Tag Archives: কৃষি সম্প্রসারণ

কৃষি সম্প্রসারণ

শিলা ও খনিজ পরিচিতি

শিলা ও খনিজ পরিচিতি [ ব্যবহারিক ] নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “কৃমৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের ২ নং ইউনিটের ২.৬ নং পাঠ। মৃত্তিকা একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক মিশ্র পদার্থ। ক্ষয়ীভূত শিলা ও খনিজ দ্রব্যের সাথে বিভিন্ন রকম জৈবদ্রব্য পানি ও বায়ুর মিশ্রণই মৃত্তিকা। ফলে বিভিন্ন স্থানের মৃত্তিকার গুণাবলীতে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। কণার আকার, বুনট, সংযুক্তি, ঘনত্ব, বর্ণ, বায়ুচলাচল, তাপমাত্রা প্রভৃতি মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য। বুনট ও সংযুক্তি মৃত্তিকার দুটি মৌলিক ধর্ম কারণ এ দুটি উপাদান মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদনক্ষমতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া মৃত্তিকার ঘনত্ব, রক্ত পরিসর, দৃঢ়তা, তাপমাত্রা, বর্ণ ইত্যাদি সামগ্রিকভাবে মৃত্তিকায় ফসল উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।

শিলা ও খনিজ পরিচিতি

সুতরাং মৃত্তিকাকে সফলতার সাথে কৃষি কাজে ব্যবহার করতে হলে উল্লিখিত ভৌত বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ ইউনিটে মৃত্তিকার কণা, মৃত্তিকার গঠন ও বুনট, সংযুক্তি, ঘনত্ব, বর্ণ ও তাপমাত্রা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্তিকার কণা (Soil seperates), বুনট, সংযুক্তি, ঘনত্ব, রন্ধ্র পরিসর, বর্ণ, তাপমাত্রা ইত্যাদি হলো। মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য।

এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভরশীল। মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মৃত্তিকা পদার্থ বিদ্যা (Soil Physics) বলা হয়। মৃত্তিকা পদার্থবিদ্যা মৌলিক ও ব্যবহারিক মৃত্তিকা বিজ্ঞানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রযুক্তিবিদ্যায় মৃত্তিকা পদার্থবিদ্যার গুরুত্ব অনেক বেশি।

উপকরণ

১। বিভিন্ন ধরণের শিলা ও খনিজের নমুনা
২। টেবিল
৩। আতশী কাচ (magnifying glass )
৪। সাদা কাগজ
৫। বিভিন্ন শিলা ও খনিজের বৈশিষ্ট্যের তালিকা
৬। HCI

কাজের ধাপ

১। টেবিলের উপর সাদা কাগজ রেখে তাতে একটি শিলা বা খনিজের নমুনা রাখুন।

২। আতশী কাচ দিয়ে নমুনাটি ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।

৩। দানার গঠন প্রকৃতি, বর্ণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহ লিপিবদ্ধ করুন। প্রয়োজনে কয়েক ফোঁটা

৪। HCI নমুনার উপর ফেলুন।

৫। পর্যবেক্ষণকৃত নমুনাটির বৈশিষ্ট্য প্রদত্ত তালিকার শিলা ও খনিজ সমূহের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে দেখুন।

৬।  প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী পর্যবেক্ষণকৃত নমুনার নাম ও শ্রেণি লিপিবদ্ধ করুন। অনুরূপ পদ্ধতিতে প্রতিটি নমুনা শনাক্ত করুন।

৭। বৈশিষ্ট্যসহ শনাক্তকৃত নমুনার বিবরণ ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করুন।

 

 

মৃত্তিকার বর্ণ ও তাপমাত্রা

মৃত্তিকার বর্ণ ও তাপমাত্রা – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের, ২ নং ইউনিটের ২.৫ নং পাঠ।

মৃত্তিকার বর্ণ ও তাপমাত্রা

 

মৃত্তিকা বর্ণ কী (What is soil colour)?

মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম। আলোক বিজ্ঞানের ভাষায়, মৃত্তিকা থেকে যে আলো প্রতিফলিত হয়ে চোখে ফেরত আসে তাকে মৃত্তিকা বর্ণ বলে। আপনি নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন, ভূ-পৃষ্টের বিভিন্ন জায়গার মাটি বিভিন্ন ধরনের।

যেমন : পাহাড়ী অঞ্চলের মাটি সাধারণত লাল, কিন্তু নিচু এলাকার মাটি কিছুটা কালচে বর্ণের হয়। এ ছাড়া একই স্থানে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রের বিভিন্ন স্তর বা হরাইজনে বিভিন্ন বর্ণের মৃত্তিকা দেখা যায়। আপনিকী কখনো ভেবে দেখেছেন মৃত্তিকা বর্ণের এসব পার্থক্য কেন হয়? মৃত্তিকার এ সব বর্ণবৈষম্যের জন্য অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ দায়ী। এসব কারণ সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই ধারনা থাকা প্রয়োজন। কারণ কোন স্থানে মৃত্তিকায় ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা এবং কোন ধরনের ফসল ভাল জন্মাবে তা এর বর্ণ দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়।

 

 

মৃত্তিকা বর্ণের কারণ (Causes of soil colour):

কোন স্থানের মৃত্তিকা লাল, বাদামী, গাঢ় বাদামী কিংবা ধূসর হওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এসব কারণগুলো হলো নিম্নরূপ:

উৎস দ্রব্য (Parent material) :

মৃত্তিকা সৃষ্টিতে উৎস দ্রব্যের প্রভাব সম্পর্কে পূর্ববর্তী ইউনিটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। উৎস দ্রবা মৃত্তিকা বর্ণের অন্যতম কারণ। বিভিন্ন স্থানের মাটি বিভিন্ন রকমের উৎস দ্রব্য থেকে সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকা বর্ণ নির্ভর করে এসব উৎস দ্রব্যের রাসায়নিক সংস্থিতির (chemical composition) ওপর। যেহেতু উৎস দ্রব্য নানা ধরনের খনিজের সমন্বয়ে গঠিত কাজেই এসব খনিজের বর্ণ মাটির বর্ণে প্রভাব ফেলে। যেমনঃ লাল স্যান্ড স্টোন (red sand stone) হতে যে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয় তা লাল বর্ণের হয়। লাল বর্ণের এসব মৃত্তিকাকে লিথোক্রোমিক (lithochromic) মৃত্তিকা বলে।

জৈব পদার্থ :

আমরা জানি, উৎস দ্রব্যের সাথে বিভিন্ন জীবের দেহাবশেষ মিলে জলবায়ুর ক্রিয়ায় দীর্ঘসময় পর মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকার এসব জীবদেহের অবশেষকে মৃত্তিকা জৈব পদার্থ বলে। জৈব পদার্থ কার্বন সমৃদ্ধ বলে জৈব পদার্থের উপস্থিতিতে মৃত্তিকা গাঢ় বর্ণের হয়। যে সব মৃত্তিকায় জৈব পদার্থ অধিক থাকে সেসব মৃত্তিকার বর্ণ গাঢ় ধূসর বা বাদামী থেকে কাল বর্ণ হয়ে থাকে। আবার যে সব মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ কম সেগুলো সাধারণত হালকা বাদামী, হলুদ কিংবা সাদাটে বর্ণের হয়।

লৌহ দ্রব্যের উপস্থিতি :

মৃত্তিকায় সাধারণত বিভিন্ন ধরনের লৌহ অক্সাইড ও অন্যান্য মৌলের সাথে লৌহের বিভিন্ন যৌগ উপস্থিত থাকে। লৌহ অক্সাইড ও লৌহের অন্যান্য যৌগের উপস্থিতি মৃত্তিকা বর্ণে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এদেশে মধুপুর, সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকায় মৃত্তিকা লৌহ যৌগের আধিক্যের জন্য লালচে বা হলুদ বর্ণের। লৌহ যৌগের উপস্থিতিতে মৃত্তিকা গাঢ় বাদামী, লাল কিংবা হলুদ বর্ণের হতে পারে।

সিলিকা ও চুন দ্রব্যের উপস্থিতি :

মৃত্তিকায় সিলিকা, চুনদ্রব্য বা অন্যান্য লবণ দ্রবীভূত থাকলে তার বর্ণ সাদা বা ধূসর হয়। সমুদ্র সৈকতে কিংবা নদীর মোহনায় এ বর্ণের মৃত্তিকা পাওয়া যায়।

জলাবদ্ধতা :

মৃত্তিকায় পানি জমে থাকলে সেখানকার বায়ু অপসারিত হয়। ফলে মৃত্তিকায় বিদ্যমান বিভিন্ন মৌলিক বা যৌগিক পদার্থে বিজারণ ঘটে। অক্সিজেনের অনুপস্থিতি এ ধরনের বিজারণে জন্য দায়ী। যেমনঃ লাল বর্ণের ফেরিক অক্সাইড সমৃদ্ধ সুনিষ্কশিত মৃত্তিকা জলাবদ্ধ হলে ফেরিক অক্সাইড বিজারিত হয়ে ফেরাস অক্সাইডে পরিণত হয়। ফলে মৃত্তিকা হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এসব ছাড়াও মৃত্তিকা বর্ণের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী আরও অনেক উপাদান রয়েছে। যেমন : মৃত্তিকা পানি তলের (water table) উঠানামা, বায়ুচলাচল ইত্যাদি।

 

 

মৃত্তিকা বর্ণ পরিমাপ:

মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকার উর্বরতা, উৎপাদন ক্ষমতা, ফসলের প্রকার ইত্যাদি পরিমাপের পূর্ব শর্ত। কৃষিকাজে মৃত্তিকার অর্থনৈতিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা বর্ণের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং চাষাবাদের পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্বে মৃত্তিকা বর্ণ পরিমাপ করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত মৃত্তিকা বর্ণ একটি আদর্শ বর্ণের চার্টের সাথে তুলনা করে নির্ণয় করা হয়। এ কাজে মুনসেল রঙ্গীন চার্ট (Munsell colour notation) ব্যবহার করা হয়। চার্টের বর্ণের সাথে মৃত্তিকা নমুনার বর্ণের তুলনা করে সহজেই মৃত্তিকার বর্ণ নির্ণয় করা যায়।

 

 

কৃষিতে মৃত্তিকা বর্ণের গুরুত্ব ( Importance of soil colour in agriculture):

মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকার একটি অন্যতম ভৌত গুণ। কোন মৃত্তিকায় কী কী রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে এবং এতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ ও উদ্ভিদ খাদ্যোপাদান সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারনা এর বর্ণ দেখে অনুমান করা যায়। মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম উপাদান। আর উল্লিখিত উপাদানসমূহ ফসল নির্বাচন, চাষাবাদ কৌশল এবং ফসলের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। যাহোক মৃত্তিকা বর্ণের গুরুত্ব সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

১। মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকা শ্রেণিবিন্যাসের অন্যতম নিয়ামক ( factor) যেমন : লাল মৃত্তিকা, কাল মৃত্তিকা, বাদামী মৃত্তিকা ইত্যাদি।

২। বর্ণ মৃত্তিকার উর্বরতা অনুমান করতে সহায়তা করে। যেমন : কাল বা বাদামী মৃত্তিকা তুলনামূলকভাবে বেশি উর্বর কারণ তাতে অধিক জৈব পদার্থ থাকে।

৩। মৃত্তিকা বর্ণ সরাসরি মৃত্তিকা তাপমাত্রায় প্রভাব ফেলে। কাল বর্ণের মৃত্তিকার তাপশোষণ ক্ষমতা বেশি অন্যদিকে হালকা বর্ণের মৃত্তিকার তাপশোষণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম। যেহেতু মৃত্তিকা তাপমাত্রার ওপর এর রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি নির্ভরশীল সে জন্য মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকায় রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি প্রকৃতি নির্ধারণে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।

৪। মৃত্তিকার অন্যান্য ভৌত ধর্ম যেমন: বুনট / সংযুক্তি, (Structure) দৃঢ়তা, আঁঠালোতা ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

৫। মৃত্তিকা অণুজীবের বৃদ্ধি, উন্নয়ন মৃত্তিকা বর্ণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ ছাড়া মৃত্তিকার রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং মৃত্তিকায় উপস্থিত রাসায়নিক মৌল ও যৌগের উপস্থিতি মৃত্তিকা বর্ণ দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়।

 

 

 

মৃত্তিকা তাপমাত্রা কী (What is soil temperature)?

