আগাছা দমন ও রোগিং নিয়ে আজকের আলোচনা। বীজ ফসলের জমিতে অনাকাঙ্খিত কোন উদ্ভিদ জন্মালে তাকে আগাছা বলা যাবে। এই আগাছা বীজ ফসলের সাথে খাদ্য ও পানি গ্রহণে প্রতিযোগিতা করবে ও বীজ ফসলকে সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি হতে দেবে না। তাই বীজ ফসলের প্লট সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। বীজ প্লটের পরিচর্যা আলোচনাকালে বিষয়টি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বীজ উৎপাদন গাছের বংশ রক্ষার একমাত্র উপায়। তাছাড়া ফসলের ফলন বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ভালো বীজ উৎপাদনের বিকল্প নেই। সাধারণ ফসল উৎপাদন পদ্ধতির চেয়ে বীজ ফসল উৎপাদন পদ্ধতি কিছুটা আলাদা।
অর্থাৎ বীজ ফসল উৎপাদন করার জন্য বিশেষ কিছু পরিচর্যা ও যত্ন নেয়া প্রয়োজন। আমরা বীজ থেকে ফসল উৎপাদন করি খাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন বীজ হিসেবে ফসল উৎপন্ন করব তখন সতর্কতার সাথে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
আগাছা দমন ও রোগিং
যেমন : ভালো বীজ ব্যবহার, উপযুক্ত স্হান ও জমি নির্বাচন, জমি সুচারুরূপে কর্ষন করা এবং মাত্রা মোতাবেক সার প্রয়োগ করা, নির্দিষ্ট ফসলের জন্য নির্দিষ্ট নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা যাতে বিজাতি বা অন্য জাতের সাথে পরাগায়ন হতে না পারে, উত্তমরূপে আগাছা দমন করা এবং সময়মত ও প্রয়োজন মাফিক কীটনাশক/বালাইনাশক স্প্রে করা যাতে বীজ ফসল পোকামাকড় বা রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত না হয়। বীজ ফসল নির্দিষ্ট সময়ে পরিপক্ক ও পুষ্ট হওয়ার পর বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
রোগিং:
বীজ ফসলের জমিতে অন্য ফসল, অন্য জাত বা একই জাতের অবক্ষয় প্রাপ্ত গাছ জন্মালে সেগুলোকে তুলে ফেলে অপসারণ করাকে রোগিং বলে। বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ গুলোর উপস্হিতি বীজের বিশুদ্ধতা নষ্ট করে। পর পরাগায়নের মাধ্যমে নির্ধারিত জাতটির যাতে অবক্ষয় না হয় তার জন্য গাছে ফুল আসার আগেই যথা সম্ভব রোগিং করা উচিত। কতবার রোগিং করতে হবে তা নির্ভর করবে ফসল এবং মাঠের অবস্হার ওপর। সাধারণত সকল ফসলের বেলায় নিম্নের যে কোন স্তরে অথবা সব কটি স্তরেই রোগিং করার প্রয়োজন হতে পারে
(ক) গাছের বৃদ্ধি/ফুল আসার আগে।
(খ) ফুল আসার সময়।
(গ) ফসলের পরিপক্কতা আসার পূর্ববর্তী সময়ে।
গাছের বৃদ্ধির সময় এবং ফুল আসার আগেই সর্বপ্রথম রোগিং করা উচিত, যাতে অন্য জাতের সাথে সংক্রমিত হয়ে নির্বাচিত জাতটির বংশগত বিশুদ্ধতা নষ্ট না হয়। এ সময় নির্বাচিত জাতটির সাথে উচ্চতায়, গাছের রং এর বিভিন্নতায়, পাতার আকার ও গঠনে এবং অন্য যে কোন দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেই তা মাঠ থেকে নির্মূল করতে হবে। এমনকি একই জাতের রোগাক্রান্ত এবং বিকলাংগ গাছ সমূলে তুলে দূরে ফেলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
প্রথম রোগিং এর সময় অনাকাঙ্খিত কোন গাছ চিনতে না পারলে, দ্বিতীয় রোগিং অর্থাৎ ফুল আসার সময় সেগুলোকে নির্মূল করতে হবে। এ সময় খুব সাবধানে রোগিং করা না হলে অনাকাঙ্খিত গাছের পরাগরেনু বাতাসে ছড়িয়ে যেতে পারে। তৃতীয় এবং সর্বশেষ রোগিং ফসল পরিপক্ক হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে করা প্রয়োজন। এ সময় নির্বাচিত জাতটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয় এমন সব গাছ (Off type) তুলে ফেলতে হবে। জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য রোগিং একটি উত্তম পদ্ধতি। ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য ফসল ও মাঠের অবস্থাভেদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক রোগিং করা আবশ্যক।
সূত্র:
আগাছা দমন ও রোগিং , বীজ ও বীজ প্রযুক্তি , ইউনিট-২ , পাঠ-২.২
বীজ উৎপাদন: স্থান নির্বাচন, জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ২ নং ইউনিটের ২.১ নং পাঠের অংশ। যে কোন জাতের বীজ উৎপাদনে স্থানীয় এলাকার জলবায়ুর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। সুতরাং বীজ উৎপাদনের সময় ঐ এলাকার মাটির প্রকৃতি এবং জলবায়ু, যেমন : তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সুর্যের আলো, দিবসের দৈর্ঘ্য ( Day length), ভূমির উচ্চতা, বাতাসের আর্দ্রতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। যে জাত যে পারিপার্শ্বিকতার উপযোগী এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এবং ব্যাপক চাহিদা আছে সেই জাতের বীজই সেই এলাকায় উৎপাদন করা উচিত।
বীজ উৎপাদন
অধিকাংশ ফসলের ফুলের বৃদ্ধি এবং পরাগায়নের জন্য সূর্যালোকিত শুষ্ক দিন এবং মধ্যম তাপমাত্রার প্রয়োজন। তাই বীজ উৎপাদনের জন্য বাতাসের আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মোটামুটি মাঝারী হলে ভালো হয়। বাতাস অনেক ফসলের পরাগায়নে সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে রৌদ্রজ্জল আবহাওয়ার সাথে হালকা বাতাস ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত পোকামাকড় ও রোগবালাই এর প্রার্দুভাব ঘটায় এবং বীজকর্তন থেকে বীজ শুকানো পর্যন্ত সকল স্তরে অসুবিধার সৃষ্টি করে। তাই উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের জন্য প্রচুর সুর্যের আলো, মাঝারী বৃষ্টিপাত, শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়া এবং পরাগায়নের সময় হালকা বাতাস প্রবাহিত হয় এ ধরনের স্থান নির্বাচন করা উচিত।
বীজ উৎপাদনের জন্য জমি নির্বাচন:
জমি নির্বাচন কালে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে :
(ক) জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ উর্বর দোআঁশ মাটি বীজ উৎপাদনের জন্য উত্তম। কারণ এ ধরনের মাটি পর্যাপ্ত রস ও খাদ্যোপাদান ধারণ এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করতে পারে। বীজ উৎপাদনের জমি সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া সমীচীন।
(খ) বীজ ফসলের মাটি রোগ জীবাণু এবং ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ মুক্ত হওয়া একান্তপ্রয়োজন। যথোপযুক্ত শস্য পর্যায় ও আবাদ প্রযুক্তি অনুসরণ এবং পরিচ্ছন্ন চাষাবাদের ব্যবস্হা করেও রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
(গ) কোন জমিতে উপর্যুপরি একই জাতের বা পরিবারের সবজি চাষ এবং দুই তিন বৎসরের মধ্যে সমগোত্রীয় সবজির উৎপাদন করা অনুচিত।
(ঘ) বীজ প্লট সমতল হওয়া উচিত।
বীজ উৎপাদনের জন্য জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ:
বীজ উৎপাদনের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। ভালোভাবে জমি কর্ষণ করে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে। জমি ভালোভাবে তৈরি করা হলে বীজ ভালোভাবে অঙ্কুরিত হবে। এ ছাড়াও জমি সমতল হওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রিত সেচ প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
বীজের গঠন, পরিপুষ্টি ও ফলন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের প্রয়োজন হয়। বীজ ফসলের সমন্বিত বৃদ্ধির জন্য সঠিক নিয়মে ও সুষম মাত্রায় জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করা উচিত। সাধারণত নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম বীজ ফসলের সমন্বিত বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গাছের বৃদ্ধি ও ফলনের উপর নাইট্রোজেনের প্রভাব অত্যন্ত বেশি। নাইট্রোজেনের সুষ্ঠু প্রয়োগ যেমন এ কাজে সহায়তা করে, অতিরিক্ত প্রয়োগেও তেমনি ফসলের পরিপক্কতা বিলম্বিত হওয়ার কারণে বীজ মানের সাংঘাতিক অবনতি হতে পারে।
তাই গাছের বৃদ্ধি বিবেচনা করে নাইট্রোজেন সার কিস্তিতে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। বীজ বপনের কিছুদিন পর প্রথম এবং ফুল আসার সময় দ্বিতীয় মাত্রার নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফসলের বীজের ফলন ও মান উন্নয়নে সহায়তা করে। ফসফরাসের সুষম মাত্রা গাছের শিকড় বৃদ্ধি, কান্ডকে শক্ত ও মজবুত, বীজের ফলন ও পরিপক্কতা বৃদ্ধি ও ফসলকে আগে পাকতে সাহায্য করে। পটাশিয়াম ফুল ও ফলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং রোগ দমন ও বীজের গুণগতমান উন্নয়নে সাহায্য করে।
এ ছাড়াও অন্যান্য খাদ্য উপাদান যেমন : সালফার, বোরন, ম্যাগনেশিয়াম, কপার ও জিংক এর অভাব বীজ পরিপক্কতা ও বীজ গঠনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাই মাটি পরীক্ষা করে সুষম সার প্রয়োগ করা উচিত।
বীজ নির্বাচন:
বীজ ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত বীজ অবশ্যই নির্ধারিত মানের (জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত) এবং পরিচিত ও অনুমোদিত উৎস থেকে সংগৃহীত হতে হবে। বীজ কেনার সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা প্রয়োজন :
(ক) নির্ধারিত শ্রেণীর বীজ ক্রয়, যেমন : ভিত্তি বীজ উৎপাদন করতে হলে মৌল বীজ ব্যবহার করতে হবে। তেমনি প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের জন্য ভিত্তি বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
(খ) ক্রয় করা মৌল বীজ/ভিত্তি বীজের বস্তায় বীজ উৎপাদনকারী ও বীজ প্রত্যয়ন সংস্হার সরবরাহকৃত ট্যাগ ও সিল অক্ষুন্ন থাকতে হবে।
(গ) ব্যবহারের সময়সীমা উত্তীর্ণ হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
(ঘ) ক্রয় করা সকল বীজ একই জাতের কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
বীজ বপন:
প্রায় বীজই সারিতে বপন/রোপণ করা ভালো। নির্দিষ্ট দূরত্বে সারিতে বীজ বপন করলে তা যথেষ্ট আলো বাতাস ও খাদ্য পাবে। বীজ ফসলের অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা সুবিধাজনক হবে এবং বীজও কম লাগবে। সারিতে বীজ বপনের জন্য বীজ বপন যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তা ব্যবহার করার আগে অবশ্যই পরিস্কার করে নিতে হবে যেন উক্ত যন্ত্রে অন্য কোন জাতের বীজ আটকিয়ে না থাকে।
ফসলকে ভালোভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য বপনের গভীরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ছোট ছোট বীজ অল্প গভীরে এবং বড় আকারের বীজ মাটির গভীরে বপন করা হয়। কর্দমাক্ত মাটির চেয়ে বেলে মাটিতে অধিক গভীরে বীজ বপন করতে হয়। শুষ্ক মাটিতে কিছুটা গভীরে বীজ বপন করা হলে মাটির আর্দ্রতার সংস্পর্শে এসে অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করবে। বীজ বপনের গভীরতা অনেকটা নির্ভর করে মাটির প্রকৃতি, মাটিতে রসের পরিমাণ এবং বীজের আকারের উপর।
নিরাপদ দূরত্ব:
বীজ ফসলকে কলুষিত হওয়ার সম্ভাব্য সকল উৎস থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয়। অর্থাৎ ভিন্ন জাতের সাথে যাতে পর পরাগায়ন না ঘটে তার জন্য যথাযথ দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হয়। বীজ ফসলের জন্য এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যথোপযুক্তভাবে পালন করলে এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জাতের মধ্যে পরপরাগায়ন, শস্য সংগ্রহকালীন সংমিশ্রণ এবং সমগোত্রীয় অন্যান্য ফসল থেকে রোগ ও পোকার বিস্তার রোধ করা যায়। যদি কোন কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব না হয়, তবে বীজ প্লটের চারদিকে একই ফসলের অতিরিক্ত বর্ডার লাইন রোপণ করে বীজ প্লটের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব।
নিরাপদ দূরত্ব নির্ভর করে বিভিন্ন ফসলের বিভিন্ন জাতের এবং কোন শ্রেণীর বীজ তার ওপর। যেমন : ভিত্তি বীজ আলু উৎপাদনের বেলায় ২০০ মিটারের মধ্যে একই সময়ে বা একই মৌসুমে নিম্নমানের বীজ দ্বারা আবাদকৃত আলু ফসল বা জাব পোকার আশ্রয়দানকারী ফসল গাছ যেমন : তামাক, মরিচ, বেগুন বা অন্য স্হানীয় জাতের আলুর চাষকরা চলবে না। কারণ ভাইরাস রোগ জাব পোকার মাধ্যমে বীজ আলুতে সংক্রমন হতে পারে। নিম্নে বিভিন্ন ফসলের নিরাপদ দূরত্বের এবং পরাগায়নের ধরনের একটি তালিকা দেয়া হলো :
আগাছা দমন:
বীজ প্লট সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। কারণ জমিতে আগাছা থাকলে বীজ ফসল কর্তনের সময় আগাছা মিশ্রিত থাকার ফলে মাড়াই অংগনে ফসলের বীজ এবং আগাছা বীজ একত্রে মিশে বীজের মানের অবনতি ঘটায়। তাছাড়া আগাছা মূল ফসলের সাথে খাদ্য ও পানি গ্রহণে প্রতিযোগিতা করে বিধায় বীজ ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি হয় না। আগাছা পোকামাকড় ও রোগজীবাণুর আশ্রয়স্হল। অতএব বীজ প্লটকে সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে পারলে মান সম্পন্ন বীজ উৎপাদন সম্ভব হবে।
কীট-পতংগ ও রোগবালাই দমন:
রোগ ও পোকার আক্রমণে কেবল ফলনই হ্রাস পায় না, অনেক সময় বীজে সংক্রামক রোগের আক্রমণও ঘটে। তাই বীজ প্লটকে কীট পতংগ ও রোগবালাই এর হাত থেকে রক্ষা করতে পারলে শুধুমাত্র বীজের ফলনই বৃদ্ধি পাবে না, সাথে সাথে রোগমুক্ত ও স্বাস্থ্যবান বীজও পাওয়া যাবে। কীট পতংগ এবং রোগবালাই সময়মত দমন করা না হলে বীজের মান নষ্ট হতে পারে।
কিছু কিছু জীবাণু বীজের মধ্যে থাকে যা খালি চোখে দেখা যায় না। যদি এ সমস্ত রোগ দমন করা না হয় তবে রোগের জীবাণু উৎপাদিত বীজের মধ্যে অনেকদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে যা পরবর্তী মৌসুমে রোগাক্রান্ত গাছের জন্ম দিবে। মান সম্পন্ন বীজ পেতে হলে (ক) ব্যবহৃত বীজ অবশ্যই শোধিত হতে হবে, (খ) পোকামাকড় এবং রোগবালাই দেখা দেয়া মাত্র তা দমনের জন্য নির্ধারিত ঔষধ সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে (গ) রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ফেলে রোগ বিস্তার রোধ করতে হবে।
পানি সেচ ও নিষ্কাশন:
শুষ্ক আবহাওয়া মান সম্পন্ন এবং রোগমুক্ত বীজ উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কিন্তুএই পরিবেশে প্রয়োজনীয় সেচ প্রয়োগ না করলে বীজের ভালো ফলন আশা করা যায় না। জমিতে যথেষ্ট রস না থাকলে বীজ বপনের পূর্বে উপযুক্ত পরিমাণ সেচ দিয়ে যথাযথভাবে জমি তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। জমিতে প্রয়োজনীয় রস না থাকলে বীজের অঙ্কুর বের হয় না। আবার জমিতে অতিরিক্ত রস থাকলে তা বীজের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। মাটি পানি দ্বারা সম্পৃক্ত (Saturated) অবস্হায় চলে গেলে অক্সিজেনের অভাবে বীজ অঙ্কুরিত না হয়ে বরং পচে যেতে পারে।
