যাতে কৃষকের চাহিদা ও জমির উর্বরতা রক্ষা হয়।

৫. ১ বছরের সিডিউল তৈরি করলেই ৪ বছরের সিডিউল সহজেই তৈরি করা যায়।

 

কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণ

কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণ – পাঠটি বাউবির “কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র” বিষয় এর ইউনিট – ১৮, পাঠ – ১৮.৪। কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে ভোক্তার কাছে পৌছান হয়। কৃষকদের যাতে উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষি পণ্য বিভিন্ন পাইকার, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠারেন হাত ঘুরে ভোক্তার নিকট পৌছানোর প্রক্রিয়াই হলো বাজারজাতকরণ।

কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণ

 

নিম্নে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণের মূল উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব আলোচনা হলো :

ক) কৃষক শুধু নিজের ভোগের জন্য পণ্য উৎপাদন করে না। তাই কৃষি পণ্যের উন্নত বাজার কৃষি উন্নয়নের মূল উৎপাদিকা শক্তি। অন্যদিকে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করায় সমবায় ব্যবস্থাকে আয় বৃদ্ধির একটি অন্যতম উপায় বলা যায়।

খ) উন্নত বাজার ব্যবস্থা যেমন ভোক্তাদের উপযোগ বৃদ্ধিতে সাফল্য করে তেমনি উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের বাজারজাতকরণ বিশেষ ভূমিকা রাখে।

গ) বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে কৃষি পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পায় ফলে কৃষকরা অধিক উৎপাদনের জন্য উৎসাহী হয় এবং তাদের আয় বৃদ্ধি ঘটে।

ঘ) উন্নত বাজার ব্যবস্থা বিরাজমান থাকলে পণ্যের অধিক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে পণ্যের গুনগতমান বৃদ্ধির তাগিদ সৃষ্টি হয় । ঙ) উন্নত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব।

চ) উন্নত বাজার ব্যবস্থায় প্রতিটি পণ্যের চাহিদা মূল্য নির্দেশ করে। এরূপ মূল্যের স্থিতিশীলতা উৎপাদন পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের সুযোগ প্রদান করে।

ছ) একটি উন্নত বাজার ব্যবস্থাই কৃষি উৎপাদনের পরিমান ও গুণগতমান নির্ধারন করে থাকে। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন বাজার ব্যবস্থার দক্ষতার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

 

বাংলাদেশে কৃষি পণ্যর বাজারজাতকরণের সমস্যাবলী:

ক) পণ্যের নিম্নমান :

নানান কারণে আমাদের কষি পূ ণ্যের মান নিম্নমুখী হয়ে থাকে। যেমন- উন্নত বীজের অভাব, শস্য উৎপাদনকালে থাকৃতিক বিপর্যয়, পোক-মাকড়ের আক্রমন, ফসল কর্তনের উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ না করা, সংরক্ষনের ভালো ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি কারণে কৃষিপণ্যের গুনগুন নিম্ন হয়। ফলে কৃষক পণ্যের ভালো দাম পায় না।

 

খ) কৃষকের দারিদ্রতা :

কৃষকরা দরিদ্র হওয়ার কারণে পণ্য গুদামজাত করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করে ভালো দাম পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না বিধায় ফসল উঠার পর পরই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

 

গ) মধ্যস্বস্তভোগীদের শোষণ :

এদেশে কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে মধ্যস্বত্তভোগীদের অবস্থানের কারণে কৃষক সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারে না। ফলে ভোক্তা বেশি দামে পণ্য কিনলেও কৃষক তার সুফল পায় না।

 

ঘ) অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা:

সুষ্ঠ ও সহজ পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য দূরের বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে বেশি দামে বিক্রির সুযোগ পায় না ফলে কৃষক তার দোরগেড়ায় কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

 

ঙ) স্থান ভেদে কৃষি পণ্যের বিভিন্ন দাম :

বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের বাজারগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় একই পণ্যের দাম স্থান ভেদে ভিন্ন হয়। এত কম দামের বাজারে বিক্রয়কারী কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

 

কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণে সমবায়ের ভূমিকা :

ক) সমবায় আত্মসচেনতা সৃষ্টি করে সমবায় তার সদস্যদের মধ্যে কৃষি পণ্য বিপণনে ঐক্য ও সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করে। ফলে কৃষকের পণ্য বিক্রি করার সময় ঠকার আশংকা কমে যায়।

খ) উচ্চমূল্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে কৃষকরা সমবায় সমিতি গঠনের ফলে বাজারে ক্রিয়াশীল মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম কমে যায়। ফলে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তাদের নিকট পণ্য বিক্রির সুযোগ পেয়ে পণ্যের উচ্চমূল্য পেয়ে থাকে।

গ) বাজারজাতকরণ খরচ কমে—সমবায়ের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাতকরণের ফলে সামগ্রিকভাবে পণ্য পরিবহন, প্যাকেজিং, গুদামজাতকরণ ইত্যাদির খরচ হ্রাস পায়।

ঘ) ফড়িয়াদের দৌরাত্ম কমে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা সংঘবদ্ধ হওয়ার কারণে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষকরা বাধ্য হয় না। ফলে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম সমবায় বাজারসমূহে হ্রাস পায়।

ঙ) সহজে ঋণ প্রাপ্তি— সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরা খুব সহজে ঋণ পেতে পারে। ফলে ফসল মৌসুমে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির ঝুকি কমে যায়।

চ) বাজারের হালনাগাদ তথ্য প্রাপ্তিতে সাহায্য করে— সমবায়ের মাধ্যমে কৃষক বাজারের চাহিদা, বাজার দর, ভবিষ্যৎ চাহিদা সংক্রান্ত তথ্য খুব সহজে পেয়ে যায়। ফলে কৃষক তার পণ্য উৎপাদিত ও বাজারজাতকরণ পরিকল্পনা মাফিক কররে পারে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয় না।

ছ) কৃষি উপকরণ সরবরাহ— সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় বীজ, সার, কীটনাশক ও কৃষি যন্ত্রপাতি একত্রে সংগ্রহ করে বিতরণ করায় মূল্য কম পড়ে এবং উপকরণ প্রাপ্তি সহজসাধ্য হয়।

জ) সঞ্চয়ের উৎসাহ— সমবায় সমিতির সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সাপ্তাহিক অথবা মাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় জমা করার নিয়ম থাকায় কৃষকরা সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ হয়।

ঝ) পণ্যের মান উন্নয়ন হয়— সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত কৃষকরা মানসম্মত কৃষি উপকরণ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে বিধায় পণ্যের মান উন্নত হয়।

ঞ) বাজার নিয়ন্ত্রন সম্ভব হয়— সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি পণ্যের বিপণন সুবিধা সৃষ্টি হলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রয় করা হয় বলে বাজার কৃষকদের নিয়ন্ত্রনে থাকে।

ট) পরিবহন ও গুদামজাতকরণে সুবিধা হয়— দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সমিতির নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারজাতকরণের ও গুদামজাতকরণের সুবিধা থাকে বলে পণ্য নষ্ট ও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।