মৃত্তিকা বর্ণের ন্যায় মৃত্তিকা তাপমাত্রা মৃত্তিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভূ-ত্বক যে সূর্য কিরণ শোষণ করে তাকে মৃত্তিকা তাপমাত্রা বলে। তবে শুধুমাত্র সূর্য কিরণই মৃত্তিকা তাপমাত্রার একমাত্র উৎস নহে। পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ তাপও মৃত্তিকা তাপমাত্রার একটি উৎস। ইতোপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি মৃত্তিকা বর্ণ মৃত্তিকা তাপমাত্রার একটি অন্যতম নিয়ামক। কারণ গাঢ় বর্ণের মৃত্তিকা অপেক্ষা হালকা বর্ণের মৃত্তিকা বেশি সূর্য কিরণ শোষণ করতে পারে। ফলে গাঢ় বর্ণের মৃত্তিকার তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি।

মৃত্তিকা দিনের বেলা সৌর তাপ শোষণ করে উত্তপ্ত হয় এবং রাতে তা বিকিরণ করে শীতল হয়। মৃত্তিকা তাপমাত্রার ওপর মৃত্তিকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি প্রকৃতি নির্ভরশীল। আর এসব রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা উদ্ভিদের মূল দ্বারা পুষ্টি উপাদানের শোষণ প্রভাবিত হয়৷ কাজেই সফলভাবে ফসল উৎপাদনের জন্য মৃত্তিকা তাপমাত্রা সম্পর্কে বিশদ জানা আবশ্যক।

মৃত্তিকা তাপমাত্রার উৎস :

মৃত্তিকা তাপের প্রধান উৎস সূর্য রশ্মি। তবে মৃত্তিকা জৈব পদার্থের বিযোজন ও অন্যান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ মৃত্তিকা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সূর্য থেকে সমান তাপ পেলেও সকল মৃত্তিকা সমানভাবে উত্তপ্ত হয় না। এর জন্য মৃত্তিকা অভ্যন্তরস্থ ও বাহ্যিক অনেকগুলো কারণ দায়ী। এসব কারণ নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা রয়েছে। তবে কোন মৃত্তিকার এলবেডো (Albedo) সংখ্যা যত বেশি হয় মৃত্তিকার তাপমাত্রা তত কম হয়। এলবেডো (Albedo) হলো মৃত্তিকায় পতিত সূর্যকিরণ ও প্রতিফলিত সূর্যকিরণের সরাসরি অনুপাতের ফল।

মৃত্তিকার বর্ণ গাঢ় হলে এবং আর্দ্রতা বেশি হলে সূর্যকিরণ কম প্রতিফলিত হয়। এছাড়া মৃত্তিকার উপরিভাগ মসৃন না হয়ে কিছুটা উঁচু নিচু হলে তা অধিক তাপ শোষণ করতে পারে।

মৃত্তিকা তাপমাত্রার ওপর প্রভাবকারী উপাদানসমূহ (Factors affecting soil temperature) :

মৃত্তিকা তাপমাত্রা অনেকগুলো উপাদান (factors) দ্বারা প্রভাবিত হয়। একটু পর্যবেক্ষণ করলেই সহজে ধরা পড়বে যে, বেলে মাটি সূর্য কিরণে খুব দ্রুত উত্তপ্ত হয়। অর্থাৎ বেলে মাটির ক্ষেত্রে উপরের মাটির তাপমাত্রা এবং নিচের মাটির তাপমাত্রার তফাৎ খুব বেশি। এ ছাড়া এ মাটি খুব দ্রুত শীতল হয়। কিন্তু এঁটেল মাটি সৌর তাপে ধীর গতিতে উত্তপ্ত হয়। তবে তা দ্রুত নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে উপর ও নিচের মাটির তাপমাত্রা তফাৎ কম। এ মাটি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে থাকে।

সুতরাং এ আলোচনা থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে মৃত্তিকা বুনট মৃত্তিকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী একটি অন্যতম কারণ। অনুরূপভাবে মৃত্তিকা বর্ণও আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা মৃত্তিকার তাপমাত্রা বহুলভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। এসব হলো মৃত্তিকার অভ্যন্তরীণ উপাদান। এছাড়াও বাহ্যিক অনেকগুলো উপাদান রয়েছে যা মৃত্তিকা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন : অক্ষাংশ, জলবায়ু, ঋতু ইত্যাদি। যাহোক যেসব উপাদানসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্তিকা।

তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তা নিচে তুলে ধরা হলো :

১। মৃত্তিকা বুনট

২, মৃত্তিকা সংযুক্তি

৩। অক্ষাংশ

8। আবহাওয়া ও জলবায়ু

৫। ঋতু.

৬। মৃত্তিকাস্থ পানির পরিমাণ ও বাষ্পায়ন

৭। ঢাল ও দিক (Slope and aspect

৮।  মৃত্তিকাস্থ পানি স্তরের উচ্চতা

৯। দ্রবীভূত লবণের ঘনত্ব

১০। জৈব পদার্থের বিয়োজন

১১। কর্ষণ ও মালচিং

১২। মৃত্তিকায় কী ধরনের ফসল রয়েছে, প্রভৃতি।

 

 

মৃত্তিকা তাপমাত্রার গুরুত্ব :

মৃত্তিকা তাপমাত্রা মৃত্তিকার অনেক রাসায়নিক ধর্ম এবং কিছু কিছু ভৌত ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ফলে কৃষিকাজে মৃত্তিকাকে সফলভাবে ব্যবহার করতে হলে মৃত্তিকা তাপমাত্রার গুরুত্ব সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা আবশ্যক। নিচে সংক্ষেপে মৃত্তিকা তাপমাত্রার গুরুত্ব তুলে ধরা হলো :

১। মৃত্তিকাস্থ রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে তাপমাত্রা একটি অন্যতম উপাদান। বিজ্ঞানীদের মতে, কোন স্থানের মৃত্তিকা তাপমাত্রা ১০°সে. বৃদ্ধি পেলে সেখানকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেজনা উচ্চ তাপমাত্রায় জৈবপদার্থের বিয়োজন দ্রুত সংঘটিত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলের মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ সাধারণত কম থাকে। এছাড়া মৃত্তিকাস্থ বিভিন্ন আয়নের (NO3, Cath, K’ ইত্যাদি) স্থিতিশীলতা (persistance) এবং আয়ন বিনিময় (Ion exchange) মৃত্তিকা তাপমাত্রা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

২। মৃত্তিকাস্থ অণুজৈবিক কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণে তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মৃত্তিকাস্থ তাপমাত্রার ওপর কোন মৃত্তিকায় কী কী অণুজীব (Microorganism) বর্তমান থাকবে তা নির্ভর করে। এদের বংশবিস্তার, বৃদ্ধি ও উন্নয়ন এবং মৃত্তিকায় এসব অণুজীবের কার্যক্রম সবই তাপমাত্রা দ্বারা কম বেশি প্রভাবিত হয়। যেহেতু বিভিন্ন অণুজীবের কার্যক্রমের ওপর উদ্ভিদের খাদ্য উপাদানের সহজলভ্যতা নির্ভরশীল সেজন্য মৃত্তিকা তাপমাত্রা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের খাদ্য উপাদানের প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে। এসব অণুজীব জৈব পদার্থের বিয়োজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ খাদ্য উপাদানের গ্রহণোপযোগী আকারে নিয়ে আসে।

৩। বীজের অংকুরোদগমে তাপমাত্রা একটি অন্যতম নিয়ামক (factor)। ফসল উৎপাদনের জন্য আমরা মাটিতে বীজ বপন/রোপণ করে থাকি। এসব বীজের অংকুরোদগম হবে কি না কিংবা কী হারে হবে তা মৃত্তিকা তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। নির্দিষ্ট ফসলের বীজ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় অংকুরিত হয়।

শীতকালীন ফসলের বীজের অংকুরোদগমের জন্য গড় মৃত্তিকার তাপমাত্রা ২০° সে. পক্ষান্তরে গ্রীষ্মকালীন ফসল বীজের অংকুরোদগমে তা ৩২° সে.। খুব নিম্ন কিংবা খুব উচ্চ মৃত্তিকা তাপমাত্রায় বীজের অংকুরোদগম বিঘ্নিত হয়। এছাড়া ফসল উদ্ভিদের মূলের বৃদ্ধিও মৃত্তিকা তাপমাত্রার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

শিকড় দ্বারা পুষ্টি উপাদান ও পানি পরিশোষণ মৃত্তিকা তাপমাত্রা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উদ্ভিদের খাদ্য উপাদানের সহজলভ্যতা মৃত্তিকাস্থ রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। আর রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি ও প্রকৃতি বহুলাংশে মৃত্তিকা তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। কাজেই উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের পরিশোষণে মৃত্তিকা তাপমাত্রা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মৃত্তিকা তাপমাত্রা শিকড়ের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে বলে তা পানি ও খাদ্য উপাদান পরিশোষণে পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।

 

মৃত্তিকার ঘনত্ব

মৃত্তিকার ঘনত্ব – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি কৃষি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের, ২ নং ইউনিটের ২.৪ নং পাঠ। ঘনত্ব যে কোন পদার্থের একটি ভৌত ধর্ম। সংজ্ঞা হিসেবে আমরা জানি, কোন পদার্থের একক আয়তনের ভরকে এর ঘনত্ব বলা হয়।

 

মৃত্তিকার ঘনত্ব

 

 

ভরের একক গ্রাম এবং আয়তনের একক ঘন সে.মি ( cm বা c.c) হওয়ায় ঘনত্বের একক হলো গ্রাম / ঘন সে.মি. (g/cm’)। যেমন : পানির ঘনত্ব ১ গ্রাম / ঘন সে.মি., পারদের ঘনত্ব ১৩.৫ গ্রাম/ ঘন সে.মি। যেহেতু মৃত্তিকা একটি পদার্থ সেহেতু এর অবশ্যই ঘনত্ব রয়েছে। ঘনত্ব মৃত্তিকার একটি অন্যতম ভৌত গুণ। মৃত্তিকার ঘনত্ব প্রধানত দুই প্রকার। যথা—

১।  আয়তনী ঘনত্ব (Bulk density)
২। কণা ঘনত্ব (Particle denisty )

 

 

আয়তনী ঘনত্ব (Bulk density) :

একক আয়তনের শুকনো মৃত্তিকার ভরকে মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব বলে। মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব বের করার সময় মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসরের (Pore space) আয়তনকে হিসেব করা হয়। রন্ধ্র পরিসর হলো মৃত্তিকা কণার মধ্যকার বায়ু দ্বারা দখলকৃত স্থানের আয়তন। আয়তনী ঘনত্ব বের করার পূর্বে মৃত্তিকাকে ১০৫° সে. তাপমাত্রায় চুল্লীতে শুকানো হয়। ফলে মৃত্তিকা থেকে আর্দ্রতা অর্থাৎ জলীয় অংশ দূরীভূত হয়। মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়—

 

 

আয়তনী ঘনত্ব মৃত্তিকার চাপবদ্ধতা (Compactness) প্রকাশ করে। আয়তনী ঘনত্ব যত বেশি হবে মৃত্তিকা তত বেশি চাপবদ্ধ (Compact) বুঝাবে। বিপরীতক্রমে, আয়তনী ঘনত্ব যত কম হবে মৃত্তিকা তত ঝুর ঝুরে হবে। সেজন্য আয়তনী ঘনত্ব দ্বারা জমিতে উদ্ভিদের শিকড়ের বৃদ্ধি, পানি চলাচল, বায়ুর পরিমাণ এবং দৃঢ় স্তরের (Hardpan) উপস্থিতি জানা যায়। এসব জেনে সহজেই মৃত্তিকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ধারণ করা যায়। এছাড়া মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্বের দ্বারা এর পানি পরিশোষণ ক্ষমতা ও বায়ু চলাচল নির্ণীত হয়।

সাধারণত কৃষি মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব ১.১১.৪ গ্রাম/ সি.সি.। খনিজ ও জৈব মাটির আয়তনী ঘনত্ব যথাক্রমে ১.১-১.৮ গ্রাম / সি.সি. ও ০-০.৫ গ্রাম/সি.সি । মৃত্তিকার রন্ধ্র পরিসর বাড়ার সাথে সাথে আয়তনী ঘনত্ব হ্রাস পায়। মৃত্তিকার ভৌত ধর্মাবলী জানার জন্য কণা ঘনত্বের চাইতে আয়তনী ঘনত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব যত কম সে মাটির ভৌত ধর্মাবলী চাষের জন্য তত বেশি উপযোগী। ভূ-পৃষ্ঠের যত গভীরে যাওয়া যায় আয়তনী ঘনত্ব তত বেড়ে যায়। জমিতে জৈব পদার্থ/জৈব সার যোগ করলে জমির মৃত্তিকার আয়তনী ঘনত্ব কমে যায়।

 

 

কণা ঘনত্ব (Particle density):

মৃত্তিকার কঠিন অংশের ঘনত্বকে কণা ঘনত্ব নামে অভিহিত করা হয়। কণা ঘনত্বে মৃত্তিকার তরল (পানি) ও গ্যাসীয় (বাতাস) অংশকে বিবেচনা করা হয় না। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যায়, মৃত্তিকা কণার (Soil particles) একক আয়তনের ভরকে কণা ঘনত্ব (Particle density) বলা হয় ( The particle density of soil solids is defined as the mass per unit volume of soil particles) | | গ্রাম / সি.সি. এককে প্রকাশ করা হয়। কণা ঘনত্বকে নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় ঃ

 

 

কণা ঘনত্বে রন্ধ্র পরিসর (Pore space) কে বিবেচনা করা হয় না। এ ঘনত্ব মৃত্তিকায় জৈব ও অজৈব পদার্থের উপস্থিতি নির্দেশ করে। খনিজ প্রধান মাটির কণা ঘনত্ব ২.৬০ -২.৭০ গ্রাম / সি.সি. হয়ে থাকে। নিরক্ষীয় অঞ্চলের মৃত্তিকা যেখানে লৌহ অক্সাইড বেশি থাকে সেখানে কণা ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। অপরপক্ষে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মৃত্তিকায় নিম্ন কণা ঘনত্ব হয়ে থাকে। উচ্চ জৈব পদার্থ সম্পন্ন মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব ১.২-১.৭ গ্রাম / সি.সি.। মৃত্তিকার উপরের স্তরে তুলনামূলকভাবে জৈব পদার্থ বেশি থাকে বিধায় মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্রের (Profile) উপরের স্তরে নিম্ন কণা ঘনত্ব এবং নিচের স্তরে উচ্চ কণা ঘনত্ব হয়ে থাকে। সাধারণভাবে খনিজ মাটির কণা ঘনত্ব ২.৬৫ গ্রাম/ সি.সি. ধরা হয়। মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব সর্বদাই আয়তনী’ ঘনত্বের চাইতে বেশি হয়ে থাকে।