কাজেই ফসল ও মাটি ভেদে সেচের পরিমাণ ও প্রয়োগ নির্ভর করে। সাধারণত ফুল আসার আগে এক থেকে দুইটি সেচই বীজ ফসলের জন্য প্রয়োজন।
পরিমিত সেচ গাছের খাদ্য উপাদান গুলোকে ব্যবহারপোযোগী করে গাছের বৃদ্ধি, প্রস্বেদন ও শ্বসনে সহায়তা করে। ফসলের বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে সেচের প্রয়োজনীয়তা এক নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে গাছের শাখা প্রশাখা বৃদ্ধির সময় সেচের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ সময় মাটিতে রস না থাকলে গাছের বৃদ্ধি থেমে যায় এবং কান্ড শুকিয়ে যায়। পানি পেলে গাছ আবার সজীব হয়ে উঠে। তাই সময়মত প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দেয়া দরকার।
কিছু কিছু বীজ ফসলে সেচ খুবই সংবেদনশীল। সেচ একটু বেশি হলেই বিভিন্ন রোগ ব্যাধির আক্রমণ বেড়ে যায়। অতিরিক্ত সেচ অনেক সময় ফসলের পরিপক্কতাকে বিলম্বিত করে, যা মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের জন্য মোটেই উপাযোগী নয়। কিছু কিছু সবজি ও পেঁপে দাঁড়ানো পানি একবারেই সহ্য করতে পারে না। তাই সেচ বেশি হলে বা বৃষ্টির কারণে পানি জমে গেলে তা দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্হা করতে হবে।
বীজ ফসলের জমিতে সাধারণত নিম্নলিখিত তিন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যেতে পারে:
(ক) সেচ নালার সাহায্যে মাটির উপরিভাগে
(খ) ফোয়ারা পদ্ধতিতে ফসলের উপরে
(গ) মাটির অভ্যন্তরে গাছের গোড়ায়
যে পদ্ধতিতেই সেচ দেয়া হোক না কেন, ফসলের জমিতে সমানভাবে যাতে সেচ প্রয়োগ করা হয়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিমিত এবং সময়মত সেচ প্রয়োগই সেচের কার্যকারিতাকে ফলপ্রসু করে তোলে। ফসল কাটার ২/৩ সপ্তাহ পূর্বে অবশ্যই সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে।
বীজ উৎপাদনের জন্য – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ১.৮ ও ১.৯ নং পাঠ।
বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ( ব্যবহারিক)
কোন বীজের কোন সুপ্ত ভ্রূণ জাগ্রত হওয়ার নাম অংকুরোদগম। অংকুরিত বীজ সংখ্যা তাত্ত্বিকভাবে শতকরা হারে নির্ণয় করে অংকুরোদগম পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ১০০টি বীজ গজাতে দিলে কতটি বীজ গজিয়েছে বের করলেই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতার শতকরা হার বের হয়ে আসে। অংকুরোদগম ক্ষমতার হার পূর্ণ সংখ্যায় প্রকাশ করতে হয়।
এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য:
(১) বীজ নমূনার স্বাভাবিক চারা উৎপাদনকারী বীজের সংখ্যা (%) নির্ণয়
(২) বীজ নমূনায় অন্যান্য উপকরণ অংশের তুলনায় স্বাভাবিক চারা উৎপাদনকারী বীজের পারস্পরিক পরিমাণ নির্ণয়।
(৩) বপনের জন্য বীজের হার ও বীজের বাজার মূল্য নির্ধারণ।
(৪) বীজের প্রকৃত মান নির্ধারণ।
পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি:
(১) বীজ অঙ্কুরোদগম যন্ত্র
(২) বোর্ড (সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য)
(৩) মাটি ও বালির বাক্স
( ৪ ) তোয়ালে, চোষ কাগজ, পেট্রিডিস
(৫) নমূনা রাখার ট্রে ইত্যাদি
পরীক্ষা পদ্ধতি:
বিশুদ্ধ বীজের অংশ থেকে অংকুরোদগমের জন্য বীজ নমূনা নিন। অংকুরোদগমের জন্য কমপক্ষে ৪০০ বীজ নিন এবং পরীক্ষা নির্ভুল হওয়ার জন্য এগুলো চারটি ভাগে (Replicate) ভাগ করুন। প্রতি ভাগে ১০০ টি বীজ থাকবে।
সর্ব প্রথম উপযুক্ত পাত্রে যে কোন একটি অংকুরোদগম মাধ্যমের ( চোষ কাগজ, ফিল্টার কাগজ, বালি, করাতের গুড়া, তোয়ালে) উপর প্রয়োজনীয় পানি ও বীজ নিন। বীজ স্হাপনের সময় কমপক্ষে বীজের সমান মাপের ১-৫ গুন স্হান ফাঁকা রাখুন।
পেট্রিডিস ব্যবহার করা হলে বীজ বসানোর প্রথম দিন পেট্রিডিসটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন। এতে পানির বাষপায়ন কম হয়। তারপর পেট্রিডিস গুলো উপযুক্ত পরিবেশে গবেষণাগারে রেখে দিন। সুবিধা থাকলে পেট্রিডিসগুলো নিয়ন্ত্রিত অঙ্কুরোদগম যত্নে রাখুন।
(ক) এখন পেট্রিডিসে নেওয়া বীজের নাম, জাত, সংখ্যা ও পরীক্ষায় বসানোর তারিখ কাগজে লিখে রাখুন।
(খ) প্রতিদিন লক্ষ রাখুন যেন পানি শুকিয়ে না যায়। পানি শুকিয়ে গেলেই পুণরায় পেট্রিডিসে পানি দিন। অতিরিক্ত পানি ক্ষতিকর।
পরীক্ষার ৪টি ভাগের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হলে পুনরায় পরীক্ষা সম্পাদন করতে হবে।
যে বীজগুলোকে অংকুরোদগম পরীক্ষার জন্য বসানো হবে, অংকুরিত হওয়ার পর সেগুলোকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয় যেমন :
(১) স্বাভাবিক বীজ অর্থাৎ যেগুলো স্বাভাবিক চারার জন্ম দেয়।
(২) অস্বাভাবিক বীজ অর্থাৎ যেগুলো অস্বাভাবিক চারার জন্ম দেয়। (৩) মৃত বীজ অর্থাৎ একেবারেই গজায় না।
(৪) সজীব বীজ অর্থাৎ সুপ্তাবস্হা ভাংগার পর অংকুরোদগম হতে পারে।
(৫) শক্ত বীজ অর্থাৎ সুপ্তাবস্হা ভাংগার পরও অংকুরোদগম হতে নাও পারে। (মালভেসী ও লিগুমিনোসি পরিবারের কোন কোন বীজে শক্ত বীজের উপস্হিতি দেখা যায়।)
প্রথম গণনার সময় স্বাভাবিক বীজগুলো (যা গজিয়েছে) গণনা করে এবং মৃত বীজগুলো (যদি চিহ্নিত করা যায়) ফেলে দিতে হয়। প্রাথমিক গণনার ফলাফল কাগজে / রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। এরপর দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত গণনা খুব সতর্কতার সাথে করতে হয়। এ সময় যদি সুপ্ত বীজের উপস্হিতি টের পাওয়া যায় তবে চূড়ান্ত গণনার তারিখ আরও ৫ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে। বীজের সুপ্তকাল ভাংগার পরও (পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা জিবারেলিক এসিড প্রয়োগ করে) যদি কোন বীজ না গজায়, তবে সে বীজ মৃত/শক্ত বীজ বলে ধরে নিতে হবে।
স্বাভাবিক চারার বৈশিষ্ট্য :
স্বাভাবিক চারার বৈশিষ্ট্য সকল বীজের ক্ষেত্রে এক নয়। নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকলে মোটামুটিভাবে চারাকে স্বাভাবিক চারা বলা যেতে পারে।
(ক) সুস্হ ও বর্ধিষ্ণু চারা হলে ।
(খ) চারার শিকড় সুউন্নত হলে।
(গ) ইপিকোটাইল ও হাইপোকোটাইল অক্ষত থাকলে (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
(ঘ) গ্রামিনি পরিবারের চারার ক্ষেত্রে কলিওপটাইল ও প্রাথমিক পাতা সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হলে (যেমন : গম)।একবীজ পত্রী বীজের জন্য একটি বীজপত্র এবং দ্বিবীজপত্রী বীজের ২টি বীজপত্র থাকলে।
(জ) চারার বৃদ্ধি সুষম থাকলে।
(ছ) চারার সীমিত স্হানে ক্ষত রয়েছে, তবে কোন পরিবহণকারী কোষ কলা ক্ষতিগ্রস্হ না হয়ে থাকলে।
(জ) চারা সুস্হ থাকলে, দ্বিবীজপত্রী বীজের একটি বীজপত্র বর্তমান থাকলে (বীজপত্রের সংযোগস্হল অক্ষত থাকা সাপেক্ষে)।
(ঝ) ইপিজিয়েল অংকুরোদগমের ক্ষেত্রে শিকড় ও হাইপোকোটাইলের যুক্ত দৈর্ঘ্য বীজের দৈর্ঘ্যের ৪ গুণের বেশি হয়ে গাছের কান্ড, পাতা ও শিকড় সুষমভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে।
অস্বাভাবিক চারার বৈশিষ্ট্য :
(ক) চারা ক্ষতিগ্রস্হ হয়ে বীজপত্র না থাকলে এবং গাছের কান্ড, পাতা ও শিকড়ে বিস্তৃত ক্ষত সৃষ্টি হলে।
(খ) কান্ড, পাতা ও শিকড়ের বৃদ্ধি অসম হলে।
(গ) বেঁকে যাওয়া ও বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রুমিউল বা হাইপোকোটাইল বা এপিকোটাইল সম্পন্ন চারা হলে ।
(ঘ) কান্ড, পাতা, শিকড় রোগাক্রান্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত চারা।
১। স্বাভাবিক চারা (এপিকোটাইল ও ব্রেডিকল এর বৃদ্ধি ভাল)
২। অস্বাভাবিক চারা (দুর্বল রেডিকল)
৩। অস্বাভাবিক চারা (রেডিকল বৃদ্ধি খুব খারাপ)
৪। অস্বাভাবিক চারা (স্ফীত এপিকোটাইল)
৫। অস্বাভাবিক চারা (খুব দুর্বল এপিকোটাইল ও রেডিকল)
৬। অস্বাভাবিক চারা (এপিকোটাইল অনুপস্থিত)
বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
আন্তর্জাতিক বীজ পরীক্ষা সংস্হা কর্তৃক অনুমোদিত বীজের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কয়েকটি পদ্ধতি নিয়ে বর্ণনা করা হলোঃ
(ক) অল্টারনেরিয়া পদ্ধতি :
সরিষা পরিবারের সবজি ও তৈলবীজ অল্টারনেরিয়া গোত্রের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। বীজে ২, ৪ ডাইক্লোরো ফেনোক্সি এসিটিক এসিডে ০.২% সোডিয়াম প্রয়োগ করে ১৮–২২° সেঃ তাপমাত্রায় ৬–১১ দিন রাখার পর অণুবীক্ষন যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষায় উল্লেখিত রোগ জীবাণুর উপস্হিতি জানা যায়।
(খ) ভাইরাস পরীক্ষা :
সরাসরি বীজে ভাইরাস রোগের উপস্হিতি নির্ণয় করা যায় না, তাই বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে ভাইরাসের আক্রমণ যাচাই করে বীজে ভাইরাসের উপস্হিতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়। তাছাড়া বীজ গুঁড়ো করে তার নির্যাস নির্দিষ্ট গাছে প্রয়োগ করে রোগাক্রমণ হয় কী না তা প্রত্যক্ষ করেও বীজে ভাইরাসের উপস্হিতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
আপনার টিউটোরিয়েল কেন্দ্রে টিউটরের সহযোগিতায় বীজের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অনুশীলন করতে পারবেন। তবে বাহ্যিকভাবে ও বীজের গায়ে বিভিন্ন রোগ পোকার আক্রমণের চিহ্ন কিংবা বীজের বর্ণের উজ্জ্বলতার তারতম্য দেখেও বীজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভ করা সম্ভব। সুস্থ বীজে সবল চারা উৎপাদন করা সম্ভব। রোগাক্রান্ত বীজ দ্বারা চারা উৎপাদন করা গেলেও পরবর্তীতে উৎপন্ন চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে।
আজকের পাঠে আমরা আলোচনা করব বীজেরবিশুদ্ধতাপরীক্ষা নিয়ে, যা বীজওবীজপ্রযুক্তি বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক অংশ। এই পাঠে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে বীজের বিশুদ্ধতা নির্ণয় করা হয় এবং এই পরীক্ষায় কী ধরনের যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা
বীজেরবিশুদ্ধতাপরীক্ষাকী?
বীজের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা বলতে বোঝায়—কোনো নির্দিষ্ট বীজ নমুনায় ওজনের ভিত্তিতে শতকরা কত ভাগ মূলশস্যেরবিশুদ্ধবীজ রয়েছে, তা নির্ধারণের প্রক্রিয়া। এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় নমুনায় অবাঞ্ছিত উপাদান কতটা বিদ্যমান এবং কৃষকের জন্য তা কতটা উপযোগী।
বীজনমুনারপ্রধানউপাদানসমূহ
একটি সাধারণ বীজ নমুনায় সাধারণত নিচের চারটি উপাদান থাকে:
১. বিশুদ্ধবীজ (Pure Seed): যে বীজটি মূলত চাষের উদ্দেশ্যে নির্বাচন করা হয়েছে।
২. অন্যফসলেরবীজ (Other Crop Seed): অন্য ফসলের অনাকাঙ্ক্ষিত বীজ যা মূল ফসলের সঙ্গে মিশে গেছে।
৩. আগাছারবীজ (Weed Seed): অনিষ্টকারী আগাছার বীজ যা জমিতে গিয়ে ফসলের ক্ষতি করতে পারে।
৪. জড়পদার্থ (Inert Matter): খড়কুটা, পাতা, ধুলাবালি, চিটা, ছাতাগুটি ইত্যাদি অবাঞ্ছিত বস্তু।
ব্যবহারিকপরীক্ষায়প্রয়োজনীয়যন্ত্রপাতি
সঠিকভাবে বিশুদ্ধতা নির্ধারণের জন্য নিচের যন্ত্রপাতিগুলি ব্যবহার করতে হয়:
পিউরিটিবোর্ড (Seed Purity Board)
সুনির্দিষ্টমাপকনিক্তি (যা +0.001 গ্রাম পর্যন্ত ওজন নির্ণয় করতে পারে)
উপাদানপৃথককরণ:
নিচের চারটি উপাদান আলাদা করুন—চিমটা ব্যবহার করে:
বিশুদ্ধ বীজ
অন্য ফসলের বীজ
আগাছার বীজ
জড় পদার্থ
সনাক্তকরণেসতর্কতা:
যদি কোনো বীজ শনাক্ত করতে সন্দেহ হয়, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস ব্যবহার করে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করুন।
পেট্রিডিসেসাজানোওওজননির্ধারণ:
পৃথক করা প্রতিটি উপাদান আলাদা পেট্রিডিসে রাখুন এবং আলাদাভাবে প্রতিটির ওজন নির্ণয় করুন।
বীজেরবিশুদ্ধতারহিসাব:
ধরা যাক—
বিশুদ্ধ বীজের ওজন = P গ্রাম
কার্য সম্পাদিত মোট নমুনার ওজন = W গ্রাম
তাহলে, বীজেরবিশুদ্ধতারহার = (P ÷ W) × 100
⚠️ গুরুত্বপূর্ণনোট:
যদি কার্য সম্পাদিত নমুনার ওজন W এবং মূল নমুনা ওজন G এর মধ্যে পার্থক্য ১% এর বেশি হয়, তাহলে পুনরায় পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
বিশুদ্ধ বীজ অংশ :
বীজেরবিশুদ্ধতাপরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করতে হলে নমুনার প্রতিটি উপাদান সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হয়। এজন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করে বিশুদ্ধ বীজ, অন্য ফসলের বীজ, আগাছা বীজ এবং জড় পদার্থ পৃথক করতে হবে।
১. বিশুদ্ধবীজঅংশ (Pure Seed):
বিভিন্ন ফসল বা প্রজাতিভেদে বিশুদ্ধ বীজের সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে নিচের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ বীজ নির্ধারণ করা যায়:
✅ সম্পূর্ণ, অক্ষত ও সুস্থ বীজ
✅ ভাঙা বীজ হলেও যদি ভ্রূণসহ ৫০% বা তার বেশি অংশ অবশিষ্ট থাকে
যে বীজটি পরীক্ষাধীন ফসলের নির্ধারিতজাতব্যতীতঅন্যান্যজাতবাপ্রজাতির অন্তর্গত, সেগুলো এই শ্রেণিতে পড়বে। এর মধ্যে থাকতে পারে:
পুষ্ট বীজ
আংশিকভাবে পুষ্ট বীজ
ভাঙা বীজ (যদি অর্ধেক বা তার বেশি অংশ থাকে)
🔹 এগুলো দেখতে অনেকটা মূল বীজের মতো হলেও ভিন্নজাতবাভিন্নফসল হওয়ায় বিশুদ্ধ বীজের মধ্যে গণ্য হবে না।
৩. আগাছারবীজঅংশ (Weed Seed):
পরীক্ষাধীন নমুনায় থাকা সমস্ত সনাক্তযোগ্য আগাছার বীজ এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
পূর্ণ বীজ
ভাঙা বীজ
ফাটল ধরা বা অপূর্ণ বীজ
🛑 এইসব বীজ মাঠে গিয়ে অপ্রয়োজনীয়আগাছাহিসেবেবৃদ্ধিপায়, যা ফসলের ফলন ব্যাহত করে।
৪. জড়পদার্থ (Inert Matter):
উপরে উল্লিখিত তিনটি বিভাগের বাইরে যে কোনো উপাদান জড়পদার্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
মূল শস্য বা অন্য শস্য বীজের ৫০% এর কম অবশিষ্ট অংশ
ছাতাগুটি বা কৃমিসদৃশ গঠন (বাইরে বা ভিতরে) যুক্ত বীজ
চিটা বা ফাঁপা বীজ
খড়কুটা, শুকনো পাতা, কাণ্ড ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ অংশ
ধুলাবালি, মাটি কণা, ইটের টুকরো, নুড়ি
মৃত বা জীবিত পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ
📌 জড়পদার্থ পরীক্ষার মান ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এই উপাদানসমূহ বীজ থেকে পৃথক করা অত্যন্ত জরুরি।
✅ পরিশেষে:
বীজ বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের পর প্রতিটি উপাদান যথাযথভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে নোটবুকে লিপিবদ্ধ করুন। এতে আপনি নিজের হাতে বিশুদ্ধতার হার হিসেব করতে সক্ষম হবেন এবং এটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় আত্মবিশ্বাস এনে দেবে।
বীজের আর্দ্রতা পরীক্ষা- পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.৬ নং পাঠের অংশ। তাত্ত্বিকভাবে বীজের আর্দ্রতা বলতে বীজের মধ্যে যে মুক্ত পানি আছে তাকেই বুঝায় যা সমস্ত বীজের ওজনের শতকরা হারে প্রকাশ করা হয়।ফসল উৎপাদনে বীজ একটি মৌলিক উপকরণ। কারণ বীজ কেবল ফলন বৃদ্ধিই নয় ফসলের মান উন্নয়ন, কীট-পতঙ্গ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক অবস্হায় জন্মানোর উপযোগীতা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া ফসল উৎপাদনের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও এখানে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন : ধান, গম, গোল আলু, মিষ্টি আলু, তৈল ও ডাল বীজের হেক্টর প্রতি ফলন অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
বীজের আর্দ্রতা পরীক্ষা
এর অন্যতম কারণ হলো ভালো বীজের অপ্রতুলতা এবং কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব। হেক্টরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি এবং চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভালো বীজ ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আর ভালো বীজ ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই উন্নত বীজ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে কমবেশি ৭০টি ফসলের চাষ হচ্ছে এবং এসব ফসল চাষ করার জন্য বছরে প্রায় ৭ লক্ষ টন বীজের প্রয়োজন হয় যার মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ৭০টি ফসলের মধ্যে কেবল ধান, গম, পাট, আলু, কিছু সবজি, ডাল ও তৈলবীজ সরকারী ব্যবস্থাপনায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। দেশের বর্তমান চাহিদার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বীজের চাহিদা কৃষক নিজেই পূরণ করে থাকে। যার অধিকাংশ নির্ধারিত মানসম্পন্ন নয় কিন্তু উন্নত দেশে শতকরা ১০০ ভাগ ভালো বীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে সরকারী পর্যায়ে বীজ উৎপাদন ও বিপণনের যে অবকাঠামো বিদ্যমান তা দিয়ে এর বেশি চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাছাড়া সরকারীভাবে বীজ উৎপাদনেও খরচ বেশি হয়। অনেক কৃষক বেশি মূল্যে ভালো বীজ ক্রয় করতে চায় না। তারা নিজেদের ফসলের একাংশ বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বীজ নিম্নমানের এবং কম উৎপাদনশীল হয়ে থাকে। বীজ প্রযুক্তি সম্পর্কেও বাংলাদেশের কৃষক খুব একটা অবহিত নন। তাই উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের গড় ফলন অনেক কম।
উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করে চীন ও জাপানে যেখানে ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫-৬ টন সেখানে আমাদের দেশে মাত্র ২ টন। সার, পানি এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। একমাত্র বীজ প্রযুক্তি ছাড়া এটা কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
তাই ভালো বীজ এবং বীজ প্রযুক্তি অর্থাৎ ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য, বীজ ফসল উৎপাদনের কলাকৌশল, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে আমাদের সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। বীজের আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য অনেক পদ্ধতি আছে, তবে নিম্নলিখিত দু’টি পদ্ধতিই প্রধানত অনুসরণ করা হয়।
ওভেন ড্রাই পদ্ধতি।
ময়েশ্চার মিটার পদ্ধতি।
ওভেন ড্রাই পদ্ধতি :
আন্তর্জাতিক বীজ পরীক্ষণ সংস্হায় (ISTA) নিয়মানুযায়ী নিম্নলিখিত দু’টি ওভেন ড্রাই পদ্ধতি অনুসরণ করে বীজের আর্দ্রতা নির্ণয় করা যেতে পারে
(খ) অপরিবর্তনীয় উচ্চ তাপে (১৩০° সেঃ) ভূট্টা বীজ ৪ ঘন্টা, দানাশস্য বীজ ২ ঘন্টা এবং অন্যান্য বীজ ১ ঘন্টা শুকানো।
পরীক্ষার পদ্ধতি ঃ
এই পদ্ধতিতে বীজের আর্দ্রতা পরীক্ষার জন্য সংগৃহীত বীজ এর কার্য সম্পাদন নমুনা থেকে ৪-৫ গ্রাম ওজনকৃত বীজ নিয়ে (চূর্ন কিংবা অচূর্ন) ওভেনে নির্ধারিত তাপমাত্রায় শুকানো হয়। তার পর ওভেন থেকে বের করে নিয়ে ঠান্ডা করার পর পুনরায় ওজন করা হয়। শুকানোর পূর্বের এবং পরের ওজনের পার্থক্যকে শতকরা হারে প্রকাশ করলেই বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। বীজের আর্দ্রতা নিম্নের সূত্রের সাহায্যে বের করা হয়
ময়েশ্চার মিটার পদ্ধতি ঃ
ময়েশ্চার মিটারের সাহায্যে খুব সহজেই এবং অল্প সময়েই বীজের আর্দ্রতা মাপা যায়। ওসাও ইউনিভার্সেল ময়েশ্চার মিটার (OSAW Universal Moisture Meter) দ্বারা বর্তমানে বাংলাদেশের বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে বীজের আর্দ্রতা মাপা হচ্ছে। এ যন্ত্রটি ব্যবহারের জন্য নিম্নলিখিত পরিসংখ্যান ব্যবহৃত হয়ঃ
কার্যকরী নমূনা থেকে বিভিন্ন বীজের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ বীজ নিন। যেমনঃ ধানের ক্ষেত্রে ৫০ গ্রাম বীজ।
উক্ত পরিমাণ বীজ ওসাও মেশিনের টেষ্ট কাপে ভর্তি করে যথাস্থানে রাখুন।
তারপর চার্ট অনুযায়ী নির্ধারিত ফসলের বীজের জন্য নির্দিষ্ট পূরুত্বে চাপ প্রয়োগ করুন। যেমনঃ ধান বীজের ক্ষেত্রে ০.৫৫ ইঞ্চি।
চাপ প্রয়োগের পর মেশিনের সুইচ ও ডায়াল সুইচ চালু করুন।
এখন ক্যালিব্রেশান (Calibration) কাটার রিডিং এবং মেশিনের সেন্টিগ্রেড থার্মোমিটারের রিডিং যে অংকে মিলিত (Coincide) হবে, সে স্হানে ডায়ালকে ঘুরিয়ে আনার ফলে তীর চিহ্নিত স্হানে যে রিডিং পাওয়া যাবে, সেই রিডিংই ঐ বীজের আর্দ্রতার পরিমাণ হিসেবে গণ্য করুন।
এটা খুব সহজ এবং দ্রুত পদ্ধতি। এ মেশিন একবার বাস্তবে ব্যবহার করলে পরীক্ষাটি সহজেই করতে পারবেন। পরীক্ষাশেষে যাবতীয় বিবরণ আপনার নোটবুকে লিপিবদ্ধ করুন।
বীজের সুপ্ততা এবং সুপ্ততার কারণসমূহ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.৪ নং পাঠের অংশ। বীজের সুপ্ততা কোন সজীব বীজকে উপযুক্ত পরিবেশে বপন করলে অংকুরোদগম হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সকল বীজে এরূপ ঘটেনা। কোন কোন বীজের জীবনকালে সকল বৃদ্ধি প্রক্রিয়া থেমে থাকে, যদিও শ্বসন প্রক্রিয়া অতি ধীর গতিতে চলতে থাকে। বীজের এ অবস্হাকে সুপ্ততা বলে। সুপ্ততার অবসান হলে বীজের অংকুরোদগম হয়। বীজের সুপ্ততা বীজ ভেদে কয়েকদিন থেকে কয়েক বৎসর হতে পারে। বীজের সুপ্তাবস্হাকে নিম্নোপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
বীজের সুপ্ততা এবং সুপ্ততার কারণসমূহ
উপযুক্ত পরিবেশে কোন সজীব বীজের অংকুরোদগম না হওয়াকেই বীজের সুপ্তাবস্হা বলে। উক্ত বীজকে সুপ্ত বীজ বলে। বিভিন্ন কারণে বীজের সুপ্ততা হতে পারে। আলোচনার সুবিধার্থে উক্ত কারণসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় :
(১) প্রাথমিক সুপ্ততা
(২) মাধ্যমিক সুপ্ততা
(৩) বিশেষ প্রকার সুপ্ততা
সয়াবিন বীজ
(১) প্রাথমিক সুপ্ততা :
বীজ মাতৃগাছে পরিপক্ক হওয়া পর্যায়ে বীজের নিজস্ব ভৌত ও শারীরবৃত্তীয় কারণে অংকুরোদগম হয় না। এ অবস্হাকে প্রাথমিক সুপ্ততা বলে। এর স্হায়ীত্ব নিম্নরূপ হবেঃ
অস্হায়ী বা স্বল্পস্থায়ী
দীর্ঘস্থায়ী
অস্থায়ী বা স্বল্পস্থায়ী সুপ্ততা কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে এবং দীর্ঘস্হায়ী সুপ্ততা ৩-৬ মাস হতে পারে। বীজের প্রাথমিক সুপ্ততার কারণগুলো নিম্নরূপ :
(ক) অভেদ্য বীজত্বক দৃঢ় বীজাবরণ
(গ) বীজত্বকের অক্সিজেন অভেদ্যতা
(ঘ) অপূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ
(ঙ) সুপ্ত ভ্রূণ
(চ) অঙ্কুরোদগম রোধক দ্রব্যের উপস্হিতি
(২) মাধ্যমিক সুপ্ততা :
বীজ কর্তনের বা সংগ্রহের পরপরই অংকুরোদগমে সক্ষম এমন বীজকে কিছু সময় প্রতিকুল পরিবেশে রাখার দরুণ বীজ সুপ্ততা প্রাপ্তি হলে তাকে মাধ্যমিক সুপ্ততা বলে। এই সুপ্ততাকে কৃত্রিম সুপ্ততা বলা যেতে পারে।
(৩) বিশেষ প্রকার সুপ্ততা :
যে বীজে সুপ্ততা থাকা সত্ত্বেও অংকুরোদগম হওয়ার পর নানা কারণে অংকুরিত ভ্রূণের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় তাকে বিশেষ সুপ্ততা বলে। অনেক বন্য ফুলে স্বাভাবিক বাহ্যিক পরিবেশে বীজের অংকুরোদগম হওয়ার পরও ভ্রূণমূল প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার দরুণ চারাগাছ উৎপন্ন হয় না তাকে এপিকোটাইল সুপ্ততা বলে। উক্ত এপিকোটাইল সুপ্ততা সম্পন্ন বীজ ১-১০° সেন্টিগ্রেডে কয়েকদিন রাখলে সুপ্ততা দূর হয়।
ব্যক্তবীজ
প্রাথমিক সুপ্ততার কারণসমূহের বিশদ বর্ণনা :
নানা কারণে বীজে সুপ্ততা দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশেষ সুপ্ততার কারণের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তবে কৃষিতাত্ত্বিক (Agronomic) বিবেচনায় প্রাথমিক কারণগুলিকেই সুপ্ততার কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
অভেদ্য বীজত্বক এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
বীজের আবরণ অপেক্ষাকৃত শক্ত হওয়ার ফলে বীজের ভিতরে পানি ঢুকতে না পারার দরুণ বীজের সুপ্ততা দেখা দেয়। এর সাথে সময়ের বা শারীরবৃত্তীয় পরিপক্কতা লাভের কোন সম্পর্ক নেই। বীজে যতদিন পর্যন্ত পানি প্রবেশের অনুকূল ব্যবস্হা না করা হবে ততদিন উক্ত বীজের ত্বরিৎ অংকুরোদগম হবে না। উদাহরণ স্বরূপ লিগিউম পরিবারের কৃষ্ণচূড়া, ইপিল ইপিল ও জবা পরিবারের তুলা বীজ এর উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সকল বীজ সংগ্রহের পরপরই বীজত্বক পানি অভেদ্য থাকে। কিন্তু শুষ্ক অবস্থায় সংরক্ষণ করার পর ধীরে ধীরে পানি ভেদ্যতা বাড়তে শুরু করে।
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কমালে বাড়লে পানি ভেদ্যতা দ্রুত বাড়ে। কৃত্রিমভাবে প্রয়োজনীয় ক্ষত সৃষ্টি করলে অংকুরোদগম ত্বরান্বিত হয়। যেমন : ইপিল ইপিল বীজ একটি পিন দ্বারা হালকাভাবে ফুটো করে দিলে সদ্য সংগৃহীত বীজ ৩-৫ দিনের মধ্যে অংকুরিত হয়, অথচ পিন না ফুটালে ১৫ দিনেও অংকুরিত হয় না।
দৃঢ় বীজাবরণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
কিছু কিছু বীজ আছে যাদের আবরণ যথেষ্ট পুরু ও শক্ত থাকে। ফলে পর্যাপ্ত পানি পেলেও ভ্রূণ স্ফীত হওয়ার প্রক্রিয়াটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেমন : পিগ আগাছা ও কেপসেলা গণের উদ্ভিদের বীজ।
বীজত্বকের অক্সিজেন অভেদ্যতা
বীজত্বকে অক্সিজেন অভেদ্যতার কারণে বীজের সুপ্ততা:
কারণেও বীজ সুপ্ততা দেখা দিতে পারে। ঘাগরা বীজের ত্বক ফাটিয়ে দিলে বা বীজের চারপাশে অক্সিজেনের চাপ বাড়ালে এদের সুপ্ততা ভংগ হয়। গাছের উপরের দিকে বীজের জন্য অক্সিজেনের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি প্রয়োজন হয়। শুষ্ক অবস্থায় রেখে দিলে বা সংরক্ষণ করলে এসকল বীজের অক্সিজেন ভেদাতা বাড়তে থাকে। কিছু ঘাসবীজ ও কম্পোজিটি পরিবারের বীজে বীজত্বকের অক্সিজেনের অভেদ্যতাজনিত সুপ্ততা দেখা যায়।
অপূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
অনেক উদ্ভিদ বীজের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ভ্রূণের বৃদ্ধির হার সংলগ্ন অন্যান্য অংশের কোষকলা অপেক্ষা কম। এমতাবস্হায় বাহ্যিক দিক থেকে বীজটি পুষ্ট হলেও তার ভ্রূণ ক্ষুদ্রাকার থেকে যায় অথচ বাহির থেকে তা বুঝার কোন উপায় নেই। তাই বীজটি উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করার পর উক্ত ভ্রূণের বৃদ্ধি ও পূর্ণতা পেতে যে সময় প্রয়োজন হয়, ততদিন উক্ত বীজের সুপ্তাবস্হা থাকবে। বিভিন্ন প্রকার অর্কিড জাতীয় উদ্ভিদে এ অবস্হা সচরাচর চোখে পড়ে।
সুপ্ত ভ্রূণ এর কারণে বীজের সুপ্ততা:
অনেক বীজে পরিপক্ক ভ্রূণ শারীরবৃত্তীয় কারণেও সুপ্তাবস্হায় থাকতে পারে। এ ধরণের বীজের আবরণ তুলে ফেলে অংকুরোদগমের উপযুক্ত বাহ্যিক পরিবেশে স্হাপন করলেও অংকুরোদগম হবে। না। একটি নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরই কেবল এই সমস্ত বীজের অংকুরোদগম সম্ভব। পাইন ও পীচ বীজে এ জাতীয় সুপ্তাবস্হা বিদ্যমান থাকে।
অংকুরোদগম রোধক দ্রব্যের উপস্থিতির কারণে বীজের সুপ্ততা :
অনেক উদ্ভিদের বীজে নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে। উক্ত পদার্থসমূহ অংকুরোদগমে সরাসরি বাধা প্রদান করে। পেঁপে ও বাঁধাকপির বিভিন্ন জাতের বীজে এরূপ রোধকের উপস্হিতি বিদ্যমান থাকে।
লিচু ও লিচু বীজ
মাধ্যমিক সুপ্ততার কারণসমূহ :
যদি কোন বীজ অংকুরোদগমের অনুপযুক্ত বাহ্যিক পরিবেশগত কারণে সুপ্ততা প্রাপ্ত হয়, তবে তাকে মাধ্যমিক সুপ্ততা বলে। বিভিন্ন কারণে মাধ্যমিক সুপ্ততা হতে পারে, নিম্নে কারণগুলো বর্ণনা করা হলোঃ
কার্বন ডাই অক্সাইডের উপস্হিতির কারণে বীজের সুপ্ততা :
যদি বীজকে উক্ত গ্যাসের ভিতরে কিছু সময় ধরে রাখা হয় এবং পরে অংকুরোদগমের উপযুক্ত পরিবেশে ফিরিয়ে আনা হয় তবে সুপ্ততা প্রদর্শন করে। সাদা সরিষা বীজে এরকমের সুপ্ততাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
আলোর কারণে বীজের সুপ্ততা :
যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য আলোর উপস্হিতি অত্যাবশ্যক, তাদের কিছুদিন অন্ধকার অবস্থায় রাখলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে। অপরপক্ষে যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য অন্ধকার অত্যাবশ্যক, তাদেরকে আলোতে কিছুদিন রাখলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে।
তাপমাত্রার কারণে বীজের সুপ্ততা :
তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলেও বীজে সুপ্তাবস্হা আসে। যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন তাদের নিম্ন তাপমাত্রায় স্থাপন করলে এবং যে সমস্ত বীজের অংকুরোদগমের জন্য নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন তাদেরকে উচ্চ তাপমাত্রায় স্থাপন করলে সুপ্ততা প্রদর্শন করে।
বীজাবরণের পরিবর্তনর কারণে বীজের সুপ্ততা :
