কৃষি অর্থনীতি

অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল বিষয় হলো মানুষের অসংখ্য চাহিদা লক্ষ্যের পরিপূরণ, যা তারা বিভিন্ন সম্পদ বা উপকরণের মাধ্যমে করে সর্বোচ্চ তৃপ্তি লাভের চেষ্টা করে। এই বিজ্ঞানসম্মত আলোচনাই অর্থনীতির মূল বিষয়বস্তু। কৃষি অর্থনীতি হচ্ছে কৃষি অর্থনীতির সমন্বিত একটি শাখা, যা কৃষি শিক্ষার অংশ হিসেবে পরিচিত এবং কৃষির উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ বন্টনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।

 

কৃষি অর্থনীতি

(কৃষি শিক্ষা ২য় পত্র, ইউনিট ১৭, পাঠ ১৭.১)

 

 

কৃষি অর্থনীতির সংজ্ঞা

অর্থনীতির সেই শাখাটিকে কৃষি অর্থনীতি বলা হয়, যেখানে কৃষির যাবতীয় কর্মকান্ড যেমন কৃষিপণ্যের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, লাভ-লোকসান ও ভোক্তাদের মাধ্যমে পণ্যের বিতরণ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ আলোচনা করা হয়। অধ্যাপক এল. সি. গ্রে-এর মতে, কৃষি অর্থনীতি হলো এমন একটি বিজ্ঞান যা কৃষি শিল্পের বিশেষ পরিস্থিতিতে অর্থনীতির নীতি ও পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে। অপরদিকে, প্রফেসর হাবার্ড কৃষি অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেন কৃষিতে নিয়োজিত মানুষের সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের বিভিন্ন কার্যকলাপের আলোচনার মাধ্যমে।

 

কৃষি অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়সমূহ

১. কৃষিপণ্য উৎপাদন
২. কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ
৩. কৃষিপণ্য বিপণন
৪. কৃষি মূলধন
৫. কৃষিতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা
৬. কৃষিখাতে সরকারি নীতিমালা

কৃষি অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো কৃষি সম্পর্কিত অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সনাক্তকরণ, সমাধান, নির্দেশনা প্রদান ও বিস্তারিত বর্ণনা।

 

কৃষি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য

  • কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রমের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, যেমন: কৃষিপণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বন্টন, গুদামজাতকরণ, বাজারজাতকরণ এবং ভোগ।
  • বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রায় ২০% কৃষি থেকে আসে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
  • কৃষি অর্থনীতি একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

 

জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান:

একসময় কৃষি বলতে শুধুমাত্র জমি চাষ করে ফসল উৎপাদনকেই বোঝানো হতো। কিন্তু আধুনিক কৃষি ধারণাটি অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক অর্থ বহন করে। বর্তমানে কৃষির অন্তর্ভুক্তি শুধু শস্য উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ না থেকে এর উপখাতগুলো যেমন মৎস্য চাষ, গবাদি পশুপালন, হাঁস-মুরগী পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ, রেশম চাষ, মৌমাছি পালন ও মধু উৎপাদন, সবজি ও ফুলের চাষ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফলে কৃষি শুধু একটি প্রথাগত কৃষি কার্যক্রম নয়, এটি এখন একটি গতিশীল অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে এবং তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি জাতীয় অর্থনীতিতে বহুমুখী অবদান রাখে, যা নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—

অবদান বিস্তারিত
১. খাদ্যের যোগান কৃষি দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্যের প্রধান উৎস, যেমন চাল, গম, মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম সরবরাহ করে। এটি শুধু খাদ্য যোগান দেয়াই নয়, পুষ্টি নিরাপত্তা ও কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করে।
২. কাঁচামালের সরবরাহ পাট, তুলা, চামড়া, কাঠ, রেশম ইত্যাদি শিল্পের জন্য কৃষি থেকে কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়, যা শিল্পায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত।
৩. কর্মসংস্থান সৃষ্টি কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান কৃষি কর্মসংস্থানের বৃহৎ উৎস। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষির সাথে যুক্ত।
৪. বিনিয়োগের উৎস কৃষি থেকে অর্জিত আয় ভূমি, রাজস্ব ও করসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে ব্যবহৃত হয়, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
৫. বাজার সম্প্রসারণ কৃষিকর্মে নিয়োজিত লোকজন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে, যেমন পোশাক, আসবাবপত্র, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি, যা অর্থনীতির অন্য খাতকে সমৃদ্ধ করে।
৬. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন পাট, চা, তুলা, চিংড়ি মাছসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনা হয়।
৭. জাতীয় আয় বৃদ্ধি কৃষি খাত দেশের জাতীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রদান করে এবং কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এর অবদান আরও বাড়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু জনজীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করে না, পাশাপাশি দেশের শিল্পায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। কৃষির সঠিক উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন দেশের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার ক্ষেত্রে অন্যতম মূল চালিকা শক্তি। তাই কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারাকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব।

 

 

 

কৃষি অর্থনীতির পাঠের প্রয়োজনীয়তা:

কৃষি অর্থনীতি শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো অর্থনীতির তত্ত্ব ও পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ ও সমাধান করা। কৃষি অর্থনীতি অধ্যয়ন করার মাধ্যমে কৃষিজ উৎপাদনের লাভ-ক্ষতি, খামার ব্যবস্থাপনা, মূল্য নির্ধারণ ও বিপণন, কৃষি ঋণ ও ভর্তুকি, বন্টন প্রক্রিয়া, কৃষি সমবায় ও সংগঠন সম্পর্কিত ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করা যায়।

এতে কেবল কৃষিক্ষেত্রের সমস্যা চিহ্নিত ও বিশ্লেষণই হয় না, বরং কৃষি উৎপাদন ও আয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যকর ও যথোপযুক্ত নীতি ও কর্মপদ্ধতির নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ফলে কৃষি অর্থনীতি শিক্ষার মাধ্যমে কৃষি খাতের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নের জন্য বাস্তবমুখী সমাধান তৈরিতে সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয়।

সংক্ষেপে, কৃষি অর্থনীতি পাঠ কৃষক, নীতি নির্ধারক ও গবেষকদের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি কৃষিক্ষেত্রের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সুসংগঠিত ও দক্ষ করে তোলার পথপ্রদর্শক।

By একাডেমিক ডেস্ক, কৃষি গুরুকুল

কৃষি গুরুকুলের একাডেমিক ডেস্ক

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Exit mobile version