 

 

অনুশীলন ( Activity) :

মৃত্তিকা কণা ঘনত্ব ও আয়তনী’ ঘনত্বের পার্থক্য নির্দেশ পূর্বক একটি তালিকা তৈরি করুন।

কৃষিতে মৃত্তিকা ঘনত্বের গুরুত্ব (Importance of soil density in agriculture):

মৃত্তিকা ঘনত্বের ওপর কৃষি কাজে মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নির্ভরশীল। নিচে সংক্ষেপে কৃষিতে মৃত্তিকা ঘনত্বের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো :

(১) মৃত্তিকায় বায়ু চলাচল, পানির অনুপ্রবণ (water infiltration), অণুজৈবিক কার্যাবলী ইত্যাদি ফসল উৎপাদনের পূর্বশর্ত। আয়তনী’ ঘনত্ব বেশি হলে মৃত্তিকায় বায়ু চলাচল, অণুজৈবিক কার্যাবলী ও পানির অনুসরন কমে যায়। ফলে উদ্ভিদের শিকড়ের বৃদ্ধি ও বিস্তার কম হয়। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ যোগ করে অবস্থার উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে।

(২) আয়তনী’ ঘনত্ব বেশি হলে মৃত্তিকা শুকানোর সময় ফেটে যেতে পারে। (৩) মৃত্তিকার কণা ঘনত্ব বেশি হলে বায়ু চলাচল কমে যায়। উচ্চতর কণা ঘনত্ব ভারী খনিজের আধিক্য বুঝায়। ভারী খনিজের আধিক্যে অনেক ফসলেরই উৎপাদন ব্যাহত হয়।

মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসর ( Soil pore space) :

কোন মৃত্তিকার জৈব ও অজৈব অংশ ব্যতিত অবশিষ্ট অংশকে রন্ধ্র পরিসর (pore space) বলে। মৃত্তিকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ইহা বায়ু ও পানি দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। আকার অনুসারে মৃত্তিকায় দু’ধরণের রন্ধ্র দেখা যায় :

(১) বড় রন্ধ্র (Macro pore)

(২) অণু রন্ধ্র (Micro pore)

সাধারণত বড় রন্ধ্রে বাতাস এবং অণু রন্ধ্রে পানি থাকে। কোন স্থানের মৃত্তিকায় শতকরা ৫০ ভাগ রন্ধ্র পরিসর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন মৃত্তিকার আয়তনী’ ঘনত্বকে কণা ঘনত্ব দ্বারা ভাগ করে ১০০ দ্বারা গুণ করলে এর রক্তৃতা (porosity ) পাওয়া যায়।

 

 

 

মৃত্তিকা রন্ধতার গুরুত্ব ( Importance of soil porosity ) :

উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মৃত্তিকা হতে আয়নরূপে অপরিহার্য খনিজ উপাদান ( N, P, K, Zn, s ইত্যাদি) শোষণ করে থাকে। মৃত্তিকা হতে খনিজ উপাদান পরিশোষণে তাই মৃত্তিকার ভিতর উদ্ভিদের শিকড়ের বিস্তার ও পানির উপস্থিতি আবশ্যক। মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসরের উপস্থিতি উল্লিখিত দুটি শর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মৃত্তিকা রন্ধ্র পরিসরের গুরুত্বকে নিচে তুলে ধরা হলো :

(১) কৃষি জমির জন্য মৃত্তিকা রন্ধতা (soil porosity) একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৃত্তিকা বায়ু ও পানির চলাচল এর রন্ধ্রতার ওপর নির্ভরশীল। রন্ধ্রতার পরিমাণ কম হলে মৃত্তিকায় বায়ু ও পানি চলাচল বিঘ্নিত হয়। ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়নও বাধার সম্মুখীন হয়।

(২) মৃত্তিকা রক্ত পরিসরের আকার ও পরিমাণ মৃত্তিকায় পানি পরিশোষণ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া রন্ধ্র পরিসরের আকার ও সংখ্যার ওপর উদ্ভিদের পানির প্রাপ্যতাও নির্ভর করে।

(৩) মৃত্তিকা রক্ত পরিসরের আকার ও পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ফসলে সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাপনা নির্ণীত হয়।

মৃত্তিকার সংযুক্তি

মৃত্তিকার সংযুক্তি – বিষয়টি আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের ইউনিট ২ এর পাঠ ২.৩ নং পাঠ। মৃত্তিকা বুনট সম্পর্কে আমরা পূর্ববর্তী পাঠে আলোচনা করেছি। বর্তমান পাঠে মৃত্তিকা সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা করবো। মৃত্তিকা সংযুক্তি মৃত্তিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌত ধর্ম। ফসল উৎপাদনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়া নির্মাণ কাজ অর্থাৎ দালান কোঠা, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ কাজে মৃত্তিকা সংযুক্তি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

মৃত্তিকার সংযুক্তি

 

মৃত্তিকা সংযুক্তি কী (What is soil structure)?

মাটি কণা যেমন— বালি, পলি ও কর্দমকণা পরস্পর যুক্তভাবে সজ্জিত হওয়ার ফলে মাটির দলা যে বিন্যাস বা আকার প্রাপ্ত হয় তাকে মাটির সংযুক্তি বলা হয়।
মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ, আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Fe203 ও Al2O3) এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট (CaCO3 MgCO3) এ সকল সিমেন্টিং পদার্থ মাটির দলা গঠনে সহায়তা করে। মৃত্তিকার সংযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে নিম্নবর্ণিত শব্দসমূহ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

মাটির দলা বা পেড (Ped) এবং ঢেলা (Clod) মাটির সংযুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

পেড (Ped) : প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মাটির সংযুক্তির একক।

ঢেলা (Clod) : কর্মনজনিত কারণে ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট মাটির সংযুক্তির একক। দলা খন্ড (Fragments) : প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট দলার (peds) ভগ্নাংশ।

কংকর বা নুড়ি (Concretion) : মাটিতে দ্রবীভূত লবণ অধঃক্ষেপিত হয়ে কংকর সৃষ্টি হয়।

 

 

মাটির সংযুক্তি শ্রেণিবিন্যাস (Classification of soil structure):

মাটির সংযুক্তিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

A. প্রকার অনুসারে (Classification according to Type)।

B. শ্রেণি অনুসারে (Classification according to Class)।

C. ক্রম অনুসারে (Classification according to Grade)।

 

A. সংযুক্তির প্রকার :

দলার আকৃতির ও জ্যামিতিক আকার এর ওপর ভিত্তি করে মাটির সংযুক্তিকে ৪ (চার) ভাগে ভাগ করা যায়

i. থালাকৃতি (Plate like)

ii. প্রিজমাকৃতি (Prism like )

iii. চৌকাকৃতি (Block like )

iv. উপগোলাকৃতি (Sphere like)

 

B. সংযুক্তির শ্রেণি বা দল :

মাটির দলার আকার (Size) অনুসারে প্রধানত ৫টি শ্রেণির সংযুক্তি উল্লেখ করা যায়। এগুলো নিম্নরূপ :

i. অতি সূক্ষ্ণ বা অতি পাতলা (Very fine or very thin)। যেমন এঁটেল, বেলে, এঁটেল দোআঁশ।

ii. সূক্ষ্ণ বা পাতলা (Fine or thin

iii. মধ্যম (Medium)

iv. মোটা বা পুরু (Coarse or thick

V. খুব মোটা বা খুব পুরু (Very coarse or vrey thick )

 

সংযুক্তি ক্রম ঃ

মাটির দলার এককগুলো স্পষ্টতা ও দৃঢ়তা অনুসারে সংযুক্তিকে ৪ (চার) ভাগে ভাগ করা যায় :

i. সংযুক্তিহীন (Structureless)

ii. দুর্বল (Weak)

iii. মধ্যম (Moderate )

iv. কঠিন (Strong )

 

 

সংযুক্তি প্রকারের বিভিন্ন শ্রেণির বর্ণনা:

i. থালাকৃতি (Plate Like):

এই সংযুক্তির অন্তর্ভূক্ত পেডগুলো অনুভূমিক দিক (Horizontal) বরাবর উন্নতি লাভ করে প্লেটাকার, পাতাকৃতি বা লেন্স আকৃতি সৃষ্টি করে। এ আকৃতি আবার দু’প্রকার যথা :

(ক) প্লেটি (Platy) :

দলাগুলো ( aggregates ) প্লেটের মত। প্লেটগুলো একটি অন্যটিকে অতিক্রম করে, অপ্রবেশ্য ও পুরু (thick) | (খ) ল্যামিনার (Laminar) : সব বৈশিষ্ট্যই প্রেটির মত তবে পাতলা (thin)

ii. প্রিজমাকৃতি (Prism Like) :

এ সংযুক্তির অন্তর্ভুক্ত পেডগুলো উর্ধ্বভূমিকভাবে উন্নতি লাভ করে পিলারের মত হয়। এ সংযুক্তি আবার ২ ( দুই ) প্রকার

(ক) প্রিজমেটিক (Prismatic) :

প্রিজমাকার দলার উপরের তল যখন সমান ও মসৃন হয়। তখন তাকে প্রিজমেটিক বলা হয়।

(খ) স্তম্ভাকার (Columnar) :

প্রিজমাকার দলার উপরের তল গোলাকার হলে তাকে কলামনার বলা হয়।

iii . চৌকাকৃতি (Block like) :

এক্ষেত্রে পেডগুলো সজ্জিত হয়ে কিউবস আকার এবং মাটিকণাগুলো একত্রিত হয়ে ছয়তল বিশিষ্ট আকার ধারণ করে যাহার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা প্রায় সমান। চৌকাকার সংযুক্তি ২ প্রকার হতে পারে।

(ক) কৌণিক চৌকাকৃতি (Angular Blocky) :

যখন দলাগুলো ঘনকের মত এবং চতুস্পার্শ্বের ধারগুলো স্পষ্ট, প্রশস্থ ও তীক্ষ্ম কোণাকার হয় তখন তাকে কৌণিক চৌকাকৃতি বলে।

(খ) উপকৌণিক চৌকাকৃতি (Sub-angular Blocky) :

যখন দলার ধারগুলো অস্পষ্ট এবং কিনারা প্রায় গোলাকার হয় তখন তাকে উপকৌণিক চৌকাকৃতি বলে।

iv. উপ-গোলাকৃতি (Sphere like or spheroidal) :

দলা বা পেডের আকার মোটামুটি গোলাকার এবং সাধারণত আকারে ছোট। এই দলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :

v. গ্র্যানুলার বা দানাদার ( Granular) :

যখন দলাগুলো তুলনামূলকভাবে কম রন্ধ্রযুক্ত থাকে এবং একে ভাঙ্গা যায় না তখন তাহাকে গ্র্যানুলার বলে। (খ) চূর্ণাকার গঠন বা ক্রাম্ব (Crumb) : যখন পেডগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি রন্ধযুক্ত থাকে এবং একে ভাঙ্গা যায় তখন তাহাকে ক্রাম্ব বলে।

 

 

কৃষিতে মৃত্তিকা সংযুক্তির গুরুত্ব (Importance of soil structure in agriculture):

কৃষিতে মাটির সংযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :

(১) সংযুক্তি মাটির একটি উল্লেখযোগ্য ভৌত ধর্ম যা অন্যান্য ভৌত ধর্ম যেমন ঃ সচ্ছিদ্রতা, পানি, বায়ু চলাচল, আর্দ্রতা এবং আয়তনী ঘনত্ব ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে সংযুক্তি খুবই সম্পর্কযুক্ত।

(২) তাপমাত্রা স্থানান্তরে সাহায্য করে।

(৩) উদ্ভিদের শিকড় বিস্তারে সাহায্য করে।

(৪) জৈব পদার্থের বিয়োজন ও অণুজৈবিক কার্যাবলী বৃদ্ধি মাটির সংযুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(৫) মাটির ধর্ম জানতে সাহায্য করে।

(৬) কোন মাটিতে কোন ফসল জন্মানো যাবে তাহা মাটির সংযুক্তির সাহায্যে জানা যায়।

(৭) মাটির ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়।

(৮) থালাকৃতি সংযুক্তি পানির অবাধ নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করে।

(৯) দানাকৃতি ও ক্রাম্ব সংযুক্তি মাটির সবচেয়ে ভাল অবস্থা আনায়ন করে। কৃষি কাজের জন্য এ ধরণের সংযুক্তি উত্তম।

(১০) চাষ দেওয়া, সার দেওয়া, লাইমিং করা প্রভৃতি দ্বারা সংযুক্তি প্রভাবিত হয় এবং মাটির সংযুক্তির ওপর নির্ভর করিয়া বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাটির কর্ষন সমাধা করা হয়।

 

 

 

মাটির সংযুক্তির উৎপত্তি (Genesis of soil structure):

আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, মাটির উৎস বস্তু (Parent material) এক দানা বিশিষ্ট যেমন: বালি প্রধান মাটি, অথবা সংহত যেমন : কর্দম প্রধান মাটি এবং এই অবস্থা হতে মাটির সংযুক্তি সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। মাটির একক দানাগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে দলা বা সংযুক্তি সৃষ্টি করে। যেমন : ডাইপোলার পানি-মৌলের আঠালো প্রভাব বারবার ভিজে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে যথাক্রমে সম্প্রসারন ও সংকুলান ঘটায় যাতে মাটিকণা সামনে পিছনে আন্দোলিত হয় এবং এভাবে মাটির দলায় ফাটল বা চিড় দেখা যায়।