অনেক সময় বীজাবরণের পরিবর্তনের ফলে বীজে সুপ্তাবস্হা আসে। উক্ত বীজের আবরণকে সরিয়ে ফেললে ভ্রূণের অংকুরোদগম হয়। কিন্তু পরিবর্তিত বীজাবরণের উপস্হিতি উক্ত বীজে সুপ্তাবস্হা আনয়ন করে।
বীজ আবরণ
বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গার উপায়
বীজতত্ত্ববিদগণ বীজের সুপ্ততা ভঙ্গের নানা উপায় খুজে বের করেছেন। এদের একক বা সম্মিলিত পদ্ধতি বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গতে বা কমিয়ে আনতে সক্ষম। কোন পদ্ধতিই এককভাবে সকল বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বীজ এবং সুপ্ততার প্রকৃতি অনুসারে পদ্ধতিরও পার্থক্য হয়।
কোন একটা পদ্ধতি হয়ত কোন জাতের বীজের সুপ্ততা তাড়াতাড়ি ভঙ্গ করতে পারে। সেই পদ্ধতি আবার অন্য জাতে তা দীর্ঘায়ু করতে পারে। তাই বীজের সুপ্ততা ভংগের কাজ অবশ্যই যথাযথভাবে করা বাঞ্ছনীয়। বীজের সুপ্ততা ভংগের বিভিন্ন পদ্ধতি নিচে বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো:
(১) পানিতে ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
এ পদ্ধতিতে বীজকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ফলে যে সমস্ত বীজে সহজে পানি প্রবেশ করতে পারে না সে সকল বীজে পানি প্রবেশ ত্বরান্বিত হয়, বীজ আবরণ নরম হয়, ভ্রূণের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং বীজ আবরণ সহজে অল্প চাপে ফেটে যায়। পানির পরিমাণ এবং ভিজিয়ে রাখার সময় বীজের বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল।
(২) যান্ত্রিক ও দৈহিক আঁচড়ানোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
আঁচড়ানোর উদ্দেশ্য হলো শক্ত বীজাবরণকে এমনভাবে পরিবর্তন করে নেয়া যাতে করে বীজের ভিতরে সহজেই পানি ও অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে। যান্ত্রিক উপায়ে বীজকে একটি যন্ত্রে নিয়ে এমনভাবে নাড়াচাড়া করা হয় যাতে বীজের আবরণে কোথাও কোন ফাটল ধরে বা ক্ষয় হয়। দৈহিকভাবেও বীজকে কোন পাথর, ইট, বা এ জাতীয় কোন পদার্থের সাথে ঘর্ষণ বা কোন কিছুর মাঝে রেখে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
যান্ত্রিক বা দৈহিক আঁচড়ানোর কাজ খুব সাবধানে করতে হবে যাতে কোন অবস্হাতেই বীজের ভ্রূণ নষ্ট না হয়। কী পদ্ধতিতে বা কতক্ষণ আঁচড়াতে হবে তা বীজের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।
(৩) অল্পদ্রব্য সহযোগে আঁচড়ানোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
এ পদ্ধতিতে বীজকে ঘন সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হয়। ঘন সালফিউরিক এসিডের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৮৪ হওয়া দরকার। সাধারণত বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ এসিড (নির্দিষ্ট ঘনমাত্রার) একটি কাঁচ বা মাটির পাত্রে নিতে হয়। তারপর বীজকে উক্ত পাত্রে ঢেলে মুখ আটকাতে হবে এবং মাঝে মাঝে কোন কাঠির সাহায্যে বীজকে নাড়াচাড়া করতে হবে।
অতিরিক্ত নাড়াচাড়া উচিত নয়। তবে বীজের চতুপার্শ্বে যেন সমভাবে এসিডের ক্রিয়া হয় এবং উক্ত মিশ্রণের তাপমাত্রা যেন খুব বেড়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। উপযুক্ত তাপমাত্রা হলো ৬০-৮০ ফাঃ।
এই পদ্ধতিতে বীজকে কতক্ষণ নাড়াচাড়া করতে হবে তা তাপমাত্রা, বীজের প্রকৃতি, এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বীজের স্তুপের উপর নির্ভর করবে। সময়ের পরিমাণ ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৬ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। বীজাবরণ যখন পাতলা হয়ে আসে তখন সাবধানে এসিড ঢেলে নিতে হয় এবং তৎক্ষনাৎ বীজগুলোকে প্রবাহমান পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হয়। উক্ত ধোয়া বীজ ভিজা অবস্হায় সরাসরি জমিতে বপন করা চলে। অথবা ভালোভাবে শুকিয়ে গুদামেও রাখা চলে।
সাবধানতাঃ সালফিউরিক এসিড শরীরের চামড়ায় বা কাপড়ে লাগলে তা পুড়ে যাবে। তাই সাবধানে এসিড নিয়ে কাজ করা উচিত।
(৪) আলোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
আলোর উপস্থিতি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুপস্হিতি বীজের অংকুরোদগমকে ত্বরান্বিত বা প্রতিরোধ করে। এসব ক্ষেত্রে আলো বীজের সুপ্ততা ভংগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। চিহ্নিত আলোর উপস্হিতি বীজের প্রকার, বয়স ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে তার সুপ্তাবস্হাকে ভেংগে দিতে যথেষ্ট সহায়তা করে। পরিপক্কতা লাভের পরপরই আলোর প্রতি বীজের সংবেদনশীলতা বেশি থাকে এবং গুদামজাত করার বয়সের সাথে তা কমতে থাকে।
(৫) গুদামজাতকরণের মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
অনেক বহুবর্ষজীবী লতাগুলোর বীজ বেশ কিছুদিন গুদামজাত না করা পর্যন্ত তাদের অংকুরোদগম হয়না। এই সুপ্ততা কয়েকদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত হতে পারে। স্বাভাবিক অবস্হায় বীজকে শুরুনাবস্হায় বেশ কিছুদিন ঘরে রাখা হয় এবং পরে বপন করার ফলে উক্ত সময়ের মধ্যে বীজের সুপ্ততা প্রাকৃতিকভাবেই ভেংগে যায়।
(৬) সরাসরি বপনের মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
অনেক জাতের বীজ, যেমন : জুনিপার ও ম্যাগনোলিয়ার প্রজাতি সমূহে পরিপক্কতা লাভের পর বীজ শুকিয়ে গেলে বীজাবরণ যথেষ্ট শক্ত হয় ও বীজে সুপ্ততা আসে। এ অবস্হায় উক্ত বীজসমূহকে না শুকিয়ে সরাসরি বপন করলেই সুপ্ততার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
(৭) বীজকে ঠান্ডায় রাখার মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
বহু প্রকার বৃক্ষ ও ঝোপ জাতীয় গাছের বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ঠান্ডা প্রয়োগ ফলপ্রসু হয়েছে। এই ঠান্ডাবেশ বীজে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় যার ফলে বীজের পরবর্তী পরিপক্কতা ত্বরান্বিত হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে ১°-১০° সেঃ তাপমাত্রা, পরিমিত পানি এবং অক্সিজেনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাখা হয়। প্রথমে বীজকে শুষ্ক অবস্হায় ১২-২৪ ঘন্টার জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় তারপর আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারে এমন মাধ্যমে যেমন: বালি, পিট মাটি, করাতের গুঁড়া ইত্যাদির মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ২° –৭° সেঃ তাপমাত্রায় রাখা হয়।
এ পদ্ধতিতে কত সময় লাগবে তা নির্ভর করে বীজের প্রকৃতির উপর। তবে অধিকাংশ বীজের জন্য ১-৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনবোধে উক্ত সময়ে মাঝে মাঝে পানি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয় এবং বীজে অংকুরোদগম হতে থাকে। তখনই বীজ বপন করা উচিত।
(৮) তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিনোর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটিয়ে বীজের সুপ্তাবস্হা পরিবর্তন করা সম্ভব। তাপমাত্রার পরিবর্তন দুইভাবে করা যায়ঃ
(ক) শুষ্ক অবস্হায় ও
(খ) ভিজা অবস্হায়।
(ক) শুষ্ক অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে বীজে শুষ্ক অবস্থায় তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটানো হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের পরিমাণ ১০-২০ সেঃ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। 0 যেমন : জনসন ঘাস এর বীজ ৩০° সেঃ তাপমাত্রায় ১৮-২২ ঘন্টা এবং পরে ৪৫ সেঃ তাপমাত্রায় ২-৮ ঘন্টা রেখে সুপ্ততা ভাংগানো সম্ভব হয়েছে।
(খ) ভিজা অবস্হায় : এ পদ্ধতিতে ভিজা অবস্হায় তাপমাত্রার পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের সীমা অনেক বেশি। প্রথমে শক্ত আবরণ সম্পন্ন বীজকে তাদের প্রায় ৫ গুণ পানিতে ভিজিয়ে ৭৭° – ১০০° সেঃ তাপমাত্রায় কিছুক্ষণ রাখা হয়। তারপর আবার ঠান্ডা পানিতে ১২-২৪ ঘন্টা রাখা হয় এবং তারপর বীজকে সরাসরি বপন করা হয়।
(৯) চাপ প্রয়োগ এর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেও বীজের সুপ্ততা ভংগ করা যায়। বীজ শুকানোর আগে এই চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং চাপের প্রভাব শুকানোর পর অথবা গুদামজাত করার দরুণ দূরীভূত হয়না। আলফা আলফা বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য ১৮ সেঃ তাপমাত্রা ও ২০০ বায়ুচাপে বীজকে ৫-১০ মিনিট রেখে দেওয়া বেশ কার্যকরী।
(১০) রাসায়নিক উত্তেজক প্রয়োগ এর মাধ্যমে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা :
বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক উত্তেজক দ্বারা বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা সম্ভব হয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলোঃ
(ক) পটাশিয়াম নাইট্রেট দ্বারা বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
অনেক সদ্য আহরিত বীজের সুপ্ততা ভংগের জন্য পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে বীজকে চোষ কাগজ বসানো একটি পেট্রিডিসে নিয়ে ০.১ থেকে ০.২% দ্রবণ দ্বারা চোষ কাগজ ভিজিয়ে দেয়া হয়। দ্রবণ শুকিয়ে গেলে আর পটাশিয়াম নাইট্রেটের দ্রবণ না দিয়ে শুধু পানি দিতে হয়। এভাবে কিছুক্ষণ রাখার পর বীজের সুপ্ততা ভংগ হয়।
ধান বীজের খোসায় পানিতে দ্রবণীয় যে অংকুরোদগম নিরোধক থাকে তা দূরীকরণের জন্য উপরোক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। ১০০ গ্যালন পানিতে ১ গ্যালন সোডিয়াম হাইপো ক্লোরাইড (১% দ্রবণ) মিশিয়ে এ কাজ করা হয়।
(গ) থায়ো ইউরিয়া দিয়ে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
যে সমস্ত বীজ অন্ধকারে ও উচ্চ তাপমাত্রায় গজায় না, তাদের সুপ্তাবস্হা ভাঙ্গার জন্য থায়ো ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে ০.৫–৩% দ্রবণে বীজ ভিজিয়ে রাখতে হয়। তবে ২৪ ঘন্টার বেশি বীজ ভিজিয়ে রাখা যাবে না, কারণ গাছের বৃদ্ধির উপর থায়ো ইউরিয়ার কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে।
(ঘ) জিবারেলিক এসিড দিয়ে বীজের সুপ্ততা ভাঙ্গা:
বীজের সুপ্তাবস্হাজনিত অসুবিধা দূরীকরণে জিবারেলিক এসিড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি বীজ গজাতে, অংকুরোদগম হার বৃদ্ধি এবং চারা গাছের বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহৃত হয়। এমনকি বীজের এপিকোটাইল খাটোজনিত অসুবিধা দূরীকরণের জন্যও ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ১০০-৫০০ গ্রাম এসিড ১০০০ মিঃলিঃ পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করা হয়।
অনেক সময় শক্ত বীজাবরণ ভেংগে দিতে হয় অথবা খোসা খুলে নিতে হয় যাতে দ্রবণ সহজে প্রবেশ করতে পারে। এসিডের দ্রবণ বীজের বৈশিষ্ট্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্হার ওপর নির্ভরশীল।
বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.২ নং পাঠের অংশ। বীজের শ্রেণীকরণ বিভিন্নভাবে করা যায়। বীজের আকার-আকৃতি, ব্যবহার, শারীরবৃভীয় গুণাবলী ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বীজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। নিয়ে তা আলোচনা করা হলোঃ
বীজের শ্রেণীবিভাগ ও বীজের অপরিহার্য অঙ্গসমূহ
বীজের অঙ্কুরোদগম
বীজের ধারণা:
উদ্ভিদের বংশবিস্তারের অন্যতম মাধ্যম হলো বীজ। উদ্ভিদ যৌন পদ্ধতিতে বীজের মাধ্যমে অথবা অযৌন পদ্ধতিতে কোন অঙ্গজ অংশের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত : উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবেচনায় নিষিক্ত পরিপক্ব ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন- ধান, গম, পেঁপে।
দ্বিতীয়ত : কৃষিতাত্বিক বিবেচনায় উদ্ভিদের শারীরিক বা জাননিক অঙ্গ উপযুক্ত পরিবেশে আপন জাতের নতুন উদ্ভিদের জন্ম দিতে পারে, তাকে কৃষি বীজ বলে। যেমন- আদা ও হলুদের কন্দ, মিষ্টি আলুর লতা, পাথরকুচির পাতা, ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদি।
ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য:
ভালো বীজ হলো এমন বীজ যা স্বাস্থ্যসম্মত, উৎপাদনশীল এবং শস্যের ভালো ফলন নিশ্চিত করতে সক্ষম। এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
১। বীজ পরিষ্কার থাকবে; এতে ধুলো, বালি, ময়লা, আগাছা বা অন্য ফসলের বীজ মিশ্রিত থাকবে না। ২। বীজ পুষ্টি সমৃদ্ধ ও সুপরিপক্ক হবে, যাতে চারা শক্তিশালী হয়। ৩। বীজের রং উজ্জ্বল এবং জাতের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বহন করবে। ৪। বীজ পোকামাকড় ও কীটের আক্রমণমুক্ত থাকবে। ৫। বীজ রোগমুক্ত হবে, যাতে উদ্ভিদ সুস্থভাবে বৃদ্ধি পায়। ৬। বীজ কৌলিকভাবে বিশুদ্ধ (Genetic purity) হবে; এক জাতের বীজে অন্য জাতের সংমিশ্রণ থাকবে না। ৭। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৮০% বা তার বেশি হবে। ৮। বীজের আর্দ্রতা ৪–১২% এর মধ্যে থাকবে। ৯। বীজে সমরূপিতা থাকবে; আকার, আকৃতি ও রঙ প্রায় একই রকম হবে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিশ্চিত করলে বীজ থেকে শক্তিশালী চারা উৎপন্ন হয় এবং ফসলের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
বীজের শ্রেণীবিভাগ:
বিভিন্নভাবে বীজের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
বীজপত্রের সংখ্যা অনুসারে:
১ একবীজপত্রী বীজ (Monocotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে কেবল একটিমাত্র বীজপত্র থাকে, তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলে। উদাহরণ: পাট, হোগা, ধান, গম, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি। ২ দ্বিবীজপত্রী বীজ (Dicotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে দুটি বীজপত্র থাকে। উদাহরণ: ছোলা, সয়াবিন, আম, কাঠাল ইত্যাদি। ৩ বহুবীজপত্রী বীজ (Poly-cotyledonous seed): যে সমস্ত বীজে দুইয়ের বেশি বীজপত্র থাকে। উদাহরণ: পাইন বীজ।
ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে:
১. একজনী বীজ (Monoembryonic seed): যে সমস্ত বীজে একটিমাত্র ভ্রূণ থাকে, তাদেরকে একজনী বীজ বলে। উদাহরণ: ধান, পাট, গম। ২. বহুজনী বীজ (Polyembryonic seed): যে সমস্ত বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রতিটি ভ্রূণ পৃথক উদ্ভিদ উৎপন্ন করতে সক্ষম, তাদেরকে বহুজনী বীজ বলা হয়। উদাহরণ: আম, লেবু ইত্যাদি।
নিষিকতা অনুসারে:
১. নিষিক্ত বীজ (Fertilized seed): যে বীজ ডিম্বক ও পরাগরেণুর মাধ্যমে নিষিক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়। উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি। ২. অনিষিক্ত বীজ (Unfertilized seed): যে বীজ ডিম্বক নিষিক্ত না হয়েই উৎপন্ন হয়। এ ধরনের বীজকে এপোমিকটিক বীজ (Apomictic seed) বলা হয়। উদাহরণ: লেবু, জাম্বুরা, কমলা ইত্যাদি।
শস্যের Endosperm উপস্থিতি অনুসারে:
১. সস্যল বীজ (Endospermic seed): যে বীজের ভ্রূণের বাইরের অংশে খাদ্য হিসেবে সস্য (Endosperm) থাকে। উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা। ২. অসস্যল বীজ (Non-endospermic seed): যে বীজে ভ্রূণের বাইরের অংশে খাদ্য সঞ্চিত থাকে না। উদাহরণ: ছোলা, কুমড়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী:
বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুসারে বীজকে উৎপাদন ও বংশগত বিশুদ্ধতার ভিত্তিতে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণির উদ্দেশ্য হলো বীজ উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষকদের কাছে উচ্চমানের বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। শ্রেণীবিভাগগুলো নিম্নরূপ:
(ক) মৌল প্রজননবিদ বীজ (Breeder seed):
১. অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো মৌল বীজ উৎপাদন। ২. উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠানে বা প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত বীজকে মৌল বীজ বলা হয়। ৩. মৌল বীজে সর্বাধিক বংশগত বিশুদ্ধতা (Genetic purity) বজায় থাকে এবং এটি ভবিষ্যতের সমস্ত বীজ উৎপাদনের মূল উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(খ) ভিত্তি বীজ (Foundation seed)
১. মৌল বীজ থেকে বিস্তার ঘটানোর জন্য ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়। ২. এটি বীজ অনুমোদনকারী সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মনীতি অনুসরণ করে প্রজননবিদের তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত হয়। ৩. ভিত্তি বীজে জাতের স্বাতন্ত্র্য ও কৌলিক বিশুদ্ধতা বজায় থাকে।
(গ) নিবন্ধিত বীজ ( Registered seed)
১. ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে নিবন্ধিত বীজ বলা হয়। ২. এটি সাধারণত বীজ বর্ধন খামার বা জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ব্যক্তিগত খামারে উৎপাদিত হয়। ৩. নিবন্ধিত বীজে ভিত্তি বীজের সমস্ত কৌলিক গুণাবলী ও বিশুদ্ধতা বজায় থাকে।
(ঘ) প্রত্যায়িত বীজ (Certified seed)
১. ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত বীজকে প্রত্যায়িত বীজ বলা হয়। ২. চুক্তিভিত্তিক চাষীর মাধ্যমে বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি অনুসরণ করে জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা হয়। ৩. উৎপাদিত বীজ পরে বীজ প্রত্যায়ন সংস্থা (Seed Certification Agency) পরীক্ষা ও অনুমোদন করার পর বাজারে সরবরাহ করা হয়।
উদ্ভিদের বংশবিস্তারে মৌলিক উপকরণ হলো বীজ। উচ্চমানের ফসল উৎপাদনের জন্য অবশ্যই ভালো এবং মানসম্মত বীজ ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে, যা বীজ উৎপাদন, বংশগত বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ এবং কৃষকদের জন্য মানসম্মত বীজ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।
ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুসারে শ্রেণীবিন্যাস:
বাংলাদেশে বা সাধারণ উদ্ভিদবিজ্ঞান অনুযায়ী বীজকে ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুসারে প্রধানত দুইটি ভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়।
১। প্রকৃত বীজ (True Seed): ১.১ নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিম্বক থেকে উৎপন্ন বীজকে উদ্ভিদতাত্তিক বা প্রকৃত বীজ বলা হয়। ১.২ প্রকৃত বীজ সাধারণত দানাদার, তৈলবীজ বা ডালবীজ আকারে হয়। ১.৩ উদাহরণ: - দানাদার বীজ: ধান, গম, ভুট্টা প্রভৃতি - তৈলবীজ: সরিষা, সয়াবীন, তিল প্রভৃতি - ডালবীজ: মসুর, ছেসারী, মুগ প্রভৃতি
২। কৃষি বীজ (Vegetative/Propagative Seed): ২.১ উদ্ভিদের যে কোনও অংশ যা উপযুক্ত পরিবেশে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নতুন উদ্ভিদ জন্ম দিতে সক্ষম, তাকে কৃষি বীজ বলা হয়। ২.২ কৃষি বীজ সাধারণত কাণ্ড, শিকড় বা পাতা থেকে উৎপন্ন হয়। ২.৩ উদাহরণ: - কাণ্ড: আখ, আলু প্রভৃতি - শিকড়: মিষ্টি আলু, কাকরোল, পটল প্রভৃতি - পাতা: পাথরকুচি প্রভৃতি - প্রকৃত বীজের উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়: ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি কুষিত বীজ
প্রকৃত বীজ এবং কৃষি বীজের পার্থক্য মূলত উৎপাদনের উৎস ও প্রজনন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। উচ্চফলন ও মানসম্মত ফসলের জন্য সঠিক ধরনের বীজ ব্যবহার অপরিহার্য।
আম বীজ
বীজের আবরণের উপর ভিত্তি করে:
বীজকে আবরণের উপস্থিতি অনুযায়ী প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
১। নগ্নবীজ (Naked Seed): ১.১ যে সকল বীজে কোন প্রাকৃতিক আবরণ বা স্তর থাকে না, তাকে নগ্নবীজ বলা হয়। ১.২ এই ধরনের বীজ সাধারণত সরাসরি জমিতে রোপণযোগ্য এবং খাদ্যশস্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১.৩ উদাহরণ: - গম - ভুট্টা প্রভৃতি
২। আবরিত বীজ (Covered Seed): ২.১ যে সকল বীজে প্রাকৃতিক আবরণ বা বীজপাতলা থাকে, তাকে আবরিত বীজ বলা হয়। ২.২ এই বীজ সাধারণত অতিরিক্ত সুরক্ষা পায় এবং খাদ্য, তৈলশস্য বা ডালবীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২.৩ উদাহরণ: - ধান - ডালবীজ - তৈলবীজ ইত্যাদি
বীজের আবরণ তার সংরক্ষণ ক্ষমতা, অঙ্কুরোদগমের গতি এবং প্রজননশীলতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। সঠিক বীজ নির্বাচন ফসলের ফলন ও মানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বীজ পত্রের সংখ্যা অনুযায়ী:
১। একবীজপত্রী বীজ (Monocot Seed): ১.১ যে সকল বীজে কেবল একটি বীজপত্র থাকে, তাদেরকে একবীজপত্রী বীজ বলা হয়। ১.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, নারিকেল, তাল ইত্যাদি।
২। দ্বিবীজপত্রী বীজ (Dicot Seed): ২.১ যে সকল বীজে দুটি বীজপত্র থাকে, তাদেরকে দ্বিবীজপত্রী বীজ বলা হয়। ২.২ উদাহরণ: পাট, ছোলা, সয়াবীন, আম, কাঠাল ইত্যাদি।
৩। বহুবীজপত্রী বীজ (Polyploid Seed): ৩.১ যে সকল বীজে দুটি বা ততোধিক বীজপত্র থাকে, তাদেরকে বহুবীজপত্রী বীজ বলা হয়। ৩.২ উদাহরণ: পাইন বীজ।
বীজপত্রের সংখ্যা অনুযায়ী বীজকে শ্রেণীবদ্ধ করলে উদ্ভিদের প্রজনন প্রক্রিয়া ও গঠন বোঝা সহজ হয়। একবীজপত্রী, দ্বিবীজপত্রী ও বহুবীজপত্রী বীজের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য স্পষ্ট থাকে।
গম
বীজে ভ্রূণের সংখ্যা অনুসারে:
১। একজণী বীজ (Monoembryonic seed): ১.১ যে সকল বীজে কেবল একটি মাত্র ভ্রূণ থাকে, তাদেরকে একজণী বীজ বলা হয়। ১.২ উদাহরণ: পাট, ধান, গম।
২। বহুভ্রূণী বীজ (Polyembryonic seed): ২.১ যে সকল বীজে একাধিক ভ্রূণ থাকে এবং প্রত্যেকটি ভ্রূণ একটি স্বতন্ত্র উদ্ভিদের জন্ম দিতে সক্ষম, তাদেরকে বহুভ্রূণী বীজ বলা হয়। ২.২ উদাহরণ: আম, লেবু ইত্যাদি।
৩। সস্যল বীজ (Endospermic seed): ৩.১ যে সকল বীজে বীজপত্রের বাইরে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য খাদ্য হিসেবে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম সঞ্চিত থাকে, তাদেরকে সস্যল বীজ বলা হয়। ৩.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি।
৪। অসস্যল বীজ (Non-endospermic seed): ৪.১ যে সকল বীজে ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য সস্য হিসেবে জমা না থেকে বীজপত্রের মধ্যে সঞ্চিত থাকে, তাদেরকে অসস্যল বীজ বলা হয়। ৪.২ উদাহরণ: কুমড়া, ছোলা ইত্যাদি।
ভ্রূণের সংখ্যা এবং সস্যের উপস্থিতি অনুযায়ী বীজকে শ্রেণীবিন্যাস করলে উদ্ভিদের প্রজনন ও বীজের পুষ্টি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া বোঝা সহজ হয়।
গুটি কলম
নিষিক্ততা (Fertilization) অনুসারে:
১। নিষিক্ত বীজ (Fertilized seed): ১.১ যে সকল বীজ ডিম্বক পরাগরেণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়, তাদেরকে নিষিক্ত বীজ বলা হয়। ১.২ উদাহরণ: ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা ইত্যাদি।
২। অনিষিক্ত বীজ (Unfertilized seed): ২.১ যে সকল বীজ পরাগরেণু দ্বারা ডিম্বক নিষিক্ত না হয়ে উৎপন্ন হয়, তাদেরকে অনিষিক্ত বীজ বলা হয়। ২.২ এই ক্ষেত্রে ডিম্বকের দেহকোষ (Vegetative cell) থেকে ভ্রূণ উৎপন্ন হয়। এই ধরনের বীজকে এপোমিকটিক (Apomictic seed) বীজ বলা হয় এবং বীজ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটিকে এপোমিক্সিস (Apomixis) বলা হয়। ২.৩ এপোমিকটিক বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ফলে মাতৃগুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে, যা অঙ্গজ বংশবৃদ্ধি (Clonal propagation) হিসেবে পরিচিত। ২.৪ উদাহরণ: লেবু, জাম্বুরা, কমলা ইত্যাদি সাইট্রাস ফল।
নিষিক্ততা অনুযায়ী বীজ শ্রেণীবিন্যাস করলে বীজ উৎপাদন ও প্রজনন প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য এবং বংশগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝা যায়।
চোখ কলম
বিভিন্ন অঙ্গজ বীজের পরিচিতি:
রাইজোম (Rhizome) :
রাইজোম ভূ-নিম্নস্থ রূপান্তরিত কান্ড। আদা, হলুদ ইত্যাদির বংশ বিস্তারের জন্য রাইজোম ব্যবহৃত হয়।
স্ফীত কন্দ (Tuber) :
স্ফীত কন্দ ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড। নিম্ন কান্ডের শীর্ষে খাদ্য সঞ্চিত হয়ে তা স্ফীত হয়ে কন্দের রূপ ধারণ করে। এতে চোখ (Eye বা bud), শল্কপত্র (Scale leaves) বর্তমান থাকে। গোল আলুর বংশ বিস্তার টিউবারের সাহায্যে করা হয়ে থাকে।
বীজ আবরণ
টিউবারকল (Tubercol বা Bulbil) :
এ জাতীয় উদ্ভিদে পাতার কক্ষীয় কুঁড়ি রূপান্তরিত হয়ে স্ফীত ও গোলাকার ধারণ করে। এদের টিউবারকল বা বুলবিল বলে। যেমনঃ মেটে আলুর বুলবিল।
শঙ্ক কন্দ (Bulb) ঃ
এটা ভূ-নিম্নস্হ রূপান্তরিত কান্ড যা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং স্কেল (Scale) সমন্বয়ে গঠিত। পিয়াজের অংঙ্গজ বংশ বিস্তার শঙ্ক কন্দের দ্বারা করা হয়। অনেক সময় শঙ্কের কক্ষীয় কুঁড়িও আবার ক্ষুদ্রাকার কন্দে পরিণত হয়। এগুলো কোয়া (Bulblet) নামে পরিচিত। যেমনঃ রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি।
গুঁড়িকন্দ (Corm) :
কান্ডের নিচের অংশ স্ফীত ও গোলাকার হলে একে গুঁড়িকন্দ বলে। এতে সন্ধি (Node) ও পর্বসন্ধি (Inter node) বিদ্যমান থাকে। গুঁড়িকন্দের উপরিভাগ শল্কপত্র দ্বারা আবৃত থাকে। আবার গুঁড়িকন্দের নিচের দিকে কতিপয় কুড়ি ক্ষুদ্রাকার গুঁড়িকন্দে পরিণত হয়। এগুলো মুখি নামে পরিচিত। কচুর বংশ বিস্তার গুঁড়িকন্দ দ্বারা করা হয়।
ব্যক্তবীজ
কন্দালমূল (Tuberous root) :
যখন কোন মূল খাদ্যদ্রব্য সঞ্চিত করে স্ফীত হয়ে উঠে তখন তাকে কন্দালমূল বলে। মিষ্টি আলু ও বিভিন্ন জাতের আলুর বংশ বিস্তারে কন্দালমূল ব্যবহৃত হয়।
শোষক (Sucker) :
মাতৃগাছের গোড়া থেকে নতুন চারা বের হয় এবং বৃদ্ধির প্রথম পর্যায় মাতৃগাছ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে যেমন: কলা, আনারস, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি।
শিকড় (Root cutting) :
অনেক গাছের মূল নতুন চারা গাছের জন্ম দেয় এবং পরে তা কেটে পৃথক করে রোপণ করলে স্বতন্ত্র উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। বেল ও পেয়ারা ফলের এরূপ শিকড় ব্যবহার করা হয়।
পাতা ঃ
পাতা থেকেও চারা উৎপন্ন করা যায়। যেমন : পাথরকুচি। অনেক সময় চায়ের পাতা থেকে চারা উৎপন্ন করা হয়।
শাখা কলম (Stem cutting) :
বিভিন্ন প্রকার ফসল, ফল ও ফুল গাছের বংশ বৃদ্ধির জন্য শাখা কলম ব্যবহৃত হয়। যেমন : আম, মিষ্টি আলু, আংগুর, গোলাপ, গন্ধরাজ, ইত্যাদি। যথাঃ কর্তন বা ছেদ কলম : এক্ষেত্রে সরাসরি কচি ডাল কেটে মাটিতে লাগিয়ে চারা তৈরি করা হয়। যেমন : সজিনা, শিমুল, এলামন্ডা ইত্যাদি।
প্রধানত পাঁচভাবে কলমের চারা তৈরি করা হয়।
দাবা কলম ঃ
এক্ষেত্রে গাছের শাখার খানিক মাটিতে চাপা দিয়ে তাতে মূল গাজিয়ে মাতৃগাছ থেকে আলাদা করা হয়। যেমন : লেবু।
গুটি কলম ঃ
নির্বাচিত গাছের ডালের ৫ সে.মি. পরিমাণ অংশের ছাল তুলে গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে গুটি তৈরি করে চট দিয়ে আটকে দিতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত লিচু, ডালিম, লেবুতে, এ ধরণের কলম করে চারা তৈরি করা হয়।
জোড় কলম ঃ
এক্ষেত্রে একই জাতের দুটি গাছের কান্ডকে পরিমিত চেছে একত্রে বেঁধে দিলে ২-৩ মাসের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। অতঃপর কাঙ্খিত গাছের মধ্যে অন্যটির নিচের অংশ কেটে আলাদা করে কলমের চারা পাওয়া যায়। আমের ক্ষেত্রে জোড় কলম উত্তম।
চোখ কলম :
পাতা বা ডালের সংযোগ স্থানের কুঁড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে অন্য উদ্ভিদে স্থানান্তরিত করাকে চোখ কলম বলে। গোলাপ, লেবু, কুল প্রভৃতি উদ্ভিদে এ কলম ব্যবহৃত হয়। কুলের ক্ষেত্রে টক কুল গাছকে চোখ কলমের সাহায্যে মিষ্টি কুলে রূপান্তরিত করা যায়।
আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতির শ্রেণিবিন্যাস:
এতক্ষণ আপনি প্রকৃত বীজের শ্রেণিবিন্যাস এবং কৃষি বীজের বিভিন্ন অঙ্গজ বংশ বিস্তারের মাধ্যম সম্পর্কে ধারণা পেলেন। এখন আমরা আলোচনা করবো আন্তর্জাতিক শস্য উন্নয়ন সমিতি (International Crop Improvement Association, ICIA) বীজকে কীভাবে শ্রেণিবিন্যাস করছেন। উক্ত সমিতি বিভিন্ন বীজের কৌলিক বিশুদ্ধতা, উৎপাদন ও বিতরণের প্রকৃতির ভিত্তিতে বীজকে প্রধানতঃ ৪টি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন (ক-ঘ)। কিন্তু বাংলাদেশ বীজ বিধি ১৯৮০ এর ১৮ ধারা মোতাবেক বীজকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে (ক, খ, ঘ)।