পানি শুকিয়ে গেলে মাটি কণাগুলো পুণরায় ঘনিষ্ঠ হয়ে দলা দৃঢ় হয়ে যায়। এ হচ্ছে মাটিতে দলা সৃষ্টিতে পানির অন্যতম কাজ। মাটিতে সংযুক্তি সৃষ্টির তত্ত্ব যা হোক না কেন এ কথা স্বীকৃত যে, একক মাটি কণাগুলোর পারস্পারিক বন্ধনের জন্য কোন প্রকার আঠালো বা বন্ধন দ্রব্য প্রয়োজন। এ সমস্ত বন্ধন দ্রব্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে মাটির কোলয়েড, রাসায়নিক লবণ ও ধনাত্মক আয়ন (Cation), উদ্ভিদ, শিকড়, অণুজীবের কার্যাবলী, চাষাবাদ ইত্যাদি।

 

 

মৃত্তিকার গঠন ও বুনট

মৃত্তিকার গঠন ও বুনট – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের ইউনিট ২ এর পাঠ ২.২ । মৃত্তিকা গঠনকারী উপাদান মৃত্তিকা একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রাকৃতিক মিশ্র পদার্থ। ক্ষয়ীভূত শিলা ও খনিজের সাথে জৈব পদার্থ এবং পানির মিশ্রণে মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। যে কোন মৃত্তিকা প্রধানত চারটি উপাদান নিয়ে গঠিত।

মৃত্তিকার গঠন ও বুনট, মৃত্তিকা বিজ্ঞান

 

যথা—

১। খনিজ দ্রব্য (Mineral matter)
২। জৈব দ্রব্য (Organic matter)
৩।  পানি বা জলীয় অংশ (Water)
8।  বায়ু (Air)

সাধারণত কৃষি মাটিতে এ চারটি উপাদান নিম্নবর্ণিত শতকরা হারে উপস্থিত থাকে :

খনিজ দ্রব্য (Mineral matter):

আয়তন ও ওজন ভিত্তিতে মৃত্তিকায় খনিজ দ্রব্যের শতকরা গড় পরিমাণ যথাক্রমে ৪৫ ও ৭৩ ভাগ। মাটিতে খনিজ দ্রব্যের আকার বড় হলে এবং নুড়ি বা স্থূল বালিকণার পরিমাণ বাড়লে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। খনিজ দ্রব্য মৃত্তিকায় উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানের ভাণ্ডার। খনিজ দ্রবোর বৈশিষ্ট্যের ওপর তা নির্ভরশীল। পাথর খণ্ড, বালি কণা, পলি কণা ও কর্দম কণা সমন্বয়ে মৃত্তিকা খনিজ দ্রব্য গঠিত।

 

জৈব পদার্থ (Organic matter):

উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহের পচনের ফলে সৃষ্ট পদার্থ যা মৃত্তিকায় মিশে আছে তাই মৃত্তিকা জৈব পদার্থ। জৈব পদার্থকে মাটির প্রাণ বলা হয়। জৈব পদার্থের পরিমাণের উপর মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা সরাসরি নির্ভরশীল। জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হলে মাটির গুণাগুণ উন্নত হয়। জৈব পদার্থ অধিকাংশ পুষ্টি উপাদানের ভান্ডার হিসেবে বিবেচিত।

 

পানি বা জলীয় অংশ (Water):

মৃত্তিকা কণার ফাঁকে অথবা গায়ে শোষিত অবস্থায় যে জলীয় অংশ বিদ্যমান সাধারণভাবে তাকে মৃত্তিকা পানি বলা হয়। বৃষ্টি, সেচ ও বিভিন্ন জলাশয় হলো মৃত্তিকা পানির উৎস। মৃত্তিকা পানিতে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানসমূহ আয়ন আকারে অবস্থান করে।

বায়ু (Air):

মৃত্তিকা কণার ফাঁকে বিদ্যমান বায়বীয় অংশই মৃত্তিকা বায়ু। এর মধ্যে রয়েছে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস।
একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো : মৃত্তিকায় বায়ু ও পানির পরিমাণ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ মৃত্তিকা বায়ুর পরিমাণ বাড়লে পানির পরিমাণ কমে। জলাবদ্ধ মাটিতে বায়ুর পরিমাণ প্রায় শূন্য কারণ এ অবস্থায় মৃত্তিকা কণার সকল ফাঁক পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে।

 

মৃত্তিকা বুনট কী (What is soil texture)?

আমরা জানি, মাটিতে তিন ধরণের কণা (Soil seperates) বিদ্যমান। এরা হলো বালি, পলি ও কর্দম কণা। মৃত্তিকা বুনট বলতে মৃত্তিকাস্থ বালি, পলি ও কর্দম কণার তুলনামূলক পরিমাণকে বুঝায়। বুনট হলো মৃত্তিকার একটি অন্যতম ভৌত ধর্ম। মাটির অনেক ভৌত গুণাবলী বুনটের ওপর নির্ভরশীল। সংজ্ঞা হিসেবে বলা যেতে পারে যে :

বুনট হলো কোন মৃত্তিকায় বিদ্যমান বালি, পলি ও কর্দম কণার আপেক্ষিক অনুপাত বা শতকরা হার। অন্য কথায় এটি মৃত্তিকা কণার স্থূলতা বা সূক্ষ্ণতাকে বুঝায়। (Soil texture refers to the relative proportion or relative percentage of sand, silt and clay in a soil. In other words, it is the relative coarseness and fineness of soil particles or soil seperates).

মাটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে এর বুনট সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেমনঃ যে মাটিতে বালি কণার পরিমাণ অধিক সে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা কম এবং বালি প্রধান মাটিতে মূল জাতীয় ফসল ভাল হয়। সুতরাং সেচ, নিকাশ, ফসল নির্বাচন, শস্য পর্যায়, সারের প্রকৃতি ও প্রয়োগ পদ্ধতি ইত্যাদি ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত ব্যবস্থাপনা কৌশলসমূহ মৃত্তিকা বুনটের ওপর নির্ভরশীল। মৃত্তিকা বুনটের শ্রেণিবিন্যাস (Textural classification of soil)

মৃত্তিকায় বিদ্যমান বালি, পলি ও কর্দম কণার আনুপাতিক উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে মৃত্তিকা বুনটের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। মৃত্তিকা বুনটকে দুই পদ্ধতিতে শ্রেণিবিন্যস করা হয়ে থাকে। এদের একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র পদ্ধতি (USDA System) ও অন্যটি হলো আর্ন্তজাতিক পদ্ধতি।

মৃত্তিকার বুনট শ্রেণির উন্নতীকরণ (Development of soil textural class):

এঁটেল বা কাদামাটিকে দোআঁশ মাটিতে রূপান্তরিতকরণ : বালি, ছাই, চুন ইত্যাদি যোগ করে কাদা মাটিকে দোআঁশ মাটিতে রূপান্তরিত করা যায়। কোন কোন সময় গভীরভাবে চাষ দিলে নিচ স্তরের মাটি উপরে উঠে আসে ফলে আংশিকভাবে দোআঁশ মাটিতে পরিণত হয়। কমপোস্ট সার, সবুজ সার পশুপাখির মল-মূত্র, পরিমাণ মত বালি যোগ করেও এ কাজ সমাধা করা যায়।

বেলে মাটিকে দোআঁশ মাটিতে পরিণতকরণ : পার্শ্ববর্তী কোন উঁচু জমি বা খাল, নদী হতে নালা কেটে জমিতে পানি প্রবেশ করিয়ে চারিদিকের আইল বেধে রাখলে ক্রমে ক্রমে বেলে মাটি দোআঁশ মাটিতে পরিণত হয়। এ ছাড়া বেলে মাটির সাথে কাদা/এঁটেল মাটি /সবুজ সার, পশুপাখির মল-মূত্র যোগ করেও বেলে মাটিকে দোআঁশ মাটিতে পরিণত করা যায়।

 

মৃত্তিকার বুনটের গুরুত্ব (Importance of soil texture):

১। মৃত্তিকার শ্রেণিবিভাগ করতে সহায়তা করে ফলে কোন মাটিতে ফসল উৎপাদন করা যাবে তা নির্ণয় করা যায়।

২। মাটির যথোপযুক্ত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা করতে সহায়তা করে।

৩। কোন কোন সময় নির্দিষ্ট মাটির pH ও পুষ্টি উপাদানের মাত্রা জানতে সাহায্য করে।

৪। মৃত্তিকার ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক ধর্মাবলী জানতে সাহায্য করে।

৫। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা জানা যায় ফলে সময় মত সেচ ও নিকাশ করা যায়।

৬। মাটির বয়স জানতে সাহায্য করে।

৭। দালানকোটা, রাস্তা, রেলপথ, প্রভৃতি নির্মাণের জন্য কোন স্থান ভাল তা জানতে সাহায্য করে।

৮। ভূমি কর্ষনের সুবিধা/অসুবিধা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

৯। মাটিকে নির্দিষ্ট দলে শ্রেণিবিভাগ করতে সহায়তা করে।

১০। মাটির উর্বরতা, উৎপাদনশীলতা এবং বায়ু চলাচলে (aeration) সাহায্য করে।

১১। শিলাক্ষয়ের পর্যায় (weathering stage) জানতে সাহায্য করে।

১২। নদীর ধারের মাটিতে অধিক বালি থাকায় তা ভূমিক্ষয়ে সাহায্য করে।

১৩। ক্রমাগত পলির স্তর জমা হয়ে নদীর মোহনায় বিভিন্ন বুনটের মাটি গঠিত হয় যা কৃষি কাজে সহায়তা করে।

 

মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যের ধারনা ও গুরুত্ব

মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যের ধারনা ও গুরুত্ব – নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “মৃত্তিকা বিজ্ঞান” বিষয়ের ইউনিট ২ এর পাঠ ২.১। মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যাবলী মৃত্তিকার কণা (Soil seperates), বুনট, সংযুক্তি, ঘনত্ব, রন্ধ্র পরিসর, বর্ণ, তাপমাত্রা ইত্যাদি হলো মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর মৃত্তিকার উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা নির্ভরশীল। মৃত্তিকা বিজ্ঞানের যে শাখায় মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে মৃত্তিকা পদার্থ বিদ্যা (Soil Physics) বলা হয়। মৃত্তিকা পদার্থবিদ্যা মৌলিক ও ব্যবহারিক মৃত্তিকা বিজ্ঞানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রযুক্তিবিদ্যায় মৃত্তিকা পদার্থবিদ্যার গুরুত্ব অনেক বেশি।

মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যের ধারনা ও গুরুত্ব

 

কৃষিতে মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যাবলীর গুরুত্ব:

মৃত্তিকার ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিম্নবর্ণিত কার্যাবলী সম্পন্ন করে :

১। মৃত্তিকা তাপমাত্রা ও বায়ুচলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।

২। পানি চলাচল এবং ভূমিক্ষয়ের হ্রাস বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।

৩। মৃত্তিকায় বীজের অংকুরোদগম হার ও গতি নিয়ন্ত্রণ করে।

8। উদ্ভিদের শিকড়ের অনুপ্রবেশ, প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।

৫। উদ্ভিদের ধারণ ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

৬।মৃত্তিকাস্থ অণুজীবের কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে।

৭। মৃত্তিকা পানি ও পুষ্টি উপাদান ধারন ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।

৮। সেচ ও নিকাশ এর কার্যকারিতার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

 

মৃত্তিকা কণা (Soil particles or Soil seperates ):

মৃত্তিকা খনিজ পদার্থের মধ্যে তিনটি অংশ রয়েছে। ২ মিলিমিটারের কম ব্যাস বিশিষ্ট খনিজ কণাকে মৃত্তিকা কণা বলে। ২ মিলিমিটারের চাইতে বড় পদার্থকে গ্রাভেল বা নুড়ি বলা হয়। কিন্তু 0.0005 মি.মি. এর চাইতে ক্ষুদ্র খনিজকে কোলয়ডাল কে বলে। মাটিতে প্রধানত তিন ধরনের মৃত্তিকা কণা দেখা যায়। এগুলো হলো বালি, পলি ও কর্দম কণা। মৃত্তিকা খনিজ (অজৈব) অংশ থেকে মৃত্তিকা কণার সৃষ্টি। যেমন : কোয়ার্টজ (SiO2) থেকে বালি কণা, ফেল্ডস্পার থেকে পলিকণার সৃষ্টি ইত্যাদি। তালিকা : আকার অনুযায়ী মৃত্তিকা খনিজ পদার্থের শ্রেণিবিন্যাস

মৃত্তিকা কণার শ্রেণিবিন্যাস ( Classification of soil particles ) মৃত্তিকা কণাসমূহকে তাদের কাজের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। একে মৃত্তিকা কণার বিভক্তিকরণও বলা হয়। বালি, পলি ও কর্দম কণাসমূহকে তাদের ব্যাসের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিভাগের জন্য তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।

পদ্ধতিগুল হলো :

১। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগের পদ্ধতি বা ইউ এস ডি এ পদ্ধতি (United States Department of Agriculture System)
২। আন্তর্জাতিক পদ্ধতি (ISSS System International Society of Soil Science System)
৩। মোহরের দশ ভগ্নাংশ পদ্ধতি (Mohr’s 10 Fractions System)

 

মৃত্তিকা কণার শ্রেণিকরণ:

১। ইউ এস ডি এ পদ্ধতি (USDA System )

 

বালু কণা (Sand particles ):

বালু কণায় সাধারণতঃ নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়

১। বালুকণা স্বল্প ক্ষয়ীভূত শিলাদ্রব্যের ক্ষুদ্রাকার চূর্ণ এবং ইহাতে উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশকীয় খাদ্যোপাদান থাকে না বললেই চলে।

২। কণাগুলো সহজে একটা আর একটার সাথে লেগে থাকে না।

৩। এদের দ্বারা গঠিত রন্ধগুলো বড় হওয়ায় বায়ু ও পানি সহজেই চলাচল করতে পারে।

৪।  ইহাদের জৈব ও অজৈব পদার্থের ধারন ক্ষমতা কম।

৫। এরা ভূমিক্ষয় ত্বরান্বিত করে এবং মরুভূমি গঠনে সহায়তা করে।

৬।  যে সমস্ত ফসল ভূনিম্নস্থ কান্ড বা শিকড়ের জন্য চাষ করা হয় বা গভীরমূলী, সেগুলো বেলে মাটিতে ভাল হয়। যেমন : গোলআলু, মিষ্টি আলু প্রভৃতি।

৭। এদের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল খুবই কম।

৮। এদের ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতা ( CEC ) 0-5 me / ১০০ গ্রাম মাটি।

৯। এদের কণার ব্যাস ২.০০ ০.০২ মিলিমিটার।

 

পলি কণা (Silt particles ):

পলি কণায় সাধারণতঃ নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়

১। পলি মাটি হাতে নিলে অনেকটা ময়দার গুঁড়ার মত মনে হয় এবং উক্ত মাটির মাঝে কিছু বড় রন্ধ থাকে।

২।  বালি হতে পলিমাটির পানির ধারণ ক্ষমতা বেশি।

৩। ইহাদের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল মধ্যম যা বালি কণার ক্ষেত্রফল হতে বেশি, প্রায় ২০ গুণ কিন্তু কর্দম কণা হতে কম।

৪।  পলি মাটির উদ্ভিদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদান ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি। এ কণার ব্যাস ০.০২-০.০০২ মিলিমিটার।

কর্দম কণা (Clay particles):

কর্দম কণার বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ—

১। কর্দম কণা মাটি কণার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র খনিজ দ্রব্য। ফলে খালি চোখে এদের একক কণা দৃষ্টিগোচর হয় না।

২। এদের পানি শোষণ ক্ষমতা খুবই কম কিন্তু পানি ধারণক্ষমতা খুবই বেশি।

৩। এরা শুকালে শক্ত হয়ে যায় কিন্তু ভিজা অবস্থায় আঠার মত মনে হয়।

৪।  কর্দম কণা মাটির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলীতে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং উদ্ভিদের খাদ্যোপাদান সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫। এদের পৃষ্টতলের ক্ষেত্রফল খুব বেশি।

৬। এ কণার ব্যাস ০.০০২ মিলিমিটারের চাইতে কম।

 

 

মাটি কণার আকার বিশ্লেষণ (Particle size analysis ):

কোন মাটিতে বালি, পলি ও কর্দম কণার পরিমাণ যে পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয় তাকে মাটি কণার আকার বিশ্লেষণ বলে। মৃত্তিকা বুনট জানাই মৃত্তিকা কণার আকার বিশ্লেষণের প্রধান উদ্দেশ্য।

 

মাটির কণার আকার বিশ্লেষণ নিম্নলিখিত দুটি ধাপে করা হয় :

১। মৃত্তিকার দলার পূর্ণ বিচ্ছুরণ করে পৃথক পৃথক কণায় বিভক্তিকরণ।
২। বিচ্ছুরিত মৃত্তিকা কণার আকার ভিত্তিক পরিমাণ নির্ণয়।

১। মৃত্তিকা দলের বিচ্ছুরণ :

মৃত্তিকার কণাগুলো একসাথে লেগে থেকে মৃত্তিকা দলার সৃষ্টি করে। মাটিতে অধিক পরিমাণ জৈব পদার্থ, আয়রন (Fe2O3) ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (A12O3), ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট (CaCO3, M, CO3) থাকে। আর এদের বন্ধন গুণাবলী থাকায় মৃত্তিকা দলার সৃষ্টি হয়। ফলে কণাগুলো বিচ্ছুরণে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। এদেরকে সিমেন্টিং পদার্থ বলে। তাই বিশ্লেষণের পূর্বে এ সকল দ্রব্য দ্রবীভূত করার প্রয়োজন হয়। রাসায়নিক পরিশোধন দ্রবা প্রয়োগ করে এগুলো নষ্ট করা হয়। বিচ্ছুরণের সাহায্যে শুধুমাত্র মৃত্তিকা দলাকে ভাঙ্গা যায় কিন্তু পৃথক পৃথক কণায় পরিণত করা যায় না।

নিম্নলিখিত কয়েকটি ধাপে পরিশোধন কাজ সমাধা করা হয়:

১। মাটি গুঁড়া করে ২ মি.মি. ব্যাসযুক্ত চালুনী দ্বারা চেলে নেওয়া হয়।

২। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড প্রয়োগ করে জৈব পদার্থ দূর করা হয়। H₂O₂+O.M→ CO2 [O.M.= Organic matter]

৩। হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রয়োগ করে আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনোশিয়াম দূর করা হয়।

Fe₂03+6HC1 → FeCl3+3H20,
A1203+6HC1 2A1C13 + 3H2O
CaCO3+2HC1 → CaCl2 + CO2 + H20
MgCO3 + 2HC1 → MgCl2 + CO2 + H20

৪।  কাদা কণার বিচ্ছুরণের জন্য সোডিয়াম হেক্সামেটা ফসফেট (NaPO3), সোডিয়াম কার্বনেট (Na2CO3), সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (N, OH), সোডিয়াম অক্সালেট (Na2CO3), লিথিয়াম কার্বনেট (Li2CO3) ইত্যাদি যোগ করা হয়।

৫। যান্ত্রিক মিশ্রণ সহযোগে মাটি কণা বিচ্ছুরণ করা হয়।

 

বিচ্ছুরিত মৃত্তিকা কণার আকারভিত্তিক পরিমাণ নির্ণয়:

এ পদ্ধতিতে বালি, পলি ও কর্দম কণার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। বালি পলি ও কর্দম কণার পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য তলনীকরণ ও চালুনীকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।

তলানীকরণ

বিচ্ছুরিত মৃত্তিকা কণা ১০০০ সি.সি সিলিন্ডারে নিয়ে পানি ভর্তি করে উহার মুখে ছিপি আটকিয়ে উপর ও নিচে ঝাকিয়ে মৃত্তিকা কণার তলানী পড়তে দেওয়া হয়।

দুটি প্রক্রিয়ায় তলানীকরণ পদ্ধতির সাহায্যে মৃত্তিকা কণার পরিমাণ নির্ণয় করা যায়:

১। হাইড্রোমিটার পদ্ধতি, ও
২। পিপেট স্যাম্পলিং পদ্ধতি৷

 

মৃত্তিকা কণার আকার বিশ্লেষণের মূলনীতি বা হাইড্রোমিটার পদ্ধতির মূলনীতি:

কোন মাধ্যমে মৃত্তিকা কণার পতনের গতি নির্ভর করে উহার আকার, আয়তন, ঘনত্ব ও তলের ওপর। কোন মাধ্যম যেমনঃ পানিতে একই ঘনত্ব বিশিষ্ট বড় মৃত্তিকা কণাগুলো ছোট মৃত্তিকা কণা অপেক্ষা অতি দ্রুত নিচে জমা হয়। ইহার পর সময়ের ব্যবধানে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রকার কণাগুলোর তলানী পড়তে থাকে। পতন গতির ওপর ভিত্তি করে মৃত্তিকা কণা পৃথক করা হয়।
একটি তরলে নিক্ষিপ্ত বা পতিত মত্তিকা কণার ক্ষেত্রে

উপরের সূত্র হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, একটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থের ভিতর দিয়ে একই ঘনত্বের কঠিন কণাসমূহের পতনের গতি তাদের ব্যাসার্ধের বর্গমানের সাথে বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ Var কেননা Pp. PL ও n ধ্রুব থাকে।
চালুনীকরণ এ প্রক্রিয়ায় মাটি গুঁড়া করে ২ মি.মি হতে ০.০০২ মি.মি ব্যাসের ছিদ্রযুক্ত চালুনী দ্বারা ঢেলে নেওয়া হয় এবং আকার অনুযায়ী মৃত্তিকা কণাগুলো পৃথক করা হয়।

 

অসুবিধা:

২-০.০০২মিঃ ব্যাসের চালুনী পাওয়া খুবই দুরহ। কণাগুলোর আকারে বিভিন্নতা জনিত অসুবিধা দেখা দেয়।

 

স্টোকস এর সূত্র (Stokes’ law):

বিজ্ঞানী স্টোকস (Stokes’) (১৮৫১) সর্বপ্রথম বলেন যে, তরল পদার্থের মধ্যে কণার বা দ্রব্যের পতনের গতি পতন কণাটির বা দ্রব্যটির ব্যাসার্ধের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সূত্রটি হচ্ছে : কোন একটি কণা তরল পদার্থের ভিতর দিয়ে পতনের সময় তরল পদার্থটি কণার পতনে যে বাধা সৃষ্টি করে তা কণাটির ব্যাসার্ধের ওপর নির্ভরশীল, পৃষ্ঠতলের উপর নয়। এ সূত্রানুসারে,

উপোরোক্ত সমীকরণ হতে বুঝা যায় যে, একটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থের ভিতর দিয়ে একই ঘনত্বের কঠিন কণাসমূহের পতনের গতি তাদের ব্যাসার্ধের বর্গমানের সাথে বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ Var কারণ dp ও N ধ্রুবক থাকে।

 

স্টোকস (Stokes) এর সূত্রের অনুমিত শর্তাবলী:

স্টোকস (Stokes) এর সূত্রের সত্যতা কতকগুলো মৌলিক শর্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত। শর্তাবলী নিম্নরূপ

১। তরল পদার্থের অণুর চেয়ে মৃত্তিকা কণার আকার অবশ্যই বড় হতে হবে যাতে ব্রাউনিয়ান গতি কণার পতনে বাধা সৃষ্টি না করে।

২। পতন নলে পতন দ্রব্যের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে তরল দ্রব্য থাকতে হবে যাতে কোন কণার পতন অন্য কোন কণার দ্বারা বিঘ্নিত না হয় অথবা পাত্রের প্রাচীরের নৈকট্য দ্বারা কণার পতন প্রভাবিত না হয়।

৩। কণাগুলো অবশ্যই দৃঢ় ও মসৃন হতে হবে। অন্যথায় গলে যাবে।

৪। তরল পদার্থ ও কণাগুলোর মধ্যে কোন পিচ্ছিলতা থাকবে না।

৫।  কণার পতনের গতি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হবেনা। তরলের সান্দ্রতা কণার পতনে বাধা সৃষ্টি করবে।

 

স্টোকস (Stokes’) এর সূত্রের সীমাবদ্ধতা:

সকল মৃত্তিকা কণা একই আকৃতির নয়, যেমনঃ বালি কণা গোলাকার অন্যদিকে কর্দম কণা প্লেট আকৃতির। বিভিন্ন আকৃতির কণা বিভিন্ন গতিতে পড়বে। সুতরাং ইহা স্টোকস (Stokes) এর সূত্রের একটি বড় বাধা। কণার পতনের গতি মাধ্যমের সান্দ্রতার পরিবর্তনের বিপরীতভাবে পরিবর্তিত হয়।

এজন্য বিশ্লেষণের সময় একটি জানা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। যেমন : ১৫°C তাপমাত্রায় চেয়ে ৩০°C তাপমাত্রায় একটি কণার পতন গতি ১২% বৃদ্ধি পায়। তা মৃত্তিকা কণার ঘনত্ব স্টোকস (Stokes) এর সূত্র প্রয়োগের আরও একটি বড় বাধা। কণা সমূহের ঘনত্ব খনিজ ও রাসায়নিক উপাদান এবং পানিযোজনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। এমনকী কোন কণার ঘনত্ব সঠিকভাবে নির্ণয় করাও কঠিন।

যেমন : একটি পানিযোজিত কণা অপানিযোজিত কণা অপেক্ষা তাড়াতাড়ি পড়বে। যেহেতু কণার পতনের গতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হবে না এজন্য পলিকণার চেয়ে বড় কণার গতি যেমনঃ বালি কণার পতন গতি এ সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যাবে না।

 

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আজকের আলোচনা। শিলাক্ষয় (Weathering) একটি ধ্বংসাত্বক প্রক্রিয়া কিন্তু মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া গঠনমূলক যা মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Profile) তৈরিতে সহায়তা করে। শিলাক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলা ও খনিজের উপর জলবায়ু ও বিভিন্ন ধরনের জীবের ক্রিয়ার ফলে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। ইহা একটি দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া। শিলাক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট চূর্ণ-বিচূর্ণ মৃত্তিকার উৎস বস্তু প্রধানত তিনটি প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকায় রূপলাভ করে।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া

যথা :

  • চুনীকরণ (Calcification)
  • ল্যাটেরাইজিকরণ (Laterization )
  • পড়জলিকরণ (Podzolization)

কী প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উৎস বস্তু থেকে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র সৃষ্টি হবে তা প্রধানত সেখানকার জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে মৃত্তিকার পার্শ্বচিত্র (Profile) গঠনে তিনটি ভৌত প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যথা হিউমিফিকেশন (Humification), চুয়ীসরণ (Eluviation.) এবং সঞ্চয়ন (Illuviation ) । মৃত্তিকা গঠনের প্রধান তিনটি প্রক্রিয়া আলোচনার পূর্বে উল্লিখিত তিনটি ভৌত প্রক্রিয়া আলোচনা করা প্রয়োজন।