বাংলাদেশ বীজ বিধিতে নিবন্ধিত ও প্রত্যায়িত বীজকে একই ধরণের বিবেচনা করে নিবন্ধিত বীজকে বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ এ দুই শ্রেণির বীজই ভিত্তি বীজ থেকে উৎপাদিত হয়।
প্রজননবীদের বীজ (Breeder seed) :
উদ্ভিদ প্রজনন প্রতিষ্ঠান বা কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কোন প্রজননবিদের ঘনিষ্ঠ ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপন্ন বীজ, যা থেকে ভিত্তি বীজ (Foundation seed) উৎপন্ন করা হয় তাকে প্রজনন বীজ বলে। এ বীজের মধ্যে সর্বাধিক কৌলিক বিশুদ্ধতা (Genetic purity) থাকে। অনুমোদিত বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো প্রজনন বীজ। প্রজনন বীজ থেকে ভিত্তি বীজ উৎপাদন করা হয়।
ভিত্তি বীজ :
বীজের পরবর্তী বিস্তার ঘটানোর জন্য কৌলিকভাবে শনাক্তকরণযোগ্য জাতের প্রথমিক উৎসকে ভিত্তি বীজ বলে। ভিত্তি বীজে কৌলিক স্বাতন্ত্র্য (Genetic identity) ও জাতের বিশুদ্ধতা (Varietal purity) বিদ্যমান থাকে। ভিত্তি বীজ থেকে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয়। অনুমোদনকারী সংস্হা কর্তৃক অনুমোদিত বীজ উৎপাদনের নিয়মনীতি পালন করে ও সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক কমিটির তত্ত্বাবধানে এ বীজ উৎপাদন করা হয়।
নিবন্ধিত বীজ ঃ
অনুমোদিত সরকারী উৎসের ভিত্তি বীজ থেকে নিবন্ধিত উৎপাদনকারী যথাযথ নিয়মনীতি অনুসরণ করে যে বীজ উৎপন্ন করে তাকে নিবন্ধিত বীজ বলে। ভিত্তি বীজের সকল কৌলিক গুণাবলী ও বিশুদ্ধতা নিবন্ধিত বীজে বিদ্যমান রাখা হয়।
প্রত্যায়িত বীজ :
ভিত্তি বীজ হতে প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হয় যাতে বংশগত ও বাহ্যিক বিশুদ্ধতা নির্ধারিত মানের থাকে। প্রয়োজনবোধে প্রত্যায়িত বীজ হতেও সর্বাধিক তিন ধাপ পর্যন্ত প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা যেতে পারে।বীজের গুণাবলী সংরক্ষণের জন্য প্রত্যয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্হা। বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী নামে একটি সরকারী সংস্হা এই অনুমোদনের কাজটি করে থাকে।
বীজের অপরিহার্য অংগসমূহ :
একটি বীজের প্রধানতঃ দুইটি অংশ থাকে। যথাঃ
(১) বীজত্বক :
বীজের আবরণকে বীজত্বক বলে। ডিম্বকের ত্বক বীজত্বকে পরিণত হয়। বীজত্বক আবার দুইটি আবরণ দ্বারা গঠিত। বাহিরের অপেক্ষাকৃত পুরু ও শক্ত স্তরটিকে বলে বহিঃত্বক বা টেস্টা (Testa)। ভিতরের পাতলা স্বচ্ছ আবরণকে বলে অন্তঃত্বক বা টেগমেন (Tegmen)। বীজত্বক দুইটি সংযুক্ত থাকতে পারে অথবা একটি হতে অন্যটি পৃথক থাকতে পারে। বীজ যে অংশ দ্বারা ফলের সংগে যুক্ত থাকে সেই সংযোগস্থলকে বলে হাইলাম (Hilum) বীজনাভি বা ডিম্বকনাভি। বীজ ফিউনিকুলাস (Funiculus) নামক বোটার সংগে হাইলামের সংগে যুক্ত থাকে। হাইলামের সন্নিকটে বীজত্বকে একটি ছিদ্র থাকে যাকে মাইক্রোপাইল (Micropyle) বা বীজরন্ধ্র বলে। কোন কোন বীজের ত্বকে লম্বালম্বি যে প্রবর্ধন দেখা যায় তাকে র্যাফি ( Raphe) বলে। রাফির সাহায্যে বীজ বোঁটার সংগে লেগে থাকে।
(২) অস্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার :
বীজত্বক অপসারণের পর বীজের অবশিষ্ট অংশকে বলে অন্তবীজ বা কার্নেল বা বীজসার। কার্নেল শুধু ভ্রূণ দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ছোলা বীজ) অথবা ভ্রূণ ও সস্য (Endosperm) দ্বারা গঠিত হতে পারে (যেমন : ধান বীজ)।
অন্তবীজ বা কার্নেল এর বিভিন্ন অংশ:
ভ্রূণ (Embryo) :
বীজত্বক দ্বারা আবৃত সুপ্ত উদ্ভিদকে ভ্রূণ বলে। কার্নেলের মূল অংশ ভ্রূণ। ভ্রূণের দুইটি অংশ যথাঃ ভ্রূণাক্ষ বা টাইজেলাম (Tigellum) ও বীজপত্র (Cotyledon)। ভ্রূণাক্ষের আবার দুইটি অংশ যেমন: ভ্রূণমূল (Radicle) যা থেকে বীজ গজানোর পর শিকড় হয় এবং ভ্রূণকান্ড ভ্রূণমুকুল (Plumule) যা থেকে কান্ড উৎপন্ন হয়।
ভ্রূণাক্ষ :
যে অক্ষের সংগে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণাক্ষ বলে। ভ্রূণাঙ্কের যে স্হানে বীজপত্র সংযুক্ত থাকে তাকে ভ্রূণপর্ব (Nodal zone) বলে। ভ্রূণাক্ষের উপরের অংশ ভ্রূণমুকুল এবং নিচের অংশ ভ্রূণমূল। ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের উপরে অবস্থিত তাকে এপিকোটাইল (Epicotyle) বা বীজ পত্রাধিকান্ড বলে। অপরপক্ষে ভ্রূণাক্ষের যে অংশ পর্বাঞ্চলের নিচে অবস্থিত তাকে বলে হাইপোকোটাইল (Hypocotyle) বা বীজপত্রাবকান্ড। একবীজপত্রী উদ্ভিদে ভ্রূণমুকুল ও ভ্রূণমূল যে আবরণীসমূহ দ্বারা আবৃত থাকে তাদেরকে যথাক্রমে কলিওপটাইল (Coleoptyle) এবং কলিওরাইজা (Coleorrhiza ) বলে।
বীজপত্র (Cotyledon) :
দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদে দুইটি বীজপত্র এবং একবীজপত্রী উদ্ভিদে একটি বীজপত্র থাকে। বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকলে তা পুরু ও রসাল হয়। যেমন : ছোলা বীজ। যে বীজপত্রে খাদ্য সঞ্চিত থাকে না তা পাতলা ও স্বচ্ছ হয় (যেমন : রেডি)। নিম্নে চিত্রে বীজের বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে।
পান
বীজপত্রের কাজ :
বীজপত্র নরম ও কোমল ভ্রূণমুকুলকে রক্ষা করে।
বীজপত্র ভ্রূণের জন্য খাদ্য সঞ্চয় করে।
বীজপত্র ভ্রূণাক্ষকে খাদ্য সরবরাহ করে।
সস্য (Endosperm) :
কোন কোন কার্নেলে সস্য বা এন্ডোস্পার্ম পাওয়া যায়। বীজের এন্ডোস্পার্মে শিশু উদ্ভিদের খাদ্য সঞ্চিত থাকে। সকল বীজে সস্য থাকে না। সস্য যুক্ত বীজকে বলে সসাল (Albuminous) বীজ। যে বীজে সস্য থাকে না তাকে বলে অসস্যল বীজ (Exalbuminous)।
পেরিস্পার্ম (Perisperm) :
ডিম্বকের নিউসেলাসের অবশিষ্টাংশকে পেরিস্পার্ম বলে। ইহা বর্ধিষ্ণু ভ্রূণে খাদ্য সরবরাহ করে। সকল বীজে পেরিস্পার্ম থাকে না। খুব অল্প সংখ্যক বীজে পেরিস্পার্ম থাকে। যেমন : শাপলা।
উদ্ভিদের বংশবিস্তার ও কৃষি উৎপাদনের জন্য বীজ অপরিহার্য উপাদান। বীজের গুণমান, শ্রেণীবিন্যাস এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে কৃষি চাষে ভালো ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব। বীজের শ্রেণীবিভাগ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে করা যায়—পত্র সংখ্যা, ভ্রূণের সংখ্যা, নিষিক্ততা, এন্ডোস্পার্ম উপস্থিতি, ব্যবহার, আবরণ ইত্যাদি। বাংলাদেশ বীজ বিধি অনুযায়ী বীজকে মৌল বীজ, ভিত্তি বীজ, নিবন্ধিত বীজ ও প্রত্যায়িত বীজ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
বীজের প্রধান অঙ্গসমূহ হলো বীজত্বক এবং অন্তবীজ বা কার্নেল, যার মধ্যে ভ্রূণ, ভ্রূণাক্ষ, বীজপত্র, সস্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পেরিস্পার্ম থাকে। এই অঙ্গসমূহের কার্যক্রম ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং চাষের জন্য শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যসম্মত চারা উৎপাদন সম্ভব হয়।
সার্বিকভাবে, বীজ ও এর অঙ্গসমূহের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কৃষক ও বীজপ্রজনকদের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি কৃষি উৎপাদনকে সফল এবং টেকসই করার মূল ভিত্তি স্থাপন করে।
বীজের সংজ্ঞা, প্রকৃত ও কৃষি বীজের মধ্যে পার্থক্য এবং বীজের গুরুত্ব – পাঠটি “বীজ ও বীজ প্রযুক্তি” বিষয়ের ১ নং ইউনিটের ব্যবহারিক পাঠ ১.১ নং পাঠের অংশ।
বীজ কাকে বলে বা বীজের সংজ্ঞা কী তা আপনার জানা দরকার। বীজ উদ্ভিদের বংশ বিস্তারের মাপাম হিসেবে কাজ করে। উত্ভিদতান্তিক বৈশিষ্ট্যাবলী এবং কৃষি কাজের বৈচিত্রাময় ব্যবহার অনুসারে বীজের সংজ্ঞা দু’রকম হতে পারে। প্রথমত, উত্ভিদতত্তানুসারে ফুলের পরাগরেণু দ্বারা ডিন্গক নিষিক্ত হবার পর পরিপক্ক ডিম্বককে বীজ বলে। যেমন ৪ পান, গম, পেপে বীজ।
বীজের সংজ্ঞা, প্রকৃত ও কৃষি বীজের মধ্যে পার্থক্য এবং বীজের গুরুত্ব
দ্বিতীয়ত, কৃষিতত্তানুসারে গাছের যে অংশ (শারীরিক বা জাননিক) বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয় পাথরকুচির পাতা, বিভিন্ন ফুল গাছের শাখা-প্রশাখা, পান, গম ইত্যাদি। উপরিউক্ত সংজ্ঞা দ্বারা প্রকৃত বীজ ও কৃষি বীজের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারি। প্রকৃত বীজ বা ধৌন বীজ হচ্ছে বীজত্বকদ্বারা আবৃত এক সুপ্ত ভ্রণপারী পরিণত ও নিষিক্ত ডিন্ক। আর গাছের যে কোন অংশ বিশেষ, যা উপযুক্ত পরিবেশে একই রকম গাছের বংশ বিস্তারের জন্য ব্যবহার হয়ে
থাকে, তাকে কৃষি বীজ বলে।
আলুর টিউবার বলতে আমরা যে আলু খাই তাকে বোঝায়। কলার সাকার বলতে কলার চারা বোঝায় যা মুখ্য বা তেউড় নামেও পরিচিত। আনারসের চারাকেও সাকার বলে। কচুর চারাকে কন্দ বা গুঁড়িকন্দ বলে।
বীজের গুরুত্ব
বীজ থেকে গাছ জন্মায় যা পৃথিবীকে ধূসর বিবর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হতে না দিয়ে আচ্ছাদিত করে সবুজ বৃক্ষরাজিতে এবং পরিবেশকে বাসপোযোগী করে। বীজ মানুষের জন্য একটি সর্বোত্তম কল্যাণকর শক্তি। অতি ক্ষুদ্র একটি বীজ মাটিতে বপন করার পর তা সুন্দর, সতেজ ও বৃহৎ একটি গাছে রূপান্তরিত হওয়া নিঃসন্দেহে একটি শক্তি। মানুষ যখন আবিষ্কার করল বীজ থেকে গাছ জন্মায়, মানব সভ্যতার উন্মেষ তখন থেকেই শুরু। কৃষিতে বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ বীজ কেবল ফসলের ফলন বৃদ্ধিই করে না, এর মান উন্নয়ন, কীট ও রোগাক্রমণ প্রতিরোধ, ভালো বাজার প্রাপ্তি এবং নির্দিষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক অবস্হায়
কম খরচ করে অদিক ফলন পাওয়া কৃষকের একটি অন্যতম লক্ষ্য থাকে। রোগজীবাণু, পোকামাকড় ও আগাছা মুক্ত সে জক্ষারটি অর্জন করতে পারে। কৃষি ও পলাটী উন্নয়ন স্কুল জন্মানোর উপযোগিতা ইত্যাদি গুণাগুণও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ফসল উৎপাদনে বীজকে একটি মৌলিক উপকরণ বলা যেতে পারে। অতএব কৃষি কাজে সম্পৃক্ত সকলেরই বীজের গুরুত্ব সম্পর্কে সমাক পারণা থাকা প্রয়োজন। নিমোক্ত বিষয়সমূহ সংক্ষেপে বীজের গুরুত্ব তুলে পরে।
১। বীজ ফসল উৎপাদনের প্রান মৌলিক উপকরণ।
২। উন্নত মানের বীজে উচ্চ ফলন হয়।
৩। ভালো বীজ পোকামাকড় ও গাছের রোগবালাই প্রতিরোপ করে।
৪। ভালো বীজ পরোক্ষভাবে উৎপাদন ব্যয় কমায়।
৬। বীজের মাপামে সংকরায়ন করে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন করা হয়।
৭। বীজ ব্যবসা খুবই লাভজনক।
৮। বীজের মাপানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
ঈ। বীজ প্রজাতি টিকিয়ে রাখার অনাতম প্থা।
১০। বীজের খামার বা বীজ বর্ণন খামার করে জীবিকা নির্বাহ করা খুবই লাভজনক।
১১। বীজের মাপ্যমে সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়।
আসুন এসব বিষয়সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
বীজ ফসল উৎপাদনের প্রধান মৌলিক উপকরণ
ফসল উৎপাদনের জনা অন্যান কৃষি উপকরণ, যেমন $ঃ সার, সেচ, ও বালাইনাশকের ন্যায় বীজ একটি অন্যতম মৌল উপকরণ। কারণ বীজ বপন না করে অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করলে কোন ফসল আসবে না। কিন্তু বীজ বপন করে তন্যান্য যত্ত না নিলেও কিছু ফলন পাওয়া সম্ভব৷ ততএব উপরোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা পূর্বক বীজকেই প্রপান মৌলিক উপকরণ বলা যায়।
উচ্চ ফলনশীল বীজে অধিক ফলন হয়
যেখানে জমি সীমিত এবং লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে খাদ্যোৎপাদন বাড়ানোর জন্য উচ্চ কিছুটা সফলতা পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে দেশী পান জাতের (যেমন ঃ ধারিয়াল, দুলার, কটকতারা ইত্যাদি) হেক্টর প্রতি ফলন ছিল ১.০-১৫ টন বর্তমানে উফশী বীজ ব্যবহার করে (বরি-পান ৩০, ৩১ ৩২ ইত্যাদি) হেক্টর প্রতি ৪-৬ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া দেশী আলুর উৎপাদন যেখানে হেক্টর প্রতি ছিল ৮_-১০ টন সেখানে আপুনিক জাত (ডায়মন্ড, পেট্রোনিজ, মুলটা প্রভৃতি) বাবহার করে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ২৫৩০ টন।
ভালো বীজ রোগবালাই ও পোকামাকড় প্রতিরোধী
অনেক রোগের জীবাণু বীজবাহিত। তাছাড়া, বীজের স্তুপে পোকা, রোগজীবাণু ও আগাছার বীজে মিশ্রিত থাকতে পারে। বর্তমানে বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাপামে এগুলো দূর করা সম্ভব হচ্ছে এবং প্রত্যায়িত ভালো বীজ কৃষকের মগ বিতরণ করা যাচ্ছে।
ভালো বীজ উৎপাদন ব্যয় কমায়
কম খরচ করে অপিক ফলন পাওয়া কৃষকের একটি অনাতম লক্ষা থাকে। রোগজীবাণু পোকামাকড ও আগাছা মুক্ত ভালো বীজ বাবহার করে কৃষক সে লক্ষি অন করতে পারে। সেক্ষেত্রে কীটনাশক, বালাইনাশক এবং আগাছা দমনের জনা শ্রমিক বায় কমে আসবে।
বীজ উন্নত জাত উদ্ভাবনের মাধ্যম
বিজ্ঞানের একটি অন্যতম অবদান হলো উদ্ভিদের বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্টাসমৃহকে সংকরায়নের মাপামে একটি জাতে সংযোগ করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটি যে সমস্ত ফসল উদ্ভিদতান্তিক বীজ উৎপন্ন করে কেবল সেক্ষেত্রে সম্ভব। যেমন ঃ বি আর-৩ পান দুইটি জাতের পানের বীজের সাথে সংকরায়ন পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে।
বীজ ব্যবসার উপাদান
বর্তমানে বীজ ব্যবসা একটি লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন বীজের ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে এমন নজিরও এদেশে আছে। বিশেষ করে তরমুজ, বীপাকপি, ফুলকপি ও আলু বীজের ব্যবসা খুবই লাভজনক।
বীজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব
উন্নত জাতের বীজ ও হাইবরীড বীজ উৎপাদন করে তান্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাজার তৈরি করে বৈদেশিক ঘুদ্রা অর্জন করা যায়। বীজ রপ্তানি করে জাপান, তাইওয়ান, ডেনমার্ক, হল্যান্ড উন্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
বীজ প্রজাতি টিকিয়ে রাখার অন্যতম পশ্থা
গাছ থেকে যে বীজ উৎপন্ন হয়, সেই বীজ অনুরূপ গাছ উৎপাদনে সন্দম। সুতরাং যুগ যুগ পরে বীজ তার প্রজাতি টিকিয়ে রাখছে।
বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা – পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের, পরিবেশ বিভাগের ৩ নং ইউনিটের পাঠ ৩.৫ নং পাঠের অংশ।
বায়োগ্যাস কী?
গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ বায়ুর অনুপস্থিতিতে জৈব বিজারণের ফলে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে যে সকল প্রাণী জাবর কাটে (যেমনঃ গো—মহিষ, ছাগল) তাদের অন্ত্রে এবং অক্সিজেন বিবর্জিত ইকোলজীক্যাল এলাকা যেমনঃ জলাবদ্ধ ভূমি, সঁ্যাতসঁ্যাতে ভেজা জায়গা, ময়লাযুক্ত পানির আধার প্রভৃতি স্থান থেকেও মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস রংবিহীন এবং খুব সহজেই দাহ্য। জৈব উৎস থেকে উৎপন্ন বলে এই গ্যাসকে বায়োগ্যাস বলা হয়।
বায়োগ্যাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
বায়োগ্যাসের ব্যবহার ও সুবিধা
১। বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসেবে সব ধরনের রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারের ফলে হাড়ি—পাতিল, বাড়ি—ঘর ও কাপড়—চোপড়ে ময়লা পড়ে না।
২। এই গ্যাস দিয়ে রাতে ম্যান্টল জ্বেলে হ্যাজাক লাইটের মতো আলো পাওয়া যায়। কেরোসিনের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজেও বায়োগ্যাস ব্যবহৃত হয়।
৩। রসায়নাগারে কোলগ্যাস, এ্যারোজেন গ্যাস বা পেট্রোল গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কম খরচে এই গ্যাস ব্যবহারযোগ্য।
৪। গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে বায়োগ্যাস উপরি হিসেবে পাওয়া যায়। এর পরে úারী হিসেবে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই উন্নতমানের জৈব সার। জৈব—দহন প্রক্রিয়ার কারণে সকল আগাছার বীজ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে এই সার ব্যবহারে জমিতে আগাছার পরিমাণও হ্রাস পায়।
৫। বায়ুরোধী অবস্থায় পচন ক্রিয়া স¤žন্ন হয় বলে কোন দুর্গন্ধ ছড়ায় না এবং মশামাছির উপদ্রবও গোবর ও অন্যান্য পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে বায়োগ্যাস উপরি হিসেবে পাওয়া যায়। এর পরে úারী হিসেবে যা অবশিষ্ট থাকে তা খুবই উন্নতমানের জৈব সার। থাকে না।
৬। এই গ্যাস পারিবারিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে উদ্ভিদ জ্বালানির উপর চাপ কমে যায়।
৭। একটি বায়োগ্যাস প্লাণ্ট স্বল্প পরিসর স্থানে এমনকি জনবহুল এলাকাতেও তৈরি করা সম্ভব। এর প্রস্তুত প্রণালী ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এবং খরচও কম।
বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ কৌশল
একটি বায়োগ্যাস প্লাণ্টের প্রধান অংশ হচ্ছে ডাইজেস্টার বা ফারমেণ্টেশন ট্যাঙ্ক এবং গ্যাস হোল্ডার। এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে ইনলেট ট্যাঙ্ক বা খাদকনালী , নিগর্মন নালী ও আউটলেট কূপ এবং গ্যাস সরবরাহ লাইন। একটি বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্টের বিভিন্ন অংশের আকার আকৃতি নির্ভর করে গ্যাসের চাহিদা, ব্যবহৃত কাঁচামালের পরিমাণ, ধরণ ইত্যাদির উপর।
এখানে ৪—৫ টি গরু/মহিষ আছে এমন বাড়ীতে ৬/৭ জন পারিবারিক সদস্যের জ্বালানি চাহিদা মেটানো উপযোগী একটি বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্টের বর্ণনা দেয়া হলো। প্রথমে ৮ ফিট গভীর ও ৭ ফিট ব্যাসের একটি কূপ খনন করতে হবে। খননকৃত কূপের তলায় ৩ আর.সি.সি ঢালাই দিতে হবে।
এই ঢালাইয়ের উপরে ৬ ফুট অভ্যন্তরীণ ব্যাস ও ৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৫ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনী দিয়ে একটি গোলাকার নিশ্ছিদ্র কূপ তৈরি করতে হবে। দেয়ালের ৫ ফুট উচ্চতায় ভেতরে ও বাইরে ৩ ইঞ্চি ইটের একটি বর্ধিত গাঁথুনী চতুর্দিকে দিতে হবে। খালি অবস্থায় গ্যাস হোল্ডারটি এর উপরে অবস্থান করবে। বর্ধিত গাঁথুনীর ঠিক নিচ দিয়ে ৪—৬ ফুট ব্যাসের ৮—১০ ফুট লম্বা একটি আর.সি.সি পাইপ এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে এর নিম্নাংশ কূপের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে তলদেশ থেকে ১ ফুট উপরে অবস্থান করে। অপর অংশ ২২২ মাপের ইটের তৈরি ইনলেট বা ফিডিং ট্যাঙ্কের সাথে সংযুক্ত থাকবে।
ডাইজেস্টারের উপরের দিকে দেয়ালের গায়ে সুবিধা মতো স্থানে একটি ছিদ্র করে তার সাথে ৪— ৬ ব্যাসের ৩— ৪ দীর্ঘ একটি আর.সি.সি পাইপ জুড়ে দিয়ে নির্গমন কূপের সাথে সংযুক্ত করে দিতে হবে। এই পথেই গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাবার পর úারী (পানি মিশ্রিত গোবর) ডাইজেস্টারের বাইরে চলে আসবে। ডাইজেস্টারের তলায় ঠিক কেন্দ্র বিন্দুতে ১ ১ ১ ঢালাই এর মাধ্যমে ৮ ফুট লম্বা ২ ব্যাসের একটি রড খাড়া ভাবে বসাতে হবে। এই রডের উপরেই গ্যাস হোল্ডার বসানো থাকে।
গ্যাস হোল্ডার
গ্যাস হোল্ডারের ব্যাস অবশ্যই ডাইজেস্টারের ব্যাস অপেক্ষা সামান্য (প্রায় ৩) কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় এটি সহজে ডাইজেস্টারের কূপের ভেতরে ঘুরানো বা উঠানামা করানো যাবে না। প্রায় ১০০ ঘন ফুট গ্যাস ধারণক্ষম একটি ডাইজেস্টারের জন্য ৩ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি বাসের (৩.৫— ২ নং চিত্র অনুযায়ী) একটি গ্যাস হোল্ডার প্রয়োজন। এটি ১৬ থেকে ২৪ গজী এম, এস সিট ওয়েল্ডিং করে তৈরি করা যায়। গ্যাস হোল্ডারের অভ্যন্তরে আড়াআড়িভাবে দু’টো রড এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে গ্যাস হোল্ডারটি সহজে উপরে নিচে উঠা নামা করতে পারে এবং চারদিকে ঘুরতে পারে। গ্যাস হোল্ডারের এক মুখ খোলা এবং অপর মুখ বন্ধ থাকবে।
বন্ধ মুখের কেন্দ্রস্থল থেকে খোলা মুখের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বা একটি জি,আই পাইপ সোজাভাবে আড়াআড়ি রডের সাথে ওয়েল্ডিং করে লাগাতে হবে। ডাইজেস্টারের কেন্দ্রে অবস্থিত রডটি জি, আই পাইপের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে গ্যাস হোল্ডারটি ডাইজেস্টারের উপরে স্থাপন করতে হবে। গ্যাস হোল্ডারের উপরে ভালভ্সহ ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটি গ্যাস ট্যাপের সংযোজন দিতে হবে। এই সংযোগস্থল থেকে জি,আই পাইপের সাহায্যে ব্যবহারস্থলে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
বায়োগ্যাস প্ল্যাণ্ট চালুকরণ নির্মাণ শেষে এ ধরনের গ্যাস প্ল্যাণ্ট প্রথম চালু করার জন্য ৪০/৫০ মণ গোবর প্রয়োজন। গোবর ও পানি ১:১ অনুপাতে মিশিয়ে úারী (গোবরের দ্রবণ) তৈরি করে ফিডিং ট্যাঙ্কের মধ্যে ঢেলে দিলেই তা দ্রুত ডাইজেস্টারে পৌঁছবে। ফিডিং এর সময় গ্যাস হোল্ডার বায়ু শূন্য করার জন্য গ্যাস লাইন খোলা রাখতে হয়। ডাইজেস্টার ট্যাঙ্ক ভর্তি হবার পর হুইল কর্ক বন্ধ করে গ্যাস লাইনের সংযোগ দিতে হয়।
কয়েক দিনের মধ্যেই গ্যাস জমা হয়ে গ্যাস হোল্ডার উপরের দিকে উঠে যাবে। প্রথম দিকে গ্যাস হোল্ডারে কিছু কার্বন ডাই—অক্সাইড জমা হবার কারণে তা নাও জ্বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে গ্যাস হোল্ডারে জমাকৃত সম্পূর্ণ গ্যাস বের করে দিতে হবে। প্রথমেই úারীর সাথে কিছু পরিমাণ লাইম বা চুন (ঈধঙ) মিশিয়ে দিলে বায়োগ্যাস উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং কার্বন—ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হ্রাস পায়। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রতিদিন ৪/৫ বালতি গোবর ও সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে ফিডার চ্যানেলের মাধ্যমে ডাইজেস্টারে প্রবেশ করাতে হবে।
এখানে উলেখযোগ্য যে, টংবফ ঁঢ় ংষঁৎৎু বা ঊভভষঁবহঃ গ্যাস উৎপাদনের পর যা বের হয়ে আসে তা অত্যন্ত উন্নত মানের জৈব সার হিসেবে মাটিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ সারে ১.৫৮% নাইট্রোজেন, ১.২% ফসফেট (চ২ঙ৫) এবং ০.৭% পটাশ (ক২ঙ) থাকে।
সতর্কতা
১। ডাইজেস্টারে যাতে বৃষ্টির পানি না ঢুকে তার জন্য ফিডিং ট্যাঙ্ক ডাইজেস্টার থেকে সামান্য উপরে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে উপরে শেড তৈরি করা যেতে পারে।
২। ডাইজেস্টারে গোবর—পানি প্রবেশকালে অন্য কোন আবর্জনা যাতে না ঢুকে তা লক্ষ রাখতে হবে।
৩। গ্যাস হোল্ডারটি মাঝে মধ্যে কেন্দ্রীয় পাইপের চারদিকে ঘুরিয়ে দিলে উপরে গোবর ও পানির মিশ্রণ শক্ত হতে পারবে না।
৪। কোন কারণে ইনলেট বা আউটলেট পাইপ বন্ধ হয়ে গেলে সোজা সরু কাঠি দিয়ে তা ছাড়িয়ে দিতে হবে।
৫। কোন সময় গ্যাস লাইনে পানি জমলে পানি জমাস্থান খুলে পানি বের করে দিতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ব্যবহার শেষে বস্তুর পরিত্যাক্ত যে কোন্ অংশের নামই বর্জ্য বা আবর্জনা। অন্যকথায়, পূণঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া কোন্ বস্তু তার ব্যবহার যোগ্যতা হারিয়ে ফেল্লে তাকেই বর্জ্য বলে। বর্জ্য িবভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনঃ কঠিন বর্জ্য ও ক্ষতিকারক বর্জ্য।ব্যবহার শেষে বস্তুর পরিত্যাক্ত যে কোন অংশের নামই বর্জ্য বা আবর্জনা। অন্যকথায়, পূণঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া কোন বস্তু তার ব্যবহার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললে তাকেই বর্জ্য বলে। বর্জ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনঃ কঠিন বর্জ্য ( ও ক্ষতিকারক বর্জ্য ।
১। কঠিন বর্জ্য ( ঃ কঠিন বর্জ্য বলতে বোঝায় বাড়ী ঘর থেকে ফেলে দেয়া অপ্রত্যাশিত বস্তু, রাস্তার ঝাড়ু দেয়া আবর্জনা, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কৃষি খামার প্রভৃতি স্থান হতে মানব কার্য কলাপ সৃষ্ট অনাকাঙ্খিত বস্তুসমহকে। শহরাঞ্চলে এসব বর্জ্য ূ এবং গ্রামাঞ্চলে আবর্জনা হিসেবে পরিচিত। এসবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপাদান রয়েছে, যেমনঃ ধুলা, খাদ্যজাত উচ্ছিষ্ট, কাগজ, ধাতব উপাদান, প্লাষ্টিক, রাবার কাঁচ, পরিত্যক্ত কাপড়, বাগানের আবর্জনা, নির্মাণ সামগ্রীর ফেলে দেয়া অংশ, প্যাকিং সামগ্রী, শিল্পজাত বর্জ্য, ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে আরও বহুবিধ দহনযোগ্য ও অদহনযোগ্য সামগ্রী এবং তেজষ্ক্রিয়া পদার্থ। বহু ধরনের খামারজাত উচ্ছিষ্টও কঠিন বর্জ্য শ্রেণিভুক্ত, যেমনঃ গোবর ও গৃহপালিত পশু—পাখির বিষ্ঠা, খড়কুটা, শস্যের পরিত্যাক্ত অংশ ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মাথাপ্রতি বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। যেমনঃ ঢাকায় মাথাপ্রতি প্রতিদিনের গড় যেখানে মাত্র ০.২২ কেজি সেখানে কলকাতায় ০.৫১ কেজি এবং নিউইর্য়কে ১.৮ কেজি। নগর বর্জে্যর বৈশিষ্ট্য নগরের অধিকাংশ কঠিন বর্জ্যই গৃহ, শিল্প ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে সৃষ্ট। প্রতিদিন জনপ্রতি কী পরিমাণ কঠিন বর্জ্য সংগৃহীত হবে তা নগরের আয়তন, এবং ঋতুর উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে মাথাপ্রতি বর্জ্য সংগ্রহের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
যেমনঃ ঢাকায় মাথাপ্রতি প্রতিদিনের গড় যেখানে মাত্র ০.২২ কেজি সেখানে কলকাতায় ০.৫১ কেজি এবং নিউইর্য়কে ১.৮ কেজি। ঢাকায় এত কম হওয়ার প্রধান কারণ হয়ত সেখানকারচ্ছ’র্বল সংগ্রহ ব্যবস্থা। নগরের প্রধান প্রধান বর্জ্য সমূহের তালিকায় রয়েছে ফেলে দেয়া খাদ্য, বাজার এলাকার উচ্ছিষ্ট, পাতা, ঘাস, কাগজ, প্লাষ্টিক সামগ্রী, ধাতব পদার্থ, ক্যান, কাঁচ, বোতল, ইটের টুকরা, বস্ত্রাংশ, ভগ্নস্তুপ, ময়লা,
ছাই, কাঠ, চামড়া ও রাবারজাত দ্রবাদি।
২। ক্ষতিকারক বর্জ্য ঃ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম থেকেই ক্ষতিকারক বা বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব উপাদানে শতকরা ৭৫ ভাগের ওপরে থাকে রাসায়নিক দ্রব্য। উৎপন্ন হবার পর থেকেই এ সকল উপাদান দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করে। এটি যেমনঃ উন্নত বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য, তেমনি অনুন্নত বিশ্বের জন্যও প্রযোজ্য। এসকল রাসায়নিক দ্রব্যাদি বায়ু, পানি এবং আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রবেশের সুযোগ করে নেয়। এক তথ্য বিবরণীতে প্রকাশ ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রতিদিন ৪৯,০০০ কি.গ্রা. শিল্পজাত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতেও প্রতিদিন ৪৫,০০০ কি.গ্রা. শিল্পজাত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।
এসকল বর্জে্যর কারণে বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলী নদীর পানিতে দস্তা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডিয়াম ও আরসেনিকের মতো ভারি ধাতুর মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে নদী ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় মাছের চারণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বিনষ্ট হচ্ছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল
আবর্জনা বা জঞ্জাল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের সামনে যে তিনটি পথ খোলা রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।
(১) উন্মুক্তস্থানে, নদী, হ্রদ, সাগর বা অন্য কোন জলাশয়ে অশোধিত অবস্থায় নিক্ষেপন করা। এ প্রক্রিয়ার মূল দর্শন, “দূষণের সমাধান হচ্ছে হালকাকরণ” (“ঞযব ংড়ষঁঃরড়হ ঃড় ঢ়ড়ষষঁঃরড়হ রং ফরষঁঃরড়হ”)। বিশ্বের সর্বত্র এটিই বহুল প্রচলিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপায় হিসেবে বিবেচিত। যে কারণে নগর ও শিল্প কারখানাগুলো সাধারণত জলপথের তীর ধরে গড়ে উঠেছে।
(২) বিশেষভাবে নির্বাচিত স্থানে জঞ্জাল স্তুপীকৃতকরণ এবং প্রায় প্রাকৃতিক উপায়ে বিয়োজন ঘটিয়ে পূনঃব্যবহারযোগ্য সম্পদ সৃষ্টিকরণ। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দূষণ পরিহারকারী এটিই সহজতম পদ্ধতি। এর মাধ্যমে অধিক পরিমাণে বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি তেমন হুমকি সৃষ্টি না করেই পরিশোধন করা সম্ভব।
(৩) যান্ত্রিক—রাসায়নিক পদ্ধতি (ঈযবসড়—সবপযধহরপধষ ঢ়ৎড়পবংং) অনুসরণ করে পূনঃব্যবহারযোগ্য সম্পদ সৃষ্টিকরণ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে যান্ত্রিক উপায়ে রাসায়নিক শোধন দ্বারা বর্জ্য পরিশোধন করে পূনঃব্যবহার উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতি দূষণ নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকরী। কিন্তু ব্যয়বহুল পদ্ধতি বিধায় কিছু কিছু উন্নত দেশ ছাড়া সর্বত্র প্রচলিত নয়।
বাংলাদেশে যেসব বর্জে্যর কিছুটা বাজার চাহিদা রয়েছে সেগুলো তিন পর্যায়ে সংগ্রহ বা উদ্ধার করা হয়ে থাকে। প্রথম পর্যায়ে উদ্ধারের সাথে জড়িত থাকেন বাড়ীর গৃহিণীরা। তারা কাগজ, বোতল, কনটেইনার, পুরাতন কাপড়, জুতা ইত্যাদি দ্রব্যাদি (যাদের ভাল বাজার চাহিদা রয়েছে) বাছাই করেন এবং হকারদের নিকট বিক্রয় করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বস্তি এলাকার দরিদ্র শিশুরা যারা ‘টোকাই’ নামে পরিচিত। এরা ভাঁঙ্গা কাঁচ, ক্যান, কার্ডবোর্ড, ফেলে দেয়া কাগজ, ছিন্ন বস্ত্র, প্লাষ্টিক সামগ্রী, ধাতব পাত্র, ও ফেলে দেয়া অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে। তৃতীয় পর্যায়েও রয়েছে দ্ররিদ্র শ্রেণির টোকাইরা। তারা পৌরসভার গাড়ী থেকে চূড়ান্ত নিগর্মন স্থানে বর্জ্য ফেলার সময় তা থেকে বাছাইকৃত বর্জ্য সংগ্রহ করে।
বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থা পুণঃব্যবহার উপযোগীকরণের পর্যায়গুলো চিত্র ৩.৫—৩ এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। হকার, টোকাই এবং আবর্জনা ফেলার স্থান থেকে সংগ্রহকারীদের মাধ্যমে সংগৃহীত দ্রব্যাদি পুরাতন দ্রব্য বিক্রয়কারীদের দোকানে পৌঁছে। তারা সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে, ধৌতকরণ, বাছাইকরণ প্রক্রিয়া শেষে ডিলারদের নিকট সরবরাহ করে। পুরাতন সামগ্রীর ডিলারগণ যথাযথ পৃথকীকরণের পর সরাসরি ব্যবহারকারীদের নিকট বিক্রয় করে। আর বিক্রয় অযোগ্য দ্রবাদি পণঃব্যবহারযোগ্যকরণ ু কারখানায় (জবসড়ষফরহম ভধপঃড়ৎরবং) প্রেরণ করে। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণের পর পুণরায় তা বাজারে ফিরে আসে।
চূড়ান্ত বিসর্জন ও বিকল্প ব্যবস্থা