হিউমিফিকেশন (Humification ) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

নিরক্ষীয় (Tropical) ও অবনিরক্ষীয় (Sub-tropical) অঞ্চলে জীবদেহের (উদ্ভিদ ও প্রাণীর) অবশেষ বা জৈবপদার্থ বিয়োজিত হয়ে মাটির উপরের স্তরে হিউমাস স্তর গঠন করে। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি থাকার ফলে জৈব পদার্থের পচন দ্রুত সংঘটিত হয়। হিউমাস হলো জৈবপদার্থ পচনের বা বিয়োজনের সর্বশেষ অবস্থা। হিউমাস উৎপাদনের সময় নানা জৈব এসিড (হিউমিক এসিড) ও কার্বন-ডাই অক্সাইড (CO2) উৎপন্ন হয়। এসব জৈব এসিড মৃত্তিকার উপরের স্তরের খনিজ পদার্থসমূহকে দ্রবীভূত করে নিচের দিকে নিয়ে যায়। ফলে মৃত্তিকা প্রোফাইলে A ও B স্তর গঠন সহায়ক হয়।

চুয়ীসরণ এবং সঞ্চয়ন (Eluviation and Illuviation) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে চুইয়ে মৃত্তিকার গভীরে প্রবেশ করে। এই পানি উপরি স্তরের খনিজ পদার্থকে দ্রবীভূত করে ক্রমে নিচের দিকে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে চুয়ীসরণ (Eluviation) বলে। যে স্তর থেকে খনিজ পদার্থ অপসারিত হয় তাকে পরিস্রুত (Eluvial) স্তর বলে এবং যে স্তরে সঞ্চিত বা জমা হয় তাকে সঞ্চিত (Illuvial) স্তর বলে। খনিজ আয়নসমূহ উপরের স্তর থেকে চলে এসে নিচের স্তরে জমা হবার প্রক্রিয়াকে সঞ্চয়ন (Illuviation) বলে। চুয়ীসরণ আবার নিচের স্তর থেকে উপরের স্তরেও ঘটতে পারে। যে সব অঞ্চলে বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে বাষ্পীভবন বেশি সেখানে এ ধরণের চুয়ীসরণ ঘটে থাকে।

চুয়ীসরণ ও সঞ্চয়ন এর মধ্যে পার্থক্য (Differences between Eluviation & Illuviation) চুয়ীসরণ (Eluviation) ও সঞ্চয়নের (Illuviation) মধ্যে পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ

চুনীকরণ (Calcification) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হয় সেখানে এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। বৃষ্টিপাত কম হলে অনুসরন (Infiltration) কম হয়। উপরের স্তর থেকে খাড়াভাবে নিচের স্তরে পানির চলাচলকে অনুসরণ বলে। যেসব এলাকায় বাস্পীভবন বেশি হয় সেক্ষেত্রে নিচের স্তরের পানি দ্রবণীয় চুনজাতীয় আয়ন (ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) উপরের স্তরে জমা হয়। এ প্রক্রিয়ায় চুনজাতীয় পদার্থ মৃত্তিকার উপরের স্তরে জমা হয় বলে তাকে চুনীকরণ বলে। এ প্রক্রিয়ায় যে মাটি গঠিত হয় তাকে পেডোকেল (Pedocal) বা ক্যালসিয়ামযুক্ত মাটি বলে। ভারতের রাজস্থানে এ ধরণের মৃত্তিকা বেশি দেখা যায়।

ল্যাটেরাইজিকরণ (Laterization ) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

উষ্ণমন্ডলীয় অতি বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায় এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। এসব এলাকায় জৈব পদার্থের বিয়োজন দ্রুত সংগঠিত হয়। অতিবৃষ্টির ফলে বিয়োজিত জৈব পদার্থ, ক্যালসিয়াম ও সিলিকা জাতীয় কর্দম নিচে চলে যায়। এ ছাড়া এসব এলাকায় মৃত্তিকার অনেক গভীর স্তর পর্যন্ত শিলাক্ষয় (Weathering) সংগঠিত হয়। ক্রমাগত শিলাক্ষয় ও জৈবপদার্থের বিয়োজন এবং অতিবৃষ্টির ফলে উপরের স্তরের বিশেষ করে ক্যালসিয়াম সম্পূর্ণরূপে অনুসাবিত (Infiltration) হয়ে নিচের স্তরে চলে যায়। লৌহ ও এলুমিনিয়াম ভূ-পৃষ্ঠে বা তার সন্নিকটে জমা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ল্যাটেরাইজিকরণ বলে এবং এর ফলে সৃষ্ট মৃত্তিকাকে পেডালফার (Pedalfer) মৃত্তিকা বলে। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মাটির বর্ণ লাল এবং এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম কম পরিমাণে থাকে। দক্ষিণ ভারতের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার অধিকাংশই এ প্রক্রিয়াজাত।

পলিকরণ (Podzolization) এর মাধ্যমে মৃত্তিকা গঠন:

আমরা জানি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে জৈবিক ও অজৈবিক পদার্থসমূহ এক স্তর হতে অন্য স্তরে অনুসারিত হয়। যে সব অঞ্চলের জলবায়ু আর্দ্র ও শীতল সে অঞ্চলে এ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা গঠিত হয়। আর্দ্র-শীতল জলবায়ু সম্পন্ন এলাকায় জৈবপদার্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্তিকা কণা, লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম যৌগসমূহ A স্তর থেকে অনুসারিত হয়ে প্রায় সম্পূর্ণরূপে B স্তরে জমা হয়। দ্রবণীয় ক্যালসিয়াম যৌগসমূহ সম্পূর্ণরূপে অনুসাবিত হয়ে বের হয়ে যায়। মৃত্তিকা গঠনের এ প্রক্রিয়াকে পলিকরণ (Podzolization) বলে। এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট মৃত্তিকাকে পড়জল মৃত্তিকা বলে। ভারতের কাশ্মীরে এ ধরনের মৃত্তিকা পাওয়া যায়।

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলাফল:

মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়ার ফলাফল তিনটি :

১।মৃত্তিকার উৎস বস্তুর উপাদানগুলির আকার কমে যায় এবং এসব উপাদান একত্রিত হয়ে মৃত্তিকার একটি সুনির্দিষ্ট সংযুক্তি (Structure) সৃষ্টি করে।

২। ভূ-পৃষ্ট বা তার নিকটবর্তী জৈবপদার্থসমূহ একত্রে জমা হয়।

৩। মৃত্তিকার একটি সুস্পষ্ট প্রোফাইল বা পার্শ্বচিত্র গঠিত হয়, যাতে A, B ও C স্তর (Horizon) নামে পরিচিত সুচিহ্নিত স্তরগুলি গঠিত হয়। জৈব পদার্থ সম্বলিত ভূ-পৃষ্ঠ সমপূর্ণ শিলাক্ষয় প্রাপ্ত (Completety weathered) মৃত্তিকাকে A স্তর বলে। এর নিচের উর্বর উপাদানগুলো B স্তর নামে পরিচিত। আংশিক শিলাক্ষয় প্রাপ্ত মৃত্তিকার উৎসবস্ত সম্পন্ন স্তরকে C স্তর বলে।

পরবর্তী পাঠে মৃত্তিকা পার্শ্বচিত্র (Soil profile ) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

সূত্র:

  • মৃত্তিকা গঠন প্রক্রিয়া, পাঠ ১.৫, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

 

শিলাক্ষয় মৃত্তিকা বিজ্ঞান

শিলাক্ষয় মৃত্তিকা বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপুর্ন বিষয়। আজকে আমরা শিলাক্ষয় কী, কেন, কিভাবে হয়, বা এর কারণে কি হয়, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচানা করবো।

শিলাক্ষয় মৃত্তিকা বিজ্ঞান

শিলাক্ষয় কী (What is weathering):

পূর্বের পাঠে শিলা ও খনিজ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। শিলা ও খনিজ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি যেমন : সূর্যতাপ, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, বায়ুমন্ডলীয় চাপ ও অন্যান্য রাসায়নিক শক্তির প্রভাবে ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। সুতরাং প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে শিলার চূর্ণ হওয়াকে শিলাক্ষয় বলে।

এসব চূর্ণ বিচূর্ণ অংশের সাথে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহাবশেষ মিলে কালক্রমে মৃত্তিকা তৈরি হয়। সুতরাং যে ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শিলা ও খনিজ পদার্থ মাটি সৃষ্টির জন্য আলগা বা অজমাটবদ্ধ পদার্থে পরিণত হয় তাকে শিলাক্ষয় (Weathering) বলে। বিভিন্ন বিজ্ঞানী শিলাক্ষয়কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। বিজ্ঞানী N. C. Brady’র মতেও প্রাকৃতিক উপায়ে বায়ুমন্ডলীয় শক্তির প্রভাবে ভূ-ত্বকের উপরে শিলার ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনকে শিলাক্ষয় বলে৷ অন্যদিকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এম. এম. রাই এর মতে, শিলাক্ষয় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ভূ-ত্বকের কঠিন শিলা ভেঙ্গে মৃত্তিকার উৎস বস্তুতে পরিণত হয়।

শিলাক্ষয়ের গুরুত্ব:

কঠিন শিলাকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে মৃত্তিকার উৎস বস্তুতে (Soil Parent material) উন্নীত করা এবং সর্বোপরি মৃত্তিকায় রূপান্তরিত করার সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া সাধনে শিলক্ষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং শিলাক্ষয় ব্যতিরেকে মাটি সৃষ্টির কথা কল্পনা করা যায় না।

শিলাক্ষয়ের প্রকারভেদ (Types of weathering):

শিলাক্ষয় প্রধানত দুই প্রকার যথা :
১। ভৌত শিলাক্ষয় (Physical Mechanical weathering)
২। রাসায়নিক শিলাক্ষয় (Chemical weathering)

ভৌত শিলাক্ষয় (Physical Mechanical Weathering):

প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ যেমনঃ তাপমাত্রা, বায়ু প্রবাহ, হিমবাহ, নদী প্রবাহ ইত্যাদির প্রভাবে বড় বড় শিলা ও খনিজ পদার্থ ভেঙ্গে ছোট আকারে পরিণত হওয়াকে ভৌত শিলাক্ষয় বলে। এ প্রক্রিয়ায় শুধু শিলা বা খনিজের ভৌত পরিবর্তন হয়। রাসায়নিক উপাদানের কোন পরিবর্তন হয় না বলে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যেরও কোন পরিবর্তন হয় না। যেমন : গ্র্যানাইট শিলা ভেঙ্গে গ্র্যানাইট শিলার কয়েকটি টুকরো হতে পারে কিন্তু গ্র্যানাইটের বৈশিষ্ট্যের কোন পরিবর্তন হয় না।

রাসায়নিক শিলাক্ষয় (Chemical Weathering) শিলা ও খনিজ পদার্থসমূহ ভৌতভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার পর পরই শুরু হয় রাসায়নিক বিযোজন। এটি বিশেষত উষ্ণ ও আর্দ্র এলাকায় উল্লেখযোগ্য হারে ঘটে যেখানে ভৌত ও রাসায়নিক শিলাক্ষয় নিবিড়ভাবে সংঘটিত হয় এবং একে অপরকে ত্বরান্বিত করে।

পানির উপস্থিতিতে রাসায়নিক শিলাক্ষয় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়। উদ্ভিজ্জ অবশিষ্টংাশের জীবাণুঘটিত ভাঙ্গনের (Breakdown) ফলে O2 এবং জৈব ও অজৈব এসিড সৃষ্টি হয়। এদের যুগপৎ ক্রিয়ায় রাসায়নিক শিলাক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। এ সমস্ত এজেন্ট যৌথভাবে প্রাথমিক খনিজের উপর ক্রিয়া করে এদেরকে সেকেণ্ডারী খনিজে রূপান্তরিত করে এবং পরিশেষে উদ্ভিদের অপরিহার্য খাদ্য উপাদানে পরিণত হয়। রাসায়নিক শিলাক্ষয়ের ফলে শিলা ও খনিজের স্থায়ী রাসায়নিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

 

ভৌত শিলা ক্ষয়ের উপাদানসমূহ:

(ক) তাপমাত্রা

(খ) বায়ু প্রবাহ

(গ) হিমবাহ

(ঘ) নদী প্রবাহ

(ঙ) উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রভাব

(চ) বরফ জমা ও গলা

(ছ) পানি

(জ) মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তি

ক) তাপমাত্রা জনিত শিলা ক্ষয়:

শিলা তাপ কুপরিবাহী। কাজেই শিলা পৃষ্ঠের উচ্চতাপ কেবল সামান্য অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। উত্তাপের ফলে শিলাপৃষ্ঠ আয়তনে অধিক সম্প্রসারিত হয় বলে তা অবশিষ্টাংশ থেকে আলাদা হয়ে যায়। বড় আকারের শিলার চেয়ে মিহি আকারের শিলায় এবং উঁচু স্থানে যেখানে অল্প সময়ের ব্যবধানে তাপমাত্রা বেশি পরিবর্তিত হয় সেক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া সহজেই চোখে পড়ে। বিজ্ঞানী Bartlett (১৮৩২) দেখিয়েছেন যে, প্রতি ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রতিফুটে গ্রানাইট ০.০০০০০২৬৮ ইঞ্চি সম্প্রসারিত হয়।

দিন ও রাতের তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে পাশাপাশি সংলগ্ন ভিন্ন ভিন্ন খনিজে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সংকোচন ও প্রসারণ ঘটে। ফলে শিলাস্থ স্ফটিকগুলো আলগা হয়। যাতে শিলাগুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়া শিলার সূক্ষ্ণ দশা অপেক্ষা স্থূল দশায় বেশি কার্যকরী। এভাবে শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত অন্যান্য শক্তির ক্রিয়ার ফলে মৃত্তিকা পদার্থে পরিণত হয়।

(খ) বায়ুপ্রবাহ জনিত শিলা ক্ষয় :

বায়ুপ্রবাহ যখন ধূলিকণায় পূর্ণ থাকে তখন তা শিলা ও শিলাস্থ খনিজগুলোতে এক ঘর্ষণের সৃষ্টি করে। বায়ু সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে এবং উপকূল অঞ্চলে শিলাক্ষয় ঘটায়। ধূলি-ঝড় বিপুল ওজনের পদার্থ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে নিয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ের মৃত্তিকা ও মরু অঞ্চলের মৃত্তিকা এ ধরণের ভৌত শিলাক্ষয় দ্বারা গঠিত। এদের মধ্যে মোটা পদার্থ বেশি অনুপাতে থাকে। এদের ভৌত মিশ্রণ দেখিয়ে রেখা আকলে তার উচ্চতর অংশ প্রায় সরল রেখার মত হয়।

(গ) হিমবাহ জনিত শিলা ক্ষয় :

যে অঞ্চলে সারা বছর বরফজমে, হিমবাহ দ্বারা সে অঞ্চলে পানি নিষ্কাশিত হয়। পার্বত্য অঞ্চলে প্রবাহমান হিমবাহের চলার পথে শিলাসমূহ ধাক্কা ও ঘর্ষণের ফলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। হিমবাহ বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে চলে বলে এর ক্ষয়সাধনের সামর্থ্য অনেক বেশি। হিমবাহ প্রবল চাপের সহিত পাহাড় পর্বত ও নদীর উপর দিয়ে চলতে থাকে। ফলে এর সাথে ঘর্ষণের ফলে যে কোন বস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।

(ঘ) নদী প্রবাহ জনিত শিলা ক্ষয়:

নদী প্রবাহের সাথে যে প্রচুর কর্দম, পলি, নুড়িপাথর এমনকি স্থানচ্যুত বড় শিলা থাকে, তাতে শুধু যে উপত্যকা গভীর ও বিস্তৃত হতে থাকে তাই নয়, এগুলো বিভিন্ন পদার্থকে ভেঙ্গে মৃত্তিকা গঠন করার মত অবস্থায় নিয়ে যায়। প্রবাহমান পানির ক্ষমতা এর বেগের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বিজ্ঞানী Dulton হিসেব করেছেন, কলরাডো নদী ১৪,000 বর্গমাইল আয়তনের স্থান থেকে ১০,০০০ ফুট শিলা স্তর স্থানচ্যূত করেছে।

(ঙ) উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রভাব জনিত শিলা ক্ষয়:

Joffe বলেন, সত্যিকার অর্থে জৈবিক শিলাক্ষয় বলতে কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে এটি উদ্ভিদ ও প্রাণী দ্বারা সংগঠিত ভৌত ও রাসায়নিক শিলাক্ষয়। এটি তিনভাগে বিভক্ত :

(১) ক্ষুদ্র জীবাণুর কার্য জনিত শিলা ক্ষয়:

মাটিস্থ ব্যাকটেরিয়া মাটি হতে নানা প্রকার মৌলিক পদার্থ গ্রহণ করে, আবার মারা গেলে এদের দেহ বিয়োজিত হয়। ব্যাকটেরিয়া জৈবপদার্থকে বিয়োজিত করে মাটির সাথে মিশ্রিত করে। এভাবে ক্ষুদ্র জীবাণুর তৎপরতার দ্বারা নানা প্রকার জৈব ও রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে ফলে শিলা ও খনিজ পদার্থের বিগলন হয়।

(২) উদ্ভিদের কার্য জনিত শিলা ক্ষয়:

শিলার গায়ে জন্মানো নিম্নস্তরের উদ্ভিদ সরে যাওয়ার পরে পচে নানা প্রকার এসিড উৎপাদন করে শিলায় স্থানীয়ভাবে ক্ষয় ঘটায়। অন্যদিকে শিলার ফাটলে বৃহদাকার উদ্ভিদ জন্মালে এদের শিকড় চারপাশে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে এবং শিলার ভাঙ্গন ঘটায়।
গাছপালা শ্বাসক্রিয়ায় CO2 ত্যাগ করে। এটি পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড উৎপাদন করে যা শিলাক্ষয় ঘটায়। লাইকেন নামক উদ্ভিদ শুষ্ক পাথর হতে খাবার শুষে নেয়। এতে শিলাক্ষয় হয়।

(৩)  প্রাণীর কার্যাবলী জনিত শিলা ক্ষয়:

কেঁচো, সজারু, ইঁদুর, উইপোকা, পিঁপড়া, উড়চোঙ্গা ইত্যাদি মাটিতে ৫ ফুট গভীর পর্যন্ত গর্ত করতে পারে। এতে পানি ও বায়ু মৃত্তিকার নিচের স্তরে প্রবেশ করে এবং অন্তভূমি এভাবে প্রাণীর দ্বারা শিলাক্ষয় এর জন্য উন্মুক্ত হয়। কেঁচো যখন মাটি তোলে তা কেঁচোর পাকস্থলীর ভেতর দিয়ে বের হবার সময় পাথর জাতীয় বস্তুগুলো আকারে ছোট হয়ে যায় এবং মাটির উপরিস্তরে উদ্ভিজ্জ সমৃদ্ধ একটি মিহি স্তর সৃষ্টি হয়। মানুষ তার স্বীয় প্রয়োজনে শিলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটি খুড়ে, পুকুর খনন করে, রাস্তা তৈরি করে। এ সমস্ত কার্য সম্পাদনের সময় শিলা বা খনিজগুলো ভেঙ্গে যায়। কর্ষণের সময় মাটি আলোড়িত হয় বলে শিলা বা খনিজ কণায় ভাঙ্গা-গড়া চলতে থাকে। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রাণী বা মানুষের প্রভাবে শিলা বা খনিজের অবক্ষয় চলছে।

(চ) পানির মাধ্যমে শিলা ক্ষয়:

বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত, সেচের পানি, পানিস্রোত, গড়ানী পানি ইত্যাদি শিলা ও খনিজ পদার্থের উপর চাপ/বল প্রয়োগ ভৌত শিলাক্ষয় ত্বরান্বিত করে। পাহাড় থেকে ঝরনা বা প্রস্রবণের পানি অনবরত পড়তে থাকলে শিলা ভেঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককে পরিণত হয়।

(ছ) বরফ জমা ও গলার মাধ্যমে শিলা ক্ষয়:

ঠান্ডা পানি যখন বরফে পরিণত হয় তখন এর আয়তন ৯% বৃদ্ধি পায়। এর আয়তন বৃদ্ধির সময় প্রতি বর্গ ফুটে ১৫০ টন অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১ টনেরও বেশি চাপের সৃষ্টি হয়। এ চাপের প্রভাবে শিলাস্থ ফাটলগুলো প্রসারিত হয় যার ফলে শিলা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।য টুকরোগুলো এত ছোট হয় যে, এরপর যখন বরফ গলে তখন এগুলো বরফ গলা পানির সঙ্গে গড়িয়ে চলে যায়। অতি সচ্ছিদ্র শিলা বিশেষত যখন সংপৃক্তির কাছাকাছি অবস্থায় থাকে, বরফ জমার সময় খুব সহজে গুড়া হয়ে যায়। ঠান্ডা ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল যেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে বরফ জমা এবং গলা শিলার ভৌতক্ষয় এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(জ) মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তি জনিত শিলা ক্ষয় :

পর্বতের উপরের ভঙ্গুর বা অদৃঢ় শিলা খন্ড মাধ্যাকর্ষণজনিত শক্তির প্রভাবে নিচে পতিত হওয়ার সময় পাথরের গায়ে ধাক্কা লাগে। তখন তা আবারও ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে পরিণত হয়।

রাসায়নিক শিলাক্ষয়ের উপাদানসমূহ:

(ক) দ্রবণ (Solution)
(খ) আর্দ্র বিশ্লেষণ (Hydrolysis)
(গ) পানি সংযোজন (Hydration)
(ঘ) কার্বোনেশন (Carbonation)
(ঙ)জারণ (Oxidation)
(চ) বিজারণ (Reduction)

দ্রবণ :

শিলা যে সকল উপাদানে গঠিত তার প্রায় সবগুলোই বিশুদ্ধ পানিতে গলে না। আবার কিছু কিছু খনিজ যেমনঃ কোয়ার্টজ CO2 যুক্ত পানিতে গলে না। বৃষ্টির পানিতে সামান্য পরিমাণ CO, দ্রবীভূত থাকে। গাছের শিকড়ের শ্বাসকার্যের ফলে ও জৈব পদার্থের পচনের ফলে মৃত্তিকার বায়ুতে যথেষ্ট পরিমাণ CO, থাকে যা পানিতে দ্রবীভূত হয়।

বিজ্ঞানী Wollny দেখছেন যে, ১.৫ মি. গভীরে বছরের বিভিন্ন সময়ে CO2 এর পরিমাণ শতকরা ৩.৮৪-৪.০৬ ভাগ থাকে। ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি CO2 পরিমাণ কম (০.৩-১০ ভাগ) থাকে। তবু ইহা বায়ুমন্ডলের তুলনায় অনেক বেশি। গাছপালা পচনের ফলে আরও জৈব অম্লের সৃষ্টি হয় যা মৃত্তিকাস্থ পানির দ্রবণীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অন্যান্য খনিজের তুলনায় CaCO3 এর দ্রবণীয় শক্তি অনেক বেশি। সেজন্য CaCO3 বহণকারী শিলা অগ্নীয় জলে খুব সহজে খন্ড খন্ড হয়ে যায় আর অকার্বনেট পদার্থ অবশিষ্টাংশ হিসেবে পড়ে থাকে।

মৃত্তিকা দ্রবণে খনিজ পদার্থ ও জৈব এসিডের উপস্থিতির ফলে এর H এর পরিমাণ এবং দ্রবণে পানির বিয়োজন বৃদ্ধি পায়। কাজেই ক্ষয় হওয়ার মত সিলিকেট খনিজের উপর পানির প্রভাব মূলত H”-এর ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে ।
Ca, Mg, Na, Al ও Fe এর জটিল সিলিকেট আর্দ্র বিশ্লেষণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। HD ক্ষার ও ক্ষারীয় মাটির আয়নকে খনিজ পদার্থের স্ফটিক স্তর (Lattice) থেকে অপসারিত করে।

ফলে অ্যালুমিনোসিলিসিক ও ফেরোসিলিসিক এসিড উৎপন্ন হয় এবং ক্ষার বা ক্ষারীয় হাইড্রোক্সাইড মুক্ত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে সিলিসিক এসিড পৃথক হয়ে যায় এবং প্রথম অবস্থায় স্ফটিক স্তর (Lattice) পরিবর্তিত রূপ নেয়। পটাশ ফেল্ডস্পার থেকে কেওলিনাইট গঠন এ পরিবর্তনের একটি উদাহরণ।

বিমুক্ত ক্ষারীয় এবং মৃত্তিকার ক্ষারীয় হাইড্রোক্সাইড সালফেট বা বাইকার্বোনেট হিসাবে নিষ্কাশিত হয়। অ্যালুমিনা ও ফেরিক হাইড্রোক্সাইডগুলো পুণরায় বিমুক্ত সিলিসিক এসিড বা তার অংশের সাথে মিলে দ্বিতীয় পর্যায়ের যৌগ উৎপন্ন করে যেগুলো বিশেষত্বের দিক দিয়ে কর্দম খনিজের কাছাকাছি। কোন কোন খনিজ দ্রব্য আয়নিত পানির সংস্পর্শে আসলে এর H খনিজ থেকে ক্ষারক প্রতিস্থাপিত হাইড্রোক্সাইড উৎপন্ন করে। এ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত রাসায়নিক যৌগ মাটি থেকে চুইয়ে ( Leaching) নিচে চলে যেতে পারে বা অন্যভাবে অপসারিত হতে পারে।

পানি সংযোজন (Hydration) :

ইহা হলো একটি বিশেষ খনিজের সাথে পানির রাসায়নিক সংযোজন। শিলাগুলো ভৌত প্রক্রিয়ায় ভেঙ্গে খনিজে বিভক্ত হয়ে পড়লে তা পানির সংস্পর্শে এসে পানি শোষণ করে নেয় তখন এ পানি খনিজ অণুগুলোর রাসায়নিক উপাদানে পরিণত হয়। ফেল্ডস্পার, এম্পিবুল, পাইরক্সিন জাতীয় খনিজগুলো পানির সংস্পর্শে আসলে পানি এই খনিজ অণুগুলোর ভেতর স্থান করে নেয়।

অণুগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম অনেকটা পরিবর্তিত হয়। তখন কোন কোন খনিজের বর্ণ পরিবর্তিত হয়, আবার কোন কোনটির বন্ধন শিথিল হয়ে যায় এবং অনেকগুলোর আয়তন বেড়ে যায়। যে সব খনিজ থেকে কর্দম কণিকার উপাদান গঠিত হয় সেগুলো প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে নেয়। এভাবে পানি শোষণের ফলে অনেক খনিজের বিয়োজন হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় সংগঠিত রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহ নিম্নরূপ :

 

কার্বোনেশন (Carbonation) :