বাজারমূল্য আছে এমন সব বর্জ্য সামগ্রী অসাংগঠনিক পন্থায় পুণরুদ্ধার করা হয়। আর বিয়োজকযোগ্য জৈবিক উপাদানসমূহ খোলা অবস্থায় নগরের অপেক্ষাকৃত নিচুস্থানে স্তুপাকারে ফেলে দেয়া হয়। আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে এসব দ্রব্য দ্রুত পঁচনের ফলে তৎসংলগ্ন এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং অসস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। বৃষ্টির পানি ময়লার স্তুপের ভিতরে প্রবেশ করে পরিবেশ দুষণক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলে। এদের প্রচুর দূষণ ক্ষমতাযুক্ত চুয়ানি ভূমি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে। কম খরচে পরিবেশ দূষণমুক্ত জৈবপদার্থ বিসর্জনের উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যান্ডফিল (ঝধহরঃধৎু ষধহফ ভরষষ) পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে উচ্চ দূষক পদার্থ সংগ্রহের নিরাপদ ব্যবস্থা রাখা হয় এবং মিথেন গ্যাস সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যার বর্ণনা এ পাঠের প্রথমাংশে দেয়া হয়েছে। বাছাইকৃত জৈব বর্জ্য কমপোষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈবসারে রূপান্তরিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় পরিমিত পানি ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীবের সাহায্যে জৈব উপাদানসমূহের দ্রুত পচন ঘটিয়ে তা জৈব সারে পরিণত করা হয়।
পানি সরবরাহের পরিমাণ জৈব বর্জে্যর ধরণের উপর নির্ভরশীল এবং এটি স্ববাত অবস্থায় সম্পন্ন করা হয়। যান্ত্রিক উপায়ে স্ববাত গার্বেজ কমপোষ্ট প্রক্রিয়া বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশেই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয়নি। অবশ্য বাছাইকৃত কিছু কিছু জৈব বর্জ্য ভারত ও চীনে উদ্ভাবিত অবাত কম্পোষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারে পরিণত করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অনুসৃতঃ পদ্ধতি চিত্র নং ৩.৫ — ৩ এর সাহায্যে দেখানো হয়েছে।
পৌর এলাকার অনিধনযোগ্য বর্জ্য নিচু এলাকা ভরাটের কাজে ব্যবহার করে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমানো সম্ভব।
ওজোনস্তরের ক্ষয় ও জীব জগতে এর প্রভাব – পাঠটি “কৃষি পরিচিতি ও পরিবেশ” বিষয়ের, পরিবেশ বিভাগের ৩ নং ইউনিটের পাঠ ৩.৪ নং পাঠের অংশ।
অক্সিজেনের তিন পরমাণু নিয়ে গঠিত একটি রূপভেদের নাম ওজোন (ঙ৩)। বিজ্ঞানের ভাষায় যা অলোপিক মডিফিকেশন নামে পরিচিত। সূর্যের ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘে্যর অতি বেগুনি রশ্মি অক্সিজেন অণুকে ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা রাখে। সাধারণভাবে সূর্যের ২৪০ হস এর চেয়ে ক্ষুদ্র তরঙ্গবিশিষ্ট অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে অক্সিজেন অণুর সালোক—বিযুক্তি ঘটে। এভাবে বেড়িয়ে আসা মুক্তঅক্সিজেন পরমাণু অক্সিজেন অণুর সাথে মিলিত হয়ে ওজোন তৈরি করে।
ওজোনস্তরের ক্ষয় ও জীব জগতে এর প্রভাব
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের প্রায় সর্বত্রই কম বেশি ওজোন পাওয়া যায়। তবে ভূ—পৃষ্ঠের ২৫ কি.মি. উর্ধ্বে এর ঘনত্ব সর্বাধিক ১৫ ি প.পি.এম.। বায়ুমন্ডলে ওজোনের ব্যাপ্তি পৃথিবীর বায়ুমন্ডল কতগুলি প্রধান স্তর নিয়ে গঠিত। এগুলো হচ্ছেঃ ট্রপোস্ফিয়ার, ট্রপোপোজ, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, আয়ানোস্ফিয়ার ইত্যাদি। বায়ুমন্ডলের সব চেয়ে নিচের স্তরটির বিস্তৃতি ভূ—পৃষ্ট থেকে প্রায় ১১ কি.মি. পর্যন্ত এবং এটির নামই ট্রপোস্ফিয়ার। মেঘ, বায়ুপ্রবাহ, ঝড় প্রভৃতি এ স্তরেই সংঘঠিত হয়। ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বসীমাকে ট্রপেপোজ বলে। সাধারণভাবে ট্রপোপজের উপরে ধুলা—বালি ও জলীয় বাষ্প থাকে না। এ স্তরের গভীরতা খুবই কম। এর উপরে রয়েছে স্ট্রাটোস্ফিয়ার, যার বিস্তৃতি ভূ—পৃষ্ট থেকে প্রায় ৫০—৬০ কি. মি. পর্যন্ত।
এই স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যেই ভূ—পৃষ্ঠের ২০ থেকে ৩০ কি.মি. উর্ধ্বে সন্নিবেশিত আছে ওজোন গ্যাসের একটি পাতলা স্তর যা ওজোনোস্ফিয়ার নামেও পরিচিত। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের প্রায় সর্বত্রই কম বেশি ওজোন পাওয়া যায়। তবে ভূ—পৃষ্ঠের ২৫ কি.মি. উর্ধ্বে এর ঘনত্ব সর্বাধিক ১৫ পি.পি.এম.।
ওজোনস্তর ক্ষয়ের প্রতিকৃতি
মূলত মানুষের ক্রিয়া কর্মের ফলেই বর্তমানে ওজোনস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে বলে প্রকাশ। বায়ুমন্ডলে ওজোনস্তরের ক্ষয় প্রথম ধরা পড়ে ১৯৮৩ সালে যখন বৃটিশ এ্যান্টার্কটিকা সার্ভে নামে এক দল বৃটিশ গবেষক এ্যান্টার্কটিকার বায়ুমন্ডলে ওজোনস্তরে একটি বিরাট গহ্বর দেখতে পান। তখন এ গর্তের পরিমাপ ছিল ৪০ শতাংশ। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। স্থানের পরিমাপে এটি প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের সমপরিমাণ বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। ১৯৭৮ সালে পরিচালিত পুনটা এরিনাস অভিযানের (চিলির দক্ষিঞ্চালীয় একটি শহর পুনটা এরিনাস) তথ্য থেকেও কুমেরুর আকাশে ওজোনস্তরের গহ্বর সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়।
এই অভিযানে আরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সামগ্রীকভাবে গত ১৮ বছরে ওজোন স্তরের ২—৩ শতাংশ বিলীন হয়ে গেছে। শুধু কুমেরু অঞ্চলের আকাশেই নয় পৃথিবীর বহু জনবহুল অঞ্চলের আকাশেও ওজোনস্তর ওজন কমতে শুরু করেছে। তবে তার মাত্রা কুমেরু অঞ্চলে যত নাটকীয় ভাবে ঘটেছে তেমনটি নয়।
কোন কোন বিজ্ঞানীর মতে কুমেরুর আকাশে সৃষ্ট ওজোনস্তরের গহ্বর সম্পূর্ণ ওজোন ঘাটতি জনিত কারণে নয়। বরং অনেকটা বায়ুস্তরের বিন্যাস জনিত ত্রুটির কারণে হয়ে থাকতে পারে। নিম্বাস আবহাওয়া উপগ্রহ থেকে লক্ষ করা গেছে বছরের কোন সময়ে কুমেরুর ওজোনসর হালকা হয়ে যায় Í আবার অন্য সময় তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অধিকাংশ ওজোন তৈরি হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের বায়ুতে। গ্রীষ্ম মন্ডল থেকে মেরু অঞ্চলে বায়ু প্রবাহের স্বাভাবিক গতি পথে অনেক সময় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফলে কুমেরুতে ওজোন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম পৌঁছে। আর সে কারণেই মেরু অঞ্চলে বায়ুতে ওজোন ঘাটতি হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
ওজোনস্তর সম্পর্কে অধিক তথ্য আহরণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সনে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী ও জাপানের বিজ্ঞানীরা এক যৌথ অভিযান পরিচালনা করেন উত্তর মেরুতে। তাদের তথ্যে জানা যায় জমাট নাইট্রিক এসিডের মেঘ উত্তর মেরুর ওজোনস্তর খেয়ে হালকা করে ফেলছে। ওজোনস্তর ক্ষয়ের কারণ প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬০ সালে ি রফ্রিজারেটরের শীতলীকরণের কাজে। পরে অবশ্য এ ধরনের গ্যাস এয়ারকুলার, স্প্রে—ক্যান, প্লাষ্টিক ফোমের উপাদান, মাইক্রোইলেকট্রিক সার্কিট পরিষ্কার করার দ্রবণ ইত্যাদি বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সর্য থেকে আগত অতি বেগুনি রশ্মির মারাÍক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পৃথিবীর জীবকুলকে রক্ষা করার জন্য যে ওজোনস্তর ছাকনীর মতো ব্যবহৃত হয় তা আজ মানুষের ক্রিয়া কর্মের ফলেই হালকা বা ধ্বংস প্রাপ্ত হতে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে ওজোনস্তর ক্ষয় সাধনে মুখ্য ভুমিকা রাখছে মানব সৃষ্ট ক্লোরোফ্লোরো কার্বন নামক শিল্পজাত গ্যাস, যার কোন প্রাকৃতিক উৎস নেই। ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল মটর্স কোম্পানীর বিজ্ঞানীগণ ঈঋঈং গ্যাস উদ্ভাবন করেন।
তবে প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬০ সালে রিফ্রিজারেটরের শীতলীকরণের কাজে। পরে অবশ্য এ ধরনের গ্যাস এয়ারকুলার, স্প্রে—ক্যান, প্লাষ্টিক ফোমের উপাদান, মাইক্রোইলেকট্রিক সার্কিট পরিষ্কার করার দ্রবণ ইত্যাদি বহুবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই গ্যাস বিষবিহীন, নিষ্ক্রিয়, সহজে অন্য কোন্ পদার্থের সাথে বিক্রিয়া ঘটায় না এবং নিচু তাপমাত্রায় বাষ্পীভুত হয়। অধিকাংশ ঈঋঈং বানানো সহজ এবং দামেও সস্তা।
ওজোন ধ্বংসকারী উৎপাদন ১৯৬০ সালের পর থেকে শতকরা ৩০ ভাগ হারে বাড়ছে। ব্যবহারের উৎস থেকে ঈঋঈং গ্যাস বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে তা দীর্ঘ দিন অক্ষত অবস্থায় থাকে। বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার থেকে ঈঋঈং পরিচালন পদ্ধতিতে প্রবাহিত হয়ে ষ্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌঁছে প্রতিক্রিয়া শুরু করতে সময় লাগে অন্ততঃ একযুগ। কিন্তু সেখানে পৌছামাত্র সেখানকার প্রবল সমান্তরাল বায়ুপ্রবাহের সংস্পর্শে এসে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে এবং অতি বেগুনি রশ্মির বিক্রিয়ার কারণে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে দূষকে পরিণত হয়। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে ঈঋঈংভেঙ্গে মুক্ত ক্লোরিন পরমাণু বেড় হয়ে আসে। বিযুক্ত ক্লোরিন পরমাণ তিন পরমাণ বিশিষ্ট ওজোন ভেঙ্গে উৎপন্ন করে ক্লোরিন মনোক্সাইড ও অক্সিজেন।
পরমুহুর্তেই ক্লোরিন মনোক্সাইড আবার মুক্ত অক্সিজেন পরমাণর সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিজেন গ্যাস ও মুক্ত ক্লোরিন পরমাণ উৎপন্ন করে। এভাবে একটি ক্লোরিন পরমাণু ক্রমাগত চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমে ১,০০০০০ অণ অক্সিজেনকে ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম। ফলে দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে ওজোনস্তর।
সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে ওজোনস্তর ক্ষয়ের পিছনে শুধু যে ঈঋঈং দায়ী তা নয়। ক্লোরিনযুক্ত অন্যান্য গ্যাস যেমনঃ কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ক্লোরোফরম ইত্যাদিও ওজোনস্তরের ক্ষয় সাধন করছে। শস্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নাইট্রোজেনঘটিত সার থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এবং সৌরশক্তির প্রভাবে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এই গ্যাস ষ্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌছলে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে নাইট্রোজেনের রেডিক্যালে পরিণত হয়। নাইট্রোজেনের এই রেডিক্যাল ওজোনকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। মুক্ত ক্লোরিন পরমাণর চেয়ে নাইট্রোজেন রেডিক্যালের ওজোন বিধ্বংসী ক্ষমতা ৬ গুণ কম। তবে বায়ুমন্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বছরে ০.২৫ ভাগ হারে বাড়ছে এবং এর কর্মক্ষমতা সম্ভবত ১৫০ বছর পর্যন্ত বজায় থাকে। মানব সৃষ্ট কারণের পাশাপাশি সৌর—কলঙ্কের কারণেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ ওজোন ধ্বংসকারী নাইট্রোজেন রেডিক্যাল সৃষ্টি হয় বলে ধারণা করা হয়।
জীব জগতে ওজোনস্তরের প্রভাব স্ট্রাটোস্ফিয়ারের তাপ কাঠামো সংরক্ষণে ওজোনস্তরের ভুমিকা অপরিসীম।সূর্য হতে আগত অতিবেগুনীরশ্মির (টষঃৎধারড়ষবঃ ৎধু) শতকরা ৯৯ ভাগই ওজোনস্তর শোষণ করে রাখে। বাকি মাত্র ১ ভাগ এসে পৌঁছে ধরাপৃষ্ঠে। এ রশ্মি মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। অথচ তা মানুষ ও উদ্ভিদসহ সকল প্রাণীকূলের জন্যই চরম ক্ষতিকর। ওজোনস্তর সুর্যের এই ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মিকে ছাকনীর মতো শুষে নিয়ে পরিচ্ছন্ন সর্যের আলো পৃথিবীকে উপহার দিেু চ্ছ। অতি বেগুনি রশ্মি শুষে নেয়ার কারণে এ স্তরের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি(প্রায় ১৭০ ফাঃ)। আর এর বিনিময়েই ধরা—পৃষ্ঠ রক্ষা পাচ্ছে অতি উত্তাপের কবল থেকে।
ওজোন নামের গ্যাসের এ বলয় ডিমের খোসার মতো লক্ষ কোটি বছর ধরে রক্ষা করে আসছে পৃথিবীর জীবকুলকে। ওজোনস্তরের ক্ষয় বা এর ঘনত্ব হালকা হওয়া জনিত কারণে স্ট্রাটোস্ফিয়ার ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যে তাপের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে ষ্ট্রাটোস্ফিয়ার এখন যে তাপমাত্রা ধারণ করে আছে ওজোনস্তরের অভাবে তা সরাসরি ট্রপোস্ফিয়ার বা ভূ—পৃষ্ঠে এসে সেখানকার তাপের মাত্রা বাড়িয়ে তুলবে।
ওজোনস্তর বিনষ্ট হলে সূর্য থেকে আগত মহাজাগতিক অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রাণী ও উদ্ভিদ কুলের জন্য মারাত্বক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। এতে প্রাণীদেহে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির সৃষ্টি হবে। অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে মানুষের গায়ের চামড়ার পীতাভ রং ধারণ, চামড়ায় ভাজ পড়া, চোখে ছানি পড়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি হবে। বাড়বে হার্পিস ও হেপাটাইটিস রোগের প্রভাব।
তাছাড়া এর প্রভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও লোপ পাবে বহুলাংশে। অতি বেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এলে মানুষের চামড়ায় স্কুয়ামাস ও ম্যালানোমা নামে দু’ধরনের ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। আমেরিকার পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির (ঊচঅ) তথ্যানুসান্ধনীদের মতে ১% ওজোন স্তরের ক্ষয় ত্বকে ৫% বেশি স্কুয়ামাস ক্যান্সার এবং ২% অধিক ম্যালানোমা ক্যান্সার সৃষ্টি করবে। ম্যালানোমা ক্যান্সার একটি জটিল রোগ, যা থেকে আরোগ্য লাভ করা প্রায় অসম্ভব।
তথ্যে আরও প্রকাশ কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে শ্বেতাঙ্গরাই এর দ্বারা বেশি আক্রান্ত হবে। জনবহুল এলাকায় ওজোনস্তর ক্ষয়—প্রাপ্ত হলে তার পরিণতি হবে আরও ভয়ঙ্কর। ওজোনস্তর ক্ষয়ের আরেকটি ক্ষতিকর দিক আছে। তা হচেছ ওজোনস্তর ট্রপোস্ফিয়ারের উপরে একটি ছাতার মতো থেকে পৃথিবীকে অতি বেগুনি হাত থেকে রক্ষা করছে। কোন কারণে এটি হালকা বা কোথাও কোন ছিদ্র হলে সুর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ভূ—পৃষ্ঠে পৌঁছে বায়ুমন্ডলের নিম্নস্তরের সমস্ত অক্সিজেনকে ওজোন গ্যাসে পরিণত করতে পারে। এতে করে বিষাক্ত ওজোন গ্যাসের আধিক্যে জীবজগত মারাত্বক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
কৃষিতে প্রভাব
ওজোন¯ র ক্ষয়জনিত কারণে পৃথিবীর জলবায়ু ও কৃষির উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। অতীতে ওজোনকে উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক নিয়ামক হিসাবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে এটি আসলে পরিবেশ ও উদ্ভিদের জন্য মারাÍক ক্ষতিকর। ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত কারণে অতিবেগুরি রশ্মির প্রভাবে উদ্ভিদ কোষ বিকৃত হওয়া, ধান, সোয়াবিন, বাঁধাকপি, স্কোয়াশ ইত্যাদি বহু ফসলের সালোকসংশ্লেষণ মাত্রা হ্রাস পাবার ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। পর্যাপ্ত পানি পাওয়া সত্বেও লতাগুল্ম ও চারা গাছে প্রাণের উদ্বেলতা থাকবে না। মাছের উৎপাদন, মাছের প্রজননসহ সকল ধরনের সামুদ্রিক প্রাণীও এ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ওজোনস্ত র ক্ষয় রোধে করণীয় বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে ওজোন ধ্বংসকারী প্রধান গ্যাস ঈঋঈং উৎপাদিত হলেও এর ব্যাপক ব্যবহার সর্বত্র। তাই ওজোনস্তরের ক্ষয়রোধে উন্নত বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু ঈঋঈং দীর্ঘ কাল বায়ুমন্ডলে অক্ষত অবস্থায় অবস্থান করে ওজোনস্তর কে ধ্বংস করে, সেহেতু এখনই এর উৎপাদন বন্ধ করা উচিত। কিন্তু বাণিজ্যিক কারণেই এ মুহুর্তে তা সম্ভব নয়। তাই বায়ুমন্ডলে যত কম ঈঋঈং নির্গত হয় সে দিকে সকলকেই সজাগ থাকতে হবে। ফ্রিজ, এয়ারকুলার, ইত্যাদি যন্ত্রপাতি (যেখানে ঈঋঈং ব্যবহৃত হয়) মেরামত/রিচার্জিং এর সময় ঈঋঈং যেন নির্গত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সম্ভব হলে পূনঃ ব্যবহারের প্রচেষ্টা নিতে হবে। এছাড়া এসব ঈঋঈং উৎপাদনকারী দ্রব্যাদির বিকল্প তৈরি করতে হবে।
কৃষি, কৃষি শিক্ষা, কৃষি প্রশিক্ষণ, কৃষি শিল্প, কৃষি গবেষণা