জৈব পদার্থের বিয়োজনে কিংবা উদ্ভিদ শিকড়ের শ্বসন প্রক্রিয়ার ফলে CO2 উৎপন্ন হয়। এ CO2 পানির সঙ্গে মিশে H2CO3 উৎপন্ন করে। ক্ষারীয় উপাদান সমৃদ্ধ খনিজের সঙ্গে এই এসিডের বিক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট খনিজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যে সকল শিলা গলে যায় এদের মধ্যে Ca Mg, K, Na, Fe বিদ্যমান থাকে। এ উপাদানগুলো এসিডের সংস্পর্শে এসে গলে যেতে শুরু করে।

হাইড্রোলাইসিস প্রক্রিয়ায় যে সব হাইড্রোক্সাইড উৎপন্ন হয় সেগুলো এসিডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এ দু’প্রকার বিক্রিয়ায় বিভিন্ন রকম কার্বোনেট ও বাইকার্বোনেট উৎপন্ন হয়। যে সব এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় সেখানে Carbonation এর মাধ্যমে খনিজের ওয়েদারিং বেশি হতে দেখা যায়। এ প্রক্রিয়া যুগপৎ কাজ করে।

মৃত্তিকা দ্রবণে যত বেশি HD থাকবে শিলা বা খনিজের ওয়েদারিং তত বৃদ্ধি পাবে। এ H যদি কোন এসিড থেকে আসে তাহলে বিয়োজনের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।

জারণ (Oxidation) :

স্বাভাবিকভাবে অক্সিজেনের সংযোজনকে জারণ বলে। কিন্তু রসায়নবিদদের মতে, জারণ হলো কোন পরমাণু, আয়ন ও মূলক থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হওয়া বা অপসারিত হওয়া। পানি সংযোজন ও জারণ পাশাপাশি সংগঠিত হয়। সচরাচর আয়রন বহণকারী খনিজে ইহা সংগঠিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু খনিজে আয়রন বিজারিত ফেরাস (Fet”) আয়ন হিসেবে ++ থাকে।

যদি এ ফেরাস Fe আয়ন জারিত হয়ে ফেরিক আয়নে (Fe) পরিণত হয় তবে খনিজে আয়নিক সমন্বয় সাধিত হয়। ফলে কম স্থায়ী খনিজ উৎপন্ন হয়, যা পরবর্তীতে বিচূর্ণীভবন এবং রাসায়নিক ভাঙ্গন প্রক্রিয়ায় বিযোজিত হয়। অলিভাইন- এ পানি সংযোজনের ফলে FeO বিমুক্ত হয়, যা দ্রুত জারিত হয়ে জিওথাইট (Geothite) এ পরিণত হয়।

যখন কোন আয়ন যেমন : Fe খনিজ থেকে বিমুক্ত হয় কিংবা জারিত (Oxidized) হয় তখন খনিজের গাঠনিক দৃঢ়তা হ্রাস পায়। ফলে খনিজের যান্ত্রিক ভাঙ্গন সহজতর হয় যা পরবর্তী রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

বিজারণ :

ইহা জারণের বিপরীত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় কোন পরমাণু বা অণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে। পাথর চূর্ণ, কাঁকড় বা নবীন মাটি ইত্যাদিতে ছোট বড় অনেক রন্ধ্র থাকে। কখনও কখনও রন্ধ্রগুলো পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। আবার কখনও কখনও জৈব পদার্থের বিয়োজনে CO2 উৎপন্ন হয়, যারা O কে অপসারিত করে। এ অবস্থায় O2 এর অনুপস্থিতিতে শিলা বা খনিজের বিজারণ প্রক্রিয়া হয়ে থাকে। এতে শিলার স্বাভাবিক কঠিনতা লোপ পায়। ফলে শিলা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। Fe 20, H₂ FeO+ H₂0 + ভৌত ও রাসায়নিক শিলাক্ষয়ের পার্থক্য :

 

সোর্স:

  • শিলাক্ষয় , পাঠ ১.৪, ইউনিট ১ , ১২০৪, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, বিএজিএড, বাউবি

বীজমান বৈশিষ্ট্যসমূহ

বীজমান বৈশিষ্ট্যসমূহ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়” এর “স্কুল অব এগ্রিকালচার এন্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট” এর “বিএজেড” স্তরের “বাউবি বিএই ১২০৪ – মৃত্তিকা বিজ্ঞান” এর “ইউনিট ১” এর “বাংলাদেশের কৃষি” এর পাঠ – ১.৩।

বীজমান বৈশিষ্ট্যসমূহ

মৃত্তিকা বিজ্ঞান , শিলা কী (What is Rocks) ? সিলেটের জাফলং বা শ্রীপুর থেকে আগত পাথর ভর্তি ট্রাক কিংবা আমাদের সড়ক ও রেলপথ তৈরির পাথর সবাই দেখে থাকবেন। বনভোজন কিংবা ভ্রমণের জন্য যারা জাফলং কিংবা শ্রীপুরে গিয়েছেন তারা পাহাড়ী ঝরণায় পাথরের আগমন দৃশ্য নিশ্চয় অবলোকন করেছেন।

ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, পাহাড়ী ঝরণা ধারায় নেমে আসা এ সব পাথরকে শিলা বলে। তাপ, চাপ ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে এরা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে উঁচু পাহাড়ী এলাকা থেকে পানির স্রোতে গড়িয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। গড়িয়ে গড়িয়ে নিচের দিকে আসার ফলে ঘর্ষণের কারণে এরা মসৃন ও সুন্দর আকার প্রাপ্ত হয়।

সুতরাং ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, শিলা হলো দুই বা ততোধিক খনিজের সংমিশ্রণ বা দলা যা ভূত্বকের অপরিহার্য অংশসমূহ গঠন করেছে এবং যাদের ধর্ম ধারণকৃত খনিজের ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল। যেমনঃ গ্র্যানাইট, চুনাপাথর ইত্যাদি। (According to the Geologists rock is a mixture or aggregate part of the earth’s crust, the properties of which will vary on the basis of minerals they contain . Such as granite, limestone etc.)।

 

শিলার প্রকারভেদ (Classification of rocks):

গঠন ও উৎস অনুসারে শিলাকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় :

১। আগ্নেয় শিলা ( Igneous rocks)

২। পাললিক শিলা (Sedimentary rocks)

৩। রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic rocks)

 

আগ্নেয় শিলা (Igneous rocks):

পৃথিবীর আদিম অবস্থার উত্তপ্ত ও গলিত লাভা কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সময় উত্থিত উত্তপ্ত গলিত লাভা ঠান্ডা হয়ে যে শিলার সৃষ্টি হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে।
আগ্নেয় শিলার বৈশিষ্ট্য

→ উত্তপ্ত গলিত অবস্থা হতে ঠান্ডা হয়ে এ জাতীয় শিলার উৎপত্তি হয় বলে আগ্নেয় শিলায় কোন স্তর থাকে না।

→ উত্তপ্ত গলিত পদার্থের মধ্যে জীব-জন্তুর অস্তিত্ব অসম্ভব। বৃক্ষলতাও তাতে জন্মে না। এ কারণে আগ্নেয়শিলার ভিতর জীবাশা দেখতে পাওয়া যায় না।

→ গলিত অবস্থা হতে তাপ বিকিরণ করে ক্ষেত্র বিশেষে এ জাতীয় শিলা কেলাসিত হয় বা নির্দিষ্ট
আকার ধারণ করে।

→ উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূ-পৃষ্ঠে ঠান্ডা হলে তাকে বহিঃজ আগ্নেয় শিলা (Extrusive igneous rocks) বলে। অপর পক্ষে উত্তপ্ত গলিত পদার্থ ভূ-পৃষ্ঠে আসতে না পেরে পৃথিবীর অভ্যন্তরেই ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে। এ রূপে গঠিত আগ্নেয় শিলাকে অন্তঃজ (Intrusive) আগ্নেয় শিলা বলে। ব্যাসল্ট, পিউমিকস্টোন, লাপিলি ইত্যাদি হলো বহিঃজ আগ্নেয় শিলা। অন্যদিকে গ্র্যানাইট, গ্যাব্রো, সায়েনাইট, পরিফাইরি ইত্যাদি অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা।।

 

পাললিক শিলা (Sedimentary rocks):

তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ, সাগরতরঙ্গ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে আগ্নেয় শিলা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ছোট ছোট নুড়ি, কাকর ও বালিতে পরিণত হয়। অতঃপর অংশসমূহ উল্লিখিত প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা বাহিত হয়ে সমুদ্র, হ্রদ বা উপমহাদেশের তলদেশে পলল বা তলানীরূপে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয়। পরে তা বায়ুর চাপে জমে শক্ত ও দৃঢ় আকার প্রাপ্ত হয়। এ ধরনের শিলাকে পাললিক শিলা বলে। পলল বা তলানী হতে এ শিলা গঠিত হয় বলে একে পাললিক শিলা বলে। আবার স্তরে স্তরে সঞ্চিত হয় বলে এ শিলাকে স্তরীভূত (Stratified) শিলা বলে। ইহা অকেলাসিত ।

 

পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য:

  • এ শিলা মূল শিলার (Older rocks) ক্ষয়প্রাপ্ত অংশ হতে সৃষ্টি হয়।
  • পাললিক শিলা স্তরে স্তরে সৃষ্টি হয় বলে এর মধ্যে স্তর থাকে।
  • এ শিলার মধ্যে জীবাশা দেখা যায়।
  • ইহা উত্তপ্ত অবস্থা হতে সৃষ্ট নয় বলে অকেলাসিত ।
  • ইহা গৌণ বা মাধ্যমিক (Secondary) শিলা নামে পরিচিত।

ইহা ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় উন্নত (Developed) হতে পারে। বালিপাথর (Sand stone), শেল (Shale), ডলোমাইট (Dolomite), সিল্ট স্টোন (Silt stone), চুনাপাথর (Lime stone) ইত্যাদি পাললিক শিলার উদাহরণ।

 

রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic rocks):

প্রচন্ড তাপ ও চাপের যৌথ প্রভাবে মূল আগ্নেয় ও পাললিক শিলা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে অধিকতর কঠিন ও স্ফটিকাকার যে নতুন শিলার সৃষ্টি হয় তাকে রূপান্তরিত শিলা বলে। এ ভাবে চুনাপাথর (পাললিক শিলা) রূপান্তরিত হয়ে মার্বেলে, বেলেপাথর (পাললিক শিলা) পরিবর্তিত হয়ে কোয়ার্টজাইট, কাদা পরিবর্তিত হয়ে প্লেটে (Slate), গ্র্যানাইট (আগ্নেয় শিলা) পরিবর্তিত হয়ে নীসে ( Gneisses) পরিণত হয়।

আগ্নেয়শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় রূপান্তরিত হলে তাকে আগ্নেয় রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমন : গ্র্যানাইট নীসে ( Gneisses ), পরিণত হওয়া। অনুরূপভাবে পাললিক শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলায় পরিণত হলে তাকে পাললিক রূপান্তরিত শিলা বলে। যেমনঃ বেলে পাথর পরিবর্তিত হয়ে কোয়ার্টজাইট পরিণত হওয়া।

 

রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য:

আগ্নেয় ও পাললিক শিলা উভয় শিলা পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তরিত শিলার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ইহা আগ্নেয় ও পাললিক শিলার জাতক।

প্রচন্ড তাপ ও চাপের যৌথ প্রভাবে এ নতুন প্রকৃতির শিলার সৃষ্টি হয়। O ইহা কেলাসিত হয় বলে ইহাকে পাললিক শিলা থেকে পৃথক করা যায়।
এ জাতীয় শিলার খনিজ উপাদানগুলি সমান্তরাল থাকে বলে আগ্নেয় শিলা থেকে সহজে পৃথক করা যায়।

 

খনিজ (Minerals) কী:

প্রাকৃতিক অজৈব প্রক্রিয়ায় তৈরি সমসত্ব স্ফটিকাকার বস্তু যার সুনির্দিষ্ট আণবিক গঠন ও রাসায়নিক সংযুক্তি রয়েছে তাকে খনিজ বলে। দুই বা ততোধিক খনিজ একত্রিত হয়ে শিলা গঠন করে। সুতরাং খনিজ হলো শিলা গঠনের উপাদান।

 

খনিজ প্ৰধানত দু’প্রকার :

প্রাইমারী খনিজ (Primary minerals) : উত্তপ্ত গলিত ম্যাগমা শীতল ও কঠিন হওয়ার ফলে সৃষ্ট খনিজকে প্রাইমারী খনিজ বলে। যেমনঃ কোয়ার্টজ (SiO2 ) অর্থোরেজ ( KAISiO3) মাস্কোভাইট [KAI Si, O 10 (OH)2], বায়োটাইট ( KAI (Mg-Fe), Si, O10 (OH)2], ইত্যাদি প্রাইমারী খনিজ।

সেকেন্ডারী খনিজ (Secondary minerals) : তাপ, চাপ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে প্রাথমিক খনিজ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যে খনিজ সৃষ্টি হয় তাকে সেকেন্ডারী খনিজ বলে। যেমনঃ ক্যালসাইট (CaCO3), জিপসাম (CaSO4, 2H2O), লিমোনাইট, (Fe2O3, 3H2O), ডলোমাইট [(CaMg (CO3)2]

শিলা ও খনিজের মধ্যে পার্থক্য:

ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মে শিলা ও খনিজ পদার্থে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নিচে শিলা ও খনিজের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য তুলে ধরা হলো।

বীজমান বৈশিষ্ট্যসমূহ , মৃত্তিকা বিজ্ঞান , ইউনিট ১ , পাঠ ১.৩